সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁 #পর্বঃ৩০ #লেখনীতে_suraiya_rafa

0
357

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ৩০
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[ক’পি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[প্রাপ্তমনস্কও মুক্তমনাদের জন্য]

পাহাড়ের নিরিবিলি পরিবেশ আর নিরিবিলি নেই। সকাল সকালই শান্ত,প্রানজুড়ানো,নিরিবিলি পরিবেশ ধারণ করেছে বিধ্বং’সীরূপ।প্রচন্ত বাতাসের তান্ডব আর বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গিয়েছে চারিপাশ, সেই সাথে গাছপালা ভে’ঙে পরার মরমর আওয়াজ তো আছেই। তবে নির্জন পাহাড়ি এলাকা ছাড়িয়ে গাড়ি করে শহরের দিকে এগিয়ে আসতেই বাতাস, বর্ষন দুটোই উধাও, যদিও পাহাড়ী ঝড়ের তান্ডবে চারিদিকের পরিবেশ গুমোট হয়ে আছে, সেই সাথে ভ্যাপসা গরমটাও বেড়েছে আজ। অতিরিক্ত ভ্যাপসা গরমে অরু হাসফাস করছে দেখে অর্ণব সহসা বাটন প্রেস করে গাড়ির টিন্ডেট জানালার কাঁচটা নামিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে নিদারুন মেঘ ভেজা বাতাস এসে আঁচড়ে পরলো অরুর চোখেমুখে।এবার সত্যিই একটু শান্তি লাগছে। ঠান্ডা বাতাসে একটা বড়সড় নিঃশ্বাস ছেড়ে অর্ণবকে উদ্দেশ্য করে অরু বলে,
—- ধন্যবাদ।

অর্ণব অরুর কথায় নিঃশব্দে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে,অরু পুনরায় শুধালো,
— উনি এখন কেমন আছেন?

অর্ণব স্টিয়ারিংএ দক্ষ হাত চালাতে চালাতে বললো,
— জ্ঞান ফেরেনি এখনো, জ্ঞান ফিরলে সুস্থ হয়ে যাবে, ইটস নট আ বিগ ডিল, দুশ্চিন্তা করোনা।

অর্ণবের কথায় অরু আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড়িয়ে বললো,
— নিজের প্রতি এতো কেয়ারলেস কেন উনি?

অরুর আনমনে বলা কথাটা বোধহয় অর্ণব শুনেছে, তাই ও সামনে তাকিয়েই বললো,
— নিজের প্রতি কেয়ারলেস হতে পারে, তোমার প্রতি নয়।

অর্ণবের কথায় অরু সচকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ওর পানে, পরবর্তীতে কথার পাছে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অর্ণব বললো,
— এসে গিয়েছি।

চলে আসার দরুন,অরুর আর কথা বাড়ানো হলোনা,তাই চুপচাপ নেমে গেলো গাড়ি থেকে। গাড়ি থেকে নেমে অর্ণব কে বিদায় জানিয়ে অপটু পায়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো ভবনের লিফটের দুয়ারে।

শরীরে প্রচন্ড জ্বর আর মাথাব্যাথা। হাত পা গুলো শক্তিহীন অসার হয়ে আছে। সুন্দর লম্বা চুলগুলো জটলা পাকিয়ে কোনোমতে পিঠে পরে আছে, সুন্দর মাখনের মতো মসৃন মুখটা ফ্যাকাশে বর্ণ ধারন করেছে , চোখদুটো ঢুকে আছে কোটরে।শরীরের এহেন অবস্থা নিয়েই লিফট থেকে বেরিয়ে, এগিয়ে এসে এ্যাপার্টমেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে কলিংবেল চাপলো অরু।

তবে কলিংবেল চাপার সঙ্গে সঙ্গেই সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা আর তার পেছন পেছন আজমেরী শেখের নতুন এসিস্ট্যান্ট রাজ। হুট করেই নিজের বাসা থেকে অপরিচিত কাউকে বেরোতে দেখে অরু খানিকটা অপ্রস্তত হয়ে পরলো, কারন ওর মাথা থেকে পা অবধি সবকিছু এলোমেলো আর অগোছালো । হুট করে কেউ প্রথম দেখে পাগল বলে সম্মোধন করলেও ভুল কিছু হবেনা বৈকি। কিন্তু অরুকে একটা বিশাল ঝটকা দিয়ে, ওর অযাচিত চিন্তায় একবালতি জল ঢেলে মহিলাটি অরুর চিবুকে আদুরে হাত ছুয়িয়ে বললো,
— মাস আল্লাহ।

বয়স্ক মহিলার এহেন কথায় চোয়ালঝুলে পরলো অরুর। মনেমনে ভাবলো,
— আমি কি ঠিক শুনলাম? নাকি জ্বরের ঘোরে আসতাগফিরুল্লাহ কে মাসআল্লাহ শুনলাম?

অরু যখন বাইরে দাড়িয়ে একমনে হিজিবিজি ভাবছিল, তখনই মহিলা দ্বিতীয়বার মুখ খুললেন, নিজে নিজেই আগ বাড়িয়ে বললেন,
— আসি তাহলে মা? আগামী রোববার দেখা হবে।

মহিলার কথার আগামাথা বুঝতে না পেরে অগত্যাই জোরপূর্বক হেসে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো অরু। অরুর সম্মতি পেয়ে মহিলাটি চলে গেলে পেছন থেকে রাজ এসে হিসিয়ে উঠে বললো,
— একি অবস্থা তোমার? একটু পরিপাটি হয়ে চলা যায়না?

