সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁 #পর্বঃ৪৪ #লেখনীতে_suraiya_rafa

0
351

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ৪৪
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[ক,পি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য]

কাল সারা রাত বৈশাখী ঝড় দা’নবীয় তান্ডব চালিয়েছে পুরো শহর জুড়ে। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, গাছপালা উপড়ে পরে বিভিন্ন লেনের যান চলাচল বন্ধ। অতিরিক্ত বৃষ্টি পাতে পুরো ক্রীতিক কুঞ্জ ফ্যাকাশে রূপ ধারণ করেছে, থোঁকায় থোঁকায় বাগান বিলাশ গুলো ঝড়ে পরে আছে পিচে ঢাকা ফ্রন্ট ইয়ার্ড জুড়ে।

অনুর সন্দিহান দৃষ্টিপাত এড়াতে লাজুক অরু খোলা জানালা গলিয়ে বাইরে চেয়ে আছে সেই তখন থেকে, সারারাত ঝড়ের তোপে কেমন নেতিয়ে পরেছে সৌন্দর্য বর্ধক গাছপালা গুলো। আজ সূর্য উঠেছে,গাঢ় তার সোনালী কীরণ। খুব সম্ভবত দুপুর গড়াতেই গাছগুলো আবার আগের রূপ ধারণ করবে।

এই মূহুর্তে অনুর নিজেরও বেশ ইতস্তত বোধ হচ্ছে অরুর সাথে কথা বলতে, কি বলতে কি বলে ফেলেছে । ওই জন্যই তখন থেকে ওদের মাঝে পিনপতন নীরবতা বিরাজমান।

এই অসস্থিদায়ক মূহুর্তটাকে কোনো মতে এরিয়ে যাওয়ার দরুন হাতের আঙুলে ওড়না প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে অনুই ডেকে উঠলো প্রথমে,
—- বলছিলাম যে অরু, ইয়ে মানে,বলছিলাম…

—- এ্যাই আপা, আজকে তোদের প্রি ওয়েডিং পার্টি না? রাতে কতো মজা হবে বলতো?

অনুকে কথা বাড়ানোর কোনোরূপ ফুরসত না দিয়েই পেছনে তাকিয়ে ফট করে কথাটা বলে উঠলো অরু। ভাবটা এমন যেন ও নিস্পাপ একটা বাচ্চা, বিয়ে,বাসর, কিংবা জায়ান ক্রীতিক এসবের কোনোদিন নাম ও শোনেনি ও।

অরুর কথায় সস্থি পেলো অনু, তৎক্ষনাৎ হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
—- হ্যা এলিসা আপুরা আয়োজন করছে শুনলাম, আমাদের দেশে আবার এসব হয় নাকি? কিন্তু…

মূহুর্তেই ভার হয়ে এলো অনুর মুখশ্রী, আধার ঘনালো পান পাতার মতো উজ্জ্বল মুখটাতে।
অরু এগিয়ে এসে শুধালো,
—- কিন্তু কি আপা?

অরুর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির পাছে অনু জবাবের উৎস খুঁজে পেয়েছে কি পায়নি, তার আগেই, নিচতলা থেকে প্রচন্ড চেঁচামেচির আওয়াজে দু’বোন হকচকিয়ে উঠলো ওরা।

আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে কেউ কাউকে মা’রছে খুব , সকাল সকাল আবার ক্রীতিক কারোও সাথে ঝা’মেলা শুরু করলো নাতো? কথাটা বোধগম্য হতেই কলিজার পানি শুকিয়ে এলো অরুর। এই মানুষটা ঝামেলা মা’রামা’রি এসব না করে অরুকে একদন্ড শান্তি দিতে পারেনা নাকি?

না পারেনা, কারণ সে তো দ্য গ্রেট অ’সভ্য, উ’গ্র, বে’পরোয়া, ছ’ন্নছাড়া,জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী। যার কাজই হলো সকাল সন্ধ্যা ঝামেলা পাকানো।

অরুর নিস্ফল ভাবনার ছেদ ঘটে আবারও নিচ তলার তীব্র শোরগোলের আওয়াজে। ভ্রম ছুটে গেলে অরু আর এক মূহুর্ত ও অপেক্ষা করেনা, ওড়নাটা কোনোমতে গায়ে জড়িয়ে, দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে অনুকে বলে,
—- আপা চলতো, আবার কি হলো দেখে আসি।

অরুর কথায় উপুর নিচ মাথা নাড়িয়ে বড় বড় পা ফেলে দোতলা ছাড়লো অনুও।

ওরা দু’বোন যখন প্রচন্ত চিন্তায় উদ্বিগ্ন মস্তিষ্কে দ্রুত কদমে নিচে নেমে এলো, তখন অন্দরমহল পুরোপুরি নিরব।

অরু, অনু চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছে, হলরুমের মাঝ বরাবর পায়ের উপর পা তুলে ডিভানে বসে আছে ক্রীতিক। ওর আশেপাশে সায়র, অর্ণব, এলিসা,ক্যাথলিন, মোখলেস চাচা সবাই আছে। আজমেরী শেখ ও অন্য একটা কাউচে বসে আছেন।

সবার সামনে চরম অ’পরাধীর ন্যায় মেঝেতে বসে বসে কাঁদছে রুপা। দেখে মনে হচ্ছে এতোক্ষণের ঝ’ড় টা ওর উপর দিয়েই বয়ে গিয়েছে।

কারণ ওর দিকে তাকিয়ে এখনো রা’গে ফো’সফাস করছেন জাহানারা। তার আ’গুনের ফু’লকির মতো চোখজোড়া দেখে মনে হচ্ছে পারলে আরও কয়েক ঘাঁ বসিয়ে দেয় রুপাকে। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তি বলে তার হাত আটকে আছে, শক্তি বলটা কি তাহলে জায়ান ক্রীতিক? ভাবছে অরু।

চারিদিক অবলোকন করে অরু হিসহিসিয়ে অনুকে শুধালো,
— আপা, কি হয়েছে বলতো?

