সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁 #পর্বঃ৩৮ #লেখনীতে_suraiya_rafa

0
562

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ৩৮
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[ক’পি করা নিষিদ্ধ🚫]
[প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য]

দেখতে পাচ্ছি না, ছুঁতে পাচ্ছি না, ভুলতে পারছি না,তবুও তুমি আছো, এ তোমার কেমন থাকা জায়ান ক্রীতিক??

ল্যাপটপের কিবোর্ডে এতটুকু টাইপ করে থামলো অরু, অতঃপর “জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী” খচিত যে ইমেইল একাউন্ট টা এখনো সেভ করা রয়েছে, সেটার সেন্ড অপশনে ক্লিক করে চোখ বোলালো মেইল একাউন্টের পাশে এটে থাকা ছোট্ট ডিপিতে।

ডিপিতে দেখা যাচ্ছে রোদচশমা আর ব্ল্যাক লেদার জ্যাকেট পরিহিত ক্রীতিক কে, যে বাইকে হেলান দিয়ে উরুর উপর হেলমেট নিয়ে নির্বিগ্নে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। গম্ভীর মুখ খানাও কি স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে।
এই ছবিটা বেশ কিছু বছর আগের হবে হয়তো, অন্তত হেয়ার স্টাইল তো তাই বলছে। দেশে ফেরার পর আজ প্রায় সাত দিন যাবত এই একই কাজ ক্রমাগত করে যাচ্ছে অরু। ও জানেনা এই মেইল একাউন্ট আদৌও ক্রীতিক ব্যবহার করে কিনা।কিন্তু ওই যে আশায় বাঁচে চাষা। সেরকমই বুকের মাঝে জমে থাকা তীব্র দহন আর একটা অনাকাঙ্ক্ষিত আশাকে সামনে রেখে প্রতিদিন ক্রীতিকের একাউন্টে মেইল পাঠায় অরু।
কি জানি হুট করে ক্রীতিকের চোখে পরলেও তো পরতে পারে। কারণ একটাই ক্রীতিক নিজে থেকে যোগাযোগ না করলে এ ছাড়া যোগাযোগের আর কোনো উপায় জানা নেই অরুর ।

মেইল পাঠানো শেষ হলেও সেই কখন থেকে এক ধ্যানে ক্রীতিকের ছবির দিকে তৃষ্ণার্থ চাতকের ন্যায় তাকিয়ে আছে অরু, মনেমনে ভাবছে,
—– কতদিন আপনাকে দেখিনা, আপনি কত দূরেএএ।আপনার ছবির দিকে তাকালে হৃদয় কেঁপে ওঠে আমার,বারবার মনে হয় হাজার মাইল দূরত্বে নিজের অতি মূল্যবান কি যেন ফেলে এসেছি আমি, যখন মস্তিষ্কটা গভীর ভাবে ভাবতে থাকে কি সেই জিনিস? তখনই মনে পরে যায়, আমার আত্মাটাকেই তো আপনার মাঝে ফেলে রেখে এসেছি আমি। এখন আপনি হীন আমার আমিটার অস্তিত্ব যে পৃথিবীর বুকে থেকেও নেই। ছয়মাস আগে যখন আমেরিকাতে প্রথম পা রেখেছিলাম তখনও কি জানতাম? কেউ একজন আমার জন্য বুকের ভেতর ভালোবাসার পাহাড় জমিয়ে দিন রাত নিদারুণ কষ্টে অতিবাহিত করছে। আর এখন সেই কষ্টটা শুধে আসলে ফেরত দিচ্ছেন আপনি আমাকে। আপনি সত্যিই পা’ষাণ, আর নি’র্দয়। আপনি আমাকে না দেখে বেশ ভালোই থাকতে পারেন। শুধু শুধু সামনে এলে আমাকে ব্যথা দেওয়ার জন্যই পা’গলামি আর রা’গ দেখানোর নাটক করেন।এখন সব বুঝতে পারছি আমি।

প্রথমে ভালোবাসা, তারপর অভিমান অতঃপর সবশেষে বুকভা’ঙা কাতর কা’ন্না, এভাবেই যাচ্ছে অরুণ দিন। অরু ভালো নেই, ভালো থাকার কথাও নয়।এক অষ্টাদশীকে নিজের প্রেমে পা’গল করে দিয়ে ক্রীতিকের আর খোঁজ নেই।
যে ক্রীতিক জিদের তোপে গত আট বছর ধরে বাংলাদেশে আসেনি সে কখনোই হুট করে শুধুমাত্র অরুর টানে বাংলাদেশ চলে আসবে না নিশ্চয়ই?অরু হলফ করে বলতে পারে, ক্রীতিক আসবে না, আর এখানেই হয়তো অরুর অপারগতা,অসহায়ত্ব আর দুঃখের দিনের সূচনা।

অরু তখনও টেবিলের উপর মাথা এলিয়ে রেখে ল্যাপটপে ক্রীতিকের ছবির দিকে তাকিয়ে অযাচিত চিন্তায় বিভোর হয়ে ছিল। চোখের কার্নিশ দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল অশ্রুসিক্ত নোনাজল। ঠিক সে সময় হুট করেই রুমে প্রবেশ করে অনু। রুমের মাঝে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে তরিঘরি করে ল্যাপটপ বন্ধ করে চোখ মুছে পেছনে চাইলো অরু। দেখলো দরজার কাছে অনু দাড়িয়ে।

আজকাল অনুর মুখের দিকে তাকানো যায়না আর, সবসময় এইটুকুনি হয়ে থাকে শুকিয়ে । অনুর শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে গলা খাদে নামিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো অরু,
—- কিছু বলবি আপা?

