#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ৪২
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[ক,পি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য]
(ট,ক্সিক পর্ব, দূর্বল চিত্তরা এরিয়ে যেতে পারো।)
নিশুতি রাতে গাড়ি ঘোড়ার চাপ কমে এসেছে কিছুটা। পুরান ঢাকার অলিগলিতে এখন কেবলই দোকানীর শাটার টানার ঝনঝন আওয়াজ। ফুটপাত গুলোও মানব শূন্য, পথচারী যারা আছেন তারা ও দ্রুত পদচারণায় বাড়ি ফেরার পায়তারা করছেন।
ক্রীতিকের বন্ধুমহল কেনাকাটা শেষ করে বাড়িতে ফিরলেও, অনু আর প্রত্যয়ের বাড়ির বড়দের জন্য উপহার সামগ্রী কিনতে কিনতে সন্ধ্যা গড়িয়ে মাঝরাতে গিয়ে ঠেকেছে।
আজ বহুদিন বাদে আবারও ওরা হাতে হাত ধরে বাবল টি এর সিপ নিয়েছে। আমেরিকাতে বসে দু’জন দু’টো জারে টি পান করলেও, এখন সময় ভিন্ন, অতএব প্রত্যয়ের ঘোর আপত্তি আলাদা করে বাবল টি নেওয়ার।
ও যদি খায় তবে অনুর টা থেকেই খাবে। অনুও আর বাধসাঁধে নি,কোনোরূপ বাকবি’তন্ডা ছাড়াই প্রত্যয়ের সাথে ভাগাভাগি করেছে নিজের পছন্দের বাবল টি।
এরপর দু’জনে হাতে হাত ধরে হাতিরঝিলে বসে একটা প্রানোচ্ছল সুন্দর সন্ধ্যা পার করে মাত্রই বাড়ির গলিতে প্রবেশ করলো ওরা।
প্রত্যয় মনোযোগী ভঙ্গিতে ড্রাইভ করছে, আর অনু কেনাকাটার লিস্ট গুলো আরও একবার মিলিয়ে নিচ্ছে।
আজমেরী শেখ অসুস্থ মানুষ, তারউপর কোম্পানির চেয়ার ওয়েম্যান। এতোকিছু সামলানোর পর কেনাকাটা কিংবা বাড়তি ঝামেলার চাপ মায়ের উপর পরুক সেটা মোটেই চায়না অনু। ওই জন্যই আজ নিজের বিয়ের শপিং এ নিজেরই আসতে হলো ওকে।
এছাড়া ক্রীতিকের বন্ধুরাও সবাই যথেষ্ট দ্বায়িত্ব পালন করেছে, দ্বায়িত্ব নিয়ে অনু আর প্রত্যয়ের বিয়ের জন্য সকল কেনাকাটা তারাই করেছে।
এমনকি বাড়ির পুরাতন কেয়ারটেকার মোখলেস চাচাকে পর্যন্ত নিয়ে এসেছে যাতে টুকিটাকি কোনোকিছু বাদ না পরে। এসবের পেছনে অবশ্য এলিসার অবদান সর্বাগ্রে। মেয়েটা আসলেই সর্বদিকে পটু। কি না জানে সে?
ক্যারাটে, বক্সিন, মেকআপ, পকার প্লে,রান্নাবান্না, ঘর গোছানো,অর্ণবের প্রফেশনাল কাজে সাহায্য করা, এখন আবার কর্পোরেট সেক্টরে চাকরির জন্য এপ্লাই করছে, হয়তো কনফার্ম হয়েও যাবে খুব শীঘ্রই।
এতো গুণ সম্পন্ন মেয়ে এলিসাকে বিশ্লেষণ করলে এককথায় কি বলা যায়? অনু একটু ভাবে, পরক্ষনেই মনেমনে আওরায়,
—- মেইবি, মিস্টার পার্ফেক্টের ফিমেল ভার্ষনই হলো এলিসা।
—- এসে পরেছি।
প্রত্যয়ের কথায় ভাবনার সুতো ছিঁ’ড়লো অনুর। ও চোখ উঁচিয়ে দেখলো গাড়িটা ক্রীতিক কুঞ্জের সামনে দাড়িয়ে।
প্রত্যয় অনুর দিকে তাকিয়ে বললো,
—- পেছনের ব্যাগ গুলো মোখলেস চাচা নিয়ে যাবে, তুমি একাই চলে যাও।
প্রত্যয়ের কথায় হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে সহসা নেমে গিয়ে বাড়ির দিকে হাটা দিলো অনু, ঠিক তখনই পিছু ডেকে প্রত্যয় বলে,
—- এই যে বউ!
নতুন সম্মোধন, সেই সাথে চমকপ্রদ শিহরণ, অনু থমকালো, অতঃপর ঘাড় ঘুরিয়ে প্রত্যয়কে শুধালো,
—- কিছু বলবেন?
প্রত্যয় হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে একটা দুই বাই দুই ইঞ্চি সাইজের চৌকো বক্স অনুর দিকে এগিয়ে দিলো। জিনিস টা কি বুঝতে না পেরে অনু ইতস্তত বোধ করে বললো,
—- কি আছে এতে?
প্রত্যয় অনুর হাতে বক্সটা ধরিয়ে দিয়ে বললো,
—- তোমার স্বপ্ন, তবে এটা এখন খোলা যাবেনা, আমাদের বিয়ের পরে খুলবে। এখন এটাকে নিয়ে সুন্দর করে আলমারিতে তুলে রাখবে, সাবধান ভুলেও যাতে হারিয়ে না যায়।
প্রত্যয় এমন ভাবে স’তর্কবানী প্রয়োগ করেছে যে নিজের কৌতুহল দমাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে অনুর। দুষ্ট মনটা বারবার লাফিয়ে উঠে বলছে,
—এক্ষুনি খুলে ফেল, দেখে নে এইটুকুনি বক্সের ভেতর কি এমন স্বপ্ন জমা রেখেছে প্রত্যয়?
