সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁 #পর্বঃ৫২ #লেখনীতেঃsuraiya_rafa

0
33

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ৫২
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa

(ক,পি করা নিষিদ্ধ 🚫)
(কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য)

*
দিনের দ্বি-প্রহর চলমান, দুপুরের ভাতঘুমে বিভোর পুরো মহল্লা। আকাশের ধূসর মেঘ টুকু ধীরে ধীরে কেটে গিয়ে তীক্ষ্ণ সূর্য কীরণে ছেয়ে গিয়েছে ক্রীতিক কুঞ্জ। পুরো গলি ফাঁকা, সেই সাথে ফাঁকা পরে আছে সুবিশাল বাড়ির লন টাও।

এই তো মাস দেরেক আগেও ক্রীতিকের বন্ধুদের হৈ-হুল্লোড় আর কথার বহরে সর্বক্ষন জমজমাট হয়ে উৎসব মুখর পরিবেশ ঘিরে থাকতো বাড়িটায়, দীঘির পারের বৈঠক খানায় বিকেল হলেই বসতো চায়ের আসর।

অথচ মাত্র এই কয়েক দিনের ব্যবধানে সব আনন্দ উল্লাস কেমন ফিকে হয়ে গেলো, বাড়িটা সেই আগের ভূতুড়ে বাড়ির মতোই ঝিনঝিন করছে এখন,চারিদিকে কেউ নেই, কেউ নেই গন্ধটা মা’রাত্মক পীড়া দিচ্ছে আজকাল। আর এখন এই মূহুর্তে যা সবচেয়ে বেশি পীড়া দিচ্ছে,তা হলো ক্রন্দনরত অরুর চি’ৎকার।

ওর কান্নার আওয়াজ মহলের চার দেওয়ালে বাড়ি খেয়ে ক্রমাগত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কর্ণকূহরে,যা আরও বেশি ব্যথাতুর শোনাচ্ছে। আজ থেকে বছর খানিক আগেও কি কেউ জানতো? যে অরু নিজের বিলেত বাসী সৎ ভাইয়ের জন্য এভাবে আ’র্তনাদ করবে কোনোদিন ? না জানতো না, অরু নিজেও হয়তো জানতো না,কোনোদিন কল্পনাও করেনি, অথচ সময় ওকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে এলো, সবচেয়ে অপছন্দের আর বিরক্তিকর সেই ভাইয়াটার জন্য অরুর এখন কষ্টে দুঃখে জান বেরিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে চোখের সামনে দুনিয়াটা দুলছে, মানস্পটে ভেসে উঠছে শুধু একটা মুখ, একজোড়া ঘোর লাগানো চোখ, নাকে এসে স্পর্শ করছে একটা পছন্দের সুঘ্রাণ, আর কর্ণকূহরে বাড়ি খাচ্ছে গাঢ় গলার আওয়াজে ডাকা একটামাত্র শব্দ,
— তুই আমার “হার্টবিট”।

গত একমাস ধরে মানুষটার উপর দিয়ে কি কি গিয়েছে কে জানে? আচ্ছা কতটা আ’ঘাত পেয়েছেন উনি? আগের বার ও তো মাথায় আ’ঘাত পেয়ে হসপিটালে ভর্তি হতে হয়েছিল,এখন আবারও। এই একমাসে কি একবারও অরুর কথা মনে পরেছিল চেতনাহীন ক্রীতিকের?সব কিছু কবে আবার আগের মতো হবে?আচ্ছা ক্রীতিক আদৌও বাঁচবে তো?

নিজের মনে পায়তারা করে বেড়ানো হাজারো অনিশ্চিত প্রশ্নের জালে জড়িয়ে গিয়ে ক্রমশ কেঁদে চলেছে অরু। ওর ভালো লাগছে না,দম বন্ধ হয়ে আসছে,মুখের সমগ্র ছড়িয়ে পরেছে নিমের মতো তেঁতো স্বাদ,গলাটা শুকিয়ে কাঠ, চোখের দৃষ্টি অস্পষ্ট আর ঝাপসা, দেখে মনে হচ্ছে এখনই মূর্ছা যাবে মেয়েটা।

ওদিকে অরুর এহেন আর্তনাদ শুনে উপর থেকে ছুটে আসেন আজমেরী শেখ আর জাহানারা। অনু ডাইনিং এ খাবার পরিবেশন করছিল, ছোট বোনকে হঠাৎ এভাবে ভেঙেচুরে পরে কাঁদতে দেখে ও দৌড়ে আসে হলে, তরিঘরি করে হাঁটু ভেঙে বসে দু’হাতে আগলে ধরে অরুকে। অনু অরুকে ধরে রেখেছে ব্যাপার বোধগম্য হতেই তৎক্ষনাৎ শরীরের সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে অনুকে একটা ঝটকা মে’রে দূরে সরিয়ে দেয় অরু।

অরু সরিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও অনু পুনরায় অরুর দিকে এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,
— অরু,বোন আমার, শোন একটু আপার কথাটা,

অনু আবারও অরুকে ছুঁতে চাইলে অরু হাতে ভর করে দূরে সরে গিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলে,
— একদম ছুবি না আমায়, তোরা সবাই মি’থ্যেবাদী।

অনু আকুতি ভরা কন্ঠে ফুপিয়ে উঠে বললো,
— শোন একটু।

অনুর কথার পাছে অরু কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— কি শুনবো? আবার কি গল্প শোনাবি তোরা আমাকে? আমার স্বামী মা’রা যাচ্ছে আপা,গত একটা মাস ধরে অপারেশন থিয়েটারের কামরায় দিনরাত অতিবাহিত করছে, অথচ আমি কিছুই জানিনা। উল্টো তোরা আমাকে দিনের পর এটা বুঝিয়ে এসেছিস কি,আমার জায়ান ক্রীতিক আমার সাথে কথাই বলতে চায়না, আমার সাথে দূরত্ব বাড়াতে চায় বলে আমাকে রেখেই ইউ এস এ ফিরে গিয়েছে, কেনো আপা?কেনো তোরা আমার সুন্দর অনুভূতি গুলোকে এভাবে পায়ে পিষে ফেললি বল? শুধু তো ভালোই বেসেছি, অন্যায় তো করিনি।