অনু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
—- তোর সাথে একজন দেখা করতে এসেছে, ছাদে গিয়ে দেখ অপেক্ষা করছে বোধ হয়।

প্রেমিক পুরুষের হাজার কিলোমিটারের দূরত্বে নেতিয়ে যাওয়া মনটা হুট করেই লাফিয়ে উঠলো অরুর, হৃদ গহীনের কোথাও যেন প্রদীপ শিখার ন্যায় দপ করেই জ্বলে উঠলো একফালি আশার আলো। অনুর সাথে কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করায় সায় দিলোনা অরুর মন, ও তৎক্ষনাৎ গায়ে কোনোরকম ওড়নাটা জড়িয়ে ছুট লাগালো মহলের ছাদের দিকে।

ক্রীতিক কুঞ্জের তিনতলা বিশিষ্ট বিশাল মহলের লম্বা করিডোর পেরিয়ে চিলেকোঠার কাছে আসতেই হাঁপিয়ে উঠলো অরু।

দিনের দ্বিপ্রহর চলমান। তবুও চারিদিকে চৈত্র মাসের খাঁ খাঁ রোদ্দুরে চোখ জ্বলে যাচ্ছে। এই সময়ে ছাদের দিকে তাকালেও কেমন গলা শুকিয়ে আসছে, মনে হচ্ছে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে পু’ড়ে ফো’সকা পরে চামড়া উঠে আসবে।বুড়িগঙ্গা ছাপিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে যা ও একটু শীতল হাওয়া দিচ্ছে তাও রোদ পেরিয়ে এদিকে আসতে আসতেই হিটারের উত্তাপে পরিনত হচ্ছে।
অনেক গুলো দিন আমেরিকার বরফশীতল ঠান্ডা আবহাওয়ায় থেকে এসে এই রোদকে অরুর চোখে ঝ’লসানো অ’গ্নিদাহের মতোই ভ’য়ানক লাগছে। তাই কিছুক্ষণ চিলেকোঠার ঘরের সামনে দাড়িয়ে থেকে সেখান থেকেই গলা ছেড়ে ডাকলো অরু,
—– শুনছেন এদিকে আমি।

ওর প্রিয় আগন্তুক কোন দিকে দিয়ে আসবে তা ঠাহর করা যাচ্ছে না, তাই সহসা এদিক ওদিক উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে অরু। কিছু সময় যেতেই ওর চোখের সামনে দৃশ্যগত হলো সেই আগন্তুক। কিন্তু এতো জায়ান ক্রীতিক নয়, জায়ান ক্রীতিকের ধারে কাছের কেউ ও নয়। অকস্মাৎ ঝটকা টাকে সামাল দিতে না পেরে হতবিহ্বল হয়ে সামনের মানুষটার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে আছে অরু।
—– কেমন আছিস অরু?

চঞ্চলা হাসিতে ঠোঁট প্রসারিত করে প্রশ্ন ছুড়লো নীলিমা।
অনেকদিন বাদে দেখা, তাও অবাক না হয়েই মেকি হেসে অরু বলে,
—- হ্যা ভালো আছি।

চিরাচরিত মিথ্যে কথা, যা ওর চোখে মুখে স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে, তাও বলতে হয় তাই বলা।

—-কিন্তু তুই হঠাৎ ক্রীতিক কুঞ্জে?

অরুর করা দ্বিতীয় প্রশ্নে নীলিমা সহসা হেসে উত্তর দিলো,
—- তোর সাথেই দেখা করতে এলাম, অনু আপা ডেকে পাঠিয়েছে তোর নাকি মন মেজাজ ভালো নেই।

অরু মৃদু হেসে মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বললো,
—- তেমন কিছুনা আমি ঠিক আছি।

অরুর কথার পাছে নীলিমা কিছুই বললো না, শুধু নির্লিপ্ত চাহনীতে আগাগোড়া পরখ করলো ওর, মনেমনে ভাবলো,
—– এক নিখিল ভাইয়ের জন্য কি হাল হয়েছে মেয়েটার। নাদুস নুদুস মাখনের মতো শরীরটা শুকিয়ে চোদ্দ বছরের না বালিকাদের মতো লাগছে। গলার হাড় হাড্ডি সব বোঝা যাচ্ছে। তাও বলছে ও নাকি ঠিক আছে। নিখিল ভাই যে কেন অরুর একতরফা ভালোবাসা বুঝলো না, কে জানে?

