মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ #৯ম_পর্ব

0
144

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#৯ম_পর্ব

“আমি তোকে ঘৃণা করি অভ্র, সারাজীবন করবো। শুধু তোর জন্য আমার ভালোবাসা আমার হলো না। ঘৃণা করি তোকে”
“যা কখনো শুরুই হয় নি সেটার জন্য এতো কান্নার কি আছে?”
“আমার ভালোবাসার পূর্ণতা কার জন্য পায় নি অভ্র? প্রতিটা গল্পের একটা ভিলেন থাকে, আমার গল্পের ভিলেনটা তুই অভ্র। শুধু তুই”

অভ্র স্তব্ধ তাকিয়ে রইল। শ্যামমুখখানা রাগে রক্তিম হয়ে আছে তার। ঐন্দ্রিলার চোখজোড়া ঝাপসা। রাগে, ক্রোধ, বিষাদে অন্ধপ্রায় হয়ে গেলো যেনো সে। ভেতরে কেউ যেনো বারবার আক্রমন করছে বিষাক্ত ছো’রা দিয়ে। অভ্রের চেহারা দেখতেও ঘৃণা করছে। দাঁড়ালো না। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো। পা টনটন করছে, হিলের প্রভাবে ফুলে গেছে তা। কিন্তু ঐন্দ্রিলা অনুভূতিহীন। তার বোধশক্তিগুলো যেনো জড় হয়ে গেছে। অন্তর্জ্বালায় দগ্ধ হৃদয়ে কিছুই অনুভূত হচ্ছে না। অভ্র তাকিয়ে রইলো ঐন্দ্রিলার যাবার পানে। রাগে দপদপ করছে কপালের শিরা। হাতের শিরাগুলোও ফুলে উঠেছে। ফলে আক্রোশে অন্ধ হয়ে সজোরে ঘুষি মারলো দেওয়ালে। চিরে গেলো হাতের চামড়া। সামান্য রক্ত গড়ালো। কিন্তু রাগ ধমলো না। পশ্চিম আকাশ কালো হয়ে এসেছে। গুমোট মেঘের প্রলয় ঘর্ষণে কেঁপে উঠলো ধরণী। অভ্র ফোন বের করে বিল্লালকে ফোন করলো। বিল্লাল মাত্র দুপুরের খাবার খেয়ে শুতে যাচ্ছিলো। অভ্রের ফোনে লাফিয়ে উঠলো। ধরতে না ধরতেই সিংহের গর্জনের মতো ঠেকলো অভ্রের স্বর,
“এক্ষনি, বাইপাসে আয়”

বলেই ফোন কেটে দিলো অভ্র। বিল্লাল বোকার মত চেয়ে রইলো মোবাইলের দিকে।

******

সালাম সাহেবের বাসায় মেহমানের আগমন ঘটতে আরম্ভ করেছে। ছোট বোন হ্যাপি তার পরিবার সহ উপস্থিত হয়েছে দুপুরবেলা। সাবেরা তার জন্য ঘর পরিষ্কার করে দিলো। হ্যাপি এসেই শুধালো,
“ভাবী, আমাদের ঐন্দ্রিলা কোথায় গো?”
“জামাইয়ের সাথে বাহিরে গেছে”
“সেকি, বিয়ের আগেই এতো মেলামেশা?”

হ্যাপির স্বভাবটা একটু সংকীর্ণমনা। একটু খুঁচিয়ে কথা না বললে তার হয় না। সাবেরার অভ্যেস হয়ে গেছে ননদের এমন স্বভাবের। তাই হেসে বললো,
“অচেনা তো না তারা হ্যাপি, এক সাথে বড় হয়েছে। এক স্কুল, এক কলেজ। পাশাপাশি থেকেছে সারাজীবন। তাই আমার চিন্তা নেই। আর যে পুরুষের সাথে সারাটাজীবন কাটাবে, তার সাথে একটু ঘোরাঘুরি করলে নিশ্চয়ই পাপ হবে না”

হ্যাপির মুখটা কালো হয়ে গেলো। টিটকারি দিয়ে বললো,
“তোমার তো ভাগ্য ভালো গো, বাড়ির পাশে ছেলে পেয়ে গেছো। ঐন্দ্রিলার যা রাগ, আমি তো চিন্তায় ছিলাম আদৌ আমার ভাতিজির বিয়ে হবে কি না। বাড়ির পাশের শ্বশুরবাড়ি যেহেতু তারা নিশ্চয়ই জানে ঐন্দ্রিলার স্বভাব”
“হ্যা গো, জানে। তুমি ঘরে যেয়ে বিশ্রাম কর”