পরক্ষনেই ভদ্র সভ্য,সংযমি মনটা হাত গুটিয়ে বলে ওঠে,
—- মোটেই না, উনি যেহেতু বলেছেন বিয়ের পরে খুলতে, তাহলে সেটাই হবে, এই ক’দিনের জন্য সানন্দে ধৈর্য ধরবো আমি।
অনু বক্সের উপরিভাগ হাতদিয়ে স্পর্শ করতে করতেই অন্দর মহলে প্রবেশ করে, পুরোপুরি মনোযোগ ওই ছোট্ট বক্সের দিকে নিবদ্ধ থাকায়, সামনে এগোতে গিয়ে হুট করেই কারও শক্ত বাহুতে ধা’ক্কা খেয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেলো অনু।
ধা’ক্কার জোরটা বেশ ভালোই ছিল,এমতাবস্থায় প্রচন্ত ব্যথায় চোখ খিঁচিয়ে সামনে দৃষ্টিপাত করলো অনু, দেখলো ওর থেকে কয়েক সেন্টিমিটার দূরত্বে দাঁড়িয়ে রা’গে ফুঁসছে রেজা। রেজা কি তাহলে হসপিটাল থেকে বাড়িতে না গিয়ে, সোজা ক্রীতিক কুঞ্জে ফিরলো? কিন্তু কেন?
এ বাড়ির ছোট সাহেবের হাতে মা’র খেয়ে আবার এই বাড়িতেই ফিরেছে বিষয়টা বোধগম্য হতেই বিস্ময় জড়িত কন্ঠে অনু বলে ওঠে,
—- রেজা ভাই আপনি?
রেজা কাঠকাঠ গলায় জবাব দিলো তৎক্ষনাৎ,
—- তোমার সৎ ভাই আমাদের তোমার বিয়ে খেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে অনু। যে অনুকে সেই ছোট্ট বেলা থেকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখে এসেছি সেই অনুর বিয়ে খেতে। ভাবতে পারছো?
অনুর মুখ চুপসে গেলো, কিছুটা শান্ত গলায় বললো,
—- দেখুন রেজা ভাই, আপনাকে ভাই ব্যতিত অন্য কোনো নজরে কখনোই দেখিনি, না আপনার সাথে আমার কোনোকালে সহজ কথোপকথন হয়েছে। তাহলে স্বপ্নটা দেখলেন কোথা থেকে? আর বাকি রইলো বিয়ের কথা? ওটা আপনার মা’ই সারাজীবন আপনার মস্তিষ্কে ব্যা’ক্টেরিয়ার মতো প্রয়োগ করেছে। যার ফলরূপ আপনি আমাকে নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখে এসেছেন।
অনুর শান্ত গলায় করা তি’রস্কারে রেজার কপালে ক্রুর ভাঁজ প্রতিস্থাপিত হলো, ও রুষ্ট কন্ঠে বললো,
— জায়ান ক্রীতিকের আশকারায় এতো কিছু বলছো তো? আজকে দেখো জায়ান ক্রীতিকের কি হাল হয়, সাথে অবশ্য তোমার বোনটাও ফাঁ’সবে, কাল সকালের মধ্যে জায়ান ক্রীতিকের মান সম্মান যদি আমি ধুলোয় মিশিয়ে না দিয়েছি তবে আমার নাম ও রেজা নয়।
রেজার কথায় অনু আ’তঙ্কিত হলোনা, উল্টে গলার জো’র বাড়িয়ে বললো,
—- প্রথমত আমার মা এই বিয়েতে মত না দিলে, অন্য কারও আশকারায় আমার কিছু যায় আসতো না রেজা ভাই। আপনার ফুপিই সরাসরি বিয়েটা দিচ্ছেন,তাই আশকারা তো একটু পাবোই বলুন? আর জায়ান ক্রীতিকের সম্মানের কথা বলছেন? সেতো সমাজেরই পরোয়া করেনা, সম্মান তো দূরছাই। উল্টে তার পেছনে কলকাঠি নেড়ে আপনি কতোটা সেফ থাকবেন সেটা নিয়েই আমি আপাতত দুশ্চিন্তা গ্রস্থ।
রেজা অনুর দিকে দু কদম এগিয়ে এসে একটা তাচ্ছ্যিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
— আমার হাত ঠিক কতোটা লম্বা, তা তো তুমি কল্পনাও করতে পারবে না অনু, তোমাকে আমি দেখে নেবো… কাল প্রেসের লোকেরা এসে যখন বাড়ি ভর্তি করে ফেলবে একই প্রশ্নে মাথা খারাপ করে দেবে যে,
—- আজমেরী শেখ আদতে কোন সার্থ হাসিলের জন্য নিজেরই সৎ ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিলেন, নিজের স্বামীর পদবী নিজের মেয়ের গায়েও এঁটে দিলেন, তখন দেখবো তোমার ওপেন হা’র্ট সা’র্জারী ফেরত মা, আর তোমার বিয়ে, দুটোরই কি হাল হয়?