নীলিমা সেই তখন থেকে চুপ হয়ে আছে দেখে অরু বললো,
—- দাঁড়িয়ে থাকবি চল নিচে যাই, এ বাড়িতে প্রথম এলি, তোকে ক্রীতিক কুঞ্জ ঘুরিয়ে দেখাই।

নীলিমা না সূচক মাথা নাড়িয়ে, অরুর হাতে হাত রেখে বললো,
—- তোকে আমার সামনে খুশি থাকার ভান করতে হবে না অরু, আমি জানি তুই পু’ড়ছিস।তবে আমি জিজ্ঞেস করবো না কেন এই দহন, সেটা না হয় তোর ভেতরেই থাকুক। আমি শুধু বলতে এসেছি, এভাবে মনমরা হয়ে ঘরে বসে আর কতদিন থাকবি বল? যে যাওয়ার সে তো গিয়েছে, তাই বলে তো আর জীবন থেমে থাকবে না,তাই না? আমি বলি কি তুই আবার পড়াশোনায় মন দে।

অরু না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
—– এই মূহুর্তে একাডেমিক পড়াশোনায় মন বসানোর মতো মন কিংবা মস্তিষ্কের অবস্থা নেই আমার নীলিমা। আমার একটু সময় লাগবে। তাছাড়া ইউ এস এ তে আমি ইকোনমিকস এ পড়তাম। এখন আবার হুট করে এখানে কি নিয়ে শুরু করবো তাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।

অরুর কথাগুলো শুনে নীলিমা মাথা নাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলো, পরক্ষণেই চট করে বলে উঠলো,
—– অরু, তোর তো সাহিত্যে বেশ আগ্রহ, তুই নোবেল পড়তে ভালোবাসিস।তুই একটা কাজ করতে পারিস, তুই বাংলা একাডেমির সাহিত্যকলায় ভর্তি হয়ে যা না। ওখানে প্রতিদিন সাহিত্যের আসর বসে, বিভিন্ন বয়সের কবি,সাহিত্যিক, গল্পকার রা ওখানে এসে নিজের লেখা কবিতা, গদ্য,উপন্যাস এসব পাঠ করে অন্যদের উৎসাহিত করেন।
ভেতরে পাবলিক লাইব্রেরীও আছে,একেবারে মনোরম শান্তি শান্তি পরিবেশ। যারা একটু নিরিবিলিতে সাহিত্য চর্চা কিংবা উপন্যাস লেখায় মনদিতে চায়,তারাই সকল ডিপ্রেশন ভুলে একাডেমিতে গিয়ে বইয়ের মাঝে কিংবা সাহিত্য আড্ডায় ডুব দেয় ।

তাছাড়া পাশের চারুকলা একাডেমিতে আমি প্রতিদিন আঁকাআঁকি আর স্কাল্পচারের কাজ শিখতে যাই, তুই যদি সাহিত্যকলায় ভর্তি হোস তাহলে দুজন মিলে প্রতিদিন একসাথে যাওয়া যাবে।

নীলিমার কথাটা একেবারেই ফেলনা নয়, বরং অরুর ভা’ঙাচোরা মনটা ভালোই আগ্রহ পেলো ওর প্রস্তাবে। সেইসাথে অরুর মস্তিষ্কে খেলে গেলো আরও একটা কৌশলী পরিকল্পনা, মনেমনে ভাবলো,

—– এটাই সুযোগ মাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে পড়াশোনার নাম করে বিয়ে দেখা থেকে আটকানো যাবে। তাছাড়া সাহিত্যে মায়ের বেশ আগ্রহ আমি একাডেমিতে ভর্তি হতে চাই শুনলে না করবে না নিশ্চয়ই?

অরু কিছু একটা ভাবছে থেকে নীলিমা ব্যথাতুর কন্ঠে বললো,
—- একটু সময় নে, তারপর না হয় সিন্ধান্ত নিস। আর হ্যা ওসব পেছনের কথা ভুলে যা, দেখবি তোর জীবনে এমন কেউ আসবে যে তোর চোখের দিকে তাকালেও ভালোবাসার গভীরতা মাপতে পারবে, হাত বাড়িয়ে নয় বরং হৃদয় বাড়িয়ে স্পর্শ করবে তোর সুপ্ত অনুভূতি গুলোকে।

নীলিমার কথায় অরু আশ্চর্য হয়ে বললো,
—– কি বলছিস এসব নীলিমা? আমার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সবকিছু উনিই।সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাড়িয়েছে,এখন আর ওনাকে ছাড়া দ্বিতীয় পুরুষকে আমি আমার জীবনে কল্পনাও করতে পারিনা। উনি ছাড়া অন্যকেউ ভালোবেসে স্পর্শ করার আগে ম’রণ হোক আমার।

নীলিমা বুঝতে পারে মেয়েটা নিখিল ভাইয়ের প্রতি খুবই সিরিয়াস।তাই এসব ভুলে যাওয়া টাওয়ার কথা বাড়িয়ে আর মন খারাপ করলো না অরুর, সহসা কথা ঘুরিয়ে শুধালো,
—- রাখ এসব মন খারাপের কথা, আমেরিকাতে কি কি করলি তাই বল?

গোধূলী বেলায় বিকেলের অসহিষ্ণু তীব্র রোদ, এখন অনেকটা সহনীয় হয়ে এসেছে, অদূরে কান ফাটানো হুইসেল বাজিয়ে একে একে সদরঘাট ছাড়ছে লঞ্চ গুলো। বুড়িগঙ্গা পারের নাতিশীতোষ্ণ হাওয়ার বেগ বেড়েছে, সেই সাথে বড় আমগাছটার ছায়ায় ঢাকা পরেছে শেষ বিকেলের ম’রা রোদ। অরু এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা কাঁচা আম ছিড়ে, ছাঁদের পাঁচিলে পা দুলিয়ে বসতে বসতে বললো,

