প্রেমসুধা #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ৫

0
176

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫

লজ্জা, ভয়, রাগ, ক্ষোভ সকল কিছুর সংমিশ্রণ এখন পৌষ’র মাঝে। ছোট্ট একটা মেয়ে রুমে ঢুকলো ঝাড়ু হাতে। পৌষ তখন মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে কাউচে পা গুটিয়ে বসে আছে। কাজের মেয়েটা ঢুকা মাত্র ই পৌষ’র চোখ আপাদমস্তক মেয়েটাকে দেখে যাচ্ছে। একবার ভাবছে এই মেয়ের বয়স কত হবে? সর্বোচ্চ পনেরো কি ষোল। তবে কি এই পিচ্চির সাথে তৌসিফ তালুকদার ঐসব করলো? এতটা নিচ? মেয়েটার চেহারা কিছুটা মায়া মায়া। সেও পৌষ’কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। বলতে চাইলো অনেককিছু তবে পৌষ কথা না বলায় সে ও কথা বলতে পারছে না। ঝাড়ু হাতে দাঁড়িয়ে আছে সোজা হয়ে। পৌষ’র রাগ হলো। ভীষণ রাগ। কত বড় সাহস এতটুকু মেয়ে ঐসব করে ঐ দামড়া, চারশ চল্লিশ বোল্ডের ব্যাটার সাথে। ফিনফিনে শরীরটার দিকে তাকিয়ে পৌষ’র আবার সন্দেহ ও হলো। যতটুকু লোকমুখে শুনেছে তাতে তো বয়স আরেকটু বেশি হওয়ার কথা। কৌতুহল দমাতে না পেরে পৌষ বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন করলো,

— কত বছর তোমার?

আহা! এই বাজখাঁই গলা ই যেন মেয়েটার কানে গুঞ্জন তুললো। গদগদ কণ্ঠে সে পেটের নাড়ী, ভুড়ীর প্যাঁচের মাঝে যত কথা ছিলো সব উগলে দিলো একসাথে,

— ছোট ভাবী আমার নাম মিনু। বয়স চৌদ্দ। আমার বড় আপা ও এখানে কাম করতো কিন্তু এখন কিন্তু সে কামের বুয়া না৷ বয়া কইলেই ছেৎ করে উঠে। হেয় একটু বাইরে আছে এখন। আম্মা-আব্বা এইখানে আহে মাঝেমধ্যে কাম কইতা দিতে। তহন কাম অনেক থাকে। ওহহো! আমি কিন্তু শুদ্ধ ভাষায় কথা কই ছোট ভাবী। এহন হঠাৎ আপনাকে দেখে মাতৃভাষা জেগে উঠলো মনে। মামা যদি শুনে আমি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেছি তাহলে দিবে দুই ধমক। সে যে কি রাম ধমক ছোট ভাবী। একবার ধমক খাইয়া তিন দিনের জ্বরে ভুগসি। মামা ই আবার ঔষধ আইনা দিলো। মেলা ভালা মানুষ তবে বদ ও আছে। একবার চাপাটি নিয়ে উঠসিলো মা’রতে কিন্তু আমাকে না অন্য একজনকে। আচ্ছা আপনি কিন্তু আগের ভাবীর মতো সুন্দর না। সে আছিলো মেলা সুন্দরী। বাব্বাহ কি চোখ। মামা তো হেরে চোখে হারাতো। সারাটাক্ষন পিয়ু পিয়ু করতো। কত্তবার যে হেগো আদর সোহাগ চোখে পরলো, তবে আমি তহন অনেক ছোট ছিলাম।

বলেই একটু লজ্জা লজ্জা ভান করলে। হা করে তাকিয়ে রইলো পৌষ। এতটুকু মেয়ে বলে কি। এতো শুধু পাকনা না বরং ঝুনা হয়ে গিয়েছে। আর ঐ ব্যাটা বুড়ো, সে কি না….। নাহ আর ভাবতে পারলো না পৌষ। তার মাথা ঘুরে উঠছে আবারও। মিনু আর কথা না বলে ফটাফট বিছানার চাদর পাল্টে দিলো। রুম ঝাড়ু দিয়ে দক্ষ হাতে গোছগাছ করে চলে ও গেলো। পৌষ মাথা হেলিয়ে বসে রইলো। তার ভালো লাগছে না আর।

