#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ৫৪
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
(কপি করা নিষিদ্ধ 🚫)
(কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য)
(হিরোর ট’ক্সিসিটিতে যারা বিরক্ত, তাদের জন্য রেড এলার্ট।🚫)
গভীর রাতে সানফ্রান্সিসকোর রাস্তা ঘাট কিছুটা ফাঁকা। তবে শহরের অলিগলিতে মাতাল মানুষের অভাব নেই। কেউ অফিস কলিগদের সাথে লেট নাইট পার্টি করে বাড়ি ফিরছে, তো কেউ বন্ধু বান্ধবদের সাথে। কেউ বা প্রচন্ড নেশায় বুদ হয়ে রাস্তার মাঝেই শুয়ে পরেছে নির্দ্বিধায়।ওয়েল, আমেরিকাতে এটা নতুন কিংবা আশ্চর্যের কিছুই নয়।
এই মাতালদের ভীড়ে আজ এক নতুন মাতাল যোগ হয়েছে,নাম তার সায়র আহমেদ। সে হলো ফরেইনার মাতাল।
সায়র আমেরিকান সিটিজেন বহু বছর ধরে, কিন্তু ক্রীতিক, অর্ণব, এলিসার মতো উদভ্রান্ত আর অনেকটা উগ্র টাইপ থ্রীলিং বন্ধুবান্ধবদের সাথে মিশেও ওর স্বভাব চরিত্রের পরিবর্তন হয়নি একটুও। হতে পারে ওদের সাথে মিলে অনেক উল্টো পাল্টা কাজে সঙ্গ দিয়েছে সায়র, কিন্তু এসব কাজে সবসময়ই সায়র থাকতো পেছনের সারিতে, আর সবার সামনে ক্রীতিক। ছেলেটার জন্মই হয়েছে বোধ হয় সবার সাথে বেয়াদবি করার জন্য।রিডিকিউলাস।
এককথায় ক্রীতিকের সাথে তুলনা করতে গেলে সায়র হলো শুদ্ধ পুরুষ, সরলতার প্রতীমা যাকে বলে। নিজের বউকে চুমু খাওয়ার কথা কল্পনা করলেও আ’তঙ্কে শরীরের লোমকূপ সব দাড়িয়ে যায় তার।কিন্তু আজ নিজেকে বরাবরই শুদ্ধ পুরুষ খেতাবে ভূষিত করা এই সায়রের দু’মগ বিয়ার খেয়েই নেশা ধরে গিয়েছে। চোখের সামনে সবকিছু কেমন দুলছে, ওর মনে হচ্ছে ও মেঘের মতো হাওয়ায় ভেসে ভেসেই বাড়ি ফিরছে,কি আশ্চর্য চমৎকার এই অনুভূতি।
একপর্যায়ে ভাসতে ভাসতেই ঘরের দুয়ারে পা রাখলো সায়র। সায়র যখন বাড়িতে ফেরে, তখন নীলিমা কোমড়ে ওড়না গুঁজে ঘরের কাজ করায় ভীষণ ব্যস্ত, সে একদিকে ঘরদোর ভ্যাকিউম করছে,অন্যদিকে একটু পরপর দৌড়ে গিয়ে দক্ষ হাতে কড়াইয়ে স্প্যাচুলা নাড়ছে। নীলিমার কর্মকান্ডে হয়তো কেউ কল্পনা ও করতে পারবে না যে এই মেয়েকে সায়র বিয়ের আসর থেকে তুলে এনে জোর করে বিয়ে করেছে। মাত্র দু’মাস যেতে না যেতেই কেমন পাঁকা ঘরনি হয়ে উঠেছে সে। আচ্ছা, নীলিমাকে কি আসলেই জোর করে বিয়ে করা হয়েছিল? নাকি অন্যকিছু?
কাজের ফাঁকে হঠাৎ সায়রকে দেখতে পেয়ে নীলিমা তরিঘরি করে এগিয়ে এসে বলে উঠলো,
— দেখুন না,সন্ধ্যা হতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম, রাতের রান্না বসাতে একদম মনে নেই।
— থাক, মঙ্গলগ্রহ থেকে খেয়ে এসেছি।
অস্ফুটেই কথাটা বেরিয়ে এলো, টালমাটাল সায়রের মুখ ফস্কে।
সায়রের এহেন অদ্ভুত কথার মানে বুঝতে না পেরে নীলিমা দরজার দিকে এগিয়ে এসে ভ্রু কুঁচকে শুধালো,
— কি বললেন?
নীলিমার কথার প্রত্যুত্তরে,কিছুই জবাব দিলো না সায়র, উল্টো ওকে সুক্ষ্ম চোখে পরখ করে আঙুলের কর গুনতে গুনতে বিড়বিড়ালো,
—- একটা বউ, দুইটা বউ, তিনটা,চারটা…..
হাআআ,দশটা বউ!!
চোখ দুটো বড়বড় করে মুখের উপর একহাত চেপে ধরে বিস্ময়কর কন্ঠে কথাটা বললো সায়র।
সায়রের কথার আগামাথা কিছুই বোধগম্য নয় নীলিমার, এতো রাতে এ কিসব মশকরা বুঝতে পারছেনা ও, তাই সায়রের উপর কিছুটা চটে গিয়ে নীলিমা ঝাঁজিয়ে বলে উঠলো ,
— কি বলছেন এসব আবোল তাবোল?আর দশটা বউই বা কোথায় পেলেন?শুট থেকে তো আসেন নি,তাহলে কোথা থেকে এসেছেন সত্যি করে বলুন?
সায়র একটু দম নিয়ে ভাবলো, অতঃপর আঙুল উচিয়ে সিলিং এর দিকে দেখিয়ে বললো,
— জুপিটার থেকে। মাত্রই তো স্পেসশীপে ল্যান্ড করলাম।
সায়রের কথায় নীলিমা ঠোঁট টিপে হাসি সংবরণ করে বললো,
— তারমানে আপনি বলতে চাইছেন, আপনি এতোক্ষণ মহাকাশে ছিলেন তাইতো?
