#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ৩৪
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[ক’পি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য ]
আকাশে শুক্লপক্ষের মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে, তার চারিপাশে তারকারাজির নির্ভীক অবস্থান। মিটিমিটি জ্বলন্ত তারকারাজি আর চাঁদের রূপোলী আলোয় ভেসে যাচ্ছে নির্জন পাহাড়ি শহরতলীর রাস্তাঘাট।
ভোরের দিকে সেই যে একপশলা ঝুম বৃষ্টি হলো, তারপর থেকেই আকাশ পরিস্কার। রাতের আকাশে পেজা তুলোর মতো উড়ো মেঘের আড়ালে ক্ষনে ক্ষনে গা ঢাকা দিচ্ছে শুক্লপক্ষের সুন্দরী চাঁদ। তাই জোস্ন্যা রাতের নিয়ন আলো ছাপিয়ে একটু একটু আলোছায়া এসে খেলা করছে পর্দা সরিয়ে রাখা অত্যাধুনিক মাস্টার বেড রুমের আনাচে কানাচে ।
অরু আজ সন্ধ্যা হতে না হতেই রুমের সবকটা আলো নিভিয়ে পারি দিয়েছে ঘুমের দেশে , যদিও বা ক্রীতিক মুখে অনেক কিছুই বলেছিল, তবে কার্যত অনলাইনে অরুর সবরকম প্রয়োজনীয় জিনিস অর্ডার করে দিয়েছে সে। কারণ আর যাই হোক অরুকে কোনোরূপ অসস্থিতে দেখতে চায়না ক্রীতিক,তাও ওর নিজের বাড়িতে বসে।
এই যেমন আজ সারাদিন অরুর ভীষণ মন খারাপ ছিল। ক্রীতিকের ভ’য়ে বেচারি বলতেও পারছিল না যে, ও আপা আর মাকে মিস করছে।দুদিন ধরে অরু নেই,তারা কি করছে, কেমন আছে, আদৌও অরুকে খুজছে কিনা সব কিছু নিয়েই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ অরু। সেদিন হৃদ মাঝারে সদ্য গজিয়ে ওঠা প্রনয়ের টানে ক্রীতিকের সঙ্গে চলে এলেও, এখন মা আর আপার কথা মনে পরতেই হৃদয় খামচে ওঠে অরুর। বুকের মাঝে দানাবাঁধে কষ্টরা,সেই কষ্ট প্রতিফলিত হয় ওর চোখে মুখে।
অরুর চুপসে থাকা মলিন মুখ দেখে কিছুটা হলেও ঘটনা আঁচ করতে পারে ক্রীতিক, কিন্তু ওর ও তো কিছু করার নেই, অরুকে যেতে দেওয়া, কিংবা ভুলে যাওয়া, দুটোই পুরোপুরি অসম্ভব ক্রীতিকের পক্ষে। কারন ক্রীতিক ভালো করেই জানে অরুকে যেতে দিলে ও নিজেই বাঁচবে না।তবে ক্রীতিক তো ভারী কঠিন হৃদয়ের মানুষ, তাই নিজের দূর্বলতাটুকু পুরোপুরি আড়াল করে, একটা টিভি আনিয়ে সেটাকে সেট করে দিয়েছে হলরুমের মাঝ বরাবর, নিজের গেমিং মনিটরের পাশেই। এতো বড় টিভি দেখে অরু যখন শুধালো,
— এটা কেন এনেছেন?
তখন জবাবে ক্রীতিক বলে,
— বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাকার মতো টাইম আমার নেই,তাই সময় কাটানোর জন্য এনে দিয়েছি, আমি যখন না থাকবো তখন বসে বসে নেটফ্লিক্স দেখবি।
ক্রীতিকের গমগমে রুষ্ট কথায় মেজাজ খিটখিটিয়ে উঠলো অরুর, তবে এখন পর্যন্ত ঝাজিয়ে তেঁতো গলায় কথা বলার সাহস ওর হয়ে ওঠেনি, তাই অরু সহসাই স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
—- সময়ই যখন নেই,তাহলে অমন মাঝরাতে রাস্তা থেকে নিয়ে এলেন কেন?