তৌসিফ রুমে ঢুকলো ফোনে কথা বলতে বলতে। কথা বলার ফাঁকেই সে পৌষ’কে দেখে নিলো। পাকিস্তানি একটা থ্রি পিস পরণে তার। দেখতে বেশ লাগলো। তৌসিফ ফোন কেটে বিছানায় ছুঁড়ে মা’রে। পৌষ’র কাছে এগিয়ে আসতেই পৌষ চমকালো। তৌসিফ ওর মাথায় প্যাঁচানো টাওয়াল খুলে দিয়ে লম্বা চুলগুলো মুছে দিলো। পৌষ ভয়ে জমে একদম। এই লোক এখন যে হাতে ওর চুল মুছে দিচ্ছে এই হাতেই নাকি চাপাটি তুলেছে? হায় আল্লাহ! না জানি কবে শিরোনাম উঠে, “নতুন বউকে চাপাটি দিয়ে কু*পিয়ে হত্যা করলো চরিত্রহীন বুড়ো”। পরক্ষণেই ভাবলো না। এত বড়লোক মানুষ, নিশ্চিত সাংবাদিকদের টাকা গিলাবে। ধামাচাপা দিবে নিজের কুকর্ম। পৌষ’র শরীর তখন মৃদু কাঁপছে যা ভালোই টের পেলো তৌসিফ। পৌষ’র চুলে আঙুল চালিয়ে যতটুকু পারলো ভেজা চুল গুছিয়ে দিতে দিতে বললো,

— একদম না পারলে হেয়ার ড্রায়ার ইউজ করবে। হিটে চুল নষ্ট হয়ে যাবে। তোমার চুলগুলো অনেক সুন্দর পৌষরাত। আমার ভালো লেগেছে। আম্মুর চুলগুলো এমন ছিলো। ঘন, কালো আর লম্বা।

কথাগুলো বলতে বলতে পৌষ’র চুলের ভাজে যখন নাক ডুবিয়ে ছোট এক শ্বাস নিলো তৌসিফ তখন পৌষ’র মনে হলো এবার মরণ নিশ্চিত। পৌষ আর বাঁচবে না। তবে তা হলো না। সেকেন্ডের ব্যাবধানে তৌসিফ সরে এলো। খুবই সাবলীল ভাবে বললো,

— শুধু ঘ্রাণ টা ভিন্ন।

বলেই টাওয়াল রাখতে গেলো ওয়াশরুমে। পৌষ দম ছাড়লো। এভাবে টিকা যাচ্ছে না। এই লোক হুটহাট অনেক কাছে চলে আসছে। পৌষ’র ঘৃণা লাগছে। এই লোকের দেয়া কাপড় গায়ে দিতেও ঘৃণা লাগছে। একদিন ও হলো না অথচ পৌষ’র দম আটকে আসছে। এখানে কি ভাবে থাকবে ও?

তৌসিফ এসেই পৌষ’র হাত ধরে নিতে চাইলো বাইরে। এত ধরাধরি এবার পৌষ মানতে পারলো না। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঝাঁঝালো গলায় এবার বলেই ফেললো,

— এত কেন ছোঁয়া ছোঁয়ি করছেন আপনি? এতই যেহেতু ধরার সখ তাহলে গুটিয়ে আছেন কেন? যা করার করুন। দয়া দেখানো বন্ধ করুন। কি ভেবেছেন আমি জানি না কিছু। সব জানি আমি….