সায়র তৎক্ষনাৎ ঠোঁট উল্টে জোরে জোরে হ্যা বোধক মাথা নাড়ালো।
— তা মহাকাশে মদ কোথায় পেলেন?
সায়র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— আর বলোনা, মাঝ আকাশে এলিয়েন গুলো হকারী করছিল,খুবই দরিদ্র ওরা,দেখে মায়া হলো, তাই কিছু মদ দিয়ে দুটো টাকা কিনেছিলাম।
নীলিমা ভ্যাঁবাচ্যাকা খেয়ে গেলো সায়রের প্রত্যুত্তর শুনে, ওকে আরেকটু বাজিয়ে দেখলে মন্দ হয়না সেই ভেবে এবার আরও দিগুণ উৎসাহ নিয়ে কৌতুক কন্ঠে নীলিমা শুধালো,
— তা এখন আপনি কোথায় আছেন?
সায়র ঢুলতে ঢুলতে হলের কাউচের উপর গিয়ে বসে পরে বললো,
— কোথায় আবার চাঁদে, অর্ণবের বাচ্চাটা কি জোরে জোরে স্পেসশীপ চালায়, মাথাটা ঘুরে গেলো আমার, এমনিতেই মদ খেয়েছি, তারউপর যদি নেশা ধরে যায় তাহলে কি হবে বলোতো? আমিতো ভুলভাল বকতে শুরু করবো তখন।
নীলিমা সায়রের দিকে এগিয়ে গিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
— আচ্ছা আপনি যদি চাঁদেই থেকে থাকেন, তাহলে বলুন তো আমি কে?
সায়র তৎক্ষনাৎ ভ্রু কুঞ্চিত করে নাকটা সিকোয় তুলে নীলিমার দিকে দৃষ্টিপাত করে গম্ভীর গলায় বললো,
— তুমি আবার কে? চাঁদের সেই ডা’ইনী বুড়িটা না? কাজকম্ম বাদ দিয়ে যে সারাক্ষণ সুতো কাঁটে?
—- কিহ! আমি ডা’ইনী বুড়ি?
সায়রের কথায় খেঁকিয়ে উঠলো নীলিমা।
সায়র দিন দুনিয়ার হুঁশ হারিয়ে পুনরায়, চোখমুখ কুঁচকে বললো,
—- হ্যা ডা’ইনীই তো, কি বিচ্ছিরি দেখতে তুমি ওয়াক!
বমির ভান করতে গিয়ে, অবশেষে সত্যি সত্যিই বমি করে নীলিমার সর্বাঙ্গ ভাসিয়ে দিলো সায়র।
*************************************************
নীলিমা সব সময় একটু বেশিই পাষাণ, সায়রের মতো সফ্টহার্টেড লাভিডাভি, হাসবেন্ড ম্যাটেরিয়াল ছেলের সঙ্গেও তার ভাব জমেনা খুব একটা। হয়তো নীলিমা পারেই না সেভাবে ভাব জমাতে, নিঃসংকোচে মুখ ফুটে ভালোবাসি শব্দ আওড়াতে।
নীলিমার ভাষ্যমতে ভালোবাসা এতো ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলে বেড়ানোর কি আছে? দু’চোখ দেখলেই তো পড়ে ফেলা যায়, আদতে কে তোমায় ভালোবাসে, আর কেইবা ঘৃ’ণা করে। অথচ সায়রের নিকট চোখের ওই কঠিন ভাষাগুলো পড়া অসাধ্য সাধনের মতোই দূর্লভ। কারণ সায়রের দৃষ্টিকোন এতোটাও জটিল নয়, যতটা জটিল ভাবে নীলিমা নিজেকে উপস্থাপন করে। তবুও দিন শেষে সায়রের মতো এমন একটা উষ্ণ হৃদয়ের ছেলেই কিনা এইব পাষাণ মেয়েটার প্রেমে পরতে গেলো, কি অদ্ভুত! ছেলেটা এ জীবনে বউয়ের আদর সোহাগ তো দূরে থাক, বউয়ের মুখ থেকে একটু আধটু মিষ্টি মাখোমাখো কথা শুনতে পাবে কিনা, সেটাই এখন দুশ্চিন্তার বিষয়।
কিন্তু কথায় আছেনা, মানুষের ভাবনা যেখানে এসে শেষ হয়, উপরওয়ালার সুক্ষ্ম ভাবনাগুলো সেখান থেকেই শুরু হয়। আজ তেমন কিছুই হলো, সবসময় সব পরিস্থিতিতে নীলিমা সায়রকে উপেক্ষা করে গেলেও, আজ গেলোনা, বরং সায়রকে বসিয়ে রেখে নিজে ফ্রেশ হয়ে এসে, ওকেও সুন্দর করে পরিস্কার দিলো।অতঃপর টেনেটুনে সায়রকে নিয়ে শুয়িয়ে দিলো বেডরুমে। সায়র অচেতন নয়, তবে ওর দৃশ্য কিছুটা ঝাপসা, তবুও ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নীলিমার পান পাতার মতোন ঢলঢলে আদুরে মুখটা, এই মূহুর্তে ওর ডাগর চোখ দুটো ওর ঝাপসা চোখেই নিবদ্ধ রয়েছে।
সায়র সেই কতক্ষণ ধরে ধ্যানমগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে নীলিমা নির্লিপ্ত কণ্ঠে শুধালো,
— তাকিয়ে আছেন কেন এভাবে? আমিতো ডা’ইনী বুড়ি।
নীলিমার কন্ঠে ক্ষোভ অভিমান দুটোই প্রকাশ পেলো, সায়র তাতে পাত্তা না দিয়ে বোকার মতো হেঁসে বললো,
— চুমু খাবো বলে, জেকে বলেছে মাল খেলে চুমু খাওয়া খুব ইজি।
সায়রের কথায় নীলিমা নাক মুখ কুঁচকে বললো,
—- যেমন আপনি, তেমন আপনার বন্ধুরা,কি শিক্ষা, ছ্যাহ!
