সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁 #পর্বঃ৫৩ #লেখনীতে_suraiya_rafa

0
536

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ৫৩
#লেখনীতে_suraiya_rafa

(ক,পি করা নিষিদ্ধ 🚫)
(কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য)

আমেরিকাতে এখন পুরোদমে গ্রীষ্মকাল। যে কারনে ঘড়ির কাঁটা আটের ঘরে গিয়ে ঠেকলে তবেই সূর্যাস্ত হয় এখানে। বাংলাদেশে তো আটটা মানে নিশুতি রাত, সেখানে আমেরিকাতে আটটার সময় ও মিয়িয়ে যাওয়া সূর্য কীরণে ঝকঝক করছে চারিপাশ।সূর্যের আলো আর, হু হু বাতাস, দুটোই এখানে মাত্রাতিরিক্ত। তবুও যেহেতু আটটা বেজে গিয়েছে তাই সন্ধ্যা নামার মূহুর্ত এখন।

এদিক দিয়ে ছেলে পেলেরা সব বাস্কেটবল, বেজবল খেলে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরেছে, ঠিক তার বিপরীত দিকের রাস্তা ধরে বাতাসের বেগে এগিয়ে যাচ্ছে ব্ল্যাক মার্সিডিজটা। ক্রীতিক এতো দ্রুত আর উন্মাদের মতো গাড়ি চালাচ্ছে যে গাড়িটা অতিক্রম করার সময় আসেপাশের পথচারীরা থমকে দাঁড়িয়ে যায়, দু’একজন তো চোখের আড়াল হওয়ার পরেও তাকিয়ে থাকে বিস্ময়ে।

একটু আগে অর্ণব যে লোকেশনটা পাঠালো সেটা এদিকেই, এয়ারপোর্ট থেকে বেশ অনেকটা দূরে কোনো এক নির্জন এলাকায়। ক্যালিফোর্নিয়া তে এরূপ নির্জন শহরতলীর অভাব নেই। উঁচুনিচু পাহাড়ের ভাঁজে এখনো এমন অনেক যায়গা রয়েছে, যেখানে মাইলের পর মাইল অতিক্রম করে গেলেও কোনো একটা বসতি খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও বা খুঁজে পাওয়া যায়, হয় সেটা কোনো ফার্মহাউজ,নয়তো নিরবিচ্ছিন্ন কৃষকদের ছোট্ট ছোট্ট কটেজ।

কিন্তু দূর্ভাগ্যবসত অর্ণব কোনো সঠিক লোকেশন পাঠাতে পারেনি, কারণ অরুর ফোনটা বন্ধ,ওর লাস্ট লোকেশন ছিল এই ফাঁকা রাস্তাতেই, আর এই মূহুর্তে সেই নির্জন পাহাড়ি হাইওয়েটা ধরেই তরিৎ বেগে গাড়ি নিয়ে ছুটে যাচ্ছে ক্রীতিক। ওর কপাল জুড়ে দুশ্চিন্তার অনেকখানি ভাঁজ।কিছুদিন আগেই সার্জারি হওয়ার দরুন মাথাটা চিনচিনিয়ে ব্যথা করছে, তবুও সে-সবকিছু বেমালুম ভুলে গিয়ে দক্ষ হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং সামলাচ্ছে ক্রীতিক। কারণ এই মূহুর্তে ওর মস্তিষ্কের চেয়েও হৃদয়ের ব্যথাটা দিগুণ।

—- অরু, হার্টবিট কোথায় তুইই? আমার জন্য কি একটু অপেক্ষা করা যেত না? আমি বেঁচে আছি যেহেতু তোর কাছেই তো ফিরে যেতাম। ইভেন হাউ কুড আই লিভ উইদাউট ইউ?

দুশ্চিন্তাগ্রস্থদের মতো রাস্তার এদিক ওদিক চোখ বোলাচ্ছে আর স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে একমনে বিড়বিড়াচ্ছে ক্রীতিক। ওর কন্ঠ রোধ করে আছে এক অযাচিত ব্যর্থতা।ঠিক এমন সময় এ্যাপল খচিত মুঠো ফোনটা হুট করেই আওয়াজ তুলে বেজে ওঠায় সম্বিৎ ফিরে ফেলো ক্রীতিক। ভ্রম কেটে যেতেই ফোন রিসিভ করে তাড়াহুড়ো এয়ারপ্ল্যাগটা কানে লাগিয়ে আস্তে করে ক্রীতিক বলে ওঠে,
— হ্যালো।

ওই পাশে শুনশান নীরবতা,

ক্রীতিক পুনরায় হ্যালো বললো, এবার আর শান্ত স্বরে নয়, একটু জোরেই।

ক্রীতিক এপাশ থেকে হ্যালো উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে ভেসে এলো ক্রন্দনরত অরুর কাঁইকুই আওয়াজ। ওর কথা স্পষ্ট নয়, শুধু বোঝা যাচ্ছে অরু হিঁচকি তুলে কাঁদছে খুব, তবে ওর গলার স্বরটা ভীষণ অস্পষ্ট, মুখটা বাঁধা হবে হয়তো।

মোবাইলের অপর পাশে অরুকে এভাবে কাঁদতে শুনে অকস্মাৎ হাইওয়ের মাঝখানেই গাড়ির ব্রেক কষলো ক্রীতিক। ওর চক্ষু ছানাবড়া, মস্তিষ্কটা পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে গিয়েছে,কোনোকিছু বুঝে উঠতে না পেরে ক্রীতিক বোকাদের মতো অবিশ্বাসের সুরে ডেকে উঠলো অরুকে,
— অরু! জান আমার।

ক্রীতিক ডেকে উঠতেই খ্যাক খ্যাক আওয়াজের কৌতুক মিশ্রিত হাসি ভেসে এলো ওপাশ থেকে। ওই বিশ্রী হাসির আওয়াজটা কর্ণকূহরে পৌঁছাতেই চোখ মুখ শক্ত হলে গেলো ক্রীতিকের, সন্দেহাতিক চোখ তার রঙ পাল্টালো মূহুর্তেই, হাসির রহস্য ধরতে পেরে কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই ক্রীতিকের সমগ্র মুখশ্রী রাগে রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো,ও তৎক্ষনাৎ দাঁতে দাঁত পিষে গর্জে উঠে বললো,
— হু দ্য হেল আর ইউ ফা’কিং এ্যাসহোল?

