সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁 #পর্বঃ৩১ #লেখনীতেঃsuraiya_rafa

0
32

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ৩১
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
[কপি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য]

ইদানীং প্রায়শই শেষ রাতে ঝড় হয়। প্রকট ঝড়ে গাছপালা ভেঙেচুরে শহরতলীর হাইওয়ে রাস্তাঘাট পর্যন্ত ব্লক হয়ে থাকে নিমিষেই ।অতঃপর ভোর হতেই সেই ঝড়বৃষ্টি দমে গিয়ে নতুন করে উদীয়মান হয় সোনালী রঙা সূর্য কীরন। এখন সন্ধ্যারাত চলমান, তবুও শেষ রাতে ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়ে যাচ্ছে হুহু করে এলোপাথাড়ি বইতে থাকা মেঘ ভেজা ঘূর্ণি বায়ু। সেই তীব্র ঝড়হওয়ার উল্টো পথে বাতাস কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রীতিকের ব্ল্যাক মার্সিডিজটা। চারিদিকে শুনশান নীরবতা বিরাজমান, পুরো রাস্তাটা খালি পরে আছে, এই যায়গাটা বরাবরই এমন, সন্ধ্যে হতে না হতেই মানুষ জনের আনাগোনা নেমে আসে শূন্যের কোঠায়।

ড্রাইভিং সিটে বসে দক্ষ হাতে স্টিয়ারিং ঘুরাচ্ছে ক্রীতিক নিজেই। ভার্সিটির কিছু জরুরি কাজ সম্পন্ন করে আজকেই নিউইয়র্ক থেকে সানফ্রান্সিসকো ফিরেছে সে। চোখে তার ক্লান্তির ছাপ সুস্পষ্ট। সব সময় সেট হয়ে থাকা আন্ডারকাটিং স্টাইলিশ চুলগুলোও এখন এলোমেলো ভাবে কপালে পরে আছে। ড্রাইভ করতে করতে প্রায়শই কপালে পরে থাকা অবিন্যস্ত চুলগুলোকে একহাত দিয়ে ব্যাক ব্রাশ করে পেছনে ঠেলছে ক্রীতিক। তবে এই মূহুর্তে ওর ক্লান্ত মুখ ভঙ্গিমা খুব একটা ঠাওর করা যাচ্ছে না। চোখের ভাষা পড়ার উপায় নেই। দেখলে মনে হবে অনুভূতিহীন নির্জীব এক কাঠের পুতুল। অথচ হাতদুটো চলছে নির্বিগ্নে, ক্রীতিক যখন স্পিডোমিটারের সর্বোচ্চ গতিতে নিজের গাড়িটাকে বাতাসের বিপরীতে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো, ঠিক তখনই খানিকটা ফুরসত দিয়ে ভাইব্রেট ফোনটা সশব্দে বেজে ওঠে ওর। ক্রীতিক কানে ব্লুটুথ লাগিয়ে স্পিডোমিটারের গতি সামান্য ধীর করে ফোনটা রিসিভ করলো। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অর্ণব হন্তদন্ত হয়ে বলে ওঠে,
— ভাই খবর শুনেছিস?

ক্রীতিক শুধালো,
— কি খবর।

গলার আওয়াজে একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে অর্ণব বললো,
— নিখিল কে সার্চ করার জন্য পুলিশ সহকারে ওর এ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম। কিন্তু নিখিল কোথাও নেই। কোথাও নেই মানে কোথাও না।ভার্সিটি, ক্যাম্পাস, সাইনটিস্ট টীম কেউ ওর খবর জানেনা, কেউ না, এমন কি ওর গার্ল ফ্রেন্ডরাও না। কোথায় পালালো বলতো এই হতচ্ছাড়া?

ক্রীতিক স্পষ্ট আওয়াজে বললো,
— কোথাও না।

–কিহ!

অর্ণবের কথার প্রতিউত্তরে ক্রীতিক বললো,
— ওকে রাশিয়ান মাফিয়ারা গু’ম করে নিয়ে গেছে, তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়েছিল কিনা,দেখ গিয়ে এতোক্ষণে হয়তো পিস পিস করে ওর লি’ভার কি’ডনি গুলো অন্যদেশে পা’চার করে দিয়েছে তারা।

ক্রীতিক এমন ভাবে নিরুদ্বেগে কথাগুলো বলছিল যেন সামান্য একটা মুরগী কা’টার কথা বলা হচ্ছে এখানে, কি আশ্চর্য!

ক্রীতিকের কথায় অর্ণব আঁতকে উঠে বললো,
— কি বলছিস? তুই কি করে জানলি এতোসব?

ক্রীতিক ড্রাইভ করতে করতে ঠোঁটের কোনে একটা বিন্যাস্ত কপট হাসি ধরে রেখে বললো,
— আমিইতো ওকে মাফিয়াদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছি,কৌশলে।

অর্ণব তেতে উঠে বললো,
— এটা মোটেও হেলাফেলার কথা নয় জেকে। ছেলেটা ইয়ং, বুদ্ধিতে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ভুল করে বসেছে, আমরা ওকে আরেকটা সুযোগ দিতে পারতাম, হয়তো শুধরে যেতো, নিজের ভুলটা বুঝতে পারতো, তা-না তুই ওকে ডিরেক্ট মৃ’ত্যুর দিকে ঠেলে দিলি? এভাবে কৌশলে আর কত মানুষকে মা’র’বি তুই? সেদিন এ্যা’ক্সিডেন্টের পর জ্যাকসন হসপিটালে ধুঁকে ধুঁকে মা’রা গিয়েছে, আর আজ নিখিল।

অর্ণবের কথায় ক্রীতিকের মোটেও হেলদোল হলোনা, বরঞ্চ নিজের চোয়াল খানা শক্ত করে ও বললো,
— যে যার কর্মফল ভোগ করলে আমার তো কিছু করার নেই।

অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— ওদের একমাত্র দোষ কি? ওরা অরুর দিকে হাত বাড়িয়েছিল তাইতো?