—– আয় বলছি।

***********************************************
নিকোশ আধারে ছেয়ে গেছে সন্ধ্যার আকাশ। সূর্যের শেষ লালিমা টুকুও অবশিষ্ট নেই আর। চারদিকে ভ্যাপসা গরম, শেষ রাতে কালবৈশাখী ঝড় হলেও হতে পারে,পশ্চিম আকাশের বিদ্যুৎ চমকানোর গতিবেগ দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। অরু মাত্রই নীলিমাকে গেইট থেকে রিকশায় তুলে দিয়ে ফিরে এলো।

ভ্যাপসা গরমে জীবন অতিষ্ট, তারউপর হাঁটু সমান লম্বা চুল। অনেকটা শুকিয়ে যাওয়াতে এতো লম্বা চুলের ভার বইতেও আজকাল কষ্ট হয়ে যায় অরুর। ও কোনো রকম চুলগুলো মাথার উপর চুড়ো করে বাধতে বাঁধতে অন্দরমহলের দিকেই যাচ্ছিল। তখনই ওপাশের বাগান বিলাশের ঝোপের আড়াল থেকে ওর কানে ভেসে আসে ক্রন্দনরত অনুর অস্পষ্ট কিছু কথা। অনুর কথাগুলো ভালো মতো ঠাওর করার জন্য এগিয়ে গিয়ে বাগানবিলাশের অন্যপাশে দাঁড়াতেই অরু শুনতে পেলো কা’ন্নারত অনুর শেষ কথা,

—– আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে প্রত্যয় সাহেব। আমি আপনাকে দেওয়া কথা রাখতে পারিনি, আমার জন্য দ্বিতীয়বার আপনাকে কষ্ট পেতে হলো, কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি মোটেই ভালো মেয়ে নই,খুব খারাপ, সব ছেলের সাথেই এমন ভালোবাসার নাটক করি, আমি আপনার এক্স তিন্নির থেকেও খারাপ। আমাকে বিয়ে করে আপনি একটুও ভালো থাকতেন না, তাই যা হয় ভালোর জন্যই হয়। ভবিতব্য মেনে নিন।আর আমাকে ভুলে যান।

ওপাশ থেকে প্রত্যয় কি বললো না বললো কিছুই শোনা গেলো না, উল্টো অনু তাড়া দিয়ে বললো,
—- আমার স্বামী ডাকছে প্রত্যয় সাহেব, আমাকে যেতে হবে। কাল বাসর রাত ছিলো কিনা, ডাকবেই তো। এখন রাখছি, আর কখনো কথা হবেনা আমাদের।দোয়া করি, আপনি আমেরিকাতে সত্যিকারের সোলমেট কাউকে না কাউকে ঠিক পেয়ে যাবেন।তখন আমাকে কিংবা আমার দেওয়া পাথরের মতো আ’ঘাত গুলোকে মনে পরবে না আর।আপনি খুব সুখি হবেন।

এরপর কল কাটার পিক পিক আওয়াজ হলো, বোধ প্রত্যয়ই লাইনটা কেঁটে দিলো।

—-আর আমি এও জানি আপনার মতো পিওর হার্ট কে কষ্ট দিয়ে আমি কোনোদিনও সুখের মুখ দেখতে পাবো না, আর না আপনাকে কখনো ভুলতে পারবো।

অস্ফুটে কথাটা বলেই শুকনো মর্মরে পাতার উপর ধপ করে বসে পরে বোবা কা’ন্নায় ভেঙে পরলো অনু।

অনুর এহেন হাল না হলে অরু হয়তো ছুটে গিয়ে প্রত্যয়ের সাথে কথা বলতে চাইতো,প্রত্যয়ের মাধ্যমে ক্রীতিকের খোজ নিতো। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়। আপাতত সব দুঃখ কষ্ট ভুলে গিয়ে রাগে ফুঁসছে অরু। বোনের উপর রাগটা যেন পাহাড় সমান উঠে এসেছে, আ’গ্নেয়গিরির সুপ্ত লাভার মতোই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মস্তিষ্কটা।

অরু নিজের রাগ দমাতে না পেরে বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে অনুর সামনে দাড়িয়ে শক্ত গলায় বললো,
—–এভাবে শুধু শুধু মিথ্যে বলে একজনকে কষ্টের সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়ার কি মানে ছিল আপা?

অনু দু’হাতে মুখ চেপে কা’ন্নার আওয়াজ সংবরণ করছে ঠিকই কিন্তু ওদিকে হৃদয়টা ছি’ন্নভি’ন্ন হয়ে যাচ্ছে অপারগ কা’ন্নার তালে।

বোনকে এভাবে কাঁদতে দেখে মন টললো না অরুর, ও দিগুন আওয়াজে বললো,
—- কি হলো বল আপা? কেন করলি এটা? যে মানুষটা হাজার মাইল দূরে থেকেও নাম্বার সংগ্রহ করে তোকে কল দিয়ে তোর খোঁজ নিতে ভুললো না, তাকে তুই এভাবে ফিরিয়ে দিলি?
অথচ আমাকে দেখ চাতক পাখির মতো ছটফট করছি জায়ান ক্রীতিকের একটুখানি খবর পাবো বলে, কিন্তু জায়ান ক্রীতিক তো প্রত্যয় ভাইয়ার মতো এতোটা সদয় নয়। তাহলে কেন করলি এটা?

