সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁 #পর্বঃ৩৫ #লেখনীতেঃsuraiya_rafa

0
370

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ৩৫
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
[ক’পি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য]

ঝিমিয়ে পরা ম’রা বিকেলে সূর্যরশ্মির আলোর ছটা মিয়িয়ে এসেছে কিছুটা। চোখের সামনে পরিষ্কার তকতকে পিচ ঢালা রাস্তাতেও শেষ বিকেলের ছায়া পরেছে। মাঝ আকাশে পাখিদের ঘরে ফেরার ঢল।

সারিসারি উইল্ড মিল গুলো এখনো স্বীয় গতিতে ঘুরছে, ঈষান কোনে মেঘ জমেছে, খানিকবাদে বাদেই মেঘের গুড়গুড়ানি ভেসে আসছে সেথা থেকে। ব্ল্যাক মার্সিডিজের টিন্ডেট জানালা দিয়ে বাইরের দিকে একনজর পরখ করে আবারও ড্রাইভিং এ মন দিলো প্রত্যয়,গন্তব্য এয়ারপোর্ট।

গাড়ির স্টিয়ারিংএ হাত চালাতে চালাতেই লুকিং গ্লাসে চোখ রেখে একনজর ক্রীতিককে পরখ করে নিলো সে। পেছনে বসে ব্যাকসিটে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছে ক্রীতিক। সেই তখন থেকে একই ভাবে বসে আছে দেখে এবার
প্রত্যয় একটু গলা খাঁকারি দিয়ে শুধালো,
—- ভাই, আর ইউ ওকে?

ক্রীতিক চোখ খুললো না আর, শুধু ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
— ঠিক আছি।

যদিও বা প্রত্যয় ক্রীতিকের উত্তরে সন্তুষ্ট নয়, কারণ ও জানে ক্রীতিক ঠিক নেই, এমন একটা মূহুর্তে ঠিক থাকার কথাও নয়, তবুও জায়ান ক্রীতিক যখন বলেছে সবকিছু ঠিক আছে, তখন সেটাই সঠিক ধরে নিতে হবে।এর বাইরে কথা বাড়ানোটা মূর্খতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই প্রত্যয়ও সেটাই করলো, ক্রীতিকের কথায় হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে পুনরায় ড্রাইভিং এ মন দিলো।

বেশ কিছুটা সময় ধরে চোখদুটো বন্ধ রেখেও অরুর মুখটা সরানো যাচ্ছেনা মানস্পট থেকে। গাড়িটা এয়ারপোর্টের দিকে যত এগোচ্ছে ততই হৃদয়টা অদৃশ্য বেদনায় তপ্ত খরার মতো খাঁ খাঁ করছে। ক্রীতিক বরাবরই উগ্র মেজাজী হুটহাট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় যখন তখন, কিন্তু অরুর বেলায় সম্পূর্ণ তার বিপরীত। আজও অরুকে ওমন করে একা ছেড়ে আসছে মন সায় দেয়নি ক্রীতিকের, তাইতো অর্ণবকে বলে এসেছে অরুর বাসায় সর্বক্ষন নজর রাখতে।

অরুর কথা ভাবতে গিয়ে পাশে পরে থাকা মোবাইল ফোনটা হাতরে নিলো ক্রীতিক, অতঃপর গ্যালারীতে ঢুকে,স্ক্রল করতে লাগলো কাল ভোরে ধারণকৃত কিছু একান্ত মূহুর্ত। ক্রীতিকের মোবাইলে অরুর তেমন কোনো ফটো নেই বললেই চলে, কিন্তু গতকাল সূর্যদয়ের সময় কটেজে নিজেদের অন্তরঙ্গ মূহুর্তের পরে অরুর বেশ কয়েকটা ছবি তুলেছিল ক্রীতিক। যেখানে দেখা যাচ্ছে শরীরে ছফেদ রঙা কম্ফোর্টার জড়িয়ে গাল ফুলিয়ে বসে আছে অরু, চোখ দুটো অশ্রুশিক্ত, কেঁদে কে’টে লালবর্ণ ধারণ করেছে সুন্দর ফর্সা কোমল মুখটা।

অরুর ছবিতে চোখ বুলিয়ে ওর রাগের কারণ ভাবতে ভাবতে আজও নরম করে হেসে ফেললো ক্রীতিক। একেএকে ভাবতে লাগলো কাল ভোর থেকে এই মূহুর্ত অবধি ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটা ঘটনা।