ক্রীতিক রিমোট কন্ট্রোলটা ভালোমতো চেক করতে করতে জবাব দেয়,
—- থাকতে পারছিলাম না তাই,তোকে দেখতে ইচ্ছে করলে হাজারটা ব্যস্ততাকেও পায়ে ঠেলে দিতে পারি আমি। তাই আমার ফিলিংস নিয়ে এতো ভাবতে হবে না তোর। নিজে কেন বাংলার পাঁচের মতো মুখ বানিয়ে রেখেছিস সেটা নিয়ে ভাব।
অরু আর জবাব দিলোনা, ক্রীতিকের সাথে বেহুদা তর্ক করার এনার্জি নেই ওর,মনটা বিষিয়ে আছে সেই সকাল থেকেই, তাই কথা না বাড়িয়ে গটগট করে সিঁড়ি ডিঙিয়ে দোতলায় চলে গেলো অরু। দোতলায় গিয়ে ক্রীতিকের রুমের দিকে আর পা বাড়ালো না ও, বরং উল্টো ঘুরে বিপরীত পার্শে ওর আর অনুর জন্য বরাদ্দ কৃত সেই আগের রুমটায় প্রবেশ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই নিঃশব্দে তলিয়ে গেলো ঘুমের দেশে।
.
অরু অন্যরুমে গিয়ে শুয়েছে ব্যাপারটা নজরে আসতেই, ক্রীতিকের তীক্ষ্ণ চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠলো। অকস্মাৎ র’ক্ত টগবগিয়ে উঠলো ধমনীর শিরায় শিরায়, এমনিতেই অরুর বিষন্ন মুখ আর উদাসীনতায় ক্রীতিকের মেজাজটা বিগড়ে ছিল সারাদিন , তারউপর এখন আবার অরুর এমন কান্ড। ক্রীতিকের শক্তপোক্ত চওড়া বক্ষ ছাড়া অরু অন্যকোথাও মুখ দাবিয়ে ঘুমাবে সেটা বোধ হয় ক্রীতিক কল্পনাতেও ভাবতে চায়না,আর অরু কিনা একদিনের মাথায়ই অন্য রুমে গিয়ে শুয়ে পরলো? কথাটা ভাবতেই ক্রোধটা তুঙ্গে উঠে এসেছে ওর। হঠাৎ বেড়ে ওঠা তীব্র ক্রোধটাকে কোনোমতে ঠোঁট কামড়ে সংবরণ করে,দু’আঙুলে নিজের গলাটা ঘষতে ঘষতে কিছু একটা ভাবলো ক্রীতিক। অতঃপর চট করেই উঠে চলে গেলো দোতলায় অরুর ঘরের দিকে ।
.
প্রকট আক্রোশ আর চরম বিরক্তি নিয়ে রুমের মাঝে পা বাড়াতেই, ঘুমন্ত অরুকে দেখা মাত্র পা দুটো সহসা ধীর হয়ে যায় ক্রীতিকের, সেই সাথে মস্তিষ্কের জ্বলন্ত ক্রোধে ভাটি পরে তৎক্ষনাৎ, রুমের পর্দাগুলো আলগোছে ঠেলে ধীর পায়ে, ঘুমন্ত নিষ্পল অরুর দিকে এগিয়ে আসে ক্রীতিক।
খানিকক্ষন সেই ঘুমন্ত মুখটা মনদিয়ে পরখ করে ওকে দু-হাতে তুলে নিয়ে নিজের রুমের দিকে ফিরে যেতে যেতে হিসহিসিয়ে ক্রীতিক বলে,
— তোর ঘুম তোকে বাঁচিয়ে দিলো অরু, নয়তো আজ আমি তোর ঠিক কিই হাল করতাম সেটা নিজেও জানিনা। আজ তুই টের পেতিস জায়ান ক্রীতিকের রোমাঞ্চ আদতে কতটা মারাত্মক। যেটা সহ্য করতে পারবি না তার জন্য উইশ করিসনা হার্টবিট।কষ্টটা তোরই হবে।
***********************************************
অরু সন্ধ্যাবেলায় ঘুমিয়েছে, আর এখন রাতের শেষ প্রহর চলমান, ঘড়ির কাটায় ঠিক কয়টা বাজে জানা নেই অরুর, জানার অবশ্য কথাও নয়, ও তো ঘুমের ঘোরে বুদ হয়ে আছে এখনো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, অরুর মনে হচ্ছে কয়েকক্রোশ দূর থেকে ওকে কেউ গলা উঁচিয়ে ডাকছে, গলার আওয়াজ স্পষ্ট নয়, তাই অরু এবার ঘুমের ভ্রম কাটিয়ে একটু সচকিত হলো, অতঃপর খেয়াল করে শোনার চেষ্টা করলো সেই দূরের আওয়াজ। এবার চোখ বুজেই সুস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে এলো অরুর কানে, কয়েকক্রোশ দূর থেকে নয় বরং খুব কাছে, একেবারে কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে হাস্কিস্বরে ডাকছে ক্রীতিক,