দেখা যাবে মান সম্মানের ভয়ে তোমার বিলেত ফেরত স্বামী আর তার পরিবার বিয়েটাই ভে’ঙে দিলো। তখন তোমার মা মান সম্মান বাঁচাতে আবারও আমার মায়ের হাত পা ধরে তোমাকে আমার ঘাড়ে গছিয়ে দিতে উদ্যত হবেন। মার্ক মাই ওয়ার্ড অনন্যা শেখ।
রেজার এতোগুলা কথায় থমথমে হয়ে গেলো অনুর চোয়াল, রাগে র’ক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে ওর সমগ্র মুখশ্রী, এক্ষুনি রেজার গালে চ’ড় না বসালে খুব বড় অ’ন্যায় হয়ে যাবে, সেই অ’ন্যায়ের ভাগিদার হতে চায়না অনু, যার ফলস্বরূপ কয়েক পা সামনে এগিয়ে গিয়ে ক্ষ্যা’পাটে বাঘিনীর মতো রেজার গালে শ’ক্ত চ’পেটাঘা’ত বসাতে উদ্যত হলো অনু।
তবে চ’ড় টা আর বসাতে পারলো না, তার আগেই শি’কার ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ঝড়ের বেগে অনুর সামনে থেকে রেজার কলার ধরে ওকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো ক্রীতিক।
অনু ভড়কালো, মাথার মধ্যে টগবগিয়ে বেড়ে ওঠা ক্রো’ধটা মূহুর্তেই বিস্ময়ে পরিনত হলো, ও ঘাড় ঘুরিয়ে সাইডে তাকাতেই দেখতে পেলো, রেজাকে মেঝেতে ফে’লে ওর বুকের উপর হাটু গেড়ে বসে এলোপাথারি ঘু’ষি দিয়ে যাচ্ছে ক্রীতিক। ক্রো’ধান্বিত প্রতিটি ঘু”ষি আঁচড়ে পরছে রেজার চোখে মুখে।
এভাবে ক্রমাগত এলোপাথারি মা’রের তোপে একদন্ড শ্বাস ফেলছে পারছে না রেজা, অথচ ক্রীতিক থামার নামই নিচ্ছে না, উল্টে মা’রের সাথে সাথে চোয়াল শক্ত করে অ’স্রাব্য গা’লিতে পিষ্ট করছে রেজাকে।
ক্রীতিকের কর্মকান্ডে একটা শুষ্ক ঢোক গিলে ভয়ার্ত চোখে অরুর দিকে চাইলো অনু, দেখলো অরুর একহাতে হাতে গজের ব্যন্ডেজ প্যাঁচানো অন্য হাতে ডোরার বাস্কেট। ও নিজেও ক্রীতিকের এমন রা’গ দেখে থরথরিয়ে কাঁপছে।
কিন্তু এখন তো কাঁপাকাপির সময় নয়, ক্রীতিককে থামাতে হবে নয়তো রেজাকে আজ মে’রেই ফেলবে লোকটা, ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই, অরু ছুটে গিয়ে ক্রীতিকের হাত টেনে ধরলো, তবুও থামছে না ক্রীতিক, অরু পারছে না ক্রীতিকের পুরুষালী শক্তির সাথে কুলিয়ে উঠতে, তাও জো’র জব’রদস্তি করে কোনোমতে রেজার বুকের উপর থেকে সরিয়ে দাড় করালো ওকে।তবুও হিং’স্র সিংহের ন্যায় গর্জন করতে করতে রেজাকে পা দিয়ে ক্রমাগত আ’ঘাত করে যাচ্ছে ক্রীতিক। ওর র’ক্তিম চোখ, আর তীব্র ক্রো’ধ দেখে মনে হচ্ছে ও আজ রেজাকে মে’রেই ফেলবে।
হলরুমে হঠাৎ এতো চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে দোতলার করিডোর দিয়ে উঁকি দিলো সায়র, অর্ণব আর এলিসাও। ক্রীতিককে হঠাৎ করে এমন রে’গে যেতে দেখে ওরাও হতবাক, কি এমন হলো হুট করে? সন্ধ্যা বেলাতেও তো সব ঠিক ঠাকই ছিল। বেশ শান্ত সাবলীল ছিল ক্রীতিক।
ক্রীতিকের গর্জন শুনে আজমেরী শেখ আর জাহানারা ও অন্য দিক থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন, সবাই নিরব দর্শক, কেউ ক্রীতিকের রা’গের কারণ ধরতে পারছে না, শুধু মাত্র জাহানারা বেগম সিঁড়ি ভেঙে ছুটে নিচে নেমে এলেন, তিনি কা’ন্না জড়িত কন্ঠে একপ্রকার কাকুতি মিনতি করেই অরুকে বলতে লাগলেন,
— ও অরু, দয়াকরে থামা তোর স্বামীকে, আমার ছেলেটাকে মে’রে ফেললো তো।
অনু জানেনা কি হয়েছে, কেনই বা ক্রীতিক এতো ক্ষে’পেছে, তবুও খারাপ কিছু যে ঘটেছে সেটা অরুর ব্যান্ডেজ করা হাত দেখেই আঁচ করতে পারছে ও, কিন্তু এখন ক্রীতিককে থামানোটা জরুরি, নয়তো রেজার খুব খারাপ পরিনতি হবে, তাই অনু নিজেও উদ্বিগ্ন স্বরে অরুকে বললো,
—- ক্রীতিক ভাইয়াকে আটকা অরু, রেজা ভাইয়ের না’ক মুখ দিয়ে র’ক্ত বেরোচ্ছে ম’রে যাবে তো।
আপার কথা কর্ণকূহরে পৌঁছালে অরু এক প্রকার হন্যে হয়ে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ক্রীতিক কে। পর মূহুর্তেই ওর মনে পরে গেলো ক্রীতিকের বলা তখনকার কথাগুলো,
—- বারবার বল হার্টবিট, তোর মুখে তুমি ডাক শুনলে পা’গল হয়ে যাই আমি। যখন আমি খুব রে’গে যাবো, তখন তুই এই ট্রিকস টা প্রয়োগ করতে পারিস । আমি শান্ত হয়ে যাবো, প্রমিস।
অরু এবার তাই করলো, সবার সামনেই দু-হাতে পেছন থেকে শক্ত করে ক্রীতিককে জড়িয়ে ধরে বললো,
—- প্লিজ থামো, একটু শান্ত হও, আর না। দয়া করে আর মে’রোনা, ম’রে যাবেতো।
অরুর ট্রিকস বোধ হয় কাজে লাগলো, ক্রীতিক তার কথা রেখেছে, অরুর করা তুমি সম্মোধনে মূহুর্তেই মস্তিষ্কে জ্বলতে থাকা বি’ধ্বংসী ক্রো’ধটাকে সামলে নিয়েছে ও।
পরমূহুর্তেই নিজের মেদহীন এ্যাবসে শক্ত করে জড়িয়ে রাখা অরুর ব্যান্ডেজ করা হাতটাতে নজর দিয়ে, বাঁজপাখির মতো তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করলো, মু’মূর্ষু রেজার দিকে, সেভাবেই তাকিয়ে থেকে ধা’রালো আওয়াজে বললো,
—- বা’স্টা’র্ড, আমার মতো অভদ্রের পেছনে লাগতে এসে মোটেই ঠিক কাজ করিস নি তুই, আজকে ইন্ট্রো দিলাম খুব শীঘ্রই তোর খেল খতম করবো আমি। সময় হলে টের পাবি জায়ান ক্রীতিক আদতে কতটা জ’ঘন্য আর ট’ক্সিক।
অরু আবারও হাঁপাতে হাঁপাতে চোখ বন্ধ রেখেই রিনরিনে আওয়াজে বললো,
—- প্লিজ শান্ত হও একটু, প্লিইইজ।
ক্রীতিক অরুর ব্যন্ডেজ করা হাতে আলতো স্পর্শ করে ঘাড় ঘুরিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে,
—- এতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছিস, হাতে ব্যথা করছে না?