…. কাল মিষ্টি ভোরে, নরম রোদের আড়ালে মিষ্টি অরুকে নিজের মতো করেই কাছে টেনে নিয়েছিলো ক্রীতিক,এরপর অরুর ছোট্ট শরীরে চলেছিল ক্রীতিকের দীর্ঘক্ষনের রাজত্ব আর কতৃত্ব।ভালোবাসার পর্ব শেষ করে ক্রীতিক যখন সবে সবে একটু আবেশিত ঘুমের তোপে চোখ দুটো বুজেছিল, তখনই কর্ণকূহরে ঝঙ্কার তোলে ক্রন্দনরত অরুর ফোপাঁনোর আওয়াজ।

অরু কাঁদছে ব্যাপারটা মস্তিষ্কে গিয়ে বিট করতেই শোয়া থেকে চট করে উঠে বসলো ক্রীতিক,ঘুম জড়ানো কন্ঠে অবুঝের মতোই চোখ বড়বড় করে প্রশ্ন করলো অরুকে,
—- কি হয়েছে কাঁদছিস কেন?

বয়সে বারো বছরের বড় ক্রীতিকের কাছে অষ্টাদশী অরু বরাবরই বাচ্চাসম, একমাত্র ক্রীতিক আর আপার সামনেই ওর বাচ্চামী করার সভাব রয়েছে, ক্রীতিকের আওয়াজ পেয়ে অরু এইমূহুর্তে বাচ্চাদের মতোই ফ্যাচফ্যাচিয়ে কেঁদে উঠলো, শরীরে একটা সুতা ও নেই,কোনোমতে নরম চাদরটাকে শরীরে পেচিয়ে অরু অস্পষ্ট আওয়াজে ফোপাঁতে ফোপাঁতে বললো,
—- আপনি সেদিন গাড়িতে বলেছিলেন আমাকে একটুও ক’ষ্ট দেবেন না, সবসময় জেন্টাল থাকবেন, অথচ আজকে দেখুন, আপনার ভালোবাসার চোটে আমি আ’হত হয়ে গিয়েছি।

অরুর কথায় ক্রীতিক উদ্বিগ্ন হয়ে শুধালো,
—- বেশি লেগেছে? ডক্টরের কাছে যেতে হবে?

অরু দাঁত কটমটিয়ে বললো,
—- চুপ করুন বেহায়া লোক, এসব অসুস্থতা নিয়ে কেউ ডক্টরের কাছে যায়?

—- কেউ না গেলেও তুই যাবি, কারণ তোকে নিয়ে আমি একটুও রি’স্ক নিতে চাইনা, এমনিতেও এসবের জন্য তোর বয়সটা অনেক কম।

ক্রীতিক কথা শেষ করে অরুকে কোলে নেওয়ার জন্য উদ্যত হলে অরু হুরমুড়িয়ে খাট থেকে নেমে যায়,তবে বিছানা ছেড়ে নেমে গিয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না বেচারি, পা দুটো অবশ হয়ে থাকার দরুন, কম্ফোর্টার সহ’ই ধপ করে বসে পরলো মেঝেতে। অরুর এহেন নাজেহাল অবস্থা দেখে ঠোঁট টিপে হাসি সংবরণ করলো ক্রীতিক। অতঃপর এগিয়ে গিয়ে অরুকে পুনরায় বাহুবদ্ধ করে কোলে তুলে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে হাস্কিটোনে হিসহিসিয়ে বলে,
—– আগেই বলেছিলাম তোকে, ডার্ক রোমান্স আমার বেশ পছন্দ।

ক্রীতিকের কন্ঠে ঘোর মাদকতা,চোখ দুটোতে কামনার জোয়ার, ওর এমন দ্রত নিঃশ্বাসে ভরকে যায় অরু।শুষ্ক ঢোক গিলে শুধায়,
—ককি হয়েছে আপনার?

অরুকে বিছানায় ছু’ড়ে ফেলে দিয়ে তপ্ত আওয়াজে ক্রীতিক বলে,
— বেইবি,ফ্রর্ম নাও অন, আই ওন্ট বি জেন্টাল এনি মোর।বি আ গুড গার্ল ওকে?

