সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁 #পর্বঃ৫৬ #লেখনীতে_suraiya_rafa

0
568

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ৫৬
#লেখনীতে_suraiya_rafa
(কপি করা নিষিদ্ধ 🚫)
(কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য)

সুন্দর একটা দিনের সূচনা হলো ধরণীতে। বিগত ঊনিশ বছরের জীবনে যতগুলো সুন্দর সকাল পার করে এসেছে অরু, তার মধ্যে আজকের সকালটা অন্যতম। অবশ্য অরুর নিকট ক্রীতিকের সংস্পর্শের সকাল গুলো বরাবরই স্বপ্নের মতোই সুন্দর আর আনন্দদায়ক। কাল রাতে ঝড়ো হাওয়ার তান্ডব ছিল প্রকট, তবে বৃষ্টি হয়নি এক ফোঁটাও। অথচ আজ সকাল সকালই আকাশ বাতাস ছাপিয়ে ঝুম বৃষ্টিতে মুখরিত চারপাশ।

সকালের আকাশটা ঘুটঘুটে কালো মেঘে ঢাকা পরেছে, আজ আর সূর্যের মুখ দেখা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। আমেরিকার এই এক বেহাল দশা, আবহাওয়ার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই এখানে, এই রোদ তো এই বৃষ্টি।

আজ অরুর ঘুম ভাঙলো বৃষ্টির রিমঝিম আওয়াজে। বাইরে একফোঁটাও দিনের আলো নেই,তাই পর্দার ভাড়ি পাল্লা টেনে রাখা রুমটাও ঘুটঘুটে আঁধারে ছেয়ে আছে, অরু পিটপিট করে চোখ খুলে পুরো রুম হাতরে কোথাও ক্রীতিকের দেখা পেলো না। এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে হুট করেই কোথায় চলে গেলো লোকটা, কে জানে? অরু খুব বেশি ভাবলোও না, আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসে স্বভাব বশত বিছানা হাতরে ক্রীতিকের ফোনটা তুলে নিলো হাতে। দুজনার বার্থডে দিয়ে সেট করা পাসওয়ার্ডটা খুলে একেকটা ফোল্ডারে ঢুকে এটা সেটা দেখতে লাগলো অরু, যদিওবা অরুর মতে এই মোবাইলটার থেকে বোরিং মোবাইল ফোন দুনিয়াতে আর দুটো নেই।কি সব হাবিজাবি ডকুমেন্টস দিয়ে ভর্তি সব। গ্যালারীতেও কিছু নেই, সর্বশেষ ছবি তোলা হয়েছে আরও মাস দুইয়েক আগে।তাতে দেখা যাচ্ছে দার্জিলিং এ সায়রের হোমস্টে থেকে কাঞ্চনজঙ্খার একটা ঝাপসা ভিউ।

— ধুর বোরিং।

ফোনের সব গুলো সফটওয়্যারে ছোটমোটো একটা ঢু মে’রে হতাশ হয়ে ঠোঁট উল্টে কথাটা বলে ফোনটা সাইডে রেখে দিলো অরু, ঠিক এমন সময় ফোন থেকে আগত টুংটাং ম্যাসেজের আওয়াজ পুনরায় আকর্ষন কেড়ে নিলো ওর, তাইতো সকাল সকাল কে ম্যাসেজ দিয়েছে দেখার জন্য আবারও নতুন উদ্যমে ফোনটা হাতে নিলো অরু, নোটিফিকেশনে ভাসছে অর্ণবের নাম, সাথে কিছু ভিডিও লিংক আর ছোট্ট বার্তা।
— ডান ব্রো।

ছোট্ট ম্যাসেজে চোখ বুলিয়ে মনের মাঝের কৌতুহল আর দমিয়ে রাখতে পারলো না অরু, ফট করেই ঢুকে গেলো লিংকে।আর ঢুকে যা দেখলো তাতে সমস্ত গাঁ গুলিয়ে উঠলো ওর, তৎক্ষনাৎ একটা বিরক্তিকর ভাব প্রকাশ পেল চেহারার আদলে, সঙ্গে সঙ্গে কয়েকহাত দূরে ছুড়ে মা’রলো ফোনটাকে,অতঃপর ক্রীতিকের উপর ক্রোধান্বিত হয়ে একা একাই তেঁতো গলায় বলে উঠলো,
— ডার্ক রোম্যান্স শোনেন সেটা মানলাম, তাই বলে উনি এইসব দেখবেন? ছিহ!

কথাটা বলতে বলতেই কপালের মাঝে সুক্ষ্ম চিন্তার ভাঁজ পরলো অরুর, কিছু একটা মনে পরার মতো সচকিত হয়ে বিড়বিড়ালো ও,
—- এক সেকেন্ড, ভিডিওর লোকটাকে চেনা চেনা লাগলো মনে হচ্ছে , কোথায় যেন দেখেছি।

সন্দেহের বশবর্তী হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আরও একবার ভিডিও তে চোখ বোলালো অরু, আর যা দেখলো তাতে ওর হাড় হীম হয়ে গেলো আ’তঙ্কে। ভীষণ আশ্চর্য হয়ে চোয়াল জোড়া আপনা আপনি দু’দিকে ফাঁক হয়ে গেলো ওর, মুখ দিয়ে বেরোলো অস্পষ্ট আওয়াজ,
—- রেজা ভাই এসব কি করছে? আর এমন একটা ভিডিও ইন্টারনেটেই বা কি করে এলো?

অরুর ছোট্ট মস্তিষ্কটা কোনো কিছুরই ইঙ্গিত দিতে পারলো না হঠাৎ করে, একটু নড়েচড়ে বসে ভিডিওটাতে আবারও নজর দিয়ে বারবার পজ করে লেকটার চেহারা ভালোমতো পরখ করলো অরু, অতঃপর অস্ফুটেই বললো,
— অণর্ব ভাইয়া রেজা ভাইয়ের এমন গোপনীয় একটা ভিডিও ওনাকে পাঠালো কেন হঠাৎ? ক্রীতিক কুঞ্জের সব ঠিকঠাক আছে তো? নাকি সাংবাদিকরা মা’কে এসবের জন্য বিরক্ত করছে?