ক্রীতিকের রণমূর্তি অনেকেরই ভয়ের কারন, ওর এহেন চেহারা সুরত, আর ধা’রালো কথার ভঙ্গিমা ওর বন্ধুদের কাছেও স্বাভাবিক মনে হয়না কোনোকালেই , অথচ ওপাশের লোকটা ক্রীতিকের এই গর্জন গায়ে পিছলে দিয়ে হাসতে হাসতে বললো,
—- গালিটা বাংলাতেই দাও জামাই বাবাজীবন, আমি বাংলাটা বেশ ভালোই বুঝি।

লোকটার কথায় ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে এলো ক্রীতিকের, ও সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর করে বললো,
— কি চাই? অরুকে কেন কি’ডন্যা’প করেছেন? লিসেন ম্যান, আমার বউয়ের শরীরে একটা নখের আঁচড় লাগলেও আপনার আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে দেবো আমি।

ক্রীতিকের এহেন কঠিন হু’মকির সম্মুখীন হয়েও লোকটার হেলদোল দেখা গেলো না মোটেই, সে কিছুটা রহস্যময় কন্ঠে বললো,
—- এই তো লাইনে এসেছো বাবাজীবন , তোমার বউকে কিচ্ছু করবো না,শুধু আমার একাউন্টে তিন মিলিয়ন ডলার ট্রান্সফার করো, আর তোমার বউকে সহি সালামতে বাড়িতে নিয়ে যাও, নো ওয়ান ইভেন কেয়ারস।

ক্রীতিকের বুঝে আসছে না, বাবা হয়ে মেয়েকে কিভাবে টাকার জন্য কি’ডন্যা’প করতে পারে মানুষ ? তাই ও একটু বিভ্রান্ত গলায় বলে ওঠে,
— মানে?

লোকটা ঠোঁট বাকিয়ে বললো,
—- রেজা বলেছিল বড় মেয়েটাকে কি’ড’ন্যাপ করতে, সেই উদ্দেশ্যেই গিয়েছিলাম বিডিতে,কিন্তু গিয়ে দেখি বড়টা যেমন তেমন, ছোট জামাই আমার টাকার কুমির, তারউপর বিয়ে বাড়িতে আমার মেয়েকে যেভাবে সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দিলে,ওয়াহ!আই ওয়াজ স্পিচলেস, ব্যাস তখনই প্ল্যানটাকে তিনশো ষাট ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুড়িয়ে ফেললাম। কজ, ইউ নো হোয়াট? আমি তোমার মতো বাংলাদেশী ইয়ং বিলিয়নিয়র এর আগে দুটো দেখিনি।

যদিও ক্রীতিক নিজেকে বিলিয়নিয়র দাবি করার একদমই পক্ষপাতি নয়, কারণ এতো ধনদৌলত, প্রতিপত্তি কিছুই ওর দু’হাতে কামানো নয়, সবই পূর্ব পুরুষদের অবদান, ও তো কেবল এসবের একমাত্র উত্তরাধিকারী এই যা।

কিন্তু এই মূহুর্তে ক্রীতিকের কৌশলী মস্তিষ্কটা অন্যান্য চিন্তায় বিভোর, এতোসব ভাবার সময় কোথায়? ও বেশ ভালোই বুঝতে পারছে অরুর বাবা মোটেই মেন্টালি স্ট্যাবল নয়, হতে পারে সাইকোপ্যাথ, তাহলে তো দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেলো, কখন আবার অরুকে রাগের বশে আ’ঘাত করে বসে এই পা’গল।

অনেক কিছু একসঙ্গে ভেবে ক্রীতিক ফোনটা হাতে নিয়ে ফ্রেন্ডস গ্রুপে sos লিখে টাইপ করে ম্যাসেজ করলো, এরপর সেটাকে পুনরায় আগের যায়গায় রেখে দিলো। ওদিকে অনেক্ষন ধরে ক্রীতিকের কোনো সারা শব্দ না পেয়ে লোকটা থমথমে গলায় বলে উঠলো,
—- পুলিশের চিন্তা ভুলে যাও বাবাজীবন, চালাকি করার চেষ্টাও করোনা, চুপচাপ টাকা ট্রান্সফার করো, নয়তো,

থেমে গেলো লোকটা,তার কথার সূত্র ধরে ক্রীতিক বলে উঠলো,
— নয়তো কি?

— মা’র্ডা’র।

কথাটা বলে ক্রন্দনরত অরুর মুখের সামনে আবারও ফোনটা এগিয়ে দিলো সে।

অরুর কান্না শুনে ক্রীতিক এবার হকচকিয়ে উঠলো, আচমকা চেচিয়ে উঠে বললো,
— নো নোহ! ডোন্ট টাচ্ হার, ডোন্ট, ওকেই? আমি ডলার ট্রান্সফার করছি, তার আগে আপনার এ্যাড্রেস দিন, আমি একাই আসবো, আর কেউ নয়।

লোকটা কিছুক্ষন ভাবলো, পরক্ষণেই বললো,
— এ্যাড্রেস পাঠাচ্ছি, বাই এনি চান্স চালাকি করার দুঃসাহসও দেখালে আই সয়ার, হাত পায়ের সবগুলো র’গ কে’টে এখানেই ফেলে রেখে যাবো মেয়েটাকে, মাইন্ড ইট।

— ডোন্ট ডেয়ার টু টাচ হার, এ্যাসহোল!

লোকটার মুখের উপর চেঁচিয়ে কথাটা বললেও অরুর বেলায় বরাবরই ক্রীতিক অপারগ, অবুঝ, আর নাজেহাল , এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। অরুর ক্ষতি হবে সেই শঙ্কায় সত্যি সত্যিই ক্রীতিক সিন্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে টাকা’টা ও দেবে, তবুও যদি অরু অক্ষত থাকে এর চেয়ে স্বস্তির আর কিইবা হতে পারে? সেই ভেবেই ক্রীতিক গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগলো লোকটার পাঠিয়ে দেওয়া গন্তব্যে।

*************************************************

এদিকে জায়ান ক্রীতিক কল কেটে দিতেই লোকটা একমনে খ্যাক খ্যাক করে হেঁসে উঠলো। তার এই বিদঘুটে হাসির আওয়াজ শুনে কান্নাকাটি বাদ দিয়ে আঁতকে উঠল অরু। অরুকে আচমকা লাফিয়ে উঠতে দেখে লোকটা ধীরে ধীরে সময় নিয়ে ঘাড় বাকিয়ে অরুর চোখের দিকে চাইলো,তৎক্ষনাৎ চোখের আ’তঙ্ক ছড়িয়ে পরলো অরুর সমগ্র শরীরে।