অরু হকচকিয়ে উঠে বললো,
— কিহহ!

অরুর আশ্চর্যের সীমানা তুঙ্গে নিয়ে, ঠোঁটের কোনে একটা ক্রুর হাসি ঝুলিয়ে, বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা হ্যা’ন্ডকাফ্ বের করতে করতে ক্রীতিক বললো,
—- ভ’য় নেই,আমার সাথে থাকলে অভ্যেস হয়ে যাবে।
**********************************************

*রিসোর্ট থেকে বাড়িতে ফিরে, বেলা বারোটার দিকে পুরোপরি ফর্মাল গেটআপে রেডি হয়ে রুম থেকে বেরিয়েছে ক্রীতিক। এ’ক্সি’ডেন্টের কারনে বেশ অনেকদিন ভার্সিটিতে যেতে পারেনি ও, গতকাল উইকএন্ড ছিলো বলে বাড়িতেই সময় কাটিয়েছে।আর আজ হুট করেই ডিপার্টমেন্ট প্রফেসরদের মিটিং এ জরুরি তলব পরেছে ওর, না গেলেই নয়।তাইতো অরুকে নিয়ে দ্রুত বাড়িতে ফিরেছে ক্রীতিক।

তবে বিপত্তি ঘটেছে অরুকে নিয়েই, সেই যে রিসোর্টে বসে রা’গ করে গাল ফুলিয়েছে, এখনো সেভাবেই বসে আছে। অরুর কাছে অবশ্য রা’গ করার যথাযথ যুক্তি রয়েছে, তবে ক্রীতিকের মতামত অনুযায়ী,
—- নিজেকে সামলাতে না পারলে আমার কি করনীয়?

হলরুমের কাউচে বসে টিভি দেখতে দেখতেই অরুর চোখ গেলো ক্রীতিকের দিকে। শরতের আকাশের মতো লাইট ব্লু শার্টের ফুল স্লিভস হাতার বোতাম গুলো বেশ মনোযোগী দৃষ্টিতে লাগাতে লাগাতে নিচে নামছে ক্রীতিক। কাঁধের একপাশে ঝুলে আছে ল্যাপটপ ব্যাগ। আজ অনেকদিন পরে ক্লিন সেভ করায় ওকে দেখতে অন্য রকম সুদর্শন লাগছে। ক্রীতিককে আড় চোখে একঝলক পরখ করে ভেতরে ভেতরে জমিয়ে রাখা রাগটা আবারও মাথায় চড়ে বসলো অরুর,তৎক্ষনাৎ মুখ ঝামটি দিয়ে ক্রীতিকের দিক থেকে চোখ সরিয়ে, টিভির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়ালো অরু,
—- দয়ামায়াহীন নির্দয়,পাষাণ, সা’ইকো,বদমাশ লোক।

অরুর এতো অভিযোগ আর গা’লাগাল বোধ হয় ক্রীতিক শুনেও শুনলো না, বরং এগিয়ে এসে অরুর কপালে টকাস করে একটা গভীর চুমু খেয়ে নির্লিপ্ত কন্ঠে শুধালো,
—- ব্যাথা কমেছে জান?

অরু জবাব না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
অরুর কান্ডে ক্রীতিক চোয়াল শক্ত করে বললো,
—- ইগনোর করা আমার পছন্দ নয় অরু। তুই আমাকে যা খুশি বল সমস্যা নেই, আমার উপর জিদ ফলাতে নিজের হাত ব্যবহার কর তাতেও সমস্যা নেই,কিন্তু আমাকে ইগনোর কিংবা রিজেক্ট করার দুঃসাহস দেখাবি না আর। কখনোই না।

অরু এবার মাথা নিচু মিনমিনিয়ে বললো,
— আআপনি আমাকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পান তাই না?