আর কিছু বলার আগেই পৌষ’কে থামিয়ে দিলো তৌসিফ। ওর কানের কাছে মুখ এনে শুধু বললো,

— তুমি যদি এতই ডেস্পারেট হও দেন আই হ্যাব নো প্রবলেম পৌষরাত। তবে এখন একটু ধৈর্য ধরো। বড় আপা এসেছে বাসায়। চুপচাপ তার সামনে ভদ্র ভাবে থাকবে। বাকি যা চাইছো সব দিব। রাতে বললে তখনই দিতাম। আমার তো কোন ছোঁয়াচে রোগ নেই তোমার মতো।

এই দফায় পৌষ কাঁদতে চাইলো। এই লোক তাকে যা তা বলে অপমান করে যাচ্ছে। পৌষ মানতে পারছে না। এত অপমান সহ্য করার মতো না। তৌসিফ ওর হাত ধরে ড্রয়িং রুমে নিয়ে এলো। তৌসিফের বড় আপা সহ দুজন ছেলে উপস্থিত আপাতত। টেবিলের কাছে আসতেই তায়েফা উঠে দাঁড়ালেন। ভাইয়ের বউকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বললেন,

— অনেক বড় হয়ে গিয়েছো পৌষ। কত ছোট দেখেছি তোমাকে। তোমাদের উঠানে যখন খেলতে তখন একদিন দেখেছিলাম। ছোট্ট পিচ্চিটা আমার সম্পর্কে ভাবী হবে কোনদিন ভাবি নি সোনা। বসো খাবে আগে। পরে কথা হবে।

পৌষ’কে নিজের সাথে করে নিয়ে বসলেন তিনি। ঠিক পাশে বসা তৌসিফ। ব্রেডে বাটার লাগিয়ে পৌষ’কে দিলো তৌসিফ। মুখ,নাক কুঁচকে তাকালো পৌষ। এসব অখাদ্য তো সে খায় না। কিছুতেই না। মরণ কালেও না। ওর নাক কুঁচকানো তৌসিফ খেয়াল করলো। জুসের গ্লাসে চুমুক বসিয়ে পৌষ’র প্লেটে ডিম তুলে দিলো। পৌষ’র মুখভঙ্গি বদলালো না। খাচ্ছে না আবার উঠেও যাচ্ছে না। পৌষ শুধু পুতুলের ন্যায় বসে আছে। তৌসিফ সবার সামনেই জিজ্ঞেস করলো,

— খাচ্ছো না কেন?

পৌষ কথা বললো না। তায়েফা ও তাকালো পৌষ’র দিকে। চারজোড়া চোখ ওর দিকে তাকাতেই অশস্তি শুরু হলো পৌষ’র। তৌসিফের হঠাৎ মনে হলো হয়তো শরীর খারাপ লাগছে ওর। তাই পৌষ’র মাথায় হাত রেখে বললো,

— খারাপ লাগছে?

পৌষ মৌন রইলো এখনও৷ তায়েফা পৌষ’র মুখের সামনে ব্রেড ধরলেন৷ আদরের সহিত বললেন,

— আমি খায়িয়ে দিচ্ছি সোনা৷ হা করো।

পৌষ চুপ থাকাতে তৌসিফ এবার কিছুটা গম্ভীর স্বরে বললো,

— কথা বলো পৌষরাত। কি সমস্যা হচ্ছে তোমার? কেন খাচ্ছো না?

তৌসিফের গম্ভীর কণ্ঠে পৌষ এবার কেঁদে দিবে দিবে ভাব। তায়েফা ও বুঝলো না ব্যাপার টা। তৌসিফ পৌষ’র কবজিটা চেপে ধরে টেনে তুললো চেয়ার থেকে। একদম সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তায়েফার দিকে তাকিয়ে বললো,