অরুর এতো এতো অ’ভিযোগের পাছে অনু ডুকরে কেঁদে উঠলো, কাঁদতে কাঁদতে নাক টেনে বললো,
— আমার কথাটা তো একটু শোন।

অরুর মাথা ঠিক নেই, এই মূহুর্তে হৃদয় আর মস্তিষ্ক জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে শুধুই জায়ান ক্রীতিক, এছাড়া আর কোনো কিছু শোনার অবস্থাতে নেই ও। তাই অনুর কা’ন্নাকাটিকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে টলতে টলতে হলরুম ত্যাগ করে অরু, হেলেদুলে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে উঠতে ধরা গলায় বলে,
— সবাই ঠকিয়েছে আমায়, আমার আপা ও।

অরু ধীর পায়ে চলে যাচ্ছে, আজমেরী শেখ সেদিকে তাকিয়ে শান্ত নির্জীব গলায় বললেন,
— কেউ ঠকায়নি তোমাকে,বরং বাঁচিয়েছে।

মায়ের কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি হেঁসে রুমে ঢুকে ধাপ করে দরজা লাগিয়ে দিলো অরু।

*************************************************

গভীর রাতে পিক পিক করে দরজার পাসওয়ার্ড খোলার আওয়াজে আচমকা তন্দ্রা ছুটে গেলো নীলিমার। তবে তীব্র জ্বরের দাবদাহে ঝাপসা চোখ দুটো খুলে রাখা যাচ্ছেনা মোটেই। মাথাটা ঝিমঝিম করছে, মাতাল মানুষের মতোই একমনে বিড়বিড় করে যাচ্ছে নীলিমা । কোথায় আছে, কি করছে, কেন করছে, কিছুই বোধগম্য নয় ওর। শুধু মনে হচ্ছে খোলা আকাশের শূন্যতায় আপন মনে গা ভাসাচ্ছে ও।

একটু পর রুমে এসে হাজির হলো সায়র, হাতে একটা খাবারের পার্সেল, চোখ মুখ বি’ষন্ন, দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাইরে থেকে ফিরেছে মাত্র। রুমের ভেতরে প্রবেশ করে, জ্বরে কাতরাতে থাকা নীলিমাকে দেখে বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো সায়রের। গত দেরটা মাস ধরে ওদের চারজনের দিন আর রাত সমান হয়ে গিয়েছে, কখনো লস এঞ্জেলস তো কখনো সানফ্রান্সিসকো, মোট কথা প্রাইভেট জেটে একপ্রকার ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করেছে ওরা চারজন।

তবুও আজ এতোগুলো দিন পর একটু স্বস্তিতে বাড়ি ফিরেছিল সায়র, কারন ক্রীতিকের জ্ঞান ফিরেছে আজ সকালেই। যেখানে ওর বাঁচার সম্ভাবনাই ক্ষীণ ছিল, ইন্ডিয়ান ডক্টররা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিল, সেখানে ওরা তিনজন বন্ধু হাল ছাড়েনি কখনো।
এশিয়ান ডাক্তারদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ক্রীতিককে সেদিনই এমার্জেন্সী ফ্লাইটে উড়িয়ে নিয়ে এসেছিল ইউ এস এ। যার ফলসরূপ উপর ওয়ালার অশেষ রহমত,এবং এলিসা,অর্ণব আর সায়রের দৃঢ় মনের জোরে আজ এই পর্যন্ত ফিরে এসেছে ক্রীতিক।

কিন্তু সায়রের এহেন দিনের পর দিন অনিয়মিত জীবন যাপন আর দিনরাত ডেইলি প্যাসেঞ্জারীতে আরেকজন যে একাকী বি’ষন্নতায় দিন কাটাতে গিয়ে ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল তা আর ঠাওর করে উঠতে পারেনি সায়র। বন্ধুমহলের সব থেকে স্ট্রং আর দৃঢ় মনোবল সম্পন্ন বেস্ট ফ্রেন্ডের এমন জীবন ম’রণের সন্নিহিত সময়ে দাঁড়িয়ে অন্য কিছুতে মনোনিবেশ করার কথা যেমন নয়। ঠিক তেমনই, এমন একটা পর্যায়ে দাঁড়িয়ে সায়রও পারেনি নীলিমার যত্ন নিতে, ওকে যথাযথ মূল্যয়ন করতে, যার ফলে নীলিমা আজ পুরোপুরি বিছানা সজ্জায়।

ভাগ্যিস নীলিমার আব্বাজান এখানে নেই, নইলে আদরের মেয়ের এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে তিনি সায়রের কয়টা হাড্ডি আস্ত রাখতেন সেটাই ভাবনার বিষয়।

নিরবে নীলিমাকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষন করতে করতে আবারও দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো সায়রের বুক চিড়ে। পরক্ষণেই নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে একনজর ঘড়ির কাঁটায় চোখ রাখলো সায়র।দেখলো, রাত তখন দের টার কাছাকাছি।

এতো রাত হয়ে গিয়েছে অথচ এখনো নীলিমার কিছুই খাওয়া হয়নি, সেই ভেবে সায়র তাড়াহুড়ো করে জামা কাপড় ছেড়ে পাজামা সেট গায়ে চড়ালো, অতঃপর পার্সেলের খাবার গুলো প্লেটে করে নিয়ে এলো নীলিমার কাছে, নীলিমা তখনো একমনে বিড়বিড়াচ্ছে।
সায়র ওকে আলগোছে নিয়ে নিজের বুকের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে একটু একটু করে খাবার তুলে দিতে লাগলো নীলিমার মুখে, নীলিমা কতক্ষণ চিবুচ্ছে তো কতক্ষণ খাবার গালে নিয়ে থম মে’রে বসে আছে। ওর মাথাটা টলছে, সায়র নিজের ঘাড়টা বাকিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে শুধালো,
— কি হলো খাচ্ছো না কেন? বেশি খারাপ লাগছে?