অনিমেষ কথাগুলো কানে ভেসে আসতেই অরু পুরোপুরি বাঁধন হারা করে দিলো ক্রীতিককে, ওকে ছেড়ে দিতেই চারিদিকের বিস্মিত হতবাক কয়েক জোড়া চোখ দেখে, লজ্জিত হয়ে দ্রুত মাথা নিচু করে নিলো অরু।
আজমেরী শেখ করিডোরের কার্নিশে হাত রেখে এতোক্ষণ জীবন্ত পুতুলের মতোন দাঁড়িয়ে ছিলেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে যাওয়া ছাড়া তার আর কিছু করার নেই এই মূহুর্তে। অরুকে নিজের বশে এনে ক্রীতিক অদৃশ্য শেকলে বে’ধে ফেলছে আজমেরী শেখের হাত, পা। তারউপর বাড়িটা ক্রীতিকের, এখন তিনি চাইলেও চুপচাপ নিরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করতে পারছেন না।
—– রিডিকিউলাস।
ক্রীতিক থেমে যাওয়ার এক পর্যায়ে, চোখে চশমা এটে গটগটিয়ে রুমে যেতে যেতে, দাঁতে দাঁত পিষে বিড়বিড়ালেন আজমেরী শেখ।
***********************************************
ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে, একটা সিল্কের পাজামা গায়ে চড়িয়ে,সতর্ক হাতে ডোরাকে কোলে নিয়ে মাত্রই বিছানায় বসেছে অরু।
মাঝরাত তখন শেষ রাতে গিয়ে ঠেকেছে, আরেকটু পরে হয়তো ফজরের আজান হবে। অথচ বাড়ির সবাই মাত্র কিছুক্ষণ হলো যে যার রুমে ঢুকেছে, ক্রীতিকের সাথে সায়র অর্ণব ও ওর রুমে। এতো রাতে কি নিয়ে কথা বলছে তারা, কে জানে?
আগের রাতের সব ঘটনা ভুলে গিয়ে অরু যখন ডোরাকে আদর করায় মন দিয়েছে, ঠিক তখনই ওর রুমে কড়া নারে অনু। দরজা খোলাই ছিল, তবুও অরু কিছুটা গলা উঁচিয়ে বললো,
—- দরজা খোলাই আছে।
অনু রুমে ঢুকলো, তবে এগিয়ে গিয়ে বসে কথা বলার অপেক্ষা করলো না,বরং অরুর দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
—- হ্যারে অরু, কি হয়েছে বলতো?
ক্রীতিক ভাইয়া হঠাৎ করে রেজা ভাইকে এভাবে মা’রলো কেন?
তারউপর তোর হাতে ব্যান্ডেজ, তোকেও মা’রেনি তো?
অনুর কথায় অরু নিজের হাতের দিকে তাকালো, হাতের কব্জিটা ঘুরিয়ে ব্যান্ডেজ করা, নিজের হাতটা ভালো মতো পরখ করে, অরু নরম স্বরে বললো,
— রেজা ভাই ঠিক আছে?
অনু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
—- ক্লিনিক থেকে প্রাইমারী ট্রিটমেন্ট নিয়ে, মামী সহ তাদের বাড়িতে চলে গিয়েছে।
— ওহ, ভালো।
অরুকে কেমন উদাসীন লাগছে, তাই অনু আবারও আগ বাড়িয়ে বললো,
—- কি হয়েছে বললি নাতো?
অনুর কথায়, অরুও ভাবনায় পরে গেলো, মনেমনে ভাবতে লাগলো তখনকার ঘটনা, একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জের ধরে মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে কতটা দূ’র্বিষহ আর আ’তঙ্কিত হয়ে উঠেছিল ওদের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ মূহুর্তটা। আর সবচেয়ে বড় কথা সেই পুরো ঘটনার পেছনে ছিল ওরই মামাতো ভাই রেজা। এখনো সেসব কথা ভাবতে গেলে, রেজার উপর মেজাজ চড়ে ওঠে অরুর।
মাঝরাতে শুনশান নিস্তব্ধতার মাঝে, নিরিবিলি রাস্তায় ক্রীতিক যখন শুধুই অরুর হৃদস্পন্দন বাড়ানোর পায়তারা করছিল, ক্রমশ নিজের ঠোঁটের খেলায় অরুকে মাতিয়ে তুলছিল,ঠিক সেসময় খুব কাছ থেকে অযাচিত কিছু হিসহিসানির আওয়াজ কানে বিট করতেই অকস্মাৎ গতি হারায় তীব্র গভীরতর চুম্বন।
ক্রীতিক তরিৎ গতিতে চোখ খুলে দেখতে পায়, রাস্তার অপর পাশের বন্ধ টং দোকানের আড়ালে দাঁড়িয়ে সুক্ষ্ম হাতে গো’পন ক্যা’মেরায় ওদের একান্ত মূহুর্তগুলো ভিডিও করছে কেউ।
এহেন অবস্থায় ক্রীতিক কোনোরূপ উচ্চবাচ্য করলো না, উল্টো অরুকে ছেড়ে দিয়ে শান্ত স্বরে বললো,
— আমি আসছি বেইবি, তুই বস।
কথাটা শেষ করে টি-শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে রাস্তার ওপাশে গিয়ে, এক টাকে কলার ধরে টেনে বের করলো ক্রীতিক। তারপর শুরু করলো একের পর শক্ত হাতের থা’প্পড় দেওয়া।
এভাবে হঠাৎ করে মাঝরাস্তায় ক্যামেরা হাতে লোকটাকে দেখতে পেয়ে ভয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো অরুর। তার উপর এমন একটা খোলামেলা যায়গায় বসে ক্রীতিক লোকটাকে বেধ’ড়ক মা’রছে।
আচ্ছা, লোকটা যদি প্রেসের কেউ হয়? কিংবা কোনো গ্যাং এর সদস্য হয় তখন? তখন তো বেশ ঝামেলায় পরে যাবে ক্রীতিক। তার চেয়েও বড় কথা,এখানে যে একজনই আছে তার নিশ্চয়তা কোথায়? এক্ষুনি যদি অন্ধকার ছাপিয়ে আরও কয়েকজন চারপাশ থেকে বেরিয়ে আসে?