লোকটার চোখে অসহ্য রকম হিং’স্র’তা অথচ কথাবার্তার ধরন শান্ত নদীর মতোই ঠান্ডা আর নির্জীব। তার এরকম দু’মুখো আচরণে বারংবার আঁতকে উঠছে অরুর হৃদয়,দেখে মনে হচ্ছে লোকটা চোখ দিয়েই খু’ন করে ফেলবে ওকে,সেই সাথে জ্বালিয়ে দেবে সবকিছু। অরু তখন থেকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দিকে তাকিয়ে আছে দেখে,লোকটা হঠাৎ করেই চোখের পলকে অরুর মুখের সামনে এসে দাড়ালো, লোকটার হঠাৎ এভাবে আগমনে আত’ঙ্কে থরথরিয়ে কেঁপে উঠল অরু, ওর শীড় দাঁড়া অতিক্রম করে গেলো হিমশীতল ঠান্ডা স্রোত। না চাইতেও বেঁধে রাখা মুখ থেকে বেরিয়ে এলো অযাচিত ভ’য়ার্ত চাপাকান্না।

অরুকে এভাবে ভয় পেতে দেখে লোকটার বোধ হয় আনন্দই হলো বেশ,সে গ্রীবা নামিয়ে ঠোঁট দুটো দিগুণ প্রসারিত করে ফ্যাসফ্যাসিয়ে শীতল কন্ঠে বললো,
— বাবাজীবন টাকা নিয়ে আসছে মামুনি, ধৈর্য ধরো,ধৈর্য ধরো,ধৈর্য ধরো,ধৈর্য ধরো….

একই বুলি আওড়াতে আওড়াতে অরুকে ম্যানিউপুলেট করে আচমকা ছোট্ট সাইজের চা’কু বের করে অরুর হাতে একটা টান মে’রে দিলো লোকটা।

সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা হাত কেটে গিয়ে ফিনকি দিয়ে র’ক্ত বেড়িয়ে এলো ওর ক্ষত স্থান থেকে।এমতাবস্থায় ভয় আ’তঙ্ক আর প্রতন্ড ব্যথায় জর্জরিত হয়ে অরু চিৎকার দিয়ে উঠবে তার আগেই ছোট্ট দোচালা কুটিরের বাইরে থেকে অরুর নাম নিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো অন্য কেউ।
— অরুউউউ!

ক্রীতিকের আওয়াজ শুনতে পেয়ে অরু হাতের ব্যথা ভুলে গিয়ে পুনরায় কাঁইকুই শব্দ করে উঠলো, ওদিকে বাইরের দিকে কারও আওয়াজ শুনে লোকটা সটান উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে যেতে যেতে,তার সাথে থাকা অন্য চ্যালা প্যালাদের ইশারা করে বললো অরুর দিকে নজর রাখতে।

হাইওয়ে থেকে অনেকটা দূরে শুনশান নিরিবিলি নিরবিচ্ছিন্ন এই যায়গাটা দিনের বেলাতেও ঝিমঝিম করে সারাক্ষণ, আর এখন তো সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত প্রায়, তাই চারিপাশ আরও বেশি নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে। চোখের সামনে বেত আর কাঠের সংমিশ্রণে তৈরি বেশ কয়েকটা ছোট্ট সাইজের কুটির ছাড়া আর কিছুই লক্ষ করা যাচ্ছে না। কুটিরের সামনে বিস্তৃত লনে একটা বৈদ্যুতিক বাল্ব পর্যন্ত অনুপস্থিত, খালি চোখে কিছুই দেখার উপায় নেই, তাই মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ধীর পায়ে সামনে এগোতে এগোতে আওয়াজ করলো ক্রীতিক,
—-এক্সকিউজ মি, কেউ আছেন?

ক্রীতিক এগোতে এগোতেই থমকে গেলো, কারণ ততক্ষণে কুটিরের ভেতর থেকে বেড়িয়ে এসেছে, সুঠাম দেহী বয়জেষ্ঠ একজন, ষাটোর্ধ এই লোকটাকে এর আগে কখনো না দেখলেও, তাকে চিনতে খুব একটা অসুবিধে হলোনা ক্রীতিকের, এক দেখাতেই লোকটাকে চিনে ফেললো ও,সেই সাথে মনে পরে গেলো তার সকল বায়োডাটা,

ইশতিয়াক পাঠান,একজন সাইকো কি’লা’র তার সাথে বাংলাদেশের মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রি’মিনালদের মধ্যে একজন। পত্র পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলের ক্রি’মিনাল নিউজে তার ছবি অহরহ ভেসে বেড়ায়, কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি যে দেশের বড়বড় মাথা ওয়ালা লোকদের কারনেই এরা এখনো দিব্যি বাইরের দুনিয়ায় ঘুরে ফিরে আরামসে ক্রা’ইম করে বেড়াচ্ছে, অথচ পুলিশ এদের টিকিটিও ছুঁতে পারেনা। এটা বাংলাদেশ পুলিশের খুব বড় অক্ষমতা বললেও কথাটা ভুল কিছু হবেনা বোধ করি।

কিন্তু এরকম একটা বাজে লোক কি করে অরুর বাবা হলো সেটাই আপাতত ভাবনার বিষয়,আর আজমেরী শেখের মতো মানুষই বা কেন এমন একটা পশুকে বিয়ে করে ঘর বেধেছিল সেটাও অবশ্য রহস্যই থেকে যায়।

ইশতিয়াক পাঠানের আগমনে ভাবনার সুতো ছিড়লো ক্রীতিকের,সম্বিৎ ফিরে এলে ওর দৃষ্টি বরাবর এসে হাজির হয় লোকটা, লোকটা ষাটোর্ধ অথচ তার সুঠামদেহ, চেহারার কাঠিন্যতা, উজ্জ্বলতা সবকিছু দেখলে মনে হয় তিনি কোনো অ’পরাধী নন বরং সুন্দরী মেয়েদের পছন্দের সুগার ড্যাডি।

এই লোককে দেখেই ক্রীতিক বোধ হয় আজ ঠাওর করতে পারলো যে, অরুর চেহারা কেন এতো আকর্ষনীয়।কিন্তু পরক্ষণেই ক্রীতিকের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো এই ভেবে যে, লোকটা অরুকে কি’ডন্যা’প করেছে, অরুকে কষ্ট দিয়েছে,না জানি কোথায় কোথায় ব্যথা দিয়েছে ওর হার্টবিটকে। ক্রীতিক হাত দুটো মুঠি বদ্ধ রেখে চোখ মুখ কঠিন করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে, লোকটা সামান্য ঠোঁট বাকিয়ে গমগমে আওয়াজে বললো,
— হোয়েয়ার ইজ মানি?