— আমার ঘুম পরী উঠে পরো।
ক্রীতিকের তপ্ত নিঃশ্বাস, আর আলতো ঠোঁটের পরশ ক্রমশই কানে গলায় এসে স্পর্শ করছে ওর,ক্রীতিকের এহেন নেশা ধরানো স্পর্শে অগত্যাই ঘুম ছুটে গেলো অরুর। ও চট করেই চোখ দুটো খুলে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
—- কি বললেন? আবার বলুন।
ক্রীতিক উঠে দাড়িয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
—- বলেছি অনেক ঘুম হয়েছে, এবার উঠে পর,বের হবো আমরা।
অরুর স্পষ্ট মনে আছে, ক্রীতিক বেশ নরম গলায়, আদুরে ভাষায় সম্মোধন করেছিল ওকে,অথচ এখন তার পুরোপুরি বিপরীত, তবে এসবের বাইরেও যেই প্রশ্নটা সবার আগে অরুর মস্তিষ্কে গিয়ে ঠেকলো সেটা হলো,
—- এই ভোর রাতে কোথায় যাবেন উনি?
অরুকে ভাবতে দেখে ক্রীতিক বললো,
— এখন আবার দিবাস্বপ্ন দেখা শুরু করলি নাকি?
অরু শোয়া ছেড়ে উঠে বসে শুধালো,
— এতো রাতে কোথায় যাবো?
ক্রীতিক অরুকে বাচ্চাদের মতো কোলে তুলে নিয়ে বাইরের দিকে এগোতে এগোতে বললো,
—- আমি যেখানে নিয়ে যাবো, যেদিকে নিয়ে যাবো, যে দেশে নিয়ে যাবো, ইভেন ম’রতে নিয়ে গেলেও, সেখানেই চুপচাপ যাবি তুই ,উইথ আউট এনি কোশ্চেন অর এনি ডাউট ।
অরু নিজের ঝীম ধরা ঘুমুঘুমু মাথাটা ক্রীতিকের কাঁধের উপর এলিয়ে দিয়ে মনেমনে বলে,
—- করবোনা, কখনো কোনো প্রশ্ন করবো না, যেখানে খুশি নিয়ে যাও শুধু এভাবেই নিজের বুকের মাঝে আগলে রেখো,আমি চোখ বন্ধ করে অনুসরণ করবো তোমায়,ইভেন উইথ আউট এনি কোশ্চেন অর এনি ডাউট।
***********************************************
হাইওয়ে রাস্তা ধরে হাওয়ার গতিতে ছুটে যাচ্ছে ইয়ামাহা খচিত গাঢ় নীল রঙের বাইকটা, স্পিডোমিটারের গতি তখনও একশোর কাটা ছুঁই ছুঁই। অরু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে ক্রীতিককে, ও জানেনা ক্রীতিক ওকে ঠিক কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তারউপর ঘুমের রেস এখনো কাটেনি ভালোকরে, কি করেই বা কাটবে? ভোরের আলো ফুটতে এখনো ঢের বাকি। অগত্যাই নিজের টাল সামলানোর জন্য ক্রীতিকের পিঠে মাথা ঠেকিয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে অরু। ওর পরনে এখনো ক্রীতিকের কালোরঙা টিশার্ট আর থ্রী কোয়ার্টার। ক্রীতিকের পরনেও একই রঙের কেলভিন ক্লাইন খচিত টিশার্ট। দেখে মনে হচ্ছে ওরা দুজন পরিকল্পনা করেই একই রকম কাপড় পরিধান করে বেরিয়েছে। যাকে বলে ম্যাচিং ম্যাচিং….
