সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁 #পর্বঃ৪৮ #লেখনীতে_suraiya_rafa

0
558

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ৪৮
#লেখনীতে_suraiya_rafa
(ক,পি করা নিষিদ্ধ 🚫)
(কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য)

দিনের শেষ প্রহরে প্রকৃতি জুড়ে সন্ধ্যে নামার হাতছানি। অদূরের পাখিরা ডানা ঝাপ্টে ঘরে ফেরার সুর তুলেছে, সারাদিন উত্তাপ ছড়িয়ে বেড়ানো তেজস্ক্রিয় সূর্যটাও মেঘের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গিয়েছে পশ্চিম আকাশে, সেথায় এখন কাঁদা মাটির ন্যায় লেপ্টে আছে সিঁদুর রঙা এক ফালি নিয়ন আলোর ছটা। আর তো কিছুক্ষণ তারপরই নিকোশ আধারে তলিয়ে যাবে ধরনী।

সন্ধ্যার আয়োজনটা আজ ক্রীতিক কুঞ্জে বেশ ঘটা করেই পালন করা হচ্ছে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে ডাইনিং টেবিল ভরে উঠেছে নানান রকম সুস্বাদু নাস্তার বহরে।
অর্ণব, এলিসা, তার ক্যাথলিন সেখানে বসে বসে পাকোড়া চিবুচ্ছে, অরু আর সায়রও উপস্থিত, তবে ওদের মনটা ভালো নেই।

নীল আকাশের ভারী মেঘের ঘনঘটার মতোই কালো হয়ে আছে ওদের মুখশ্রী।
অরু মুখটা মলিন করে সেই তখন থেকে শূন্য চোখে গালে হাতদিয়ে বসে আছে দেখে এলিসা খেতে খেতে শুধালো,
— এ্যাই মেয়ে ,কি হয়েছে তোমার? মুখ কালো কেন? নিশ্চয়ই জেকে কিছু বলেছে?

অরু জোরপূর্বক হেসে জানালো,
— তেমন কিছু নয় আপু, আসলে আপাকে খুব মিস করছি। সব সময় ,সব পরিস্থিতিতে একসাথে ছিলাম আমরা দু’বোন, অথচ এখন দেখো আজ তিনদিন হয়ে গেলো আপা শশুর বাড়িতে পরে আছে।

মনেমনে বললো,
— তোমাদের জেকে আর কিইবা বলবে, সে’তো তো আমার সাথে কথাই বলেনা সেই বিয়ের দিন থেকে।

অরুর কথায় ভারী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এলিসা করুন স্বরে বলে,
—- তা ঠিক বলেছো অনুকে তো আমরাও মিস করছি, তার উপর বউ ভাতের দিন আমরা গেলেও জেকে তো তোমাকে যেতেই দিলোনা আর।

বউ ভাতের দিনের কথা মনে পরতেই আরও একদফা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো অরুর চিত্ত চিড়ে। সেদিন শুধু শুধু ক্রীতিক ওকে যেতে দিলোনা, বউ ভাতের দিন অনুর কাছে যেতে না দেওয়ার দুঃখ টা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই অরু ডুব দিলো সেদিনের ঘটনায়।একে একে মনে পরতে লাগলো ক্রীতিকের বিরক্তিকর কর্মকান্ড গুলো।

বউ ভাতের আয়োজনে সামিল হতে একে একে ক্রীতিক কুঞ্জের গেইট ছাড়িয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো অতিথিদের গাড়ির বহর।
একেবারে শেষে যে গাড়িটা পরে রইলো সেটাতেই আপাতত ওঠার প্রস্ততি নিচ্ছিলো, সায়র, অর্ণব,এলিসা, ক্যাথলিন আর অরু।

কালকের কাহিনির পরে অরুর যে বউ ভাতে যাওয়ার খুব ইচ্ছে তেমনটা নয়,কিন্তু সবার জোরাজুরি আর অনুকে এক নজর দেখার স্পৃহার দরুন নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে রাখতে পারলো না অরু।

না গেলে নিশ্চয়ই আপা মন খারাপ করবে,সেই ভেবেই আপার মন খারাপকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে, অগত্যা, রেডি হয়ে অরু ও বেড়িয়ে পরলো সবার সাথে।

সায়র ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট করতে করতে পেছন তাকিয়ে বললো,
—- সবাই এসেছে তো?

অরু তখনও ওঠেনি, ভারী সুতোর কাজ করা ফুল স্লিভ, ফুল নেক গাউনটা সামলে আস্তে ধীরে উঠতে যাবে, ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ একজন বলে,
—- তোরা চলে যা, ও যাবেনা।

আগন্তুকের কথায় অরু বিষ্ফরিত নয়নে পেছনে চেয়ে দেখলো, বাসায় পরার সফেদ রঙা ওভার সাইজ টিশার্ট আর ওভার সাইজ খাকি ট্রাউজার পরে এলোমেলো চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্রীতিক। এক হাত পকেটে গুজে, অন্য হাতে ধরে রেখেছে আইপ্যাড আর হেডফোন,
নির্ঘাত ডার্ক রোমান্টিক অডিও বুক শুনছিল।

চোখ ছোট করে ভাবছে অরু, মনেমনে বলছে,
—- সারাদিন হেডফোন লাগিয়ে এসব শুনবে আর আমার উপর ভুলভাল এ’ক্সপেরিমেন্ট প্রয়োগ করবে, খারুস লোক একটা।
সে যাই হোক কিন্তু এখন উনি কি বললো?

অরুর ভাবনার সুতো ছিড়লো এলিসার রুদ্ধ আওয়াজে, ও ক্রীতিকের কথার পাছে খেঁকিয়ে উঠে বললো,
—-যাবেনা মানে? আমরা সবাই যাচ্ছি তাহলে অরু কেন যাবে না?