লোকটার কথার দু’পয়সা কেয়ার না করে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লো ক্রীতিক,

— হোয়েয়ার ইজ মাই ওয়াইফ?

, এভাবে ছক্কা হাঁকানো বাউন্ডারি বলকে সরাসরি ক্যাচ করাটা মোটেই ভালো লাগলো না সাইকোপ্যাথ লোকটার, অগত্যা মূহুর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেলো তার মুখের কপট হাসিটা,তার বদলে চোয়াল শক্ত করে আঙুল উঁচিয়ে পেছনের কটেজ ইশারা করে বললো,
—-ওখানে।

হিতে বিপরীত হতে পারে সেই ভেবে, অরুর সন্ধান পাওয়ার পরেও ক্রীতিক হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে গেলো না, বরং সময় নিলো লোকটার ভাব ভঙ্গিমা বুঝে ওঠার জন্য।

— এবার টাকাটা?

লোকটা নিজের একাউন্ট নাম্বার এগিয়ে দিতে দিতে বললো কথাটা।

এই মূহুর্তে অরুর সেইফটির থেকে আর কিছু জরুরি হতে পারেনা, তিন মিলিয়ন ডলার ও না। সেই ভেবে ক্রীতিক কার্ডটা হাতে নিয়ে, দ্রুত হাতে মোবাইল স্ক্রিনে একাউন্ট নাম্বারটা টুকতে টুকতে সন্দিহান গলায় শুধালো ,
— অরু ঠিক আছে তো?

লোকটা আবারও ঠোঁট প্রসারিত করে জোকারের মতো হাসলো,কি ভয়া’নক যে সেই নীরব হাসি তা বলে বোঝানার নয়। হাসতে হাসতেই আস্তে করে জবাব দিলো সে ,
—- শী ইজ কম্পিলিটলি ফাইন।

ক্রীতিক কয়েকটা একাউন্টের টাকা মিলিয়ে তিন মিলিয়ন ট্রান্সফার করে সস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো, বহু আগে থেকেই কোম্পানি থেকে একটা মোটা অংকের সম্মানি জমা হতো ক্রীতিকের একাউন্টে, এতোগুলা দিন জিদের বসে তাতে হাত না দিলেও, আজ সেগুলোতে হাত দিতেও এইটুকু দ্বিধাবোধ করেনি ক্রীতিক। যদিওবা ওর সব একাউন্ট গুলো এখন শূন্য ব্যালেন্স হয়ে আছে কিন্তু তাতে কি যায় আসে? অরু যে ঠিক আছে এটাই শান্তি।

— ডান।

ক্রীতিকের কথায় লোকটা নিজের ফোন চেক করলো, অতঃপর কাউকে ফোন করে কানে লাগানো ব্লুটুথের সাহায্যে বললো,
— চলে এসো, কাজ হয়ে গিয়েছে।

লোকটার কথা শুনে ক্রীতিক ও ফোনের মাঝে কিছু একটা চেক করলো, অতঃপর লোকটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো অন্ধকার কটেজের দিকে।

একদিক দিয়ে ইশতিয়াক পাঠান বেড়িয়ে যাচ্ছে অন্য দিক দিয়ে ক্রীতিক লন ছাড়িয়ে কটেজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আড়াআড়ি একটা দৃশ্য, দুজন দুজনকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে, যেতে যেতে ক্রীতিক আরও একবার ফোন চেক করলো।

ওদিকে ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে পেছনে ঘুরে একনজর ক্রীতিকের বাঁজপাখির মতো তীক্ষ্ণ চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো লোকটা, অতঃপর কানে লাগানো ব্লুটুথে অপর পাশের কাউকে হিসহিসিয়ে বললো,
— জাস্ট বার্ন ইট!

ক্রীতিকের তীক্ষ্ণ নজর তখনো মোবাইল স্ক্রিনে নিবদ্ধ ছিল, ঠিক সেই সময় আচমকা চোখের সামনে দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো কাঠের তৈরি কটেজ গুলো। চোখের সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত এই দৃশ্য দেখে হকচকিয়ে উঠলো ক্রীতিক, এতোগুলো টাকা পাওয়ার পরেও লোকটা এমন কিছু করবে সেটা বোধ হয় কল্পনাতেও আশা করেনি ও। ওই জন্যই হুট করে ঘাবড়ে গিয়ে দাউদাউ করে জ্বলন্ত কুটির গুলোতে নজর বুলিয়ে লোকটার পানে অবিশ্বাসের চোখে তাকালো ক্রীতিক। ওর আহত চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে লোকটা গা ছাড়া ভাবে হেঁসে বললো,
—- কেন যেন মনে হয়েছিল বাবাজীবন আমাকে এতো সহজে ছেড়ে দেবে না, তাই ছোট্ট একটু প্রটেকশন দিলাম, এবার তুমিই ভাবো কি করবে, আমাকে ধরবে? না-কি নাকি নিজের বউকে বাঁচাবে?

কথা বলতে বলতে ভাবলেশহীন হয়ে ঠোঁট উল্টালো লোকটা, ক্রীতিকের চোখে তখন জ্বলে উঠেছে তীব্র রাগের অ’গ্নিস্ফুলিঙ্গ ,মা’রাত্মক ক্রোধে শরীরটা কাঁপছে ওর, চোখের সামনে কটেজ গুলো পু’ড়ে যাচ্ছে, ভেতরে অরু, ওদিকে লোকটার হাসি দেখে রাগ সংবরণ করার কোনো উপায় নেই, ইচ্ছেতো করছে এখনই গিয়ে লোকটাকে কে’টে টুকরো টুকরো করে ফেলতে, কিন্তু ক্রীতিক দুইয়ের মাঝে আটকা পরে আছে।

লোকটা হাসছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, ক্রীতিক ওর হাসি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বললো,
— শুয়ো*** বাচ্চা আমি তোর থেকেও জ’ঘন্য, শুধু ভদ্রলোক সেজে থাকি এই যা।