ঘন্টা খানেকের দূর্বার রাইডিং এর পর বাইক এসে থামলো একটা পাহাড়ি রিসোর্টের সামনে, সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় তার অবস্থান।অন্যদিক দিয়ে এলে সোজা রিসোর্টের গেইটে গাড়ি দাড় করানো যেত, অযথা এতোখানি ঘুরে এই পাহাড়ি রাস্তার ঢালে বাইক থামানোর কি মানে আছে জানেনা অরু। রিসোর্টে টাঙানো ল্যানটার্ন আর ফেইরী লাইটের কৃত্তিম আলোয় পাহাড়ের চূড়া থেকে শুরু করে আঁকাবাকা রাস্তা অবধি যতদূর চোখ যায় সবকিছু ঝকঝকে পরিষ্কার। অরু চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ক্রীতিককে শুধালো,
—- এখানে কেন নিয়ে এলেন? এখান থেকে হেটে হেঁটে সিঁড়ি ডিঙিয়ে অতো উপরে উঠতে গেলে জান বেরিয়ে যাবে। আমি পারবো না।
ক্রীতিক নিজের হেলমেট খুলে বাকেট হ্যাট টা পরে নিয়ে তীক্ষ্ণ আওয়াজে বললো,
—- তোকে উঠতে বলেছি আমি?
অরু মুখ কাচুমাচু করে বললো,
—- তাহলে?
ক্রীতিক আর জবাব দিলো না অরুর প্রশ্নের, বরং এগিয়ে এসে অরুকে কোলে নিয়েই, একে একে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগলো পাহাড়ের চূড়ায়,
ক্রীতিকের এহেন কান্ডে অরুর চোখ কপালে উঠে গিয়েছে,সেই সাথে শুকিয়ে গিয়েছে গলার তরল টুকুও, নিজের শক্ত হাতে ক্রীতিকের গলা জড়িয়ে ধরে, জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে কম্পিত কন্ঠে অরু বলে,
—- এভাবে কোলে নিয়ে অতো উপরে ওঠা টা রিস্ক হয়ে যাচ্ছেনা? না মানে এধারওধার হলে যদি কিছু হয়ে….
ক্রীতিক অরুর দিকে না চেয়েই পা চালাতে চালাতে জবাব দিলো,
—- ম’রলে দুজন একসাথে ম’রবো, আর কোনো আপসোস থাকবে না,সেটাই ভালো নয় কি?
—- কিন্তু আপনার তো আমাকে নিয়ে উঠতে কষ্ট হচ্ছে।
ক্রীতিক অরুকে একঝলক দেখে নিয়ে উপরে উঠতে উঠতে বললো,
—- আমি একবারও বলেছি তোকে কোলে নিয়ে উপরে উঠতে আমার কষ্ট হচ্ছে?
ক্রীতিকের কথায় অরু না সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক পুনরায় বলে,
—- তাহলে বেশি বোঝা বন্ধ কর নয়তো মা’র খাবি।
ক্রীতিকের এহেন কথায় অভিমান হলো অরুর, আগে সম্পর্ক যা-ই ছিলো মানা যায়,কিন্তু এখন তো স্বামী হয়ে গিয়েছে,এখনও কিনা ক্রীতিক মা’রতে চায় ওকে?ব্যপারটা বেশ অ’পমান জনক আর লজ্জার ।স্বাভাবিক ভাবে অরুরও খারাপ লেগেছে,তাই দরদ দেখানোর সকল ইচ্ছেকে জলাঞ্জলি দিয়ে আর একটাও কথা না বাড়িয়ে, চুপচাপ হয়ে ক্রীতিকের কোলেই বসে রইলো অরু।
ক্রীতিক যখন পাহাড়ের চূড়ায় এসে অরুকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় তখনো ভোরের আলো ফোটেনি, রিসোর্টের আবছা আলোয় অরু চারিদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে যায়গাটা সংরক্ষিত, কিন্তু আপাতত কোনো মানুষের আনাগোনা নেই এখানে, পেছনে অবস্থিত সফেদরঙা কটেজ গুলোর ব্যাক ইয়ার্ডটা বেশ সুন্দর এবং সুসজ্জিত। আর সামনে রয়েছে বিস্তৃত খোলা আকাশ, অরু যেখানে দাড়িয়ে আছে সেখান থেকে কয়েক কদম এগোলেই গভীর খাদ। সেদিকে ভুলক্রমে উঁকি দিলেও পিলে চমকে ওঠে অরুর, শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যায় শীতল ঠান্ডা স্রোত। অথচ সেখানে গিয়েই পা দুলিয়ে বসেছে ক্রীতিক,বসে থেকেই আঙুলের ইশারায় ডাকলো অরুকে।
ক্রীতিকের ইশারা বুঝতে পেরে অরু,না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
—- আমি ওখানে যাবোনা, আমার ভ’য় করছে,তাছাড়া নিচের দিকে তাকালেই আমার কেমন গা গুলিয়ে ওঠে।
ক্রীতিক খানিকটা দূরে দাড়িয়ে থাকা অরুকে আশ্চর্য কন্ঠে শুধালো,
—– আমি থাকতে ভ’য় কিসের তোর?
