সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁 #পর্বঃ৪৫ #লেখনীতে_suraiya_rafa

0
350

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ৪৫
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[ক,পি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য]

মস্ত বড় আলিশান বাড়িটা আজ ষাটের দশকের নামি-দামি রাজ প্রাসাদের মতোই জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে সেজে উঠেছে ।

এটাকে একঝলক দেখায় কে বলবে? যে এ বাড়িটাই গত কয়েক বছর যাবত মানব শূন্য হয়ে দিনাতিপাত করেছে। তখন অরু আর অনু ব্যতিত পুরো বাড়িটাই ছিল ভূতুড়ে বাড়ির ন্যায় শুনশান জনমানবহীন।

যদিও বা মামিরা আসতো কম বেশি, তবে সেটাও তাদের প্রয়োজনে। তাছাড়া মামিদের আগমন অরু অনুর নিকট সর্বদাই ছিল মোক্ষম আ’তঙ্কের কারণ। এক কথায় এরা আসার চেয়ে না আসাটাই ছিল বহুল কাম্য।

আজ বাড়িতে কোনো আ’তঙ্ক নেই। চারিদিকে খুশির ফোয়ারা বইছে। প্রত্যয় অনুর গায়ে হলুদের আয়োজন এ বাড়িতেই করা হয়েছে যার ফলসরূপ প্রত্যয়দের বাড়ির সবাইও এখানেই উপস্থিত। অমিতের আজ ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে তাই আসতে পারেনি, কাল হয়তো অমিতও আসবে।

স্টেজে মন মাতানো গানের তালে একে একে নাচ করছে নাচের দলের মেয়েরা। ভিআইপি অতিথি থেকে শুরু করে,সকলের মনোনিবেশ আপাতত স্টেজেই আটকে আছে।

হাত ভর্তি মেহেদী নিয়ে স্টেজে প্রত্যয়ের পাশেই বসে আছে অনু, চোখের সামনে মজার মজার খাবার, অথচ কিছুই খেতে পারছে না মেয়েটা, ওদিকে সকাল থেকে না খাওয়ার দরুন পেটটাও কেমন গুড়গুড়াচ্ছে ওর।

পেটে ক্ষুদা থাকলে সবকিছুই যেমন বিষাদে পরিপূর্ণ,ঠিক তেমনি অনুর কাছেও আপাতত এই নাচগান হৈ-হুল্লোড় সবকিছু জঘন্য রকম তেঁতো লাগছে, বড্ড তেঁতো ।
অথচ অরুটা এন্ট্রি সং এ কোমড় দুলিয়ে সেই যে তখন উধাও হলো আর খবর নেই। অনু তখন থেকে কেমন হাসফাস করছে, ওর পাশেই বসেছিল প্রত্যয়।

কোম্পানির বিভিন্ন কর্মকর্তা, কর্মচারীরা এসে এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে যাচ্ছে প্রত্যয়কে, কিন্তু অনুর তাতে কোনো আগ্রহ নেই, ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই প্রত্যয় অনুর কানের কাছে মুখ নিয়ে সামান্য নিচু স্বরে প্রশ্ন করলো,
—- কি হয়েছে তোমার? তখন থেকে খেয়াল করছি অন্য মনস্ক হয়ে আছো।

অনু বরাবরই পরিস্থিতি সামলানো দ্বায়িত্বশীলা বড় মেয়ে, নিজের বিয়েতে অতিথি সকলের খাওয়ার আগেই, নিজের ক্ষিদে পাওয়ার মতো লজ্জা জনক কথাটা কৌশলেই প্রত্যয়ের কাছ থেকে চেপে গেলো ও।সামান্য হাসার চেষ্টা করে মুখ ফুটে অস্পষ্ট আওয়াজে বললো,
—- কই,কিছু হয়নিতো।

কিন্তু প্রত্যয় তো এতোটাও বোকা, কিংবা দ্বায়িত্বজ্ঞান হীন ছেলে নয়। অনুকে সে যথেষ্ট ভালোভাবে চেনে। তাই অনু বলা সত্ত্বেও সবার মাঝে থেকে স্টেজ খালি করে অনুকে নিয়ে সরাসরি অন্দরমহলের ভেতরে চলে যায় প্রত্যয়। যাওয়ার আগে নিজের বড় আপুকে ডেকে বলে অনুর রুমে যাতে এক প্লেট কাচ্চি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
একটু পরেই ওরা আসছে, তখন না হয় হলুদ লাগানো যাবে।

***************************
রুমের ভেতরে প্রবেশ করে অনু ঠোঁট উল্টে বললো,
—- এতো মেহমানদের বসিয়ে রেখে আমাদের এভাবে চলে আসা কি ঠিক হলো?

প্রত্যয় হাত ধুয়ে এসে, পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে অনুর মুখে পোলাও এর লোকমা তুলে দিতে দিতে বললো,
—- যাবো তো,তার আগে খেয়ে নাও। নয়তো তোমার পেটের গুড়গুড় আওয়াজ আমি একা নই পুরো ক্রীতিক কুঞ্জ শুনে ফেলবে।

অনু খাবার চিবুতে চিবুতে নরম স্বরে বললো,
—– আপনি কিভাবে বুঝলেন আমার যে ক্ষিদে পেয়েছে?

প্রত্যয় অনুর চোখে অনিমেষ চেয়ে থেকে বললো,
—- আমি কিভাবে বুঝলাম সেটা ম্যাটার করেনা, ম্যাটার হলো সেদিন এতো করে বুঝানোর পরেও তুমি আমাকে কিছুই শেয়ার করছো না, নিজের ভেতরের কথা ভেতরেই আটকে রাখছো।
আচ্ছা অনু,একবারও ভেবে দেখেছো? আজ রাত পেরোলে কাল যে আমরা স্বামী স্ত্রী হয়ে যাবো। তুমি, আমি আমরা হয়ে যাবো।

তোমার সকল ভয়, লজ্জা আমি নির্দ্বিধায় হরণ করে নেবো? তোমার জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি হবো আমি, অথচ সেই আমার কাছেই তুমি ইজি হতে পারছো না এখনো।সামান্য ক্ষিদে পেয়েছে এই কথাটুকুও বলতে দ্বিধাবোধ করছো, কেন?