ক্রীতিকের কথায় এবার সত্যি সত্যি লোকটার কপাল কুঞ্চিত হয়ে এলো,ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না কোন দিক থেকে আদতে ঝড়টা আসবে। লোকটা ভাবছে, ঠিক তখনই, কোথা থেকে যেন ছুটে এসে পেছন দিক থেকে লোকটার নাক বরাবর ঘু’ষি ছেড়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে চোখের পলকে লোকটার হাত পা সব বেধে ফেললো এলিসা।

তবে লোকটা এখনো খ্যাক খ্যাক করে হাসছে, যেন কিছুই হয়নি। এরকম মা’রধর খেয়ে অভস্ত্য সে। ওর হাসি দেখে র’ক্ত উঠে গেলো ক্রীতিকের মাথায়, লোকটাকে ইচ্ছে মতো পে’টাবে বলে এগিয়ে আসতে গিয়েও জ্বলন্ত কটেজ থেকে অরুর চিৎকারের আওয়াজে ওর পা দুটো থমকে গেলো অকস্মাৎ, এতোক্ষণের রাগ ঢাক সব ঠিকেয় তুলে হুট করেই একটা ভ’য়ানক কাজ করে বসলো ক্রীতিক। কোনোকিছু না ভেবেই এগিয়ে গিয়ে আচমকা ঝাপ দিয়ে ঢুকে পরলো জ্বলন্ত কটেজের মধ্যে।

ওর এহেন কান্ডে চোখ মুখ খিঁচে চিৎকার দিয়ে উঠলো এলিসা। এই প্রথমবার এলিসার কন্ঠস্বর ভ’য়ার্ত শোনালো। অকুতোভয় মেয়েটাও কাছের বন্ধুকে হারানোর ভয়ে জর্জরিত হয়ে কেঁদে ফেললো হুট করেই, আর হবে নাই’বা কেন? ওরা তো একজন আরেকজনের আপনের চেয়েও আপন।

ওদিকে যতক্ষনে অর্ণব আর সায়র পুলিশ আর ফায়ার ফাইটারস নিয়ে হাজির হয়েছে , ততক্ষণে ক্রীতিকের আর হদিস নেই, কারণ ইতিমধ্যে কটেজ গুলোর সর্বত্র আ’গুন ছড়িয়ে পরেছে, দাউদাউ করে একেকটা কটেজকে যেন গ্রাস করে নিচ্ছে রা’ক্ষুসে অ’গ্নিশিখার দল। এখানে এসে এমন জ্বলন্ত আ’গুনের লেলিহানের মাঝে ক্রীতিককে হারিয়ে যেতে দেখে সায়র আর অর্ণব দূর্বল চিত্তে হাটু ভেঙে ধপ করে মাটিতে বসে পরলো একই সাথে ।

*
ক্রীতিক এতো সহজে হার মানার ছেলে নয়,খুব অল্প বয়সেই জীবন ওকে অনেক কিছু দেখিয়ে দিয়েছে,তাছাড়া ও বরাবরই বেপরোয়া স্বভাবের, কলিজার মধ্যে ভয় ডর কিছু নেই বললেই চলে, যদিও বা থেকে থাকে সেটা শুধু মাত্র অরুকে হারানোর ভয়। যেই ভয়ে আগাগোড়া তটস্থ ক্রীতিক।

আর আজ এই মূহুর্তে, অরুর জন্যই জ্ব’লন্ত কুটিরের মধ্যে নির্দ্বিধায় পা বাড়িয়েছে ও।ছোট্ট ঘরের চারিদিকে আ’গুন ছড়িয়ে পরলেও ভেতরটা ধোঁয়ার কুন্ডলীতে ঝাপসা হয়ে আছে, ক্রীতিক ধোঁয়ার মধ্যেই ছুটে গেলো অরুর নিকট, অরুর হাত,পা, মুখ সবকিছু চেয়ারের সাথে বাঁধা, লম্বা চুলগুলো মাটি ছুঁই ছুঁই করছে, মাথাটাও টলছে, অরু হয়তো ভেবেই নিয়েছিল এটাই ওর শেষ, কিন্তু হঠাৎ করেই সবসময়ের মতো আঁধারের মরিচীকার মধ্যে একটু খানি আলোর ছটা হয়ে ওর সামনে এসে দাড়ালো ওর সেভিয়র, ওর জায়ান ক্রীতিক।

যাকে এই মূহুর্তে ঝাপসা, অথচ ব্যাকুল চিত্তে পরখ করছে অরু,ক্রীতিক হুডি পরে আছে, মাথাটা ক্যাপ দিয়ে সম্পূর্ণ ঢাকা, তবুও লম্বা চুলের অনুপস্থিতিটা ঠিকই ধরতে পারলো অরু।

সেই সাথে ক্রীতিক শুকিয়েও গিয়েছে অনেকটা, এতোগুলা দিন পরে,এতোটা বিচ্ছেদের য’ন্ত্রনার ইতি টেনে ক্রীতিকের মুখোমুখি হওয়াটা ছিল অরুর কাছে স্বপ্নের মতোই সুন্দর আর চমকপ্রদ।

তাইতো, এই আগুনের লেলিহান, এই শারীরিক যন্ত্রনা, এই ফাঁকা মস্তিষ্ক সবকিছুকে ছাঁপিয়ে চোখের সামনে ক্রীতিককে দেখতে পেয়ে সহসা ছটফট করে উঠলো অরু, মুখ বাঁধা অবস্থাতেই কেঁদে উঠলো চিৎকার করে। ক্রীতিক ব্যথাতুর চাহনীতে তাকিয়ে আছে অরুর মুখের দিকে, যে এই মূহুর্তে ওকে দেখে হাত পা দমাচ্ছে আর শব্দ করে কাঁদছে।

আজ এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে অরু ঠিকই বুঝতে পেরেছে, সেদিনের সেই স্বপ্নে অরু যখন গভীর চোরাবালির নিচে হারিয়ে যাচ্ছিল, তখন ওর হাতটা অন্য কেউ নয় সয়ং ক্রীতিকই টেনে ধরেছিল। কারণ ও এতোদিনে এইটুকু বিশ্বাস করে ফেলেছে যে , শেষ নিঃশ্বাসের আগ পর্যন্ত এই লোকটা ওর হাত ছাড়বে না, কিছুতেই ছাড়বে না।