— আপা তোমরা খেয়ে নাও। আমি দেখছি ওর সমস্যা কোথায়।

বলে আর দাঁড়ালো না একপল। সোজা রুমে নিয়ে দরজা লক দিলো। পৌষ’কে বিছানায় বসিয়ে ও শুধু দরজা লক করেছে। পিছু ফিরতেই দেখলো পৌষ’র চোখে মুখে ভয়ের ছাপ৷ তৌসিফ বুঝলো না এতটা ভয় কেন পেলো মেয়েটা। ও তো এখনও একটা ধমক পর্যন্ত দিলো না। তৌসিফ যেই না এগিয়ে আসবে কিছু বলতে ওমনিই সাহসী, চঞ্চলা পৌষ হু হু করে কেঁদে উঠলো। মিনু’র কথাগুলো শুনে রাগে,ভয়ে ওর অন্তরআত্তা কাঁপছে। এতক্ষণ চেপে রাখলেও তৌসিফ সামনে আসলেই ওর মনে হচ্ছে কখন না জানি চাপাটি নিয়ে ওকেই মা’রতে আসে। তৌসিফ ওর হঠাৎ কান্নায় চমকালো। দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসলে নিলেই পৌষ’র গলার শব্দ বৃদ্ধি পেলো,

— মা? হেমু ভাই? চাচি? আমাকে মে’রে ফেললো। আমি থাকব না এখানে।

পৌষ’র এই আচরণ বুঝলো না তৌসিফ। শুধু মাত্র ধরে আনাতে এতটা ভয়? তাও কি না সামনের জন পৌষ নিজে। এই মেয়ে যে পাঁজি, সেই পাঁজির পা ঝাড়া পৌষরাত পেলো ভয়, তাও কি না তৌসিফ তালুকদার এখনও কিছু করলোই না। পৌষ’র কান্নার শব্দ যখন বাড়তে লাগলো তখনই হঠাৎ তৌসিফ ওর মুখ চেপে ধরলো। বড় বড় চোখ করে তাকালো পৌষ। ছটফটানি বেড়ে গেলো কয়েক গুণ। সমান তালে হাত পা ছুঁড়ে যাচ্ছে ও। দুই একটা লাথি ও লাগলো তৌসিফের গায়ে। নিজেকে যথাযথ শান্ত রেখে তৌসিফ শুধু ওকে বললো,

— শান্ত হও পৌষরাত। আপা বাসায়। একটা অনুরোধ করেছিলাম, আপার সামনে শান্ত থাকতে বলেছিলাম। এতই শান্ত হয়ে গেলে যে কথাই বললে না। কেন খাচ্ছিলে না? আপা কি ভাবছে বলো তো?

পৌষ উত্তর দিতে চাইলো। উম উম শব্দ ও করলো। তৌসিফ “ওহ” বলে ওর মুখ ছাড়তে ছাড়তে বললো,

— আর শব্দ করবে না। আপা বাসায়। আমাকে সময় দাও।

মুখটা ছাড়া মাত্র জোরে জোরে শ্বাস নিলো পৌষ। এই পর্যায়ে তার হিচকি উঠে গেলো। তৌসিফ পাশে থাকা গ্লাসটাতে পানি নিয়ে ওর মুখের সামনে ধরতেই পৌষ পানি খেলো। খেলো তো খেলো পুরো গ্লাস ভরে পানি খেলো। এমনিতেই খালি পেট তার উপর এমন পানি খাওয়াতে সেটা পেটে সইলো না। দুটো হিক হিক শব্দ তুলে একদম তৌসিফের পায়ের উপর বমি করে দিলো। বমিতে শুধু সেই পানিই বের হলো। তৌসিফ তাকিয়ে রইলো। এই মেয়ে’টাকে বুঝে উঠলো পারছে না ও। এতো বারোমাসী রুগী মনে হচ্ছে তার। রাত থেকেই কেমন অসুস্থ অসুস্থ। নিজের পা ধুয়ে এসে প্যান্টটাও চেঞ্জ করে নিলো ও৷ পৌষ বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। মেয়েটা তখনও কাঁদছে। নিশ্চিত খারাপ লাগছে। কিছুটা মায়া হলো তৌসিফের। পৌষ ভয় পাবে এটাই স্বাভাবিক। এলাকায় সবাই তাকে ভয় পায়। নিজের দাপট বজায় রাখা জানে তৌসিফ তালুকদার। নরম,কোমল, বরফ সে ছিলো শুধু দুইজনের জন্য। তারা কেউ এখন নেই ওর কাছে। তাহলে কার জন্য তৌসিফ তালুকদার নিজেকে খোলস মুক্ত করবে? কেউ কি আদৌ তাকে চায়? সবাই টাকা চিনে। ক্ষমতা চিনে। তৌসিফ’কে কে চায়? শুধু তার ক্ষমতা’র বলে তার আগেপিছে মানুষ ঘুরে। যেদিন এই ক্ষমতা থাকবে না সেদিন কেউ থাকবে না ওর কাছে তা খুব ভালো ভাবেই জানা ওর। বড় আপা’কে সে সম্মান করে। মায়ের পর আপা তাকে যথেষ্ট সাপোর্ট দিয়েছে। তৌসিফ চাইছে না আপা পৌষ’কে নিয়ে চিন্তা করুক। কিন্তু ঘুরে ফিরে হচ্ছে তো তা ই।