অনু প্রত্যয়কে মানানোর চেষ্টা করলো, কিঞ্চিৎ আদুরে গলায় বললো,
—- আমিতো ভেবেছি সবার সামনে ক্ষিদে পেয়েছে বলাটা ভালো দেখাবে না, এতো লোকজন কে কি ভাববে…

অনুর বাকি কথা জিহ্বাতেই আটকে রইলো, তার আগেই প্রত্যয় কিছুটা শক্ত গলায় বললো,
—–কতবার বলেছি আমার সামনে এতো ম্যাচিউরিটি, এতো দ্বায়িত্ববোধ দেখাতে হবে না, আমি আছিতো তোমাকে সামলানোর জন্যে, একটা প্রত্যয় আছে তো তোমাকে নিজের কাঁধে ঠায় দেওয়ার জন্য, তবুও কেন যে এতো ওভার থিংক করো কে জানে?

ওর কথা শুনে ফিক করে হেঁসে দিলো অনু, অতঃপর প্রত্যয়ের গলাটা মেহেদী শুকানো দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,
—– এতো আস্কারা দিচ্ছেন? আমি কিন্তু আপনার মাথায় চড়ে বসবো, তখন বুঝবেন বউয়ের কি জ্বালা।

অনুর শরীর থেকে মিষ্টি একটা বউ বউ গন্ধ বেরোচ্ছে, প্রত্যয় ভালোভাবে টের পাচ্ছে সেই সুঘ্রান, ও প্রথমে অনুর কপালে কপাল ঠেকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাসে আস্বাদন করলো অনু অনু মিষ্টি মেয়েলী সুগন্ধটুকু, তারপর ওর নাকে নাক ঘষে হিসহিসিয়ে বললো,
—– আমিতো চাই তুমি আমাকে জ্বা’লাও, পো’ড়াও। জ্বা’লিয়ে পু’ড়িয়ে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নাও। এই দূরত্ব যে আর ভাল্লাগছে না অনু, একটুও ভাল্লাগছে না।

******************************
বাড়ি ভর্তি মানুষ হলেও, সেই মানুষের কোনোরূপ আনাগোনা নেই অন্দরমহলের চারিদিকে । সবাই আপাতত স্টেজের ওখানে নাচ গান নিয়ে মেতে আছে।

দোতলার করিডোরটা পুরোপুরি নিরব। চারিদিক ল্যাভেন্ডার মোমের আলোয় চিকচিক করছে, সেই সাথে ওয়াইল্ড জেসমিনের সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে।ক্ষনে ক্ষনে প্রবল ভেগে ধেয়ে আসছে বৈশাখী দমকা হাওয়া। হাওয়ার তালে দুলে উঠছে সৌন্দর্য বর্ধক লাল, নীল, হলুদ নেটের উপর কারুকার্য করা ফিনফিনে পর্দাগুলো। বাইরে থেকে ভেসে আসছে অস্পষ্ট গানের লাইন,
” নেশা নেশা একি নেশা চোখে,
ভুলে থাকতে পারিনা তোকে,
অচেনা স্বপ্নগুলো তোকে ছুঁতে চায়”

আর এদিকে একের পর এক নেটের পর্দার আড়ালে আলগোছে গা ঢাকা দিচ্ছে অরু। ক্রীতিক যখনই সেই পর্দাটা দ্রুত হাতে সরিয়ে দিচ্ছে, তৎক্ষনাৎ একই ভাবে ছুটে গিয়ে অন্য একটা পর্দার আড়ালে ঠায় নিচ্ছে অরু।

এভাবেই করিডোরের এমাথা ওমাথা করছে ওরা দুজন। একজন চোখের লজ্জা আর মনের সংকোচ আলগোছে লুকোতে নিঃশব্দে আড়াল হচ্ছে, তো আরেকজন মনের কামনায় চোখের যাতনায় বারবার তাকে উন্মুক্ত করছে।
নিরব রাত নিস্তব্ধ পদধ্বনি অথচ দুজনার হৃদ মাঝারে বয়ে যাচ্ছে উত্তাল সমুদ্রাগত তীব্র জ’লোচ্ছ্বাসিত জোয়ার । যার নাম “প্রেম”।

অরু পারছে না ক্রীতিকের সাথে, পারছে না নিজের লজ্জাটুকু আড়াল করে লুকিয়ে থাকতে, বারবার ওকে কাছে টানার পায়তারা করে যাচ্ছে ক্রীতিক। বেহায়া পুরুষ ক্রীতিক।

আজ কি এমন হলো লোকটার? বুঝে উঠতে পারছে না অরু। ওদিকে সফেদ লেহেঙ্গাটা হলুদে মাখামাখি, সেই সাথে ক্ষনিক আগের ক্রীতিকের অবাধ্য স্পর্শ গুলো এখনো জীবন্ত, কি শিহরণ, কি উথালপাথাল পা’গলপারা অনুভূতি ভাবতে গেলে এখনো শরীরের লোমকূপ দাড়িয়ে যাচ্ছে অরুর ।

ক্রীতিক যেভাবে ওর পেটে পিঠে হলুদ মেখে দিয়েছে মনে হচ্ছে গায়ে হলুদটা অনুর নয়,বরং অরুরই।আর ক্রীতিক হলো একমাত্র ব্যক্তি যে অরুকে হলুদ মাখিয়ে গায়ে হলুদ সম্পন্ন করেছে আর কারোর হলুদ লাগানোর প্রয়োজন নেই ওর বউয়ের শরীরের ভাজে।

ক্রীতিকের সাথে লুকোচুরি প্রেমে এবার সত্যিই হাঁপিয়ে উঠেছে অরু, একপর্যায়ে উপয়ান্তর না পেয়ে তিনতলার সিঁড়ি ধরে দৌড়ে ছাঁদে উঠে গেলো ও। অরুকে এভাবে দিশেহারা হয়ে ছুটতে দেখে ভ্রম ছুটে গেলো ক্রীতিকের। মাতাল ভাবটা মস্তিষ্ক থেকে সরে যেতেই ক্রীতিক হাঁক ছেড়ে অরুকে বললো,
—– আস্তে, সাবধানে বেইবি, তুই মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলে আমি ডিএনএ কাকে দেবো বলতো?