নীলিমা চোখ বুজেই হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো।

— এই তো আমি ফিরে এসেছি, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে,আমি সব ঠিক করে দেবো,তোমাকে আর একা থাকতে হবে না, সায়র মোটেও বউকে অবহেলা করার মতো ছেলে নয়। একটু সুস্থ হও তারপর পুরো আমেরিকা চষে বেড়াবো আমরা দুজন, প্রমিস।

একমনে কথাগুলো বলে আবারও নীলিমার মুখে খাবার তুলে দিতে ব্যস্ত হয়ে পরলো সায়র।

একেএকে খাবার আর অষুধ খাইয়ে, হাত পা মুছিয়ে নীলিমাকে পুনরায় বেডে শুয়িয়ে দিলো সায়র। অতঃপর সবকিছু গুছিয়ে রাখতে বেড ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ও। তৎক্ষনাৎ পেছন থেকে সায়রের আঙুলটা টেনে ধরে অস্পষ্ট গলায় নীলিমা বললো,
— আমার শীত করছে, এখানে অনেক ঠান্ডা। জলদি আসুন।

সায়র ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখতে পেলো, সত্যিই নীলিমার চিবুক কাঁপছে থরথরিয়ে, মনে হয় জ্বরটা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, অথচ নীলিমার শরীরে দু’দুটো কম্ফোর্টার।

সায়র ব্যাচেলর মানুষ, নীলিমাকেও এনে উঠিয়েছে নিজের ছোট্ট এপার্টমেন্টে, এখনো জিনিসপত্র সেরকম কিছুই কেনা হয়নি, বাসায় আর কোনো কম্ফোর্টারও নেই, এদিকে সায়রের নিজেরও শীত করছে আর নীলিমাও শীতে অস্থির হয়ে উঠেছে, কি করা যায় এখন? সেই ভেবে, পরিশেষে নিজেদের পরিস্থিতি পরখ করে, সায়র অনেক কিছু ভেবেচিন্তে আজ প্রথমবারের মতো নীলিমার সাথে এক বিছানায় এক কম্ফোর্টারের নিচে শুয়ে পরলো। সঙ্গে সঙ্গে আদুরে বিড়াল ছানার মতো ওর বুকের মধ্যে এসে ঠায় নিলো নীলিমা।

নীলিমা এভাবে কাছে আসায় সায়র একটুও ইতস্তত বোধ করলো না।আর নাতো, ওর মাঝে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো কোনো অবাধ্য পুরুষালী ইচ্ছে।উল্টো নীলিমার কম্পনরত শরীরটাকে নিজের বুকে আগলে নিয়ে ওর উষ্ণতা ছড়িয়ে দিতে লাগলো নীলিমার সর্বাঙ্গে,কিছুক্ষণ যেতেই নীলিমা কাঁপা-কাঁপি থামিয়ে একটু শান্ত হয়ে এলে সায়র ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে হিসহিসিয়ে শুধালো,
— এখন ভালো লাগছে?

নীলিমা প্রথমে হ্যা না দু’দিকেই মাথা নাড়ালো, অতঃপর কোনোরকম কথা বার্তা ছাড়াই সায়রকে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বানিয়ে দিয়ে, নিজের শরীরের উপরিভাগে এটে থাকা সবটুকু সম্ভ্রম টেনেটুনে খুলে ফেললো। নীলিমার এহেন কান্ডে সায়র চোখ বড়বড় করে দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠলো ,
—- এই মেয়ে কি করছো তুমি? আমি এসব জীবনেও দেখিনি, এক্ষুনি ঢাকো।

সায়রের কথার দু’পয়সা পাত্তা না দিয়ে ওকে পুনরায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নীলিমা বিড়বিড়িয়ে বললো,
— গরম লাগছে তো।

—কি আজিব মুড সুইং রে বাবা, একটু আগে শীত শীত করে মাথা খারাপ করে ফেলছিল, এখন আবার হুট করেই গরম লাগছে।

মনেমনে হাজারটা যুক্তি দাড় করালেও বস্তুত সায়র এই মূহুর্তে কথা বলার অবস্থাতেই নেই, ও নিজের হাত-পা, দাঁত সবকিছু খিঁচিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে, এক্ষুনি পানি খাওয়া প্রয়োজন, নীলিমার তুলতুলে শরীরের স্পর্শে ক্রমশ একটা ভেজা নরম অনুভূতি ছড়িয়ে পরছে সায়রের মন মস্তিষ্ক জুড়ে, সেই ছড়িয়ে পরা বেসামাল অনুভূতির জোয়ারে কাবু হয়ে যাচ্ছে সায়রের ভালো মানুষী সত্তাটা, ওর হৃদয়টা অবাধ্য কিছুর আস্কারা দিয়ে যাচ্ছে বারবার।

কিন্তু সেটাতো সম্ভব নয়, নীলিমা এমনিতেই জ্বরের ঘোরে বুদ হয়ে আছে, তারউপর সম্পর্কটা এখনো এতোটা স্বাভাবিক হয়নি,অগত্যা উপয়ান্তর না পেয়ে সায়র দু-হাত মুঠি বদ্ধ করে দাঁত খিঁচিয়ে নিজের মনটাকে ধমকাচ্ছে ক্রমাগত, নিজেকেই নিজে চোখ রাঙিয়ে বলছে,
—- কন্ট্রোল সায়র, কন্ট্রোল ইওর সেল্ফ, তুই হলি জেন্টেল ম্যান, তুই কেন জেকের মতো অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিস, কট্রোল, কট্রোল,কন….

এভাবেই কন্ট্রোল বুলি আওরাতে আওরাতে কখন যে সায়র নিজেও উন্মুক্ত নীলিমাকে দু’হাতে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমের দেশে পারি জমিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
*************************************************

সেদিনের ঘটনার আজ প্রায় একসপ্তাহ হতে চললো। সেই যে অরু ঘর মেড়েছিল আজ অবধি আর বের হয়নি, কেউ খাবার দিয়ে গেলে খেয়েছে, নয়তো না।

এর মাঝে অনু অনেকবার এসেছিল অরুর সাথে একটু কথা বলতে কিন্তু প্রত্যেকবারই দরজার বাইরে থেকে ফিরে যেতে হয়েছে ওকে। এক কথায় অরু নিজেকেই নিজে ঘরবন্দী করে ছেড়েছে। অরুর দুচোখে সব কিছু ধোঁয়াসা, ও ক্রীতিককে দেখতে চায়, ক্রীতিককে ছুঁতে চায়, ক্রীতিকের কন্ঠস্বর শুনতে চায়, কিন্তু কিভাবে?