ক্রীতিক তীর্যক হেসে বললো,
—এক্স্যাকলি।

— এতো অবসেশন ভালো নয় জেকে। বাই এনি চান্স তোর এই অতিরিক্ত আসক্তি অরুর উপর চড়াও হলে তখন? মেয়েটাকে তো রেগেমেগে মে’রে ফেলবি তুই।

অর্ণবের কথার পাছে ক্রীতিক বললো,
— কখনো এমন পরিস্থিতি এলে নিজেকেই নিজে আ’ঘাত করবো আমি। তবুও ওকে নয়। আফটার অল,সি ইজ মাই প্রোপার্টি,হার্টবিট, এন্ড মাই এভরিথিং।

অর্ণব ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
—বুঝেছি তোকে আবার সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে। নয়তো তুই শুধরাবি না।

ক্রীতিক ওর কথায় বিরক্ত হয়ে বললো,
— জ্ঞানদান পর্ব শেষ হলে বল, কলটা রেখে দেই, আমি ড্রাইভ করছি।

এরপর ওপাশ থেকে কল কাটার পিক পিক আওয়াজ ভেসে এলো কানে। অর্ণব কল রেখে দিলে ক্রীতিক আবারও মন দেয় ড্রাইভিং এ।
সেদিনের পাহাড়ের ঘটনার আজ প্রায় একসপ্তাহ হতে চললো, অথচ গত একসপ্তাহে একবারও অরুর সাথে দেখা কিংবা কথা কোনোটাই হয়ে ওঠেনি ওর।কারন গত একসপ্তাহ ধরেই শহরের বাইরে ছিল ক্রীতিক। আর আজ যখন সানফ্রান্সিসকো ফিরে অরুকে কল দিলো তখন বারবারই ফোনটা বন্ধ বলছে। এতোক্ষণ তো ক্রীতিক ভেবেছে ব্যাপারটা খুবই সাভাবিক ফোন বন্ধ থাকতেই পারে, কিন্তু অর্ণবের সাথে কথা বলার পর থেকেই অরুকে দেখার জন্য হৃদয়টা কেমন আনচান করছে ওর। বারবার মনে হচ্ছে দেখা না হোক এটলিস্ট অরুর তপ্ত নিঃশ্বাসের শব্দটুকু যদি শোনা যেত তাহলে রাতে অন্তত নিশ্চিন্তে ঘুমানো যেত।

খানিকক্ষন ধরে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে মাঝ পথেই ব্রেক কষলো ক্রীতিক। অতঃপর ফোন হাতে নিয়ে দ্রুততার সাথে ডায়াল করলো অরুর নাম্বারে। কিন্তু না অরু কল তুললো না। গত কয়েকবারের মতো এবারও ফোনটা বন্ধ বলছে।এহেন কান্ডে ক্রীতিক বেশ বিরক্ত হলো, উগ্র মেজাজটা হুট করেই চড়াও হলো অরুর উপর। রাগের তোপে মনেমনে দাঁত খিঁচে বললো,
— তোকে একবার চোখের সামনে পেয়ে নেই অরু। তারপর বুঝাবো ফোন বন্ধ করে রাখার শা’স্তি কাকে বলে।

বারবার কল দিয়েও কোনোভাবেই অরুকে কলে না পেয়ে, বিরক্তিতে ফোঁসফাস করতে করতে শেষ মেশ ক্রীতিক কল লাগালো প্রত্যয়ের নাম্বারে।
দুএকবার রিং হওয়ার পরেই কল তুললো প্রত্যয়, তবে ওপাশ থেকে কিছু বলার আগেই ক্রীতিক তড়িঘড়ি করে প্রশ্ন ছু’ড়লো ওকে,
— অরুর কোনো খবর জানো প্রত্যয়?

ওপাশ থেকে বোধ হয় প্রত্যয়ের শুষ্ক ঢোক গেলার আওয়াজ ভেসে এলো, অগত্যাই আমতাআমতা করতে লাগলো ও।
প্রত্যয় আমতাআমতা করছে দেখে ক্রীতিক হুংকার দিয়ে বললো,
— কি হয়েছে? এরকম মেয়েদের মতো মিনমিন করছো কেন? যা বলার স্পষ্ট ভাবে বলো, হোএয়ার ইজ অরু?

প্রত্যয় উল্টো প্রশ্ন করে শুধালো,
— ভাই আপনি কি ফিরেছেন?

ক্রীতিক বললো,
— হ্যা একটু আগেই ফিরেছি, এখন বাড়ির দিকে যাচ্ছি, কেন বলোতো?

প্রত্যয় ভয়ার্ত গলায় গাইগুই করে বললো,
— তাহলে বোধ হয় আমাদের একবার অরুদের বাসায় উচিৎ। আমি শুনেছি, না মানে সিওর না, শুনেছি কেবল, অরুর মা,মমানে আজমেরী ম্যাম বোধ হয় অরুকে বববিয়ে দিতে চাইছেন, আজ পাত্র পক্ষ দেখতে আসার কথা।

প্রত্যয়ের কথা শুনে ক্রীতিকের মাথায় ভলভলিয়ে র’ক্ত উঠে গেলো, নিজের সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে স্টিয়ারিংটা চেপে ধরে ক্রীতিক গর্জে উঠে বললো,
— হোয়াট? এমন একটা কথা তুমি আমাকে এখন বলছো? ব্রেইন কোথায় তোমার?