ক্রীতিক অরুর চিবুক ধরে ওর মাথাটা তুলে,চোখের মধ্যে চোখ রেখে বললো,
—- তুই আমার সম্পত্তি বেইবি,তোর সবকিছু আমার জন্য বিলোং করে, যেভাবে খুশি তোকে সেভাবে আদর করার অধিকার রাখি আমি। এটাকে যত দ্রুত পজিটিভলি নিবি, তত তাড়াতাড়ি তোর কাছেও সবকিছু স্বাভাবিক মনে হবে।

কথা শেষ করে নতুন উদ্যমে অরুর দু’গালে চুমু খেয়ে গটগটিয়ে বেরিয়ে গেলো ক্রীতিক।

অরুর শরীরটা সত্যি সত্যিই ভালো নেই, সকাল থেকেই জ্বর জ্বর ভাব, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে। আগের রাতে না ঘুমানোর দরুন মাথাটাও ধরে আছে খুব, এই মূহুর্তে বিশ্রাম নেওয়াটা বড্ড জরুরি। তাই ক্রীতিকের অর্ডার করে রেখে যাওয়া খাবার আর অষুধ খেয়ে হলরুমেই চাদর টেনে ঘুমিয়ে পরে অরু।
.
একটা দুঃস্বপ্নের মাঝপথে আটকে গিয়ে অরুর যখন হুট করেই ঘুম ছুটে যায় তখন সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে।দুঃস্বপ্নের পরিনতি জানার সাহস কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই নেই ওর,অগত্যাই ধরফরিয়ে শোয়া ছেড়ে উঠে বসলো অরু। ঠান্ডার মধ্যেও শরীরটা ঘামে ভিজে জপজপ করছে, হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে শ্বাসপ্রশ্বাস।

ভ’য়ে জর্জরিত চুপসে যাওয়া মুখমন্ডলটাকে বেশ অনেকক্ষন লাগলো স্বাভাবিক করতে। কিছুক্ষণ একই ভাবে বসে থেকে হাতের পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম টুকু মুছে চারিদিকে চোখ বোলালো অরু, রুমটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে হয়তো ক্রীতিক এখনো ভার্সিটি থেকে ফেরেনি, অন্ধকার রুমের আনাচে কানাচে লেজ নাড়িয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে বিড়াল ছানা ডোরা। ক্রীতিকের বাড়ির ফ্রি সার্ভিসে আগের থেকে বেশ নাদুসনুদুস হয়েছে সে। এ বাড়িতে আসার পর অনেকদিনের মাথায় সুস্থ সবল টগবগে ডোরাকে দেখে বেশ আস্বস্ত হয়েছিল অরু, মনেমনে ভেবেছিল,
—- সবাই মিথ্যে বলে,আমার জায়ান ক্রীতিক এতোটাও খারাপ না।

কিছুক্ষন ধরে বসেবসে ডোরার নড়নচড়ন লক্ষ করার পরে, কয়েকবার নাক টেনে ভেতরে অনেকটা ঠান্ডা বাতাস পুরে নিয়ে ধীর পায়ে রুমে চলে গেলো অরু।অতঃপর ফ্রেশ হয়ে জামা কাপড় পাল্টে পুনরায় ফিরে এলো হলরুমে। এখন সত্যিই শরীরটা বেশ হাল্কা লাগছে,মেজাজটাও ফুরফুরে। অগত্যাই ডোরাকে কোলে নিয়ে অরু গিয়ে বসলো টিভি দেখতে, আজকাল এ বাড়িতে থাকা সত্বেও ডোরাকে সময় দিতে পারেনা অরু। কি করেই বা দেবে?আরেকজনার হাজার রকমের মুড সুইং মেটাতে মেটাতেই ওর ছোট্ট জীবনটা ফালাফালা। কখনো বিরক্ত হবে, তো কখনো আদর করবে। কখনো চ’ড়িয়ে গাল লাল করে দেবে, তো কখনো নিজেই সেখানে মলম ঘষবে, কি মুশকিল।

রিমোট দিয়ে একেক করে টিভির চ্যানেল পাল্টাচ্ছে অরু, কোনো কিছুই ভাল্লাগছেনা। বিদেশি চ্যানেলের ছাতার মাথা কিছুই বোঝার জো নেই,ওদিকে নেটফ্লিক্স দেখার মতো ধৈর্য নেই।
অরু যখন টিভির চ্যানেল পাল্টাতে গভীর মনোযোগী তখনই বাড়িতে ফেরে ক্রীতিক। হলরুমে একমূহুর্তও অপেক্ষা না করে সোজা সিঁড়ি ডিঙিয়ে রুমে গিয়ে,গলা উঁচিয়ে ডাকতে শুরু করে অরুকে।
—- অরু,অরুউউ, ডাকছি আমি রুমে আয়!