হাজারটা দুশ্চিন্তায় ভার হয়ে এলো অরুর মাথাটা, মস্তিষ্কে জড়ো হওয়া কোনো প্রশ্নেরই উত্তর নেই অরুর কাছে।সবকিছুর উত্তর জানতে হলে ক্রীতিককে প্রয়োজন, কিন্তু সে কোথায়? শেষ প্রশ্নটা মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই ক্রীতিককে খোঁজার উদ্দেশ্যে মোবাইল সমেত রুম থেকে বেরিয়ে গেলো অরু। তাড়াহুড়োয় ভুলেই গেলো যে ওর পড়নে এখনো ক্রীতিকের ওভার সাইজ টিশার্ট রয়েছে , জামাটা অন্তত বদলানো উচিৎ ছিল।

এদিক সেদিক খুঁজে অবশেষে ক্রীতিকের দেখা মিললো জিমে। ছোট্ট ডুপ্লেক্স বাড়িটার সবচেয়ে বড় রুমটাই ক্রীতিকের ব্যক্তিগত জিমনেশিয়াম। যদিওবা এই রুমে খুব কমই আসা হয়েছে অরুর, কারণ জিমে ওর কাজটাই বা কিই? তাও আজ খুঁজতে খুঁজত এখানেই হদিস মিললো ক্রীতিকের, অরু একটু উঁকি ঝুঁকি দিয়ে ভেতরে ঢুকেই দেখলো, ক্রীতিক ট্রেডমিলের উপর সমানে দৌড়াচ্ছে, ওর পরনে ওভার সাইজ ব্যাগী প্যান্ট আর কালো রঙা স্যান্ডোগেঞ্জি। মাথাটা কালো ক্যাপ দিয়ে ঢাকা। তাও পেছন থেকে মাথার শেষভাগের সেলাইয়ের দাগ গুলো স্পষ্ট দৃশ্যমান, চুল বড় হলে হয়তো ধীরে ধীরে ঢেকে যাবে সেগুলোও। কিন্তু ছোট ছোট বাজ কাটিং হেয়ার স্টাইলেও যে গৌড় বর্ণের জায়ান ক্রীতিককে এতোটা মানাবে সেটা বোধ হয় অরুর কল্পনাতীত।

আর এই মূহুর্তে, ট্রেডমিলের উপর দৌড়াতে থাকা প্রাপ্তবয়স্ক সুদর্শন যুবকটির চওড়া বলিষ্ঠ পৃষ্ঠদেশের দিকে চেয়ে অষ্টাদশীর মুখ থেকে একটাই কথা বেরোলো শুধু ,
—- হাউ ম্যানলি!

অরুর আওয়াজ পেয়ে ট্রেডমিলের গতি কমালো ক্রীতিক, ধীর গতিতে দৌড়াতে দৌড়াতেই অরুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— গুড মর্নিং বেইবি।

ক্রীতিকের মুখ থেকে পাওয়া সকাল সকাল উষ্ণ সম্মোধনে ভ্রম কেটে গেলো অরুর, অন্য সময় হলে হয়তো এখন গিয়ে একটু ঢং করতো স্বামীর সাথে, কিন্তু এই মূহুর্তে এসবের জন্য একটুও সময় নেই ওর হাতে, নিজের অযাচিত ভাবনা গুলো বড়’ই ভাবাচ্ছে অরুকে, যার দরুন সময় নষ্ট না করে ক্রীতিকের কাছে এগিয়ে গিয়ে ভিডিওটা প্লে করে ওর মুখের সামনে ধরলো অরু, থমথমে গলায় শুধালো,
— এসব কি?

ক্রীতিক খানিকটা মিনারেল ওয়াটার পান করে, নতুন উদ্যমে দৌড়াতে দৌড়াতে নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
— তোর মামাতো ভাই রেজার নু** ভিডিও।

অরু দাঁত কটমটিয়ে বললো,
— সেটা আমিও দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু আপনার ফোনে এসব কি করে এলো?

ক্রীতিক ঠোঁট উল্টাল, গা ছাড়া একটা ভাব নিয়ে বললো,
— শুধু আমার ফোনে নয়, পৃথিবীতে যত সোশ্যাল মিডিয়া ইউজার মানুষ আছে সবার ফোনেই এটা শো করছে। ছাত্রলীগ সহসভাপতির অপকর্ম ফাঁস। আরও কয়েকটা আছে দেখবি নাকি? ইজন’ট ইট ইরোটিক? অবশ্য তোর আমার কাছে কিছুই না এসব।

শেষ কথাটা বলে এক ভ্রু উঁচিয়ে, অরুর পানে শয়তানি হাসি নিক্ষেপ করলো ক্রীতিক।
ক্রীতিকের হাসিতে গা জ্বলে উঠলো অরুর, ও তৎক্ষনাৎ ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,
— চুপ করুন অসভ্য লোক, আপনি একটা অ’শ্লীল।

ক্রীতিক ট্রেডমিল থেকে নেমে কাঁধের উপর তোয়ালে রেখে, সেটা দ্বারা গলার ঘাম মুছতে মুছতে এগিয়ে গিয়ে বসলো এককোনে রাখা ডিভানের উপর, অতঃপর আঙুলের ইশারায় অরুকে কাছে ডেকে বলে উঠলো,

—পৃথিবীর সব পুরুষই বউয়ের কাছে অসভ্য বেইবি, আমার বন্ধু সায়রকেই দেখনা, সারা পৃথিবীর সামনে শুদ্ধ পুরুষ নামে খ্যাত হলেও গিয়ে দেখ, ব্যাটা দিন শেষে বউয়ের কাছে গিয়ে ঠিকই অশুদ্ধ হতে চায় ।

অরু ক্রীতিকের নিকট এগিয়ে এসে বিরক্তি নিয়ে বললো,
—- আপনি কথা ঘোরাচ্ছেন, সত্যি করে বলুন এসবের পেছনে আপনার হাত রয়েছে, তাইনা?

ক্রীতিক এবার নিজের উরুর উপর ইশারা করে অরুকে বসতে বললো, অরু চোখমুখ কালো করে, ঠাস করেই গিয়ে বসে পরলো সেখানে। ক্রীতিক অরুর পিঠে নিজ কপালে ঘাম মুছতে মুছতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— রাগ করতে হবেনা, কি জানতে চাইছিস বল?

পেছনের দিকে সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে অরু শুধালো,
— কেন করেছেন এটা? মামির পরিবার কি এখন আর সমাজে মুখ দেখাতে পারবে? তাছাড়া হলুদ সাংবাদিকরা যদি ক্রীতিক কুঞ্জে এসে মাকেও হ্যারাস করে তখন?

— চিন্তা নেই,তোর মাকে কেউ হ্যারাস করবে না, সাদা পোশাক ধারী পুলিশ রয়েছে বাড়ির চারিদিকে। আর তোর মামির পরিবারের কথা যদি বলিস তাহলে বলবো তাদের একটা উপযুক্ত শিক্ষা হওয়া উচিৎ,রেজাকে আমি একটা সুযোগ দিয়েছিলাম, কিন্তু জা’নোয়ার টা সেই সুযোগের যোগ্যতাই রাখেনা।

— মানে?