ক্রীতিকের এই একটা বাক্যই যথেষ্ট ছিল অরুর আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার জন্য। অরু জানে, জায়ান ক্রীতিক বেঁচে থাকতে ওর শরীরে বিপ’দের সুক্ষ্ম আঁচ ও লাগতে দেবেনা সে, অবশেষে সেই বিশ্বাসের দৃঢ়তা থেকেই সহসা এগিয়ে গিয়ে সাবধানে ক্রীতিকের গা ঘেঁষে পাহাড়ের চূড়ায় বসে পরলো অরু। অরু বসার সঙ্গে সঙ্গে ওর কোলে মাথা এলিয়ে দিয়ে কচি ঘাসে আবৃত মাটির উপর শুয়ে পরে ক্রীতিক। ক্রীতিকের এহেন কান্ডে অরু ধরফরিয়ে উঠে বললো,
—- কি করছেন, খাদে পরে যাবেন তো?
অরু কথায় ক্রীতিক বাঁকা হাসিতে ঠোঁট প্রসস্থ করে, অতঃপর কোনো টু শব্দ না করেই, হাত উঁচিয়ে একটানে অরুর লম্বা চুলের গার্ডারটা খুলে নেয় নিজ হাতে। সঙ্গে সঙ্গে ঝরঝরিয়ে ক্রীতিকের শরীরে আঁচড়ে পরলো রেশমের মতো সিল্কি চুল গুলো। অরুর চুলগুলোকে নিজের বুকে যায়গা করে দিয়ে ক্রীতিক বললো,
—- খোলা চুলে তোকে বরাবরই এট্রাক্টিভ লাগে। আমি পাগল হয়ে যাই দেখলে।
ক্রীতিকের কথায় অরু ভ্রু কুঁচকালো, কি প্রশ্নে কি উত্তর দিলো এই লোক? নিজের বিরক্তিটুকু ঠোঁট কামড়ে সংবরণ করে অরু আবারও শুধালো,
—- কি বলছেন এসব?
ক্রীতিক অরুর হাতটা নিজের চুলের ভাঁজে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো,
— হাত বুলিয়ে দে,ঘুমাবো আমি। কাল সারারাত ঘুমায়নি।
অরু কর্কষ আওয়াজে শুধালো ,
— কেন ঘুমাননি, নিষেধ করেছিলাম আমি?
ক্রীতিক চোখ দুটো বন্ধ করেই জবাব দিলো,
—- তোর জন্যই তো ঘুমাতে পারিনি, নিজের রূপ দেখিয়ে আমাকে সিডিউস করেছিস,তোর শা’স্তি হওয়া উচিৎ।
—- বা-রে আপনি বুঝি আমাকে খুব ঘুমাতে দিয়েছেন? গাড়ির মধ্যেই তো….