ক্রীতিক শান্ত স্বরে বললো,
— কারণ আমি যাচ্ছি না, আমার অনেক কাজ রয়েছে পেন্ডিং।

এবার সায়র গলা উঁচিয়ে বললো,
— তোর কাজ তুই কর গিয়ে, ওকে কেন যেতে দিবি না?

সায়রকে তীক্ষ্ণ চোখে ভস্ম করে দিয়ে, ক্রীতিক সবার উদ্দেশ্যে বলে,
—–আমি যেহেতু যাচ্ছিনা, সেহেতু আমার বউয়ের ও যাওয়া হচ্ছে না। তাছাড়া আমার অরুর সাথে দরকারি কাজ আছে, ইটস ভেরী পার্সোনাল।

ক্রীতিকের এহেন ঘুরানো প্যাচানো কথায় কেউ আর দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করার সাহস দেখালো না, আবার প্রশ্ন করতে গেলে সবার সামনে কি জানি কিই ঠাস করে উত্তর দিয়ে বসে তখন আবার মান সম্মানের প্রশ্ন। তার চেয়ে ইজ্জত বাঁচিয়ে চলে যাওয়াই উত্তম, যার বউ তার কাছেই বরং থাকুক।

অরুর কোনো মতামত না নিয়েই সবাই চোখের পলকে হুঁশশ করে বেরিয়ে গেলো।

চলতি গাড়িটার দিকে নিস্প্রভ চোখে চেয়ে থেকে ভারাক্রান্ত আওয়াজে অরু বলে ওঠে,
—- এটা কি হলো? আপা তো রাগ করবে। এটা কিইই করলেন আপনিইই?

অরুর দুঃখের বিলাপ ক্রীতিকের কান অবধি পৌঁছেছে বলে মনে হচ্ছে না, উল্টে ও অরুর কব্জি চেপে ধরে টান’তে টা’নতে নিয়ে গেলো দু’তলায় নিজের রুমে। পুরো ক্রীতিক কুঞ্জ খালি পরে আছে, একটা সার্ভেন্ট অবধি অবশিষ্ট নেই, সবাই রওনা করেছে বউ ভাতের অনুষ্ঠানে, বাড়িতে রয়ে গিয়েছে শুধু ক্রীতিক আর অরু।

এতো বড় বাড়িটা হুট করে ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় অরুর গা ছমছম করছে, তারউপর ক্রীতিক এমন টানা হেঁচড়ে করছে দেখে অরুর এবার সত্যিই ভয়ে গা শিউরে উঠলো। ও নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে কাইকুই করে বলে ওঠে,
—- ছাড়ুন না, লাগছে আমার।

ক্রীতিক রুমে এনে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে তবেই অরুর হাত ছাড়লো।
অরু দম নিলোনা ব্যথাতুর হাতটা অন্য হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে বললো,
—- কি হয়েছে যেতে দিলেন না কেন?

ক্রীতিক নিজের এক ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
—- কালকের ঘটনার পরেও আমার কাছে কৈফিয়ত চাইতে আত্না কাপছে না তোর?

অরুর মেজাজটা বিগড়ে আছে, একে তো আপার সাথে দেখা হওয়ার সুযোগটা মাটি, তার উপর ক্রীতিকের এমন জোর জব’রদস্তি, আর এই মূহুর্তে বিগড়ানো মেজাজটাকে সামলে নেওয়ার কোনো ইচ্ছেও নেই ওর, অগত্যা নিজের নাকটা সিকোয় তুলে, ঝাঁজিয়ে উঠে অরু বলে,
—- না কাঁপছে না, কারন আপনি আমার স্বামী, স্বামীর সাথে কথা বলতে কারও আত্না কাঁপে শুনেছেন কখনো?

ক্রীতিক বুঝলো ওর দূর্বলতাটা অরু ভালোমতোই রপ্ত করেছে,কিভাবে কথা এগোলে ক্রীতিক দমে যাবে সেটা অরু শিখে গিয়েছে। তাই ওর সাথে তর্কে না গিয়ে ক্রীতিক কথা ঘুরিয়ে গম্ভীর মুখে বললো,
—- এসব হাবিজাবি পোশাক এক্ষুনি চেঞ্জ কর,রাগ লাগছে আমার।

অরু ত্যক্ত গলায় বললো,
— চেঞ্জ করার জন্য হলেও তো রুমে যেতে হবে, যেতে দিন?

— না এখানেই কর।

— কিহ!

অরুর হতবিহ্বল মুখের পানে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ক্রীতিকের ঠোঁটের আগায় খেলে গেলো এক চিলতে কপট হাসি, এই ভীত হরিণীটাকে ভরকে দিতে ওর বেশ লাগে।

কিন্তু পরক্ষনেই গতকাল অমিত অরুকে স্পর্শ করেছে, সেই দৃশ্যটা মানস্পটে ভেসে উঠতেই সঙ্গে সঙ্গে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ক্রীতিকের। ও কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে অরুর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে, চুলের পেছন থেকে অরুর সরু ঘাড়টা চেপে ধরে মুখের কাছে মুখ নিয়ে গাঢ় গলায় বলে,
—- উল্টা পাল্টা চিন্তা করা বন্ধ কর, আমি তোকে আদর সোহাগ করার জন্য ড্রেস চেঞ্জ করতে বলিনি,অবশ্য আমার আদর তুই ডিজার্ভ ও করিস না।

কথা শেষ করে অরুকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো ক্রীতিক। ক্রীতিক প্রচন্ড রাগে বো’ম হয়ে আছে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অরু নিচু স্বরে বললো,
—- এখানে পড়বো টা কি? জামা কাপড় তো সব রুমে।

ক্রীতিক স্টাডি টেবিলে গিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে বললো,
—- ক্লজেটে অনেক গুলো ওভার সাইজ টিশার্ট আছে যেটা ইচ্ছে পর।