****************************
ছাদেঁর পাঁচিলে দু-হাত রেখে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এলিসা। ওর দু’চোখ দূর আকাশে নিবদ্ধ, যেখানে আলো নেই, চাঁদের দেখা নেই, আছে কেবল একফালি কালচে মেঘের ঘনঘটা।
আজকেও বোধ হয় সেদিনের মতো দা’নবীয় ঝড় আসবে ভূবণ ভুলিয়ে।সেই সাথে আকাশ ফুটো হয়ে ঝমঝম বৃষ্টি। এলিসা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেও ওর চাঁদের মতো ফ্যাটফ্যাটে ফর্সা মুখের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে আছে অর্ণব।

একটু আগেও ওর সাথে যা নয় তাই ব্যবহার করেছে এলিসা, ওর প্রতিটি কথা ছিল বি’ষাক্ত তীরের ফলার মতোই বে’দনাদায়ক আর অ’পমান জনক।

কিন্তু অর্ণব তো বরাবরই নির্লজ্জ, এলিসার কাছে দু’পয়সার দাম না পেলেও ওর ইমেজে এইটুকু ভা’ঙন ধরেনা, এটা আজ বা কাল থেকে নয়, বরং বহু বছর আগে থেকেই। তাইতো এলিসার বলা তি’ক্ত কথা গুলোকে একপাশে সরিয়ে অকস্মাৎ পেছন থেকে দু’হাতে শক্ত করে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরলো অর্ণব।
গ্রীবা নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ওর ঘাড়ের উপর। অর্ণব ধরেছে থেকেই এলিসা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করছে। কিন্তু অর্ণব তাতে এক ফোঁটাও বিরক্ত নয়, উল্টো এলিসাকে আরও কাছাকাছি এনে ওর ঘাড়ে গলায় উ’ন্মাদের মতো সামান্য জো’র খাটিয়ে দাঁত বসাতে বসাতে অর্ণব শুধালো,
—- কি হয়েছে জান,কে কি বলেছে? এক্ষুনি বল, নয়তো, নয়তো আমি তোকে ব্যথা দিতে বাধ্য হবো। আমার কা’মড় গুলো জোরালো হবে, তোর ফর্সা শরীরটা র’ক্তিম হয়ে উঠবে।আর….

অর্ণব কথা শেষ করতে পারলো না, তার আগেই নিজেকে ছাড়িয়ে ওর শক্ত হাতে অর্ণবের তীক্ষ্ণ ফর্সা গালে আচমকা চ’ড় বসালো এলিসা। অর্ণব নিজেও বোধহয় আশা করেনি এলিসা হুট করে এমন কিছু করবে।

ওদিকে চ’ড় খেয়ে পাশ ফেরার সঙ্গে সঙ্গে অরুর সাথে চোখাচোখি হলো অর্ণবের। অরুকে দেখা মাত্র ও আর এক মূহুর্ত ও দাঁড়ালোনা। থমথমে মুখ নিয়ে, অরুকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত পায়ে ত্যাগ করলো সিঁড়ি ঘর।
অর্ণব চলে যেতেই অরু এগিয়ে এলো এলিসার নিকট, কিছুটা ইতস্তত আর ভয়ার্ত কন্ঠে অস্ফুটে শুধালো,
—- কিছু হয়েছে আপু? তুমি কি কোনো কারনে ডি’স্টার্ব?

অরুর কথায় এলিসা আড় চোখে তাকালো ওর দিকে। অরু শুষ্ক ঢোক গিলে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবারও বললো,
—– না মানে, আমাদের বাড়িতে কেউ যদি কিছু….

অরুর কথা এখানেই আটকে গেলো, বাকি কথাটুকু গ্রাস করে নিলো হতবিহ্বল এক অনাকাঙ্খিত পরিবেশ। হুট করেই অরুর কথার মাঝে ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো এলিসা। এলিসার মতো শক্ত আর কঠোর মানবী যে কাঁদতেও পারে, তা আগে জানা ছিলোনা অরুর।

এই ক্রীতিকের বন্ধু মহলটাই কেমন রহস্যে ঘেরা এক দূর্লভ প্রাচূর্য, যার উপরটা চকচকে আর আকর্ষনীয় হলেও ভেতরটা রহস্যের জালে মোড়ানো, কখনো সেখানে ধরা দেয় প্রকট অসহায়ত্ব, কখনো বা কিঞ্চিৎ অপারগতা।
কি অদ্ভুত হাতের কাছে টাকার পাহাড় থাকতেও কিছু মানুষ অসুখী, বড্ড অসুখী । কি এতো না পাওয়া তাদের? বুঝতে পারেনা অরু, আপাতত বোঝার মতো সময়ও না, ও তৎক্ষনাৎ নিজের হিজিবিজি ভাবনার ইতি ঘটিয়ে এলিসার পিঠে আলতো হাত বুলিয়ে বললো,
—- কি হয়েছে আপু, বলা যাবে?

এলিসা পুনরায় সটান হয়ে দাঁড়ালো, চোখের পানিটুকু আঙুলের ডগা দিয়ে তাড়াহুড়ো মুছতে গিয়ে আবারও ফুঁপিয়ে উঠলো। অরু বুঝলো এলিসা নিজেকে জোরকদমে সামলাতে চাচ্ছে, কিন্তু কোনো কারনে পারছে না।

—- বলোনা আপু কি হয়েছে? অর্ণব ভাইয়া কি?

অরুর কথার মাঝখানে এলিসা বলে ওঠে,
—- ওর কোনো দোষ নেই অরু, সব দোষ আমার, আমিইতো বেবিটাকে…..

কান্নার তোপে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে এলিসার, অরু একটা বড়সড় দম নিয়ে আস্তে করে প্রশ্ন ছু’ড়লো,
—– তুমি কি প্রেগন্যান্ট আপু?