অরুর সামান্য মানের পেছনে অনেক বড় কৌতূহল লুকিয়ে রয়েছে, তাই একটু খোলাসা ভাবেই জবাব দিলো ক্রীতিক,বললো,
—- মনে আছে আমাদের ভিডিও ধারণ করতে মিডিয়ার লোক লেলিয়ে দিয়েছিল রেজা?

অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক বলে,
— এই ভিডিও গুলো তখনই সংগ্রহ করেছিলাম। বা’স্টা’র্ড টা ক্ষমতার বদৌলতে রাত হলেই মেয়েদের সাথে এসব নোংরামি করে বেড়াতো, আর দিনের বেলা স্বাধু সেজে মাইকের সামনে গিয়ে মানুষকে শান্তির বানী শোনাতো। রেজার কিংবা ওর এসব নোংরা কাজকর্মে আমার কিছুই যায় আসতো না, যদি না ও আমার সাথে লাগতে আসতো। তখনই চেয়েছিলাম ওর সব অপকর্ম ফাঁস করে ওকে জেলে পাঠাবো। কিন্তু ওই যে, একটা সুযোগ দিয়েছিলাম। মস্ত ভুল করেছিলাম তখন, যার ফলরূপ আমার কলিজা অবধি নজর দিয়ে ফেলেছে রা’স্কেলটা। তবে কথায় আছে না, লাস্ট বাট নট লিস্ট। আমি ওর চোখ উপড়ে ফেলিনি, কিন্তু এমন ব্যাবস্থা করেছি যে, চোখ থাকতেও আর কোনোদিন চোখ তুলে কারও দিকে তাকিয়ে কথা বলার মতো মান সম্মান টুকু অবশিষ্ট নেই ওর।

কথা বলতে বলতেই ক্রীতিকের চোখ মুখের ভঙ্গিমা কেমন পাল্টে গিয়েছে, শান্ত নদীর মতো চোখ দুটোতে ফুটে উঁঠেছে কাঠিন্যতা, দেখেই বোঝা যাচ্ছে ক্রীতিক এখনো রেগে আছে।রেজার ভাগ্যটা ভালো যে ও আমেরিকাতে রয়েছে , নয়তো বাংলাদেশে থাকলে না জানি কি করতো রেজার সঙ্গে। হয়তো দেখা যেত, সত্যি সত্যিই রেজার চোখ দুটো হ্যামার দিয়ে গেলে দিতো ক্রীতিক।

কি সব উদ্ভট চিন্তা করতে করতেই শরীর কাটা দিয়ে উঠলো অরুর, আজেবাজে চিন্তা সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে একটা শুষ্ক ঢোক গিলে ও ক্রীতিককে শুধালো,
—- এখন কোথায় আছে রেজা?

জবাবে ক্রীতিক বললো,
— ভিডিও ভাইরাল হবার পর থেকেই পলাতক, ভুক্তভোগী মেয়েগুলো সব একেএকে পুলিশের কাছে গিয়ে কমপ্লেইন করেছে, সবাইকে চাকরি, রেশন,বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের সিট, এসবের প্রলোভন দেখিয়ে, দিনের পর দিন নিজের স্বার্থ হাসিল করতো রেজা, ছাত্র লীগের নেতা বলে ভয়ে এতোদিন কেউ মুখ না খুললেও, এবার সুযোগে সব অপকর্ম বেরিয়ে আসছে ব’দমাশ টার।

ক্রীতিকের কথা শুনে চুপচাপ মুখে আঁধার নামিয়ে বসে রইলো অরু, দক্ষিণের জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে আঁচড়ে পরছে ওদের শরীরে, হঠাৎ ঠান্ডা জলের স্পর্শ পেয়ে জানালার দিকে এক ঝলক পরখ করে পুনরায় অরুর দিকে দৃষ্টিপাত করে ক্রীতিক শুধালো,
— মুড অফ?

অরু এদিক ওদিক না সূচক মাথা নাড়ায়, ক্রীতিক ওর কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে বেশ সিরিয়াস হয়ে বললো,
— অনেক তো হলো, এবার তো পড়াশোনাটা কন্টিনিউ করতে হবে বেইবি, তোকে গ্রাজুয়েট হতে হবে। আমি সিন্ধান্ত নিয়েছি তোর গ্রাজুয়েশন কম্পিলিট না হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা আর বিডি তে ফিরবো না। লাস্ট একবছরে একটা সেমিস্টারও কম্পিলিট করতে পারিস নি এদিক ওদিক করতে গিয়ে, অনেক হয়েছে ফাঁকিবাজি আর না।

অরু নাকটা সিকোয় তুলে, অসহায় মুখে বললো,
— কিন্তু আমার তো ইকোনমিকস পড়তে একটুও ভালো লাগেনা।

—- লাগতে হবে, ভবিষ্যতে জেকে গ্রুপে বসতে হবে। আমার পাশাপাশি বিজনেসের হাল ধরতে হবে, যেভাবে তোর মা আমার বাবার ছাঁয়া হয়ে পাশে থেকেছিল,ঠিক সেভাবে।

অরু তৎক্ষনাৎ পেছনে ঘুরে আশ্চর্য হয়ে বললো,
—- আপনি কি চাইছেন আমিও আমার মায়ের সাথে কোম্পানি নিয়ে দন্দে লিপ্ত হই?

অরুর কথার জবাবে তীর্যক হাসলো ক্রীতিক, অতঃপর বললো,
— আমি বেঁচে থাকতে তোর সাথে লাগতে আসার মতো কলিজা কারোর নেই বেইবি, কিন্তু আমি যখন না থাকবো, তখন তো তোর নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হবে এই ক্রুয়েল পৃথিবীটাতে। আমাদের নিষিদ্ধ সম্পর্কের জের ধরে তোকে অনেকে অনেক ভাবে হেয় করতে চাইবে, দেখবি কাছের মানুষরাও কেমন রূপ বদলে ফেলবে, তখন যদি তুই বিগেইনার হোস তো তোর জন্য সবকিছু সামলানো খুব কঠিন হয়ে যাবে, নিজের দ্বায়িত্ব বুঝে নিতে গিয়ে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন ভাবে কটাক্ষের স্বীকার হতে পারিস, যা তোকে সামনে এগোতে দেবে না, কারণ ওরা চাইবে তুই যাতে ভেঙে পরিস, ভেঙে পরে নিজের অধিকার ছেড়ে দিস । তাই আমি থাকতে থাকতেই আমার পাশে থেকে আমার হাত ধরে নিজের যায়গাটা নিজেই তৈরি করে নিতে হবে তোকে বেইবি। আর এসবের জন্য পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই।