তৎক্ষনাৎ অরু চোখ পাকিয়ে বলে ওঠে ,
—- আপনি কি পা’গল? এটা আপনার ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়ি নয় যে চাইলেই আমি আপনার হাটু সমান টিশার্ট পরে ঘুরে বেড়াবো, এটা ক্রীতিক কুঞ্জ, বাংলাদেশের ক্রীতিক কুঞ্জ।

ক্রীতিক ল্যাপটপ স্ক্রিনে চোখ নিবদ্ধ রেখেই জবাব দিলো,
—- বাড়িতে কেউ নেই, যা বলছি চুপচাপ তাই কর।

অরু জানে ক্রীতিকের জিদের কাছে ওর হার মানতেই হবে, তাই অযথা কথা বাড়িয়ে নিজের সময় আর এনার্জি খরচ করলো না ও আর, ক্লজেট খুলে বড় দেখে একটা সাদা টিশার্ট নিয়ে ঢুকে গেলো ওয়াশরুমে।

অরু যখন বেরিয়ে এলো, তখনও ক্রীতিক আগের ন্যায় স্টাডি টেবিলেই বসে আছে, অরুর পায়ের আওয়াজে এক ঝলক ওর দিকে তাকিয়ে ক্রীতিক বলে,
—- তুই কি প্ল্যান করে আমার সাথে ম্যাচিং কালারের টিশার্ট পরেছিস নাকি? এই সব প্ল্যান ফ্ল্যান করে থাকলে ভুল করছিস, তোর অ’ন্যায়ের কোনো ক্ষমা নেই। এখন দাঁড়িয়ে না থেকে চুপচাপ পড়তে বস।

ক্রীতিকের শেষ কথায় অরু যেন আকাশ থেকে পাতালে পরলো, কপালে বিরক্তির একশো একটা ভাজ টেনে নাকটা চুড়োয় তুলে অরু বললো,
—- পড়তে বসবো মানে?

ক্রীতিক নির্লিপ্ত গলায় বলে,
—- এতে এতো অবাক হওয়ার কি আছে? আমি ছিলাম না বলে পড়াশোনার বারোটা বাজিয়েছিস, এখন থেকে এসব একাডেমি ফ্যাকাডেমি যাওয়া বন্ধ,অমিতের মতো নোভেলিস্ট হওয়ার ভুত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল,অমিত কিংবা ওর পেশা সবকিছু থেকে একশো হাত দূরে থাকবি তুই। এ্যাম আই ক্লিয়ার?
এখন পড়তে আয়, আজকের লেসন এর উপর কিছু এসাইনমেন্ট দেবো তোকে, কাম হেয়ার।

অরু নির্লিপ্ত মুখে এগিয়ে এসে চেয়ারে বসে পরলে, ক্রীতিক ওর সামনে ল্যাপটপ এগিয়ে দিয়ে নিজে লেকচার শুরু করে। সময় নিয়ে একে একে প্রত্যেকটা পয়েন্ট ধরে ধরে অরুকে বোঝায়, কোথাও বুঝতে সমস্যা হচ্ছে কিনা সেটাও বারবার জিজ্ঞেস করে। এভাবে লেসন দিতে দিতে কয়েকঘন্টা অতিবাহিত হলে ক্রীতিক অরুকে কিছু শর্ট কোশ্চেন সলভ করতে দিয়ে নিজে পুনরায় ল্যাপটপে মনোযোগী হয়।

ক্রীতিক অন্যদিকে খেয়াল দিয়েছে, সেটা বোধগম্য হতেই অরু এগিয়ে এসে ক্রীতিকের সামনের চেয়ারটাতে বসে ওর দিকে ঝুঁকে কিছু বলতে যাবে, তৎক্ষনাৎ ঘোর আপত্তি জানিয়ে ক্রীতিক বলে,
—- খবরদার একদম কাছে আসবি না আমার। যা বলার দূর থেকে বল।

অরু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্রীতিকের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে মুখ কাঁচুমাচু করে বললো,
—- দেখুন আমার ইকোনমিকস পড়তে একটুও ভালো লাগেনা,সত্যি বলছি।আমি বাংলা সাহিত্য পড়তে চাই।

অরুর কথাটা বোধ হয় মোটেই ভালো লাগেনি ক্রীতিকের,ও নিজের হাতে থাকা পেপার ওয়েটটা মুঠিতে নিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলে,
—- তুই বলতে চাইছিস আমার সাবজেক্ট নয়,বরং অমিতের সাবজেক্ট তোর ভালো লাগে তাইতো?

অরু তরিৎ গতিতে না সূচক মাথা নাড়িয়ে উদ্বিগ্ন গলায় বলে,
—- না না তেমন কিছু নয়, আপনি ভুল বুঝছেন। কিন্তু ইকোনমিকস….

—- হয়েছে আর বলতে হবেনা, এটুকুতেই অনীহা ধরে গিয়েছে আমার প্রতি। সারাজীবন থাকলে নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়ে যাবি?

ক্রীতিকের কথায় অরু বারবার না সূচক মাথা নাড়ায়, কিন্তু ক্রীতিকের জিদ তো কুন্ডলী পাকিয়ে বেড়েই চলেছে।

ও এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে, অরু ওর সাবজেক্ট রিজেক্ট করে অমিতের সাবজেক্ট পড়তে চাইছে, হাউ ডেয়ার শি?