তখন তো ক্রীতিক একা তাদের সাথে পারবে না।
এলোমেলো চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে অরুর, অথচ ক্রীতিক থামছেই না, প্রথমে ওর হাতের ক্যামেরাটাকে আ’ছাড় মে’রে গুড়িয়ে ফেলেছে। অতঃপর ক্রমাগত ওর চো’য়াল বরাবর পা’ঞ্চ বসাতে বসাতে বলছে,
— জা’নো’য়ার, কিসের ভিডিও করছিলি,বল কে পাঠিয়েছে? সাফ সাফ বল নয়তো আজ রাতই তোর জীবনের শেষ, দিনের আলো আর দেখতে পাবিনা। তার গ্যারান্টি সয়ং আমি।
কথা শেষ করে আবারও লোকটাকে মা’রতে উদ্যত হলে,লোকটা কোনো মতে নিঃশ্বাস ধরে রেখে হাপিত্যেশ করে কাঁদতে কাঁদতে দু’হাত জোর করে বললো,
—- বলছি! ঢাকা দক্ষিণ ছাত্রলীগের সহ সভাপতি রেজা ভাই আমাদের কল করেছিল, বলেছিল তরতাজা নিউজ আছে, জেকে গ্রুপের নতুন এম ডি নাকি তার আপন সৎ বোনের সাথে অ’ন্তরঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তার কথা বিশ্বাস করে টি আর পি বাড়ানোর আশায় সেই সন্ধ্যা থেকে আপনাকে স্ট’ক করছিলাম আমরা। আআসলে আমরা মিডিয়া থেকে এসেছি ।
ক্রীতিক নতুন উদ্যমে লোকটাকে মা’রতে মা’রতে বললো,
—- হা’রামজাদা, ব’দমাশ, আমি আমার বউকে চুমু খাই কি তোদের টিআরপি বাড়ানোর জন্য?
জিদের বসে লোকটাকে মা’রতে গিয়ে ক্রীতিকের একটা কথা মাথা থেকেই বেরিয়ে যায়,লোকটা বলেছিল আমরা আপনাকে স্টক করছি, তারমানে ওরা একজন নয়।
কিন্তু হঠাৎ করেই যখন পেছন থেকে অরুর আচমকা চিৎকার ভেসে এলো কানে,তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে চাইলো ক্রীতিক।দেখলো অরু থরথরিয়ে কাঁপছে, সেই সাথে ওর কব্জি বেয়ে গড়িয়ে পরছে অনর্গল র’ক্তধারা ।
অরুর পেছনে ক্যামেরার একটা ভাঙা অংশ নিয়ে দাড়িয়ে আছে আরেকটা লোক। লোকটার গতিবিধি দেখে মনে হচ্ছে ও শীঘ্রই অরুকে আবারও আ’ঘাত করবে, তবে তার আর ফুরসত দিলোনা ক্রীতিক, ছুটে গিয়ে ক্যামেরার ধা’রালো টুকরোটা ছিনিয়ে নিয়ে লোকটাকেই কয়েক ঘা বসিয়ে দিলো ও।
লোকটার বাহুতে মে’রে, ক্রীতিক যখন ওর গলায় আ’ঘাত করবে, ঠিক সেই মূহুর্তে কাঁপা হাতে ওর হাতটা টেনে ধরে, না সূচক মাথা নাড়ালো অরু।
অরু সেই তখন থেকে ভয়ের তোপে থরথরিয়ে কাঁপছে দেখে, ক্রীতিক সব ফেলে দু’হাত দিয়ে আগলে ধরলো অরুকে। ওর মাথাটা শক্ত করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে ক্রীতিক ভয়ার্ত গলায় বললো,
—- জানবাচ্চা, হার্টবিট, আর ইউ ওকে না?
অরু কাঁপতে কাঁপতে ক্রীতিকের টি-শার্টে ভেজা চোখ নাক মুছতে মুছতে বললো,
— ভ’য় করছে, আপনি এখানেই থাকুন। কোথায় যাবেন না।
ক্রীতিক একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
—- কোথাও যাবো না আমি, ব্যাগ থেকে আমার ফোনটা দে, ট্রিপল নাইনে কল করতে হবে।
অরু বললো,
—- আমি আপনার ফোন থেকে করে দিয়েছি কল।
অরুর কথায় সস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে ওর কপালে শব্দ করে চুমু খেলো ক্রীতিক, তারপর ওর হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
— দেখি হাতটা?
কাহিনীর এই পর্যায়ে এসে থামলো অরু। এতোক্ষন যাবত অরুর কথা শুনে অনুও দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, আলগোছে কানের পেছনে লম্বা চুল গুলো গুঁজে দিয়ে শুধালো,
—– তারপর কি পুলিশ কে’ইস হলো?
অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে, বললো,
— হ্যা, তখনই আমাদের থানায় যেতে হয়েছে, ওনারা জায়ান ক্রীতিকের হাত পা ধরে নিজেদের কর্মের জন্য ক্ষমা চাইলেও, প্রেসের লোকদের গায়ে হাত তোলার ফলস্বরূপ ওনাকে অনেকগুলো টাকা জ’রিমানা দিতে হয়েছে।
অনু আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, কেন যেন এতো ঝামেলার জন্য কোথাও একটা নিজেকেই অ’পরাধী মনে হচ্ছে ওর। মনেমনে ভাবলো,
—- সবকিছুর মূলে হয়তোবা আমিই ছিলাম।আজ আমার বিয়েটা অন্য কোথাও হচ্ছে বলেই রেজা ভাই সবার উপর এতোটা ক্ষে’পেছে। বিয়ে হতে হতে আরও যে কি কি ঝামেলা পাঁকাবে তা কেবল উপর ওয়ালাই জানে।
***********************************************
—- আস্তে ভাই আস্তে, সামলে, আরে আরে ওদিকে না এদিকে।
অর্ণবের ডিরেকশনে কান ঝালাপালা হয়ে গেলো সায়রের, ও এবার না পেরে বিরক্ত হয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলেই উঠলো,
—- বাইক টা কি তুই চালাচ্ছিস না আমি?