প্রত্যয় থতমত খেয়ে বললো,
— ইয়ে মানে, আমি নিজেই একটু আগে শুনলাম ভাই।

ক্রীতিক আর অযথা কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করলো না, তৎক্ষনাৎ গাড়ি ঘুরিয়ে স্পিডোমিটারের কাঁটায় একশোর উপর গতি তুলে হাওয়ার বেগে হুঁশশ করে চলে গেলো উল্টো পথে।
*****************************************
বাইরের ঝড়হাওয়া ক্ষনে ক্ষনে বেড়েই চলেছে। প্রচন্ড বাতাসের তান্ডবে বারবার জানালার ভারী পাল্লা গুলো বারি খাচ্ছে আর বিকট আওয়াজ তৈরি করছে, এই দানবীয় শব্দ সইতে না পেরে অরু এগিয়ে গিয়ে রুমের সবগুলো জানালার গ্লাস টেনে দিলো। গ্লাস টেনে দেওয়াতে গ্লাসের সাথে বাতাস বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে এখন আরও ভ’য়ানক আওয়াজ তৈরি হচ্ছে রুমের মাঝে। সেদিকে অবশ্য খেয়াল নেই অরুর। ওতো সেই কখন থেকে রুমের দরজায় খিল দিয়ে বসে আছে, চোখের সামনে যে ছোট্ট বেডসাইড টেবিলটা,তারউপর পিচ কালারের জামদানী শাড়ি আর কিছু গহনা রাখা আছে। এগুলো সেই বিকেলে এসে দিয়ে গিয়েছিল অনু। বলেছে সবকিছু পরে রেডি হয়ে থাকতে। সন্ধ্যা নাগাদ রাজের পরিবার আসবে ওকে দেখতে। রাজরা দুইতলায় থাকে, তাই মনে হয়না সন্ধ্যা হওয়ার পর আর দেরি করেছে তারা, বাইরে একাধিক মানুষের কথাবার্তা আর শোরগোল শুনে মনে হচ্ছে সবাই চলে এসেছে এতোক্ষনে অথচ অরু এখনো ক্রীতিকের দেওয়া পাজামা সেট পরেই বসে বসে ঠোঁট উল্টে কাঁদছে। কিভাবে কি ভেস্তে দেওয়া যায় সেটাই ভাবছে তখন থেকে। এতো অল্প বয়সে এরকম সব পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে সেটা বোধ হয় কল্পনাতেও ভাবেনি অরু। অথচ যার জন্য এতো হৃদয়ের হাহাকার, গত একসপ্তাহ ধরে তার কোনো খবরই নেই। ফোন নেই তো কি হয়েছে? একটা বার কি বাসার নিচে আসা যেতো না?

অভিমান হলো অরুর, বেজায় অভিমান। অভিমানের জোয়ারে গলায় আটকে আছে বুক ফাটা কান্নার দল। ক্রীতিকের উপর অভিমানের ঘট যখন পরিপূর্ন ওর হৃদয়ে, তখনই অরুর মনে হলো,
—-না এসেছে ভালোই হয়েছে, ভুলেও যদি এসব কাহিনি জানতে পারতো তাহলে রাজের সাথে সাথে আমাকেও থা’পরিয়ে চান্দে পাঠিয়ে দিতো নিশ্চিত। যা হয়, তা বোধ হয় ভালোর জন্যই হয়, এবার আজকের দিনটা কোনোমতে বিগড়ে দিতে পারলেই হলো, পরে নাহয় রাজকে আমি সবকিছু বুঝিয়ে বলবো। আর তারপর মাকেও।

অরুর ভাবনার সুতো ছিড়লো বাইরে থেকে অনুর ডাকে, দরজার বাইরে বারবার ক’রাঘাত করতে করতে অনু বললো,
— কিরে অরু, রেডি হয়েছিস? দরজাটা খোল, তোকে যেতে হবেতো।

অনুর উপস্থিতি টের পেয়ে অরু মনেমনে চিন্তা করলো,
— আপাকে একবার বুঝিয়ে বললে কেমন হয়? আপাও তো একজনকে ভালোবাসে, ও নিশ্চয়ই বুঝবে।

— অরু দরজা খোল, সবাই অপেক্ষা করছে তো।
পুনরায় অনুর খাদে নামানো কন্ঠ কানে এলে, অরু এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।

ভেতরে প্রবেশ করে অরুর এমন অগোছালো বিমূর্ষ রূপ দেখে অনুর চোখ কপালে উঠে যায়, ও তৎক্ষনাৎ দরজাটা লাগিয়ে অরুর কাছে এগিয়ে এসে ঝাঁজিয়ে বললো,
— রেডি হসনি কেন এখনো?কি চাইছিস? মা আবারও তোর উপর রেগে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পরুক? আবারও এতিম হতে মন চাইছে?

অরু এবার কান্না ভেজা গলায় অনুকে অনুরোধ করে বললো,
— আমি এসব দেখাদেখি করতে চাইনা আপা, তুই প্লিজ মাকে একটু বোঝা, তোকে আমি সব বলবো, তার আগে তুই কিছু কর।

অনু অরুর চিকন বাহুটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
— আমাকে কিচ্ছু বলতে হবেনা, এখানে মায়ের সম্মান জড়িয়ে আছে, মা নিজে ওদেরকে ইনভাইট করেছে তোকে দেখার জন্য, আর এখন তুই বলছিস যেতে পারবি না?

অরু কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— যদি বলি আমি কাউকে ভালোবাসি?

অরু ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
— কে সে, শুনি?