সায়র চোখ ছোট ছোট করে নীলিমার হাত টেনে ওকে কাছে এনে বললো,
— আসোনা একটা চুমু খাই, নইলে আমি ওদের মুখ দেখাবো কি করে বলোতো?
—- মাস্ক পড়ে থাকবেন ব্যাস তাহলেই আর মুখ দেখাতে হবে না, এখন ঘুমানতো।
নীলিমার কথার প্রত্যুত্তরে সায়র নেশালো গলায় আবদারের সুরে বললো,
—- সেদিনের মতো ড্রেস খুলে আমার সাথে ঘুমাবে প্লিইইইজ, এক্সুয়ালি,এক্সুয়ালি আই এনজয়েড ইট,কি সুন্দর তুমি।
সায়রের মাতাল মাতাল অস্পষ্ট কথা শুনে শুষ্ক ঢোক গিললো নীলিমা, কি ভেবে যেন সায়রের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলো হুট করেই, আজ প্রথমবার ওর নিজের হৃদয়টাও কেমন যেন সায়রের জন্য উথাল পাথাল করছে, মন বলছে এটাই ভবিতব্য, আজ কিংবা কাল সায়রের কাছে আবেদনময়ী নারী রূপে নিজেকে উপস্থাপন করতেই হবে। এ যে সায়রের কঠোর অধিকার,তাতে কি করেই বা বাঁধা দেবে নীলিমা? যার দরুন একটু আগের সেই জিদি নারী সত্তাটা সায়রের পুরুষ সত্তার কাছে হার মেনে মাথা নত করে ফেলেছে মূহুর্তেই।
নীলিমা ভবঘুরে হয়ে কি যেন ভাবছে তখন থেকে, সায়র সেই মূহুর্তটারই ফায়দা নিলো, ওকে একটানে নিজের দিকে ঘুরিয়ে আস্তে আস্তে ঠোঁট ডোবালো নীলিমার তুলতুলে নরম র’ক্তরাঙা অধর যুগলের ভাঁজে।
সায়রের প্রথম স্পর্শে অকস্মাৎ কেঁপে উঠল নীলিমা, অথচ সায়রের স্পর্শগুলো কতটা নরম আর স্বস্তিদায়ক তা বলে বোঝানোর নয়, এটা ছিল একটা সুন্দর প্যাসোনেট চুমু যার ফলরূপ নীলিমার হৃদয় মন সবকিছু ক্রমশ নাড়িয়ে দিচ্ছে উত্তাল সমুদ্রের মতো বেসামাল ঢেউ। ক্ষণে ক্ষণে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে অযাচিত বন্য চাহিদারা।সায়র নীলিমার হাতে হাত রেখে আধশোয়া হয়ে আছে, আর নীলিমা ওর উপরে,গভীর চুম্বনে একটা ভেজা নরম অনুভূতিতে আবিষ্ট হয়ে নীলিমাও কেমন যেন নেতিয়ে পরলো, নিজের অজান্তেই হাত নিয়ে রাখলো সায়রের কাঁধের উপর, ঠিক সেই সময় সায়র চেতনা হারিয়ে বিড়বিড় করতে করতে আস্তে করে ঢলে পরলো নীলিমার বুকের উপর।
, অসহ্য রকম বিরক্তিকর একটা পরিস্থিতিতে পরে অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ খুললো নীলিমা, ও এখনো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সায়র অস্পষ্ট আওয়াজে বলছে,
— তুমি অনেক সুন্দর রাগীনি, তুমি অনেক বেশি সুন্দর, আই ওয়ান্না টাচ ইউ, কিস ইউ, ইভেন …..
এটুকু বলেই পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পরে রইলো সায়র,
এদিকে সায়রের কথায় প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে নীলিমার।ও এক ধাক্কায় সায়রকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে দাঁত কটমটিয়ে বললো,
—- মাতাল একটা।
*************************************************
কাল সারারাত ক্রীতিককে ফোনে না পেয়ে আজ সকাল সকাল ডাক্তার সমেত বাড়ি বয়ে এসে ক্রীতিককে চেকআপ করিয়েছে প্রত্যয়, ডাক্তার বলেছে ক্রীতিকের শরীর এখনো অনেকটা দূর্বল, এ্যা’ক্সিডেন্টের ধকল কাটিয়ে উঠতে আরও কিছুটা সময় লাগবে, তার উপর কালকে একটু বেশিই প্রেশার দিয়ে ফেলেছে নিজের অসুস্থ শরীরটাকে, যার দরুন এই মূহুর্তে হাতে স্যালাইন লাগিয়ে হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে ক্রীতিক। ওর একহাতে আইপ্যাড আর কানে হেডফোন,এভাবে বসে বসে কি শুনছে কে জানে?