ক্রীতিক যে সেই সূদুর আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটের সানফ্রান্সিসকো শহরে রয়েছে। আর অরু এখানে ক্রীতিক কুঞ্জে। নিজের মা বোনের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েছে অরুর,তাদের কাছে কখনোই সাহায্য চাইবে না ও। ওদিকে চেনা জানা কারোর থেকে সাহায্য চাইবে তেমন কেউই নেই ওর জীবনে। কেইবা ওকে সাহায্য করবে অতো দূরের গন্তব্য পৌঁছাতে? সবাই তো আর ক্রীতিক নয়, যে অরু মুখ দিয়ে আ করলো অমনি সেটা মঞ্জুর হয়ে গেলো।

এক আকাশ পাতাল চিন্তায় জর্জরিত হয়ে সবসময় গুমোট হয়ে থাকে অরুর মন মস্তিষ্ক, ও ধরেই নিয়েছে ওর আর ক্রীতিককে দেখা হবে না। এই যে দেখা হবেনা, এটা ভাবলেই প্রচন্ড রকম য’ন্ত্রনা শুরু হয়ে যায় বুকের মাঝে, নিজের অজান্তেই মেয়েটা ছটফট করে ওঠে তৃষ্ণার্থ চাতকের মতো। অথচ সামনে পেছনে, ধারে দূরে, একটু খানি মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দেওয়ার মতো কেউ নেই ওর, কেউনা।

ডোরাকে কোলে নিয়ে সেই কখন থেকে বসে আছে অরু। ওর ভাবনারা যেন অন্তহীন। অরুর দুঃখ গুলো বোঝার সাধ্যি নেই ডোরার, ও শুধু উপলব্ধি করতে পারে অরুর ভারী দীর্ঘশ্বাস। এই যেমন এখন, ধীরে ধীরে নিঃশ্বাসের পাল্লা ভারী হয়ে উঠছে অরুর, আর ওর কোলে বসে বসে আনমনে মাথা ঘষছে ডোরা, এমন সময় বাইরে থেকে কড়া নেড়ে একজন ভৃত্য জানায়,সে দুপুরের খাবার নিয়ে এসেছে ।

বুক চিড়ে ভেতরের আহত বাতাসটুকু বের করে দিয়ে, অরু ডোরাকে রেখে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই লোকটা ভেতরে প্রবেশ করে টেবিলের উপর খাবার সাজিয়ে রেখে ফিরে যেতে যেতে বলে,
—- আফা জলদি খায়া লয়েন,নাইলে অনু আফায় আবার আমার লগে চ্যাত দেহাইবো,

অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে লোকটাকে বিদেয় জানায়, লোকটা চলে যেতেই অরু পুনরায় দরজা লাগাতে যাবে ঠিক তখনই দরজা ঠেলে হুট করে ভেতরে প্রবেশ করে রেজা। রেজার কর্মকান্ডে অরু বিস্মিত হয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,
— এটা কোন ধরনের ম্যানার রেজা ভাই? আপনি এক্ষুনি বের হন আমার রুম থেকে।

অরুর কথা কানে নিলোনা রেজা, সে এগিয়ে গিয়ে ডিভানে পায়ের উপর পা তুলে বসে, কৌতুক হাসি দিয়ে বললো,
—- তোর সৎ ভাই ওরফে নাগর,জায়ান ক্রীতিক, সে-তো দেশে নেই, শুধু তাই নয়, বিদেশ থেকেও এখানে এসে আমাকে মা’রার ক্ষমতা এখন আর তার নেই, তবুও এতো তেজ কোথায় পাচ্ছিস?

রেজার কথায় মস্তিষ্কটা মূহুর্তেই টগবগিয়ে উঠলো অরুর, ও দু’কদম এগিয়ে গিয়ে রেজার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তুলে বললো,
— আপনি এখন যেখানে পায়ে পা তুলে বসে আছেন, সেই গদিটাও ওনার টাকায় কেনা, তাই ভালোয় ভালোয় বলছি মুখ সামলে কথা বলুন। আপনার সাহস হলো কি করে আমার রুমে আসার?

অরুর কথা শেষ হতেই রেজা ওর আঙুলটা ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে অরুকেও ডিভানে বসিয়ে দিলো, অতঃপর ওর দিকে খানিকটা ঝুঁকে গিয়ে বললো,
—- প্রথমে জায়ান ক্রীতিকের বউকে বিয়ে করবো, তারপর দেখাবো এই রেজার সাহস আদতে কতখানি।

রেজার কথায় অরু ঘৃ’নিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্রুদ্ধ স্বরে বলে ওঠে,
— আপনি না আপাকে ভালোবাসতেন? এই ক’দিনেই ভালোবাসা শেষ হয়ে গেলো?

অরুর কথায় রেজা তাচ্ছিল্য করে হেসে বলে,
— ভালোবাসা মাই ফুট, ওর থেকেও আমার তোকে বেশি ভালো লাগে, আমি জানি তুই ভা’র্জিন না,কিন্তু তাতে আমার যায় আসেনা বিশ্বাস কর।

রেজার কথাগুলো বলতে বাকি, সঙ্গে সঙ্গে ওর গাল বরাবর চোখ মুখ খিঁচিয়ে শক্ত চড় বসাতে দেরি হলোনা অরুর। চ’ড় মে’রে ওর দিকে অ’গ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে অরু বললো,

—- আপনি আমার দিকে যে নোং’রা দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন, তার শা’স্তি সরূপ আপনার চোখ দুটোই তুলে দেবে জায়ান ক্রীতিক, শুধু অপেক্ষা করুন।

এমনিতেই জায়ান ক্রীতিকের মা’র খেয়ে খেয়ে ভর্তা হয়ে গিয়েছে রেজার শরীরটা, তার উপর অরু কথার মাথায় শুধু জায়ান ক্রীতিকের বয়ান করছে। যে মানুষটা হাজার মাইল দূরে হসপিটালের বেডে পরে আছে, তার উপর এখনো কি ভরসা মেয়েটার।

