#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ২৭
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[কপি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য]
দিনের দ্বিপ্রহর চলমান, অথচ বাইরে ঝুম বর্ষন, তীব্র বর্ষনে চারিদিকের প্রকৃতি সন্ধ্যারূপ ধারন করেছে। বৃষ্টির ছাট আর দমকা হাওয়ায় বারবার জানালার ভারী পাল্লা দুলেদুলে উঠছে। খানিক বাদে বাদে বৈদ্যুতিক ঝলকানি আর বাজ পরার প্রকান্ড আওয়াজে শরীরের লোমকূপ দাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। তবুও হাট করে রাখা খোলা জানালা গলিয়ে বাইরের অঝোর বারিধারার পানে ধ্যানমগ্ন হয়ে চেয়ে আছে অনু। অসময়ে বৃষ্টি নামার সাথে সাথে মনটাও কেমন বিষাদপূর্ন হয়ে উঠেছে ওর।অযাচিত মনে বারংবার একই প্রশ্ন এসে উঁকি দিচ্ছে অরু ঠিক আছে তো?
মনেমনে ভাবছে,
— মেয়েটাকে কেন যে একা রেখে আসতে গেলাম, ক্রীতিক ভাইয়া আদৌও ওর সাথে আছে, নাকি ওকে রেখেই চলে গিয়েছে,কে জানে?
অনু যখন অরুকে নিয়ে হাজারো দুশ্চিন্তাগ্রস্থ তখনই হাতে দু’কাপ গরম গরম দুধ চা নিয়ে ওর সামনে হাজির হয় প্রত্যয়। এটা প্রত্যয়েরই ফ্ল্যাট। তাই নিজ হাতে অনুর জন্য চায়ের বন্দবস্ত করেছে সে। অনুর দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে প্রত্যয় শুধালো,
— হঠাৎ মনমরা হয়ে গেলে যে, কি ভাবছো?
অনু হাঁটু মুড়ে বসে তাতে মাথা ঠেকিয়ে বললো,
— অরুর জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এই বৃষ্টির মাঝে একা রেখে এলাম,কি জানি কি করছে?
প্রত্যয় ভ্রু কুঁচকে বললো,
— একা কোথায় ভাই তো আছে।
অনু ঠোঁট উল্টে বললো,
— ক্রীতিক ভাইয়ার মতো মানুষ কি আর অরুর জন্য বসে থাকবে?
অনুর কথায় প্রত্যয় মনেমনে একটু হাসলো, অনু তো আর জানেনা তার বোনের শরীরটা ব্যক্তিগত হলেও আত্নাটা সয়ং জায়ান ক্রীতিকের। আপাতত এসব জানানোও যাবেনা,অরুর বারণ আছে, তাই প্রত্যয় কথা ঘুরানোর উদ্দেশ্যে অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
— তুমি সবার জন্য কতো ভাবো, সবার প্রতি তোমার কত দায়িত্ববোধ, আচ্ছা আমার কথা কখনো ভাবোনা কেন?
— কে বললো আপনার কথা ভাবিনা? ভাবি বলেই তো মাকে এতোগুলো মিথ্যে বলে বের হলাম, শুধু আপনাকে দেখবো বলে।
প্রত্যয় অনুর কথাতে আস্বস্ত হয়ে বললো,
— তুমি শুধু আমার অনু। তোমার উপর শুধু আমার দখলদারি। আমি ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ তোমার জীবনে আসবেনা,কোনোদিন না।
অনু লজ্জামাখা হাসিতে রাঙা হয়ে বললো,
— আমি শুধু আপনার, আপনিই আমার প্রথম ভালোবাসা, অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেম। আপনার অতীত আপনাকে কতটুকু দুঃখ দিয়েছে তা আমি জানিনা, তবে আমি চেষ্টা করবো তার চেয়ে দ্বিগুণ ভালোবাসায় আপনাকে মুড়িয়ে দিতে।
একজন আরেকজনকে প্রতিশ্রুতি দিতে দিতে কখন যে ওরা এতোটা কাছাকাছি চলে এসেছে টের পায়নি কেউই। ব্যাবধান মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার মাত্র, প্রত্যয় হয়তোবা আজকেও বেসামাল হয়ে পরেছে হৃদয়টা নিয়ন্ত্রণে নেই ওর, অগত্যাই ঠোঁট দুটো এগিয়ে দিয়েছে অনুর ঠোঁটের পানে। তৎক্ষনাৎ ওর ওর ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়ালো অনু, না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
—এখন নয়, বিয়ের পরে, এটা অন্যায়।
প্রত্যয় নিজের হুশে নেই ও অনুর হাত সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
— একটু আধটু অন্যায় করলে কিছু হবেনা ডিয়ার।
প্রত্যয়ের এমন বেসামাল রূপ দেখে উপায়ন্তর না পেয়ে একটানে ওর চশমা খুলে নিজের চোখে লাগিয়ে নিলো অনু,এবার প্রত্যয়ের চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে এসেছে। ফলস্বরূপ না চাইতেও মাঝপথে থেমে যেতে হলো ওকে।
চশমা টাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনু শুধালো,
— দেখুন তো আমাকে কেমন লাগছে, বাবাহ! কি পাওয়ার।
প্রত্যয় ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
— এটা কিন্তু মোটেই ঠিক হলোনা অনু।
— কি ঠিক হলোনা? চশমা ছাড়া কি আপনি পুরোপুরি কানা?দেখুন তো এখানে কয়টা আঙুল।
আঙুল উঁচিয়ে শুধালো অনু।
প্রত্যয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— আমি এতোটাও কম দেখিনা অনু, দুইটা আঙুল।
অনু চমকে উঠে বললো,
— সর্বনাশ, কি বলছেন?এখানে তো তিনটা আঙুল।
প্রত্যয় এবার নিজের দূর্বলতা এড়াতে একটু গলা খাঁকারী দিয়ে বললো,
— আমিতো মশকরা করে বলেছি, যাতে তুমি এন্টারটেইন হও।
অনু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
— বুঝলাম, পরক্ষণেই বুদ্ধিদীপ্তদের মতো চোখ বড়বড় করে বললো,
— আরে আপনি কানা হলেও তো সমস্যা নেই, আমিতো আছি, আমি আপনাকে ঠিক সামলে নেবো।
নিজের শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে প্রত্যয় শুধালো,
— তুমি সারাজীবন থাকবে আমার সাথে ?