কথাটা শেষ করার আগেই নিজের জিভে লাগাম টানলো অরু, কথায় কথায় কিসব বলা শুরু করেছে টের পায়নি তখন, আর এখন নিজের লাগামহীন কথায় নিজেরই লজ্জা লাগছে খুব, মনেমনে ভাবছে,
—- সব দোষ এই জায়ান ক্রীতিকের, ওনার সাথে দুদিন থেকেই ঠোঁট কা’টা হয়ে গিয়েছি আমি। ভবিষ্যতে যে আরও কত অভ্যেস জুটিয়ে ফেলবো তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এখন কি করি?অগত্যাই কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে অরু নরম স্বরে ক্রীতিককে বললো,
—- ঘুমাবেন যখন বাড়িতে ঘুমালেই তো পারতেন? কষ্ট করে এতো দূর রাইড করে আসার কি দরকার ছিল শুনি?
ক্রীতিক ঘুমু ঘুমু আওয়াজে জবাব দিলো,
—- কেন নিয়ে এসেছি সেটা একটু পরেই বুঝতে পারবি।
***********************************************
ক্রীতিক ঘুমিয়েছে অনেকক্ষণ, অরু আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ক্রীতিকের চুলের ভাঁজে, আর মনেমনে ভাবছে,
—- আগে আপনার চোখের দিকে তাকাতেও ভ’য় করতো আমার, মনে হতো এই বুঝি ভাসা ভাসা চোখ দুটো দিয়ে গিলে খাবেন আমাকে, অথচ এখন দেখুন, পুরো দুনিয়ার আড়ালে কতোটা আয়েশ করেই না ঘুমিয়ে আছেন আপনি আমার কোলে।আর আমাকে দেখুন কতোটা নিঃসংকোচে, কতোটা যত্ন করে আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। কেনইবা দেবোনা বলুন, আপনাকে তো আমি ভালোবেসে ফেলেছি, আপনি কি তা জানেন?
অরুর মন গহীনের হাজারও সহজ সীকারোক্তি তখনই থেমে যায়, যখন ও দেখতে পায় চোখের সামনে বিস্তৃত আকাশে কুসুম রঙা সূর্য উদয় হচ্ছে। ভোর হয়েছে,প্রশান্ত মহাসাগরীয় হিমেল হাওয়ায় ছেয়ে যাচ্ছে শরীর,কর্ণকূহরে ভেসে আসছে পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ, আর চোখের সামনে পুরো আকাশ জুড়ে ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে একফালি র’ক্তিম সূর্য কীরন। কি অপরূপ দৃশ্য, এতোটা কাছ থেকে আগে কখনো সূর্যদয় দেখার সুযোগ হয়নি অরুর এটাই প্রথমবার, তাই নিজের ভেতরের চরম উৎকন্ঠাকে দমাতে না পেরে দু’হাতে ঘুমন্ত ক্রীতিকের চুল খামচে ধরে খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠলো ও।
হঠাৎ করেই চুলে বেশ জোরেশোরে টান পরায় অকস্মাৎ লাফিয়ে উঠে বসলো ক্রীতিক,চিৎকার রত অরুর দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
—- কি হয়েছে?
অরু খুশিতে টলোমলো চোখে আঙুল উঁচিয়ে সূর্যদয় দেখালো,ক্রীতিক এবার মৃদু হাই তুলে সেদিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে অরুর দিকে চাইলো, যে এই মূহুর্তে মুগ্ধনয়নে ধরনী জুড়ে সোনালী সূর্যের আগমন দেখছে।
আর ক্রীতিক দেখছে তার অরুকে, নিস্প্রভ চোখে অরুকে দেখতে দেখতেই ক্রীতিকের মন বলে,
—– আমার চাঁদ সূর্য দুটোই তোর মাঝে নিবদ্ধ অরু, তোর মাঝেই তারা উদীয়মান, আবার তোর মাঝেই তারা অস্তমান, আমি কেবল মুগ্ধ নয়নে দেখি আর ভাবি কি অপরূপ তারা।
গলে যাওয়া মোমের নিয়ন অগ্নিশিখায় তোকে প্রথমবার দেখেছিলাম আমি,সেটাই ছিল আমার দেখা সবচেয়ে অপরূপ দৃশ্য। প্রথম দেখাতেই তৃষ্ণার্থ হয়ে উঠেছিলো হৃদয়টা,যে তৃষ্ণা আজও মেটেনি আমার, বরাবরই আমি সার্থপর,আর সার্থপরের মতোই তোকে অতিরিক্ত চাই। সেদিনের পর থেকে এক অষ্টাদশী ছাড়া আর কাউকে মনভরে দেখার ইচ্ছে জাগেনি কোনোকালেই, এ জীবনে আর কোনোদিন জাগবে বলে মনেও হয়না।
ক্রীতিক সেই তখন থেকে তাকিয়ে আছে দেখে অরু একটু ইতস্তত বনে গেলো,নিজের জামা কাপড় কোনোমতে ঠিকঠাক করে মিনমিনিয়ে শুধালো,
—- কি দেখছেন অমন করে?