অনু জবাব দেয়,
—- কাল সন্ধ্যা বেলায় টিউশনে গিয়ে সারারাতেও আর বাড়িতে ফেরেনি রুপা, রেজা ভাই গিয়েছিল ওকে আনতে, কিন্তু গিয়ে শোনে রুপা নাকি টিউশনিতেই যায়নি। কোনো এক ছেলের সাথে ভেগেছে, তাই সকাল সকাল মামি এসেছিল ক্রীতিক কুঞ্জে, মাকে বলে কয়ে কিছু একটা উপায় বের করানোর জন্যে। সেটা জানাতেই তো আমি তোর রুমে গেলাম তখন। আর এখন এসব।

ওদের কথোপকথনের মাঝেই অন্দরমহলে প্রবেশ করেন অরুর মামা, তিনি চারিদিকের থমথমে পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে উঠতে না পেরে তার স্ত্রী জাহানারার দিকে এগিয়ে গিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালেন,
—- কি হয়েছে, মেয়েটা এভাবে মেঝেতে বসে কাঁদছে কেন?

স্বামীর কথায় গর্জে উঠলেন জাহানারা, রুষ্ট গলায় বললেন,
—- সেটা তোমার মেয়েকেই জিজ্ঞেস করো, সারারাত একটা ছেলের সাথে ফ’ষ্টিন’ষ্টি করে, মান সম্মান খুয়িয়ে এখন ঘরের চৌকাঠ মাড়িয়েছে, ওকে মে’রে ফেলো রেজার বাবা, নইলে আমি মহল্লায় মুখ দেখাতে পারবোনা। যেই জাহানারা সবাইকে কথায় দাবিয়ে রাখে, মুখের জোরে সবাইকে ওঠায় বসায়, আজ তার মেয়ে হয়ে ও কিনা এমন একটা নোং’রা কাজ করে ফিরলো? ছিহ!
এখন আমি ওকে দিয়ে করবো টা কি বলতে পারো?

অরুর মামা কিছুটা শান্তস্বরে বললেন,
— আহ, এভাবে বলছো কেন?

জাহানারা পুনরায় ঝাঁজিয়ে উঠে বললেন,
—- বলবোনা তো কি করবো? তোমার মেয়েকে গাড়ি করে কয়েকটা ছেলে মহল্লার মাঝখানে ফেলে রেখে গেছে। সবাই দেখেছে, কানাঘু’ষায় পুরো মহল্লা গরম, তোমার কি মনে হয়, এই মেয়ের আর বিয়ে হবে কোনোদিন? মুখপু’ড়ি সব খুয়িয়ে এখন আবার ফিরলি কেন?

এই বলে জাহানারা আবারও রূপাকে মা’রতে উদ্যত হবেন, ঠিক তখনই জাহানারা বরাবর কথার তী’র ছো’ড়ে ক্রীতিক,
—- স্টপ ইট,আই হেইট নয়েজ।

ক্রীতিকের গর্জনে থেমে গেলেন জাহানারা, জাহানারা থেমে যেতেই ক্রীতিক তীর্যক কন্ঠে পুনরায় বললো,
—- ঠিকই বলেছেন আপনি,আপনার মেয়ের কোথাও বিয়ে হবেনা, লোকজন আপনার সম্মুখে ছি ছি বুলি আওরাবে, এর কারণ অবশ্য আপনি নিজেই, লোকজনের হাঁড়ির খবর ঘেঁটে কাসুন্দি বানিয়েছেন এতোদিন। এখন সয়ং আপনার মেয়ের পালা,তারা তো এবার আপনাকে আখমাড়াই করবেই। এতে কোনো ভুল নেই।

ক্রীতিকের কথায় জাহানারা জবাব খুঁজে পেলোনা, জবাব দেওয়ার মতো কিই’বা আছে? কথা তো সত্য।

আজমেরী শেখ এখনো চুপচাপ, তিনি ক্রীতিকের পরবর্তী পদক্ষেপের অপেক্ষায়, আসলে চাইছেটা কি ক্রীতিক? সেটাই আপাতত ভাবছেন তিনি। অনু, অরু এখনো চুপচাপ শুকনো মুখে ঘরের এককোনে দাঁড়িয়ে আছে।

ক্রীতিক স্পষ্ট চোখে একনজর অরুর দিকে তাকালো, অতঃপর সবার সামনেই ওকে ডেকে বললো,
—- বেইবি, একগ্লাস পানি নিয়ে আয়তো, সকালে ব্রেকফাস্ট করে পানিটাও খেতে পারিনি।

অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলে,ক্রীতিকের কথায় মোখলেস চাচা হকচকিয়ে বলে ওঠেন,
—- আমি নিয়ে আসছি বাবা।

ক্রীতিক গম্ভীর গলায় বাঁধ সেধে বললো,
—- আমার বউ আছেতো এখানে, আপনি দাঁড়িয়ে থাকুন, আপনার সাথে জরুরি কথা আছে।

মোখলেস চাচাকে হুকুম করে, পরক্ষণেই জাহানারার দিকে তাকিয়ে ক্রীতিক বলে,
—- রূপাকে মোখলেস চাচার সাথে বিয়ে দিয়ে দিন। মোখলেস এখনো অবিবাহিত বয়স খুব বেশি না মাত্র পয়তাল্লিশ বছর।

ক্রীতিকের কথায় যেন বাজ পড়লো পুরো হলরুম জুড়ে। আজমেরী শেখ তৎক্ষনাৎ তেতে উঠে বললেন,
—– ক্রীতিক!এবার একটু বেশি বারাবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, অফিসেও তুমি আমার অমতে ইচ্ছে মতো রুলস দিয়ে যাচ্ছ আর এখন বাড়িতেও?

ক্রীতিক হাতের ইশারায় আজমেরী শেখকে থামিয়ে জিভ দিয়ে গাল ঠেলে বললো,
—- আমার কথা এখনো শেষ হয়নি মাদার ইন ল্। তাছাড়া ডিল টা আপনার আমার মাঝে হচ্ছে না, ডিল হচ্ছে আমার আর ওনার মাঝে, চোখ দিয়ে জাহানারাকে ইশারা করে ক্রীতিক।

—- তাই আপাতত আপনার মতামত গ্রহনযোগ্য নয়।

আজমেরী শেখ আর কথা না বাড়িয়ে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপ হয়ে গেলে জাহানারা রেগেমেগে বলেন,
—- তাই বলে বাড়ির কেয়ারটেকারের সাথে আপনি আমার মেয়ে….

জাহানারা কথা শেষ করার আগেই কথা ছুড়লো ক্রীতিক, বললো,
—– বিয়ে হয়ে গেলে আমার বনানীর ফ্ল্যাটটা আমি মোখলেস চাচা আর রুপার নামে উইল করে দেবো।এছাড়া মোখলেস চাচাকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী জেকে গ্রুপে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া হবে।আফটার অল আপনারা আমার বউয়ের পরম আত্নীয় এতোটুকু দায়বদ্ধতা তো আমার আছেই, রাইট?