এলিসা কাঁদতে কাঁদতে শুধু হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো।

অরু ঝটকা খেলো না, ও তো মনেমনে এটাই সন্দেহ করেছিল,তারপর আবারও বললো,
—-বাচ্চাটা নিশ্চয়ই অর্ণব ভাইয়ার?

এলিসা এবার জবাব দিলো,
—– হ্যা, সেদিন যখন জেকে এল এ থেকে ফিরলো, অর্ণব হুট করেই জেকের জবাবদিহীতার ভ’য়ে আমার বাসায় চলে এসে ফোন টোন বন্ধ করে দেয়। তারপর বেশ কয়েকদিন ও আমার বাসাতেই ছিল।

অরু ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে গলায় অসহায়ত্ব ধরে রেখে বললো,
—– তাহলে এটা অর্ণব ভাইয়াকে কেন জানাচ্ছো না? ওনার সন্তান ওনার তো জানার অধিকার রয়েছে।

এলিসা নাক টেনে বললো,
—- তোমার কি মনে হয়, বিয়ের আগে এই বাচ্চাকে ও কখনো স্বীকৃতি দেবে? শোনার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয়ই বলবে অষুধ খেয়ে ন’ষ্ট করে ফেলতে।যেটা আমি পারছি না, আমার দ্বারা হচ্ছে না, গত ওয়ান উইক যাবত এটাই চেষ্টা করে যাচ্ছি আমি। কিন্তু আমি পারছি না অরু, মাতৃত্ব আমাকে বারবার অ’পরাধীর কাঠগ’ড়ায় দাঁড় করাচ্ছে, আমার মতো শক্ত হার না মানা মেয়েটাকেও তীব্র ভাবে হারিয়ে দিচ্ছে এই দুই মাসের ভ্রুণটা। কি করবো আমি?

অরুর চোখ দুটো অভিমানে ছলছল করছে, এলিসা এমন একটা কথা ভাবলো কি করে সেই অভিমান? নাকি অর্ণবকে কষ্ট দিলো সেই অভিমান? জানা নেই অরুর, যা হোক ও নিজেকে সামলালো, অতঃপর আস্তে ধীরে ছাঁদের পাঁচিলে অহেতুক আঙুল ঘষতে ঘষতে বড়বড় শ্বাস ফেলে বললো,

—- আমি বিবাহিতা আপু, জায়ান ক্রীতিকের মতো ঘা’ড়ত্যা’ড়া লোকটাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি, ওনার বড্ড বেশি মুড সুইং হয়। যখন মেজাজ বিগড়ে যায়, তখন কি বলে, না বলে নিজেও খেয়াল করে উঠতে পারেনা। সেসময় ওনার মাঝে যেন উনি থাকেনা,বরং জেগে ওঠে এক হিং’স্র পশু সত্তা।
তবুও আমি ওনার মাঝেই সুখ হাতরে বেড়াই, নিজের মাঝে ওনার রাগ ঢাক সবটা সহ্য করার ক্ষমতা ধারণ করি, দিনশেষে উনিই আমার শান্তি নিকেতন, কারন উনি হলেন আমার প্রেমিক পুরুষ, আমার জনম জনমের ভালোবাসা, আমার জায়ান ক্রীতিক।

এতো কিছু কেন বলছি জানো আপু?কারন আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই মানুষটা আর যাই হোক, নিজের প্রান পণ উজাড় করে হলেও, আমাকে বি’পদ, আপদ, দোটানা, পিছুটান এবং সবরকম অশু’ভ থেকে খ’ঞ্জরের মতো রক্ষা করতে কোনোদিন কার্পন্য করবেনা।
আর না কোনোদিন পিছুপা হবে। সেটা যদি মৃ’ত্যুর দুয়ারও হয় তবুও না।

আর সেখানে তুমি অর্ণব ভাইয়ার ভালোবাসায় আঙুল তুলছো আপু? আমিতো বহুদূর থেকেও দেখতে পাই তোমার প্রতি ওনার এক আকাশসম মায়া, এক মহাসমুদ্র ভালোবাসা, এক পৃথিবীসম হৃদয়ের টান। তাহলে তুমি কেন দেখতে পেলেনা আপু?

উনিতো কষ্ট পেলেন, যে তোমাকে বছরের পর বছর শর্তহীন ভালোবেসে গিয়েছে সে কষ্ট পেলো।তোমার বাচ্চার বাবা কষ্ট পেলো। যার অংশ তোমার উদরে একটু একটু করে বড় হচ্ছে সেই মানুষটা কষ্ট পেলো। যে তোমাকে জীবনে প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ উপভোগ করিয়েছে সেই মানুষটা আ’ঘা’ত পেলো,…..

অরু গড়গড়িয়ে আরও কিছু বলবে,তার আগেই ওর দু’হাত শক্ত করে চেপে ধরে ফুপিয়ে উঠলো এলিসা, কা’ন্না জড়ানো কন্ঠে ঠোঁট ভেঙে বললো,
—– থামো অরু, আর নিতে পারছি না আমি, অর্ণব কোথায়? ও কোথায়?আমার বাচ্চার বাবা কোথায়? ওকে ডেকে আনো, বলো যে আমাকে যতদ্রুত সম্ভব বিয়ে করে নিজের বক্ষস্থলে ঠায় দিতে।আমি আর পারছি না,ওকে ছাড়া আর এক মূহুর্তও থাকতে পারছি না।

কথাগুলো বলে কাঁদতে কাঁদতে হাঁটু ভেঙে ধপ মাটিতে লুটিয়ে পরলো এলিসা। অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে এলিসাকে শান্ত করে বললো,
—- তুমি এখানেই থাকো আপু, আমি এক্ষুনি আসছি।

****************************
অরু নিচে নেমে অর্ণবের ঘর তালাশ করে দেখলো অর্ণব ঘরে নেই, তাই একটু সন্দেহ বশত এগিয়ে গেলো ক্রীতিকের ঘরের দিকে। কারন এই সময় অর্ণবের ক্রীতিক আর সায়রের কাছে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

হলোও তাই, অরু কোনোরূপ কড়ানাড়া ছাড়াই ক্রীতিকের রুমে প্রবেশ করলো। ভেতরে ঢুকতেই দেখা মিললো ওদের তিনজনার, ক্রীতিক ভিডিও গেইমটাকে পজ করে থমথমে মুখ নিয়ে গেমিং চেয়ারটাতে বসে আছে, অর্ণব আর সায়র ও তাই, চুপচাপ বসে আছে বেডের উপর। দেখে মনে হচ্ছে অরুকে দেখামাত্র ওরা একটু অসস্থিতেই পরলো বটে। অরুর অবশ্য তাতে যায় আসেনা, কিন্তু ও ভেতরে প্রবেশ করার আগেই বাঁধসেধে ক্রীতিক বলে,
—– কি হয়েছে অরু, কিছু বলবি?

অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক গম্ভীর গলায় বলে,
—- রাতে শুনবো, এখন রুমে যা।

ক্রীতিকের কথায় ঘোর আপত্তি জানালো অরু, ওর কথায় কোনোরূপ তোয়াক্কা না করে ভেতরে আসতে আসতে অরু বলে,
—– আমার জরুরি কথা আছে।

ক্রীতিক একটু শা’সানোর সুরে বললো,
—- বলেছিতো এখন না পরে শুনবো, দেখছিস না এখানে বড় রা কথা বলছে?

—– আপনাদের কথা পরে শুনবো, আগে আমার কথা শুনুন।

ক্রীতিক বুকের ভেতরের তপ্ত দীর্ঘঃশ্বাসটা নাক দিয়ে বের করে, একটু গম্ভীর গলায় বললো,
—– বেইবি রাগ উঠাস না, রুমে যা, রাতে তোর সব কথা শুনবো, দরকার পরলে সারারাত না ঘুমিয়ে শুনবো, বাট নট নাও।
এখানে বড়রা কথা বলছে, যদি
আমার রুম থেকে যেতে ইচ্ছে না করে তো চুপচাপ বসে থাক। নো মোর সাউন্ড ওকে?

অরু বুঝলো ক্রীতিক নাছোড়বান্দা, ওকে কিছুতেই আলাদা কথা বলতে দেবে না এই নি’র্দয় লোকটা, তাই এবার উপয়ান্তর না পেয়ে অর্ণবের দিকে দৃষ্টিপাত করে, অরু সবার সামনে বলেই ফেললো,
—– ভাইয়া, এলিসা আপু অন্তঃসত্ত্বা ।

অরুর কথাতে যেন ঘরময় ব’জ্রপাতের আওয়াজ হলো। সায়র,অর্ণব, এমনকি ক্রীতিক পর্যন্ত হতভম্বের মতো চেয়ে আছে অরুর পানে। সবাই এখনো ভ্রম থেকে বেরোতে পারেনি বিধায়, অরু পুনরায় অর্ণবকে ডেকে বললো,
—– আপু ছাঁদে অপেক্ষা করছে।

এবার একে একে টনক নড়লো সবার, এই মূহুর্তে ওদের চোখে সবচেয়ে বড় অ’পরাধী অর্ণব। সায়র তো রা’গ দমাতে না পেরে কটমটিয়ে বলেই উঠলো,
—– শালা ধা’ন্ধাবা’জ, বাসর ফাসর সেরে বাচ্চা পয়দা করে, এখন এখানে এসে ইনোসেন্ট সাজা হচ্ছে?

বেচারা অর্ণব চরম অসহায়ের মতো চুপসানো মুখে সায়রকে ঝাড়ি মে’রে বললো,
—- আমি কি জানতাম নাকি?যে এক বাসরেই বাচ্চা হয়ে যায়? তাহলে অন্তত গেস করা যেত।

তৎক্ষনাৎ বিরক্তি প্রকাশ পেলো সায়রের চোখে মুখে, ওর চোখে এই মূহুর্তে মী’রজাফরের চেয়েও বড় বে’ঈমান এই বন্ধুগুলো। নিজের ইমোশন সামাল দিতে না পেরে ও ক্রীতিক আর অর্ণবকে তর্জনী দিয়ে ইশারা করে ব্যথাতুর স্বরে বলে উঠলো ,
—- তোদের একটাকেও আমি আর বিশ্বাস করিনা, আমাকে না নিয়ে কিভাবে বাসর সেরে ফেললি তোরা? একটু ও মনে পরলো না আমার কথা?এই সিঙ্গেল ছেলেটার কথা?

ক্রীতিক ওর কথায় দু পয়সার পাত্তা দিলোনা, উল্টে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস হয়ে শুধালো,
—– কি করবি এখন?

অর্ণব মৃদু হেসে একটু লাজুক হওয়ার ভান ধরে বললো,
—– কি আর করবো, বাচ্চার মাকে বউ বানাবো।

ক্রীতিক অর্ণবের কথায় সম্মতি জানিয়ে বললো,
—- ওকে ফাইন, প্রত্যয় অনুর গায়ে হলুদটা শেষ হোক দেন আমরা কোনো একটা রেজিষ্ট্রি অফিসে যাবো, রেজিষ্ট্রি ম্যারেজ হয়ে গেলে তারপর না হয় কোনো একটা চার্চে নিয়ে ফাদারের আশির্বাদ নিয়ে আসবি তোরা।

সায়র উৎসুক হয়ে ক্রীতিকের কথায় বাম হাত ঢুকিয়ে বললো,
—- ভাই এতো রাতে রেজিষ্ট্রি ম্যারেজ? কে খুলে রাখবে তোদের জন্য রেজিষ্ট্রি অফিস?

ক্রীতিক বসা ছেড়ে উঠে এলো, অতঃপর সায়রের কাঁধে হাত রেখে বললো,
—- বাংলাদেশে একধরণের কাগজের প্রচলন আছে বন্ধু,যেটার মাধ্যমে শুধু রেজিষ্ট্রি অফিস কেন? গন ভবন ও চব্বিশ ঘণ্টা খুলে রাখা যায়।

*
অর্ণব আর সায়র মাত্রই ক্রীতিকের রুম থেকে বেরিয়ে গেলো, অরু এখনো এককোনে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রীতিকের এতোক্ষণে নজর গেলো অরুর দিকে, যে ঠৌঁট, নাক ফুলিয়ে কপাল কুঁচকে দাড়িয়ে আছে। অরুকে দেখে ক্রীতিক এগিয়ে এসে আলতো হাতে ওর নাক টেনে দিয়ে শুধালো,
—- হোয়াট হ্যাপেন্ড হার্টবিট? খেয়ে ফে’লবি নাকি? নিজেকে লবন ম’রিচ মাখিয়ে প্রিপেয়ার করে আনবো কিনা বল ?