অরুর কথার পাছে অনু এবার হেঁচকি তুলে বললো,
—- যা করেছি চিন্তা ভাবনা করে, বুঝে শুনে করেছি,তোর টেনশনে এমনিতেই মায়ের শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। বাড়িতে প্রতিনিয়ত একের পর এক ঝামেলা লেগেই আছে। এখন যদি আমিও এসব বলে মা’কে নিরাশ করি তাহলে মা’কে আর বাঁচাতে পারবো না অরু। পরিবারের বড় সন্তানের জন্মই হয় স্যাক্রিফাইস করার জন্য, আমিও নাহয় মায়ের কথা ভেবে নিজের ভালোবাসাকে স্যাক্রিফাইস করলাম। এ আর এমন কি?

কথা শেষ করে পুনরায় কা’ন্নায় ভে’ঙে পরলো অনু।

অনুর কথার যুক্তি আছে,কিন্তু অনুর ভালোবাসা না মানার মতো তো কোনো কারন নেই? অনু তো আর নিজের সৎ ভাইয়ের প্রেমে পরেনি। আর না ক্রীতিকের মতো প্রত্যয়ের সাথে মায়ের কোনো ব্যক্তিগত ঝামেলা আছে, তাহলে মাকে একবার খুলে বলতে সমস্যা কি?

অনুর কান্নাকা’টি দেখে অরু তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নিলো ও গিয়ে মাকে সত্যিটা বলবে, নরম সুরেই বলবে বোঝানোর চেষ্টা করবে তারপর যা হওয়ার হোক। নিজের সিদ্ধান্তকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়ে অনুকে রেখেই দ্রুত যায়গা ত্যাগ করলো অরু। দ্রুত পদধ্বনিতে মায়ের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনেমনে ভাবলো,
—— আমি না হয় জায়ান ক্রীতিকের প্রেমে পরে খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছি,কিন্তু আপা তো আর তেমন কিছু করেনি, তাহলে আপা কেন নিজের ভালোবাসার মানুষকে আপন করে পাবেনা?

***********************************************
ভর সন্ধ্যা বেলা এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে একটু ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আজমেরী শেখ।

বাংলাদেশে ফিরে আজকেই প্রথম অফিসে গিয়েছিলেন তিনি, অফিস থেকে ফিরে সব ফাইল পত্র গুছিয়ে কেবলই শুতে যাবেন তখনই হুরমুরিয়ে কক্ষে প্রবেশ করলো অরু।

অরুর সাথে আজকাল খুব একটা কথা বলেন না আজমেরী শেখ, অরুর চোখের দিকে চাইলেই ক্রীতিকের জন্য এক অদম্য ব্যথাতুর ভালোবাসার জোয়ার দেখতে পান তিনি। যা আজমেরী শেখের মোটেই পছন্দ নয়।নিজের সৎ ছেলের সঙ্গে কিভাবে তার মেয়ে ছি ছি। ভাবলেও বিরক্ত লাগে তার, অগত্যাই সেসব চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে, হেড বোর্ডে গা এলিয়ে দিয়ে বইয়ের পাতায় চোখ দুটো নিবদ্ধ রেখে মেয়েকে শুধালেন,
—- কি প্রয়োজন?

অরু প্রথমে কিছুক্ষন তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তখনই পুনরায় আওয়াজ ভেসে এলো ওদিক থেকে,
—-কিছু বলার না থাকলে যেতে পারো, আমি একটু রেস্ট করবো।

মনের মাঝের সকল শঙ্কাকে হটিয়ে অরু এবার চট করে বলেই ফেললো,
—– মা আপা একজন ভালোবাসে, তুমি রেজা ভাইয়ের সাথে আপার বিয়েটা দিওনা,আপা মুখ ফুটে কিছু বলবে না তোমাকে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ক’ষ্টের বোঝা বইতে বইতে আপা হয়তো ম’রেই যাবে।

অরুর কথায় তৎক্ষনাৎ হাতের বইটা ডিভানে ছু’ড়ে মে’রে গভীর গলায় প্রশ্ন করলেন আজমেরী শেখ,
—- সে আবার কার সাথে ন’ষ্টামো করে বেরিয়েছে?

নোংরা কথাটা যে আকারে ইঙ্গিতে অরুকে বলা হয়েছে, সেটা অরু ভালোমতোই বুঝতে পেরেছে,তবুও মায়ের কথা গায়ে না মেখে নরম গলায় বললো,
—– পপপ্রত্যয় ভাইয়া।

—- সি এফ ও অফ জেকে গ্রুপ?

মায়ের কথায় অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়াতেই কোথা থেকে যেন শ’ক্ত চ’পেটাঘা’ত এসে আঁচড়ে পরলো অরুর গালে। শরীরটা বেশ দূর্বল, তারউপর এতো শক্ত চ’ড় খেয়ে দু কদম পিছিয়ে গেলো অরু।তীব্র ব্যথায় চ’ড় খাওয়া গালে হাতদিয়ে চোখদুটো খানিকক্ষণ খিঁচে রাখলো ও। অরুর দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে অনু বললো,
—- তোকে আমি এসব বলতে বলেছি? সত্যি করে বল অরু? আমিকি একবারও বলেছি মাকে গিয়ে এসব বল, তাহলে কেন বললি?

অরু ফুপিয়ে উঠে বললো,
—— আমিতো মিথ্যে কিছু বলিনি আপা, তাছাড়া যা বলেছি তোর ভালোর জন্যই…

অরু কথা শেষ করার আগেই অনু তেতে উঠে বললো,
—–কে বলেছিল তোকে আমার ভালো করতে? আমি বলেছি?আমার ভালো করতে গিয়ে এখন যদি মায়ের কিছু হয়ে যায় তখন কি করবি তুই? এমনিতেই সারা ঘরে একাই অশান্তি বাধিয়ে রেখেছিস, আর কত অশান্তি হলে থামবি তুই? বল আমায়?