ক্রীতিক মেজাজ হাড়িয়ে অরুকে তৎক্ষনাৎ রুম থেকে বের করে দিয়ে দরজা লক করে দিলো। ক্রীতিকের এমন হুটহাট রেগে যাওয়াতে এই মূহুর্তে অরু নিজেও বেশ বিরক্ত, তাই ওকে আর আগ বাড়িয়ে ডাকতে গেলো না অরু, চুপচাপ হাঁটু সমান টিশার্ট টাকে আরেকটু টেনেটুনে নিচে নামিয়ে, লম্বা চুল গুলো চুড়ো করে বাঁধতে বাঁধতে এগিয়ে গেলো নিজের রুমের দিকে ।

*****************************************

আড়মোড়া ভেঙ্গে অরু যখন ঘুম থেকে জাগে তখন সূর্য মাঝ আকাশে। জানালা গলিয়ে দুপুর বেলার তীর্যক সূর্য রশ্মি এসে শরীরে আঁচড়ে পরতেই চোখ মুখ কুঁচকে গেলো অরুর। সেই যে তখন ক্রীতিকের রুম থেকে ফিরে শুয়েছিল, তারপর কখন যে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গিয়েছে তা আর টের পায়নি অরু, যখন টের পেলো তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়।

ক্রীতিক আশেপাশে কোথাও নেই, তবুও ক্রীতিকের মাস্কি সুবাসটা চারিদিকে ভুর ভুর করছে, কোথা থেকে ভেসে আসছে এই সুঘ্রাণ তার উৎস খুঁজতেই গিয়েই অরুর খেয়াল হলো ও ক্রীতিকের টিশার্ট পরে আছে, পরক্ষণেই নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে অরু, কেন যেন এই টিশার্ট টা পরে মনে হচ্ছে ক্রীতিক ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।

আর এই গন্ধটা, ভাবতে ভাবতে গলার কাছ থেকে টিশার্টটা টেনে নাকে ছোঁয়ালো অরু, এটা বোধ হয় আজকাল পরেছে ক্রীতিক, ওই জন্যই এতো সুন্দর ম্যানলি সুঘ্রাণ বেরোচ্ছে। সিগারেট, আফটার শেভ, স্যান্ডাল উড পারফিউম,শুকিয়ে যাওয়া ঘাম সবটা মিলেমিশে এক অকৃত্রিম নেশাতুর প্রভাব বিস্তার করে অরুর মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে।হৃদ মাঝারে ক্রীতিকের জন্য পা’গলপারা অনুভূতির জোয়ার উগরে দিতে অরুর বোধ হয় এতোটুকুই যথেষ্ট। অষ্টাদশীর প্রথম প্রেম বলে কথা, আবেগ তো টইটম্বুর হবেই।

অরু এসব ভেবে ভেবে আর সময় নষ্ট করে না, কারন ক্রীতিকের কথা ভাবতে বসলে ওর দিন পেরিয়ে রাত ঘনাবে তবুও এই মানুষটাকে ভালোবাসার কোনো কারন মাথায় আসবে না ওর। এমন ছন্নছাড়া বদ মেজাজী মানুষকে কেউ ভালোবাসাবে অরু ছাড়া?

প্রকট গর্ববোধে মনে মনে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ালো অরু, তারপর জামা কাপড় পাল্টে নিচে গিয়ে জোগান দিতে বসলো দুপুরের খাবারের।

বউকে রান্না করে নিজ হাতে খাওয়ানোর মতো হাসবেন্ড ম্যাটেরিয়াল পুরুষ ক্রীতিক নয়, হয়তো নিজেও অরুর সাথে জিদ দেখিয়ে না খেয়ে বসে বসে কাজ করছে।
তাই অরুই দ্রুত হাত চালিয়ে ভাত,ডাল রান্না করলো, ফ্রিজের লেফটওভার তরকারি গুলো গরম করলো, আর সাথে ক্রীতিকের জন্য মিক্সড স্যালাড বানালো।

সবকিছু তৈরী করে অরু খাবার দাবার সব ডাইনিং এ সাজিয়ে নিচতলা থেকে টেলিফোন করলো ক্রীতিকের নাম্বারে। ক্রীতিক ফোন তুলে রুদ্ধ আওয়াজে বললো,
— কি চাই?

অরু কিছুটা কপটতা অবলম্বন করে নাক টেনে ফুপিয়ে উঠে বললো,
—- আ..আমার হাত কেটে গিয়েছে, অনেক র’ক্ত পরছে আপনি তাড়াতাড়ি নিচে আসুন।

অরুর বলতে দেরি হলো ক্রীতিকের ধরফরিয়ে নিচে নেমে আসতে দেরি হলোনা, এমনকি তাড়াহুড়োয় পায়ের স্লিপারটাও পরেনি ও, খালি পায়ে দৌড়ে এসে অরুকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ক্রীতিক উদ্বিগ্ন স্বরে বলে,
—- কি হয়েছে বেইবি, কোথায় লেগেছে?

—- আমি ঠিক আছি, কোথাও লাগেনি।

অরুর মিটিমিটি হাসি আর কথাটা বোধগম্য হতেই ক্রীতিকের ম্লান হয়ে যাওয়া সুপ্ত রাগটা পুনরায় ভলভলিয়ে ওঠে মস্তিষ্ক জুড়ে, ও তৎক্ষনাৎ বাজপাখির ন্যায় ছো মে’রে অরুর গলাটা হাল্কা চেপে ধরে আ’গুন চোখে তাকিয়ে বলে,
—- আমার সঙ্গে এই ধরনের মশকরা করার সাহস কোথায় পেলি তুই? তুই জানিস একটুর জন্য আমার হার্টবিট স্টপ হয়ে গিয়েছিলো? আমি কয়েক সেকেন্ড আগেও এটা ভেবে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলাম যে কতখানি কে’টে গেলো তোর,কাটা যায়গা থেকে ঠিক কতটা র’ক্ত ঝরছে , আর তুই কিনা আমার সাথে এই সব সেনসিটিভ বিষয় নিয়ে মশকরা করছিস? হাউ দেয়ার ইউ অরু? অনেক সাহস বেড়ে গিয়েছে তোর।

ক্রীতিকের বরফ কেটে ফেলার মতো ধা’রালো কথায় শুষ্ক ঢোক গিললো অরু, কোনো মতে সাহস জুগিয়ে মিনমিনিয়ে বললো,
—- খেতে ডাকলে তো জীবনেও আসতেন না, তাই এভাবে ডেকেছি।

অরুর কথায় ক্রীতিক এবার আরও রেগে গেলো, রাগে ফোঁসফাস করে বলে উঠলো ,
—- আমার দূর্বলতা নিয়ে টানাটানি করা বন্ধ কর অরু, আই হেইট বিট্রে্।