সাবেরার ননদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু হ্যাপি তো নাছোরবান্দা তাই ফট করে শুধালো,
“নীলাদ্রী কই ভাবি, দেখি না যে”
“আমি ওকে ত্যাজ্যপুত্র করেছি”

নির্লিপ্ত স্বরে উত্তর দিলেন সালাম সাহেব। হ্যাপি হতবাক হলো, বিস্মিত কন্ঠে বললো,
“কি কউ ভাইজান, আসলে?”
“হ্যা। এখন তুই এই কথাটা এখন ই বিবিসি চ্যানেলের মত সবাইকে জানিয়ে দে। আজকের ব্রেকিং নিউজ হল সালাম মজুমদার তার বড় ছেলে নীলাদ্রি মজুমদারকে ত্যাজ্য করেছে। ফোনে রিচার্জ করা আছে নাকি বাদশাহকে বলবো”

হ্যাপির স্বভাব সম্পর্কে সালাম সাহেবের অজানা নয়। সে সারাক্ষণ শকুনের মত সবকিছু খুতিয়ে দেখবে তারপর তা নিয়ে সমালোচনা আলোচনা করে হট টপিক বানাবে। চোগলখুরিতা যেন রক্তের সাথে মিশে আছে। সালাম সাহেবের কথা শুনে হ্যাপির মুখ কালো হয়ে গেলো। মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“ভাতিজার খোঁজ নিলেও দেখি দোষ ভাবী”
“নিতে বলেছে কে তোকে? তুই বিয়ে খেতে এসেছিস বিয়ে খা না। এতো প্যাচাল পারিস কেন?”
“ভাবী, ভাইজান আমাকে অপমান করছে”

সাবেরার মেজাজ খারাপ হলো। এই ভাইবোনের কোন্দলে সে যেন রেফারি। বলে রাগী স্বরে বললো,
“তোমাদের ঝগড়া করতে হবে আমার ঘরের বাড়িয়ে যেয়ে কর এখানে নয়। হ্যাপি, তোমার ভাই জন্মগত ক্ষেপাটে। তাই তুমি ঘরে যাও। বিশ্রাম নাও। তারপর আসো খেয়ে নিবে”

হ্যাপি আর কথা বাড়ালো না। সাবেরা সালাম সাহেবের কাছে এসে বিরক্ত গলায় বললো,
“ছেলের সাথে ঝগড়া করেছো, এখন কি বোনের সাথেও করবে নাকি?”
“শোন সাবেরা, আমি কারোর সাথে ঝগড়া করি নি। আমি উচিত কথা বলেছি। আর তোমার আহাম্মক পুত্র আমার ঝগড়ার যোগ্যও না”

ঠিক তখন ই কলিংবেল বাজলো। সাবেরা বিরক্ত মুখে দরজা খুলতে গেলো। দরজা খুলতেই দেখলো একটা যুবক দাঁড়িয়ে আছে। উশখো খুশকো চুল, পরণে একটা হাফহাতা টিশার্ট আর হাফপ্যান্ট। জামা এতোই ময়লা যে রঙ্গ বেরঙ্গ হয়ে গেছে। মুখভর্তি অবিন্যস্ত দাঁড়ি। চোখে কালো চশমা। কাঁধে বিশাল একটা বস্তা ব্যাগ। সাবেরা অবাক নয়নে শুধালো,
“কাকে চাই?”

যুবক চশমা খুলে বললো,
“মা, তুমি আমাকে চিনছো না?”
“নীলাদ্রি?”

নিজের উচু লম্বা, গৌঢ় বর্ণের সৌম্যপুরুষের ন্যায় দেখতে ছেলেকে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে বিস্ময়ের চরম শিখড়ে পৌছে গেলো সাবেরা। গায়ের রঙ্গ পুড়তে পুড়তে তামাটে হয়ে গেছে। মুখে দাঁড়ির জঙ্গলে মুখের অর্ধেক অংশ ঢাকা পড়েছে। উপরে মোটা সানগ্লাস। আর কি পোশাকের ধরন। টিশার্টের ফুটো নজরে পড়ছে। সাবেরা ছেলের মুখে হাত দিয়ে বললো,
“তোর কি অবস্থা বাপ?”