ক্রীতিকের ছু’ড়ে মা’রা মেঘ না চাইতে জলের মতোন অফার শুনে জাহানারার চোখ বিস্ময়ে চিকচিক করে উঠলো। বনানীতে নিজস্ব ফ্ল্যাট তো তার বাবা দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠীর ও সাধ্যের বাইরে, সেখানে ক্রীতিক কিনা এমনি এমনি দিয়ে দেবে? জাহানারার চোখেমুখে লোভাতুর দৃশ্য ভেসে উঠেছে, ভেতরে ভেতরে টগবগ করছে কামনার লাবডুড। জাহানারা তখন থেকে চুপ হয়ে আছেন দেখে অরুর মামা এবার ক্রীতিকের কথায় নাকোচ করে বললো,
—- অসম্ভব, তাই বলে মেয়েকে এমন চল্লিশোর্ধ লোকের সাথে বিয়ে দেবো নাকি?

অরুর মামার রাশভারী কথা তখনই থেমে গেলো, যখন পাশ থেকে জাহানারা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলেন,
—- তুমি চুপ করো একদম, কে বিয়ে করবে তোমার এই অ’পয়া, হত’চ্ছা’ড়া, ন’ষ্টা মেয়েকে? যা হয় ভালোর জন্যই, উনি আমাদের ভালোর জন্যই একথা বলেছেন, চুপচাপ বিয়েতে মত দাও। তাছাড়া ওমন বিশাল ফ্ল্যাটের মালিক হলে মোখলেস কে জামাই বানাতে আমার কোনো অসুবিধা নেই।

এদিকে এই কাহিনির মূল চরিত্র মোখলেস চাচা এখনো হতবিহ্বল চোখে একে একে সবার কথা শুনে যাচ্ছে, ক্রীতিক কি আসলেই তাঁকে বিয়ে দিয়ে, তার এতো বছরের বি’ষাদময় আইবুড়ো নাম ঘোঁচাবে নাকি? সেটাই আপাতত ভাবছে মোখলেস চাচা।

সবার মাঝে নিরবতা বিরাজমান, শুধু মাত্র রুপা মায়ের হাত পা ধরে কা’ন্নাকাটি করছে, যাতে তাকে মোখলেস চাচার কাছে বিয়ে না দেওয়া হয়। অনু আর অরু মামিকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু জাহানারা তার সিদ্ধান্তে অনর, তিনি উল্টে খানিকটা দোনোমোনো করে ক্রীতিককে প্রশ্ন করেই বলেন,
—- বলছি যে,বিয়েটা হয়ে গেলে সত্যি ফ্ল্যাট পাবেতো ওরা?

ক্রীতিক গভীর গলায় বললো,
—- এখন বিয়ে হলে, উইলটাও এখনই হবে, আমার কাগজ পত্র সব রেডি।

ক্রীতিকের কথায় জাহানারা পুলকিত হয়ে নিজের স্বামীর উদ্দেশ্যে বললো,
—- ওগো তাহলে আর দেরি কেন? কাজী আনার ব্যবস্থা করো,
আজকেই বিয়ে হবে ওদের।

অরুর মামা খুব যে সৎ মানুষ তা নয়, টাকা,অধিপত্য এসবের লো’ভ তারও আছে, মেয়ের সূত্র ধরে যদি এভাবে রাতারাতি লাখ পতি হয়ে যাওয়া যায় তো ক্ষতি কি? হোক বিয়ে, মেয়ে তো আর পানিতে পরে যাচ্ছে না, উল্টো মোখলেস কে জামাই বানিয়ে নাকের ডগায় দড়ি দিয়ে ঘুরানো যাবে, ব্যাপারটা মন্দ হবেনা।

অবশেষে মনেমনে হাজারো লাভ লসের হিসেব কষিয়ে তবেই তিনি চললেন কাজী খোঁজার উদ্দেশ্যে।

শেষমেশ নানান জল্পনা কল্পনার ইতি টেনে রুপার বিয়ে হতে-হতে সকাল গড়িয়ে বিকেল হলো। একহাতে রুপাদের বিয়ে হয়েছে, আর অন্যহাতে ফ্ল্যাটের চাবি উঠেছে জাহানারার কোমরের গোছায়।

আজমেরী শেখের কিছু বলার ছিলোনা, বললেও হয়তো জাহানারা পাত্তা দিতেন না। তাই নিজের গুরুগম্ভীরতা ধরে রাখতে চুপই রয়েছিলেন তিনি। আজকাল ক্রীতিকের কর্মকান্ডে তিনি শুধুই নিরব দর্শক মাত্র। কোনো কিছু বলার বা ক্রীতিককের বাইরে গিয়ে কোনো সিন্ধান্ত নেওয়ার হেতু রাখেনা ক্রীতিক। ব্যাপারটা আজমেরী শেখের নিকট চ’রম বি’রক্তির পর্যায়ে উঠে এসেছে, তাও তিনি নিশ্চুপ।কারন একটাই, অনুর বিয়ে। অনুর বিয়েটা সর্বোত্তম পন্থায় দিতে চান তিনি। তারপর না হয় একে একে দান চালা যাবে। তাড়াহুরোর কিছু নেই। তাছাড়া আজমেরী শেখের তাড়াহুড়ো জিনিসটা পছন্দও নয় মোটে ।

আজ যেহেতু বিয়ের প্রথম দিন তাই মেয়ে জামাইকে নিয়ে খুশি মনে বাড়ি ফিরেছেন জাহানারা।
কে জানে? হয়তোবা অনুর বিয়ে উপলক্ষে দুয়েক একদিন বাদে আবারও পুরো পরিবার শুদ্ধ ক্রীতিক কুঞ্জে হাজির হবেন তিনি।

* অরু তরিঘরি পায়ে মাত্রই প্রবেশ করেছে ক্রীতিকের রুমে।রাগের তোপে শরীরটা রি রি করছে ওর। এখানে আসতে আসতেই ঠিক করে নিয়েছে যা হওয়ার হয়ে যাক আজকে ক্রীতিক কে কিছু কড়া শুনিয়ে তবেই এখান থেকে যাবে ও।

ক্রীতিক তখন রুমেই ছিল, আপাতত তার মনোযোগ ল্যাপটপে নিবদ্ধ। অরু ভেতরে গিয়ে আচমকা ক্রীতিকের মুখের সামনেই ল্যাপটপটা ঠাস করে বন্ধ দিলো।
অরুর কান্ডে ক্রীতিক কিছুটা রাগী গলায় বললো,
—– হোয়াট্স রং অরু?কাজ করছি তো।

অরুর এক অগাধ বিশ্বাস ক্রীতিক ওকে পা’গ’লের মতো ভালোবাসে, অন্য সবার সাথে যাই করুক না কেন,তবে অরু যদি ক্রীতিকের কলিজাটাও চি’বিয়ে খে’য়ে নে’য় তবুও ক্রীতিক টু শব্দটাও করবে না, সেই সাহস থেকেই রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ও বললো,
—- কাজ পরে করবেন, আগে বলুন এতো বড় একটা অ’ন্যায় কেন করলেন? মামীকে লো’ভ দেখিয়ে কেন মোখলেস চাচার মতো একটা চল্লিশোর্ধ লোকের সাথে রুপার বিয়ে দিলেন?বিয়ে কি একটা ছেলে খেলা?যে যার সাথে খুশি যেভাবে খুশি বিয়ে দিয়ে দিলেন?