কথা শেষ করতেই খাবার টেবিলে চোখ আটকে গেলো ক্রীতিকের। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে, অথচ ওরা দুজনার একজন ও কিছু খায়নি এখনো।

অরু অভুক্ত সেটা মাথায় আসতেই অরুর গলাটা ছেড়ে দিয়ে ওকে নিয়ে বেসিনে চলে যায় ক্রীতিক, অতঃপর অরুর ঘর্মাক্ত মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে নরম স্বরে বলে,
—- আর কখনো এমন মশকরা করিস না হার্টবিট, আমাকে মানাতে তোর নিজেকে নিয়ে মিথ্যে কথা বলার প্রয়োজন নেই, সময় হলে আমি নিজেই মেনে যাবো, তোকে ছেড়ে কোথায় যাবো আমি বল? তুই ছাড়া কেইবা আছে আমার?

******************************************

সেদিনের কথাগুলো ভেবে আরেক দফা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অরু, ক্রীতিক তখন কথা দিয়েছিল মেনে যাবে, আর রাগ করে থাকবে না, কিন্তু কিসের কি?

এখনো অরুর সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনা ক্রীতিক। যেটুকু বলে সেটাও ধমকের সুরে, সত্যি বলতে অরু শুধুমাত্র অনুকে নয়,ক্রীতিককেও মিস করছে, ওর ভালোবাসা গুলো ভীষণ মিস করছে অরু।

অর্ণব অরুর মলিন মুখের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সায়রের দিকে চাইলো, সায়রের ও একই হাল,কয়েক সেকেন্ড অন্তর অন্তর খালি ফুসফাস দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে ছেলেটা। অর্ণব পাকোড়া ভর্তি মুখ নিয়ে সায়রের দিকে ভ্রুক্ষেপ করে অস্পষ্ট আওয়াজে শুধালো,
—- অরুর না-হয় অনুর জন্য মন খারাপ, ছোট বেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছে এখন দু’বোন দুই বাড়িতে, কিন্তু তোর কি হয়েছে? তোর ভারী নিঃশ্বাসের আওয়াজে তো উপর ওয়ালার ও মন গলে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

অর্ণবের কথার পাছে সায়র বুক ভার করা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই হুড়মুড় করে সদর দরজা ঠেলে অন্দরমহলে প্রবেশ করে ক্রীতিক আর আজমেরী শেখ।

ওদের পেছন পেছন প্রত্যয় ও এসেছে । তাদের সবার বেশভূষা আর হাতের ফাইলপত্র দেখে মনে হচ্ছে মাত্রই অফিস থেকে ফিরলো তারা, তবে আজমেরী শেখ আর ক্রীতিক দু’জনারই চোখ মুখ গম্ভীর হয়ে আছে।

দু’জনার তীক্ষ্ণ চোখ দেখে মনে হচ্ছে, পারছে না দুজন দু’জনকে কাঁচা গি’লে খেতে, আর ওদের মধ্যে চাপা পরে প্রত্যয় অসহায়ের মতো শুধু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

ভেতরে প্রবেশ করে দু’জন দুজনার চোখের দিকে কঠিন দৃষ্টিপাত করে, দু’জনই বড় বড় পা ফেলে দুই দিকের সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে উপরে চলে গেলো তারা। নিজের মা আর স্বামীর এমন স্নায়ু যু’দ্ধ দেখে অরু হকচকিয়ে ওঠে, সহসা দৌড়ে এসে প্রত্যয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,
—- কি হয়েছে প্রত্যয় ভাইয়া?সব ঠিক আছে তো?

প্রত্যয় বিরক্তিতে চিড়বিড়িয়ে উঠে, তেঁতো গলায় বললো,
—- এই যে অরু, তোমার মা আর তোমার বর কে সামলাও। প্রতিদিন মিটিং এ তারা টেন্ডার নিয়ে একজন আরেক জনের পিছনে লেগেই থাকে। জামাই শাশুড়ী যদি একটু হলেই একজন আরেকজনের পেছনে লেগে যায়, তাহলে অন্য শেয়ার হোল্ডাররা কি করবে শুনি? মাঝখান থেকে আমি বেচারা সব কিছু সামলাতে সামলাতে টেনশনে ভর্তা হয়ে যাচ্ছি, এদের টেনশনে টেনশনে আমি যদি এ্যাটাক,ফ্যাটাক করে বসি তাহলে তোমার আপার কি হবে বলোতো?

খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সত্যিই তো প্রত্যয় ভাইয়া এই বয়সে পটল তুললে আপার কি হবে? তার উপর আপা যদি শোনে প্রত্যয় ভাইয়ার মৃ:ত্যুর পেছনে একমাত্র দায়ী তার ছোট বোনের একমাত্র স্বামী জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী, তাহলেতো সব সম্পর্ক শেষ।

—- কি ভাবছো?

প্রত্যয়ের ডাকে ভ্রম কেটে গেলো অরুর। ও তৎক্ষনাৎ সাবধানে প্রশ্ন ছুড়ে বললো,
—- মায়ের কি হয়েছে?

প্রত্যয় বললো,
—- শেয়ার হোল্ডারদের দুটো টেন্ডারই ক্রীতিক ভাই পেয়েছে, নতুন জয়েন করে একই সাথে দুটো টেন্ডার পাওয়া মুখের কথা নয় অরু, অনেক খাটুনির কাজ। ক্রীতিক ভাই কষ্ট করেছে, দিন রাত খেটেছে, কিন্তু মা এটাকে পজিটিভলি নিচ্ছে না। টেন্ডার গুলো যাতে হাতছাড়া হয় সে জন্য বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করছেন মা, যা পরবর্তীতে ক্রীতিক ভাইয়ের কানেও চলে এসেছে। ওই জন্যই আর আরকি….