অষ্টাদশী অপারগ অরু নিজের মায়ের সৎ ছেলের নামটা উচ্চারণ করার সাহস আর পেলোনা, সব তচনচ হয়ে যাবে সেকথা ভেবে।
অরু চুপ হয়ে আছে দেখে অনু খিটমিটিয়ে উঠে বললো,
— মিথ্যে কথা বলার আর যায়গা পাস না?আমাকে বোকা না বানিয়ে চুপচাপ রেডি হ।

— আপা বিশ্বাস কর আমি মিথ্যা বলছিনা, তুই কিছু একটা কর আপা। আমাকে এভাবে ভরা নদীতে ঠেলে দিস না।

বোনের এরূপ কাকুতি মিনতি দেখে মন গললো অনুর, কিন্তু মায়ের সম্মানেরও তো একটা ব্যাপার আছে,তারউপর মা অসুস্থ এসপারওসপার হয়ে গেলে মায়ের যদি শারীরিক কিছু ক্ষতি হয়ে যায়? সেই ভয়ে তটস্থ অনু। তাই ও নিজের কঠিন সুরটা একটু নরম করে অরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
— দেখ বোন, আগেও বলেছি এখনো বলছি, দেখতে এলেই বিয়ে হয়ে যায়না। ওরা শুধু দেখে যাবে এই যা। তাছাড়া আজকের দিনটা কোনোমতে চলে গেলেই দেখবি সব সমস্যার সমাধান, পরে না হয় রাজ কে একান্তে বুঝিয়ে বলিস তোর সমস্যা গুলো। এখন দেরি না করে চল।মা সেই কখন থেকে অতিথিদের সামনে বসে আছে।

আপার কথায় বেশ আস্বস্ত হলো অরু। বুকের ভেতরটা অনেক হালকাও লাগছে এখন। ঠিকই তো আজকের রাতটা মানে-মানে চলে গেলে রাজকে ভালোমতো বুঝিয়ে বলতে হবে। তাহলে রাজই সব কিছু মিটিয়ে ফেলতে পারবে। এসব ভাবতে ভাবতে অরুর কান্নাকাটিতে একটু ভাটি পরলে অনু শাড়ি হাতে নিয়ে বললো,

— আয় পরিয়ে দিই।

*****************************************
অনু অরুকে আনতে রুমে গিয়েছে, এদিকে অনবরত কলিং বেলের আওয়াজ ভেসে আসছে তখন থেকে। কি জানি কে এমন ভাবে কলিং বেলে চাপছে। অনু ধারেকাছে নেই বলে আজমেরী শেখ এবার নিজেই উঠে গেলেন দরজা খুলতে। অতিথিরা সবাই গোল হয়ে কাউচে বসে আছে, রাজ ও আছে, অফ হোয়াইট কালারের প্রিন্স কোর্টে তাকে বেশ সুদর্শনই লাগছে। রাজ ছোট বেলা থেকেই আমেরিকাতে বড় হয়েছে। ওর পুরো চোদ্দগোষ্ঠী আমেরিকান নাগরিক , সবাইই এখানকার বড়বড় ব্যাবসায়ী কিংবা চাকুরীজীবি। সেই হিসেবে পাত্রী দেখতে আসায় কোনোরূপ ত্রুটি রাখেননি তারা ভরপুর এনেছেন, তারউপর এসেছেও অনেকজন। পুরো বসার ঘর মানুষে গিজগিজ করছে এই মূহুর্তে ।

ঠিক সেই সময়ই আগমন ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত একজনার, সে আর কেউ না, মিসেস অরোরা জায়ানের লিগ্যাল গার্ডিয়ান,মি. জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী।

আজমেরী শেখ দরজা খুলতেই চোখের সামনে প্রত্যয়কে দেখতে পায়, প্রত্যয়কে দেখে তিনি ভেবেছেন হয়তো কোনোরূপ অফিসিয়াল কাজেই তার আগমন, কিন্তু তারপর পরই প্রত্যয়ের পেছন থেকে বেড়িয়ে আসে আরেকজন। যদিও এটাই প্রথম সাক্ষাৎ, তবুও এই লম্বা সুদর্শন ছেলেটাকে চিনতে খুব একটা সমস্যা হলোনা আজমেরী শেখের, তিনি ক্রীতিককে দেখা মাত্রই তাচ্ছিল্য হেসে বললেন,
— জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী, এইখানে? অহংকার ভাঙলো তবে? তা আগমনের কারনটা জানতে পারি?

ক্রীতিক আজমেরী শেখের একটা কথারও জবাব না দিয়ে হনহনিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো, ওর পেছন পেছন প্রত্যয়ও। ভেতরের সবাই ক্রীতিককে দেখে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো বটে, সবার মনে একটাই প্রশ্ন,
— এ আবার কে? আদৌও বাঙালি, নাকি বিদেশি? চেহারা দেখেতো মনে হচ্ছে দুটোর মিক্সড।

ক্রীতিক জিভ দিয়ে গাল ঠেলে এগিয়ে গিয়ে আজমেরী শেখের ব্যক্তিগত ডিভানের উপর পায়ে পা তুলে বসে পরলো। ক্রীতিকের বে’য়াদবি দেখে আজমেরী শেখ এগিয়ে এসে অস্পষ্ট সুরে বিড়বিড়িয়ে ক্রীতিকের উদ্দেশ্যে বললেন,
— এটা আমার বসার যায়গা, গেট আপ।

ক্রীতিক পা দুলাতে দুলাতে বললো,
—আমার কোম্পানির টাকায় কেনা। ইনভেস্ট ফ্রম জেকে গ্রুপ? এম আই রাইট?

— কোম্পানির ধারে কাছেও তো আসোনা, আমার নিজের কোম্পানি দাবি করছো?

ক্রীতিক রহস্যের হাসি হেসে বললো,
— আমি যদি সারাজীবনও কোম্পানির ধারে কাছে না যাই, তাও জেকে গ্রুপ আমারই থাকবে।

আজমেরী শেখ নিজের রাগ টুকু সংবরণ করে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,
— কি চাইছো কি তুমি ক্রীতিক, কেন আমার বাসায় অহেতুক এসে ঝামেলা পাকাচ্ছো?