এমনিতেই অরুর মানসিক অবস্থা বিদ্ধ’স্ত, তারউপর রাজের এমন অধিকার দেখিয়ে কথা বলা, ব্যাপারটা মোটেই সহ্য হলোনা অরুর, মাথার মধ্যে অযাচিত রাগটা হুট করেই কুন্ডলী পাকিয়ে উঠলো কেন যেন। মূহুর্তেই মেজাজ হারালো অরু, রাজের দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচে বললো,
— আমি কিভাবে চলবো না চলবো সেটাও আপনি আমাকে শিখিয়ে দেবেন? কে হই আপনার? দেখুন রাজ, অযথা গায়ে পরা স্বভাব আমার একদম পছন্দ নয়। ছেলেমানুষের এতো গদোগদো ভাব মানায় না, এটলিস্ট আমার চোখে তো বি’চ্ছিরি লাগে।

অরুর কাঠকাঠ কথাগুলো বোধ হয় রাজের গা থেকে পিছলে চলে গেলো, ও অরুর দিকে তাকিয়ে মারাত্মক হেঁসে বললো,
— কেমন ছেলে পছন্দ তোমার? আমিকি হতে পারিনা তেমনটা?

— না পারেন না, তার নখের যোগ্যতাও আপনার নেই,এটলিস্ট পুরুষ মানুষ হিসেবে তো নেই।

অরুর ছু’রির ফলার মতো ধা’রালো কথা শেষ হলে রাজ পুনরায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই ভেতর থেকে ছুটে আসে অনু। এগিয়ে আসতে আসতে উদ্বিগ্ন সুরে বলে,
— কি ব্যাপার কার সাথে তর্ক করছিস বাইরে দাড়িয়ে? মা শুনতে পাচ্ছে তো।

অনু চলে আসাতে অরু ভেতরে যেতে যেতে রাজকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— রিডিকিউলাস।

রাগে ফোঁসফাস করতে করতে সদর দরজা ঠেলে অরু ভেতরের রুমে দু’কদম দিয়েছে কি দেয়নি তার আগেই গম্ভীর গলায় ডেকে উঠলেন আজমেরী শেখ।
— অরু দাঁড়াও।

অরু ভ’য়ে তটস্থ হয়ে আছে বহুক্ষণ আগে থেকেই। তবে এই মূহুর্তে মেজাজটাও বিগড়ে আছে ওর, তাই কোনোরূপ হাপিত্যেশ না করেই পেছনে ঘুরে মায়ের দিকে চাইলো ও। আজমেরী শেখ মোটা থানের ছাই রঙা শাড়ী আর কালো রঙের চুড়িহাতা ব্লাউজ পড়ে আছেন। চোখে তার মোটা ফ্রেমের চশমা। শাড়ীর প্রত্যেকটা ভাঁজ অত্যন্ত সুনিপুণ ভাবে সেট করা, দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো টিভিসেটের সংবাদ পাঠিকা।
অরুর চোখে অবশ্য এটা নতুন কিছু নয়, আজকাল মা প্রায়ই এভাবে পরিপাটি হয়ে অফিসে যান। নিজের মরচে পরা আধিপত্যতে একটু খানি ঝালাই করে দিতে।

সাইড ব্যাগটাকে শক্ত হাতে চেপে ধরে মাথা নিচু করে সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে অরু,আজমেরী শেখ ওর আগাগোড়া পরখ করে স্পষ্ট আওয়াজে শুধালেন,
— কোন ছেলের সাথে গিয়েছিলে?

মায়ের কথায় অরুর পিলে চমকে উঠলো,নিজের সুপ্ত ভ’য়টাকে দূরে সরিয়ে মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে গলায় আত্মবিশ্বাস নিয়ে অরু বললো,
— কি বলছো মা? ককোন ছেলের সাথে আবার যাবো? আমি কাউকে চিনি নাকি এখানে?

আজমেরী শেখ অরুর দিকে নিখুঁত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
— এক বছর অসুস্থ ছিলাম আমি,মা’রা যায়নি, তাতেই মিথ্যে কথা শিখে গেলে?

অরুর না সূচক মাথা নাড়িয়ে বলে ওঠে,
— মা বিশ্বাস করো…

আজমেরী শেখ ওকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললেন,
—- রাজ খোঁজ নিয়েছে, তোমাদের ক্লাস থেকে কোনো গ্রুপ ক্যাম্পিং এ যায়নি, তাহলে গত চব্বিশ কোথায় ছিলে তুমি?

এখানেও রাজ, বিরক্ত লাগছে অরুর তবুও মাথা নিচু করে গলা খাদে নামিয়ে অরু বললো,
— আসলে মা, আমি অন্য গ্রুপ…

— থাক।
আজমেরী শেখ এবারও সহসা থামিয়ে দিলেন অরুকে। অতঃপর বললেন,
— আমি আর মিথ্যে অজুহাত শুনতে চাইছি না অরু, আর না আমার এসব চেঁচামেচি কৈফিয়ত দেওয়া নেওয়া পছন্দ। আমি শুধু সময়ের কাজ সময়ে করতে পছন্দ করি।

মায়ের রহস্যেঘেরা কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না অরু। তবে ওর মা যে একশো তে একশো পাক্কা খিলাড়ী সেটা অরু ভালো করেই জানে। কখন কোন চালে আটকে ফেলবে সেটা অরুর কল্পনাতীতই থেকে যাবে। এবারও তাই হলো।আজমেরী শেখ হঠাৎ করে অরুর সামনেই অনুকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন,
— এখন এই মূহুর্তে অরুর পুরো ঘর তল্লাশি করে ওর কাছ থেকে সমস্ত ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস গুলো নিয়ে নাও। আর হ্যা আজ থেকে অরুর সাথে সর্বক্ষন থাকবে তুমি। আমি যদি ঘুনাক্ষরেও শুনেছি বোনের প্রতি দরদ দেখিয়ে আমাকে বোকা বানাচ্ছো তাহলে তোমার ব্যাবস্থাও আমি করবো। নাও সার্চ হার।

মায়ের কথায় অরু ফুপিয়ে কেঁদে উঠে অাহত সুরে বললো,
— মা, কি বলছো?