ক্রীতিকের থেকে হাত কয়েক দূরে স্টাডি টেবিলে বসে তখন থেকে ল্যাপটপে কি যেন টাইপ করছে অরু। আসলে আজ বহুদিন বাদে আবারও লিখতে বসেছে ও, লিখালিখিটা মূলত এমনই, হৃদয় থেকে শব্দগুচ্ছ উগরে না বেরোলে একটা অক্ষরও লেখার শক্তি নেই। অরুও পারেনি এতোগুলা দিন বসে থেকেও কোনো একটা বাক্য সাজাতে, কারণ মনের ব্যথা আর মস্তিষ্কের হয়রানি ওকে লিখতে দেয়নি, কোনো এক অজানা শক্তিবলে আঙুল গুলোকে করে দিয়েছিলো অসার আর অপারগ। বহুদিনের সেই অপারগ শক্তিবলকে হটিয়ে, আজ আবারও শান্ত মস্তিষ্কে মনদিয়ে লিখছে অরু।
অফিসে কাজ আছে বলে প্রত্যয় অনেক আগেই চলে গিয়েছে, যদিও ক্রীতিক নিজেই নিজের কাজ করতে পারে, তবুও প্রত্যয় যাওয়ার আগে অরুকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছে, এছাড়া ক্রীতিকের কথামতো কালকের ঘটনার জের ধরে অরুকেও প্রাথমিক চিকিৎসা আর কিছু ওষুধ পত্র লিখে দিয়ে গিয়েছেন ডাক্তার।
ক্রীতিকের স্যালাইন শেষ পর্যায়ে, অরু তখনও সচকিত হয়ে একধ্যানে টাইপ করছিল, এমন সময় ভাইব্রেট আওয়াজ তুলে কম্পিত হয়ে বেজে উঠলো ক্রীতিকের ফোন, মোবাইল ফোনটা তখন অরুর কাছেই ছিল, কারণ অনুর সাথে কথা শেষ করে আর ক্রীতিককে ফেরত দেওয়া হয়নি ফোনটা, এখানেই রেখে দিয়েছিলো মনের ভুলে। তাই এই মূহুর্তে ল্যাপটপের দিক থেকে চোখ সরিয়ে চেয়ার ছেড়ে মোবাইল হাতে ক্রীতিকের কাছে এগিয়ে গেলো ও, ক্রীতিকের দিকে মোবাইলটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—- ক্লাব থেকে কল এসেছে।
ক্রীতিক কানের হেডফোন খুলে একনজর মোবাইলে চোখ বোলালো, অতঃপর কলটা কেটে দিয়ে সেটাকে অযত্নে ছুড়ে মা’রলো বিছানার এককোনে।
— কি হলো?
অরুর প্রশ্নে ক্রীতিক ওর পানে চেয়ে শান্ত স্বরে বললো,
— কিছুই হইনি বেইবি।
—- তাহলে ফোনটা এভাবে ছুড়ে ফেললেন কেন?
ক্রীতিক অরুকে কাছে টেনে এনে নিজের পাশে বসিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বললো,
—- যে রাইডিং এর কারনে আমার হার্টবিট এতোটা ব্যথা পেয়েছে, যে রাইডিং আমাদের এভাবে আলাদা করে দিয়েছে, সেই রাইডিং আমি পুনরায় কন্টিনিউ করবো ভেবেছিস? ইভেন আই হেইট বাইক। আজ থেকে আমার একটাই অবসেশন, আর সেটা হলি তুই।
এতোক্ষণ ধরে ক্রীতিকের কথাগুলো মনোযোগী হয়ে চুপচাপ শুনলেও,এই মূহুর্তে চট করে উঠে দাড়িয়েছে অরু।
অরুকে উঠে যেতে দেখে ক্রীতিক গভীর গলায় প্রশ্ন ছুড়লো,
— হোয়াট হ্যাপেন বেইবি?
অরু দ্রুত হাতে স্যালাইন খুলতে খুলতে বললো,
— স্যালাইন শেষ হয়ে র’ক্ত উঠে এসেছে, তবুও চুপ করে আছেন, বলি আপনার কি অনুভূতি শক্তি নেই নাকি?
স্যালাইন খোলা হয়ে গেলে, ক্রীতিক অরুকে হ্যাঁচকা টানে নিজের বুকের উপর ফেলে দিয়ে বললো,
—- কে বলেছে নেই?কাছে আয় দেখাচ্ছি,
অরু মুখ ভার করে বললো,
— থাক আর দেখাতে হবে না, হাতে লাগবে আপনার।
—- নো ওয়ে।
কথাটা বলেই অরুকে ধা’ক্কা মে’রে বিছানায় ফেলে দিয়ে ওর উপর উঠে বসলো ক্রীতিক, দু’হাতে অরুর নরম কব্জি দুটো চেপে ধরে হাস্কিস্বরে বললো,
—-কাল আমার কতটা কষ্ট হয়েছে সে খবর রাখিস তুই? সারারাত একটুও ঘুমাতে পারিনি, তাও নিজেকে বারবার বুঝিয়েছি, আমার পিচ্চি বউটা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে ছিল,এই ঘুমন্ত পরীটাকে কি করে জাগাতাম আমি? আমিতো নির্দয় মানব তবুও এই নি’ষ্ঠুরতম কাজটা করতে পারিনি আমি,ফলে রাতের মতো ছাড় দিয়েছি তোকে। সকাল বেলা যে কিছু করবো তাও সহ্য হলোনা তোর উজবুক দুলাভাইয়ের,কোথা থেকে যেন উড়ে এসে স্যালাইন ঝুলিয়ে দিয়ে চলে গেলো, আর এখন তুই ও বাহানা দেখাচ্ছিস? কি সাহস তোর অরু? ভয় করছে না আমাকে?
মাথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে অরু লাজুক হেসে জবাব দিলো,
— না করছে না, আপনার সবরকম রূপ দেখেই অভস্ত্য আমি।
—- বেইবি লুক এট মি,
ক্রীতিকের ডাকে ওর চোখে চোখ রাখলো অরু, তৎক্ষনাৎ হৃদয়ে ঝড় বইতে শুরু করে অরুর, ওলট পালট হয়ে যায় আবেগের সমুদ্র, কি ভ’য়ানক আকর্ষন ওই ভাসমান চোখ দুটোতে, অরু আজও বুঝতে পারেনা কি আছে ওই দু’চোখে? যা অরুকে এভাবে নিস্তেজ করে ছাড়ে, হৃদয়ের কূল ভে’ঙেচুড়ে প্লাবিত করে দেয় মূহুর্তেই। আজ সকল সংকোচ উপেক্ষা করে অরু প্রশ্নটা করেই বসলো ক্রীতিককে, তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে শুধালো,
—- কি আছে আপনার দু’চোখে বলুন না?