আমি খুব ভালো করে জানি রুপা উধাও হওয়া থেকে শুরু করে এতো কাহিনীর পেছনে নিশ্চয়ই আপনার হাত আছে, বলুন কেন করেছেন এসব?

অরুর একাধারে বলে যাওয়া ননস্টপ কথার বহরে কান না দিয়ে পুনরায় ল্যাপটপে মন দিয়ে ক্রীতিক শান্ত স্বরে বললো,
—- বড়দের কথা এতো জানতে হয়না অরু, ভুলে গিয়েছিস আমি যে তোর বারো বছরের বড়?

ক্রীতিকের কথায় অরু বিরক্ত হয়ে বললো,
—– তা এতোই যখন আপনি বড়, আমি যে আপনার বারো বছরের ছোট সেটা কাল রাতে মনে ছিলোনা? এতো করে বলেছিলাম ছাড় দিয়েছিলেন একটুও? তখন তো নো ওয়ে, নো ওয়ে, করছিলেন।

অরু রাগে ফোসফাস করছে। কি বলছে, না বলছে, কিচ্ছু খেয়াল নেই ওর। তাই ক্রীতিক এবার উঠে গিয়ে অরুর মুখোমুখি হয়ে সটান দাঁড়িয়ে পরলো, অতঃপর ঘাড়টা একটু নিচু করে নরম, শান্ত, গলায় শুধালো,
—– কি হয়েছে, এতো রেগে আছিস কেন?

অরু ঠোঁট উল্টিয়ে শক্ত গলায় বললো ,
—- কেন করলেন এটা?

রাগের তোপে তিড়তিড়িয়ে কাঁপতে থাকা অরুর ফিনফিনে ঠোঁটে বৃদ্ধাঙ্গুলি বুলিয়ে ক্রীতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
—– তুই আমাকে না বললেও তোর শরীর আমাকে বলে দেয় অরু, আমার অবর্তমানে তোর উপর দিয়ে ঠিক কতটা ঝ’ড়ঝাপটা গিয়েছে। শুধু মাত্র আমাকে ভালোবাসার অ’পরাধে, আমাদের বিয়েটা মেনে নেওয়ার অ’পরাধে, তোর আশেপাশের মানুষ গুলো তোকে ঠিক কি পরিপান মানসিক য’ন্ত্রনায় ভুগিয়েছে সেটা তোর চেহারা, তোর শরীর দেখেই বুঝিয়ে গিয়েছি আমি।

ইউ এস এ থেকে আসার পর তোর অবস্থা দেখে নিজেকেই নিজের শা’স্তি দিতে ইচ্ছে করছিল আমার। তোকে যতবার চোখের সামনে দেখছিলাম ততবারই নিজের রা’গ সামলাতে পারছিলাম না আমি।মস্তিষ্ক আ’গুন হয়ে উঠছিল আমার। ইচ্ছে করছিল আরও আগে দেশে না ফেরার শা’স্তি সরূপ নিজেকেই নিজে শেষ করে দিই। ফলস্বরূপ তোকে বারবার এড়িয়ে গিয়েছি।

অরু এখনো প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, ডাগর ডাগর চোখ দুটো কৌতুহলে পরিপূর্ণ। ওর কৌতুহলের জোয়ারে কিছুটা ভাটি দিতে আবারও বলা শুরু করে ক্রীতিক,
—– মনে আছে অরু? আমি বলেছিলাম, তুই নিশ্চিন্তে থাক পুরো দুনিয়া আমি দু’হাতে সামলে নেবো। যে সমাজ আমার বউয়ের দিকে আঙুল তুলবে সেই সমাজের নিয়মই আমি পাল্টে দেবো।

হয়তো কিছুটা দেরী হয়েছে,কিন্তু আমি সেটাই করেছি, সমাজের রিপ্রেজেন্টার হিসেবে তোর মামী তোর দিকে বারবার আঙুল তুলেছে, তোর আমার বয়সের পার্থক্য নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে। তোর শরীরে আমার করা ভালোবাসার স্পর্শ গুলোকে নোং’রা বলে আখ্যায়িত করেছে। ওই জন্যই আমি ওনার কথার বান ওনাকে দিয়েই কাটিয়েছি।

আজ প্রথমে ওনার মেয়ের শরীরে নোং’রা স্পর্শের ক’লঙ্ক উঠেছে, পুরো মহল্লার কাছে খা’রাপ আ’খ্যায়িত হয়েছে, তারপর দিন শেষে লো’ভের তাড়নায় উনিই আবার ওনার মেয়েকে এমন একজন লোকের সাথে বিয়ে দিয়েছেন, যার সাথে ওনার মেয়ের বয়সের পার্থক্য এক, দুই, কিংবা বারো বছর নয়, গুনে গুনে ছাব্বিশ বছর।

আজ থেকে তোর মামী আর তোর সামনে, সমাজ নিয়ে টু শব্দও করবে না অরু। কারন আমি সমাজের নিয়মটাই ভে’ঙে দিয়েছি।

ক্রীতিকের কথায় হতবাক হয়ে ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে অরু, চোখ দুটো আগের চেয়েও বৃহৎ আকৃতি ধারণ করেছে, মনেমনে ভাবছে,
—- মানুষ এতোটা গভীর আর সুকৌশলি চিন্তা কিভাবে করতে পারে?

অরু তখন থেকে হতবুদ্ধি হয়ে দাড়িয়ে আছে দেখে ক্রীতিক ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,
—- কি বউ? সবটা মাথার উপর দিয়ে গেলোতো?