জবাবে ক্রীতিক বললো,
— ঝামেলা পাকাবো কেন আশ্চর্য ? কি প্রোগ্রাম হচ্ছিল এখানে? প্রোগ্রাম করুন না, আমার কোনো অসুবিধা নেই আমিও দেখছি।

ক্রীতিকের কথায় আজমেরী শেখ ওর দিকে বিরক্তির দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে দেখে ক্রীতিক পুনরায় বললো,

—কেন, আমি ইনভাইটেড না? তাছাড়া ইনভাইট দিয়ে করবো টা কি?আফটার অল উই আর ফ্যামিলি। রাইট মামুনি?

আজমেরী ঠিকই বুঝলেন, যেই ছেলে সারাজীবন উনি উনি করে কথা বলেছে। জীবনে এইটুকু সম্মান পর্যন্ত দেয়নি, তার হটাৎ করে মামুনি ডাকে নিশ্চয়ই কোনো ঘাবলা আছে। তবুও চোখের সামনে এতোগুলা মেহমান দেখে দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইলেন তিনি। ঠিক তখনই সবার কৌতুহল, অযাচিত প্রশ্ন সবকিছুকে জলাঞ্জলি দিয়ে অরুকে নিয়ে অনু প্রবেশ করে বসার ঘরে। অরুর পরনে পিচ কালারের জামদানী শাড়ি, হাতে স্বর্ণের বালা। মাথায় ছোট্ট করে ঘোমটা টানা, দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে।

কিন্তু অরুর এই সৌন্দর্য দেখে ক্রীতিকের র’ক্ত গরম হয়ে উঠেছে মূহুর্তেই। শরীরের শিরা উপশিরায় সেই টগবগে র’ক্তের উত্তাল ক্রোধ কোনোমতে ধামাচাপা দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে অনবরত পা দোলাচ্ছে সে।

অনু এগিয়ে এসে অরুকে রাজের মুখোমুখি কাউচে বসিয়ে দেয়। এতোক্ষণ মাথা নুয়িয়ে রাখার জন্য ক্রীতিককে খেয়াল না করলেও কাউচে বসার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিককে দেখে অরুর মুখ যেনো থেকে র’ক্ত সরে গেলো। প্রকট আতঙ্কে অজান্তেই নিজেই খামচে ধরলো নিজের শাড়ি। ক্রীতিক এই মূহুর্তে দু আঙুলে কপাল ঘষতে ঘষতে অরুর দিকেই গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পরনে তার সিলভার কালারের ব্র্যান্ডেট শার্ট। শার্ট গলিয়ে শক্ত হয়ে থাকা হাতের জিম করা পুরুষালী পেশিগুলো স্পষ্ট দৃশ্যমান। ক্রীতিককে এভাবে হুট করে এই সময় দেখতে পেয়ে, ক্রীতিকের আ’গুন চোখে চোখ রেখেই তিরতিরিয়ে কাপছে অরু।

ওকে এভাবে কাঁপতে দেখে রাজের মা অরুর পাশে এসে বসে ওকে আসস্থ করে বললেন,
— কাঁপছো কেন মা? আমরা আমরাইতো। এক সময় এরাই তোমার আসল পরিবার হবে এতো ভয়’ পাওয়ার তো কিছু নেই।

কে শোনে কার কথা? এই মূহুর্তে কারোর কথায় কোনোরূপ খেয়াল নেই অরুর, ওতো এখনো ক্রীতিকের দিকেই ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ক্রীতিক কি থেকে কি করবে সেই ভয়েই তটস্থ অরু।

ক্রীতিক প্রথমে অরুর থেকে চোখ সরিয়ে চারিদিকে একবার চোখ বোলালো, অতঃপর চট করে উঠে দাড়িয়ে অরুর হাতটা শ’ক্ত করে চেপে ধরে, ওকে টা’নতে টান’তে রুমের দিকে নিয়ে গেলো। ক্রীতিকের হঠাৎ এমন বি’স্ফোরিত কান্ডে সবাই হতভম্ব। কারও মুখে কোনো বাক্য নেই, কি করছে এই ছেলে। ক্রীতিক যখন অরুকে নিয়ে রুমে যাচ্ছিল ঠিক তখনই অরুর অন্য হাত টেনে ধরে রাজ। ক্রীতিক রাজের দিক অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তীর্যক স্বরে বললো,
— হাউ ডেয়ার ইউ।

রাজ একটু সাহস দেখিয়ে বললো,
— সি ইজ নট ইওর প্রোপার্টি।

ক্রীতিক শক্ত গলায় জবাব দিল,
— ইয়েস সি ইজ।

কথাটা বলে ক্রীতিক রাজকে মা’রতে উদ্যত হবে, তার আগেই প্রত্যয় অরুর থেকে রাজের হাত ছাড়িয়ে বললো,
— জানে বাঁচতে চাইলে ছাড়ো রাজ। অরু বিবাহিত। ক্রীতিক ভাই অরুর হাসবেন্ড।

প্রত্যয়ের শেষ কথাতে রুমের প্রত্যেকটা মানুষের মাথায় যেন আকাশ ভে’ঙে পরলো। কি বললো প্রত্যয় মাত্র এটা? আদৌও ঠিক শুনেছে তো সবাই? আজমেরী শেখ আর অনুতো বাকরুদ্ধ পুরোপুরি। ক্রীতিক সেসবের দু পয়সা তোয়াক্কা না করে প্রত্যয়কে বললো,
— আবর্জনা গুলো পরিষ্কার করো, এস সুন এস পসিবল। আর যেন এদের চোখের সামনে না দেখি আমি।

প্রত্যয় হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক অরুকে নিয়ে রুমে গিয়ে ঠাস করে রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়। অরু জানে ওর কপালে শনি নৃত্য করছে, তাই ভয়ের চোটে কুকরে আছে মেয়েটা।