হাতে ক্যানোলা থাকার দরুন ব্যস্ত হাতে অরুর শরীরের সম্ভ্রমটুকু টেনে ছিঁড়তে ছিঁড়তে ক্রীতিক হিসহিসিয়ে জবাব দিলো,
—- অবসেশন, আই থিংক আনহেলদি অবসেশন।
নিজের জামার নড়বড়ে হাল দেখে অরু অসহায়ের মতো করে বললো,
—- কি করছেন, আমার পছন্দের জামা এটা।
ক্রীতিক উদভ্রান্তদের মতো অরুর কপালে চুমু খেয়ে জবাব দেয়,
— আবার কিনে দেবো বেইবি, একটা নয় দশটা কিনে দেবো, তাও এখন চুপ করে থাক, না না কি যেন বলছি? জাস্ট কন্টিনিউ ইট।
ক্রীতিকের কথা মতো অরু পুনরায় শুধালো,
—- আর?
অবসেশনের বাইরে গিয়ে অরুর প্রশ্নের সঠিক উত্তর বোধ হয় ক্রীতিকেরও অজানা, দুনিয়াতে এতো সুন্দরী আর আকর্ষনীয় মেয়ে থাকতে কেন ও অরুর জন্যই শুধু এতো পাগলামি করে, কে জানে? অজানা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলো ক্রীতিক, বরং এক সমুদ্র ভালোবাসায় হারিয়ে যাওয়ার প্রয়াশে মুখ বাড়িয়ে দিলো অরুর তুলতুলে নরম উন্মুক্ত গলার ভাঁজে। তবে ওর অধর জুগল অরুকে স্পর্শ করার আগেই অরুর গলায় অনেক গুলো কালচে ক্ষত দেখতে পেয়ে ভীষণ ব্যতিগ্রস্থতায় কপাল টা কুঁচকে এলো ক্রীতিকের।
ও সেগুলোতে তীক্ষ্ণ নজর বুলিয়ে অকস্মাৎ শক্ত হাতে গলাটা চে’পে ধরলো অরুর। ক্রীতিকের স্পর্শ বরাবরই তীব্র বেদনাদায়ক, কিন্তু কোনটা ভালোবাসার স্পর্শ আর কোনটা ক্ষো’ভের সেটা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারে অরু।যার দরুন, অসহনীয় ভালোবাসার স্পর্শের মাঝে হুট করেই এমন রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় কিছুটা আ’তঙ্কিত হয়ে ক্রীতিকের চোখের দিকে চাইলো অরু, দেখলো একটু আগের সেই কামুক চোখদুটো কখন যে উধাও হয়ে গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ক্রীতিকের হাতের বাঁধনটা এতোই দৃঢ় যে অরুর দম আটকে আসছে,চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরছে আপনাআপনি, তবুও বহু কসরত করে ক্রীতিকের আ’গুনের হালকার মতো চোখের দিকে চেয়ে অস্পষ্ট আওয়াজে অরু শুধালো,
— কি হয়েছে, লাগছে তো আমার।
অরুর কথায় পাত্তা দিলোনা ক্রীতিক, মুখের পেশীগুলো শক্তকরে অত্যন্ত ধীর কন্ঠে বললো,
—- গত দু’মাস ধরে তোকে স্পর্শ করিনি আমি, তাহলে এগুলো কি? কে করেছে তোর শরীরে পার্পল মার্ক? আমার জিনিসে কে হাত দিয়েছে?
শেষ কথাতে ধমকে উঠলো ক্রীতিক, অরু নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না কোন দাগের কথা বলছে ক্রীতিক? তাছাড়া কেমন করেই বা এলো এই দাগ? অরুর মাথাটা কাজ করছে না, এদিকে ছাফছাফ উত্তর দিতে না পারলে ক্রীতিক নির্ঘাত মে’রে ফেলবে ওকে, সেই ভয়ে অরু আমতাআমতা করে বললো,
—- আপনি কাল কথা দিয়েছিলেন আআমাকে আর মা’রবেন না, আ…
— এইইই চুপ, রাখ তোর কমিটমেন্ট, আগে জবাব দে, আমার জিনিস কে এভাবে স্পর্শ করেছে? নয়তো আজ তোর শরীরের কোনো যায়গা বাদ রাখবো না আমি অরু, র’ক্তা’ক্ত করে ফেলবো একদম , এর থেকেও বেশি জঘন্য অবস্থা হবে তোর।
কথা বলতে বলতে অরুকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বসিয়ে দিলো ক্রীতিক। ক্রীতিকের সেই টানে অরুর মনে হলো বাহু থেকে ওর হাতটাই ভে’ঙে চলে আসবে, কোনোমতে কম্ফোর্টারের ভাঁজে নিজেকে আড়াল করে অরু ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে হেচঁকি তুলে বললো,
— বিশ্বাস করুন, আমি জানিনা কি ভাবে হলো এসব।
এই মূহুর্তে ক্রীতিকের মেজাজ চড়ে আছে সপ্তম আসমানে,সেই সাথে উগ্রতা ছড়িয়ে পরেছে চোখে মুখে এমনকি সমগ্র শরীর জুড়ে, ও পারলে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতো অরুকে, ওর জিনিসকে কেউ এতোটা গভীর ভাবে স্পর্শ করেছে আর অরু কিনা সেটা এরিয়ে যাচ্ছে? কত বড় কলিজা ওর।
মাত্রাতিরিক্ত চড়াও মেজাজের ফলসরূপ এবার অরুর চো’য়ালটা শ’ক্ত হা’তে চেপে ধরলো ক্রীতিক, সেভাবেই অরুর মুখের সামনে মুখ এনে কঠিন গলায় বলে উঠলো ,
—- জানিস না মানে? তোকে কেউ এভাবে স্পর্শ করলো আর তুই জানিসই না? কার সাথে শুয়েছিস সত্যি করে বল? দাগগুলো তো তরতাজা মনে হচ্ছে, অমিতের সাথে নয়তো?