অরুর প্রশ্নের জবাবে ক্রীতিক ক্ষীণ আওয়াজে বললো,
—- আমার সূর্যদয়।
***********************************************
টিন্ডেট কটেজের জানালা দিয়ে সূর্যদয়ের দৃশ্য স্পষ্ট, অরু কাচের জানালা দিয়ে এখনো সেদিকেই তাকিয়ে আছে।পুরো দৃশ্য উপভোগ করার আগেই ক্রীতিক টেনেটুনে কটেজে নিয়ে এসেছে ওকে, ভারী নির্দয় আচরণ, কিন্তু এই মূহুর্তে ঝগড়া করার মতো সময় নেই অরুর হাতে, ও পুরোটা দৃশ্য ঠিকঠাক ভাবে দেখতে চায়, তাই কটেজের জানালা দিয়েই আপাতত উপভোগ করছে সাদামাটা সূর্যদয়।
কিন্তু এই মূহুর্তে বোধ হয় সেটাও সহ্য হলোনা নির্দয় ক্রীতিকের, ও কোনোরূপ আওয়াজ না করেই এগিয়ে এসে হাট করে লাগিয়ে দিলো জানালাটা। এবার বিরক্তিতে চিড়বিড়িয়ে ওঠে অরু। নিজের রাগটাকে কোনোভাবেই দমাতে না পেরে তেঁতো গলায় ক্রীতিককে বলে,
— কি সমস্যা?
অরুর কাঁধের উপর নিজের চিবুক ঠেকিয়ে, ক্রীতিক হিসহিসিয়ে জবাব দেয় ,
—– আমার এই টি শার্টটা তোর পরনে বি’শ্রী লাগছে অরু, খুলে ফেলি?
ক্রীতিকের কথায় অরুর গলা শুকিয়ে এলো, ঠান্ডার মাঝেও হাতের তালু ভিজে উঠলো তপ্ত ঘামে।লজ্জায় কথা আটকে আসছে,তবুও নিজের মধ্যে একটু মেকি গাম্ভীর্য ধরে রেখে কথা ছো’ড়ে অরু ,
—–ককেন?আপনিই তো কাল বললেন যে, আপনার জামা কাপড়ে আমাকে মারাত্মক লাগে।
ক্রীতিক নিজের বলিষ্ঠ হাতে অরুর পরনের টি শার্টটা টেনে খুলতে খুলতেই হাস্কিস্বরে বললো,
—- কাল পরার পরে মারাত্মক লেগেছে, আর আজ খোলার পরে, ডিপেন্ডস অন মাই মুড বেইবি।
***********************************************
একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে আজ চারদিনের মাথায় আবারও সানফ্রান্সিসকো ফিরে যাচ্ছে অরু। ক্রীতিক নিজেই ড্রাইভ করে এগিয়ে দিয়ে আসছে ওকে। ওদিকে মনের মাঝে একরাশ ভয় আর দ্বিধা আকরে ধরে আছে অরুকে,মা আর আপার মুখোমুখি হলে ঠিক কি রকম লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে বসবে তারা, তা একমাত্র উপরওয়ালাই ভালো জানে।
কিন্তু পাশে বসা ক্রীতিকের গম্ভীর মুখটা দেখে আপাতত সেসব ভাবতে ইচ্ছে হলোনা অরুর, গত দু’ঘন্টার পিনপতন নীরবতা ভে’ঙে কোনোমতে হৃদয়ে সাহস সঞ্চার করে অরু ক্রীতিককে শুধালো,
—- কবে ফিরবেন?