ক্রীতিক এগিয়ে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে অরুর হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিতেই, অরু তৃষ্ণার্থ চাতকের মতো উঠে দাঁড়িয়ে নিজের কাঁপা কাঁপা হাত দুটো ছোঁয়ালো ক্রীতিকের মসৃণ তীক্ষ্ণ গালে,সেভাবে দু’হাত রেখেই এক ধ্যানে দেখতে লাগলো নিজের ফেরারী ভালোবাসার মুখখানা। আজ কতগুলো দিন বাদে এই মানুষটাকে স্পর্শ করলো ও, ভীষণ স্বস্তিতে দম বন্ধ হয়ে আসছে অরুর, চোখ দুটোও ঝাপসা, ক্রীতিক কোনোকিছু না বলে অরুর হাতে ঠোঁট ছুয়িয়েছে কি ছোঁয়ায় নি তার আগেই অকস্মাৎ চেতনা হারিয়ে ক্রীতিকের বুকেই ঢলে পরলো অরু।

ফায়ার ফাইটারদের সাহায্যে অচেতন অরুকে কোলে নিয়ে খুব সহজেই বাইরে বেরিয়ে আসতে পেরেছে ক্রীতিক, ততক্ষণে ইশতিয়াক পাঠান কে ধরে ফেলেছে ইউ এস এ পুলিশ। ক্রীতিক অরু সমেত লোকটার কাছে এগিয়ে এসে বললো,
—- ইউ ফা’কড আপ শশুর আব্বা,আগেই বলেছিলাম তোকে, আমি ক্রীতিক এতোটাও ভদ্রলোক নই, এবার জেলে গিয়ে ডিসাইড কর তিন মিলিয়ন দিয়ে কি কি করবি।আর হ্যা, এটা বাংলাদেশ পুলিশ নয়,যে চাইলেই বড় মাথা ওয়ালাদের পা চেটে বেরিয়ে আসবি, তোকে উপযুক্ত শা’স্তি প্রদানের জন্য ঠিক যা যা করার দরকার আমি তাই তাই করবো, প্রথমে আমেরিকান গভমেন্টের কঠোর শা’স্তি ভোগ করে নে, এরপর নাহয় কোনোদিন মুক্তি পেলে আমি নিজেই তোর যমদূত হবো। তুই আর এ জীবনে আমার হাত থেকে নিস্তার পাবিনা।

কথাটা বলে লোকটার মতো করেই নিঃশব্দে একটা কপট হাসি দিলো ক্রীতিক। অন্ধকারের মাঝে হৃদয়ে কাঁপন ধরিয়ে দেবার মতোই ভয়া’নক দেখালো সেই মেকি হাসি।

*************************************************

একটা ছোট্ট যায়গায় গুটিসুটি মেরে ঘুমাতে ঘুমাতে শরীরের মাংসপেশী সব ব্যথায় টনটন করছে অরুর, অথচ মস্তিষ্কটা সেই তুচ্ছ ব্যথার উর্ধে গিয়ে নীরব আর চিন্তামুক্ত হয়ে ক্রমশ ঘুমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে ওকে,ঘুমের রেশ কাটাতে না পেরে সরু যায়গা টুকুতেই এবার একটু আরাম করে শুলো অরু, ওর মাথার নিচের বালিশটা বেজায় শক্ত কিন্তু উষ্ণ,এমন উষ্ণতা বিগত দু’মাস ধরে অরু কত খুঁজেছে তার ইয়ত্তা নেই। অথচ আজ হুট করেই এই উষ্ণ বস্তুটা ওর কাছে নিজে থেকেই ধরা দিলো। এর প্রশান্তির আর কিইবা হতে পারে?

এতোকিছু ভাবতে ভাবতে ঘুমের ঘোরেই শক্তপোক্ত উষ্ণ বালিশে নাক ঘষলো অরু, বরাবরের মতো বদভ্যাসের বশবর্তী হয়ে মুখের কোন বেয়ে বেড়িয়ে আসা লালা টুকু ও তাতে মুছলো। কিন্তু যখনই নাক টেনে লম্বা শ্বাস নিলো,ঠিক তখনই টনক নড়লো অরুর, কারণ এখান থেকে ভেসে আসছে অরুর সবচেয়ে পছন্দের মাদকীয় সুবাস ওর প্রিয় পুরুষের গন্ধ । এই স্নিগ্ধ ম্যানলি সুঘ্রানটা শুধুমাত্র ক্রীতিকের শরীর থেকেই পায় অরু, তাহলে কি এটা ক্রীতিক?প্রশ্নটা মস্তিষ্ক ছুঁতেই তন্দ্রা ছুটে গেলো অরুর,তৎক্ষনাৎ চকিতে চোখ খুলে দেখতে পেলো এটা অন্য কারোর নয়,সয়ং ক্রীতিকেরই চওড়া ঢেউ খেলানো বক্ষদেশ।

যা নিঃশ্বাসের তালেতালে বার ওঠানামা করছে ওর চোখের সামনেই, তারমানে কি এটা স্বপ্ন ছিলোনা?

—বেইবি!

ক্রীতিকের শান্ত গলার আওয়াজ টুকু কানে ভেসে আসতেই শোয়া থেকে ধরফরিয়ে উঠে বসলো অরু, চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝলো ওরা এই মূহুর্তে গাড়িতে বসে আছে, গাড়িটা এক যায়গায় স্থির, তারমানে চলছে না, আর অরু এতোক্ষণ ধরে ক্রীতিকেরই বুকে শুয়ে নিরিবিলি ঘুমুচ্ছিল।

চারিদিকে চোখ বুলিয়ে এতোক্ষণে অরুর নজর গেলো ক্রীতিকের দিকে, যে সেই তখন থেকে ওর পানেই নিস্প্রভ চোখে চেয়ে আছে, চোখের সামনে জলজ্যান্ত ক্রীতিককে দেখতে পেয়ে অরু উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠলো,
—- তুমিহ, না মানে আপনি ঠিক আছেন?

ক্রীতিক আস্তে করে অরুকে কাছে টেনে নিয়ে ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে হাস্কিস্বরে বললো,
— সে ইট এগেইন বেইবি।

— কিহ!