অরু নির্লিপ্ত চোখে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালে, ক্রীতিক ওকে বুকের মধ্যে টেনে এনে বললো,
—- চিন্তা নেই,মোখলেস চাচা মানুষ হিসেবে অসাধারণ। তাছাড়া ওরা যাতে ভালো থাকে সে সব ব্যবস্থা আমি নিজ হাতে করবো। তারচেয়েও বড় কথা রুপা যার সাথে পালিয়েছিল সেই ছেলেটা মোটেও সুবিধার না এক কথায় ডা’কা’ত বলতে পারিস। আ’ম সিওর ও রুপাকে দূরে কোথাও নিয়ে পাঁ’চা’র করে দিতো।

অরু নিজের নরম দু’হাতে ক্রীতিকের চওড়া পিঠখানা আঁকড়ে ধরে ওর শক্ত বুকের মাঝ বরাবর মুখ দাবিয়ে দিয়ে বললো,
—– আপনি কি জানেন? আপনি একটা বেস্ট হাসবেন্ড? সবার থেকে বেস্ট। আজ থেকে আপনি যে নিশানা ধরে পথ এগোবেন, আপনার ফেলে যাওয়া সেই পায়ের ছাপে পা রেখে চোখ বন্ধ করে এগিয়ে যাবো আমি, প্রমিস। এই যে পিংকি প্রমিস।

মিষ্টি হেসে কথাটা বলে ক্রীতিকের খরখরে কনু আঙুলের ভাঁজে নিজের কোমল তুলতুলে কনু আঙুলটা প্রবেশ করালো অরু।
***********************************************
যেহেতু নিজেরা নিজেরা, এদেশে ওদের চেনা পরিচিত তেমন কেউ নেই, তাই প্রি ওয়েডিং এর পার্টিটা ক্রীতিক কুঞ্জের ছাদেই আয়োজন করা হয়েছে।

মাত্রই কেক টেক কেটে মাদুর পেতে আড্ডা দিতে বসেছে সবাই। আগামী কাল অনু প্রত্যয়ের গায়ে হলুদ, পরশু বিয়ে, তারপর সারা জীবনের জন্য এই পরিবারের অতিথি হয়ে যাবে অনু।

অরুর তো তাও বাড়িতেই বিয়ে হয়েছে, তারউপর ক্রীতিক ওকে বাচ্চাদের মতো করে আগলে রাখে, কিন্তু অনুকে তো শশুর বাড়ি যেতে হবে, পুরো একটা আলাদা পরিবারের সাথে নিজেকে মানিয়ে গুছিয়ে নিতে হবে, দিন রাত সংসার সামলাতে হবে, সেসব ভাবতে গেলেই প্রত্যয়কে নিজের করে পাওয়া, বিয়ের আনন্দ সবকিছু কেমন ফিকে হয়ে যাচ্ছে অনুর হৃদয়ে।

এই আড্ডাতে অনু ছাড়াও আরও একজনার মুখটা মলিন হয়ে আছে, সে হলো এলিসা। যার কিনা এই বিয়ে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল,সেই সকাল থেকে মুখ ভার করে বসে আছে। প্রয়োজনের বাইরে কারও সাথে একটা কথাও বলছে না, কি অদ্ভুত?
অনুর মন খারাপের কারন জানে অরু, কিন্তু এলিসার এই মাত্রাতিরিক্ত বি’ষন্নতা কিছুতেই ধরতে পারছে না ও। অরু যখন চোখ মুখ কালো করে এলিসার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে এসব ভাবছিল,তখনই কনুই দিয়ে সামান্য খোঁ’চা মে’রে ওকে ডেকে উঠলো নীলিমা, শুধালো,
—- কি ভাবছিস বলতো তখন থেকে?

নীলিমার ডাকে ধ্যান ভাঙে অরুর, ও না সূচক মাথা নাড়িয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলো,
—– কিছুনা।

অতঃপর পুনরায় মন দিলো সবার সাথে আলাপ চারিতায়। আপাতত সায়রই বকবক করে যাচ্ছে সবার মাঝে। অর্ণব গিটার নিয়ে বসেছে গান গাইবে বলে। অনু আর প্রত্যয় চোখে চোখে হাজারো কথা আদান-প্রদান করছে।

ক্রীতিক সবার সাথে আড্ডা দিতে বসেছে ঠিকই, তবে তার ধ্যান জ্ঞান সবকিছুই ম্যাকবুকে নিবদ্ধ। নতুন নতুন অফিস জয়েন করার পর থেকেই সারাক্ষণ ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকে ও। কি জানি, কি করে?

ক্যাথলিন এলিসার কাধে মাথা রেখে অর্ণবের করা গিটারের টুংটাং আওয়াজে মন দিয়েছে। নীলিমা অরুর পাশে বসেই সায়রের সাথে একের পর এক যুক্তিবিদ্যায় ব্যস্ত।

একমাত্র অরুই চুপচাপ সবাইকে গভীর চোখে কে পরখ করছে। সায়র কি ভেবে যেন কথার একপর্যায়ে হুট করেই বললো,
—- গাইস চলো সবাই ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলা যাক।

আশেপাসের উৎসুক জনতা সবাই একে একে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালেও ক্রীতিক কিবোর্ডে আঙুল চালাতে চালাতে গভীর গলায় বললো,
—– আমাকে এসব ডেয়ার ফেয়ার দিলে খবর আছে তোর সায়র।

ক্রীতিকের কথায় সায়র বিরক্ত কন্ঠে বললো,
—- এখানে আছিস মানে তোর খেলায় অংশগ্রহন করতে হবে নো ক’ম্প্রোমাইজ।

কথা শেষ করে একটা খালি হুইস্কির বোতল সবার মাঝে ঘোরালো সায়র, বোতল ঘোরাতেই সবার আগে ফেঁ’সে গেলো বেচারি নীলিমা। সায়র নীলিমার দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
—- কি সাহসী আব্বাজানের সাহসী কন্যা, ট্রুথ না ডেয়ার?

নীলিমা ঠোঁট বেকিয়ে বললো,
—- ডেয়ার ফেয়ার পারবো না, ট্রুথ।

সায়র নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
—- ঠিকাছে বলো তাহলে, বয়ফ্রেন্ড আছে?

নীলিমা দাঁত কটমটিয়ে মনে মনে বললো,
—- ব’দমা’শ, বিদেশি বা’ন্দর, জানতাম তুই ভুলভাল কোশ্চেনই করবি আমায়।

—- কি ভয় পেয়ে গেলে নাকি রাগীনি?