অরু তৎক্ষনাৎ আ’তঙ্কি’ত হয়ে এদিক ওদিক জোরে জোরে মাথা নাড়ালো।
তবে তা দৃষ্টিগোচর হলোনা ক্রীতিকের তার আগেই ওর চোখ গিয়ে ঠেকল স্টাডি টেবিলের উপর রাখা ল্যাপটপের দিকে, যেখানে অরুর বহুকষ্টের লেখাগুলো এখনো ফ্রন্টপেজে ভাসছে, ক্রীতিক সেদিকে তাকিয়ে দাঁত দিয়ে দাঁত পিষে বললো,
—- আমি জানতাম এই অমিতের প্রতি তোর ভীষণ দূর্বলতা।
—- কি বলছেন এসব পা’গল লোক?
এতোক্ষণ নিজেই ভীষণ দ্বিধাদন্দের মধ্যে থাকায় অরু খুব একটা খেয়াল করতে পারেনি ক্রীতিকের কর্মকান্ড, কিন্তু যেই মূহুর্তে মনে পরে গেলো এটা আসলে রেজার কাজ, সেদিন ধ’স্তাধস্তি’র সময় রেজা অসংখ্যবার অরুর কলার টেনে ধরেছিল, যার প্রেক্ষিতে নখের আঁচড় বসে এমন কালচে হয়ে গিয়েছে কলার বোন গুলো, ঠিক তখনই চেচিয়ে উঠলো অরু।
তবে অরুর চেঁচানোতে খুব একটা যায় আসলো না ক্রীতিকের, ও রাগের বশবর্তী হয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে অরুর ল্যাপটপটা তুলে নিয়ে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আছাড় মা’রলো মেঝেতে , প্রথমবারে খুব একটা ক্ষয়ক্ষতি না হওয়ার দরুন, ক্রীতিক পুনরায় সেটা হাতে তুলে নিয়ে এবার জানালা দিয়ে বাইরে ফেলতে উদ্যত হয়।
চোখের সামনে নিজের স্বপ্ন, এতোগুলো দিন ধরে জমানো লেখা সব এভাবে নিজের স্বামীর হাতে ধ্বং’স হয়ে যেতে দেখে বিছানা ছেড়ে ছুটে এসে ক্রীতিককে আটকালো অরু, পেছন দিক থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—- থামো প্লিজ, ওটা ফেলোনা, আমি তোমাকে সব খুলে বলছি, তাও ওটা ফেলোনা দয়া করে, এখানে অমিতের কোনো যোগসূত্র নেই, লেখালিখি আমার ছোটবেলার স্বপ্ন।
ক্রীতিক থামলো, ল্যাপটপটা বাইরে না ফেলে ছুড়ে মা’রলো টেবিলের উপর।
অরুর” তুমিতে” কাজ হয়েছে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো ও। এরপর সেভাবেই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে একে একে রেজার ঘটনা সব খুলে বললো ক্রীতিককে, ক্রীতিক শুধু দু’হাত মুঠি বদ্ধ করে সবটা চুপচাপ শুনে গেলো, অতঃপর ঘুরে দাঁড়িয়ে অরুকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে গমগমে আওয়াজে শুধালো,
—- আর কোথায় টাচ করেছে বা’স্টা’র্ডটা?
ক্রীতিকের কথার জবাবে অরু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে না সূচক মাথা নাড়ালে, ক্রীতিক কি ভেবে যেন নিজের শার্টটা খুলে অরুর উন্মুক্ত শরীরটা ঢেকে দেয়,পরমূহুর্তেই নিজে একটা হুডি পরে সিগারেট আর ওয়ালেট নিয়ে গটগটিয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে, যেতে যেতে অরুর উদ্দেশ্যে বলে,
— ফ্রেশ হয়ে রেস্ট কর, তোকে টায়ার্ড লাগছে।
ক্রীতিকের কথায় জবাব দিলোনা অরু, উল্টো রাগে ক্ষো’ভে ফোসফাস করতে করতে ক্রীতিক বেড়িয়ে যেতেই ধাপ করে লাগিয়ে দিলো বেডরুমের বিশাল দরজাটা।
***********************************************
সে বেলা সেভাবেই কেটে গেল, সকাল পেরিয়ে দুপুর হলো, দুপুর পেরিয়ে বিকেল ,এক পর্যায়ে বিকেল পেরিয়ে আঁধারের চাদর মুড়ি দিয়ে রাত নেমে এলো সুবিশাল ধরনী জুড়ে, তখনও অরু যেন অস্তিত্বহীন, সারাদিনেও একটিবার দরজা খোলে নি ও। আর নাতো খোঁজ নিয়েছে ক্রীতিকের, ওদিকে ক্রীতিকও কেন যেন আগ বাড়িয়ে ঘাটায়নি অরুকে,আর ঘাটাবেই বা কেন? ও কি তার যোগ্যতা রাখে আদৌও? তাছাড়া অরু দরজা খুললে কিইবা জবাব দেবে ও? এইতো সকালেই, শুধু শুধু মেয়েটাকে কথার আ’ঘাতে ছি’ন্নভি’ন্ন করে দিয়েছে ক্রীতিক। ওর মাত্রাতিরিক্ত পসেসিভনেস, অবসেশন, টক্সিসিটি এসব অরুকে কষ্ট দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, ক্রীতিক সেটা ভালোকরেই জানে, তবুও কেন যেন রাগ উঠলে নিজেকে সংযত করতে পারেনা ক্রীতিক, অরুর বেলায় তো মোটেই না, তখন বারবার মনে হতে থাকে এই শরীর এই আত্মা সব আমার, সব। ওর সাথে যা ইচ্ছে তাই করতে পারি আমি, আমাকে বাঁধা দেওয়ার অধিকার কেউ রাখেনা, সয়ং অরু নিজেও না।