তৌসিফ পৌষ’র কাছে বসলো৷ পাশ থেকে টিস্যু নিয়ে ওর চোখ, মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,

— সকালে নাস্তায় কি খাও পৌষরাত?

পৌষ কথা না বলাতে তৌসিফ এবার ওর মুখটা ওর সামনে নিয়ে বললো,

— প্রশ্নের উত্তর দাও।

ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে পৌষ। কাঁপা স্বর তার। কথা বলতে গিয়ে ঠোঁট দুটো ভীষণ কাঁপলো। তৌসিফের কপাল কুঁচকে গেলো। পৌষ’র ঠোঁট দুটো সাদা হয়ে গিয়েছে অথচ মেয়েটার ঠোঁট ঈষৎ গোলাপি। সে দেখেছে সকালে ঘুমন্ত অবস্থায়। তড়িৎ বেগে পৌষ’র গালে হাত রেখে অনবরত ডাকতে লাগলো ওকে। পৌষ ভাবলো হয়তো সে প্রশ্নের উত্তর চাইছে। তাই কাঁপা কাঁপা গলায় জানালো,

— পরোটা, চা…..

আর বলতে পারলো না মেয়েটা। তৌসিফের কিছু বুঝতে বাকি রইলো না। খালি পেটে মেয়েটা আবারও বমি করতে চাইলো। হলো না। পৌষ’কে রেখে তৌসিফ সেকেন্ডের ব্যাবধানে বাইরে গেলো পুণরায় ফিরে এলো। পৌষে’র মাথাটা নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ঠেস দিয়ে তুললো। মিনু ততক্ষণে দুধ হাতে ফিরে এসেছে। গোল গোল চোখ দিয়ে তৌসিফের বুকে পৌষ’কে দেখলো ও। নতুন বউ নিয়ে মামা এসব ঢলাঢলি করছে তা বড় আপাকে জানাতে হবে। সারা বাড়ীতে জানাতে হবে। মামা’র বড় ভাবীকেও জানাতে হবে। সে বারবার বলেছে এখানকার খবর পই পই করে তাকে দিতে। তৌসিফ মিনুকে বেখেয়ালি দেখেই ধমক দিলো। সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠলো মিনু। দুধের গ্লাসটা এগিয়ে দিতেই তৌসিফ তা পৌষ’র ঠোঁটের সামনে ধরলো। এতটা যত্ন করে পৌষ’কে কে কবে খাওয়ালো মনে পরে না পৌষ’র। সে ফিকরে কেঁদে উঠতেই তৌসিফ আরেকটু বুকে চেপে নিলো ওকে। কারো উষ্ণ, চওড়া বুকে ঠাই পেয়ে লতার মতো পেঁচিয়ে যেতো চাইলো পৌষ। ভুলে গেলো মানুষটা কে। গুটিয়ে ওভাবেই দুধটুকু খেলো। তৌসিফ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সযত্নে মুছে দিলো পৌষ’র ঠোঁট। চুলগুলো গুছিয়ে হাতে হাত বুলিয়ে আদর দিলো।