নীলিমা থমথমে গলায় উত্তর দিলো,
—- না নেই।

নীলিমা জবাব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তেতে উঠলো সায়র,সবার সামনেই ঝড়ের গতিতে নীলিমার দিকে ঝুঁকে গিয়ে চোখ মুখ খিঁচিয়ে বললো,
—– বিএফ নেই তো আমাকে একটা চান্স দিতে পারতে, শুধু শুধু আব্বাজানকে দিয়ে তাড়া খাওয়ানোর মানেটা কি ছিল? তোমাদের মেয়েদের এতো ভাব কেন বলোতো?

সায়রের কান্ডে নীলিমা খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে, শুষ্ক ঢোক গিললো।

ওদিকে সায়রের ভাবসাব এমন যে আজকে নীলিমার সাথে একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে ও। কেন ওকে আছোলা বাঁ’শ নিয়ে তাড়া করা হলো সেই প্র’তিবাদ সরূপ। কিন্তু ওকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে অর্ণব বললো,
—– থাম ভাই, খেলার মাঝখানে কি শুরু করলি? খেলাটা কন্টিনিউ কর নয়তো চললাম, অনেক রাত হয়েছে ঘুমাবো।

সায়র নিজেকে সংবরণ করে ফোসফাস করতে করতে পুনরায় বোতল ঘোরালো, এবার গিয়ে বোতল থামলো ক্রীতিকের সামনে। ক্রীতিক সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেই, অর্ণব বললো,
—- কি নিবি ট্রুথ না ডেয়ার?

ক্রীতিক নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
—- ট্রুথ, তবে কোনোরূপ ফা’জলামো করবি না বলে দিলাম।

অর্ণব ক্রীতিকের স’র্তক বার্তায় দু’পয়সার তোয়াক্কা না করে, সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন ছু’ড়লো ওকে,
—- অরুকে তোর দেওয়া ফার্স্ট গিফট কি ছিল? আর এমন কি স্পেশাল গিফট যা তুই ওকে দিতে চাস এখনো দেওয়া হয়নি?

অর্ণবের কথা শেষ হলে ক্রীতিক ম্যাকবুক থেকে চোখ সরিয়ে অরুকে পর্যবেক্ষন করলো, যে লাজুক লতা হয়ে হাত দিয়ে কানের পেছনে চুল গুঁজে ক্রীতিকের দৃষ্টি এড়াতে বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ক্রীতিক অরুর দিকে দৃষ্টি রেখেই একটু ভেবে বললো,
—– আই থিংক ফার্স্ট গিফ্ট ছিলো কিছু পাজামা সেট। আর স্পেশাল গিফট যদি বলিস, দেন আই ওয়ান্না গিভ হার মাই বেস্ট ডি এন এ।

এ কি ঠোঁট কা’টা কথা!!ক্রীতিকের কথা শুনে কাশি উঠে গেলো সবার। অরু লজ্জা টজ্জা ঠিকেয় তুলে, ক্রীতিকের দিকে তাকিয়ে কটমটিয়ে বললো,
—- নি’র্লজ্জ লোক।

ক্রীতিক ঠোঁট উল্টে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
—– আশ্চর্য ট্রুথ আর ডেয়ার খেলা হচ্ছে, তাইতো সত্যিটা বললাম।

অরু চোখ মুখ খিঁচিয়ে বললো,
—- এই সত্যি কে বলতে বলেছে আপনাকে?

ওদের স্বামী স্ত্রীর বা’কবিত’ন্ডার মাঝে সায়র হো হো করে হেসে বললো,
—– শুনেছিস অর্ণন? জেকে এখনো বাসরটাই করতে পারলো না, এদিকে বাচ্চা উপহার দিয়ে দিচ্ছে? হাউ ফানি।হেহ হেহ।

ক্রীতিক সায়রের মেলে যাওয়া চোয়ালখানা আলতো হাতে বন্ধ করে দিয়ে বললো,
—- আপাতত মুখটা বন্ধ কর, যখন হবে তখন ঠিকই টের পাবি, আদৌও বাসর করেছি কি করিনি।

অরু তৎক্ষনাৎ সবার মধ্যে থেকে উঠে গিয়ে, গটগটিয়ে নিচে চলে গেলো।

সায়র হাঁক ছেড়ে বললো,
—- আরে এলোকেশী কোথায় চলে যাচ্ছো? খেলা তো শেষ হয়নি।

সায়র কথাটা উচ্চারন করার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিক আচমকা সায়রের গলা চে’পে ধরে বললো,
—– শা’লা তোকে কতবার বলেছি আমার বউকে তুই ডাকবি না কখনো। আবার ঢং করে এলোকেশী ডাকা হচ্ছে? আজ তোর খবর আছে। এই বলে ক্রীতিক সায়রের গলাটা গায়ের জো’রে চে’পে ধরে।

সায়র কোনো মতে শ্বাস টেনে অস্পষ্ট আওয়াজে অর্ণব কে ডেকে বলে,
—– ভাই থামা এটাকে, বিয়ের আগেই আমার হবু বউটা বি’ধবা হয়ে যাবে তো।

এলিসা ওদের ঝামেলার মাঝখানে অকস্মাৎ চেঁচিয়ে উঠলো, বেশ চড়া গলায় বললো,
—- থামবি তোরা? অসহ্য লাগছে আমার।

অর্ণব সায়রকে রেখে এলিসার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর মাথায় আলতো হাত ছুঁয়িয়ে বললো,
—- এলি, কি হয়েছে জান? মন খারাপ?

এলিসা জবাব দিলোনা এক ঝটকায় অর্ণবের হাতটা ঝা’ড়ি মে’রে সরিয়ে বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো ছাঁদ থেকে।

***********************************************
গোধূলি শেষে সন্ধ্যা তিমিরে মুড়িয়ে গিয়েছে চারিপাশ। আজ বোধহয় আমাবস্যা তাই সন্ধ্যাক্ষনেই রাতের মতো নিকোশ কালো আধার নেমেছে ধরনী জুড়ে। তবেই সেই আধারের এক চিলতে নিকোশ কালোও অবশিষ্ট নেই ক্রীতিক কুঞ্জে। কি করেই বা থাকবে? পুরো বাড়িটা ফেইরী লাইট আর ল্যান্টটার্নের আলোয় ঝিকমিক করছে।

সন্ধ্যা হতেই যেন পুরো মহল্লা জ্বলে উঠেছে ক্রীতিক কুঞ্জের চকচকে আলোয়। অদূর সদরঘাট থেকেও সেই আলোর ছটা পাখির চোখে দেখা যাচ্ছে। মানুষ ঘুরে ঘুরে দেখছে আর ভাবছে কি হচ্ছে ওখানে, এতো আলোই বা কেন?