ব্যাপারটা বুঝে আসতেই র’ক্ত চ’ড়ে উঠলো রেজার মাথায়, জায়ান ক্রীতিকের উপর এতোদিন ধরে দমিয়ে রাখা সুপ্ত প্রতিহিং’সার আ’গুনটা মূহুর্তেই দা’উদাউ করে জ্বলে উঠলো মস্তিষ্কে, সঙ্গে সঙ্গে খেইর হারালো রেজা, একহাত দিয়ে অরুর চুলগুলো মুঠি বদ্ধ করে, কঠিন গলায় বললো,
—- বুঝেছি, যেটা আর কয়েকদিন পরে করতাম সেটা এখনই করতে হবে, প্রতি’শোধ তো আমি নিতামই অরু,কারন তুইই হলি আমার প্রতিশো’ধের মোক্ষম অ’স্র। তোকে কিছু বলা বা করা মানেই জায়ান ক্রীতিকের কলিজায় আ’ঘাত করা, তবে এতো তাড়াতাড়ি এই সূবর্ণ সুযোগটা পেয়ে যাবো সেটা আমি আশা করিনি ।

রেজার কথা শুনে এবার মুখ থেকে র’ক্ত সরে গেলো অরুর, ও আত’ঙ্কিত চোখে রেজার দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বললো,
—- রুম থেকে এক্ষুনি বেরিয়ে যান, নয়তো খুব খারাপ হবে।

রেজা কুটিল হেসে নিজ পাঞ্জাবির বোতাম গুলো খুলতে খুলতে বললো,
— কেন? খারাপ কেন হবে? সৎ ভাইয়ের সাথে যা করতে পেরেছিস, তা মামাতো ভাইয়ের সাথে করলে কি সমস্যা? মানছি তোর সৎ ভাই একটু বেশিই সুদর্শন,কিন্তু তাতে কি? চেয়ে দেখ, তোর সৎ ভাইয়ের থেকে আমার বয়স কম।

—- ওনাকে সৎ ভাই বলে বলে আপনি মোটেও আমাকে দূর্বল করতে পারবেন না , উনি আমার স্বামী, উপর ওয়ালার নাম নিয়ে তিন কবুল বলে বিয়ে করেছেন উনি আমায়। আর নিজেকে জায়ান ক্রীতিকের সাথে তুলনা করা বন্ধ করুন, তার নখের যোগ্যতাও নেই আপনার।

কথাটা বলে রেজাকে দু’হাতে ধা’ক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো অরু, তারপর তাড়াহুড়ো করে ডিভান থেকে উঠে গিয়ে পা বাড়ালো বাইরের দিকে, কিন্তু যেতে আর পারলো না, তার আগেই ওর টপস এর কলারটা শ’ক্ত হাতে টেনে ধরলো রেজা, একটানে অরুকে নিজের কাছে এনে দাঁড় করিয়ে ওর দিকে চোখ রাঙানো দৃষ্টিপাত করে বললো,
—- আমার হাত যে ঠিক কতটা লম্বা তা তুই কল্পনাও করতে পারবি না অরু, তাই ভালোয় ভালোয় বলছি চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পর।

এবার সত্যি সত্যি ভ’য় পাচ্ছে অরু, এই মূহুর্তে এরকম একটা বাজে পরিস্থিতিতে পরে ওর অন্তরা’ত্মা থরথরিয়ে কাঁপছে, এতোটা সাহস দেখিয়েও রেজাকে দমানো যাচ্ছেনা মোটে,সেই ভেবে অপারগ অরু এবার সত্যি সত্যি ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো, রেজার থেকে নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে বললো,
— ছেড়ে দিন, ভালো হবেনা একদম, এই পা’পের চরম শা’স্তি পাবেন আপনি।

—- যখনের পাপ তখন দেখা যাবে, এখন এনজয় করি, কি বলিস?

ক্রুর হেঁসে কথাটা বলে রেজা যখনই অরুর কাছাকাছি আসতে উদ্যত হয়, ঠিক তখনই ওর গাল বরাবর আঁচড়ে পরে একটা শক্ত পোক্ত হাতের চপেটাঘা’ত । ভীষন জোরে থা’প্পর খেয়ে তাল সামলাতে না পেরে দু কদম পিছিয়ে যায় রেজা, সঙ্গে সঙ্গে ওর অন্য গালে আবারও চ’ড় বসিয়ে দিলো আগন্তুক।

থা’প্পড় খেয়ে রেজা ধরাশায়ী হয়ে তাড়াহুড়ো করে রুম ত্যাগ করলো। ও সরে যেতেই অরু দেখতে পায় অনু দাঁড়িয়ে আছে ওর মুখ বরাবর। রাগের তোপে রক্তিম হয়ে উঠেছে অনুর সমগ্র মুখশ্রী। যেন এখনি রেজাকে সর্বেসর্বা বিনাশ করবে ও। ওদিকে অনুকে দেখা মাত্রই এক ছুটে ওর বুকের উপর এসে হুমড়ি খেয়ে পরলো অরু। শব্দ করে কেঁদে উঠে অতি আপন সুরে ডাকলো অনুকে,
—- আপায়ায়া..
*

বিকেল ছাপিয়ে গোধূলির আভায় ছেয়ে গিয়েছে চারিপাশ, বাড়ির পেছনে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শুনেই বোঝা যাচ্ছে আরেকটু পরে সন্ধ্যা আঁধারের পর্দা টেনে রাত নেমে আসবে ধরনী জুড়ে। তখনও গলির মাথা থেকে ভেসে আসছে মুয়াজ্জিনের সুমধুর আহ্বান, বোধ হয় আসরের সালাতের সময় হলো।

অনুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে, নিস্প্রভ চোখে বাইরে চেয়ে আছে অরু । ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে অনুও তাকিয়েছিল এতোক্ষণ, হয়তো অরুকে একটু স্বাভাবিক হয়ে ওঠার জন্য সময় দিচ্ছিল, কিন্তু এখন তো অনুকেও বাড়ি ফিরতে হবে, তাই কোনোরূপ সময় নষ্ট না করেই হাত বাড়িয়ে অরুর চোখের সামনে পাসপোর্ট ভিসা আর বোডিং পাসের কাগজ গুলো এগিয়ে দিলো অনু।

চোখের সামনে পাসপোর্ট দেখতে পেয়ে হকচকিয়ে উঠে বসলো অরু, অতঃপর সেগুলোকে হাত দিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে বিস্মিত চোখে অনুর পানে তাকিয়ে অরু শুধালো,
—- এগুলোতো আমার, তুই এগুলো কিভাবে? না মনে…