ক্রীতিকের এই মধুর আওয়াজ তেঁতো ঠেকলো অরুর নিকট, এই লোক ওকে ভাবে টা কি আসলে? পিচ্চি বাচ্চা? নাকি ফিডার খাওয়া দুধের শিশু? কোনো কথায়ই বলতে দেয়না আশ্চর্য! তৎক্ষনাৎ মনে মনে ক্রীতিকের সঙ্গে কোনোরূপ কথা আদান-প্রদান না করার দৃঢ় প্রতীজ্ঞাবদ্ধ হলো অরু।

অতঃপর নিজের প্রতীজ্ঞায় অটল থাকার উদ্দেশ্যে ওর প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়েই ফোসফাস করতে করতে ক্রীতিকের রুম
ত্যাগ করলো অরু।
********************************
—- আগে হলুদ না লাগিয়ে এখান থেকে আমি এক পা’ও নড়বো না, ব্যাস।

সায়র ভ্রু কুঞ্জিত করে বললো,
—- নড়বে না মানে? তোমার আব্বাজান নড়বে,রেম্প ওয়াক থেকে বিলবোর্ড, সায়র কখনো লাস্ট হয়না,আর এই সামান্য হলুদের অনুষ্ঠানে আমি লাস্ট হবো? নো ওয়ে। তাছাড়া বউ জাতি সবসময় বর জাতির পেছনেই অবস্থান করে, দেখলে না তখন অরু জেকের পরে এসে হলুদ লাগালো।

—-বউ জাতি আর বর জাতি বলতে যে কোনো এলিয়েন জাতি হয়,সেটা আপনার মুখেই প্রথম শুনলাম, অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার সেরকম কিছু নেই, আপনি তো পাগলু একটা।

—- হ্যা শুধু তোমার পাগলু, ঝিঙ্কু!
সায়র মাথায় হাত বুলিয়ে দেবের মতো একটু ভাব ধরতেই।নীলিমা চোখ গরম করে বলে,
—- এ্যাই কি বললেন আপনি?

সন্ধ্যা রাতের ইতি টেনে গভীর রাত ঘনিয়ে আসছে। চারিদিকে জোরকদম হাওয়া দিচ্ছে। মনে হয় খানিক বাদেই ঝুম বৃষ্টিতে মুখরিত হবে ধরনী, অথচ অনু আর প্রত্যয়ের হলুদ সন্ধ্যার এখনো ইতি ঘটেনি। এর কারণ একটাই সায়র আর নীলিমা তখন থেকে যায়গা দখল করে দাঁড়িয়ে আছে, একজন বলছে আমি আগে হলুদ লাগাবো,তো আরেকজন বলছে না আমি আগে।

কেউ কাউকে এক চুল পরিমাণ ছাড় দিতে নারাজ তারা। এদিকে নিজেরা দাঁড়িয়ে থেকে অন্য অতিথিদের ও সময় খেয়ে দিচ্ছে ওরা দুজন । পেছনের অতিথি সমাজ বেশ বিরক্ত ওদের কান্ডে, এক পর্যায়ে একজন বয়জেষ্ঠ অতিথি না পেরে এগিয়ে এসে, ওদেরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—– বাচ্চারা, তোমরা বরং একটা কাজ করো ওই পাশে গিয়ে আগে নিজেদের ঝামেলা মিটিয়ে আসো, দরকার পরলে সময় নাও,সুপ্রিম কোর্টে যাও,মা’মলা করো,ইনভেস্টিগেশন করে জাজের থেকে অনুমতি নিয়ে ফিরে আসো, আসলেই কার আগে হলুদ দেওয়া উচিৎ। তবুও এই বৃদ্ধের উপর দয়া ধরে যায়গা ছাড়ো ভাই, সেই তখন থেকে তোমাদের ঝগড়া দেখে দেখে সুগার বেড়ে গেলো আমার, বাড়ি গিয়ে ইনসুলিন লাগাতে হবে,তাড়া আছে সর,দেখি বাপু।

সায়র নীলিমাকে নিয়ে সরে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধার উদ্দেশ্যে সন্দিহান গলায় বললো,
—– আশ্চর্য কথা বললেন তো দাদু, কোর্টে যাবো,মা’মলা করবো, রায় হবে, ততক্ষণ কি ওরা দুজন বিয়ে না করে আইবুড়ো হয়ে এক চিমটি গায়ে হলুদ লাগানোর জন্য এখানে বসে থাকবে নাকি?

বৃদ্ধ এবার দাঁত খিঁচিয়ে সায়রের দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ বললেন,
—- এতোই যখন বুঝিস হতচ্ছাড়া, তাহলে সেই তখন এক চিমটি হলুদ লাগানো নিয়ে এতো নাটক করলি কেন? দুইটা মানুষ চারটা গাল, যার যেখানে খুশি হলুদ লাগাতি, তা-না তখন থেকে যুক্তি দিয়ে দিয়ে কানের মাথা খেয়ে ফেলেছিস। তোরা দুজন এই হলুদ অনুষ্ঠান থেকে বয়’কট এক্ষুনি বিদেয় হ।

সায়র নীলিমাকে নিয়ে স্টেজ ছেড়ে নেমে যেতে যেতে গম্ভীর মুখে বিড়বিড়িয়ে বললো,
—– এ নিশ্চয়ই অরুর মায়ের বংশের কেউ হবে। নয়তো দাঁত না থাকা সত্ত্বেও মুখের ভাষা এতো তেঁতো কেন?আজিব!