অরুর ক্ষুদ্র প্রশ্নে ক্রীতিক কাতর গলায় বললো,
—- তোর মুখে কতদিন এই ওয়ার্ডটা শুনিনা, আবার ডাক তুমি করে।

ক্রীতিকের কথায় অরুর চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পরলো তপ্ত নোনাজল, ক্রীতিকের এই সামান্য কথাতে কি যে পূর্ণতা ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না অরু। এই পূর্ণতা টুকু যদি টাকায় কেনা যেতো তাহলে বোধ হয় অরু নিজের শেষ সম্বল দিয়ে হলেও এই মূহুর্তটুকু বারবার কিনে নিতো। কিন্তু হায় অরুর সেই সাধ্য নেই,কোনোদিন ছিলোওনা, তাইতো নিজের স্বামীর জীবন ম’রনের সন্ধিক্ষনে ও পাশে থাকতে পারেনি অরু, একনজর দেখতে পারেনি তাকে। কত রাত যে নির্ঘুম কাটিয়েছে এই মানুষটার পথ চেয়ে, কতদিন মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়ে কেঁদেছে শুধুমাত্র এই মানুষটা ওকে কেন অবহেলা করছে সেই দহনে, অথচ আজ সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটাই চোখের সামনে বসে এরূপ কাতরতা দেখালে কেই’বা ঠিক থাকতে পারে? অরুও পারেনি,অগত্যাই কেঁদে উঠেছে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ভেঙে।

হতবিহ্বল ক্রীতিক ক্রন্দনরত অরুর দিকে মাথা নুইয়ে ওর চুলগুলো আলতো হাতে মুঠি বদ্ধ করে একই সুরে বললো,
— কি হলো ডাক। আই ওয়ান্না হেয়ার ইওর লাভলী ভয়েস বেইবি। আই ডেস্পারেটলি ওয়েটিং ফর ইট।

ক্রীতিক ওর জন্য এমন ভাবে ব্যাকুল উঠেছে দেখে অরু আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা, মাথা উঁচিয়ে আলতো হাতে ওর পুরুষালী খড়খড়ে গাল দু’টো স্পর্শ করে আজ প্রথমবারের মতো চোখ বন্ধ করে নিজ উদ্যোগে ক্রীতিকের ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো অরু। কান্নার তোড় বেড়েছে বৈকি কমেনি,সেই কান্নারত আওয়াজেই ক্রীতিকের ঠোঁটে চুমু খেয়ে রিনরিনিয়ে অরু বললো,
— তুমি, আমার তুমি, যতবার শুনতে চাও ততবার ডাকবো , তবুও দয়াকরে আর দূরে যেও না,ম’রে যাবো আমি।

অরুর এহেন কথায় ক্রীতিকের শক্তপোক্ত পাথর হৃদয়টাও হুট করে কেমন ধরে এলো, ও স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে ওর হৃদয়ে কষ্ট হচ্ছে, ব্যথায় চিনচিন করছে বুকের বাম পাশটা, অগত্যাই অরুকে হ্যাচকা টান মে’রে নিজের কোলে বসিয়ে শক্ত করে বুকে চেপে ধরলো ওর ছোট্ট নারী শরীরটা। অরুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে অস্পষ্ট আওয়াজ ক্রীতিক বললো,
—- বেইবি, আমি ম’রে গেলে তোর কি হতো বলতো? কে ভালোবাসতো তোকে আমার মতো করে? সেই চিন্তায় তো এখন আমার প্রেসার ফল হয়ে যাচ্ছে।

অরু কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিলো,
— আপনি ম’রে গেলে আমিও ম’রে যেতাম। আর কারোর ভালোবাসার দরকার নেই আমার, আপনি যা দিয়েছেন তা আমার এক জীবনের জন্য যথেষ্ট।

অরুর কথা শুনে ক্রীতিক এবার মাথা তুলে ওর চোখে চোখ রেখে নিজের হাত পেছন থেকে অরুর জামার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো,
— তুই আমার জন্য এতোটা পা’গল কবে হলি অরু?

অরু নাক টেনে বললো,
— জানিনা তো।

— বেইবি, এবার না-হয় আমার সাথে এই অচেনা শহরে থেকে যা? মাঝে মাঝে তোকে নিয়ে যাবো দেশে, কিন্তু সারাজীবন আমার সাথেই থাকবি তুই। আমি আর দূরত্ব চাচ্ছিনা অরু, থাকতে পারবো না তোকে ছাড়া।

ক্রীতিকের কথা শুনে অরু ওর হুডির ফিতেয় আঙুল ঘোরাতে ঘোরাতে বললো,

—- থেকে গেলে কি করবেন?

অরুর তুলতুলে কোমল পৃষ্ঠদেশে আলতো হাতে স্পর্শ করে ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে ক্রীতিক হিসহিসিয়ে বলে,
— আদর করবো, অনেক আদর করবো, একটুও কষ্ট দেবোনা, আই প্রমিস।

অরু ঠোঁট উল্টে বললো,
— কিন্তু আপনিতো রেগে গেলে মা’রেন।

ক্রীতিকের হাতের স্পর্শ প্রগার হলো,সেভাবেই জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে ক্রীতিক জবাব দিলো,
—- আমিই মা’রবো, আবার আমিই আদর করবো, সব আমি করবো। আর কেউ না। কারণ তুই আমার যতখানি আছিস, আমি তার থেকেও তোকে আরোও বেশি চাই হার্টবিট।
The more i have of you, the more i want you. you kno what i mean.

ক্রীতিকের হাতদুটো অবাধে বিচরণ করছে অরুর জামার ভেতর,এহেন স্পর্শে ঠান্ডার মাঝেও মাত্রাতিরিক্ত উষ্ণতায় রক্তিম হয়ে উঠেছে ওর মুখমন্ডল, হাত পা অবস হয়ে আসছে, যার ফলরূপ কনভার্সেশনটা আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলো না অরু,চুপচাপ ভেঙেচুরে পরে রইলো ক্রীতিকের শক্ত বুকের উপর। আর নাতো ক্রীতিক আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলো ওকে, বরং অরুর উন্মুক্ত পিঠে আদুরে দু’হাত বোলাতে বোলাতেই আকস্মিক গতিতে অধর ডোবালো অরুর ওষ্ঠাধরের ভাঁজে।

বহুদিনের কামনা বাসনার অবসান ঘটিয়ে চুমু, পাল্টা চুমুতে দু’জনই ভরিয়ে দিচ্ছিল একজন আরেকজনের হৃদয় মন সবকিছু। ক্রীতিক বরাবরই বেসামাল, অরুর সংস্পর্শে এলে ওর মাথা ঠিক থাকেনা,তারউপর অরু আজ সারা দিচ্ছে ওর স্পর্শে, এহেন অবস্থায় ক্রীতিক ওর ঠোঁট ছাড়িয়ে গলায় মুখ ডুবিয়ে দিয়ে দু’হাতে টেনে উপরে তুলতে লাগলো অরুর পরনের ফিনফিনে সাদা টপসটা।

ভালোবাসা তখন তুঙ্গে, অরুও কেন যেন এতোগুলা দিন পর না করতে পারছিলনা ক্রীতিককে, ঠিক এমন সময় হুট করেই কি যেন দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো অরু,তরিৎ গতিতে ক্রীতিকের থেকে সরে গিয়ে ওর পেছনেই মুখ লুকালো চোখ খিঁচে। এমন একটা সময়ে অরু হঠাৎ সরে গিয়েছে যে ক্রীতিক নিজের মেজাজ সংবরণ করতে পারলো না, সহসাই অরুর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে দাঁত কটমটিয়ে বলে উঠলো ,
— তোর মাসে কয়বার পি’রিয়ড হয়, ইডিয়েট?