অরুকে আর খুলে বলতে হলোনা, ও যা বোঝার বুঝে গিয়েছে। ব্যক্তিগত জিদ এখন কোম্পানির কাজেকর্মেও প্রকাশ পাচ্ছে, আজকাল এসবের জন্য অরুর নিজেকেই সবচেয়ে বেশি অপ’রাধী মনে হয়, কেন যে ভালোবাসতে গেলো জায়ান ক্রীতিক কে?

আচ্ছা অরু না ভালোবাসলে জায়ান ক্রীতিক কি ওকে ছেড়ে দিতো? ভাবছে অরু। অরুর ভাবনার ছেদ ঘটে উপর তলা থেকে ক্রীতিকের ডাকে,
—- বেইবি একগ্লাস ঠান্ডা পানি।

অরু উপরের দিকে তাকিয়ে সস্থির নিঃশ্বাস ছাড়লো, আজ প্রায় তিনদিন পর ক্রীতিক আবারও ডাকছে অরুকে,যার ফলে বুকের ভেতরটাতে শীতল ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো ওর, একটু আগের সন্দেহ, দোটানা সবকিছু মূহুর্তেই হাওয়ায় উবে গেলো। পাছে এসে জড়ো হলো একরাশ সস্থি আর ব্যকুলতা।

ক্রীতিক ডাকছে তার মানে রাগ পরেছে,কথাটা ভেবেই অরু আর অপেক্ষা করে না পানি নিয়ে সোজা চলে যায় উপরের ঘরে।

তবে রুমে এসে ক্রীতিককে পায়না অরু, ওয়াশরুম থেকে পানির কলকল আওয়াজ বেরোচ্ছে, মনে হয় শাওয়ার নিচ্ছে ক্রীতিক, তাই বেডসাইড টেবিলে পানির গ্লাসটা রেখে চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে যায় ও।

********************************************

সেই যে সন্ধ্যা বেলাতে একটু খানি চোখের দেখা হলো তারপর আর কোনো খোঁজ নেই ক্রীতিকের।

এখন মাঝরাত, মেঘের চাঁদরে ঢাকা পরেছে শুক্লপক্ষের চাঁদ, বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে আছে।

মা ও সন্ধ্যা বেলাতে দরজায় খিল দিয়েছে, মামিরাও ঘুমাচ্ছে, এলিসা ক্যাথলিন ও ঘুমে বিভোর, ঘুম নেই শুধু অরুর দু’চোখে, ও কতক্ষণ পানি খাওয়ার ছলে নিচে আসছে তো কতক্ষন করিডোরে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে, মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই প্রশ্ন এতো রাতে কোথায় যেতে পারে মানুষটা?

অবশেষে অরুর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাত আড়াইটা নাগাদ বাড়িতে ফেরে ক্রীতিক। ক্রীতিক ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে রাগ অভিমান সমস্তটা ভুলে গিয়ে এক ছুটে নিচে চলে আসে অরু। নিচে এসে ক্রীতিকের মুখোমুখি হয়ে দাড়াতেই ক্রীতিক শান্ত গলায় বলে,
—- ঘুমাস নি?

—- কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?

অরুর প্রশ্নে ক্রীতিক বাধ্য স্বামীর মতো জবাব দিলো ,
—- বিয়ের আসর থেকে মেয়ে ভাগিয়ে আনতে।

ক্রীতিকের এহেন কথায় অরুর দুনিয়া দুলে উঠলো, ও তৎক্ষনাৎ হিং’স্র বা’ঘিনীর ন্যায় ঝাপিয়ে পরে দু’হাতে ক্রীতিকের ডেনিম শার্টের কলারটা খামচে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
—- ঘরে বউ থাকা সত্বেও একটা মেয়ে ভাগিয়ে আনতে লজ্জা করলো না আপনার? একটু মনমালিন্য ঝগড়াঝাটি হয়েছে বলে আপনি এমন একটা কাজ করবেন? নাকি এখন আর আমাকে ভালো লাগেনা? আমার মাঝে কি অনুপস্থিত যা ওই মেয়ের মধ্যে আছে? কেন করলেন এটা?

জীবন দিয়ে দেবো তবুও আপনার ভাগ আমি কাউকে দেবোনা।
জায়ান ক্রীতিক শুধু আমার,কই সেই হ’তচ্ছাড়ি ওকে আজ আমি ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়ে বিদায় করবো।

অরুর এসব কা’ন্নাকাটি আর আহাজারিতে বিরক্ত হয়ে শেষমেশ ওকে একটা রাম ধমক দিলো ক্রীতিক,
—- জাস্ট স্টপ ইট অরু। সেই তখন থেকে বলেই যাচ্ছিস, বলেই যাচ্ছিস, আমাকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগটা দিয়েছিস? কিভাবে বলবো আমি?

ক্রীতিকের ধমকে কেঁপে উঠল অরু, পরবর্তীতে দ্বিতীয় আর একটা কথাও মুখ থেকে বের করার সাহস দেখালো না আর। শুধু চুপচাপ মাথা নুইয়ে চোখের পানি ফেলছিল, ক্রীতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অরুকে মানানোর মতো করে বললো,
—- আমি আমার জন্য মেয়ে ভাগাতে যায়নি বেইবি।

—- তাহলে?

ক্রীতিকের আর কষ্ট করে অরুর প্রশ্নের উত্তর দিতে হলোনা, তার আগেই ওর পেছনে উপস্থিত হলো আরও দুজন ব্যক্তি, অরু ক্রীতিকের থেকে একটু খানি সরে দাড়িয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখতে পায়,
—- সায়র আর নীলিমা হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নীলিমার পরনে লাল টুকটুকে বিয়ের শাড়ি, চোখ দুটো অ’শ্রুসীক্ত। ওর লাল লাল চোখদুটো দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা অনেক কেঁদেছে।

অরু নীলিমার দিকে এগিয়ে গিয়ে হতবাক হয়ে বললো,
—- কি হয়েছে নীলিমার?