অনুর প্রতিটি ঝাঁঝালো কথায় ডুকরে কেঁদে ওঠে অরু। ওর শরীরটাও যে আর নিতে পারছে এই অশান্তি। অথচ যার কারণে এই ন’রক জীবন যাপন, তারই তো হদিস নেই। সে আদৌও বাংলাদেশে ফিরবে কিনা তাও জানা নেই অরুর। অথচ সব অপবাদ, সব তিরস্কার এসে জুটলো অরুর কপালে। বিয়ের পরে তো এইসব অশান্তিরই ভ’য় পেয়েছিল অরু।

নিজের আকাশচুম্বি রা’গকে দমাতে না পেরে অনু আরও কিছু বলবে, তার আগেই আজমেরী শেখ বলে ওঠেন,
—– তোমরা দুজনই এক্ষুনি বাইরে যাও, শরীরটা ভালো লাগছে না আমার। একটু একা থাকতে চাই।

অনু এগিয়ে এসে বললো,
—- মা কোথায় খারাপ লাগছে তোমার? বলো আমায়, মাথা টিপে দেবো একটু।

—– চুপচাপ বাইরে যাও।

আজমেরী শেখের রাশভারি আওয়াজে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল অনুর, ও তৎক্ষনাৎ অরুর হাত ধরে গম্ভীর গলায় বললো,

—– চল।

***********************************************
চোখের পলকে খসখস করে উল্টে গিয়েছে ক্যালন্ডারের পাতা। বাংলা ক্যালেন্ডারের শেষ পাতাকে বিদায় জানিয়ে বৈশাখ এসেছে ধরনীতে।

অরুরা বাংলাদেশ ফিরেছে প্রায় একমাস হতে চললো। বৈশাখে পা দিতে না দিতেই প্রায় প্রতিটি বিকেলেই আকাশ কালো করে তীব্র ঝড়ে ফেটে পরে প্রকৃতি। আজকেও তেমন এক বিকেল, মেঘ তো নয় যেন আকাশ জুড়ে বুনো মহিষের পাল। সেথা থেকে গুড়গুড়িয়ে ভেসে আসছে কাল বৈশাখী সংকেত। চারিদিকে ঘূর্নি হাওয়া বইছে।

একাডেমী গেইট দিয়ে বেরিয়ে অরু দ্রুত পা চালাচ্ছে বাড়ির দিকে। আজ পুরো রাস্তায় একটাও রিকশার দেখা নেই।যার ফলসরূপ পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে অরুকে। তবে মেইন রাস্তা ছেড়ে গলির মোড়ে ঢুকতেই দেখা মিললো চেনা পরিচিত একটা সাদা গাড়ির। অরু ফুটপাত ধরে এগিয়ে আসতেই সহসা গাড়ির কাঁচ নামিয়ে কিছুটা ঘাড় বাকিয়ে উঁকি দিলো ধূসররঙের সিকোয়েন্স পাঞ্জাবি পরিচিত এক সুদর্শন। চোখে তার রোদ চশমা। অরু কাছাকাছি আসতেই লোকটা আগ বাড়িয়ে বললো,
—- আরে অরোরা যে,

অরু সম্মোহনী হেসে জবাব দিলো,
—- জ্বি অমিত ভাই।

অমিত আরিয়ান, বাংলা একাডেমিতে যার যাতায়াত অহরহ। থাকবে নাইবা কেন, এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটা নামকরা উপন্যাস আর ছোট গল্প প্রকাশিত হয়েছে তার। বছরের বেস্ট সেলের তালিকায় তার বইয়ের নামই সর্বাগ্রে। সাহিত্য কলার সদস্যদের কাছে অমিত আরিয়ান অনেকটা সেলিব্রিটিদের মতোই, যে একাডেমিতে আসলে হইচই লেগে যায় পুরো একাডেমি জুড়ে, কেউ নিজের পছন্দের বইয়ের পাতায় অটোগ্রাফ নেয়, তো কেউ পাশে দাড়িয়ে সেলফি।

মূলত গত বছর অমিতের যে রোমান্টিক জনরার উপন্যাসটি বের হয়েছে সেটার পর থেকেই অমিতের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। অরুও সভাব সুলভ সেই উপন্যাসটা পরেছিল। পড়ার পরেই বুঝেছিল অমিত আদতে কতটা জ্ঞানের অধিকারী।একাডেমিতে নবীনদের বেশ ভালো উৎসাহ দেয় অমিত,সেইসাথে ছোটখাটো টিপস।

সেখান থেকেই মূলত অরুর সাথে মুখ চেনা চিনির পরিচয়। দেখা হলে নিজের ছোট বোনের মতোই লিখালিখি তে দু এক লাইন উৎসাহ দিয়ে যান অরুকে।অরুও বড় ভাইয়ের মতোই শ্রদ্ধার নজরে দেখে অমিতকে, মাঝে মধ্যে নিজে থেকে দুএকটা প্রশ্নও করে বটে। যদি তার বিশাল জ্ঞান ভান্ডার থেকে এক আধটু আহরণ করা যায় সেই উদ্দেশ্যে। তাছাড়া অমিতকে শ্রদ্ধা না করার তো কোনো কারণ নেই, আজ অবধি কখনো কোনো মেয়ে ঘটিত কিংবা অন্য কোনো খারাপ স্ক্যান্ডালে নাম জড়ায়নি অমিতের। অরু অন্তত শোনেনি কখনো।

—-এই গলিতে কি করো হুম?