অথচ রাগ পরে গেলে সে সব ঘটনার জন্য ভীষণ অনুশোচনায় হৃদয়টা হাহাকার করে ওঠে ক্রীতিকের, বারবার মনে হয়, একটু একটু করে ভালোবাসার বীজ বপন শেষে ছোট্ট চারাগাছ থেকে বেড়ে ওঠা ফুলের মতো পবিত্র আত্মাটাকে কি করে এতোটা আ’ঘাত করলাম আমি? আমার মতো একটা লাগামহীন ছন্নছাড়া ছেলেকে ভালোবেসে অরুও তো আজ অবধি কম য’ন্ত্রনা সহ্য করেনি, শুধু মাত্র আমার টানে ইউ এস এ পর্যন্ত চলে এসেছে মেয়েটা, আর আমি? হিজিবিজি ভাবতে ভাবতেই ভীষণ ক্ষো’ভে চিৎকার করে উঠলো ক্রীতিক,
—- আআআআহ ফা’কড মাই এ্যারোগেন্সী।
এখন নিশ্চয়ই অরু ক্রীতিকের কোনো কথা শুনবে না? হ্যা, ক্রীতিক পারে অরুকে জোর জবরদস্তি করতে কিন্তু সকালের ঘটনার পরে সেটাকি আদৌও উচিৎ হবে? সেই ভেবেই নিজেকে সারাটাদিন গুটিয়ে রেখেছে ক্রীতিক, দুপুরের সময় অরুর পছন্দের বিরিয়ানি অর্ডার করে সেটাকে ড্রোনের সাহায্যে জানালা দিয়ে অরুর রুমে পাঠিয়েছে, তাও ওকে এই টুকু বিরক্ত করেনি ক্রীতিক। খাবারের সাথে দিয়ে দিয়েছে ছোট্ট একটা চিরকুট, যাতে লেখা,
—- আ’ম সরি হার্টবিট, আর এমন হবে না, জীবনেও হবেনা, একটু রুমে এলাউ কর, তোকে অনেক আদর করবো।
সাথে দুঃখী দুঃখী একটা ইমোজি। তবে এই চিরকুট ফিরকুটে আজ আর মন টললো না অরুর। ও খাবারটা রেখে দিয়ে চিরকুটটা পুনরায় ফেরত পাঠিয়ে দেয় ড্রোনের সাথে , ড্রোনটা চিরকুট সমেত ফিরে আসায় ক্রীতিক ভেবেছিলো অরু হয়তো কিছু লিখে পাঠিয়েছে, তাই তাড়াহুড়ো করে ব্যাকইয়ার্ড থেকে ড্রোনটা কুড়িয়ে চিরকুট খুলে ক্রীতিক দেখতে পায়, ওর সরিটা কেটেকুটে সেখানে কতগুলো রাগি ইমোজি এঁকে দিয়েছে অরু।
অগত্যাই বউয়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনাটা, নদীতে বহমান উল্টো স্রোতের মতোই বিফলে চলে গেলো জায়ান ক্রীতিকের।
*************************************************
অন্ধকারের মাঝে হাই পাওয়ারই চশমা দিয়েও খালি চোখে চারিদিকের কোনোকিছুই দেখার উপায় নেই, অথচ এই নিকোশ আধারের মাঝেও সায়রের দুঃখী দুঃখী মুখখানা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অর্ণব। খানিকবাদে বাদেই ফোঁসফাস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে সে। ঘটনাটা এক কিংবা দু’মিনিট ধরে চলমান নয়, সেই যে পাহাড়ের চূড়ায় এসে তিনজন মিলে বসেছে তখন থেকেই চারিদিকে নিরবতা বিরাজমান, ফাঁকে ফাঁকে সায়রের দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ ভেসে এলেও ক্রীতিক নিরবে স্মোক করছে শুধু , এদের দুঃখী দুঃখী ব্যথাতুর চিত্তের মাঝে পরে অর্ণবের নিজেকে এলিয়েন মনে হচ্ছে, যার আদতে কোনো দুঃখ কষ্ট বলে কিছুই নেই।
অথচ এলিসার প্রেগন্যান্সি মুড সুইং এর খপ্পরে পরে প্রতিদিন কি মা’রটাই না হজম করে ছেলেটা, সে কথা না হয় অজানাই থাক। আপাতত সায়রের এই দীর্ঘশ্বাস মেনে নেওয়া যাচ্ছে না মোটেই, ওকে থামাতে হবে, তাই কিছুটা বিরক্ত হয়ে অর্ণব বলে ওঠে,
—- কি হয়েছে বলতো? এভাবে নিঃশ্বাস নিতে থাকলে তো হায়াত ফুরাবার আগেই ম’রে যাবি তুই?
তৎক্ষনাৎ সায়র খেঁকিয়ে উঠে বললো,
—- তোদের মতো হা’ড়বজ্জাত বন্ধু থাকার চেয়ে ম’রে যাওয়া অনেক ভালো, শালা কি খাইয়ে পাঠালি কাল রাতে? কিছুই মনে নেই, সকালে উঠে দেখি বউ আমার রেগে বো’ম হয়ে আছে।
অর্ণব কপাল কুঁচকে বললো,
— চুমু কি খেয়েছিলি নাকি খাসনি? রাগটা করেছে কেন সেটা নিশ্চয়ই জানিস?
সায়র মুখ কাচুমাচু করে বললো,
—- আমার কিছুই মনে নেই, আর নীলিমা তো কথাই বলছে না,ব্রেকফাস্টে পো’ড়া রুটি খেতে দিয়েছে,তাও একটা।
সায়রের কথার পাছে অর্ণব মিনমিনিয়ে অসহায় সুরে বললো,
— তোর বউতো তাও খেতে দেয়, আমার বউ তো সকালে উঠেই ক্যারাটে প্র্যাকটিস করতে বেরিয়ে যায়।
— কিছু বললি?