ওদের পর পরই অর্ণব আর এলিসা ভেতরে প্রবেশ করতে করতে হাসি মুখে বললো,
—- বিয়ে হয়েছে, আমাদের সায়রের সাথে।

নীলিমা কেঁদে উঠলো তৎক্ষনাৎ,
—- আব্বাজাআআন।

সায়র হতবাক হয়ে ওর ক্রন্দনরত মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
—- এখনো আব্বাজান আব্বাজান করবে? পালিয়ে এসেছি তো আমরা।

ওদের কারোর কথার আগামাথা বুঝতে না পেরে অরু একই সাথে অনেক গুলো প্রশ্ন ছু’ড়ে বলে,
—- এলিসা আপু তুমি না ঘরে ছিলে? আর নীলিমার তো আজ আকদ হওয়ার কথা ছিল, তাহলে সায়র ভাইয়া…..?

অরুর সকল প্রশ্নকে অগ্রাহ্য করে ওর হাতটা টেনে ক্রীতিক বলে,
—- সব প্রশ্ন কাল করতে পারবি, অনেক রাত হয়েছে আমি ঘুমাবো, তাছাড়া ওদেরকেও সকাল সকাল ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ধরতে হবে, চল এবার।

অরুর মাথাটা এমনিতেই ঘুরঘুর করছে, চোখের সামনে সব কিছু জটলা পাকিয়ে আছে, আর ক্রীতিক কিনা ঘুমাবে? এমন একটা ঘটনার পরে আদৌও ঘুম পায় কারও?আশ্চর্য!

অরু তৎক্ষনাৎ নিজের হাতটা ঝাড়ি মে’রে ক্রীতিকের থেকে ছাড়িয়ে বললো,
—- আপনার ঘুম পেলে আপনি গিয়ে ঘুমান, আমাকে কেন টানছেন?

ক্রীতিক চোয়াল শক্ত করে বললো,
— কেন টানছি বুঝতে পারছিস না?

অরু নাক ফুলিয়ে ত্যাড়া কন্ঠে বললো,
—- না বুঝতে পারছি না,বলুন?

ক্রীতিক এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,
—- উপরে চল বলছি।

— না এখানেই বলুন।

ক্রীতিক আর নিজেকে সংবরণ পারলো না, তখনই অরুকে কোলে তুলে নিয়ে উপরে যেতে যেতে সবার মধ্যেই বলে উঠলো,
—- তোর জামার মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে ঘুমাবো তাই।

রুমের সামনে এসে ক্রীতিক দরজা খোলার উদ্দেশ্যে অরুকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য কোল থেকে নামালে, অরু সেই সুযোগে ক্রীতিকের হাতে জোরে কামড় মে’রে দৌড়ে পালিয়ে যায়, ক্রীতিক ও আজ পন করে নিয়েছে ও আজ আর অরুকে ছাড়বে না,কিছুতেই না।

তাই ক্রীতিক ও এবার চুপচাপ এগিয়ে যেতে লাগলো অরুর পিছু পিছু।

অরু ছুটতে ছুটতে ছাঁদে চলে এসেছে, ক্রীতিক নিশ্চয়ই এতো রাতে ঘুম বাদ দিয়ে অরুকে তাড়া করে ছাঁদে চলে আসবে না? সেই ভেবে সস্থির নিঃশ্বাস নিলো অরু।

মাঝ রাতে আকাশে চাঁদ নেই, আছে কেবল
ঝিরিঝিরি মৃদু বাতাস, যে বাতাসে এলোমেলো হয়ে উড়ছে অরুর এক হাটু রেশমের মতো লম্বা চুল। অরু খোলা আকাশের দিকে মুখ তুলে দু’চোখ বন্ধ করে প্রান ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে যেই না চোখটা খুললো,অমনি কোথা থেকে যেন ছুটে এসে ঝড়ের গতিতে অরুকে চেপে ধরে ওর ঠোঁটের মাঝ বরাবর দাঁত বসিয়ে দিলো ক্রীতিক।

অকস্মাৎ তীব্র ব্যথায় মৃদু আর্তনাথ করে উঠলো অরু, তরিৎ বেগে দু’হাতে খামচে ধরলো ক্রীতিকের শার্ট। একেবারে অরুর ঠোঁট থেকে কয়েক ফোটা র’ক্ত পান করে তবেই ওকে ছাড়লো ক্রীতিক। ছাড়া পেয়ে ইতিমধ্যে ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়া ঠোঁটে হাত ছুয়িয়ে অরু আতঙ্কি’ত স্বরে বললো,
—- কি করেছেন এটা? র’ক্ত বেরোচ্ছে কেন?

ক্রীতিক কপট হেসে বললো,
—- কি ভেবেছিলি ছেড়ে দেবো?

অরু অভিমানি গলায় বললো,
— আপনি কখনো ছাড় দিয়েছেন আমাকে? সবসময়ই তো ব্যথা দিতে থাকেন।

কথা শেষ করে অন্য দিকে ঘুরে চোখ মুছলো অরু। ক্রীতিক ওর সংস্পর্শে এসে দাঁড়িয়ে অরুর খোলা চুলে চুমু খেয়ে ওর মাথার উপরে নিজের চিবুক ঠেকিয়ে শান্ত গলায় বলে,
—- আর আদর করিনা বুঝি?

অরু জবাব দেয়না, ক্রীতিক অরুকে ঘুরিয়ে ওর দু’গালে চুমু খেয়ে বলে,
—– আমি মে’রেছি আবার আমিই আদর করে দিচ্ছি, আর কোথায় কোথায় মে’রেছিলাম বল, সব আদর আজ একসাথে পুষিয়ে দেবো।

অরু ক্রীতিকের সুঠাম বুকে ধাক্কা মে’রে বলে,
—- লাগবেনা আপনার আদর। আমি কেউ নই আপনার, যান এখান থেকে।

ক্রীতিক সামান্য ঝুঁকে গিয়ে অরুর নাকটা হালকা টেনে দিয়ে বলে,
—- তুই ছাড়া কে আছে আমার, হুম?