ক্রীতিকের এতোসব জ্ঞানের বানী কানে ঢুকলো না অরুর, বরং ও বেশ বিরক্ত হয়ে ক্রীতিকের দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে তাকিয়ে বললো,
— আপনি থাকতে থাকতেই মানে?আমায় ছেড়ে কোথায় যাবেন আপনি? কিছুদিন আগে এতো বড় একটা এ্যা’ক্সিডেন্ট হলো, এখন আবার এসব বলছেন, আমার একটুও ভালো লাগছে না আপনার কথাবার্তা চুপ করুন এক্ষুনি।

ক্রীতিক মৃদু হেসে অরুর খোলা চুলে হাত বুলিয়ে শান্ত স্বরে বললো,
—- এটাতো কথার কথা বললাম বেইবি, তবে যা বলেছি খুব ভেবে চিন্তে চিরন্তন সত্যি কথাগুলোই বলেছি, তুই জানিস আমি আবেগে গা ভাসানো মানুষ নই, তাই তিক্ত হলেও সত্যি বলতে আমার মুখে বাঁধেনা।

অরু ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
— তাই বলে এসব বলবেন?

ক্রীতিক অরুর কলার বোনের ভাঁজে টুকরো চুমু খেয়ে বললো,
— বলবো না, তার আগে তুই বল, তুই পড়াশোনা শুরু করবি এবং সিরিয়াস হবি।

অরু একটু ভাবলো,পরক্ষণেই ছোট ছোট চোখ করে ক্রীতিকের দিকে নজর দিয়ে বললো,
—- ঠিকাছে পড়বো, তবে একটা শর্ত।

— কি শর্ত?

ক্রীতিকের বুকের উপর নিজের পিঠ ছেড়ে দিয়ে আবদারের স্বরে অরু বললো,
— পড়াশোনার পাশাপাশি আমি উপন্যাস লিখতে চাই, এটা আমার স্বপ্ন, না করতে পারবেন না কিন্তু।

অরুর কথার প্রত্যুত্তরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হার মেনে নেওয়ার মতো করেই ক্রীতিক অসহায় গলায় বললো,

— ইউ ক্যান ডু ইট।

ক্রীতিকের আস্কারা পেয়ে অরু এবার আবদারের ঝুড়ি খুলে বসলো, একনাগাড়ে বলতে লাগলো সব,
—- আর আমি সকালে ব্রেকফাস্টও বানাতে চাই।

—- ইউ ক্যান।

— এ বাড়িটাকে নতুন করে ডেকোরেট করতে চাই।

— ইউ ক্যান।

—- নীলিমার সাথে দেখা করতে চাই?

—- ইউ ক্যান।

—ডোরাকে এনে দিন।

— ইউ ক্যান।

ক্রীতিকের শেষ কথাতে থেমে গেলো অরু, ডোরাকে এনে দিতে বলার সাথে ইউ ক্যান এর কি সম্পর্ক ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে, চকিতে পাশ ফিরে তাকায় অরু। পাশে তাকাতেই দেখলো গালে হাত দিয়ে ওর দিকেই নিস্প্রভ চোখে চেয়ে আছে ক্রীতিক, যেন শিল্পী তার নিজ হাতে বানানো কোনো স্কাল্পচারকে বিস্ময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। ক্রীতিককে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অরু হাত নাড়িয়ে শুধালো,
— কি দেখছেন?

তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো ক্রীতিক,
— তোকে।

ক্রীতিকের কথায় খানিকটা লজ্জা পেয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথায় নুয়িয়ে ফেললো অরু।
অরুকে লজ্জা পেতে দেখে ক্রীতিক এবার সটান বসে কাঠকাঠ গলায় বললো,
— লেনদেনে আমি খুব কড়া অরু, তোকে আমি বিনা শর্তে এতোকিছুর অনুমতি দিয়ে দিলাম, বিনিময়ে আমি কি পাবো?

অরু হেঁসে বললো,
— আপনার তো সবই আছে, আর কি চাই?

— রাইট নাও ইউ হ্যাভ টু শাওয়ার উইথ মি, আপাতত এটাই চাই, লেটস গো।

যদিও ক্রীতিকের চাহিদার কথা শুনে বিশাল বড় একটা ঝটকা খেলো অরু, তবে ক্রীতিক তার ধার ধারলো না মোটেই, বরং অরুকে টেনে হিঁচ’ড়ে, সাথে করে নিয়ে ত্যাগ করলো জিম রুম।

************************************************

নদীর স্রোতের মতোই কলকলিয়ে বয়ে যায় সময়। চোখের পলকে খসখস করে উল্টে যায় ক্যালেন্ডারের পাতা।মিনিট, ঘন্টা, দিন,রাত পরবর্তীতে মাসের পর মাস কিভাবে যে সময় গুলো চলে যায় তা ঠাওর করা দুষ্কর। স্থান কাল ভেদে সময়ের এই বিবর্তন কিছুটা মিশ্র প্রতিফলন ফেলে রেখে যায় মানুষের মাঝে, কেউ মরিচীকার মতো হাতরে বেড়ায় পুরনো ফেলে আসা স্মৃতি, কেউবা এক বুক আশা নিয়ে প্রতীক্ষা করে নতুনের আগমনী বার্তার।

আজ তেমনই একটা সুন্দর দিন, এলিসার বেবি শাওয়ার আজ, দেখতে দেখতে কখন যে সাতটা মাস পেরিয়ে গেলো,পেটের মাঝে একটু একটু করে বেড়ে ওঠা সত্তাটার আসারও সময় হয়ে গেলো অথচ কোনোকিছুই সেভাবে অনুভব করতে পারলো না এলিসা।
কি করেই বা পারবে? গত সাত মাসে প্রেগন্যান্সী সিকনেস ওর ধারে কাছেও ঘেষতে পারেনি, বেবি বাম্প নিয়েই কর্পোরেট অফিসে ফুল টাইম ডিউটি করে গিয়েছে পুরো সময়টাতে। কিন্তু এতোগুলো দিন পেরিয়ে এলিসার নিজেরও মনে হলো এখন একটু অর্ণবের কথা শোনা প্রয়োজন, বাচ্চাটা গর্ভে বড় হচ্ছে, তারও তো ভালো থাকা মন্দ থাকার ব্যাপার রয়েছে, তাছাড়া অর্ণব সেই তিন মাস থেকে ঘ্যান ঘ্যান করছে যাতে এলিসা এবার একটু শান্ত হয়। অবশেষে সাত মাসের মাথায় এসে বাচ্চার মুখ চেয়ে এতো ভালো কর্পোরেট জবটা ছেড়েই দিলো এলিসা। আর আজকে যে এই বেবি শাওয়ারের এতো বড় আয়োজন, সেটা মূলত সায়র, ক্রীতিক আর অর্ণবেরই প্ল্যান। ওদের তিনজনার একটা মাত্র মেয়ে বেস্টফ্রেন্ড, অবশ্যই সে প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট ডিজার্ভ করে।যতই হোক ওদের চারজনের মধ্যে আর কেউ কোনোদিন মা হবে না আর, যা হবে সব বাবা।