**************************
অবশেষে অনুর গায়ে হলুদের রাতে অর্ণব এলিসার রেজিষ্ট্রিটা হয়েই যায়। ক্রীতিক নিজ উদ্যগেই ওদের বিয়েটা দিয়েছে। আর এই মূহুর্তে রেজিষ্ট্রি অফিসের বাইরের করিডোরে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা ক’জন।

বাইরে আকাশ ভে’ঙে বৃষ্টি হচ্ছে। নীলিমা আর অরু হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রীতিক একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে সিগারেটের শলাকা ধরিয়েছে। আর এলিসা এখনো অর্ণবের গলা জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। এলিসা কাঁদছে দেখে অর্ণব উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
—- এভাবে কাঁদছিস কেন এলি? ভুলে গিয়েছিস ইউ আর প্রেগি উইথ মাই বেবি? তুই এভাবে কাঁদলে আমার বাচ্চাটার ক’ষ্ট হবে,সাথে আমারও। সো স্টপ ক্রাইং রাইট নাও।

সায়র দু’হাতে কয়েকটা ছাতা নিয়ে ওদের নিকট এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
—- হয়েছে আদিখ্যেতা বন্ধ কর, আমাদের হার্ড ওয়ার্কিং এলিসাটাকে দিলি তো অসুস্থ বানিয়ে। এখন আর দরদ দেখাতে হবেনা।

অর্ণব জোর গলায় সায়রকে শাসিয়ে উঠে বললো,
—- খবরদার আমাদের বাপ ব্যাটাকে কিছু বলবিনা সায়র, তাহলে তোর কপালে সারাজীবন আইবুড়ো থাকার সিল লেগে যাবে, বলে দিলাম।

অর্ণবের কথায় এলিসা মৃদু হেসে ফেলে। এলিসা হেসেছে দেখে অর্ণব ওর কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলে,
—- এই তো লক্ষী বউ আমার।

এলিসা চারিদিকে চোরা চোখে চেয়ে অর্ণবকে সামান্য ধা’ক্কা মে’রে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললো,
—- হয়েছে, ছাতা এসে গেছে চল এবার। কাল বিয়েতে অনেক কাজ। আর আমরা এখনো এখানে।

অর্ণব এলিসাকে কোলে নিয়ে একহাতে ছাতা ধরে এগোতে এগোতে বললো,
—- তোর বাচ্চার বাবা হয়ে যাচ্ছি, এখনো তুই করেই ডাকবি জান?

এলিসা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দু’হাতে অর্ণবের গলাটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভাবুক হয়ে বললো,
—- কি ডাকা যায় বলতো তোকে? আমার তো তুমি আসছে না। ভাবতেই কেমন হাসি পাচ্ছে।

অর্ণব এলিসা পায়ে পায়ে গাড়ির পর্যন্ত চলে গিয়েছে, ওরা যাওয়ার পরে ক্রীতিক একটা ছাতা ধরে অরুর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলে,
—- বেইবি কোলে আয়।

—- মোটেই না, আপনার কোলে আপনিই উঠুন।

কথাটা বলে মুখ ঝামটি দিয়ে বৃষ্টির মাঝেই তরতরিয়ে এগিয়ে যায় অরু।অরুর কান্ডে ক্রীতিক গম্ভীর মুখে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।
সায়র একটুখানি সরে দাড়িয়ে নীলিমাকে নিজের ছাতায় আমন্ত্রণ জানালে নীলিমাও উপায়ন্তর না পেয়ে সহসা এগিয়ে এসে ওর পাশেই ছাতার তলায় দাড়িয়ে পরে।

সায়র নীলিমা সমেত গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ক্রীতিকের দিকে হতবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুখ দিয়ে চু চু উচ্চারন করে ওকে টিপ্পনী কেটে বললো,
—- তুই আসলেই জেকে তো? বিয়ে করে কি হাল হয়েছে ছেলেটার,বেচারা!

তৎক্ষনাৎ ক্রীতিক নিজের পায়ের স্লিপারটা ওর দিকে ছু’ড়ে মে’রে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
—- শালা যাবি এখান থেকে?

সায়র ওকে পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে যায়, ক্রীতিকের চোখমুখ এখনো রাগের তোপে র’ক্তিম হয়ে আছে, অথচ অরু কি হাসি মজাটাই না করছে সকলের সাথে।শুধু ক্রীতিককেই ইগ্নোর করছে। ক্রীতিক অরুর দিকে তাকিয়ে দু’হাত মুঠি বদ্ধ করে, মনেমনে তীক্ষ্ণ আওয়াজে বললো,
—- অরুর বাচ্চা তোকে একবার হাতের কাছে পেয়ে নিই। তারপর তোর হচ্ছে।

নীলিমা লেহেঙ্গা সামলে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে, সায়র বারবার ঘাড় নামিয়ে নীলিমার দিকে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। দুজন একই ছাতার নিচে হওয়ায় দূরত্ব বেশ স্বল্প।আপাতত তারই সুযোগের সৎ ব্যবহার করছে সায়র। নীলিমা লেহেঙ্গা সামলে যেই না মাথা তুলবে ঠিক তখনই সায়রের চিবুকের সঙ্গে অকস্মাৎ ধা’ক্কা খেলো ও। সায়র এমন ঝুঁকে আছে দেখে চিড়িবিড়িয়ে উঠলো নীলিমার মস্তিষ্ক, মুখ দিয়ে বিরক্তির প্রতিক্রিয়া জানালো তৎক্ষনাৎ,
—- এভাবে ঝুঁকে আছেন কেন? আমি কি চিড়িয়া? যে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে না দেখলে মহাভারত অসুদ্ধ হয়ে যাবে?

সায়র নীলিমার কথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতে দিতে শুধালো,
—- এতো সুন্দর স্মেল কেনো? কি শ্যাম্পু লাগাও চুলে হ্যা?

নীলিমা চোখ খিঁচিয়ে বললো,
—- আপনি আবার ইভ’টি’জিং করছেন? আমি কিন্তু আব্বাজান কে বলে দেবো।

নীলিমা ছাতার তলা থেকে বেরিয়ে দ্রুত হাটছে, সায়র কিছুটা তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এসে আবারও নীলিমার মাথায় ছাতা ধরে রাশভারি গলায় বললো,
—- এ্যাই মেয়ে, সমস্যাটা কি? আমি যে তোমার বড়, বড়দের কথা শুনতে হয়, সে জ্ঞান কি বিয়ে বাড়ির বোরহানির সঙ্গে গুলে খেয়েছো নাকি?