অনু এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে বললো,
— আপাতত বাসায় যাবো, মাকে মিথ্যে বলে বেরিয়েছি, সেটা মা ঘুনাক্ষরেও জানতে পারলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।
প্রত্যয় এবার অনুকে নিজের পাশে বসিয়ে শুধালো,
— আচ্ছা সত্যি করে বলোতো,তোমরা দু’বোন তোমার মাকে এতো ভয় পাও কেন?
অনু এবার ভাবুক হয়ে পরলো, একটু ভেবে চিন্তে উত্তর দিলো,
— কারণ মা অনেক বিচক্ষণ আর কঠিন প্রকৃতির মানুষ। মায়ের মতে মিথ্যা বলা সত্যি লুকানোর মতো জ’ঘন্য অ’পরাধ আর কিছু নেই। এছাড়া মায়ের খুব বেশি আহ্লাদী আহ্লাদী ভাব ও পছন্দ নয়, বুঝতেই তো পারেন বিজনেস ওয়েম্যান। ওই জন্যইতো আমি আর অরু ছোট বেলা থেকেই ম্যাচিউর। অরু যা একটু ছেলেমানুষী করে কিন্তু আমার দ্বারা সেসব কোনোকালেই হয়নি।
জানেন, মাঝে মাঝে আপসোস হয় আমার, ছোট বেলার দিনগুলো ফিরে পেতে ইচ্ছে করে,এটা-ওটা বায়না ধরতে মন চায়, কিন্তু আপসোস এখন আর কে মেটাবে আমার আবদার?
অনুর কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওকে টান মে’রে নিজের বুকের উপর ফেলে দিলো প্রত্যয়, অকস্মাৎ ঘটনায় টাল সামলাতে না পেরে অনুর মাথা গিয়ে ঠেকলো প্রত্যয়ের বুকে। প্রত্যয় অনুর মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বললো,
— আমি মেটাবো সব আবদার, একবার করেই দেখো।
হুট করে এমন কাছাকাছি আসাতে অনু একটু ভরকে গেলো, ও তাড়াহুড়ো করে প্রত্যয়ের বুকের উপর থেকে মাথাটা তুলতে নিলে প্রত্যয় ওকে পুনরায় নিজের সাথে মিশিয়ে বলে,
— মাত্র পাঁচ মিনিট, তারপর ছেড়ে দিচ্ছি, প্রমিস এর বাইরে কিচ্ছু করবো না।
প্রত্যয়ের কথায় আস্বস্ত হয়ে অনুও এবার শরীরের সবটুকু ভার ওর উপর ছেড়ে দিয়ে , চোখদুটো বন্ধ করে নিলো পরম আবেশে।
*****************************************
বৃষ্টি মাথায় নিয়েই অনেকটা তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফিরেছে ওর দু’বোন। এবার শুধু চুপিচুপি রুমে ঢুকে যাওয়ার পালা। তাহলেই ঝামেলা শেষ। কিন্তু বসার ঘর পেরিয়ে রুমের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে আজমেরী শেখের গমগমে আওয়াজ ভেসে এলো কর্ণকূহরে,
— কোথায় গিয়েছিলে, ফিরতে সন্ধ্যা হলো কেন?
অরু মুখ কাচুমাচু করে অনুর দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে, অনু ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,
— ইয়ে মা, বাজার করতে গিয়েছিলাম সুপার শপে। তোমাকে না বলে গেলাম অনেক কিছু কেনার আছে।
— মিথ্যে কেন বলছো,বাজার তো সেই কখন নিয়ে এসেছে রাজ।
অরু একটু আগ বাড়িয়ে বললো,
— আআসলে মা আজকে ব্ল্যাক ফ্রাইডে তো সব কিছুতে ডিসকাউন্ট চলছিল, তাই আমরা দু’বোন একটু লেডিস সেকশনে গিয়েছিলাম ওই জন্যই দেরি হয়ে গেলো।
আজমেরী শেখ ভ্রু কুঁচকে বললো,
— এতো দেরি করে ফিরলে তা কিছু কেনোনি কেন?
অনু বললো,
— পপছন্দ হয়নি মা।
— পছন্দ হয়নি, নাকি টাকার জন্য কেনার সাহস করোনি? তোমাদের আমি খুব ভালো করে চিনি, মনে রেখো জেকে গ্রুপের থার্টি পার্সেন্ট শেয়ার আমার নামে, তোমাদের প্রয়াত আঙ্কেল খুশি হয়ে আমাকে লিখে দিয়ে গেছেন, সে হিসেবে তোমরাও তার মালিক। তাহলে কিসের এতো টাকার চিন্তা তোমাদের?