বেবি শাওয়ারের আয়োজন করা হয়েছে বেশ জাঁকজমক ভাবে, চারিদিকে ল্যানটার্ন আর স্ফটিকের রোশনাই এ পুরো হলরুমটা ঝিলমিল করছে। পুরো অনুষ্ঠানের থীম আজ স্কাই ব্লু। এলিসাকে থীমের সাথে মিলিয়ে আকাশী রঙের গাউন আর পার্লের মুকুট পরানো হয়েছে, তাতে গুটি ইংরেজি অক্ষরে লেখা মম টু বি। অর্ণব ও এলিসার সাথে মিলিয়ে স্কাই ব্লু রঙের স্যুট চড়িয়েছে গায়ে, বউয়ের সাথে রঙ মিলিয়ে জামা কাপড় পড়ার অভ্যেসটা আর গেলোনা ছেলেটার। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো আজকে এলিসা একটুও রেগে নেই অর্ণবের উপর, বরং নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের মতো হাসবেন্ডের গলা জড়িয়ে ধরে একের পর একে ফটোতে পোজ দেওয়ায় ভীষণ ব্যস্ত সে।

হলের এক কোনে ডোরাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে এলিসা অর্ণবকে দেখে মৃদু হাসলো অরু, অতঃপর চোখ ঘুরিয়ে তাকালো প্রত্যয় আর অনুর দিকে, গত মাসেই আমেরিকা এসেছে অনু। আসলে এসেছে বললে ভুল হবে, প্রত্যয় জোর করে নিজের সাথে নিয়ে এসেছে অনুকে, কারন অনু দু’মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মাঝখানে কোম্পানির কাজে বেশ কয়েকমাস দেশে ছিল প্রত্যয়, পরে যখন অনুর এই অবস্থা হলো, তখন নিজের অনাগত সন্তানের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে আর একা একা ইউ এস এ ফিরতে পারলো না প্রত্যয়। একজন দ্বায়িত্বশীল স্বামী আর সন্তানের মতোই আব্বু আম্মু স্ত্রী সমেত ফিরে এলো সে। প্রত্যয়ের ছোট্ট এ্যাপার্টমেন্টে এখন প্রতিনিয়ত খুশির ফোয়ারা বয়ে যায়, মাঝেমধ্যে তো অরুও এসে যোগ দেয় ওদের পারিবারিক আড্ডায়, তারপর সন্ধ্যা হয়ে এলেই কোথা থেকে যেন ক্রীতিক ফিরে এসে ঠিক সময় মতো নিয়ে যায় তার ছোট্ট বউকে। বউ টউ নিয়ে আবার রাত্রিবেলা একদমই রিস্ক নেয়না সে,অরুকে কাছে না পেলে যদি ঘুম না হয়? সেই দুশ্চিন্তায়।স্বভাবটা যে শুধুমাত্র ক্রীতিকেরই, তেমনটা বললে মিথ্যে বলা হবে। আজকাল অরুর ও তো ঘুম হয়না মানুষটার শক্ত, চউড়া, ঢেউ খেলানো বুকে মাথা না ঠেকালে।
— কিরে কি ভাবছিস?

নীলিমার অকস্মাৎ ডাকে ভাবনার সুতো ছিড়লো অরুর, ধ্যান ভেঙে গেলে অরু আস্তে করে ঘাড় ঘোরালো নীলিমার পানে,শ্যামা মেয়েটাকে আজ এই অফ হোয়াইট গাউনে চমৎকার লাগছে, কি সুন্দর গাউনের সাথে ম্যাচিং করে হেয়ার স্টাইল করেছে, পুরোই ডিজনি প্রিন্সেস সিনড্রেলা। অবশ্য নীলিমার এই পরিপাটি সাজগোজের পেছনো সায়রের অবদানই সবচেয়ে বেশি, কারণ আগে পরে যে কোনো পার্টি ফাংশনেই নিজের পার্সনাল স্টাইলিস্টকে দিয়ে নীলিমার ড্রেসআপ করায় সায়র, ওই জন্যই প্রত্যেকবারই চমৎকার লাগে নীলিমাকে, যেন কোন সর্গ পরী,পার্ফেক্শনের উর্ধে যা থাকে তাই হলো নীলিমা ।

— আবার কি ভাবতে বসলি বলতো?

অরুর পাশের চেয়ারটাতে আয়েশ করে বসে কথাটা বললো নীলিমা।

অরুও এবার এগিয়ে গিয়ে নীলিমার পাশে বসলো। ডোরাকে আদর করতে করতে নীলিমাকে শুধালো ,
—- শুনলাম লন্ডন গিয়েছিলি? কেমন কাটলো ভ্যাকেশান?

নীলিমা ঠোঁট উল্টে জানালো,
— সায়র শুটের কাজে বিজি ছিল খুব, সেভাবে ঘোরা হয়নি, তোদের কি খবর?

— এই চলছে, বকুনি ঝকুনি আর পড়াশোনা।

নীলিমা নিঃশব্দে হাসলো, অতঃপর বললো,
—- তুই বলেই ক্রীতিক ভাইয়াকে সামলাতে পারিস, অন্য কেউ হলে নির্ঘাত মুখ চালাতে গিয়ে ওনার হাতে মা’র খেয়ে ভর্তা হয়ে যেত।