অনু একটু সাহস করে মাকে বললো,
— মা, মাত্রই তো এলো একটু ফ্রেস হয়ে নিক, তারপর না হয়…

আজমেরী শেখ থমথমে গলায় বললেন,
— ফ্রেস হওয়ার অনেক সময় রয়েছে, আগে ওকে সার্চ করো।

মায়ের কঠোর আদেশ, অনুর আর কিছু করার ছিলোনা অগত্যাই অরুর ব্যাগ হাতরে আইফোন ফিফটিন প্রো-ম্যাক্স মোবাইলটা নিয়ে নিলো অনু। যদিও মোবাইলটা বন্ধ ছিল। তবুও অনুরও এবার ভেতরে ভেতরে সন্দেহের দানা প্রখর হয়, মনেমনে ভাবে,
— হুট করে এতো দামি ফোন কোথায় পেলো অরু? তাহলে কি মা’ই ঠিক? অরু খারাপ কোনো পথে পা বাড়িয়েছে?

ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে গেলে অরু ব্যাগটাকে ফ্লোরেই ছু’ড়ে মে’রে হনহনিয়ে রুমে চলে যায়।অরু চড়ম কষ্ট পেয়েছে ভেবে, অনু মায়ের দিকে তাকিয়ে অসহায় মুখ করে বললো,
— মা অরুতো ছোট ভুল করতেই পারে, তাই বলে এতোটা কঠোর হওয়া কি ঠিক হবে?

অনুর কথায় আজমেরী শেখ বললেন,
—আপাতত যেটা বলেছি সেটা করো। সময় হলে সব কিছু আমি নিজেই আবার আগের মতো করে দেবো। কিন্তু এখন নয়।

*****************************************
সারাদিন রুম আটকে ম’রার মতো পরে থাকলেও সন্ধ্যা হতে না হতেই অরুর একা থাকার শখ ঘুচিয়ে দিয়ে রুমে প্রবেশ করে অনু। অনুর অবশ্য কিছু করার নেই মায়ের আদেশ আসতেই হতো। অনু আসতেই অরু মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে পরলো। অনুর হাতে খাবারের থালা। ও সেটাকে বেডসাইড টেবিলে রেখে দিয়ে নরম গলায় বললো ,
— অরু খাবার এনেছি, খাবি আয়।

অরু নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব দিল,
— খিদে নেই, নিয়ে যা।

— সারাদিন না খেয়ে, রুম আটকে পরে আছিস, তাও খিদে নেই? কি হয়েছে বলতো তোর?

অনুর কথায় অরু শক্ত গলায় বললো,
— না নেই, আর কি হয়েছে, কি হয়েছে, এই প্রশ্নটা করা বন্ধ কর আপা। কি হবে আমার?

অনুও এবার ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,
— কিছু না হলে, মিথ্যে বলে কোথায় গিয়েছিলি? আর অতো দামি ফোনই বা কোথায় পেলি?

অরু এবার শোয়া থেকে উঠে , অনুর মুখোমুখি হয়ে বসে কন্ঠে দৃঢ়তা নিয়ে বললো,
— তোর কি মনে হয় আমি খারাপ মেয়ে?

অরুর কথার পাছে অনু বললো,
— এখন আর মনে হওয়া না হওয়া দিয়ে কি যায় আসে? যা করার তাতো মা করে ফেলেছে।

অনুর একটু কথার আঁচে অরুর হৃদয় কামড়ে উঠলো, ওর পরনে এখনো ক্রীতিকের কিনে দেওয়া সিল্কের পাজামা সেট। মাথার চুলগুলো এলোমেলো ভাবে পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আটকানো, বুকের মধ্যে অজানা আত’ঙ্কের দল হাতুড়ি পেটা করছে খুব, তবুও একটা শুষ্ক ঢোক গিলে বুকের মাঝে সাহস সঞ্চয় করে অরু শুধালো,
— কি করেছে মা?

অনু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানায়,
— আগামী রোববার রাজ তার পরিবার সমেত তোকে দেখতে আসছে। আজকেই তো ওর মা এসে আমাদের মায়ের সাথে কথা বলে গেলো।

অনুর কথায় অরুর মাথায় যেন আকাশ ভে’ঙে পরলো। দুনিয়া দুলে ওঠার মতোই আচমকা ঘুরে উঠলো মাথাটা। অরু ভেবেছিল মা ওর জন্য কোনো কঠিন শা’স্তির ব্যাবস্থা করেছে, হয়তোবা ভার্সিটিতে যেতে দেবে না, কিংবা নজরবন্দি করে রাখবে সারাক্ষণ , তাই বলে এমন কিছু? অরুর কল্পনার ও বাইরে ছিল এটা। অরু তৎক্ষনাৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পরলো। অবিশ্বাসের সুরে অনুকে শুধালো,
— কি বলছিস আপা এটা? তুই থাকতে আমি কেন?

অরুর কথায় অনুর মেজাজ চড়ে এলো, ও রুষ্ট কন্ঠে বললো,
— আমি থাকতে মানে? তুই প্রত্যয় সাহেবের কথা জানিস না? তাছাড়া রাজ তোকে পছন্দ করেছে আমাকে নয়।

অনুর কথায় একটা অসহ্য য’ন্ত্রনা ছড়িয়ে পরলো অরুর শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অকস্মাৎ ফ্লোরে ধপ করে বসে হুহু করে কান্নায় ভেঙে পরলো অরু, শরীরে ব্যাথা, হৃদয়ে ব্যাথা, মস্তিষ্কে ও একরাশ য’ন্ত্রনা, সবকিছু মিলমিশে অরুর এক করুন অবস্থা এই মূহুর্তে । মেঝেতে বসে কাঁদতে কাঁদতে মনে মনে হাজারবার আহাজারি করতে করতে অরু বললো,
— তোকে আমি কি করে বোঝাই আপা, তোর যেমন প্রত্যয় সাহেব আছে, আমারও তো একজন আছে, সে আমার স্বামী, জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী। আমি বিবাহিত, আমার শরীর মন সবকিছুর দখলদারী শুধু মাত্র তার। আমি তাকে মেনে নিয়েছি। তার ভালোবাসাকে গ্রহন করেছি। তাহলে কিভাবে আমি অন্য একজন পুরুষের সামনে গিয়ে আইবুড়ো সেজে বসবো? কি করে?
এই কথার একটু খানি আঁচ ও জায়ান ক্রীতিকের কানে গেলে সবকিছু তচনচ করে ফেলবে সে। সেই সাথে আমাকেও কে’টে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। আমি এখন কি করবো? কিভাবে সবাইকে বলবো যে আমি আমার সৎ ভাই জায়ান ক্রীতিকের বিয়ে করা বউ?