ক্রীতিক স্টিয়ারিং এ হাত চালাতে চালাতে জবাব দিলো,
—- খুব শীঘ্রই।
অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে আবারও শুধালো,
—–আপনি একাই যাচ্ছেন?
—– না প্রত্যয় ও সাথে যাচ্ছে।
অরু মুখ কাচুমাচু করে বললো,
—- আমাকে নিয়ে গেলে হতোনা?
ক্রীতিক অরুদের ভবনের সামনে এসে অকস্মাৎ ব্রেক কষে বললো,
— তোকে নিয়ে যেতে পারলে আমার চেয়ে খুশি আর বোধহয় কেউ হতো না অরু, কিন্তু সেটা সম্ভব নয় মিডিয়ার ধারে কাছেও তোকে আমি এলাউ করবো না।
অরু অগত্যাই হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে শুকনো মুখে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। ক্রীতিকও নামলো ওর সাথে সাথে, ক্রীতিককে নেমে আসতে দেখে অরু শুধালো,
—- আবার নামতে গেলেন কেন? আপনার ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে তো।
ক্রীতিক স্ব পকেটে হাত গুঁজে,অন্যহাতে অরুর ঘাড় টেনে নিজের দিকে নিয়ে এসে কাতর কন্ঠে বললো,
—- একবার তুমি করে ডাক, তারপরেই চলে যাচ্ছি।
ক্রীতিকের কথায় অরু শুষ্ক ঢোক গিলে ওর গলাটা দু-হাতে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বললো,
—- ফিরে আসুন তারপর সব আবদার মেটাবো প্রমিস।
ক্রীতিক ব্যাথাতুর হাসলো, অতঃপর ক্রোধিত সুরে বললো,
—- তোর মাকে ম্যানেজ করা না করা একান্তই তোর ব্যাপার,বাট আমি ফিরে এলে আমার সাথে আমার বাড়িতে ফিরবি দ্যাটস মাই অর্ডার।
অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়,ওকে আসস্থ করে বলে,
— বুঝেছি এখন যান।
কথা শেষ করে সামনের দিকে এগিয়ে যায় অরু, ক্রীতিক এখনো সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে, এতোক্ষণ ধরে নাকের আসেপাশে মো মো করতে থাকা বুনোফুলের মেয়েলী সুঘ্রাণটা অরু যাওয়ার সাথে সাথে কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে।
অরুর হঠাৎ দূরত্বে ক্রীতিকের কেমন দম আটকে আসছে, ব্যাথায় ভরে উঠেছে হৃদয়টা।নিজের অজান্তেই হাত চলে গিয়েছে বুকের বা পাশে, আজ এই মূহুর্তে জীবনে প্রথমবার ক্রীতিক অনুভব করলো ওর হার্টবিট ফে’ইল করছে, ক্রমশ হৃদস্পন্দন গতি হারাচ্ছে, অরুর প্রতি এট্রাকশন তো নতুন কিছু নয়, তাহলে নতুন করে এই সুপ্ত অনুভূতি কোথা থেকে উদয় হলো? ক্রীতিক চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবলো,তার পরক্ষনেই গলা উঁচিয়ে স্পষ্ট আওয়াজে বলে উঠলো,
—- অরু আই লাভ ইউ।
ক্রীতিকের বলা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটা শব্দে পা দুটো অকস্মাৎ থমকে গেলো অরুর, সামনে পা বাড়ানোর শক্তি নেই আর,পুরো শরীর মন ছেয়ে গিয়েছে অজানা বৈ’দ্যুতিক শিহরনে, হৃদয়ের কানায় কানায় টইটম্বুর হয়ে উপচে পরা অনুভূতির জোয়ার, গলায় আটকে আছে তীব্র কা’ন্নার রেশ। ও আর এভাবে দাড়িয়ে থাকতে পারলো না একমুহূর্তও ,তৎক্ষনাৎ দৌড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পরলো ক্রীতিকের বুকে,একবার, দুইবার, তিনবার ক্রীতিকের আঙুলে চাপ দিয়ে কিছু একটা সংকেত বোঝালো,অতঃপর গলা খাদে নামিয়ে রিনরিনে আওয়াজে বললো,
—- আমিও তোমাকে ভালোবাসি জায়ান ক্রীতিক, খুব ভালোবাসি।
চলবে…..