অর্ণব পেছনে বসা অবস্থায় সামনে মুখ বাড়িয়ে কটমটিয়ে বললো,
—- জীবনে প্রথমবার লাইসে’ন্স ছাড়া বাইক চালাতে এসেছিস, তাও আবার এমন রেসিং বাইক। তাই তোকে ডিরেকশন দিচ্ছি, বেশি কথা না বলে চুপচাপ মন দিয়ে শোন, নয়তো বিয়ের আগেই তোর বউ বিধবা হবে, সাথে আমারটাও।
সায়র কাঁপা কাঁপা হাতে বাইকের ব্রেক সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, তবুও দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে সামনে মনোযোগ নিবেশ করে বললো,
— মানুষ মন দিয়ে নয়, কান দিয়ে শোনে হাঁদারাম। তাছাড়া, এমন ভাব দেখাচ্ছিস যেন তুই রাইডিং এ খুব এক্সপার্ট, আয় তাহলে চালা একটু।
—– বিয়ের আগে বিধবা হওয়ার শখ নেই আমার, তোর এতো শখ জাগলো কেন কে জানে? জাগলো তো জাগলো আবার আমাকে সাথে করে নিয়ে ম’রার শখ জাগলো, কি আশ্চর্য শখ!
অর্ণবের কথার পাছে সায়রের কথা বলার ফুরসত নেই, ও আপাতত বাইকের ব্রেক সামলাতে ব্যস্ত। তবুও ক্ষনে ক্ষনে এদিক ওদিক ঘুরে যাচ্ছে ব্রেক।যার দরুন বাইকটাও হেলে দুলে উঠছে ক্রমশ।
বাইক যখনই হেলেদুলে উঠছে, অর্ণব তখনই বুকে মাথায় ক্রুশ একে বারবার ঈশ্বরকে ডাকছে। ওর হা-হুতাশে বিরক্ত হয়ে সায়র ধমকে উঠে বললো,
—- চুপ করবি? বাসায় গিয়ে ঈশ্বরকে ডাকিস, আগে আমাকে ডিরেকশন দে।
অর্ণব বলে,
—- যাচ্ছিটা কোথায় সেটা তো আগে বল?
—- আমার না হওয়া শশুর বাড়ি, ভেবেছি বিয়েটা বাংলাদেশেই করবো বুঝলি।
অর্ণব হতবিহ্বল কন্ঠে বললো,
—- এই পুরান ঢাকার চিপা গলিতে তুই শশুর বাড়ি কোথায় খুজে পেলি?
সায়র দুষ্ট হেসে বললো,
—- চিরুনি তল্লাশি করে পেয়েছি, চল তোকে দেখাবো।
কথা শেষ করে সায়র বাইকে টান দিতেই, আবারও ঈশ্বর নাম জপতে জপতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেললো অর্ণব।
আজ ক্রীতিক অফিস জয়েন করেছে, সেই সুযোগে গোধূলি বিকেলে ক্রীতিকের বাইক নিয়ে সায়রের না হওয়া শশুর বাড়ি খুজতে বেরিয়েছি ওরা দুজন। কিন্তু এই গাদানো সারিসারি ছোট বড় শ্যাওলা পরা বিল্ডিং এর মাঝে আদতে সায়রের না হওয়া শশুর বাড়ি যে কোনটা সেটাই বুঝতে পারছে না ওরা।
বাইক থামিয়ে দু’জন মিলে যখন এদিক ওদিক সুক্ষ্ম নজরে পরখ করছিল, ঠিক তখনই সায়রের দৃষ্টিগত হলো এক অপার্থিব দৃশ্যপট, ওদের থেকে কয়েক মিটার দূরত্বে যে পুরাতন কংক্রিটের দোতলা বিল্ডিংটা মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার ছাঁদেই ত্রীভঙ্গ আকারে নাচের তালিম নিচ্ছে সদ্য যৌবনে পা রাখা এক অষ্টাদশী রমনী। পরনে তার কুচকুচে কালো চুরিদার,পায়ে ঘুঙুর, ওড়নাটা কাঁধ ছাড়িয়ে কোমড়ের কাছে বাঁধা। কাঁধ অবধি রিভন্ডিং করা সিল্কি চুল গুলো পাঞ্চ ক্লিপে বাঁধা পরেছে। চেহারা স্পষ্ট নয়, তবুও গোধূলির আভায় নৃত্যরত মেয়েটাকে মায়াবী অপ্সরীর মতোই স্নিগ্ধ লাগছে। আর সায়র? সে তো সেই তখন থেকেই হা করে তাকিয়ে দেখছে,তার গোধূলি বেলার অপ্সরীটাকে। অপ্সরীর অস্পষ্ট মুখশ্রী দেখেও সায়র চোখ বন্ধ করে বলতে পারে এটাই তার রাগীনি ।
***********************************************
গ্রীষ্মের ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে পু’ড়তে থাকা জনমানকে একটু খানি সস্থি দিতে সন্ধ্যা নেমেছে ধরনীতে। বাইরের উষ্ণ বাতাস এতোক্ষণে হিমেল হাওয়ায় পরিনত হয়েছে। চারিদিক এখন বেশ শীতল। শুধু মাত্র শীতল নয় ক্রীতিকের মস্তিষ্ক।
ওর মাথাটা গরম হয়ে আছে, সারাদিন অফিস শেষে যখন বাড়িতে ঢুকে অরুকে না পেলো, তখনই মেজাজ বিগড়ে গিয়েছে ক্রীতিকের, বিগড়ানোর মেজাজের অ’গ্নিস্ফুলিঙ্গতে আরও খানিকটা জোয়ার দিতে অরুর মামি এসে জানায়, তাকে বাড়িতে রেখে আজমেরী শেখ তার দুই মেয়েকে নিয়ে অমিতকে দেখতে হসপিটালে গিয়েছেন, সদ্য হওয়া আত্নীয়তার সম্পর্কে আরও খানিকটা শখ্যতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে।
সেই কথা শোনার পরে আর এক দন্ডও অপেক্ষা করেনি ক্রীতিক, গটগটিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে বাড়ি থেকে। আর এখন হসপিটালের করিডোর ধরে বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে অমিতের কেভিনের দিকে। ক্লান্ত ঘামে ভেজা শরীর হাতরিয়ে টাইয়ের নট’টা ঢিলে করতে করতে মনেমনে ভাবছে,
অনেক হয়েছে আজ অরুকে একটা উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে ও।
ক্রীতিক যখন দু পকেটে হাত গুঁজে কেভিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, ঠিক তখনই অরুর সাথে চোখাচোখি হলো ওর। অরু ভেতরেই ছিল, হঠাৎ করে এভাবে ক্রীতিককে দেখতে পেয়ে তরিঘরি করে কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এলো ও।
অরু বাইরে বেরোনোর সাথে সাথে, ওর ব্যান্ডেজ করা হাতের কব্জিটা শক্ত করে চেপে ধরলো ক্রীতিক, অতঃপর রুষ্ট গলায় বললো,
—- চল।
অরু ক্রীতিকের সাথে তাল না মিলিয়ে উল্টো হাতে টান দিয়ে বললো,
—- আরেহ! কোথায় যাবো, মা আর আপা ভেতরে তো।
ক্রীতিক অ’গ্নিদৃষ্টিতে পেছনে তাকিয়ে বললো,
—- সো হোয়াট?