নীলিমার কথা শুনে অরু মৃদু হেসে ক্রীতিকের পানে চাইলো, যে এই মূহুর্তে হলের এককোনে দাঁড়িয়ে অতিথিদের সাথে কুশল বিনিময়ে ব্যস্ত সময় পার করছে, পরনে ফুল ব্ল্যাক স্যুট তার, কানে লাগানো এয়ারপড,হাতের ঘড়ি এমনকি টাই’টা অবধি কালো রঙের । ক্রীতিকের চুল বড় হয়ে গিয়েছে এখন, সেই আগের মতো ঘাড় ছুঁই ছুঁই লম্বা চুল গুলো বেশ স্টাইল করে সেট করা, পা থেকে মাথা পর্যন্ত কালো দিয়ে আবৃত গৌড় বর্ণের লোকটাকে দেখে সবার আড়ালে লাজুক হাসলো অরু, এই ভেবে লাজুক হাসলো যে, এই ড্যাশিং, হ্যান্ডসাম, হিরোদের মতো দেখতে ছেলেটা তার প্রতি কি ভীষণ ভাবে আসক্ত।গত সাত মাসে কতবার কত রকম ভাবেই না পা’গলামি করেছে তার জন্য। প্রয়োজনে শাসন করেছে, নিজের রাগ সংবরণ করতে না পারলে একটু অতিরিক্তই করেছে, তবে দিন শেষে ঠিকই অরুর রাগ ভাঙাতে উঠে পরে লেগেছে, নিজেকে যতটা অসহায় প্রমান করলে অরুর মন টলবে, ঠিক ততটাই দূর্বল হয়েছে সে। সেই সময়গুলোতে কোথায় যেন উবে যায় ক্রীতিকের ম্যানলি ইগো। পাছে এসে ভর করে আর্দশ স্বামী হওয়ার ভীষণ পায়তারা। তবে পুরো পৃথিবী সেই ভেতরের জায়ান ক্রীতিকটাকে আবিষ্কার করতে পারেনি কোনোকালেই,যা অরু পেরেছে। অরুকে যদি কেউ কখনো জিজ্ঞেস করে, এই বদ মেজাজী, উগ্র লোকটার সাথে কি করে থাকো বলোতো? অরু তখন একগাল হেসে জবাব দেয়,
—- তোমরা যা জানোনা, তা কেবল আমিই জানি। কারণ আমি ওনার উগ্রতা নয় ভালোবাসার মাপকাঠিতে তলিয়ে আছি।যেখানে ওনার এক বুক ভালোবাসার রাজ্যে উগ্রতা নিছকই এক কীটপতঙ্গ মাত্র। ভালোবেসে সেটুকু ও সহ্য করতে না পারলে ভালোটা আর বাসলাম কই?

ক্রীতিকের দিকে সেই তখন থেকে শুকনো মুখে চেয়ে আছে দেখে নীলিমা অরুকে কনুই দিয়ে খোঁচা মে’রে এলিসাকে দেখিয়ে বললো,
— তবে যাই বলিস না কেন, অনু আপা আর এলিসা আপু কিন্তু এগিয়ে গেলো আমাদের চেয়ে।

এলিসার ভরাট গুলুমুলু চেহারাটার দিকে চেয়ে আপসোসের সুরে অরু বলে ওঠে,
— ঠিকই বলেছিস। ওরা সত্যিই লাকি।

অরুর আপসোস শুনে মনটা ভার হয়ে এলো নীলিমার, পরক্ষণেই বুদ্ধিমানদের মতো চট করেই নীলিমা বলে উঠলো,

—- বেবি নিলে কেমন হয় বলতো? আমিতো সায়র কে বললেই ও বেবি নেওয়ার জন্য লাফিয়ে উঠবে।

অরু মুখ কাঁচুমাচু করে ক্রীতিকের দিকে দৃষ্টিপাত করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— তুই তো চাইলেই পেয়ে যাবি, কিন্তু আমার যে অনুমতি নিতে হবে।

অরু যখন কথাগুলো বলছিল ঠিক তখনই স্টেজ থেকে বল নাচের ঘোষণা করলো ক্যাথলিন আর তার ফিয়ন্সে।

ঘোষনা শুনে সায়রের সঙ্গে বল নাচ করবে বলে তৎক্ষনাৎ খুশিতে লাফিয়ে উঠলো নীলিমা , আনন্দে আত্মহারা হয়ে খুশিতে করতালি দিয়ে নীলিমা যায়গা ছেড়ে উঠে গিয়েও পুনরায় ফিরে এসে, অরুর কানে কানে হিসহিসিয়ে বলে গেলো,
—- এই সুযোগে জিজুকে কনভিন্স করে ফেল, দেখবি নাচতে নাচতেই হ্যা বলে দেবে।

*************************************************

— চলুন ডান্স করবো।

আচমকা সু’পরিচিত রিনরিনে আওয়াজটা কর্ণকূহরে পৌঁছাতেই কানের একটা এয়ারপড খুলে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে পাশে তাকালো ক্রীতিক। দেখলো ওর দিকেই চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে আছে অরু। অরুর এমন গদোগদো ভাবসাব দেখে হাসি পেলো ক্রীতিকের, তবে ও হাসলো না নিজেকে যথাসম্ভব সংবরণ করে, মুখের আদলে কৃত্রিম গাম্ভীর্য টেনে এক ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,
— কাহিনী কি?

—কোনো কাহিনী নেই, চলুন তো সবাই নাচ করছে।

কোনো রকম জবাবদিহিতা ছাড়াই একপ্রকার টেনেটুনে ক্রীতিককে বল নাচের মঞ্চে নিয়ে গেলো অরু। এখানের পরিবেশটাই অন্যরকম, সবাই নিরিবিলি পার্টনারের সাথে কোমড় দোলাচ্ছে আর একটা হ্যাপি মোমেন্টের সাক্ষী হচ্ছে, এলিসাকেও খুব সাবধানে আঙুলের মাথায় ঘোরাচ্ছে অর্ণব।

তবে আজকের বল নাচের স্টেজে দাঁড়িয়ে হুট করেই সেই প্রথম দিনের কথা মনে পরে গেলো ক্রীতিকের । যখন ওর সামনের মেয়েটা স্বয়ং অরুই ছিল, কিন্তু মেয়েটার দু’চোখে ছিল অনিশ্চয়তা আর শঙ্কার ছড়াছড়ি , ভীত হরিণীর মতো একরত্তি শরীর নিয়ে ক্রীতিকের বাহুতে সেদিন কুঁকড়ে ছিল অরু , আর শেষমেশ কিছু না বলেই হুট করে এক পায়ের নুপুর ফেলে রেখেই পালিয়ে গিয়েছিল মেয়েটা।অথচ আজ মেয়েটার দু’চোখে রয়েছে নিদারুন চঞ্চলতা, নেই বিন্দু মাত্র সংশয়, আর নাতো আছে কোনোরূপ অনিশ্চয়তা। একরাশ খুশির পারদ যেন উপচে পরছে তার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা থেকে, যা চাইলেও টাকার বিনিময়ে কিনে নিতে পারবে না ক্রীতিক। অগত্যাই অরুর খুশিতে খানিকটা ঢেউ তুলে দিয়ে, ওর কোমড় চেপে ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এলো হঠাৎ। অরু ভড়কালো না, বরং নিজের হাতটাকে তুলে রাখলো ক্রীতিকের কাঁধের উপর, তারপর শুরু করলো দুজন দুজনার সাথে গানের তালে পা মেলানো। ল্যাভেন্ডার কালারের গাউন সাথে স্মোকি আইশ্যাডো আর হালকা স্টোনের জুয়েলারিতে অরুকে মারাত্মক সুন্দর লাগছিল, ক্রীতিক কম্পলিমেন্ট দিতে জানেনা খুব একটা, তবুও আজ অরুর সব সংশয় কাটিয়ে দিতে ওকে ঘোরাতে ঘোরাতে হাস্কিস্বরে বলে উঠলো ,
— তোকে অপরূপ লাগছে বেইবি।