ভেতরে এসে অরুকে সোজা দাঁড় করিয়ে শার্টের হাতাটা গুটিয়ে ওর গালে নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চপেটাঘা’ত করলো ক্রীতিক। সঙ্গে সঙ্গে ছি’টকে মেঝেতে গিয়ে পরলো অরু। ঢিলে খোপা করা লম্বা চুলগুলো বাধন হারা হয়ে পরলো মূহুর্তেই। মেঝেতে বসে নিজের মুখটা দু-হাতে চেপে ধরে তীব্র কা’ন্না সংবরণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে অরু। ক্রীতিককে দেখতে কি ভ’য়ান’কই না লাগছে। আগুনের শিখার মতো চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছে আজ ওর খবর করে ছাড়বে ক্রীতিক। ক্রীতিক নিজের অন্য হাতাটা গুটাতে গুটাতে এগিয়ে এসে অরুকে বললো,
— এটা কেন দিলাম জানিস? আমার বউ হয়েও অন্যকারও সামনে বউ সেজে বসার স্পর্ধা দেখানোর জন্য।

অরুকে শক্ত হাতে টেনে তুলে ক্রীতিক ওর অন্যগালে থা’প্পড় দিতে উদ্যত হলে, অরু চোখ দুটো বন্ধ করে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
— ব্যাথা পাচ্ছি, কষ্ট হচ্ছে আমার, আর মা’রবেন না, আআমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি, আপা বলেছিল দেখতে এলেই বিয়ে হয়ে যায়না। তাছাড়া আপনিও তো আসেননি এই কদিন কি করতাম আমি?

ক্রীতিক আর মা’রলো না ওকে, হাত নামিয়ে রেগেমেগে ওর গলাটা চেঁ’পে ধরে হিসহিসিয়ে বললো,
— একবার ফোন করতে পারতি না? আমি আদৌও বেঁচে আছি কি ম’রে গিয়েছি সেটা অন্তত খোঁজ নিতে পারতি। বিধবা হওয়ার এতো শখ?

অরু কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— কি বলছেন এসব, ফোন তো আমার কাছে ছিলোই না মা নিয়ে গেছে সেই কবে।

ক্রীতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অরুর গলা ছেড়ে দেয়। ফর্সা গলাটা আঙুলের চাপে র’ক্তিম হয়ে উঠেছে। ক্রীতিক তীক্ষ্ণ চোখে সেদিকে একবার নজর দিলো, তারপর অরুর বাহু ধরে ওকে কাছে নিয়ে এসে ওর সুন্দর কারুকাজ করা ব্লাউজের দুটো হাতাই একটানে ছি’ড়ে ফেললো ক্রীতিক। ওকে রেখে হঠাৎ ওর জামাকাপড় টেনে ছিঁ’ড়ছে দেখে অরু আঁতকে উঠে বললো,
— কি করছেন এটা?

ক্রীতিক অরুর চুলের গার্ডার, ঠোঁটের লিপস্টিক, চোখের কাজল সব কিছু নিজ হাত দিয়ে একেএকে লেপ্টে দিতে দিতে চোয়াল শক্ত করে বললো,
— অন্যকারোর সামনে নিজের সৌন্দর্য বিলাতে কেন গেলি অরু? আমার রা’গ কমছে না কিছুতেই, তোকে মার’তেও পারছি না, কলিজায় লাগছে। উল্টে আমিই ব্যাথা পাচ্ছি, ইচ্ছেতো করছে নিজেকে নিজেই…

ক্রীতিক কথা শেষ করার আগেই নিজের নরম তুলতুলে হাত দিয়ে ওর মুখটা চেপে ধরলো অরু, অতঃপর ক্রীতিকের চোখে চেয়ে, কাঁদতে কাঁদতে এদিক ওদিক না সূচক মাথা নাড়ালো।

অরুর এমন প্রতিক্রিয়ায় ক্রীতিকের কি না কি হলো কে জানে? ও হুট করেই অরুকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে ওর লালচে হয়ে যাওয়া র’ক্তাক্ত গলায় স্ব-গতিতে মুখ ডুবিয়ে দিলো। ক্রীতিক জিদের বশবর্তী হয়ে ক্রো’ধটা একটু বেশিই ঢালছিল অরুর উপর, তবুও চোখ মুখ খিঁচে পুরোটাই সহ্য করে নিলো অরু। এই মিষ্টি যন্ত্রনাটুকু বোধ হয় ওর পাওনা ছিল।

ওদিকে বাইরে থেকে দরজা ধা’ক্কাতে ধা’ক্কাতে হয়রান হয়ে উঠেছেন আজমেরী শেখ। প্রচন্ড মানসিক চাপ আর হঠাৎ রেগে যাওয়ার ফলপ্রসূ শ্বাসপ্রশ্বাস বেড়ে গিয়েছে তার। মাকে এভাবে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে দেখে অনু তরিঘরি হয়ে মাকে বসার ঘরে নিয়ে এসে বললো,
— তুমি একটু বসো মা, আমি ডাকছি ওদের।

প্রত্যয়ও বাইরেই দাড়িয়ে ছিল এতোক্ষণ, মাত্র অনুকে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে ও নিজেও এগিয়ে গেলো অনুর পিছু পিছু । যেতে যেতে পেছন থেকে প্রত্যয় বললো,
— এখন না ডাকলেই ভালো হবে ভাই খুব রেগে আছে।

প্রত্যয়ের কথায় অনু ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,
— খবরদার আর একটাও কথা যদি বলেছেন, আপনি সব জানতেন, অথচ আমাকে বোকা ভেবে দিনের পর দিন ভালোবাসা দেখিয়ে আমার পিঠেই ছু’রি মে’রেছেন।

প্রত্যয় আশ্চর্য হয়ে বললো,
— আমি কি করলাম আজিব?

— আপনি আমাকে বলেননি কেন যে অরু এতোবড় একটা অন্যায় কাজ করেছে।

প্রত্যয় ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
— কি অন্যায় করেছে অরু?