তখন ই সালাম সাহেব বেরিয়ে এলেন। সাবেরাকে বললেন,
“সাবেরা, ভিক্ষুকটাকে পাঁচ টাকা দিয়ে দাও”
“ছিঃছিঃ কি বলছো, আমাদের ছেলেকে ভিক্ষুক বলছো কেন?”
“আমার কোন ছেলে নেই, গত তিনদিন আগে মধ্যাহ্নে আমি ত্যাজ্য করেছি”

নীলাদ্রি চোখ কুচকে তাকালো। কড়া স্বরে বললো,
“আমি আপনার বাসায় আসি নি মিঃ সালাম মজুমদার। এটা আমার দাদার বাড়ি। আপনি আমার ত্যাজ্য করেছেন মুখে মুখে। খাতাকলমে না। তাই এখানে আমি আসতেই পারি। মা আমাকে এক বালতি গরম পানি দিবে। আমি গোসল করবো। গত সাতদিন আমি গোসল করি নি। যেহেতু আমি এখন পাহাড়ে নেই। তাই পাহাড়ের জীবন থেকে কয়েকদিনের ব্রেক নিচ্ছি”

বলেই নিজের ঘরের দিকে যেতে গেলে সালাম সাহেব বলে উঠলেন,
“সাবেরা গাধাকে বলে দাও, তার ঘর এখন তার ঘর নেই। কথা অনুযায়ী তিন দিন যাবৎ সেটা আমার পার্সোনাল স্পেস”

কথাটা শোনা মাত্র নীলাদ্রির চোখ মুখ কুচকে এলো। মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“সালাম সাহেব কি আমার রুম দখল করেছে মা?”
“তুমি ছাদের রুমটায় থাকতে পারো বাবা”
“না, মা। এই বাড়িতেই আমি থাকবো না”
“তাহলে কোথায় থাকবে তুমি?”
“সময় হলেই জানতে পারবে। এখন আমি গেস্ট বাথরুমে যাচ্ছি, আশা করি সেটা অন্তত সালাম সাহেবের পার্সোনাল স্পেস না”

বলেই হনহন করে বাথরুমে ঢুকে পড়লো। সাবেরা রাগী স্বরে বলল,
“এটা কি হলো?”
“তোমার ছেলের শাস্তি। গাধার বাপ আমি। গাধা পিটিয়ে যদি মানুষ না বানাই আমার নাম সালাম নয়”

স্বামীর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন সাবেরা। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন। এই বাপ ছেলের ঝামেলায় তিনি পড়তেও চান না।

*************

পিচের রাস্তার উপর ঝড়ের বেগে চলছে অভ্রের মোটরসাইকেল। হৃদয়ের সব রাগ উগড়ে দিচ্ছে যেনো এক্সেলেটরের উপর। বিল্লাল এবং তরুনের বাইক ঠিক তার পেছনে। তবুও বেগের সাথে পেরে উঠছে না। অভ্রের মোটরসাইকেলের বেগ আরোও বাড়ালো। ঐন্দ্রিলার আঘাত তাকে বিবশ করে দিয়েছে যেন। মস্তিষ্কে ছেপে গেছে সেই অশ্রুসিক্ত নয়ন। এই অশ্রু তার জন্য নয়। এই অশ্রু অন্যের জন্য। যা মোটেই মানতে পারছে না অভ্র। হঠাৎ রং সাইড থেকে একটা বাইক তীব্র বেগে আসতে দেখে স্বম্বিৎ ফিরলো। সাথে সাথে ব্রেক চাপলো অভ্র। কিন্তু তাতে লাভ হলো না। সংঘর্ষ হলো। ফলে ছিটকে গেলো অভ্রের বাইক। পিচের রাস্তায় স্লাইড করতে করতে চলে গেলো বেশ দূর। বিল্লাল এবং তরুন পেছনেই ছিলো। তারা ছুটে এলো। ভাগ্যক্রমে শুধু হাটুতে আর কনুই এ সামান্য ব্যাথা পেলো সে। লোক জড়ো হলো মুহূর্তের মধ্যেই। অপর বাইকের ছেলেটি ব্রেক কষলো। একেই মাথায় আগুন জ্বলছে অভ্রের। ফলে রাগ কিছুতেই দমাতে পারলো না। গালি দিয়ে বসলো অপর চালককে। সেই বাইকে দুজন যাত্রী। যদিও তাদের দোষ কিন্তু তারা মোটেই সেটা মানতে চাইলো না। তাদের ভাষ্য দূর্ঘটনা অভ্রের জন্য হয়েছে। একদু কথায় বেশ ঝগড়া বাধলো। একটা সময় উত্তেজিত হলো পরিবেশ। ফলে রাগের বশে কলার ধরে একটা ছেলেকে নামালো অভ্র বাইক থেকে। এলোপাথাড়ি ঘুষি দিলো। অবস্থা খারাপ দেখে বিল্লাল থামালো অভ্রকে। কোমড় ধরে তাকে টেনে আনলো। ঝামটি দিয়ে বললো,
“পাগল হয়েছিস তুই? রাস্তায় মারামারি করিস না”
“আমি কি শুরু করেছি নাকি?”