অমিতের প্রশ্নে ভাবনার সুতো ছিঁড়লো অরুর, মৃদু হেসে জবাব দিলো,
—- এই গলিতেই থাকি আমি।

—- ও এম জি, কোথায় থাকো?

অরু ইতস্তত কন্ঠে বললো,
—- জ্বি, ক্রীতিক কুঞ্জে।

আজকাল বাড়ির নামটা মুখে নিতেও কেমন যেন দম আটকে আসে অরুর। বাড়ির নামেও যে তার স্মৃতি জড়িয়ে।

অমিত আশ্চর্য হয়ে গেলো অরুর কথায়, চোখ দুটো বড়বড় করে বললো,
—– তুমি চৌধুরী বাড়ির মেয়ে?
জামশেদ জায়ান কি হয় তোমার?

এতো ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করলো না অরুর, তাই গতানুগতিক কথা এড়িয়ে অরু বললো,
—- আকাশ কালো করেছে, মনে হয় ঝড় আসবে আমি আসি অমিত ভাই।

—– আরে কোথায় যাচ্ছো, গাড়িতে এসো আমি এগিয়ে দিচ্ছি ঝড়ে পরবে তো।

অরু দ্রুত পা চালাতে চালাতে বললো,
—– দরকার নেই চলে যেতে পারবো।

অরু চলে গিয়েছে অনেকক্ষন, অমিত এখনো সেদিকে তাকিয়ে, থাকতে থাকতে ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো,
—– এতো সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটা সবসময় মুখ কালো করে থাকে কিসের এতো দুঃখ ওর?

অরু ঘরে ঢুকে ব্যাগটা ছোফার উপর ছু’ড়ে ফেলে ডাইনিং এ গিয়ে ঢকঢক করে একগ্লাস পানি পান করলো।

পানিটা শেষ হতেই কানে ভেসে এলো মামির গা জ্বালানো কথা,
—- বিদেশ থেকে এক কাহিনী করে এসেছে, এখন আবার সন্ধ্যে পর্যন্ত বাইরে বাইরে ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে বেড়ায়।

আমিও দেখবো আজমেরী কিভাবে বিয়ে দেয় এই ধিঙ্গি মেয়ে গুলোর। একজনকে তো এ বাড়ির ছেলেই ফূর্তি করে ছেড়ে দিলো,কই আর তো এলোনা, জানি জানি আর আসবেও না। যা নেওয়ার ছিল সে তা নিয়ে নিয়েছে। এখন আর কি করবে এই হাড় হাড্ডি ওয়ালা মেয়েকে দিয়ে?

অরু জানে মামি চটে আছে,চটে থাকারই কথা সেদিন অনুর ব্যাপারে সত্যি কথা গুলো বলে দেওয়ার পর আজমেরী শেখ আর বিয়েটা নিয়ে কথা বাড়ায়নি। সেই তেজে মামিও আর ক্রীতিক কুঞ্জ ছাড়েনি। সেও দেখতে চায় ঠিক কতদিন আর মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে থাকতে পারে আজমেরী। তার সোনার টুকরো ছেলেকে অনুর সাথে বিয়ে দিয়ে তবেই এ বাড়ি থেকে যাবে সে।

অন্যান্য দিন চুপচাপ থাকলেও আজ একটু বেশিই বেড়েছে মামি,তার কারন আজ বাড়িতে অনু আর মা নেই। ব্যবসায়ী কাজে শহরের বাইরে গিয়েছে আজমেরী শেখ। শরীরটা ভালো না থাকার কারনে সাথে করে অনুকেও নিয়ে গিয়েছে। সেই সুযোগে অরুকে আজ ইচ্ছে মতো কথা শোনাচ্ছেন জাহানারা।

জাহানারা যখন এ বাড়ির ছোট সাহেব কে জড়িয়ে অরুকে হাজারটা নোংরা কটাক্ষ করায় ব্যস্ত, তখনই হন্তদন্ত হয়ে বাইরে থেকে ছুটে আসে রুপা, কোনমনে হাঁপাতে হাঁপাতে গলা ছেড়ে ডেকে বলে,
—- মা, লম্বা মতো একটা ভাইয়া, রেজা ভাইয়াকে ইচ্ছে মতো পে’টাচ্ছে।

অরুর দুই পয়সার ইন্টারেস্ট নেই ওদের মা’রামা’রিতে, রেজা গোল্লায় যাক তাতে ওর কি? সেই হিসেব মতে ব্যাগটা নিয়ে উপরের দিকে হাঁটা দিলো অরু।

জাহানারা হকচকিয়ে উঠে বললো,
—- কে মা’রে আমার ছেলেকে, এতো বড় সাহস কার?