অনু এবার হাটার গতি থামিয়ে ঘুরে দাড়িয়ে বললো,
— সৎ ভাইকে বিয়ে করা অন্যায় নয়? অরু নাহয় ছোট মানুষ, কিন্তু ক্রীতিক ভাইয়া? সে তো ছোট নয়, তাহলে তিনি এটা কিভাবে করলেন? কিসের প্র’তিশোধ নিতে উনি আমাদের মুখে এভাবে চুনকালি মাখালেন? আমার বোনের জীবনটা ন’ষ্ট করলেন?

প্রত্যয় এবার একটু রেগে গিয়ে বললো,
— ধর্মে, কিংবা আইনে ওদের বিয়ের সম্পূর্ণ বৈধতা আছে, তাহলে চুনকালির কথা কোথা থেকে আসছে অনু?

অনু তেতে উঠে বললো,
— আপনি সমাজ বোঝেন? সারাজীবন তো থেকেছেন অসামাজিক জায়ান ক্রীতিকের সাথে সাথে , তাহলে কি করে বুঝবেন সমাজের মর্ম? আজ বাদে কাল যখন পুরো সমাজ আমাদের পেছনে কথা বলবে,ছি ছি বুলি আওড়াবে, সবাই কানাঘুষা করবে, যে আজমেরী শেখ টাকার জন্য নিজের সৎ ছেলের গলায় নিজেরই মেয়েকে গছিয়ে দিয়েছেন। তখন আপনাদের মতো মানুষের গায়ে না লাগলেও সমাজের অ’পমান আর বিদ্রুপে আমাদের তিন মা মেয়ের ম’রে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। কারণ সমাজে এক ঘরেদের কোনো স্থান নেই।

অনুর একনাগাড়ে বলা হাজারটা যুক্তির পাছে প্রত্যয় আর কোনো যুক্তিই খুঁজে পেলোনা অনুকে ঘায়েল করার জন্য, তাই ও সহসা ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো নিঃশব্দে। আর অনু গটগটিয়ে এগিয়ে গেলো অরুর রুমের দিকে।
*****************************************

দুইপাশে দুটো ডিভানের উপর পায়ে পা তুলে মুখোমুখি হয়ে বসে আছে আজমেরী শেখ আর জায়ান ক্রীতিক। অনেকক্ষণ ধরেই তাদের মাঝে পুরোদস্তুর নিরবতা বিরাজমান। ওদের থেকে একটু খানি দূরে দাড়িয়ে আছে অনু, প্রত্যয়, আর অরু। জামা কাপড় পাল্টে, ওড়না দিয়ে গলার কলার বোনগুলো খুব সাবধানে ঢেকে তবেই বেরিয়েছে অরু , নয়তো খানিকক্ষণ আগে পুরো গলায় ক্রীতিকের জিদের তোপে করা দাগগুলো সবার সামনে উন্মুক্ত বই হয়ে যাবে অনায়াসে । এই মূহুর্তে অরু সবার আড়ালে মাথা নুয়িয়ে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন ওই মস্ত বড় অ’পরাধী, আর এখানে ওর বিচার সভা বসেছে।

চারিদিকের থমথমে পরিবেশটাকে আরও খানিকটা গুমোট করে দিয়ে আজমেরী শেখ বললেন,
— আমার মেয়েটাকে বলির পাঁঠা কেন বানালে ক্রীতিক?

ক্রীতিক ভাবলেশহীন কন্ঠে বললো,
— ফার্স্ট অফ অল আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করেছি, বলির পাঁঠা বানায়নি, আর সেকেন্ডলি আই থিংক সি ইজ মাই হার্টবিট।

ক্রীতিকের কথায় চটে গেলেন আজমেরী শেখ, দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— মজা করছো আমার সাথে? নিজের সৎ বোনকে বিয়ে করতে লজ্জা করলো না তোমার?

ক্রীতিক বাঁকা হেসে নিজের ঠোঁট কামড়ে বললো,
— শুধু বিয়ে নয়, আরও অনেক কিছু করেছি , এই যে একটু আগেও করেছি, কিন্তু বিশ্বাস করুন একটুও লজ্জা লাগেনি, কেনইবা লজ্জা লাগবে বলুন? বউ হয় তো। যেই পুরুষ বউয়ের সামনে লজ্জা পায় সে আবার কেমন পুরুষ?

ক্রীতিকের কথায়, অনু আর আজমেরী শেখ দুজনই অ’গ্নি দৃষ্টিতে তাকালো অরুর পানে, যে এই মূহুর্তে মাথা নিচু করে ফোপাঁচ্ছে।

— ওর দিকে তাকিয়ে লাভ নেই, আমার বউকে আমি যেটা বলবো ও সেটাই করবে।

ক্রীতিকের কথায় আজমেরী শেখ চোখ ঘুরিয়ে বললেন,
— তুমি একা একা থেকে, আমেরিকান কালচারে বড় হয়ে একটা বেহায়া তৈরি হয়েছো। আর তুমি যেটাকে বিয়ে, ভালোবাসা বলছো না? এটা আসলে ভালোবাসাই নয়, ইটস ইওর অবসেশন, আনহেলদি অবসেশন, যার স্বীকার হয়েছে আমার মেয়েটা। নয়তো নিজের হাটুর বয়সী একটা মেয়েকে কে ভালোবাসে?