অরু সেই কখন থেকে মেঝেতে বসে শব্দ করে কাঁদছে দেখে অনু আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— এতো কাঁদছিস কেন অরু? দেখতেই তো আসছে, বিয়ে তো আর হয়ে যাচ্ছে না? ভালোয় ভালোয় সবটা মিটে গেলে তুইও তো বেঁচে যাবি। মা আর তোকে সারাক্ষণ নজরদারিতে রাখবে না।

কথাটা শেষ করে কম্ফোর্টার গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পরলো অনু। অনুর মাত্র বলা কথাগুলো বারবার মস্তিষ্কে বারি খাচ্ছে অরুর।
—দেখতেই তো আসছে, বিয়েতো আর হচ্ছে না।

“বিয়ে”শব্দটা অসংখ্যবার প্রতিধ্বনিত হয়ে কানে এসে লাগছে অরুর,ওর তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে সেবার থাইল্যান্ড বসেই। ধর্মীয়, সামাজিক দুইভাবেই বিয়ে হয়েছে জায়ান ক্রীতিকের সঙ্গে। তাহলে এখন আর নতুন করে কিভাবে বিয়ে হবে? আর তাছাড়া চোখ দুটো বন্ধ করলে স্বামী রুপে ওই সুদর্শন মানবের মুখটা ছাড়া আর কিছুই তো কল্পনায় আসছে না।

মনেমনে হাজার কথা ভাবতে ভাবতেই অরু চলে গেলো টানা বারান্দায়। বাইরে ভারী বর্ষন হচ্ছে। আকাশ বাতাস ছাপিয়ে মেঘ গলিয়ে বৃষ্টি নেমেছে ধরনীতে। বাতাসের তোপে বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে অরুর চোখে মুখে, তবুও সেখানেই হাঁটু মুড়ে বসে পরলো ও।

উদাসীন বারীধারার পানে চেয়ে ভাবতে লাগলো নিজের থেকে বয়সে গুনগুনে বারো বছরের বড় সুদর্শন পুরুষটির কথা, যে ওর ব্যক্তিগত পুরুষ। কোনোদিন কি অরু কল্পনা করেছিল ওর সাথে এমনটা হবে? আমেরিকাতে কেউ ওর জন্য এভাবে দিনের পর দিন অপেক্ষার প্রহর গুনবে? এরকম হুট করেই নিজের নামের পাশে মানুষটার টাইটেল এঁটে যাবে? ভাবেনিতো, কল্পনাতেও ভাবেনি। কিন্তু ভবিতব্য এটাই ছিল।
অরু মেনে নিয়েছে নিজের ডেসটিনি। অবশ্য না মেনে কোথায় যাবে? কি নেই জায়ান ক্রীতিকের? সবচাইতে যেটা বেশি আছে, সেটা অরুর প্রতি এক আকাশসম আসক্তি। মানুষটার পাগলামি, আসক্তি, রাগ, বিরক্তি, একান্ত গোপনীয় চাহিদা সবকিছু অরুকে ঘীরেই। তাহলে অরু কীভাবে ক্রীতিকের মায়ায় না পরে থাকতো? অরুর কাছে ক্রীতিকের মায়ায় জড়ানোর প্রথম ধাপ ছিল ওদের বিয়ে।

হয়তোবা বিয়ের পরে উপরওয়ালা প্রদত্ত একধরনের টান তৈরি হয়ে যায় হৃদয়ে, অরুর বারবার মনে হতে থাকে,একটা মাত্রাতিরিক্ত সুদর্শন পুরুষ, আধুনিক ভাষায় বলতে গেলে হ্যান্ডসাম। লম্বা, চওড়া, গৌড় বর্ণের কথায় কথায় ভ্রু কুঁচকানো লোকটা ওর স্বামী। এই কথাটা দিনের আলোর মতোই সত্যি। অরুর স্পষ্ট মনে আছে বিয়ের পরে সবার জোরাজোরি তে স্বামী রুপি ক্রীতিকের দু-হাতে চুমু খাওয়ার কথা। তখন তো অরুও হৃদ মাঝারে ভীষণ টান অনুভব করেছিল।

বিয়ের কথা মাথায় আসতেই অরু চলে গেলো সেদিনের ভাবনায়,যেদিন নিজের সবটুকু ক্রীতিকের নামে লিখে দিয়ে এসেছিল ও। জায়ান ক্রীতিক ওয়েডস অরু। ভাবতে ভাবতেই এক চিলতে হাসি ফোটে অরুর ঠোঁটে।

আজকের মতো সেদিন বৃষ্টি ছিলোনা, এশিয়ান দেশ হওয়াতে আমেরিকার মতো কনকনে শীতও ছিল না ব্যাংকক শহরে । তবে আবহাওয়াটা বেশ গুমোট ছিল।অনুর সাথে রাগ করে অরুর করা চড়ম বোকামির ফলসরূপ ওর উপর বেজায় চটেছিল ক্রীতিক। চোখেমুখে সে কি রাগ তার।যে রাগের কাছে প্রত্যেকবারই হার মেনে যায় অরু। সেবারও মেনেছিল।
সকাল বেলা ওকে আটকে রাখলেও বিকালে এসে কোনোরূপ কথাবার্তা না বলেই টা’নতে টান’তে অরুকে নিয়ে বাইকে বসায় ক্রীতিক। ওদের পেছনে মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে ছিল এলিসা, অর্ণব আর সায়রও। অরু কিছু বুঝে উঠতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে এলিসাকে বললো,
— কি ব্যাপার আপু, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন উনি আমায়?

এলিসা অরুকে আস্বস্ত করে ওর কানের পেছনে চুল গুঁজে দিতে দিতে বলে,
— ইটস ওকে, আমরাও আসছি, ভয় পেওনা, ও তোমাকে কিচ্ছু বলবে না।

এলিসার কথার পাছে অরু আর কিছু বলার সুযোগ পেলোনা, তার আগেই বাইকে টান দেয় ক্রীতিক। অগত্যাই নিজেকে সামলানোর জন্য ক্রীতিকের জ্যাকেট টেনে ধরলো অরু।
ক্রীতিক সামনে ফোকাস করেই অরুকে ডেকে বললো,
— অরু, তুই কি জানিস আজ তোর মায়ের অপা’রেশন?

অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক পুনরায় বললো,
— তুই কি এটা জানিস আমি ডক্টরকে বলে তোর মায়ের সব ট্রিটমেন্ট বন্ধ করে রেখেছি।
আমি না বলার আগ পর্যন্ত ওরা তোর মায়ের অ’পারেশনে হাত ও ছোঁয়াবে না।

ক্রীতিকের কথায় অরুর মুখ থেকে যেন র’ক্ত সরে গেলো। ও বাইকে বসেই স্তম্ভিত গলায় বললো,
— আপনি কি মজা করছেন?

— তোর কি মনে হয় আমি মজা করার মুডে আছি?

অরু নাক ফুলিয়ে বললো,
— তাহলে এসব কথা কেন বলছেন?

ক্রীতিক একটা পুরাতন গলির মাথায় বাইক থামিয়ে অরুর হাত ধরে বললো,
— বলছি চল।

অরু চারিদিকে তাকালো, দুপাশে পুরাতন ইটের চালার ঘর,তার মাঝ দিয়ে সরু রাস্তা, ঘর গুলোর মধ্যে বেশির ভাগই থাইল্যান্ডের স্থানীয় মানুষজনের পুরাতন দোকানপাট, ছোটখাটো স্ট্রীট মার্কেট,হকারী আর ঐতিহ্যবাহী কাপড়ের দোকান দিয়ে ভর্তি গলিটা। সরু রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে অরু খেয়াল করলো আশেপাশের সবাই ওদের দিকে অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে আছে। যেমনটা আমরা ভিনদেশীদের দেখলে করি। অরু বড়বড় চোখ করে এদিক ওদিক দৃষ্টিপাত করলেও ক্রীতিক সোজা হাটছে। হাটছে তো হাটছেই। ক্রীতিকের পুরুষালী কদমের সাথে পা মিলিয়ে হাটতে হাটতে অরুর পা ব্যথা করছে এখন। গোড়ালি ভে’ঙে মাটিতেই বসে পরতে ইচ্ছে করছে, উপায়ন্তর না পেয়ে অরু শুধালো,
— আর কতদূর?

ক্রীতিক ক্রুর হেসে বললো,
— বাবাহ এতো তাড়া?

— কিসের তাড়া? আর আপনি একটু আগে কি বললেন? আমার মায়ের অপা’রেশন বন্ধ কেন করেছেন? কি সমস্যা বলুন?

ক্রীতিক যেতে যেতে বললো,
— সমস্যা তো তুই।

— মানে?

গলির শেষ প্রান্তে একটা পুরাতন মসজিদের সামনে দাড়িয়ে ক্রীতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— ভেতরে গিয়ে যা করতে বলবো,যেভাবে করতে বলবো, তাই করবি,নয়তো তোর মায়ের অ’পারেশন আর হচ্ছে না।

অরু তৎক্ষনাৎ ক্রীতিকের থেকে নিজের হাতটা ঝটকা মে’রে ছাড়িয়ে বললো,
— মশকরা পেয়েছেন? অপা’রেশন হবেনা মানে? আপনি বলবেন আর অপা’রেশন হবে না এতো সোজা?

ক্রীতিক কপট হেসে অরুর দিকে ঝু্ঁকে এসে বললো,
— ছোট্ট মানুষ মেমোরি লস হতেই পারে।কোনো সমস্যা নেই, আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি, মনে আছে আমার এপ্রোভালের জন্য তোর মা দীর্ঘ একবছর বাংলাদেশে পরেছিলো?

অরু এবার গলার স্বর কিছুটা খাদে নামিয়ে বললো,
— কি বলতে চাইছেন?

ক্রীতিক সামনে তাকিয়ে বললো,
— আজ, এই মূহুর্তে এখানে আমাদের বিয়ে হবে।

ক্রীতিকের কথায় অরুর মাথা ঘুরে উঠলো। কি বলে এই লোক? জীবনটা কি ছেলে খেলা?যাকে ইচ্ছে হলো তাকে ধরে আনলাম আর জিদ দেখিয়ে বিয়ে করে নিলাম। ক্রীতিকের উপর মেজাজ চড়াও হয়ে গিয়েছে অরুর, ও হিং’স্র বাঘিনীর মতো গর্জে উঠে বললো,
— আপনি একটা পা’গল, উন্মা’দ, সাইকো।
নয়তো নিজের সৎ বোনের জীবন নিয়ে এভাবে ছেলে খেলা করতে পারতেন না।

অরু কথাটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে এক থা’বায় ওর বুকের কাছের জামাটা খা’মচে ধরলো ক্রীতিক। ফিনফিনে জামাটায় একটান দিয়ে নিজের কাছে টেনে এনে অরুর দিকে চোখ রাঙিয়ে ক্রীতিক দাঁত খিঁচে হিসহিসিয়ে বললো,
— তুই আমার কেমন বোন? কোন হিসেবে বোন, উত্তর দে? তোর বাপ আর বাপ এক নয়, তোর মা আমার মা এক নয়, তাহলে নিজেকে আমার বোন দাবি করিস কোন সাহসে ?

শেষ কথাটা বলে অরুকে ধা’ক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় ক্রীতিক। ক্রীতিকের যুক্তির কাছে হেরে গিয়ে অরুও এবার চুপ হয়ে যায়। চোখ মুখে অসহায় ছাপ টেনে, গলার মাঝে কান্না আটকে রেখে টলমলে চোখে ক্রীতিককে বলে,
— তাই বলে আপনি আমাকে জো’র করে বিয়ে করবেন? সমাজ কি বলবে? দুনিয়া কি বলবে?
আপনার সাথে আমি সেটাও কি সম্ভব? কোন ভুলের রা’গ ঝাড়ছেন আমার উপর, বলুন তো?