অরু এবার কিছু বুঝে না পেয়ে বললো,
— বাকি সেভেন্টি পার্সেন্ট তাহলে কার মা?
অনু ওকে কনুই দিয়ে গুঁতো মে’রে থামিয়ে বললো,
— চুপ কর।
আজমেরী শেখ সর্বদা সুস্পষ্টবাদী তাই তিনি সহসা উত্তর দিলেন,
— জায়ান ক্রীতিকের।
অতঃপত মনেমনে বললেন,কিন্তু ছেলেটার খুব বেশি আত্ন অ’হংকার, শুধুমাত্র আমি চেয়ার ওয়েম্যান বলে, কোম্পানির ধারেকাছেও ঘেঁষেনা সে। এবার আমিও দেখতে চাই নিজের এতোবড় সাম্রাজ্য ঠিক কতদিন হাতছাড়া করে রাখতে পারে জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী।
মায়ের অ’গ্নিমূর্তি তরলে পরিনত হতেই অরু, অনু দু’বোন একসাথে রুমে ঢুকে গেলো। অরু একবার ভিজেছে, শরীরটাও কেমন কুটকুট করছে, তাই রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অরু চলে গেলো শাওয়ার নিতে।
একটু পরে শাওয়ার নিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেরোতেই পিলে চমকে উঠলো ওর, দেখলো অনু একটা চেকের পাতা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, যেটা থাইল্যান্ড বসে ক্রীতিক দিয়েছিল অরুকে,বিয়ের মোহরানা সরূপ। কিন্তু সেটা নিয়ে আপা কি করছে? ধরা পরে যাওয়ার ভয়ে অরু দ্রুত এগিয়ে গিয়ে চেকের পাতা টা ছো মে’রে নিয়ে সেটাকে ড্রয়ারে রাখতে রাখতে বললো,
— এটা দিয়ে কি করছিস তুই?
অনু ঠোঁট উল্টে বললো,
— তোর জামাকাপড় গোছাতে গিয়ে আলমারিতে পেলাম, ক্রীতিক ভাইয়ার নাম মনে হলো, উনি তোকে চেক কেন দিয়েছে?
অরু জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
— আরে ভার্সিটির সেমিস্টার ফি দিয়েছিলেন,কিন্তু আমি বোকার মতো সেটা ঘরে তুলে রেখেছি, জমা দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।
অরুর কথা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য হলোনা অনুর, কারণ চেকের এমাউন্ট বেশ বড় ছিল, তবে ও পুনরায় কিছু জিজ্ঞেস করারও সুযোগ পেলোনা, তার আগেই চোখ গিয়ে ঠেকলো অরুর ঘাড়ের কাছে র’ক্তিম হয়ে যাওয়া কালচে বেগুনি দাগের উপর ।দেখে মনে হচ্ছে কেউ বাইট করেছে। অনু সহসা এগিয়ে গিয়ে, অরুর গলায় হাত দিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
— গলায় কি হয়েছে তোর? কে কামড় দিয়েছে?
অনুর কথায় অরু দ্রুত গিয়ে আয়নার সামনে দাড়ালো, দেখলো গলার আর ঘাড়ের মাঝ বরাবর ছোপ ছোপ কালচে দাগ, তৎক্ষনাৎ মনে পরে গেলো দাগগুলোর আসল উৎস। বিকেলের সেই বেসামাল অনূভুতি, ক্রীতিকের ঘোর লাগা চাহনী, আর তারপর হুট করেই অনেকটা কাছাকাছি আসা। এখন সেসব মনে পরতেই কানদুটো কেন গরম হয়ে উঠছে অরুর।
— কি হলো কিছু বল?কি করে ব্যাথা পেয়েছিস?