সকালের রাগে এখনো ভাটি পরেনি অরুর,তারউপর এখন আবার উদভ্রান্তের মতো রাগী রাগী গলায় ডাকছে ক্রীতিক, ক্রীতিকের চোখের সামনে পরলেই সকালের কথা মনে পরে যায় ওর। লজ্জা আর অভিমান দুটোই তরতরিয়ে বেড়ে যায় তৎক্ষনাৎ, ওই জন্যই হয়তো অরু আর বেড রুমের দিকে পা বাড়ানোর সাহস পেলোনা। চুপচাপ ঘাপটি মেরে বসে রইলো কাউচের উপর ।

ওদিকে অরু রুমে আসছে না দেখে ক্রীতিক রাগে ফোসফোস করে উঠে তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
—- অরুর বাচ্চা রুমে আয়, নয়তো আমি একবার নিচে এলে তোকে কাঁ’চা চি’বিয়ে খাবো, সকালের কথা ভুলে গিয়েছিস?

নাহ, অরু এবারও এলোনা। ক্রীতিকের মেজাজ এতোক্ষণে সপ্তম আসমানে উঠে এসেছে, এতো তেজ কেন এই মেয়েটার?ক্রীতিক একটুতো কোলে নিয়ে আদরই করতো ওকে,খেয়ে তো আর ফেলতো না। তাও উপরে এলোনা ওই ছলনাময়ী পিচ্চি অরু।

ক্রীতিক বিরক্ত হয়ে পায়ের জুতো জোড়া দুটোকে দুইদিকে ছু’ড়ে ফেলে দিয়ে, খালি পায়েই তরতর করে নিচে নেমে এলো। ক্রীতিক যখন শেষ সিঁড়িতে এসে দাঁড়িয়ে রেগেমেগে অরুকে কিছু বলবে,তার আগেই ওর চোখ গেলো চলন্ত টিভির স্ক্রিনে। বেশ বড়সড় ইংরেজি হেডলাইন। অরু ছলছলে চোখে সেদিকেই তাকিয়ে আছে, ক্রীতিকের উপস্থিতি টের পেয়ে, ওর দিকে না তাকিয়েই অরু বলে ওঠে,
—- কিয়ারা রোজারিও তো খুব নামকরা অভিনেত্রী ছিলেন। শুনেছি উনিশ শতকে ওনার করা প্রতিটা শর্ট ফিল্ম, সিরিজ,মুভি সবকিছুর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে,এখনো চেহারায় বার্ধক্যের চিহ্নটুকু অবধি নেই, অথচ উনি কিনা এতো তাড়াতাড়িই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন? আর এই নিউজে কি বলছে এসব? ওনার নাকি দুই সন্তান, সারাজীবন তো টিভির পর্দায় একজনকেই দেখে এলাম,তাহলে আরেকজন কোথায়?

অরুর কথা ক্রীতিকের কানে আদৌও পৌঁছেছে কি-না তার হদিস নেই, নিউজটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ও যেভাবে খালি পায়ে নিচে নেমে এসেছিল, সেভাবেই উপরে উঠে গেলো।
ক্রীতিক চলে যেতেই অরুর ভ্রম কাটে, কোনোরূপ বাক্য আদান-প্রদান না করেই ক্রীতিক এভাবে চলে গেলো কেন? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই অরু নিজেও ডোরাকে রেখে ক্রীতিককে অনুসরণ করে উপরে রুমের দিকে এগিয়ে যায়।

রুমে প্রবেশ করে অরু দেখতে পায়, দক্ষিণ দিকের যে কাচের দেওয়ালটা আছে সেদিকেই মুখ করে দু’পকেটে হাত গুঁজে জীবন্ত মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে আছে ক্রীতিক।
অরুর মনে এক অজানা আ’তঙ্ক খচখচ করছে, নিজের উদ্বিগ্নতা দমাতে না পেরে বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে প্রশ্নটা ছু’ড়েই ফেললো ও,
—– কি হয়েছে আপনার? আপনি কি কিয়ারা রোজারিও কে ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন?

আহত গলায় উল্টো শুধালো ক্রীতিক,
—- আমার নাম কি অরু?

অরু ঠোঁট উল্টে অস্ফুটেই জবাব দিলো,
—- আপনার নাম তো জায়ান ক্রীতিক…..