দরজায় দাঁড়িয়ে তায়েফা হাসছেন। তার ভাইটার বুঝি এবার একটা সুন্দর সংসার হবে। ঝটপট ভেবে নিলো সে পৌষ’কে বলবে অতি শিঘ্রই বাচ্চা নিতে। খা খা করা বাসাটা তাতে হৈ চৈ পূর্ণ হবে। মিনু’কে এখানে দেখেই ধমকে উঠলেন তিনি। দৌড়ে ছুটে পালালো মিনু৷ তায়েফা চিন্তিত হলেন আবারও। এই দুই বোন থেকে তার ভাইকে কিভাবে সরাবে সে? জঘন্যতম সম্পর্কের ইতি কবে ঘটবে? তৌসিফ কেন এদের জীবন থেকে উপড়ে ফেলছে না? সে কি পারে না নতুন কাজের লোক রাখতে? কেন এদের ই দরকার হবে? এখন ঘরে বউ আছে। সকল চাহিদা সে পূরণ করবে। তাহলে কেন এই কাজের মেয়েটাকে বিদায় করছে না? না জানি কবে টপকে পরে আবার বড়টা?

________________

হক বাড়ীতে আজ সকাল থেকেই মরা মরা ভাব। হেমন্ত ভোর থেকে বাসায় নেই। ফজরের নামাজ পরে মসজিদ থেকে কোথায় যেন গেলো। চৈত্র আর জৈষ্ঠ্য দেখেছে। ওরা ও সঙ্গে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু হেমন্তের চোখে তাকিয়ে গলা দিয়ে আর স্বর বের হয় নি তাদের। সোজা বাসায় চলে এসেছে। চৈত্র’র ধারণা তালুকদার বাড়ীর সামনে গিয়েছে হেমু ভাই। কারণ আছে অবশ্য। ঐ পাকা রাস্তা দিয়ে ই মেইন রোড। তারপর সামনে গেলেই চিকন এক গলি দিয়ে শর্টকাট ভাবে পৌঁছানো যায়। চৈত্র’র মন বলছে পৌষ আপার কাছেই গিয়েছে হেমু ভাই। ইনি, মিনি দুজনই গাল ফুলিয়ে বসে আছে। পিহা ও মন খারাপ করে বসেছে। টেবিলে বসেছে সবাই বড় চাচা’র ভয়ে। সকলকে জহুরী চোখে পর্যবেক্ষণ ও করলেন বড় চাচা। তার উপর সকলের রাগ,অভিমান আর অভিযোগ। তিনি জানেন। তবে এমন না কেউ পরিস্থিতি জানে না। বাচ্চারা বাদে সকলেই জানে। হেমন্তে নিজেও জানে সবটা তবুও তার জেদ কি মানায়? তিনি জানেন রাত ভর তার হেমু ঘুমায় নি। ফজরের নামাজ পড়েই সে পৌষ’কে দেখতে ছুটে গিয়েছে। কে জানে দেখা মিললো কি না? তার বউ ও সকল থেকে গোমড়া মুখ করা। আচ্ছা তার কি বুক জ্বলে না? পৌষ কি তার মেয়ে না? কলিজার টুকরো একটা পৌষ। রোজ সকালে তাকে এলাচিগুঁড়া কে দেয়? পৌষটাইতো ছোট্ট ছোট্ট হাতে মুঠো ভরে এনে দিতো তাকে বছর ধরে। আজ কেউ দিলো না। কেউ না। বুক ভার হয়ে এলো তার।
হঠাৎ একটা ছোট্ট হাতের মুঠো তার চোখের সামনে এলো। চমকে তাকালেন তিনি। পিহা’র মুঠো। পিহা মুখটা মলিন করে বললো,

— বড় বাবা আপা বলেছে রোজ সকালে তোমাকে দিতে।

পিহা’র হাত দুটো বুকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। চোখ, মুখ লাল হয়ে গেলো। সকলের সামনে কাঁদতে পারবেন না বলে উঠে চলে গেলেন৷ জৈষ্ঠ্য পিহাকে নিজের পাশে বসিয়ে খেতে বললো। হেমন্ত এলো মিনিট দুই পর। এসেই টেবিলে খেতে বসলো। একে একে বাকিরাও এসেছে। চেষ্টা করলো পরিস্থিতি স্বাভাবিক বুঝানোর কিন্তু কতটুকু পারলো জানে না কেউ। বাকিরা বুঝলেও ইনি, মিনি যেন মানতে চায় না। বুঝতে চায় না। না পেরে ছোট চাচি দুটোকে ধরে পিঠে দুটো করে দিতেই বাড়ীতে কান্নার রোল পরলো। হেমন্ত কোনরুপ কথা বললো না। চৈত্র আর জৈষ্ঠ্য ই দুটোকে কোলে তুলে নিলো। বিষদে পরিপূর্ণ হক বাড়ী। বাড়ীর জানটা যে অন্য বাড়ী।