আজমেরী শেখের কথায় ক্রীতিক ঠোঁট উল্টে বাহবা দিয়ে বললো,
— আপনি সত্যিই জিনিয়াস, না হলে এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে বুঝে গেলেন জিনিসটা? আর আমি কখন বললাম যে আমি অরুকে ভালোবাসি? আমি ওর প্রতি অবসেশট আনহেলদি রকম অবসেশন। আর এটাই সত্যি।

এখন আপনি সেটা ভালোয় ভালোয় নেবেন, নাকি নেবেন না, সেটা একান্ত আপনার ব্যাপার, বাট আমার বউকে আমি চাই, ব্যাস।

কথাটা শেষ করে তরাগ করে দাঁড়িয়ে পরে ক্রীতিক।
অতঃপর অরুর দিকে একপলক তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্রীতিক বলে,
— কিছুদিন সময় নিন, মন দিয়ে ভাবুন, বিয়েটা যেহেতু হয়েই গিয়েছে তারমানে, সি বিলোংস টু মি। তাই আপনাকে জোরজবর’দস্তি করে অরুকে কষ্ট দিতে চাইছি না।

তবে হ্যা আমার বউকে অন্যকারও সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন নয়তো আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। এন্ড আই মিন ইট। কথাটুকু শেষ করে গটগটিয়ে যায়গা ত্যাগ করে ক্রীতিক।

অরুর বিয়ে হয়ে গেছে, আজমেরী শেখ চাইলেও আর মেয়েকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে আটকাতে পারবেননা,কোথাও বিয়ে দিতে পারবেন না, ক্রীতিক যা চাইবে তাই করতে হবে, ব্যাপারটা বুঝে আসতেই অকস্মাৎ ক্ষে’পে গেলেন তিনি, তৎক্ষনাৎ উঠে দাড়িয়ে টেনে এনে এলোপাথারি চ’ড় বসাতে লাগলেন মেয়ের দুইগালে। হঠাৎ এভাবে এলোপাথাড়ি থা’প্পড়ে অরুর মাথায় চ’ক্কর দিচ্ছে বারবার, ও কাঁদতে কাঁদতে মাকে আকুতি করে থামতে বলছে, তবুও আজমেরী শেখের হাত থামছে না, ওকে মা’রতে মা’রতে তিনি কাঠিন্য সুরে বললেন,
— একটা নোংরা কীট জন্ম দিয়েছি আমি, বেহায়া, নির্লজ্জ,নষ্টা, নিজের থেকে বারো বছরের বড় সৎ ভাইয়ের সাথে শুতে একটুও লজ্জা করলো না তোর?

মায়ের কথায় অরু যেন আকাশ থেকে পরলো, কি বলছে মা এসব? তার আর জায়ান ক্রীতিকের সম্পর্ক তো এতোটাও গভীরে যায়নি, আর মা কিনা এতো নোংরা চিন্তা করে ফেলেছে?ছিহ!
কথাটা ভাবতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো অরু। ওদিকে অরুর কান্নার আওয়াজ কানে পৌঁছতেই দরজার কাছে থেকে পুনরায় তরিৎ বেগে ফিরে এলো ক্রীতিক, হাতদুটো মুঠিবদ্ধ করে রেগেমেগে এদিকেই এগিয়ে আসছে ক্রীতিক, তা দেখে মায়ের হাত চালানোকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে দৌড়ে গিয়ে হাঁটু মুড়ে ক্রীতিকের পায়ের সামনে বসে পরলো অরু, ওর সামনে হাতজোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— হাত জোর করছি, আর অশান্তি করবেন না, মা এমনিতেই অসুস্থ।এতো চাপ নিতে পারবেন না তিনি। আমি কথা দিচ্ছি আপনি ছাড়া এই জীবনে অন্য কোনো পুরুষের সামনে আর নিজেকে উপস্থাপন করবো না আমি।কোনোদিনও না।তাও আপনি ফিরে যান দয়া করে।

ক্রীতিক অরুর মুখোমুখি হয়ে বসে সকলের সামনে অরুর ঠোঁটে আর কপালে আলতো চুমু খেলো, তারপর ওর গালে হাত বুলিয়ে বললো,
— তুই কেন পায়ে পরছিস জান? তোর জায়গাতো আমার বুকে।

ক্রীতিকের আদুরে আওয়াজে আবারও ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো অরু, ক্রীতিক নিজের অন্য হাতটা অরুর আরেকগালে ছুয়িয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো,
— বিশ্বাস কর অরু, তোর কষ্ট দেখে আমার হৃদয় ছি’ড়ে যাচ্ছে, একবার শুধু বল, তুই আমার সাথে যাবি, বাকিটা আমি বুঝে নেবো।প্লিজ বল।

অরু নিজের হাত দিয়ে ক্রীতিকের হাত ধরে বললো,
— একটু সময় দিন আমাকে, আমি আপা আর মাকে ঠিক বোঝাতে পারবো।

অরুর কথায় ক্রীতিকের সাভাবিক মুখশ্রীটা মূহুর্তেই কঠিন হয়ে উঠলো, ও অরুর দিকে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ছু’ড়ে বললো,
— মা আর আপা যদি তোর কাছে এতোটাই প্রয়োজনীয় হয়, আমার কথা যদি তোর কাছে এতোটাই অগ্রাহ্য মনে হয়, তাহলে আমিও তোকে আর জোর করবো না।আমার কাছে যেতে হবেনা তোকে, থাকতে হবে না আমার সাথে। তবে হ্যা, আমাকে খুজে না পেলে আবার কান্না করিস না যেন। বিকজ আই হেইটস ইউর টিয়ারস বেইবি।

নিজের কথা শেষ করে এক মূহুর্তও ফুরসত না দিয়ে বাসা থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো ক্রীতিক।

অরু এখনো অবাক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে, ক্রীতিকের শরীরের মাতাল করা স্যান্ডাল উডের গন্ধটা এখনো চারিপাশে ম ম করছে। এইতো একটু আগেও দু’হাত দিয়ে অরুকে ছুঁয়েছিল সে, আর এখন কোথাও নেই সবকিছু কেমন শূন্য। গলার ভেতর দলা পাকিয়ে আছে অজস্র কান্নারা,যার দরুন নাকের ডগাটা বারবার ফুলে উঠছে অরুর । ওর ছোট্ট মস্তিষ্কটা এখনো ঠিক ধরতে পারছে না, একটু আগে কি বলে গেলো ক্রীতিক? কিইবা বোঝালো ওই কঠিন কথাগুলো দ্বারা?
চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here