ক্রীতিকের দৃষ্টিতে কোনো করুনার ছিটে ফোঁটাও নেই, ও এগিয়ে এসে পুনরায় অরুর হাত চেপে ধরে বললো,
— উপর ওয়ালা যার প্রাধান্য দিয়েছে সমাজ তাতে বাঁধা দেওয়ার অধিকার রাখেনা, আর না আমি এসবে পরোয়া করি।

অরু পুনরায় নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো,
— আমার জীবনটা এভাবে কেন নষ্ট করছেন? কি করেছি আমি?

ক্রীতিক অরুর দিকে তাকিয়ে হাস্কিস্বরে বললো,
— বিলিভ মি অরু, একটা সময় আসবে, যখন তুই এই সম্পর্কটার জন্য জীবন দিয়ে দিতেও রাজি থাকবি। তখন তুই নিজ মুখে বলবি সেদিন যা হয়েছিল খুব ভালো হয়েছিল। আমি এখন পরিপূর্ণ । আর সেই দিন বেশিদূরে নয়। এখন চুপচাপ ভেতরে চল।

অরু তেতে উঠে বললো,
— আমি যাবোনা, মা আপাকে না জানিয়ে এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে বিয়ে আমি জীবনেও করবো না।

— জায়ান ক্রীতিক লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু করেনা, আমার মন চেয়েছে আমি এখন এই মূহুর্তে তোকে বিয়ে করবো, মানে করবোই। যদি বেশি বাড়াবাড়ি করিস,তাহলে তোর মাকে আজই প্লেনে করে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেবো। ইভেন উইথ আউট এনি ট্রিটমেন্ট।

–নাহ!

ক্রীতিকের শেষ কথাতে অরু শব্দ করে না বলে ওঠে।

অরুকে কাঁদতে দেখে ক্রীতিক ওর হাত ধরে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বললো,
— মায়ের ভালো চাইলে ভেতরে চল। তুই শুধু তোর নামটা আমার নামে লিখে দিবি ব্যাস। বাকিটা জীবন তোকে সামলে নেওয়ার দায়িত্ব শুধু আমার।

অরু কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি টেনে বললো,
— আগে ডক্টর কে কল করে বলুন মায়ের ট্রিটমেন্ট শুরু করতে।

ক্রীতিক যেতে যেতে বললো,
— ফোন রিসোর্টে ফেলে এসেছি, বিয়েটা হয়ে যাক অর্ণবের ফোন থেকে কন্ট্রাক্ট করে বলে দেবো।

— ততক্ষণে যদি মায়ের কোনোক্ষতি হয়ে যায়?

ক্রীতিক এবার হাটার গতি থামিয়ে অরুর দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বললো,
— আমি বলেছি যখন পরে, তারমানে পরেই, আগে বিয়ে হবে, তারপর সব।

**************************************
পুরাতন ছোট্ট মসজিদটার ইটের চালা ক্ষয়ে যায়যায় অবস্থা। ধর্মভিত্তিক দেশ না হওয়াতে এদেশে হুজুর কিংবা মুসলিম খুজে পাওয়া বেশ কষ্ট সাধ্য। তবুও কোথা থেকে যেন অর্ণব আর সায়র মিলে একজন ইন্দোনেশিয়ান হুজুর খুজে এনেছে।
অরু আর ক্রীতিক ভেতরে ঢুকতেই অর্ণব ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,
— এতোক্ষণ লাগে তোদের? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি।

ক্রীতিক ভাবলেশহীন কন্ঠে বললো,
— বউকে রাজি করাতে দেরি হয়ে গেলো। তা তোর লইয়ার আর হুজুর কই?

ক্রীতিকের কথায় অর্ণব পাশে সরে গিয়ে বললো,
— এই যে আমেরিকান লইয়ার।যেহেতু তুই অরু দুজনই আমেরিকা থেকে বিলোং করিস তাই উনিই তোদের রেজিস্ট্রি ম্যারেজটা আমেরিকান কোর্টে তুলবে।

অর্ণবের বুদ্ধি দেখে সায়র এগিয়ে এসে বললো,
— ওরে শালা,এই ব্যাংকক বসে আমেরিকান লইয়ার কই পেলি তুই?

অর্ণব নিজের কাঁধ ঝাড়া দিয়ে একটু ভাব নিয়ে বললো,
— পেয়েছি, পেয়েছি, টাকা থাকলে বাঘের চোখও মেলে বন্ধু।

সায়র নাক সিকোয় তুলে বললো,
— তা এতোই যখন টাকা তাহলে একটা বাঙালি হুজুর ধরে আনতে পারলি না? এ কোন দেশী হুজুর নিয়ে এলি, কথা বুঝিনা কিছুনা। কবুল কোন ভাষায় বলবে ওরা?

অর্ণব দাঁত কিরমিরিয়ে বললো,
— আহাম্মক, বিয়ের সময় সব দেশেই কবুল বলে, তোর এতো চিন্তা করতে হবেনা হুজুর হলেই হলো, তাছাড়া এলিসা মোটামুটি ইন্দোনেশিয়ান ভাষা জানে।

সায়র হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে পাশে সরে গেলে ক্রীতিক বিরক্ত হয়ে বললো,
— তোদের গবেষণা শেষ হয়েছে? তাহলে এবার বিয়েটা করি?