_______________

নিজ হাতে পৌষ’কে পরোটা, ডিম খায়িয়েছে তৌসিফ। ব্যাপার টা কিন্তু সহজ ছিলো না মোটেও।
দুধ খেতেই গায়ে জোর ফিরে এসেছে ওর। তৌসিফের হাতে খাবে না ও। তায়েফা পাশে এসে বসতেই পৌষ দমে গেল। চুপচাপ মাথা নিচু করে খেয়ে নিলো পৌষ। তায়েফা পৌষ’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। এটা ওটা বুঝালো। পৌষ কথা বললো না। তৌসিফ পৌষ’র মুখ মুছে দিতে দিতে বললো,

— তোমার চা আসছে একটু পরই।

উঠে হাত ধুতে গেলো তৌসিফ। একা পৌষ’কে পেয়েই তায়েফা কথা তুললো,

— পৌষি, আজকাল তো যুগ ভালো না সোনা। ইলেকট্রনিক ডিভাইস আমরা এতটাই ব্যাবহার করি যে তা আমাদের শরীরে ও ইফেক্ট ফেলছে। ফার্টিলিটির সমস্যা এখন ঘরে ঘরে। তোমার বয়স পারফেক্ট সোনা। এখনই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে নাও। তোমার ও একা লাগবে না। ভেবো না সেকালের আমি তাই এসব বলছি বা তুমি হয়তো ম্যারিড লাইফ ইনজয় করতে পারবে না। বাচ্চা হোক। পালার মানুষের অভাব হবে না। তুমি ইনজয় করবে। আজ প্রথম তাই অসুস্থ হয়ে পরেছো এতটা।

পৌষ’কে অবাক হওয়ার সুযোগ না দিয়েই তায়েফা ওর হাত ধরলো। কাতর স্বরে আবদার করলো,

— আমি জানি তোমার হয়তো মা ডাক শুনার বয়স হয় নি তবে আমার ভাই, তৌসিফের তো বয়স হয়েছে বাবা ডাক শুনার। ওর সখ, ইচ্ছে ও প্রকাশ করে না। তুমি নিজে বুঝে নিও। শুধু ওকে একটু আগলে রেখো, দেখবে তোমাকে মাথায় তুলে রাখবে। বাসায় আসলে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিও, বিনিময়ে ও নিজের জান এগিয়ে দিবে। ও ভালেবাসার কাঙ্গাল। সব থাকলেও আমার তৌসিফের ভালোবাসা নেই। নিজের সংসারটাকে বড় করো পৌষি। তিন চারটা বাচ্চা যথেষ্ট হবে। পরে যদি তোমার মনে করো তাহলে কম, বেশি হোক।
ভেবো না ননদ নাক গলাচ্ছেন পারসোনাল ম্যাটারে। তোমাকে ছোট দেখেছি আমি। ননাস শুধু সম্পর্কেই। তোমার অনেক বড় আমি। তুমি অবুঝ পৌষি তাই শুধু বুঝাচ্ছি। এত এত সম্পদ কে খাবে? সব তোমার আর তোমাদের সন্তানদের ই থাকবে।