অরুর কথার মাঝপথে অনু মুচকি হেসে ওর কপোলে হাত বুলিয়ে জানায়,
— প্রত্যয় সাহায্য করেছে, এই সপ্তাহেই তোর ফ্লাইট, ক্রীতিক ভাইয়ার কাছে চলে যা অরু, তার তোকে প্রয়োজন।

অরু ছলছল চোখে একবার কাগজ গুলোর দিকে তো একবার অনুর দিকে তাকাচ্ছে, কোনোমতে গলার মাঝে কা’ন্নাটা আটকে রেখে অবিশ্বাসের সুরে ও বলে উঠলো,
— আপা তুই জোগাড় করেছিস এগুলো? কিন্তু তুই তো,

অনু এবার টান মে’রে অরুকে বুকের মাঝে নিয়ে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
— আমি জানি তুই খালি মুখে আমার কোনো কথায়ই শুনতে রাজি না,তাই ভাবলাম অ’পরাধ যেহেতু করেছি প্রায়শ্চিত্তটাও আমিই করি, কিন্তু তুই’ই বল? ক্রীতিক ভাইয়ার ওমন অবস্থা শুনলে তুই আদৌও ঠিক থাকতে পারতিস?

অরু মাথা তুলে অনুর চোখে চোখ রেখে শুধালো,
—- কি হয়েছিল আপা?

অনু বলে,
—- ক্রীতিক ভাইয়ার এর আগেও নাকি এ’ক্সি’ডেন্ট হয়েছিল ইউ এস এ বসে, তখনই ওনার ব্রেইন সেলস গুলো আহত ছিল, র’ক্ত জমেছিল অনেকদিন ধরে, আর দ্বিতীয়বার সেই একই যায়গায় আঘাত প্রাপ্ত হওয়ায় ওনার আর বাঁচার সম্ভাবনা ছিলনা, এমনকি তোর যখন জ্ঞান ফিরলো তখনও ক্রীতিক ভাইয়ার অবস্থা ছিল বেশ ক্রি’টিক্যাল,ওনাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল অনেকদিন। আর তখন তো তুইও অসুস্থ ছিলি, এমন একটা সময়ে যদি তোকে এসব জানাতাম তুই ঠিক থাকতিস বল?

ক্রীতিকের বিগত দের দু’মাসের মাসের কন্ডিশন শুনে অরুর কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গিয়েছে, শ্বাস টেনে তুলতে পারছে না মেয়েটা। তবুও অস্পষ্ট আওয়াজে অনুকে বললো,
— আপা, এসব কি বলছিস তুই? উনি এতোটা কষ্ট কিভাবে সহ্য করেছেন? আমাকে কেন নেওয়া হলোনা ওনার সাথে?

অনু ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— ওনার বন্ধুরা নিতে চেয়েছিল তোকে, কিন্তু মা যেতে দেয়নি, তাছাড়া এমন একটা পরিস্থিতি যে কারোরই কথা বাড়ানোর উপায় ছিলনা।

অরু কাঁদছে খুব, অনু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে পুনরায় বললো,

— এখনো আপার উপর রা’গ করে থাকবি?

অরু অকস্মাৎ অনুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে এদিক ওদিক না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
— একটুও না, তুই বেস্ট আপা, তোর মতো আপা দু’টো নেই। তুই আমার মা হলিনা কেন বলতো?

অরুর ক্রন্দনরত কথার পাছে অনু শুধু মিষ্টি করে হাসলো তারপর হাসতে হাসতেই বললো,
— ইউ এস এ ফিরে আমার স্বামীটাকে কান ধরে প্লেনে তুলে দিবি মনে থাকে যেন, তোর স্বামীর সেবা করতে করতে আমার স্বামীটা শুকিয়ে গেলো বোধ হয়।

অনুর কথা শুনে অরু এবার কাদঁতে কাঁদতেই ফিক করে হেঁসে দিলো।

আজ কতগুলো দিন বাদে অরু একটু হাসলো, কালো মেঘের বর্বরতা ছাপিয়ে মেঘের চাদর ভেদ করে একটু খানি আলোক ছটা উঁকি দেওয়ার মতোই, অরুর একটু খানি হাসিতে মূহুর্তেই প্রফুল্লতায় সজীব হয়ে উঠলো অনুর হৃদয় মন সবকিছু। অবশেষে নিজেই নিজেকে বাহবা দিয়ে মনে মনে আওড়ালো অনু,
—- আমি আপা হিসেবে ওতোটাও খারাপ নই।

*************************************************

নদীর স্রোতের মতোই সময় বয়ে যায়, বহমান সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে আজ আবারও জীবনে দ্বিতীয় বারের মতো আমেরিকার মাটিতে পা রাখলো অরু।

তবে আজ আর আপার সাথে নয়,বরং একাই এসেছে অরু। একা এসেছে বললে ভুল হবে, মনের মাঝে অনেকটা সাহস আর আত্মবিশ্বাস ধরে রেখে আসতে হয়েছে অরুকে।

জীবনের কিছু কিছু পরিস্থিতিতে যেমন উপরওয়ালা ছাড়া কেউ পাশে থাকেনা, অরুর জন্য একাকী ইউ এস এ তে আসাও তেমনই একটা জীবন যু’দ্ধ ছিল, যা অরু অত্যন্ত সাহসীকতার সাথে পার করে এসেছে, আর এখন উবারে করে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রীতিকের সেই নির্জন শহরতলীর দিকে,যেখানে ওদের প্রথম প্রেমের সূচনা হয়।

যদিও অরু জানেনা ক্রীতিক আদৌও বাড়িতে নাকি হসপিটালে, এদিকে নতুন কেনা ফোনটাও চার্জের অভাবে বন্ধ হয়ে আছে,প্রত্যয়ের সাথে যোগাযোগ করার উপায়টাও নেই।
তবুও বাড়ির পাসওয়ার্ড তো অরুর জানা, সেই হিসেব মতে এয়ার্টপোর্ট থেকে বেরিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যেই রওনা হয়েছে ও। এখনো অনেকটা পথ যাওয়া বাকি, যদিও অরু আমেরিকাতে কিন্তু এই মূহুর্তে ওর মনটা পরে আছে সূদুর ক্রীতিক কুঞ্জে। কাল আসার আগ মূহুর্তের প্রত্যেকটা ঘটনা মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে বারবার। সেসব ভাবতে ভাবতেই গাড়ির ব্যাক সিটে ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিলো অরু।