অনুর কথায় অরু থতমত খেয়ে বললো,
—কি বলতো আপা, তখন অনেক বৃষ্টি হলো না? সেই বৃষ্টির মাঝেই একটা বড়সড় পোকা কোথা থেকে যেন উড়ে এসে কামড় বসিয়ে দিলো, আমি টের পাইনি, এখন দেখছি এমন লালবর্ণ হয়ে আছে।
অনু অরুর গলায় হাত বুলিয়ে অসহায় সুরে বললো,
— কি পোকা কামড়ালো বলতো? পাছে না আবার ইনফে’কশন হয়ে যায়, আয় তো একটু মলম লাগিয়ে দিই।
অরু হ্যা না কিছুই বলতে পারলো না, চুপচাপ বসে বসে দেখতে লাগলো, তার আপা তার স্বামীর তৈরি করা প্রথম ভালোবাসার চিহ্নতে কি সুন্দর করে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে।
*****************************************
ব্যস্ততম দিনকে হটিয়ে, সন্ধ্যা নেমেছে সমগ্র ধরনী জুড়ে, সারা বিকেল ঝুম বর্ষনের ফলস্বরূপ এখন ইকোপার্কটা পুরোপুরি খালি পরে আছে। আশেপাশে মানুষজন তো দূরে থাক একটা কাকপক্ষীও নজরে আসছে না। ইকোপার্কের সরু রাস্তায় ম্যাপল পাতার ছড়াছড়ি, তকতকে সুন্দর সারিসারি ব্যঞ্চি গুলো ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে বৃষ্টির পানিতে। সন্ধ্যা বেলা একটু খানি একা একা হাটবে বলেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝেই ট্র্যাকস্যুট পরে বের হয়েছে এলিসা।সাথে আর কেউ নেই। ওর অবশ্য একটা থাকতে ভালোই লাগে,ওই জন্যই তো এই নির্জন ইকোপার্কে হাটতে আসা।
কিন্তু হাটতে হাটতে কিছুদূর যেতেই ঘটলো বিপত্তি, চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো এক সুপরিচিত মুখ। ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে একটা অল্পবয়স্কা মেয়ের সাথে কি যেন কথায় মশগুল হয়ে আছে অর্নব। কিন্তু এমন নির্জন নিরিবিলি পরিবেশে কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছে ওরা দুজন? আর মেয়েটাই বা কে? ভাবনায় পরে গেলো এলিসা।
ওদিকে অর্নব কথা বলায় এতোটাই ব্যস্ত যে ওর পেছনে সেই কখন থেকে এলিসা দাড়িয়ে আছে, ও সেটা টেরই পায়নি।
এলিসা বরাবরই অর্নবের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়ে অভস্ত্য, তাই হঠাৎ এমন অগ্রাহ্য ব্যাপারটা সহ্য হলোনা ওর, উল্টে বিরক্ত লাগতে শুরু করলো প্রচন্ড রকম।এলিসা কিছু একটা ভেবে এগিয়ে এসে পেছন দিক থেকেই অর্নবের বাহুতে জোরে জোরে হাতদিয়ে টোকা দিলো। অর্নব পেছনে ঘুরে আচমকা এলিসাকে দেখে অবাক হয়ে বললো,
— এলিসা তুই এখানে?
পরক্ষণেই সামনের মেয়েটার দিকে একনজর পরখ করে এলিসাকে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে দাড়িয়ে অর্নব শুধালো,
— তুই এখানে কি করছিস একা একা?
অর্নবের কথায় বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে, এলিসা বিরক্তি নিয়ে বললো,
— মেয়েটা কে অর্নব?
অর্নব পেছনে ঘুরে মেয়েটাকে একনজর পরখ করে, চোখ ঘুরিয়ে এলিসার দিকে তাকিয়ে বললো,
— আছে বলা যাবে না।
সঙ্গে সঙ্গে অর্নবের কলার খা’মচে ধরলো এলিসা, দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— তুই আমার সাথে মজা করছিস?
এলিসার এই হঠাৎ রেগে যাওয়াটা অর্নবের ভালোই লাগলো, ও এলিসার রাগে আরেকটু ঘি ঢেলে দিয়ে বললো,
— মজা কেন করবো, সব সিক্রেট কি আর সবাইকে বলা যায়? প্রাইভেসি বলেও তো একটা ব্যাপার আছে, এতো বড় মেয়ে হয়েছিস বুঝিস না সেটা?
— মেয়েটা কে অর্নব?
অর্নব ভাবলেশহীন হয়ে বললো,
— হবে আমার লাইফের ইম্পর্টেন্ট কেউ। তুই এতো রিয়াক্ট কেন করছিস?
এলিসা এবার অর্নবের কলার ছেড়ে দিয়ে বললো,
— খুব ইম্পর্টেন্ট কেউ তাই না?
— হ্যা খুবই ইম্পর্টেন্ট।
অর্নব কথাটা বলেছে ঠিকই, কিন্তু এর পরবর্তীতে এলিসার এমন পদক্ষেপ মোটেও কল্পনা করেনি ও। অর্নব দেখলো রাস্তার পাশ থেকে একটা বড়সড় ইটের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে রে’গেমেগে মেয়েটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এলিসা। এলিসার এমন রণমূর্তি দেখে অজ্ঞাত মেয়েটা নিজেও ভ’য় পেয়ে গিয়েছে, এই পা’গলীর হাতে নিজের গায়ে আ’ঘাত প্রাপ্ত হওয়ার আগেই আতঁকে উঠে সহসা ছুট লাগালো মেয়েটা। এলিসাও দমে যাওয়ার পাত্রী নয়, ও নিজেও সমান তালে ছুটতে লাগলো মেয়েটার পিছু পিছু। এদিকে সকল ঝামেলার উৎস বেচারা অর্নব কিছু বুঝে ওঠার আগেই এলিসা মেয়েটাকে তা’ড়া করে করে হাঁপানী রো’গী বানিয়ে ছেড়েছে। এবার অর্নবও আর দাঁড়িয়ে থাকলো না ছুটে গিয়ে দু-হাতে চেপে ধরলো এলিসার বাঁকানো কোমড়। এলিসা ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,
— ছাড় আমাকে তুই, ইম্পর্টেন্ট মানুষ হওয়া দেখাচ্ছি ওকে আমি, বজ্জাত মেয়ে অন্যের জিনিসে নজর দেয়।
অর্নব ওকে আঁটকে রাখতে না পেরে চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
— বিশ্বাস কর এলিসা, জান আমার।ও কোনো ইম্পর্টেন্ট মানুষ না, ও আমার ক্লায়েন্ট, ক্লায়েন্ট। তুই থাম একটু, আমি খুলে বলছি।
অর্নবের কথায় এলিসা একটু শান্ত হলে,অর্নব ওর হাতের ইটের টুকরোটা ছু’ড়ে ফেলে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
— আমাদেরই ভার্সিটিতে পড়ে মেয়েটা, ক্রীতিকের স্টুডেন্ট। গত কয়েকদিন যাবত ওর ছোটবোন হঠাৎ করে মিসিং, তাই ক্রীতিক ওকে আমার এজেন্সির কার্ড দিয়ে আমার সাথে দেখা করতে বলেছে, একমাত্র বোনকে খুজে না পেয়ে মেয়েটার অবস্থা দূ’র্বিষহ, তখন থেকে সেটা নিয়েই আলাপ করছিলাম আমরা।
এলিসা এবার দিগুণ ঝাঁজ নিয়ে বললো,
— তাহলে আমাকে মিথ্যে কেন বললি?কি সুখ পাস তোরা আমাকে মিথ্যে বলে?