অরু অবুঝের মতো চোখ উঁচিয়ে বললো,
— আমি কখন বললাম,

অরুর শরীর ঠিক আছে, ব্যপারটা বুঝে আসতেই ক্রীতিক আবারও তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে,

— তাহলে দূরে সরে গেলি কেনো? বেইবি বোঝার চেষ্টা কর, একটু কাছে আয় আমি তোকে…

তৎক্ষনাৎ ক্রীতিককে থামিয়ে দিয়ে খেঁকিয়ে উঠলো অরু,
—- চুপ করুন বেহায়া লোক, সবাই দেখছে।

অরুর চোখের ইশারা অনুসরণ করে ক্রীতিক তাকাতেই দেখলো জানালা দিয়ে, সায়র, অর্ণব, এলিসা চোখ বড়বড় করে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে,
ক্রীতিকের কাহিনি দেখে ওদের তিনজনের চোয়াল ঝুলে পড়ার উপক্রম, ওদের এই অদ্ভুত চাহনিকে কোনোরূপ গুরুত্ব না দিয়ে ক্রীতিক পেছনে ঘুরে ওর পিঠে মুখ লুকিয়ে বসে থাকা অরুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
— বেইবি জানালাটা লাগিয়ে দেবো? তাহলে আর…

—-চুপ করুউউউউন!

ক্রীতিকের কথা শেষ হওয়ার আগেই অরু এমন চিৎকার দিলো, যে ক্রীতিক কেন ওদের তিনজনারও কানের পর্দায় তালা লেগে গিয়েছে।

*************************************************
মাঝরাতে ক্রীতিকের বাড়ির ছোট্ট হলরুমটাতে গোল হয়ে বসে আছে ওরা তিনজন, সবার সিরিয়াস ভাব ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ হচ্ছে এখানে।

ঘুমন্ত অরুকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে, একটু পরে ক্রীতিকও নেমে এলো নিচে, সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে বিরক্ত আওয়াজে ক্রীতিক বললো,
— কি ব্যাপার ,তোদের বাড়িঘর নেই নাকি? এখানে কি চাস?

ক্রীতিকের কথায় সায়র মানে লাগার মতো করে বললো,
— তুই আমাদের খোঁটা দিচ্ছিস, আমাদের? তুই জানিস আমার নেট ওয়ার্থ কতো?

ক্রীতিক সায়রের কথায় পাত্তা দিলোনা, অর্ণব ওকে ডেকে বললো,
— সিরিয়াস আলাপ হচ্ছে এখানে জেকে,পারলে বুদ্ধি দে।

ক্রীতিক গিয়ে আসন পেতে বসে পরলো কাউচে, অতঃপর গেমিং রিমোট কন্ট্রোলটা হাতে নিয়ে বললো,
—- কি হয়েছে বল? কি এমন জরুরি কারনে তোদের মাঝ রাতে গোল মিটিং এ বসতে হলো?

অর্ণব বললো,
— খুবই জরুরি কারণ, তুই একটু সায়রকে টিপস দে তো ভাই, বেচারা বাসর তো দূরে থাক, বউকে একটা চুমু অবধি খেতে পারছে না।

ক্রীতিক চোখ ছোট ছোট করে সায়রের দিকে তাকিয়ে সন্দিহান গলায় বললো,
—- কেন পারছিস না? কোনো গোপন সমস্যা? কলিকাতা হার্বাল অর্ডার দেবো নাকি?

অর্ণব তৎক্ষনাৎ ক্রীতিককে থামিয়ে দিয়ে বললো,
— আরে ধুর, এমন কিছু না, বুঝিসই তো নার্ভাস, সবাই তো আর তোর মতো না যে গাড়ির ঘোড়ার মধ্যেই….

হুট করে এলিসার চোখ পাকানো দেখে অর্ধেক কথাতেই আটকে গেলো অর্ণব।

ক্রীতিক গেইম খেলতে খেলতে জিভ দিয়ে গাল ঠেলে বললো,
—- ওহ এই ব্যাপার, দু পেগ মাল খায়িয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দে, দেখবি শুধু চুমু না আরও অনেক কিছু খেয়ে বসে থাকবে।

ক্রীতিকের কথা শুনে সায়র ভ্রু কুঁচকে বললো,
— তুইও কি মাল খেয়ে চুমু খাস নাকি?

ক্রীতিক ঠোঁট উল্টে বললো,
— আমার ওসবের প্রয়োজন হয়না, বউয়ের কাছে গেলে এমনিতেই নেশা ধরে যায়। বউই আমার ব্যক্তিগত মাল।

সায়র ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
— তাতো রাস্তাতেই দেখে এলাম।

সায়র রাস্তার কথা বলতেই, ক্রীতিক হাতের রিমোটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে উঠে যেতে যেতে বললো,
—- দূর শালা, এতোক্ষণ ধরে নিজেকে সামলেছিলাম, দিলি তো মনে করিয়ে।

ওদিকে অর্ণব সায়রের জন্য গ্লাস ভর্তি বিয়ার নিয়ে এসে ক্রীতিকের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বললো,
—- কিরে কোথায় যাচ্ছিস? ওকে মাল খাওয়াতে হবে তো।

ক্রীতিক যেতে যেতে নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলো,
— বউয়ের কাছে।

অর্ণব বেচারা আর কিইবা করবে একা হাতেই সায়রকে মাল খাওয়ানোর মোক্ষম দায়িত্বটা পালন করতে শুরু করলো। ভরসা একটাই, এবার যদি ছেলেটা একটু খোলস থেকে বেরিয়ে নিজের আপন বউকে দু’একটা চুমু খেতে পারে।
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here