নীলিমা হাঁটার গতি পুরোপুরি থামিয়ে দিয়ে সায়রের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিপাত করে বললো,
—- ওই জন্যই তো বলছি বড় বড়দের মতো থাকুন। সম্মানিত ব্যক্তি হয়ে বাচ্চাদের পেছনে ঘুরঘুর করছেন কেন শুনি?

সায়র এবার পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে নীলিমার সঙ্গে কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো, তারপর ঘাড়টা কিঞ্চিৎ নিচে নামিয়ে গলার আওয়াজ ক্ষীণ করে বললো,
—– মনের সাথে মন মিলাতে চাই বলে, তোমার আব্বাজান কে শশুর বানাতে চাই বলে।

সায়রের কথা শুনে নীলিমা একটুখানি পিছিয়ে গিয়ে ঠোঁট টিপে বলে ওঠে,
—- আব্বাজান কিন্তু এখনো আ’ছোলা বাঁশ হাতে নিয়ে বাড়ির আশেপাশে বিদেশি বাঁদরটা খুঁজে বেড়ায়।

নীলিমার কথা শুনে ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো সায়রের মুখখানা। নীলিমা দাঁড়ালোনা, সায়রের হাত থেকে ছাতাটা কেঁ’ড়ে নিয়ে সহসা এগিয়ে গেলো সামনের দিকে, সায়র পেছন থেকে হাঁক ছেড়ে বললো,
—- তবুও তোমার আব্বাজানকেই শশুর বানাবো আমি, কথাটা মনে রেখো।

পরক্ষণেই মুখ কাচুমাচু করে একাই বিড়বিড়ালো,
—- একটু আধটু বাঁ’শ খেলে কিছু হয়না।

************************
রাতের শেষ প্রহর চলমান… পুরো ক্রীতিক কুঞ্জ ভীষন নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে, ঘুমের ঘোরে সবাই বিভোর। বাইরে বৃষ্টি থেমে গিয়ে হিমেল হাওয়া বইছে। ঠান্ডা হাওয়ায় ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠছে ঘুমন্ত অরু। শেষ রাতে আর জানালাটা বন্ধ করা হয়নি,ওই জন্যই এতো হাওয়া দিচ্ছে । কিন্তু ঘুমের মধ্যে উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করার মতো শক্তিও নেই অরুর, তাই শীতল হাওয়া গায়ে মাখিয়ে কিছুটা জড়োসড়ো হয়েই নির্বিগ্নে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা।

শীতল ঠান্ডা আর কোমলতার মাঝে একখন্ড খরখরে হাতের উষ্ণ পরশে আচমকাই কম্পিত হয়ে উঠলো ঘুমন্ত অরুর তনু শরীরটা। অরু ঘুমের মাঝেও স্পষ্ট টের পাচ্ছে কেউ একজন ওর তুলতুলে নরম উদরে আবেশিত আঙুল বুলাচ্ছে। সেইসাথে টুকরো টুকরো চুমুতে ভিজিয়ে তুলছে সর্বাঙ্গ। লোকটা অরুর কপাল,ঠোঁট, গলা, এরপর আরেকটু নিম্নভাগে স্পর্শ করতেই হকচকিয়ে চোখ খুললো অরু।

চারিদিক নিকোশ আধারে তলিয়ে আছে, অন্ধকারে কারোর মুখ দেখার যো নেই, তবুও স্যান্ডাল উড পারফিউমের সুবাসটা নাকে ঠেকতেই সস্থির নিঃশ্বাস ছাড়লো অরু। অতঃপর গলা খাদে নামিয়ে শুধালো,
—- আপনি এখানে?

ক্রীতিক জবাব দেয়না, নিঃশব্দে অরুকে বাচ্চাদের মতো কোলে তুলে নিয়ে পা বাড়ায় রুমের বাইরে। ক্রীতিক এভাবে তুলে নিয়ে যাচ্ছে দেখে অরু উদ্বিগ্ন আওয়াজ অথচ বেশ নিচুস্বরে বললো,
—- আরেহ কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন এই রাত দুপুরে?

ক্রীতিক একহাত দিয়ে নিজের রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জড়ানো গলায় বললো,
—- বউকে ছাড়া ঘুম আসছে না।

অরু ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
—- আপনি আবার ড্রিং’ক করেছেন?

ক্রীতিক না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
—- ওরা সেলিব্রেশন করেছে,কিন্তু বিশ্বাস কর আমার একটুও নে’শা হয়নি, আমিতো এখন নে’শা করবো।

কথা শেষ করে অরুকে বিছানায় ছু’ড়ে মা’রলো ক্রীতিক। অরু হকচকিয়ে উঠে বসে ব্যথাতুর গলায় বললো,
—- আহ!ব্যথা পেলাম তো।

ক্রীতিক নিজের টিশার্ট খুলে মেঝেতে ছু’ড়ে ফেলে দিয়ে, ওর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে হাস্কিটোনে বললো,
—–ইউ নো হোয়াট বেইবি? ইউ আর ইয়াম্মি।টু মাচ ইয়াম্মি। লাইক মাই পার্সোনাল ডেজার্ট।

অরু ঝাঁজিয়ে উঠে নাক সিকোয় তুলে বললো,
—- আপনার মাথাটা একদম খারাপ হয়ে গিয়েছে। এক্ষুনি লেবু পানি খাওয়াতে হবে। দাঁড়ান নিয়ে আসছি।

অরুকে এক পা’ও নড়তে দিলোনা ক্রীতিক, উল্টো অরুর আঙুলের ভাঁজে আঙুল ঢুকিয়ে মুখটাকে অরুর গলায় ডুবিয়ে দিতে দিতে হিসহিসিয়ে বললো,

—– আজকে রাতে একটু খা’রাপ এলাউ কর, কালকে একদম ভদ্র হয়ে যাবো। প্রমিস।
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here