ক্রীতিকের কথা গায়ে না লাগিয়ে, অরু পুনরায় পেছনে ঘুরে দাঁড়ালে, ক্রীতিক পেছন থেকেই ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নির্লিপ্ত গলায় বলে,
—- তুই ছাড়া আমার কেউ নেই অরু, তুই ছাড়া আমার পৃথিবীটা মরীচিকার মতো , কোনো আলো নেই, কোনো রঙ নেই, কোনো সুঘ্রাণ নেই, অমার অরু নেই। আমার চোখে পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্যের প্রতীক শুধু তুই, আমি পৃথিবীতে খুব একা বলেই হয়তো উপর ওয়ালা তোর মাঝে আমার সমস্ত সুখ রেখে দিয়েছে, নয়তো তুইই কেন বল?

হার্টবিট, আজকে এতো কথা তোকে কেন বলছি, জানিস ?

ক্রীতিকের প্রশ্নে অরু না সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক পুনরায় বলে,
—- কারণ তুই আমার বেঁচে থাকার অঙ্গীকার অরু, তোকে আমি এভাবেই সারাজীবন হৃদয়ের গহীনে আগলে রাখতে চাই,যখন ইচ্ছে হবে দু’হাতে তুলে আদর করবো, তারপর আবার সযত্নে লুকিয়ে রাখবো। আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোকে আগলে রাখার দ্বায়িত্ব শুধু আমার।
even l will protect you, till my last breath baby…and l promise that.

তুই কেবল হৃদয় উজাড় করে আমাকে ভালোবাসবি, আমার জন্য পা’গল থাকবি, যেমনটা আজকে হয়েছিলি। বাকি পুরো দুনিয়া আমি একাই সামলে নেবো । আমার জীবনে তুই ছাড়া অন্য দ্বিতীয় নারী না কোনোদিন ছিল, আর না কোনো আসবে।জায়ান ক্রীতিক শুধু তোর বেইবি, শুধু তোর।

ক্রীতিকের কথা শেষ হতেই অরু আচমকা ঘুরে ক্রীতিকের গলা জড়িয়ে ধরে রিনরিনে আওয়াজে বলে,
—- আমি তোমাকে ভালোবাসি জায়ান ক্রীতিক, খুব ভালোবাসি, অকারণেই ভালোবাসি, ভালোবাসায় এতো কারন লাগেনা, তুমি আমার সেই লাগামহীন ভালোবাসা, যে ভালোবাসার গভীরতা আমি চাইলেও কোনোদিন উপলব্ধি করতে পারবো না,কখনোই না।

ক্রীতিক নিজেদের অধর যুগলের মাঝে থাকা দূরত্বটুকু ঘুচিয়ে গভীর চুম্বনের তালে বলে,
—- আই লাভ ইউ টু বেইবি।

ধীরে ধীরে ক্রীতিকের ভালোবাসার স্পর্শ গভীরতা লাভ করতেই অরু ছিটকে দূরে সরে যায়। ক্রীতিক দু’কদম এগিয়ে গিয়ে ব্যকুল কন্ঠে বলে,
—- কি হয়েছে কাছে আয়?

অরু ক্রীতিকের চোখে চোখ রেখে না সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক আসল ঘটনা বুঝতে পেরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে বলে,
—- ইটস ওকে, মুখে বললেই তো হয়,এতো ভ’য় পাওয়ার কি আছে আমি কি মানুষ নই নাকি? এখনও পেট ব্যথা করছে?

অরু এবারও চুপচাপ না সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক ওর কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলে,
—- ঠিকাছে নিচে চল অনেক রাত হয়েছে, আমাদের ঘুমানো প্রয়োজন।

******************************
সকাল সকাল এয়ারপোর্টে এসেছে ওরা সবাই, নীলিমার আব্বাজান ওদের নাগাল পাওয়ার আগেই সায়রের বাড়ি দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যে বেরিয়ে পরেছে ওরা।

ইমিগ্রেশন শেষ করে নীলিমা আর সায়র ভেতরে প্রবেশ করলে, বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে মুখটা মলিন করে অরু বলে,
—- ইশ! দার্জিলিং ভ্রমনে যাওয়া আমার ছোট বেলার শখ, অথচ নীলিমা কত সহজেই চলে যাচ্ছে।

ক্রীতিক পাশে দাড়িয়ে ফোন স্ক্রল করছিল, অরুর কথা শুনে মাথা তুলে ক্রীতিক শুধায়,
—- যেতে চাস, দার্জিলিং এ??

অরু কোনোকিছু না ভেবেই হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো, তৎক্ষনাৎ অরুর হাতটা ধরে ক্রীতিক চট করে বলে ওঠে,
—- চল তাহলে।

অরু হতবিহ্বল কন্ঠে বলে ওঠে,
—- কি বলছেন? পাসপোর্ট নেই,টিকেট নেই কিভাবে যাবো?

—- সব আছে আমার কাছে।

ক্রীতিক এক প্রকার ছুটছে অরুর হাতটা ধরে, অরুও ক্রীতিকের সাথে দ্রুত পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
—- আর জামা কাপড়?

ক্রীতিক বললো,
—- যা যা লাগবে সব কিনে দেবো, এখন দ্রুত চল, নইলে ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে।

অরুও এবার আর ঘাবড়ালো না, দু’হাতে শক্ত করে ক্রীতিকের বলিষ্ঠ হাতটা ধরে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে আবদারের সুরে বলে,
—- আমার একটা হ্যাট চাই, আর একটা ক্যামেরাও।

ক্রীতিক মৃদু হেসে অরুর কপালে শব্দ করে চুমু খেয়ে বলে,

—- এজ ইউ উইশ বেইবি।

চলবে……..
আমি কথা রেখেছি, এবার সবাই গঠনমূলক কমেন্ট করবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here