কাল যখন অরু নিজের ট্রলি সমেত বেরিয়ে যাচ্ছিল, আজমেরী শেখ কেন যেন তখনো নিশ্চুপই ছিলেন।বোধ করি, তার দাম্ভিকতা,তার জিদি মানসিকতা কিছুটা হলেও ক্ষীণ হশে এসেছে এতোদিনে। তবে বিগত কয়েকদিন আগের ঘটনার প্রেক্ষিতে অরু আর নিশ্চুপ ছিলনা, এগিয়ে গিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে অশ্রুকণা বিসর্জন দিতে দিতে ক্রদ্ধ গলায় বলেছিলো,
— আমি চলে যাচ্ছি মা, পারলে দোয়া করলো, না পারলে প্রয়োজন নেই, তবুও একটু শান্তিতে থাকতে দিও। অনেক তো হলো, এবার নাহয় আমাকেই আমার জীবনটা বুঝে নিতে দাও।

মেয়ের কথার পাছে আজমেরী শেখ টু শব্দটিও করেনি। মায়ের স্থির মূর্তির দিকে দৃষ্টিপাত করে অরু পুনরায় বলে,
— যেদিন তুমি তোমার ভাইয়ের পরিবারকে পুরোপুরি ত্যাগ করতে পারবে, সেদিন জানিও, আমি চলে আসবো।

এবারে গভীর গলায় ছোট্ট করে উত্তর দিলেন আজমেরী শেখ

—- ভালো থেকো।

মায়ের মুখ থেকে “ভালো থেকো” শব্দটা শুনে অরুকি একটুও কষ্ট পায়নি? পেয়েছে তো। তবে ও সেটা নিছকই আন্তরিকতা ভেবে উড়িয়ে দিলো। অতঃপর অনুর কাছে এগিয়ে গিয়ে ডোরাকে অনুর হাতে তুলে দিয়ে বললো,
—- আমার মেয়েটাকে দেখে রাখিস আপা।

ডোরার মাথায় হাত বুলিয়ে অনু মৃদু হেসে বললো,
— তোর মেয়ে?

অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো,
— পিতা মহামান্য জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী, আর মাতা মহোদয়া অরোরা জায়ান।

*
হঠাৎ গাড়িতে ব্রেক কষায় সম্বিত ফিরে পেলো অরু, তন্দ্রা ছুটে গিয়ে হকচকিয়ে উঠে ড্রাইভার কে উদ্দেশ্য করে বললো,
— হোয়াট হ্যাপেন?

ড্রাইভার জানালো ওরা গন্ধব্যে এসে গিয়েছে।
কথাটা শোনা মাত্রই অরুর হৃদস্পন্দন দিগুণ তালে বেড়ে গেলো, ও খেয়াল করলো হৃদস্পন্দনের সমান তালে ওর হাত পা গুলোও কাঁপছে, খুশিতে নাকি ভ’য়ে, কে জানে?

অবশেষে সকল জল্পনা কল্পনার ইতি টেনে, অনেকটা সময় নিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করে, লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো অরু। সন্ধ্যা রাত, তবে ল্যামপোস্টের আলোয় চারিদিক ঝকঝকে পরিস্কার, সেই পরিস্কার আলোতেই অরু স্পষ্ট দেখলো এটা ক্রীতিকের বাড়ি নয়, কিংবা সেই রাস্তাও নয়, তাহলে এটা কোথায়? কথাটা ভাবতেই আ’তঙ্কে রক্তশূণ্য হয়ে গেলো অরুর মুখ চোখ, ও চকিতে পেছনে ঘুরে লোকটাকে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই দৃশ্যগত হলো কালো জ্যাকেট পরিহিত বয়স্ক গোছের আর একটা লোক। ল্যামপোস্টের আলোয় লোকটার চেহারা স্পষ্ট দেখতে পেয়ে অরু অস্ফুটে বলে উঠলো,
— বাব…. উমমম।

অরুর মুখ থেকে শব্দটা উচ্চারিত হওয়ার আগেই গ্লাভস পরিহিত লোকটা,ওর মুখের উপর সাদা রঙের রুমাল জাতীয় কিছু একটা চেপে ধরে, সঙ্গে সঙ্গে অবচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে অরুর ক্লান্ত পরিস্রান্ত অসার শরীরটা।

*************************************************
— এক্সকিউজ মি স্যার, ইউ কান্ট স্মোক রাইট নাও।

কথাটা বলে ক্রীতিকের হাত থেকে দিয়াশলাই আর সিগারেটটা নিয়ে চলে গেলো সিস্টার।
ক্রীতিক সেদিকে তাকিয়ে চোখমুখ শক্ত করে একটা বিরক্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। অতঃপর উঠে চলে গেলো কেভিনের ড্রেসিং রুমে।

শারীরিক দিক থেকে এখন মোটামুটি ফিট আছে ক্রীতিক, তবে ট্রিটমেন্ট এখনো শেষ হয়নি, যার দরুন প্রত্যয় ওকে ধরে বেধে হসপিটালে রেখে দিয়েছে। এখন দিন রাত এখানে শুয়ে থেকে স্যালাইন নাও, সকাল বিকাল বডি টেস্ট করাও, সিটি স্ক্যান করাও এসব নিয়ে বেশ বিরক্ত ক্রীতিক, এই যে সন্ধ্যা বেলা স্যালাইন শেষ হয়েছে বলে ছাড়া পেয়ে একটু স্মোক করতে চাইলো, সেটাও কে’ড়ে নিলো সেবিকা সাহেবা, বিরক্তিকর।

ক্রীতিক ড্রেসিং রুম থেকে জামা কাপড় বদলে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বের হতেই দেখলো প্রত্যয় হাজির, তবে ওকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে, ওর উদ্বিগ্ন চেহারা দেখে ক্রীতিক কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই প্রত্যয় বললো,
—- হঠাৎ চেঞ্জ করলেন কেন ভাই?