রুপা ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
—- জানিনা, কখনো দেখিও নি এই মহল্লায়। দেখতে বিদেশিদের মতো কিন্তু বিদেশি না, ভাইয়াকে বাংলায় গা’লি দিচ্ছিলো।

রুপার শেষ কয়েকটা কথা ছক্কা লাগার মতোই অরুর মস্তিষ্কে গিয়ে লাগলো, অজানা শিহরণে থরথরিয়ে কেঁপে উঠল ওর পুরো শরীর। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। টলমলে চোখদুটো দেখে মনে হচ্ছে এখনই চেতনা হারাবে ও। কিন্তু হারালো না। হাতদুটো শক্ত করে নিজেকে স্থির রেখে কাঁপা কন্ঠে বললো,
—– রুপা,যে এসেছে তার চুল গুলো কি ঘাড় অবধি লম্বা? আর চোখ গুলো কি ভাসা ভাসা?

রুপা ঠোঁট উল্টে হ্যা সূচক মাথা নাড়াতেই কাঁধ থেকে ব্যাগটা ফেলে দিয়ে বাইরের দিকে ছুট লাগালো অরু।
ওর পরনে সুতির স্কার্ট আর টপস, লম্বা চুলগুলো পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে কোনমতে আটকানো। দুই পায়ে ক্রীতিকের পরিয়ে দেওয়া দুটো সোনার নুপুর। সেভাবেই ছুটছে অরু।

তবে অন্দরমহল থেকে বেরোনোর আগেই খপ করে ওর হাত টেনে ধরলো জাহানারা, চোখ রাঙিয়ে শুধালো,
—- কে এসেছে সত্যি করে বল?

অরু জবাব দিলো না, এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে ছুটে চলে গেলো সদর দরজার বাইরে, তবে ক্রীতিকের দিকে আর এক পা ও এগোতে না দিয়ে ওকে আবারও শক্ত করে চেপে ধরলো জাহানারা। হুট করে এভাবে টেনে ধরায় সদর দরজায় হুমড়ি খেয়ে পরে গেলো অরু। ঠিক তখনই একজোড়া মোহাবিষ্ট ভাসা ভাসা চোখ স্থির হলো অরুর চোখে।

চোখের সামনে অরুকে দেখা মাত্রই হাতের হ’কিস্টিকটা দূরে ছু’ড়ে মা’রলো ক্রীতিক।
তারপর দাড়িয়ে রইলো রেজার পরবর্তী পদক্ষেপের অপেক্ষায়।

ক্রীতিককে এভাবে দাড়িয়ে পরতে দেখে হকচকিয়ে উঠলো অরু, এক্ষুনি তো রেজার চ্যালাপ্যালারা ক্রীতিকের উপর নিজেদের রা’গ ঝা’ড়তে উদ্যত হবে, তাহলে এভাবে দাঁড়িয়ে পরার কি মানে?
অরু সেদিকে তাকিয়ে দু’হাতে ভর করে উঠতে যাবে তখনই ক্রীতিককে একেরপর এক তীব্র ক’ষাঘা’ত করতে লাগলো রেজার লোকেরা।

সঙ্গে সঙ্গে আবারও মুখ থুবড়ে পরলো অরু, চোখের সামনে নিজের স্বামীকে এভাবে মা’র খেতে দেখে হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে ছি’ড়ে যাচ্ছে ওর।অথচ ক্রীতিক এক ধ্যানে অরুর দিকে তাকিয়ে মা’র খেয়ে যাচ্ছে।

মা’র খেতে খেতে এক পর্যায়ে ঠোঁট কে’টে ফিনকি দিয়ে র’ক্ত বেরিয়ে এলো ক্রীতিকের। ও হাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁটের র’ক্তটুকু মুছতে মুছতে ক্রুর হাসি হাসলো অরুর পানে চেয়ে।

ক্রীতিক কুঞ্জে দাড়িয়ে, ক্রীতিক কুঞ্জের মালিকই কিনা মা’র খাচ্ছে, তাও বাইরের লোকের হাতে। শুধু মাত্র অরুকে কাঁদানোর জন্য।

এবং সেই উদ্দেশ্য সফল ও হয়েছে, অরু বেশ ক’ষ্ট পাচ্ছে। যার প্রেক্ষিতে পৈচাশিক হাসিতে প্রসারিত হলো ক্রীতিকের দু’ঠোঁট। তবে এই অসহনীয় দৃশ্য আর সহ্য করতে পারলো না অরু,গলা ছে’ড়ে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—- ওনাকে মা’রছো কেন?ছাড়ো, উনি এই বাড়ির ছোট সাহেব।

অরুর শেষ কথাতে চমকে উঠে ভ’য়ে তটস্থ হয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেলো সকলে।তবে শেষ রক্ষা হলো না আর।

ক্রীতিক কিছু না বললেও, এলিসা, অর্ণব আর সায়র গাড়ি থেকে নেমে এই দৃশ্য দেখেই দৌড়ে এসে একেক টাকে ইচ্ছে মতো রা’ম ধো’লাই দিয়ে মুখ বেঁকিয়ে দিলো।

আর ক্রীতিক ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো অরুর দিকে। অরুও কোনো মতে হাতের তালুতে ভর করে উঠে দাড়ালো, এই আশায় হয়তো এখনই ঝড়ের বেগে ছুটে এসে ওকে বুকের মাঝে জাপ্টে ধরবে ক্রীতিক। কিন্তু আদতে তেমন কিছুই হলোনা ক্রীতিক এগিয়ে এসে অরুকে ধরা তো দুরে থাক ওর ধারে কাছেও এলোনা, উল্টো অরু এগিয়ে এসে ওর ক্ষ’তস্থানে হাত ছোঁয়াতে গেলে বিদ্যুৎ বেগে দূরে সরে যায় ক্রীতিক।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here