চেচিয়ে উত্তর দিলো অভ্র। তার গা কাঁপছে রাগে। বিল্লাল তাকে ধমকে বলল,
“চুপ কর। আর একটা কথা বলবি না”

ধমক কাজে দিলো। আহত সিঙ্ঘের মত ফুসলেও থামলো সে। বিল্লাল অপরপক্ষে কাছে অভ্রের হয়ে ক্ষমা চাইলো। তরুনকে দিয়ে অভ্রের মোটরসাইকেল গ্যারেজে পাঠালো। তারপর অভ্রকে নিজের মোটরসাইকেলে দোকানে নিয়ে এলো। দোকানে এসেই অভ্র বলল,
“মাথা গরম আছে। মাথায় ঠান্ডা পানি ঢাল”
“তোর কিছুদিন আগে জ্বর হয়েছে”
“যা করতে বলছি কর”

অভ্রের চোখে অগ্নিশিখা জ্বলছে যেন। ফলে বিল্লাল কথা বাড়ালো না। অভ্রের মাথায় ঢাললো একেবারে বরফ ঠান্ডা পানি।

*********

অম্বরের জলধরেরা যা ধরনীর বুকে পদার্পনের চিন্তায় মশগুল। ক্ষণে ক্ষণে সেই বার্তা জানান দিচ্ছে প্রকৃতিতে। বাতাসের স্পর্শেও সেই আগমনী বার্তা। ধুলো উড়ছে তীব্র বেগে। কিছুসময় সমীরণের তান্ডব চলার পর ঝমঝম করে নামলো বারিধারা। শীতল হলো পৃথিবীর বুক। কালো পিচে জলকেলি করতে লাগলো সেই স্নিগ্ধ জলধারা। সব শান্ত হলেও শান্ত হলো না ঐন্দ্রিলার হৃদয়ের ঝড়। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ঘরে ফিরলো ঐন্দ্রিলা। সাবেরা তাকে দেখে হাজারো প্রশ্ন করলো। কিন্তু ঐন্দ্রিলা উত্তর দিলো। সোজা নিজের ঘরে চলে গেলো। তারপর সশব্দে ডোর দিলো। কিছুক্ষণ পর ই তীব্র ভাঙ্গনের শব্দে কেঁপে উঠলো ঘর। ঝংকার তুললো ঘরের প্রতিটি কাঁচ। সালাম সাহেব কেঁপে উঠলেন। ছুটে গেলেন নিজের মেয়ের ঘরের সামনে। ধাক্কালেন কয়েকবার। কিন্তু তান্ডব থামলো না। সাবেরা উঠে নিজের ভাঙ্গন তহবিলের বাক্সে দু হাজার টাকা জমা করলেন।

ঘরময়ে কাঁচ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সুন্দর শোপিচ গুলো অবহেলায় গুড়ো গুড়ো হয়ে আছে। ফুলদানীর অস্তিত্ব নেই। আধ ঘন্টা আগের সাজানো ঘরটা এখন ধ্বংসলীলার স্তুপ। সেই স্তুপে বসে আছে ঐন্দ্রিলা। তার চোখজোড়া শুষ্ক। অতীতের স্মৃতিগুলো জীবন্ত। এমনই একটি বৃষ্টিমুখর দিনে ধীর পায়ে কিশোরী সত্ত্বায় নিজের রাজত্ব জমিয়েছিলো সৌরভ। সৌরভ ঐন্দ্রিলার প্রথম প্রেম, উহু প্রথম না পাওয়া রক্তিম অনুভূতি। যার গল্পটা সূচনা হবার আগেই নিষ্ঠুর হস্তে তা মাটি চাপা দিয়েছিলো অভ্র……………

চলবে

[সবাইকে ঈদ মোবারক। ভালো কাটুক আপনাদের ঈদ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here