অর্ণব না সূচক মাথা নাড়ালো, বললো,
— শোন, তুই আজ গিয়ে নীলিমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করবি, যে আদৌও তুই কিছু করেছিস নাকি করিসনি। যদি না করিস, তাহলে নতুন প্ল্যান বানাবো আমরা।যার নাম হবে মিশন ফুলসজ্জা ।
অর্ণবের কথায় সায়র হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে ক্রীতিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
—- তুই এখানে কি করিস? তোর না বাড়িতে বউ এসেছে? তাও তোর আমাদের সাথে আড্ডা দিতে মন চাইলো? স্ট্রেঞ্জ!
ক্রীতিক মুখ দিয়ে নিকোটিনের ধোঁয়া ছেড়ে বললো,
—- বউ রাগ করেছে।
তৎক্ষনাৎ নির্বিকার গলায় অর্ণব বলে উঠলো,
—- তো রাগ ভাঙালেই তো হয়, তাছাড়া অরু একটা সফ্টি, ও তোর উপর কতক্ষণই বা রাগ দেখাবে? বেশি হলে একঘন্টা।
—- সারাদিন,
অর্ণবের মুখের উপর কথাটা বলে সায়রের মতো করেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ক্রীতিক।
অর্ণব বুদ্ধিমানদের মতো মাথা দুলিয়ে বললো,
—- বুঝেছি জটিল সমস্যা, তুই একটা কাজ কর, তুই বরং অরুকে কোনো একটা সারপ্রাইজ দিয়ে দে, দেখবি রাগ ফাগ সব উধাও।
অর্ণবের কথায় ক্রীতিক ওর পানে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে, অর্ণব পুনরায় বলে,
—- এই ধর, ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে নিয়ে গেলি, ফুল দিয়ে প্রপোজ করছি, কিংবা কোনো রয়েল প্যালেসে নিয়ে গিয়ে ওকে একটু বেহালার সুর শোনালি, সেই বেহালার তালে তোরা দুজন বল নাচ করলি, তোদের পায়ের কাছে জমা হয়ে থাকবে অসংখ্য রঙিন বেলুন, মাথার উপর থেকে ঝড়ে পরবে টকটকে লাল গোলাপের পাপ…..
অর্ণব কথা শেষ করার আগেই ক্রীতিক ওকে ঠাস করে থামিয়ে দিয়ে বললো,
—- হয়েছে থাম, আমি এসব পারিনা, এগুলো আমার ডিকশনারিতেই নেই, ইভেন আজ পর্যন্ত আমি অরুকে নিয়ে কোনোদিন শপিং এ অবধি যাইনি, যখন যা প্রয়োজন সব অনলাইনে অর্ডার করেছি, বিয়েটা পর্যন্ত করেছি কোনোমতে, সেখানে তুই কিসব বুদ্ধি দিচ্ছিস? এসব আমার দ্বারা হবেনা।
কথা শেষ করে ক্রীতিক উঠে দাড়িয়ে, ওদেরকে রেখেই চলে যায়, অর্ণব পেছনে ঘুরে ক্রীতিকের যাওয়ার পানে তাকিয়ে গলা উঁচিয়ে শুধায়,
—- আরেহ কোথায় যাচ্ছিস?
ক্রীতিক যেতে যেতে জবাব দেয়,
— বউয়ের রাগ ভাঙাতে।
ক্রীতিক চলে গেলে সায়র অর্ণবকে বলে,
—ওদের হঠাৎ কি হলো বলতো?
অর্ণব মোবাইলে কিছু একটা চেইক করতে করতে জবাব দেয়,
—- জানিনা, তবে অরুর মামাতো ভাই রেজা এবার শেষ, ছেলেটা একটু বেশিই ধূর্ত।
সায়রের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পরলো, ও তৎক্ষনাৎ উদ্বিগ্ন গলায় শুধালো,
—- শেষ মানে?
অর্ণব কপট হেসে বললো,
—- কুল সায়র, কাল ইন্টারনেটে এমনিই দেখতে পাবি, এতো হাইপার হওয়ার কিছুই নেই।
*************************************************
গভীর রাতে ঘুমের মাঝে অরুর যখন মনে হতে থাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে একটা খরখরে উষ্ণ হাত অবাধে বিচরণ করছে ওর সমস্ত পৃষ্ঠদেশে ,ঠিক তখনই লাফিয়ে উঠে বসলো অরু, এদিক ওদিক চোখ বোলাতে গিয়ে ড্রীম লাইটের হলদে আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলো ক্রীতিক বসে আছে ওর মুখোমুখি হয়ে। তারমানে একটু আগের হাতটা ক্রীতিকেরই ছিল,ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই অরু রেখেমেগে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ক্রীতিক বলে ওঠে,
—- ব্যথা করছে হার্টবিট।
ক্রীতিকের কথায় রাগঢাগ ভুলে গিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো অরু, মনেমনে ভাবলো, সত্যিই তো আজ ক্রীতিক একটা অষুধও খায়নি, কি করেই বা খাবে? অষুধ তো সব বেডরুমে ছিল, আর অরুতো রাগের চোটে দরজাই খোলেনি বেডরুমের। ক্রীতিকের ব্যথার কথা শুনে অনুশোচনা হতে লাগলো অরুর মনে, ও তৎক্ষনাৎ ক্রীতিকের বাজ কাট সূচালো চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে করুন স্বরে বলে ওঠে,
—- মাথায় কি বেশি ব্যথা করছে?
ক্রীতিক না সূচক মাথা নাড়িয়ে অরুর হাতটা নিজ বুকের বাম পাশে রেখে শান্ত স্বরে বললো,
— এখানে ব্যথা করছে , তুই ইগনোর করলে আমার হৃদয়টা ব্যথা করে অরু, খুব ব্যথা করে।
চলবে……..
জ্বরের ঘোরে লিখেছি, তাই লেখায় ভুলক্রুটি হলে ক্ষমাপ্রার্থী।