আজমেরী শেখ কোনোরূপ ক্রুটি রাখতে চাননা মেয়ের বিয়েতে, ওই জন্যই হয়তো এতো আয়োজন, ধুমধামের কোনোশেষ নেই।

সন্ধ্যার পরপরই গেইট ছাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে নামি-দামি গাড়ির বহর। এরা কেউ কেউ জেকে গ্রুপের ভিআইপি ক্লায়েন্ট, নয়তো জামশেদ জায়ানের রাজনৈতিক সূত্রে পূর্ব পরিচিতরা। যাদের আপাতত আজমেরী শেখ আর ক্রীতিক দুজন মিলেই আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। যদিওবা দুজন কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেনা, কিন্তু এই মূহুর্তে ক্লায়েন্টদের সামনে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই সামলাচ্ছে তারা। ইটস কলড প্রফেশনাল রিলেশন, যেটা ক্রীতিক আর আজমেরী শেখ দুজনই বেশ ভালো মতো রপ্ত করতে পারে।

প্রত্যয় অনু স্টেজে বসে আছে। ওদেরকে মেহমানরা টুকটাক উপহার সামগ্রী দিয়ে যাচ্ছে। এখনো গায়ে হলুদ পর্ব শুরু হয়নি। গেস্টরা সবাই সফ্ট ডিংকস পান করছে। ক্রীতিক অনেক বছর পর দেশে ফেরার দরুন অনেকেই এগিয়ে এসে ওর সাথে কুশল বিনিময় করে যাচ্ছে।

এলিসা মাত্রই অন্দর মহল থেকে বেরিয়েছে ওর পরনে ল্যাভেন্ডার কালারের লেহেঙ্গা। গায়ে হলুদের প্রোগ্রাম হলেও আলাদা কোনো ড্রেসকোর্ট ছিলনা বলে, যে যার মতো জামাকাপড় পরে নিয়েছে ওরা। তবে অর্ণব এলিসার সাথে মিলিয়ে ল্যাভেন্ডার কালারেরই পাঞ্জাবি চড়িয়েছে গায়ে। সায়রের আপাতত দেখা মিলছে না।

ক্রীতিক মেরুন ভেলভেট প্রিন্স কোর্ট পরেছে,
সেই সাথে ব্ল্যাক স্কিনি ডেনিম। ঘাড় ছুঁই ছুঁই চুল গুলো আজ বেশ অনেকটা ছোট করা হয়েছে।

এলিসাকে বেরোতে দেখে অর্ণব ওর হাত টেনে আহত সুরে বললো,
—- কথা বলছিস না কেন এলি, কি হয়েছে?

এলিসা কঠোর গলায় বললো,
—- হাত ছাড় অর্ণব ভাল্লাগছে না।

—- না ছাড়বো না।

ওদের এই বা’কবিত’ন্ডার মাঝেই হুট করে, একদম হুট করেই, স্টেজে এন্ট্রি নিলো দুজন ব্রাইডমেট, প্রথমে লাল নীল চোখ ধাঁধানো লাইট, অতঃপর হঠাৎ করেই বেজে ওঠে সবার প্রিয় গান।

এলিসা অর্ণব তৎক্ষনাৎ, নিজেদের তর্কবির্তকের ইতি টেনে অবাক চোখে স্টেজে তাকালো।
সায়র মাত্রই কিছু মিষ্টি আর দধি নিয়ে একসাইডের টেবিলে বসেছিল। ও সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে এই বিয়েতে ও ডায়েট ফায়েট ভুলে সব খাবে।

তারপর আমেরিকা ফিরে যা হবে দেখা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ এক চামচ দধি মুখেও নিয়েছিল কেবল, কিন্তু সেই দধি গলা দিয়ে নামার আগেই ওর চোখ আটকে গেলো স্টেজে।

দেখলো ফেইরী টেল থেকে নেমে আসা দুটো জলজ্যান্ত পরী স্টেজে হিন্দি গানের সাথে কোমড় দোলাচ্ছে। তাদের হাসির ফোয়ারা যেন চারিদিকে মুক্ত দানার ন্যায় ঝরে পরছে।
সেদিকে তাকিয়ে কয়েকবার পলক ফেলে অস্ফুটেই সায়র বললো,
—– এটাকি আসলেই আমার রাগীনিটা নাকি? হায় আল্লাহ, এতো সুন্দর কেন লাগছে, নজর লেগে যাবেতো সবার। পঁ’চা মেয়েটাকে কে বলেছে এভাবে নাচতে? আমার তো হার্টবিট ফে’ইল করছে, ওহ গড।

ক্রীতিক তখনও ক্লায়েন্টদের সাথে কুশল বিনিময়ে ব্যস্ত। একজনের পর একজন আসছেই, চারিদিকে তাকানোর ফুরসত নেই ওর।
নেই স্টেজের দিকেও মন। কিন্তু হঠাৎ করেই ওর কেন যেন মনে হলো, স্টেজে এই মূহুর্তে যে মেয়েটা গানের তালে পা দোলাচ্ছে, সুন্দর সুন্দর ভঙ্গিমাতে হেলেদুলে নাচ করছে, সেই মেয়েটাকে ও চেনে।

কেন যেন উষ্ণ হৃদয়টা বলছে একবার ফিরে তাকা ক্রীতিক, শুধু একবার, এন্ড দেন, ইউ উইল বি ফা’কিং স্পিচ লেস।

ক্রীতিক তাকালো, হুট করে নয়, আস্তে আস্তে সময় নিয়ে নজর ঘোরালো, আর তারপর?
ওর হৃদয়টা ওখানেই থমকে গেলো। অরুকে এতোটা হাসিখুশি বোধ হয় এই জীবনে দেখেনি ক্রীতিক। তারউপর এমন মাতাল করা নাচ?