অর্নব চোখ ছোট ছোট করে বললো,
— তুই কেন এতো জেলাস? আর একটু আগে আমার জিনিস, আমার জিনিস করে চেঁচিয়ে কি যেন বললি? আমি কিন্তু শুনেছি।
এলিসা ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে যেতে যেতে বললো,
— তোর সাথে আর কথা নেই। অযথা কষ্ট দিস আমাকে।
এলিসা হনহনিয়ে হাঁটছে, চোখদুটো না চাইতেও বে’ইমানি করছে ওর সাথে, বারবার জলে ভিজে ঝাপসা হয়ে আসছে সামনের সব দৃশ্যপট। গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে আছে একরাশ না পাওয়ার কষ্ট। অথচ আজ অর্নব ও ওকে বোকা বানালো ওর ইমোশন নিয়ে খেললো।
তবে বেশিক্ষণ হেঁটে এগিয়ে যেতে পারলো না এলিসা, তার আগেই ওকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরলো অর্নব, পোনিটেল করা চুলের মাঝে হাজারটা চুমু খেতে খেতে বললো,
— আ’ম সরি, আর কক্ষনো এমন হবে না, আ’ম সরি, সত্যি সরি। তুই যে আমার জন্য কিছু ফিল করিস সেটা আমার অজানাই ছিল।বুঝতে পারিনি।
এলিসা এবার ঘুরে সপাটে চ’ড় বসিয়ে দিলো অর্নবের গালে, অতঃপর কাঁদতে কাঁদতে মুখ খুলে বললো,
— কেন বুঝিস নি? তোকে আমি গ্রহন করিনি ঠিকই, কিন্তু দুরেও তো ঠেলে দিইনি কখনো, তোর এতোএতো পা’গলামি, বাচ্চামি, সবকিছু সহ্য করে এসেছি , তোর কি মনে হয় সেটা কেবলই তোর কথা ভেবে সিমপ্যাথি দেখিয়েছি আমি? আমি এতোটাও ভালো মেয়ে নই অর্নব।
তোর করা প্রত্যেকটা পা’গলামিতে আমি সুখ পাই, আনন্দে পুলকিত হই, তাইতো কখনো তোকে বারণ করিনা, কেন বুঝতে পারলি না বল? তুই না ডিটেকটিভ? হ্যা’কার? তাহলে এটুকু তোর মাথায় ঢুকলো না কেন?উমম….
এলিসার এক নাগারে করা অভিযোগের বহরে হুট করেই ইতি ঘটালো অর্নব,ওর নরম অধর যুগল কে নিজের দখলে নিয়ে। এর আগে কি অর্নব এলিসাকে চুমু খায়নি? খেয়েছে তো জোরজবর’দস্তি করে বহুবার। কিন্তু আজ একটু বেশিই আবেগ নিয়ে স্পর্শ করছে অর্নব। যেই স্পর্শে শুধুই আন্তরিকতা আর ভালোবাসার ছড়াছড়ি। অর্নবের কাতর স্পর্শে এতোক্ষণে এলিসাও কুপোকাত, শেষমেশ অর্নবের অসহনীয় ভালোবাসার কাছে হেরে গিয়ে ও নিজেও ঠোঁট মেলালো অর্নবের সাথে। তালে তাল মিলিয়ে মত্তো হলো এক নিদারুন ঠোঁটের খেলায়।
*****************************************
ক্লাস আর প্রেজেন্টেশন আছে বলে আজ সকাল সকাল ভার্সিটিতে এসেছিল অরু। কিন্তু সকাল সকাল এসেই যে গালের উপর এমন শক্ত চপেটাঘা’ত হা’মলে পরবে সেটা বোধ হয় আশা করেনি ও। এই মূহুর্তে চ’ড় খাওয়া গালে হাত দিয়ে টলটলে চোখে ক্রীতিকের দিকে তাকিয়ে নাক টানছে অরু, মনেমনে ভাবছে, এটা স্বামী না গিরগিটি? ক্ষনে ক্ষনে রূপ বদলায়, কালই তো কত আদর দেখালো আর এখন চ’ড় মারলো।
অরুর কাঁদো কাঁদো বি’ভৎস মুখের দিকে অ’গ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্রীতিক। রাগের তোপে তীক্ষ্ণ চোয়ালটা আরও শক্ত লাগছে ওর।জিদের তোপে ইচ্ছে তো করছে ওর আরেকটা গালেও সপাটে চ’ড় মে’রে দিতে,তাহলে আবার বেশি ব্যাথা পাবে, তাই নিজেকে সংবরণ করে হাতদুটো মুঠিবদ্ধ করে রেখেছে ক্রীতিক। তবে দু’চোখের অ’গ্নিশিখা দ্বারাই আপাতত ভস্ম করে দিচ্ছে অরুর চিত্তকে। দোষটা অবশ্য অরুরই। অযথাই বাঘের কানে সুরসুরি দিলে বাঘ কি বসে থাকবে?