অরু হাসলো সামান্য, তারপর আবারও চোখ রাখলো ক্রীতিকের কালো চোখের মনিতে ,মূহুর্তেই দুজন দু’জনার চোখে চোখ রেখে হারিয়ে গেলো গভীরে, চোখে চোখেই হাজারো কথা আদান প্রদান হলো ওদের বোধ করি। চারিদিকে প্রেম প্রেম সুগন্ধ, পৃথিবীর সকল চিন্তা ভুলে গিয়ে হুট করেই ক্রীতিকের মনে হচ্ছে, আশেপাশে এই চোখ জোড়া ছাড়া কিচ্ছু নেই। কোন মানুষ নেই, কোনো শব্দ নেই, কোন বস্তু নেই, কেউ নেই।

আছে শুধু দুইজোড়া তৃষ্ণার্থ চোখ, যার ঘোলাটে চাহনী দেখে মনে হয় একে অপরের দিকে জনম জনম তাকিয়ে থাকলেও সেই তৃষ্ণা মিটবে না কোনদিন, উল্টো দিনকে দিন বেড়েই যাবে তাকে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। দুটো চোখ নেশার ঘোরে বুদ,তখনও পারিপার্শ্বিক সকল আওয়াজ ছাপিয়ে মিষ্টি একটা সুরেলা গলা কানে ভেসে এলো ওদের দুজনার, সেই গানে আরও একবার সবকিছুর উর্ধে গিয়ে মনের মাঝে ভালোবাসার হলকা জ্বলে উঠেছিল দুজনারই, খুব কাছেই কেউ একজন প্রান দিয়ে গাইছে,
i have died every day
waiting for you,
Darling don’t be afraid,
i have loved you,
For a thousand year’s
I’ll love you for a
Thousand year’s……

ক্রীতিক যখন অরুর চোখের অতল গহ্বরের ডুবে যাচ্ছিল, ব্যস্ত হয়ে ওর চোখের মাঝে নিজের সত্তাটাকে খোজার আপ্রান চেষ্টা করছিল,ঠিক সেই মূহুর্তে সকল রোমান্টিকতায় একবালতি জল ঢেলে দিয়ে অরু ঠাস করেই বলে ওঠে,
— আমার বাবু চাই।

অরুর এহেন আবদার শুনে ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো ক্রীতিকের, চোখে কয়েকবার পলক ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে উল্টো প্রশ্ন ছুড়লো ক্রীতিক,
—- কিহ, কি চাই?

অরু চোখের ইশারায় এলিসাকে দেখালো, যে এই মূহুর্তে ডিভানে বসে বসে পেস্ট্রি কেক খাচ্ছে। এলিসাকে এক ঝলক পরখ করে ক্রীতিক অরুর পানে তাকিয়ে বললো,
— তো?

—- আমারও বাবু চাই।

অরুর কথার প্রত্যুত্তরে ক্রীতিক ভাবলেশহীন গলায় বললো,
—- হ্যা তোর তো বাবু আছেই, ডোরা না তোর মেয়ে?

ক্রীতিক ইচ্ছে করে কথা ঘোরাচ্ছে, তিল কে তাল বানাচ্ছে, ব্যাপারটা বুঝতে পেলে তেতে উঠলো অরু, বিরক্ত কন্ঠে বললো,
—-এই বাবু সেই বাবু না, এলিসা আপুর মতো বাবু চাই আমার, আপার মতো বাবু চাই আমার।

ক্রীতিক গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
— বাবু কি হাতের মোয়া? যে চাইলেই পাওয়া যাবে?

অরু ঠোঁট উল্টে বললো,
— এনে দিন, আমি জানি আপনি সব পারেন।

ক্রীতিক অরুর কপালে আলতো চুমু খেয়ে জানালো,
— এখন নয়, একটু বড় হ। ঠিক সময় মতো পেয়ে যাবি।

ক্রীতিকের কথার পাছে অরু রেগেমেগে কিছু বলবে তার আগেই অর্ণব আর সায়র এসে কি দরকারে যেন ডেকে নিয়ে গেলো ক্রীতিককে। যাওয়ার আগে পেছন ঘুরে অরুর উদ্দেশ্যে ক্রীতিক বললো,
— এখানে দাঁড়িয়ে থাকিস না বেইবি,ওদিকে গিয়ে বস।স্টেজটা পিচ্ছিল, সামলাতে পারবি না।

ক্রীতিকের এতো কেয়ারিং এই মূহুর্তে আদিখ্যেতার মতোই বিরক্ত ঠেকলো অরুর নিকট। যার দরুন রাগে দুঃখে অরু একাই নাচতে শুরু করলো পা’গলের মতো, যদিও বা জীবনে প্রথমবার চার ইঞ্চি পেন্সিল হীল পরে নাচতে গিয়ে অরু জুত করতে পারলো না খুব একটা, কয়েক মিনিটের মাথাতেই ক্রীতিক যে ওকে এতোক্ষণ সামলে রেখেছিল তার হাতেনাতে প্রমান সরূপ পা মচকে পরে গেলো মেঝেতে ।

অরু এভাবে পরে গিয়েছে দেখে দ্রুত ছুটে এলো অনু, উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
— কিরে এভাবে পরে গেলি কি করে? ব্যথা পেয়েছিস কোথাও ?

অরু মাথা তুলে অসহায় স্বরে বলে উঠলো,
— পায়ে ভর দিতে পারছি না আপা, মনে হয়ে মচকে গিয়েছে।

অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শক্ত হাতে বোনকে তুলে একসাইডে নিয়ে এসে বসিয়ে দিলো চেয়ারে। অরু হঠাৎ হঠাৎ ব্যথায় চোখ মুখ খিঁচিয়ে ফেলছে, তা দেখে অনু বললো,

— তুই বস, আমি এক্ষুনি বরফ ম্যানেজ করে নিয়ে আসছি, বরফ লাগালে ব্যথা কমবে আশা করি।

কথাটা বলে অরুকে বসিয়ে রেখে দ্রুত কোথাও একটা চলে গেলো অনু। ওদিকে অরু ব্যথা পেয়েছে শুনে কই থেকে যেন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো ক্রীতিক, আশেপাশে তখনও সবাই ছিল,কিন্তু ক্রীতিককে দেখতে পেয়ে ওদের কে স্পেস দিয়ে যে যার মতো চলে গেলো সবাই।

— কতবার বলেছি এসব হাই হীল পড়তে হবে না, তবুও জিদ ধরে পরলি, এখন ব্যথাটা কে পেলো শুনি? ইশ গোড়ালিটা কালচে হয়ে গিয়েছে একদম।

অরুর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে, ওর পা থেকে জুতো গুলো খুলতে খুলতেই রাগি গলায় অরুকে ধমকালো ক্রীতিক। কিন্তু অরুতো অরু, ও এখনো তখনকার ব্যাপারটা নিয়ে ঝুলে আছে, তাইতো অভিমানে ক্রীতিকের হাত থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বসলো চট করে। ওর কান্ডে ক্রীতিক ভ্রু কুঞ্চন করে বললো,
— কি হয়েছে?