পৌষ’র লজ্জায় কান লাল হয়ে উঠলো। বড় আপা যে ওকে অসুস্থ দেখে কতটা উল্টো পাল্টা ভেবেছে যা বুঝা হয়ে গিয়েছে ওর। এজন্য ই কাজের লোক সহ বাকি ছেলে দুটো ওভাবে দেখছিলো ওকে। আর বলে কি এই আপা? তিন, চারটা বাচ্চা? কোথায় পাবে পৌষ? কে করবে ইমপোর্ট এক্সপোর্ট? পৌষ? জীবনেও না। ইহকালেও না। তার বুড়ো চরিত্রহীন ভাইকে বলুক বাচ্চা পয়দা করতে। কাজের বুয়া তো আছেই। ওহ্ তাকে ও কাজের বুয়া ও বলা যাবে না। ম্যাডামের মাইন্ডে লাগবে। বাহ্। চমৎকার। মচৎকার। এসব জ্ঞানী,গুনি মানুষ কেন পৌষ’র জীবনেই আসে? অসহ্য।
তৌসিফ পুণরায় রুমে ঢুকা মাত্রই বড় আপা বেরিয়ে গেলেন। চা দিয়ে গেলো মিনু। তৌসিফ পকেটে মানিব্যাগ ভরতে ভরতে জিজ্ঞেস করলো,

— এখন কেমন লাগছে পৌষরাত?

— কুত্তা কুত্তা লাগছে।

— হোয়াট?

ধমক খেয়ে চমকে গেলো পৌষ। তার সত্যি ই কুত্তা কুত্তা ফিলিং হচ্ছে। এখন কি সত্যিকারের ফিলিংস টাও বলা যাবে না? অনুভূতির কি দাম নেই তার?

#চলবে…..

ফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দ রোদের এই রোদমাখা দিনটায় ঘুমের ইতি টানলো। বেঘোরে ঘুমিয়ে থাকা রোদের মুখ কুঁচকে এলেও হাতরিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে না দেখেই রিসিভ করে জিজ্ঞেস করলো,

— কে?

ঘুম জড়ানো নারী কন্ঠ শুনে মুহূর্তেই যেন আদ্রিয়ান চমকালো। থমকালো। রোদ উত্তর না পেয়ে আবারও বললো,

— কে বলছেন ভাই?

আদ্রিয়ান ধাতস্থ করে নিজেকে। ঠান্ডা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

— গতকাল রাতে কল করা হয়েছিলো এই নাম্বার থেকে। আপনি কি আমার অফিসের কেউ?

রোদ এক লাফে উঠে বসলো। কান থেকে ফোন না সরিয়ে মুখ ফসকে রোদ জিজ্ঞেস করে ফেললো,

— আপনি না পাত্রী খুঁজছিলেন? তাই কল দিয়েছিলাম।

মুহূর্তেই দুই দিক চুপ। রোদ একহাতে নিজের মুখ চেপে ধরলো। ইশ! এই কারণেই ও কথা কম বলতে চায় কিন্তু কোনদিন সেটা সম্ভব হয়ে উঠে না। মস্তিষ্কের আগে মুখ চলে। এই এক সমস্যা। হায় আল্লাহ! এখন কি হবে?
রোদ চুপ রইলেই অপর পাশ থেকে আদ্রিয়ান একটু গলা খেঁকানি দিয়ে বললো,

— দেখুন ওই পোস্টারিং গুলো আমি করাই নি। কিন্তু এটা সত্যি মেয়ে খুঁজছি। আমার আমার সম্পর্কে দেয়া তথ্য গুলোও সঠিক। আপনি কি দেখেছিলেন?

এবারেও রোদ মুখ সামল দিতে ব্যার্থ হলো। ফটাফট উত্তর করলো,

— হু হু। আপনি দুই বাচ্চার বাপ আর বয়স ঊনচল্লিশ। এটাই তো?

— হ্যাঁ। এটাই। আপত্তি নেই?

— কিসের আপত্তি?

— আপনার কন্ঠ অনেকটা ছোট লাগছে। আপনি কি ডিভোর্সী অর বিধবা?

— আসতাগফিরুল্লাহ।

ই-বুক “চিনি” র অংশ বিশেষ। সম্পূর্ণ ই-বুক পড়ার লিংক কমেন্টে।
আপনাদের ভালোবাসা আদ্রিয়ানকে এখনো কেন পড়ছেন না?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here