অরু এতো সুন্দর করে নাচতেও পারে? ক্রীতিক হা হয়ে তাকিয়ে আছে স্টেজে নৃত্যরত ওই অষ্টাদশীর দিকে। পরনে অফ হোয়াইট লেহেঙ্গা, হাঁটু সমান লম্বা চুল গুলো পুরোপুরি বাঁধন হারা তার। গলায়, কানে, সিঁথিতে সাদা পাথরের ছোট ছোট জুয়েলারীতে অরুকে দেখে চোখ জ্বলে যাচ্ছে ক্রীতিকের।

এই মেয়েটা ওর হৃদয়হরনী, সেই ছোট্ট বেলা থেকে নিজের মায়াবলে ক্রীতিককে ব’শ করে রেখেছে।

আজকে মনে হচ্ছে অরুকে নতুন করে আবিষ্কার করলো ক্রীতিক। যে অরু নিজেকে মেলে ধরতে জানে, খিলখিলিয়ে হাসতে জানে, বুক ভরে শ্বাস নিতে জানে।

কিন্তু ক্রীতিক তো শ্বাস নিতে পারছে না, ওর তো দ’ম ব’ন্ধ হয়ে আসছে। এই অরুকে দেখে ওর মোটেই সস্থি লাগছে না, কেমন হাসফাস লাগছে, বুকের ভেতরটা সুক্ষ্ম ব্য’থায় চিনচিন করছে, বারবার মনে হচ্ছে আমার বউটা এতো কেন সুন্দর? এতো কেন নিখুঁত? উপর ওয়ালা কি একটু খানি খুঁত রাখতে পারতো না? ক্রীতিককে একটুখানি সস্থি দেওয়ার জন্য?

এখন যে ক্রীতিকের মাতাল মাতাল লাগছে খুব, ইচ্ছে করছে নৃত্যরত অরুর পাশে দাড়িয়ে সবাইকে এনাউন্সমেন্ট করে বলতে, দেখো সবাই এই মিষ্টি মেয়েটা আমার বউ, আমার হার্টবিট, আমার সবকিছু, শুধু আমার। ওর নেশায় আমি আসক্ত, সঙ্গিন প্রনয়াসক্ত।

কিন্তু ক্রীতিক তো সেসব বলতে পারেনা, কারন হৃদয়ের কথা মুখ ফুটে বলে বেড়ানো ওর ধাঁচে নেই। তাই অরুর নাচ শেষ হতেই ওকে টেনে টুনে মহলের মধ্যে নিয়ে গেলো ক্রীতিক।

করিডোরের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অরু একটু ভয়ার্ত গলায় শুধালো,
—- কি হয়েছে? এভাবে টানছেন কেন?

ক্রীতিক অরুর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে হাস্কিটোনে বললো,
—- কি করেছিস এটা? আমি তো ঠিক নেই অরু, আ’ম নট ওকে?

অরু ক্রীতিকের কপালে হাত ছুয়িয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে ওঠে ,
—- কেন কি হয়েছে? সেদিন বৃষ্টিতে ভিজলেন বলে জ্বর আসেনি তো আবার, দেখি?

ক্রীতিক অরুর হাত সরিয়ে দিয়ে, নিজের একহাত, অরুর আঁচলের ফাঁক গলিয়ে ওর মেদহীন উদরে ছোঁয়ালো। ক্রীতিকের শক্ত হাতের স্পর্শে তৎক্ষনাৎ কেঁপে উঠল অরু। কম্পিত কন্ঠে বললো,
— কি করছেন, আঁচলটা এলোমেলো হয়ে যাবে তো।

—- হলে হোক, তুই যে আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছিস তার কি হবে? এভাবে কেন নাচতে গেলি অরু? আমার যে এখন বুকে ব্য’থা করছে খুব, মনে হচ্ছে ম’রে যাবো। তোকে একান্তে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু সেটাতো এই মূহুর্তে সম্ভব নয়।
কারন বাইরে সবাই আমার সাথে মিট করার জন্য ওয়েট করে বসে আছে।

তাহলে এখন কি করবো আমি? তোর প্রতি এতো কেন আ’সক্তি আমার? কেন এতো সুন্দর তুই?বলনা?

তোকে কাছে না পেয়ে আমি যদি বুকের ব্যথায় ম’রে যাই? তখন সব দোষ তোর।

ক্রীতিক উ’দভ্রান্তের একের পর এক বুলি আওড়ে যাচ্ছিল। ওর চোখে মুখে ভীষণ কাতরতা,ভীষণ অসহায়ত্ব।
কিন্তু এই পর্যায়ে এসে ওর মুখটা হাত দিয়ে আলতো করে চেপে ধরলো অরু।

অতঃপর ক্রীতিকের চোখে চোখ রেখে না সূচক মাথা নাড়ালো।

ক্রীতিকের একটা হাত তখন ও পেছনে লুকোনো। অরু চুপচাপ দাড়িয়ে আছে দেখে ক্রীতিক এবার বিনা দ্বিধায় হাঁটু ভে’ঙে বসে পরলো ওর সামনে,আলতো হাতে শাড়ির আঁচলটা সরিয়ে নির্লিপ্তে ঠোঁট ছোঁয়ালো অরুর তুলতুলে কোমল উদরে, এরপর অন্য হাতটা সামনে বাড়িয়ে কাঁচা হলুদের রঙে রাঙিয়ে দিলো অরুর সমগ্র উদর।

ক্রীতিকের একেক’টা কাজে প্রত্যেক বারই বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে পরে অরু,এবারও তার বিপরীত নয়। তবে এই মূহুর্তে বিস্ময়ের চেয়েও লজ্জায় চুপসে গিয়েছে ও। ক্রীতিক কি করলো এটা? কারও চোখে পরলে নিশ্চয়ই অরুকে পা’গল ভাববে? তারা’তো আর জানেনা যে অরুর একটা পা’গল স্বামী আছে।

অরু আপন মনে হিজিবিজি ভাবছে,ক্রীতিকের ঘোর কাটেনি তখনও। ও উঠে দাড়িয়ে অরুকে এক ঝটকায় পেছনে ঘুরিয়ে, অরুর লম্বা চুলগুলো একপাশে সরিয়ে দেয়, এবং এর পরপরই পুনরায় নিজ হাতে হলুদ রঙে রাঙিয়ে দিলো ওর কোমল পৃষ্ঠদেশ। অতঃপর সেভাবেই পেছন থেকে দু’হাতে শক্ত করে অরুর কোমড় জড়িয়ে ধরে,ওর হলুদ লাগানো পৃষ্ঠদেশে নিজের গাল ঘষে দিলো পরম আবেশে।

ক্রীতিকের খড় দাঁড়ির সূঁচালো অনুভূতি আর ঠোঁটের স্পর্শে আরও একদফা কাঁপুনি দিয়ে ওঠে অরুর সর্বাঙ্গ। ও আর সহ্য করতে পারলো না ক্রীতিকের এমন এলোমেলো স্পর্শ। অগত্যাই ক্রীতিকের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে, একছুটে পালিয়ে চলে গেলো ক্রীতিকের দৃষ্টির অগোচরে।
চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here