ক্রীতিকের এমন আ’গুন ঝড়া নিস্প্রভ চাহনি দেখে অরু বুঝলো ক্রীতিক রে’গে আছে, তাই খুব একটা কথা না বাড়িয়ে শুষ্ক ঢোক গিলে বললো,
—- না মানে, ওদেরকে অন্তত বলে তো আসি।
— দরকার নেই।
গমগমে আওয়াজে কথাটা বলে আবারও অরুকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটা দেয় ক্রীতিক। তবে কয়েক কদম এগিয়ে যাওয়ার পর পরই সামনে এসে দাড়ায় অমিতের বাবা মা।
অমিতের বাবা মা মুরব্বি মানুষ, তার উপর নতুন আত্মীয়, সে হিসেবে তাদের সম্মান প্রাপ্য। কিন্তু মাথা খারাপ ক্রীতিক সেসবের ধারে কাছেও গেলো, উল্টে চোখমুখে বিরক্তির ভাঁজ টেনে অমিতের বাবাকে বললো,
—- কি হয়েছে? সামনে দাড়ালেন যে?
অমিতের বাবা সহসা হেঁসে বললেন,
—- বাবা তুমি অনু অরুর ভাইয়া না?
ক্রীতিক একঝলক অরুর মুখের দিকে চাইলো, যে এই মূহুর্তে চোখ দিয়ে হাজারো কাকুতি মিনতি করছে, ক্রীতিক যাতে উল্টো পাল্টা কিছু না বলে।
ক্রীতিক চোখ সরিয়ে নেয়, তারপর অমিতের বাবার দিকে তাকিয়ে অনুভূতি হীন গলায় বলে,
—- হ্যা ভাইয়া, শুধুমাত্র অনুর ভাইয়া।
অমিতের বাবা এতো কিছু খেয়াল করলেন না, বরং হাসিমুখে বললেন,
—- তা বাবা তুমি কি বাসায় যাচ্ছো? আর অরুও কি তোমার সাথেই যাবে নাকি?
ক্রীতিক এবার গম্ভীর কন্ঠে বললো,
—- আমার বউ যেহেতু, আমার সাথেই তো যাবে, অন্য কারও সাথে নিশ্চয়ই নয়?ভালো থাকবেন আঙ্কেল আসছি।
বাক্য শেষ করে ক্রীতিক হাটা ধরলে, অমিতের মা পিছু ডেকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে,
—- এখানে কিছু খাবার দাবার আছে বাবা, অরু যেহেতু চলেই যাচ্ছে, তাহলে তোমরা বরং এটা নিয়েই যাও।
মেজাজের মাত্রা তাপমাত্রার মতোই ক্ষণে ক্ষণে বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রীতিকের, তবুও ভেতরের উ’গ্রতাকে সামলে রেখে, প্যাকেট হাতে নিয়ে, ক্রীতিক ছোট করে বললো,
— ঠিক আছে।
তারপর আর এক মূহুর্ত ও দাঁড়ালো না, অরুকে টা’নতে টা’নতে নিয়ে গেলো সবার দৃষ্টি সীমার আড়ালে।
***************************************
বাড়িতে এসে ক্রীতিক সবার আগে খাবারের প্যাকেটটা ছু’ড়ে মা’রলো মেঝেতে। সঙ্গে সঙ্গে পুরো হলরুমে ছড়িয়ে পরলো,ফলমূল সহ সুস্বাদু সব খাবার গুলো।
ক্রীতিক এভাবে খাবার ছু’ড়ে ফেলেছে দেখে এবার অরুর ও বেশ রা’গ হলো। ও তৎক্ষনাৎ নিজের হাতটা ঝাড়ি মে’রে ক্রীতিকের থেকে ছাড়িয়ে বললো,
—- লাগছে আমার ছাড়ুন।
ক্রীতিক দ্বিগুণ শক্তিতে আবারও চেপে ধরলো অরুর হাত, তারপর কাঠিন্য গলায় বললো,
— লাগলে লাগুক, লাগার জন্যই তো ধরেছি।
কেঁ’টে যাওয়া হাতটা এভাবে বারবার চেপে ধরাতে ব্যথায় টনটন করছে ওর, কিন্তু ব্যথার চেয়েও বেশি এই মূহুর্তে বিরক্ত লাগছে অরুর।
অ’সভ্যতা, বে’য়াদবির একটা সীমা থাকে,ক্রীতিক আজ সব সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে। শুধু শুধু সবার সামনে সিনক্রিয়েট করলো, আর এখন খাবার গুলো সব ফেলে দিলো। এলোমেলো খাবার গুলোর দিকে তাকিয়ে ঝাঁজিয়ে উঠলো অরুর মস্তিষ্ক, ও সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে ক্রীতিকের হাতটা আবারও ঝটকা মে’রে ছাড়িয়ে দিয়ে তেঁতো গলায় বললো,
—- আপনি একটা উ’ন্মাদ, সা’ইকো। সারাজীবন একা থেকে থেকে নিজে তো একরোখা, আর অসামাজিক হয়েছেনই এখন আবার আমাকেও আপনার মতো নি’র্দয় বানানোর পায়তারা করছেন।
ক্রীতিক অরুর পানে র’ক্তিম চাহনি নি’ক্ষেপ করে ওর চোয়াল টা দু আঙুলে শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
— কাকে কি বলছিস, বুঝে বলছিস? মেজাজ বিগড়ে আছে অরু, এক্ষুনি থাম নয়তো তোর শরীরে আজ মা’রের নয় অন্য কিছুর দা’গ বসাবো আমি।
অরু তেজ দেখিয়ে ক্রীতিকের হাত ছাড়িয়ে বললো,
—– যা বলেছি ঠিক বলেছি, কোনো স্বাভাবিক মানুষ এতোটা নি’র্দয় হতে পারে, আপনিই বলুন? আপনি যদি বদ্ধ উ’ন্মাদ নাই হবেন, তাহলে একটা অসুস্থ পা ভা’ঙা মানুষকে নিয়ে কিসের এতো সমস্যা আপনার?