কথা শেষ করার আগেই কিছু একটা আঁচ করতে পেরে, থেমে গেলো অরু,ক্রীতিক ঘুরে তাকিয়ে বললো,
—- এখন বুঝেছিস আমার এই অদ্ভুত নামের রহস্য?

সঙ্গে সঙ্গে চক্ষু ছানাবড়া হলো অরুর,চমকে গিয়ে ক্রীতিকের মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে অরু বললো,
— তারমানে আআপনিই কিয়ারা রোজারিওর বড় সন্তান!!

কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে অজান্তেই মুখের উপর দু’হাত দিয়ে অরু বলে ওঠে,
—- আআপনি ঠিক আছেন?

ক্রীতিক জবাব দিলো না, এগিয়ে গিয়ে খাটের উপর বসে অরুকে নিজের কাছে টেনে এনে দু’হাতে শক্ত করে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে, মাথা ঠেকালো অরুর ছোট্ট পেটে।

ওর এমন কাতর,ব্যথাতুর স্পর্শে জমে গেলো অরু, যে মানুষটা সবসময় অরুকে নিজের বুকে ঠায় দিয়ে এসেছে, সে কিনা আজ হুট করেই অরুর বুকে মুখ লুকালো? ক্রীতিকের মা মা’রা গিয়েছে, যেভাবেই থাকুক না কেন মা নামক নাড়ির টানটুকু পৃথিবীর বুকেতো অন্তত জীবিত ছিল। আর আজ সেই বিনে সুতোর বাঁধনটাও ছিন্ন হলো।
ক্রীতিকের কষ্ট পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, তাহলে ক্রীতিক কেন চুপচাপ বসে আছে? কেনইবা মায়ের কথা বলে বিলাপ করে কা’ন্না করছে না এখনো? জানা নেই অরুর। ও তো কেবল নিজের ছোট্ট দু’হাতে ক্রীতিকের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে ব্যস্ত।

এভাবে নিঃশব্দে শুধু ভারী দীর্ঘশ্বাসের আদান-প্রদানে কতোটা সময় যে অতিবাহিত হয়েছিল জানা নেই অরুর, ভীষণ হৃদয়বিদারক নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ক্রীতিকের ফোনটা যখন ভাইব্রেট হয়,তখনই ভ্রম ছুটে যায় অরুর, ও ক্রীতিককে বুকের মধ্যে আগলে রেখেই একহাত বাড়িয়ে ফোনটা রিসিভ করলো।ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে প্রত্যয় বলে,
—– ভাইকে লস অ্যাঞ্জেলস যেতে হবে, ওনার মায়ের শেষ কার্য ওখানেই সম্পন্ন হবে।

অরু মিনমিনিয়ে বললো,
—- ওনার মা কি ওনাকে একবারও দেখতে চায়নি?

জবাবে প্রত্যয় বলে,
—- শুনেছি মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের ভুলের জন্য আহাজারি করছেন তিনি, চাতক পাখির মতো মুখিয়ে ছিলেন ছেলেকে একনজর দেখার জন্য, কিন্তু ভাই ইচ্ছে করেই নানা বাড়ির সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল বহুবছর আগেই। তাই শেষ ইচ্ছে আর পূরণ হয়নি ওনার।

অরু কিছুটা হলেও ঘটনার সারাংশ বুঝতে পেরে কল কেটে দিলো তৎক্ষনাৎ ।

তারপর ক্রীতিকের মুখোমুখি হয়ে হাটু গেড়ে বসে, ওর গাল দুটো দু’হাতে আঁজলা ভরে ধরে শুধালো ,
—- আমার শাশুড়ি মাকে যে সবসময় টিভিতে দেখাতো আগে বলেন নি কেন?

ক্রীতিক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরুর পানে,অরু এবার পুনরায় বললো,
—– শেষ কৃত্তের জন্য আপনি কাল এল. এ. যাচ্ছেন তাইতো?