খানিকক্ষণ অরুর দিকে এভাবে তাকিয়ে থেকে দাঁতে দাঁত পিষে ক্রীতিক ধা’রালো কন্ঠে বললো,
— ফারদার যদি এসব বোকামি করতে আসিস, তাহলে অন্য গালটাতেও থা’পড়িয়ে র’ক্ত জ’মাট বাধিয়ে দেবো।
কথা শেষ করে হনহনিয়ে ক্লাসরুমে ঢুকে যায় ক্রীতিক। ওদিকে ক্রীতিকের কথায় কলিজার পানি শুকিয়ে গিয়েছে অরুর, মনেমনে ভাবছে,
—আমি আসলেই ওনার বউতো? কবুল তো বলেছিলেন, রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন ও করেছিলেন, তাহলে কিভাবে ভরা ক্যাম্পাসে আমার গায়ে হাত তুললেন উনি?
ওর ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে সায়নী এগিয়ে এসে মুখ কাচুমাচু করে বললো,
— তুমি ঠিক আছো অরু?
অরু নাক টেনে বললো,
— সব তোমার জন্য, আমি বলেছিলাম উনি এতো সহজ নয়, ওনাকে এসব লেটার ফেটার দিতে গেলে উনি রেগে যাবে।
সায়নী মাথা নত করে, অসহায় সুরে বললো,
— আ’ম সরি অরু, তুমিতো ওনার বোন হও তাই তোমার হাত দিয়ে পাঠাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমি সপ্নেও ভাবিনি উনি এতোটা রে’গে যাবেন যে, রেগেমেগে তোমাকে চ’ড় মে’রে বসবেন।
অরু আর সায়নীর সাথে কথা বাড়ালো না, এই মূহুর্তে সায়নীর দিকে তাকাতেও ইচ্ছা করছে না ওর অগত্যাই চুপচাপ ক্লাসে ঢুকে গেলো অরু। ক্রীতিক ক্লাসেই ছিল, অরু পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে চুপচাপ বসে পরলো সবচেয়ে পেছনের সিটে।
মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারছে না একটু আগের ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটাকে। নিজের কাজে নিজেই লজ্জিত হয়ে পরেছে ও এখন। বারংবার মনে হচ্ছে কেন যে করতে গেলাম এমন পাকামি। দোষ অবশ্য সায়নীর ও কম নয়, যেদিন থেকে শুনেছে অরু ক্রীতিকের স্টেপ সিস্টার, সেদিন থেকে ননদীনি ডাকা শুরু করে দিয়েছে ওকে। ভার্সিটিতে ঢুকলেই শুরু হয় ওর প্রশ্নউত্তর পর্ব, জেকে স্যার কোথায় যায়, কি খায়, কি করে সব কিছুর পাই টু পাই খোঁজ নিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয় সায়নী, বলতে না চাইলে অরুর সাথে কেমন পরপর আচরণ করে সে।
উপায়ন্তর না পেয়ে, একমাত্র বাঙালি বান্ধবীর মনরক্ষার জন্য অরুও সবকিছুর ছাপ ছাপ স্পষ্ট জবাব দেয়। কিন্তু আজকে সায়নী একটু বেশিই করে ফেলেছে, অরুর হাতে রঙিন খামের মোড়কে বাঁধা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলেছে ক্রীতিককে দিয়ে আসতে, বলেছে তো বলেছে একেবারে ঠেলে ক্রীতিকের সামনে পাঠিয়ে দিয়েছে।
গতকাল ক্রীতিকের নরম সরম রূপ দেখে অরু ভেবেছিল একটা চিঠিই তো কি আর বলবে ক্রীতিক , দিয়ে দিলেই তো কাহিনি খতম, ওদিকে বান্ধবীর মনরক্ষাও রয়ে যাবে। কিন্তু কে জানতো কালকের ক্রীতিক আর আজকের ক্রীতিকের মাঝে এমন দিন রাত ফারাক। তাহলে কি অরু নিজের মানসম্মান খোয়ানোর মতো এতো বড় ভুলটা করতো? জীবনেও না।
— মিসেস জেকে, ফোকাস।
ঠিক এভাবেই ছোট্ট একটা বাক্য দিয়ে অকস্মাৎ ক্লাসের মধ্যে বো’ম ফাটালো ক্রীতিক। নামটা শোনা মাত্রই, হইহই করে উঠে অরুর মুখের দিকে হা হয়ে তাকিয়ে আছে পুরো ক্লাস। সেবার বাস্কেটবল কম্পিটিশনের সময় সবাই যা অনুমান করেছিল সেটাই আজ বাস্তব হলো।
তাই বলে মিসেস জেকে? সবাইতো ভেবেছিল জেকে স্যারের বেবিগার্ল হবে হয়তো। কিন্তু না এতো সয়ং স্ত্রী। তারমানে সকলের ক্রাশ জেকে স্যার বিবাহিত?কথাটা ভাবতেই পুরো ক্লাস শোক শোক নিরবতায় ছেয়ে গেলো। ছেলেরা মেয়েদের চুপসে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে টিপে হাসছে, একমাত্র অরুই চোরের মতো মাথা নুয়িয়ে বসে আছে সেই কখন থেকে, সায়নী ওর দিকে সেই তখন থেকেই কটমটিয়ে তাকিয়ে আছে, মনেমনে ভাবছে,
— তাহলে অরু আমাকে বোকা বানিয়েছে এতোদিন ধরে?