— বাড়িতে ফিরবো।

ছোট্ট করে উত্তর দিলো ক্রীতিক,কিন্তু ওর উত্তরে খুশি হতে পারলো না প্রত্যয়,সহসাই ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে উঠলো,
— বাড়ি ফিরবেন মানে? আপনার ট্রিটমেন্ট এখনো শেষ হয়নি।

ক্রীতিক ক্যানোলা হাতেই শার্টের হাতাটা ফোল্ড করার দূরহ চেষ্টা করতে করতে বললো,
—- আমি ফিট আছি, আর ট্রিটমেন্টের দরকার নেই, বাড়িতে গেলেই ঠিক হয়ে যাবো।

প্রত্যয় জোর গলায় বললো,
— বললেই হলো ফিট আছেন? ডক্টর বলেছে আপনি ফিট নেই আরও ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন। আগের বারও এমন করেছেন, এবার আর আমি আপনাকে যেতে দিচ্ছি না।

— যা ট্রিটমেন্ট বাকি আছে সব বাসায় গিয়ে করবো, এখানে আর এক মূহুর্ত ও নয়।

ক্রীতিকের কথার পাছে প্রত্যয় কিছু বলবে, তার আগেই ওর ফোনটা বেজে ওঠে তারস্বরে। তৎক্ষনাৎ প্রত্যয় এক প্রকার হুমড়ি খেয়ে পরে ফোনের উপর, ওপাশ থেকে কে কি বলেছে শোনা না গেলেও, এপাশ থেকে প্রত্যয় বললো,
— ওহ শীট, এখনো পাওনি? দেখো আশেপাশে খোঁজো পেয়ে যাবে, ওর ফোনটাও বন্ধ।

প্রত্যয়ের কথায় ভাঁজ পরলো ক্রীতিকের চওড়া কপালে, ও এগিয়ে এসে গভীর গলায় শুধালো,
— কি হয়েছে? কাকে পাওয়া যাচ্ছেনা?

প্রত্যয় একটা শুষ্ক ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে ওঠে,
— ভাই আসলে অরু,

অরুর নামটা শোনা মাত্রই ক্রীতিক দু’হাতে প্রত্যয়ের কলার চেপে ধরে উদ্বিগ্ন স্বরে বললো,
— অরুর কি হয়েছে?

প্রত্যয় এবার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কিছু না বলে ক্রীতিককে খুলে বললো সবটা, সব শুনে ক্রীতিকের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো, ও দুশ্চিন্তা গ্রস্থদের মতো নিজের কপালে আঙুল বোলাতে বোলাতে প্রত্যয়কে ঝাড়ি দিয়ে বললো,
—- ওহ মাই গুডনেস, আর ইউ ফা’কিং কিডিং মি প্রত্যয় এহসান? আমার বউ ইউ এস এ তে আসছে অথচ আমি জানিনা, আমাকে আগে জানাওনি কেন, হোয়াই?

প্রত্যয় আতঙ্কিত স্বরে বলে,
— কোম্পানির কাজে নিজে যেতে পারিনি বলে, গাড়িও পাঠিয়েছি আমি, কিন্তু…

— শাট আপ!

ক্রীতিকের ক্রুদ্ধস্বরে থেমে গেলো প্রত্যয়, ক্রীতিক কয়েক মিনিট ধরে থম মে’রে বসে কিছু একটা ভাবলো, অতঃপর শার্টের বোতাম গুলো খুলতে খুলতে প্রত্যয়ের উদ্দেশ্যে বললো,
— তোমার হুডিটা খোলো, ফাস্ট।

তৎক্ষনাৎ দু’হাত আড়াআড়ি করে বুকের উপর চেপে ধরে প্রত্যয় কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
— কি বলছেন ভাই এসব?

ক্রীতিক শার্ট খুলে হাতের ক্যানোলাটা টেনে হিঁচড়ে খুলতে খুলতে বললো,
— ঢং বাদ দিয়ে যা বলছি তাই করো।

অগত্যা উপায়ন্তর না পেয়ে নিজের সম্ভ্রমটুকু খুলে ক্রীতিকের হাতে তুলে দিলো প্রত্যয়।

হুডিটা গায়ে চড়িয়ে, মাথার বাজ কাট স্টাইলের চুল আর সেলাইলের দাগগুলো ক্যাপের সাহায্যে ঢেকে নিলো ক্রীতিক, তারপর প্রত্যয়ের ফোন, এয়ার প্ল্যাগ আর গাড়ির চাবি হাতিয়ে নিয়ে, প্রত্যয়কে রোগী বানিয়ে রেখে আস্তে করে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে পরলো ও। দুনিয়া উল্টে গেলেও হয়তো অরুকে খোঁজার জন্য বেরিয়ে যেতো ক্রীতিক, সেখান এখন তো সে বেশ ভালোই সুস্থ।

গাড়িতে বসে ড্রাইভ করতে করতে কানে এয়ারপ্ল্যাগ লাগিয়ে সবার আগে ক্রীতিক কল দিলো অর্ণবকে, ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই কোনো রকম আজেবাজে কথায় না গিয়ে ক্রীতিক সরাসরি বললো,
— একটা নাম্বার দিচ্ছি, এস সুন এস পসিবল লোকেশনটা ফরওয়ার্ড কর আমায়।

যেহেতু ক্রীতিকের ভাব ভঙ্গিমা ছিল বেশ সিরিয়াস, তাই অর্ণব ও আর বেহুদা প্রশ্ন করলো না, বরং ক্রীতিকের কথায় সায় জানিয়ে কল কেটে তাড়াহুড়ো করে লেগে পরলো কাজে।

ক্রীতিক এই মূহুর্তে বাড়ির দিকেই যাচ্ছিল, কারন অরু যদি ক্যাব নিয়ে এগোয় তাহলে বাড়িতেই গিয়েছে, তবে মাঝপথে হঠাৎ করেই ফোনে টুংটাং আওয়াজ তুলে লোকেশন ট্র্যাকিং এর ম্যাসেজ আসায়, গাড়ির স্পিড কিছুটা কমিয়ে আনলো ক্রীতিক, অতঃপর ফোন হাতে নিয়ে লোকেশনটায় একনজর চোখ বোলাতেই মুখের আদল শক্ত হয়ে এলো ওর। চোখ দুটো রঙ পাল্টে ধারণ করলো হিং’স্র বাঘের রূ’প।

পরমূহুর্তেই গাড়ি ঘুরিয়ে রাস্তা বদলে স্পিডোমিটারে একশোর উপর গতি তুলে হুঁশশ করে চোখের আড়াল হয়ে গেলো ব্ল্যাক মার্সিডিজ গাড়িটা।
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here