ক্রীতিক হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে, অরু বলে,
—- তাহলে এই সুযোগে আমিও একটু আমার মায়ের কাছে যাই? মা’ তো মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ঠিক সবকিছু মেনে নেবে, দেখবেন।
আমি কথা দিচ্ছি আপনি ফিরে এসে দেখবেন সবকিছু স্বাভাবিক আর কতোটা সুন্দর হয়ে গিয়েছে। মা আপা আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিয়েছে।তারপর আমরা প্রতিদিন একসাথে ভার্সিটি যাবো, যে যার কাজ করবো, ফেরার পথে মায়ের বাসা থেকে রাতে খেয়ে প্রতিদিন বাড়ি ফিরবো। উইকএন্ডে রাত জেগে মুভি দেখবো, অর্ণব ভাইয়া,সায়র ভাইয়া,আর এলিসা আপুর সাথে সুযোগ পেলেই ট্যুরে যাবো, আমাদের সপ্নের মতো সংসার হবে, আমি কথা দিচ্ছি, এ জীবনে আর কখনো একা হবেন না আপনি। আর না কখনো আমরা দুজন আলাদা হবো।এটাই শেষবার।

অরুর প্রতিশ্রুতির পালা শেষ হলে ক্রীতিক পুনরায় অরুকে দাঁড় করিয়ে ওর বুকে মাথা রাখে,চোখ দুটো আবেশে বন্ধ করে নির্লিপ্ত গলায় বলে,
—- একটা সত্যি বলি? পুরো দুনিয়াতে তুই ছাড়া আমার আর কেউ নেই অরু। তুই না থাকলে এই বাড়িটার মতোই আমার হৃদয়টাও ফাঁকা হয়ে যায়, কি ভীষণ য’ন্ত্রনায় কাতরাই আমি,সেটা কেবল আমার হৃদয় জানে।তুই আমার অবসেশন অরু,আমার মাদকতা,আমার স্লিপিং পিল, আমার দিন, আমার রাত, আমার আশা, আমার গড়ন, আমার ভাঙন,আমার জীবন আমার মরন সবকিছু তুই। তাই কখনো যদি আমার থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টাও করিস,সেদিন তোর য’ন্ত্রনাদ্বায়ক ভাগ্য আমি নিজের হাতে লিখবো জান।
.
গাড়িতে বসে বসেই কালকে অরুকে বলা ব্লে’ডের মতো ধারা’লো কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আজ আবারও একবার আওড়ালো ক্রীতিক,
—– আই রিপিট,আমার থেকে দূরে গেলে তোর জীবনে কালবৈশাখী ঝড় তুলে ছাড়বো আমি।
***********************************************
পরন্ত বিকেলে সাইক্লিং করে মাত্রই ইকো পার্কের শেষ প্রান্তে এসে থামলো অর্ণব আর এলিসা।
অর্ণব বরাবরই ম্যাকবুক,কম্পিউটার, কিবোর্ড এসব নিয়ে পরে থাকতে বেশি পছন্দ করে,কিন্তু আজকাল এলিসার পাল্লায় পরে প্রায়শই বিকেলের দিকে সাইকেল নিয়ে কিংবা হেটে হেটে বের হতে হয় ওকে।এলিসা আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মী মেয়ে,সে এথলেটিক গার্ল, দৌড়, ঝাপ, লাফালাফি, মা’রামা’রি এসবে শীর্ষঅবস্থান ওর।

দুই মেরুর এই দুই প্রেমিক জুগলের মিলে মিশে থাকাটাও বেশ কষ্টসাধ্য, তবুও এলিসাকে বসে রাখার জন্য নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে অর্ণব,মনেমনে ভাবে —-ভালোবাসি,ফেলেতো আর দিতে পারবো না? কিন্তু এই বদ মেজাজী উড়নচন্ডী মেয়েটার একটা দফারফা করতেই হবে এবার।

এলিসা সাইকেলের চেইনে চোখ বোলাতে বোলাতে শুধালো,
—- কি ভাবছিস?

অর্ণব মাথা চুলকাতে চুলকাতে আশপাশটা পরখ করতে করতেই চট করে বলে ওঠে,
—- দেখ এলি ওখানে একটা চার্চ।

এলিসা একনজর সেদিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
— তো?