সায়র ভ্রু কুঁচকে বললো,
— তোর দেখি তড় সইছে না জেকে। দাড়া এলিসা ফুলের মালাটা নিয়ে আসুক।

অর্ণব লইয়ারের সাথে কথা বলে কাগজ পত্র রেডি করে ক্রীতিককে ডেকে বলে,
— জেকে অরুকে নিয়ে আয় সাইন করবি।

ক্রীতিক এবার অরুর পাঁচ আঙুলের ভাঁজে আঙুল ঢুকিয়ে বললো,
— আয় আমার সাথে।

লইয়ারের সামনের চেয়ার দুটোতে পাশাপাশি বসে আছে অরু আর ক্রীতিক।
অরুর নিস্তব্ধ চোখের জলে রেজিষ্ট্রি পেপার ভিজে আঠা আঠা হয়ে গিয়েছে, তবুও কলম হাতে নিয়ে বসে আছে সে।
অরুর এহেন কান্ডে বিরক্ত হয়ে ক্রীতিক আস্তে করে অর্ণবকে বললো,
— অর্ণব প্রাইভেট জেট বুক কর। অরুর মা দেশে ফিরবে।

ক্রীতিকের কথার আগামাথা অর্ণবের বুঝে না এলেও অরু তৎক্ষনাৎ বললো,
— করছি করছি, সাইন করছি।

চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরা নোনাজল টুকু হাতের পিঠ দিয়ে মুছে, কাঁপা কাঁপা হাতে অস্পষ্ট অক্ষরে অরোরা শেখ নামটা লিখে দিলো অরু।
অরুর সিগনেচারের পর্ব শেষ হলে ক্রীতিক নিজেও গুটিগুটি অক্ষরে জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী নামটা লিখে দেয়। সিগনেচার করার সময় ক্রীতিকের মুখটা ছিল থমথমে আর গম্ভীর। দেখে মনে হচ্ছিল অরুকে নয়, বরং ওকেই অরু জোর করে ধরে বিয়ে করাচ্ছে। তবে ওর মনে চলছিল অন্য সুর,
—-কথা দিয়েছিলাম খুব বেশি না একটু খানি বড় হ, তোকে আমি আমার করে নেবো। আজ কথা রেখেছি, তুই আজ থেকে আমার অরু। পুরোটাই আমার।

রেজিষ্ট্রি পেপারে সাইন করা শেষ হলে এলিসা একটা তাজা ফুলের মালা অরুর হাত ধরিয়ে দিলো, অন্যটা ক্রীতিকের হাতে, তারপর মোবাইলের ভিডিও অন করতে করতে বললো,
— জেকে বউকে মালা পরা।

ক্রীতিক বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,
— এসবের দরকার নেই তো এলিসা।

— দরকার আছে তুই পরা।

এলিসার কথায় ক্রীতিক অরুর নত করে রাখা মাথার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
— মাথা তোল মালা পরাবো।

সায়র চোখমুখ কুঁচকে বললো,
— সিরিয়াসলি জেকে? তোর বউ হয়ে গিয়েছে মেয়েটা, এখনতো একটু সম্মান দে।

ক্রীতিক এবার সত্যি সত্যিই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— অরু মাথা তোলো মালা পরাবো।

“তোলো” শব্দটা বলতে গিয়ে ক্রীতিকের বোধহয় জিভ খসে পরার উপক্রম, ওকে দিয়ে এসব হয়না মোটেই। এবার এলিসাও পাশ থেকে তাড়া দিয়ে অরুকে বললো,
—অরু মাথা তোলো।

সবার জোরাজোরিতে অরু এবার মাথাটা তুলে ক্রীতিকের চোখের দিকে চাইলো। সেই ঝড় তোলা কামুক চাহনি, চোখ দেখে মনেই হচ্ছেনা এই লোকটা একটু আগে এতোবড় ভয়া’বহ কান্ড ঘটিয়েছে। অথচ সবার মধ্যে থেকে ফে’সে গিয়েছে অরু।
অরুর ভাবনার মাঝেই ওর গলায় মালা পরিয়ে দিলো ক্রীতিক। এবার অরুর পালা। কিন্তু অরুর মতো একরত্তি চুনোপুঁটির মতো মেয়ে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকা গ্রীকগড খ্যাত ক্রীতিকের লাগাম কি করেই বা পাবে? তাই সহসাই পা উচিয়ে আঙুলের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে মুখ কাচুমাচু অরু বললো,
— পারছিনাতো।

অরুর কথায় এলিসা মুখ টিপে হাসি সংবরণ করে বললো,
— জেকে কি সমস্যা? তোর বউ তো তোর নাগাল পাচ্ছে না।

ক্রীতিক কিছু না বলেই এবার মাথা নুইয়ে দিলো অরুর সামনে,তৎক্ষনাৎ ওকে মালা পরিয়ে দেয় অরু।
ঠিক সেই মূহুর্তটাই মুঠোফোনের ক্যামেরায় ব’ন্ধী করে নেয় এলিসা। এরপর ধর্মীয় মতে ওদের আরও একবার বিয়ে হয়।অরু আর ক্রীতিক দুজনই কবুল বলে বিয়েটা সম্পন্ন করে।

অরু কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। নাক, চোখ লালবর্ণ ধারণ করেছে। ওর পরনে ছিল লংস্কার্ট আর সুতির টপস। চেহারায় কৃত্তিম প্রসাধনীর লেশমাত্র নেই,তবুও বিয়ের মালা পরিহিত সদ্যবিবাহিতা অরুকে দেখতে অপরূপা লাগছে। চেহারাতে অন্যরকম লাবন্যতা এসেছে মেয়েটার। এটা বোধ নতুন নতুন বিয়ের পর সব মেয়েদেরই আসে, তাই অরুরও এসেছে।

বিয়ের পালা শেষ হলে ছোট্ট একটা নিয়মের মাঝে আটকে পরে ওরা। এটা ইন্দোনেশিয়ান সংস্কৃতি। বিয়ের পর স্বামী তার স্ত্রীর ঘোমটা খুলে মুখ দেখবে অতঃপর স্ত্রী তার স্বামীর দু-হাতে চুমু খেয়ে হাতদুটো চোখে ছুয়িয়ে সম্মান জানাবে। আর স্বামী স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে সেই আন্তরিকতা টুকু সাদরে গ্রহন করবে। দারুন ট্রেন্ড। হুজুরের মুখ থেকে কথাগুলো শুনে এলিসা, অর্ণব, সায়র একপ্রকার ঝুলে পরেছে ওদের দিয়ে এই ট্রেন্ড পালন করাবেই করাবে। সব নিয়ম পালন করা হয়েছে এটুকু কেন বাকি থাকবে?
ওদের জোরাজোরিতে ক্রীতিক বিরক্ত হয়ে বললো,
— অনেককিছু করেছি, আর পারবো না। এখন যা করার তোরা কর।

এলিসা ওর দিকে তাকিয়ে কটমটিয়ে বললো,
— পারবিনা মানে? মেয়েটাকে জোরজব’রদস্তি করে বিয়ে করেছিস, আর এখন বলছিস নিয়ম পালন করতে পারবি না? মগের মুল্লুক নাকি?