অরুর সোজাসাপ্টা জবাব,
— আমার বাবু চাই।

অরুর এহেন ছেলেমানুষী তে রাগ হলো ক্রীতিকের, কোনমতে নিজেকে সংবরণ করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—- বলেছি না পরে।

— না এক্ষুণি।

ক্রীতিক চেয়ার সমেত অরুর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে, গম্ভীর গলায় শুধালো,
— বাচ্চা বাচ্চা যে করছিস, বয়স কত তোর? তুই নিজেই তো একটা বাচ্চা। একটা বাচ্চাকে বাচ্চা দিয়ে তারপর দুই বাচ্চাকে সামলাতে হবে আমার, আমি এসব রিস্কে নেই।

হ্যা, না কিছুই না বলে,মুখে কুলুপ এঁটে চুপচাপ বসে আছে অরু, তা দেখে ক্রীতিক ওকে একটু মানানোর চেষ্টা করে বললো,
—প্রেগন্যান্সীর জন্য একটা নূন্যতম বয়স লাগে বেইবি, নয়তো বাচ্চাকে সামলাবি কি করে? তাছাড়া তোর হেলথ কন্ডিশন বেবি নেওয়ার জন্য উপযুক্ত কিনা সেটাও তো যাচাই-বাছাই করতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা,

মাঝপথেই থেমে গেলো ক্রীতিক, অরু এবার আগ বাড়িয়ে শুধালো,
— সবচেয়ে বড় কথা কি?

— তোর ভালোবাসায় আমি কোনো ভাগিদার এলাউ করতে রাজি নই অরু।

অরু আশ্চর্য হয়ে গেলো ক্রীতিকের এহেন ছেলে মানুষী কথায়, ও আশ্চর্য কন্ঠেই বলে উঠলো ,
—- আপনি কি পাগল? বাচ্চাটা আপনার হবে, আর আপনি তাকে এখনই হিংসা করছেন?

ক্রীতিক গম্ভীর গলায় বললো,
—- যা বলেছি তাই।

অরুও যেন নাছোড়বান্দা, ও গাল ফুলিয়ে প্রত্যুত্তর করে জানালো,
—- না আমার বাবু চাই, চাই-ই চাই।

মেয়েটার ডানপিটে জিদের কাছে আরও একবার পরাজিত হয়ে হার মানার মতোই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ক্রীতিক, অতঃপর একহাতে অরুর জুতো আর অন্য হাতে অরুকে কোলে তুলে গভীর গলায় বললো,
—- ঠিকাছে বাসায় চল, দিচ্ছি তোকে বাচ্চা।

কথাটা বলে অরুকে নিয়েই বেরিয়ে যাচ্ছিল ক্রীতিক, তখনই পেছন থেকে অনু এসে দেখলো এই কাহিনি, ক্রীতিক অরুকে নিয়ে চলে যাচ্ছে দেখে অনু বিড়বিড়িয়ে বললো,
—- আরেহ বরফ না লাগিয়েই কোথায় যাচ্ছে এরা?
প্রত্যয় পাশ থেকে অনুর কাঁধে হাত রেখে তীর্যক কন্ঠে বলে,
—- চিন্তা নেই, ক্রীতিক ভাই ঠিক সামলে নেবে অরুকে । তুমি এদিকে এসে একটু বসোতো, আজ অনেক নড়াচড়া করেছো এবার একটু রেস্ট করো।

প্রত্যয়ের কথায় অনু হাসি সংবরণ করতে না পেরে, মুখের উপর হাত রেখে বললো,
—- তুমি এমন ভাব করছো, যেন তোমার বাচ্চাটা কালকেই পৃথিবীতে চলে আসবে।

প্রত্যয় বোকাদের মতো মাথা চুলকে বললো,
— কি করবো বলো? তর সইছে না তো।

ওদিকে ক্রীতিককে এভাবে চলে যেতে দেখে, সায়র হাঁক ছেড়ে ডেকে উঠে শুধালো,
—- কিরে জেকে, পার্টি তো শেষ হয়নি, এখনই কোথায় যাচ্ছিস তোরা?

ক্রীতিক অরুকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে না ঘুরেই উত্তর দিলো,
—- বউকে বেস্ট গিফট দেওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে, তাই বাসায় যাচ্ছি।

ক্রীতিকের ঘুরানো প্যাচানো কথাটা প্রথমে ধরতে না পারলেও, যখন এর আসল মানে সায়রের ব্রেইনে ক্যাঁচ করলো, তখন আর এক মূহুর্তও অপেক্ষা করলো না সায়র, দ্রুত এগিয়ে গিয়ে নীলিমার হাত থেকে খাবার দাবার সব কেড়ে নিয়ে সাইডে রেখে বললো,
—- তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো, আই থিংক আমাদের বাসায় যাওয়া উচিৎ।

মুখ ভর্তি খাবার গুলো তাড়াহুড়ো চিবুতে চিবুতে নীলিমা বলে ওঠে,
— কেন?

বড়সড় তান্ত্রিকদের মতো করে, কৌশলী কন্ঠে সায়র বললো,
— জেকে কে এবার হারাতেই হবে আমায়, ব্যাটা সবকিছুতে ফাস্ট। এবার আর সেটা হতে দিচ্ছি না আমি। দ্রুত খাও জান, হারি আপ,বাসায় গিয়ে প্রসেসিং শুরু করতে হবে তো।
ওই হিটলার ব্যাটাকে আমার আগে কিছুতেই বাবা হতে দেওয়া যাবেনা, নেভার।

সায়রের কথার আগামাথা কিছুই মাথায় ঢুকলো না বেচারী নীলিমার, তবুও মেয়েটা বাধ্য স্ত্রীর মতোই স্বামীর কথায় ব্যস্ত হয়ে পরলো মুখ ভর্তি খাবারকে দ্রুত গলধঃকরন করার কাজে।
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here