.
ক্লাস শেষে বের হতেই অরুর হাতটা খপ করে টেনে ধরলো সায়নী, কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামিদের মতো করে প্রশ্ন করলো,
— সত্যি করে বলো, এতোদিন ধরে বোকা কেন বানালে আমাকে? আজকেও তো বলতে পারতে।
অরু নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো,
— আমি তোমাকে বোকা বানাইনি, যা সত্যি তাই বলেছি।
— এতোদিন বলে এসেছো জেকে স্যার তোমার ভাই,আর এখন জেকে স্যার নিজে তোমাকে মিসেস জেকে বলে সম্মোধন করলো।কোনটা সত্যি?
অরু ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,
— দুটোই সত্যি, উনি আগে আমার স্টেপ ব্রাদার ছিলেন আর এখন স্বামী।
সায়নী তেতে উঠে বললো,
— আর ইউ কিডিং মি? স্টেপ ব্রাদার কি করে স্বামী হলো?
— নো আ’ম নট, আর কি করে স্বামী হলো সেটা বরং তোমার জেকে স্যারকেই জিজ্ঞেস করো, উনি আমাকে জোর করে বিয়ে করেছেন কিনা, তাই উত্তরটাও উনিই ভালো দিতে পারবেন। আসছি।
একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যায় অরু। এই প্রশ্নটার সম্মুখীন হওয়ার ভ’য়ই তো এতোদিন ধরে পেয়ে এসেছে ও,
— স্টেপ ব্রাদার কি করে স্বামী হয়?
অথচ ক্রীতিক একটাবার ওর কথা চিন্তা না করেই টেনে হিঁচড়ে জোর’জ’বরদস্তি করে কবুল বলিয়ে নিলো। এখন অরু চাইলেও এই সম্পর্কটাকে মুছে ফেলতে পারবে না, আর না এড়িয়ে যেতে পারবে জীবনের সাথে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে যাওয়া সত্যিটাকে।
*****************************************
একরাশ হৃদয়ের ব্যাথায় কাতর অরু ভার্সিটি থেকে ফিরেই,রুমের দুয়ারে খিল দিয়ে তলিয়ে গিয়েছে ঘুমের দেশে। আর ওঠেনি, অথচ এখন সন্ধ্যারাত তবুও পরেপরে ঘুমাচ্ছে সে। কিন্তু বালিশের পাশে অযত্নে পরে থাকা দামি মোবাইলটার ভাইব্রেট আওয়াজে সেই ঘুম আর বেশিক্ষণ টিকলো না। অগত্যাই ঘুমু ঘুমু চোখে ফোন কানে তুললো অরু। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো চেনা পরিচিত হৃদয়ে শিহরণ জাগানো হাস্কি কন্ঠস্বর,
— আমার ঘুমপরী, বারান্দায় এসো।
ক্রীতিকের মুখে, তুমি শব্দটা শোনা মাত্রই একলাফে উঠে বসলো অরু, মনেমনে ভাবলো —আমি স্বপ্ন দেখছি নাতো? উনিতো কখনোই আমাকে এতো আদুরে গলায় ডাকেন না। তাহলে আজ হঠাৎ?
অরু চুপ হয়ে আছে দেখে ক্রীতিক পুনরায় বললো,
— কিরে বারান্দায় আয়, ডাকছি কথা কানে যাচ্ছে না?
ক্রীতিকের কথায় অরু তেতে উঠে বললো,
— পারবোনা, সকালে আমাকে মে’রেছেন মনে নেই?গালটা এখনো জ্বলছে।
— মা’র খাওয়ার মতো কাজ করলে আবার মা’রবো,তারপর আবার আদর করবো, এখন জলদি বারান্দায় আয়, তোকে দেখবো।
অরু মুখ ফুলিয়ে বললো,
— যাবোনা বলেছি তো।
ক্রীতিক গলার আওয়াজ খানিকটা নরম করে বললো,
— একবার এসে দেখ, তোর জন্য সারপ্রাইজ এনেছি।
সারপ্রাইজের কথা শুনে অরু আর অপেক্ষা করতে পারলো না, ছুটে চলে গেলো বারান্দায়, দেখলো আজ বাইক নয়, কালো মার্সিডিজের ডিকিতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে ক্রীতিক। ওর কোলের মাঝে ঘাপটি মে’রে বসে আছে ছোট্ট ডোরা। ডোরাকে দেখা মাত্রই অরুর মুখ আপনা আপনি হা হয়ে গেলো। দু’হাত চলে গেলো মুখের উপর, শুকনো মুখটা মূহুর্তেই প্রসারিত হয়ে গেলো খুশিতে, তারপর উচ্ছ্বসিত কন্ঠে অরু বললো,
— ডোরা?আসছি আসছি, আপনি দাড়ান আমি এক্ষুনি আসছি।
কয়েক মিনিটের মাথাতেই তিন তলার সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলো অরু, ওর পরনে ক্রীতিকের কিনে দেওয়া পাজামা সেট, চুল গুলো মেসি বান করে উপরে তুলে বাঁধা, যেভাবে ঘুমিয়েছিল সেভাবেই নেমে এসেছে আজ। নিচে নেমে কালবিলম্ব না করে অরু দৌড়ে গিয়ে ক্রীতিকের কোল থেকে ডোরাকে তুলে নিলো নিজের কোলে।
ক্রীতিক অবাক হয়ে বললো,
— আজ এতো তাড়াতাড়ি বের হলি কি করে?