একাতো যাইনি, মা আপার সাথে সম্মান রক্ষার্থে গিয়েছি। তারউপর মুরব্বি বয়জেষ্ঠদের ও যা খুশি তাই বলে এসেছেন, কেন?
—– আমার সামনে অমিতের হয়ে ওকালতি করা বন্ধ কর অরু, ভুলে যাসনা আমি তোর স্বামী, সেদিন আমার সামনে, আমার বাড়িতে অমিত তোর জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।ভুলে গিয়েছিস?আর তুই কিনা আজ ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে সেই অমিতকে দেখতে চলে গেলি? হাউ ফা’কিং ডেয়ার ইউ অরু!
ক্রীতিকের ক’ঠিন ধমকে এবার একটু গলা খাদে নামিয়ে অরু বললো,
—- আমি আগেও বলেছি মা আর আপার সাথে গিয়েছি। তাছাড়া অমিত ভাই ভালো একজন মানুষ, ওনার পরিবার কেন এসব বলেছে তা জানিনা, আমার জানা মতে উনি আমাকে বোনের নজরে দেখেন।
আসলে সমস্যাটা আপনার মধ্যে , একারোখা জীবন কাটাতে কাটাতে সমাজ, নিয়ম কানুন সবকিছু ভুলতে বসেছেন। হয়েছেন চড়ম অ’সভ্য।
অরু কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে পেছনে থেকে ওর ঘাড়টা চে’পে ধরে নিজের মুখের কাছে নিয়ে এলো ক্রীতিক,অতঃপর থমথমে ব্যথাতুর গলায় বললো,
—– ভুলে যাসনা আমার একরোখা হওয়ার পেছনে দায়ী কিন্তু একমাত্র তুই, তোর জন্যই এই বাড়ি, কাছের মানুষ, দলীয় পদ সব ছাড়তে হয়েছিল আমাকে। আর আজ তুই আমার দিকেই আঙুল তুললি, ইজন্ট ইট ফেইট?
আর কি যেন বললি,মা আর আপা রাইট? তোর কাছে যদি মা আর আপা এতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়, ওদের তুলনায় আমার অস্তিত্ব যদি এতোটাই ম্লান হয়, তবে চাইনা আমার তোকে।
কথাটা বলে অরুকে সজোরে ধা’ক্কা মে’রে ডিভানের উপর ফেলে দিলো ক্রীতিক।
তারপর আবারও কঠিন কিন্ত মসৃণ গলায় বললো,
—- আমি যেদিন পাশে না থাকবো সেদিন তুই বুঝবি পৃথিবীটা আদতে কতটা সা’র্থপর আর কতটা জ’ঘন্য। আমি তোকে ঠিক কিভাবে খারাপ দুনিয়া থেকে বুকে আগলে আড়াল করে রেখেছি, তখন তুই হারে হারে টের পাবি।
যদিও বা তখন তোর ক’ষ্ট দূর করার জন্য আমি আদৌও এক্সিস্ট করবো কিনা সন্দেহ ।
কিছু তিক্ত অথচ চরম সত্য কথা বলে, দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে যায় ক্রীতিক।
ক্রীতিকের শেষ কথাগুলো এবার আর অরুর মস্তিষ্কে নয়, হৃদয়ে গিয়ে লাগলো। আচমকা মনে হলো হৃদয়টাকে ন’খড় হাতে খামচে ধরেছে কেউ, ক্রীতিককে ছাড়া পৃথিবী এও সম্ভব? অরু ভাবতে পারেনা।
ভাবতে চায়ও না, নিজের করা প্রকট ভুলটাকে শুধরে নিতে তৎক্ষনাৎ ক্রীতিকের পেছন পেছন উঠে যায় সিঁড়ি ভে’ঙে। অতঃপর করিডোর পেরিয়ে সোজা ক্রীতিকের রুমে, কেবল মাত্র এই আশায় যে, ক্রীতিক হয়তো ওকে ক্ষমা করলেও করতে পারে,কিন্তু তেমন কিছুই হয়না। অরু রুমে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে, তীব্র গর্জনে,
—- জাস্ট গেট লস্ট।
বলে হাত ধরে অরুকে রুমের বাইরে ছুঁ’ড়ে মা’রে ক্রীতিক। তারপর ধাপ করে লাগিয়ে দেয় দরজাটা।
অরু কাঁদতে কাঁদতে দরজার বাইরেই হাঁটু ভে’ঙে বসে পরলো। কিছু তিক্ত সত্যি কথা যে মানুষের হৃদয়কে এই ভাবে নাড়িয়ে দিতে পারে, তা বোধ হয় কা”ন্নারত অরুকে না দেখলে বোঝা যেত না মোটেই। অরু কাঁদছে তখন থেকে, তা দেখে অরুর মামি জাহানারা এগিয়ে এসে কিছুটা পৈচাশিক হাসি দিয়ে বললো,
—– ঠিক হয়েছে একদম, টাকা হা’তানোর লোভে আরও বিয়ে কর বড়লোকের ছেলেকে। একদিন, দুদিন, তার পর ঠিকই মজা নিয়ে পথে ছেড়ে দেবে। মিলিয়ে নিস আমার কথা।
অরুর ক’ষ্টে মামির বোধ হয় বেশ আনন্দই হলো, তবে অরুর আপাতত সে সবে মন নেই। ও নিজের দু হাঁটুতে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়িবিড়ালো,
—- জায়ান ক্রীতিক তুমি কি জানো? তুমি সেই গু”প্তঘা’তক যে খু’ন করে একটা পরাসৈন্য তৈরী করার উদ্দেশ্যে, আর আমি হলাম সেই ধ’র্মা’ন্ধ যে ওই গু’প্তঘা’তকের ছু’রির ইশারাতে নাচি।
তুমি আমার জীবনে এমন এক ভালোবাসার গোলকধাঁধা, যার থেকে হাজার বছর ছুটলেও আর পরিত্রান নেই আমার। না নেই..
চলবে…….