— ভাই কেন বুজছিস না,এটা বাঙালি নিয়ম না,কোথাগার ইন্দোনেশিয়ান নিয়ম। আমরা কেন পালন করতে যাবো?

এলিসা ক্রীতিকের কথায় ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললো,
—শোন জেকে, নিয়ম ইজ নিয়ম, অতো দেশটেশ বুঝিনা আমরা। সো চুপচাপ পালন করে ফেলো।

পাশ থেকে অর্ণব বললো,
— শুধু শুধু সময় নষ্ট করছিস জেকে, অরুতো এখন তোর বউই যা নিয়ম আছে সব করে ফেল। এলিসা হলেতো আমি নাচতে নাচতে ট্রেন্ড পালন করতাম। শুধুমাত্র নিজের দেশ কেন পুরো এশিয়ান সবগুলো কান্ট্রি থেকে নিয়ম ধার করে এনে এনে পালন করতাম।

এলিসা অর্ণবকে চোখ রাঙিয়ে বললো,
— থামবি তুই?

ক্রীতিক এবার ওদের সবাইকে একসাথে থামিয়ে দিয়ে বললো,
— আচ্ছা চুপ কর তোরা। করছি, যা যা নিয়ম আছে সব পালন করছি, তবুও চেঁচামেচি থামা।

*****************************************
ক্রীতিকের সম্মতি পেয়ে এলিসা এগিয়ে এসে অরুর পাতলা ফিনফিনে দোপাট্টা দিয়ে ওর মাথায় বড়সড় একটা ঘোমটা টেনে দিলো। এখন আর অরুর মুখ দেখা যাচ্ছেনা। ক্রীতিক কয়েক সেকেন্ড ঘোমটা টানা অরুর দিকে তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে দিলো ধীরে ধীরে অরুর ঘোমটা সরানোর উদ্দেশ্যে। ভেতরের উত্তেজনা, উৎফুল্লতায় এবার সত্যি সত্যি ওর হাত কাঁপছে। নিজেকে বারবার দাড় করাচ্ছে সপ্ন দুয়ারে, অরু এখন আক্ষরিক অর্থে ক্রীতিকের বউ। মিসেস অরোরা জায়ান। আর এই মূহুর্তে ক্রীতিক তার বউয়ের ঘোমটা সরাচ্ছে মুখ দেখার উদ্দেশ্যে এটা কি আদৌও সত্যি? নাকি সপ্ন?
ক্রীতিক ধীরে ধীরে ঘোমটা তুলে অরুর, নানা তার নতুন বউয়ের মুখের দিকে নিস্প্রভ চোখে চেয়ে রইলো খানিকক্ষণ। ওর পুরো পৃথিবীটা এখানেই থমকে গিয়েছে, অরুকে আজ মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর লাগছে। তাইতো ক্রীতিকের মতো শক্ত পোক্ত কঠিন হৃদয়ের মানুষটাও কেমন গলে গলে যাচ্ছে ওর মায়াবী মুখখানা দেখে। ঘোমটা তোলা হয়ে গেলে এলিসা আর হুজুরের নির্দেশে কাঁপা কাঁপা হাতে ক্রীতিকের জিম করা পেশিবহুল সাদা ফর্সা হাতদুটো হাতের মধ্যে নিয়ে নেয় অরু। অতঃপর হেঁচকি দিতে দিতে ওর দু’হাতের পিঠে নিজের ভেজা নরম তুলতুলে অধর খানি ছুয়িয়ে দেয় নির্লিপ্তে,অতঃপর তা মাথা নুয়িয়ে স্পর্শ করায় নিজের দুচোখে।
অরুর এই নিয়ম পালনে কি মোটেও আন্তরিকতা ছিলোনা? ছিলোতো, যত যাই হোক বিয়ের পরে মেয়েদের হৃদয়টা স্বামীর প্রতি আপনাআপনি দূর্বল হয়ে যায়। ওই মূহুর্তে অরুরও বোধ হয় তাই হয়েছিল। অরু যখন ক্রীতিকের হাতদুটো দুচোখে স্পর্শ করায় তখন ক্রীতিক তার একহাত নিয়ে অরুর মাথার উপর রেখে অন্যহাতের বাহুতে টেনে নেয় অরুর ছোট্ট শরীরটাকে। সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিকের সাদা শার্টটা খামচে ধরে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে কা’ন্নায় ভেঙে পরে অরু।কি জানি কেন এতো কেঁদেছিল সেদিন? আর কাঁদবেই যখন তখন ক্রীতিকের বুকেই কেন? তখন তো ক্রীতিকই আসল কার্লপিট ছিল।তবুও ক্রীতিকের বুকেই কেঁদে ভাসিয়েছিল অরু।

এসব অযথা নিয়মকানুন পালনের পর ক্রীতিক আর দাঁড়ালো না, অরুকে কোলে তুলে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো মসজিদ থেকে। তারপর বাইকে বসে বরাবরের মতোই নিজের ওয়ালেট, সিগারেটের বক্স, এমনকি একটু আগের মালাটাও অরুর হাতে ধরিয়ে দিলো সে। অরুও চুপচাপ সেগুলো হাতে নিয়েই বসে পরলো বাইকের পেছনে।
অরুর ভেতর তখন ভোঁতা ভোঁতা অনুভূতি থাকলেও আজ ওর অনুভূতি গুলো তুঙ্গে। এখন মনে হচ্ছে বিয়ের পরে স্বামীর সাথে ওর প্রথম বাইক রাইড বোধ হয় সেটাই ছিল।
সেদিনের ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটা কথা পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে করে আরও একবার লাজুকতায় মুড়িয়ে গেলো অরু। সেই লাজে রাঙা হলো নরম তুলতুলে কপোল দুখানা।
চলবে……….
সবাই সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করে যাবে। নয়তো নেক্সট পার্ট দূর আছে🥱।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here