—- তো মানে? চল গিয়ে ফাদারের কাছ থেকে আর্শিবাদ নিয়ে আসি।

উপরে উপরে এলিসাকে পটালেও মনেমনে অর্ণব ভাবে,
—– ব’জ্জাত মহিলা, একবার চার্চে চল, ফাদারের কাছ থেকে বশীকরন পানি পরা এনে যদি না খায়িয়েছি তোকে, তবে আমার নামও অর্ণব সায়ন্ত নয়।

অর্ণবের কথায় এলিসা কিছু একটা ভাবলো, তারপর না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
—- নাহ যাবো না, সন্ধ্যা হয়ে আসছে চল ফিরে যাই।

অর্ণব তৎক্ষনাৎ নিজের সাইকেলটাকে ফেলে দিয়ে এগিয়ে এসে এলিসার বাহু আঁকড়ে ধরে বললো,
—– এমন করেনা জান, সামনে বিয়ে করতে হবেনা? একটুখানিরই তো ব্যাপার, চলনা প্লিজ।

অর্নবের এহেন আহাজারিতে অপারগ এলিসা ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
—– ঠিকাছে চল।

অর্ণব খুশি মনে এলিসাকে ধরে নিয়ে চার্চের দিকে এগিয়েই যাচ্ছিল, তখনই কোথা থেকে যেন হাঁপাতে হাঁপাতে উদয় হলো সায়র। সায়রকে দেখা মাত্রই বিরক্তিতে চিড়িবিড়িয়ে উঠে অর্ণব বলে,
—- শালা বিরিয়ানির এলাচি, আাসার আর টাইম পেলিনা?

সায়র কথা বলার ফুরসত পাচ্ছে না, এখনো হাঁপাচ্ছে, তা দেখে এলিসা অর্ণবকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
—- চুপ কর অর্ণব, আগে ওকে শ্বাস করার সুযোগ দে।

অর্ণব থমথমে গলায় বললো,
—- দিলাম।

বেশ অনেকক্ষন পরে পানি পান করে খানিকটা শান্ত হয়ে অর্ণবের উদ্দেশ্যে সায়র বলে,
—- জেকে তোর প্রেমের বারোটা বাজালো বলে, দোস্ত।

অর্ণব ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
—- কেন কি হয়েছে? তোকে না ঘুরে আসতে বললাম অরুর বাসার সামনে থেকে? এতোটুকু দ্বায়িত্ব পালন করতে পারিস না? ম্যানারলেস কোথাগার।

—- আরে সেখানেই তো গিয়েছিলাম, গিয়ে দেখি অরুদের এ্যাপার্টমেন্টে অন্য ভাড়াটিয়া উঠেছে, অরুরা নেই।

অর্ণব বড়বড় চোখ করে বললো,
—- নেই মানে? হুট করে কোথায় গেলো অরুরা?

সায়রের কথায় অর্ণবের গলা শুকিয়ে এসেছে, এলিসা অর্ণবের ভয়ার্ত চাহনি দেখে আগ বাড়িয়ে সায়রকে শুধালো,
—- আজ প্রায় দশদিন হতে চললো, জেকে এখনো এল.এ থেকে ফেরেনি?

সায়র না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
—– ওর মায়ের কিছু উইশ ছিল, সেগুলো ও আর ওর ভাই মিলে পূরন করতে করতেই শুনেছি টাইম লেগেছে, তবে আজ কিংবা কালের মধ্যে তো ফিরে আসার কথা।

সায়রের কথায় এবার এলিসার কপালেও চিন্তার ভাঁজ পরলো, ও একটা ভয়ার্ত শুষ্ক ঢোক গিলে, পেছনে খ্রীষ্ট ধর্মের পবিত্র ধর্মশালা চার্চের দিকে তাকিয়ে বুকে ক্রুশ এঁকে বিড়িবিড়িয়ে বললো,
—- আই উইশ, এভ্রিথিং উইল বি ভেরি ফাইন, আমেন।

চলবে….
(তোমাদের বোধ হয় বলেছিলাম, আমার শরীরটা ভালো নেই জ্ব’র এসেছে,তারউপর ব্যাচ শুরু হয়েছে, তবুও নিজের দ্বায়বদ্ধতা থেকে একদিন বাদে একদিন গল্প দিচ্ছি, তারপরেও যদি তোমরা রা গ করে কথা শোনাও তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই🙂 আমি আমার ফেবারিট কে ড্রামা পর্যন্ত বন্ধ করে রেখেছি, ভেবেছি গল্পটা শেষ করে তবেই আবার ড্রামা দেখতে বসবো নয়তো গল্প দিতে দেরী হতে পারে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here