অরু ডোরাকে আদর করতে করতে বললো,
— মা আর আপা বাসায় নেই, হসপিটালে গিয়েছে ফিরতে রাত হবে।
ক্রীতিক ডোরার থেকে নজর সরিয়ে বললো,
— আগামীকাল আমরা পাহাড়ে যাবো, সবাই মিলে এলিসাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার প্ল্যান আছে, কাল সকাল সকাল বাসায় ম্যানেজ করে বের হবি।
অরু ক্রীতিকের পানে সচকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
— মা জানলে মে’রে ফেলবে, তাছাড়া আপনাদের মাঝে আমি গিয়ে কি করবো?
—আমি বলেছি তাই যাবি।
অরু অসহায় মুখে বললো,
— একদিন কি বলে ম্যানেজ করবো আমি? পারবো না, আপনি বরং গিয়ে ঘুরে আসুন।
ক্রীতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অরুর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে কর্কষ আওয়াজে বললো,
— ওকে ফাইন চল তাহলে।
অরু ক্রীতিকের হাত টেনে ধরে ব্যতিগ্রস্থ হয়ে শুধালো,
— একি কোথায় যাবো?
ক্রীতিক নিজের চোয়াল শক্ত করে বললো,
— যেহেতু তুই আমার বউ, সো তুই এখন থেকে আমার সাথেই থাকবি, দেখি কে আটকায় ।
অরু বড়সড় একটা শুষ্ক ঢোক গিলে ক্রীতিককে থামিয়ে দিয়ে বললো,
— শুনুন, শুনুননা একটু, মা কেবল একটু সুস্থ হয়েছে, এই মূহুর্তে মা এতোবড় শক নিতে পারবে না,সব কিছু জানাজানি হয়ে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।এমন করবেন না প্লিজ, আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো, তবুও এমন পাগলামি করবেন না কথা দিন।
ক্রীতিক পুনরায় গাড়ির ডিকিতে বসে বললো,
— ওকে ফাইন কাঁদতে হবেনা, জোর করবো না তোকে।তবে কালকের কথা যাতে মাথায় থাকে।
অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে সায় জানালে ক্রীতিক কিছু একটা ভেবে অরুকে টেনে এনে নিজের উরুর উপর বসিয়ে দিয়ে ওর কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে বললো,
— এখনো রেগে আছিস আমার উপর?
অরু নাক ফুলিয়ে বললো,
— আমার রাগ দিয়ে কি আসে যায়, আপনিতো আমাকে সারাক্ষণই মা’রেন।
— আদর করিনা বুঝি?
অরু নিশ্চুপ। ক্রীতিক অরুর গালে হাতদিয়ে স্পর্শ করে বুঝতে পারলো সেখানে এখনো পাঁচ আঙুলের ছাপ পরে আছে। ও যায়গাটাতে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
— তোর শরীরে আমার করা দাগগুলো মা’রাত্মক লাগে।
অরু শুষ্ক ঢোক গিলে বললো,
— তাই বলে এভাবে ব্যাথা দেবেন?
ক্রীতিক তীর্যক হেসে বললো,
— ভবিষ্যতে আরও বেশি ব্যাথা দেবো অভ্যেস করে নে।
অরু বুঝতে পারলো ক্রীতিকের কথার ধরন কেমন হুট করেই পাল্টে গিয়েছে, স্পর্শে তার তীব্র কাতরতা, গলার আওয়াজে লেগে আছে একরাশ মাদকতা, নিজ মনের অযাচিত চিন্তা গুলোকে পেছনে হটিয়ে দিয়ে অরু ডোরাকে শক্ত করে চেপে ধরে চুপচাপ হয়ে আছে,
ক্রীতিক অরুর গালে নিজের গালটা আলতো স্পর্শে ঘষে দিয়ে বললো,
— আমি ব্যাথা দিয়েছি আবার আমিই আদর করে দিলাম। হার্টবিট।
— হার্টবিট মানে হৃদস্পন্দন,যা না থাকলে মানুষ মা’রা যায়।
ক্রীতিক ওর গালের সাথে গাল মিশিয়ে বললো,
— তুই আমার কাছে তার চেয়েও বেশি।
ক্রীতিকের হঠাৎ করা উষ্ণ স্পর্শে কেঁপে উঠেছে অরুর ছোট্ট শরীর, সেই সাথে মিয়িয়ে গিয়েছে মস্তিষ্কে চড়াও হওয়া রাগের ফুলিঙ্গ। পুরুষালী স্পর্শ পেয়ে অরু নিজেও খানিকটা কুঁকড়ে গেলো, গলায় দীর্ঘশ্বাস আটকে রেখেই কম্পিত কন্ঠে বললো,
—- আপনাকে আমি বুঝতে পারিনা কিছুতেই।
নিজের বলিষ্ঠ দুহাতে অরুর লতানো কোমড় টাকে জড়িয়ে ধরে অরুর গলায় মুখ ডোবাতে ডোবাতে ক্রীতিক বললো,
—- পুরোপুরি আমার হয়ে যা ঠিক বুঝতে পারবি।
চলবে……