প্রেমসুধা #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ৬

0
167

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৬

মরা’র মতো পরে আছে পৌষ। এ যেন একুল ওকুল সব কুল হারিয়ে বানের জলে ভেসে আসা এক আগাছা। অনুভূতি কেমন তা জানে না পৌষ। এই বাড়ীটা তার কাছে কেমন জানি লাগছে। মানুষ গুলো ও অদ্ভুত। তায়েফা ও এখন নেই। নিজের ভাইয়ের গুন গান গেয়ে বড় ভাইয়ের ফ্ল্যাটে গিয়েছেন। তৌসিফ সেই যে বেরিয়েছে আসার খবর নেই। ফিটফাট সদর ঘাট হয়ে বেরুলো লোকটা। ভাবখানা এমন রাজ্য জয় করতে গিয়েছে। ও না থাকায় পৌষ’র লাভ ই হলো বটে। তৌসিফ’কে ভালো লাগে না ওর। কথা বলতেও রুচির অভাব অনুভব হয়। আশেপাশে থাকলেই ঘৃণায় গা রি রি করে। সেই লোকের বুকে থেকে তারই ঐ জঘন্য, নোংরা হাতে কিভাবে পৌষ খেলো তা ই মাথায় ঢুকে না। একটু আগেই গলায় আঙুল ঢুকিয়ে বমি করার চেষ্টা করেছে। লাভ হয় নি উল্টো এখন ম’রার মতো শুয়ে আছে। পৌষ’র প্রশ্ন জাগ্রত হলো মনে। তৌফিক তালুকদার কি জানেন না ওদের বিয়ের খবর? তার অনুভূতি কেমন? তার আপন ছোট ভাই পৌষ’কে বিয়ে করেছে। এত বড় খবরটা নিশ্চিত লুকিয়ে থাকার কথা না। আর ঐ মানুষ টা কি জানে পৌষ তার অস্তিত্ব ও অতি শিঘ্রই হারাতে চলেছে। তার মধ্যের আত্মসম্মান আর কতদিন বেঁচে থাকবে পৌষ জানে না৷ ওয়াদা পূরণ করতে অক্ষম তার পুষি। পুষি তাকে ধোঁকা দিয়ে তৌসিফ তালুকদারকে বিয়ে করেছে। তৌফিক তালুকদার একথা শুনা মাত্র কেন ছুটে এলো না? তার কি উচিত ছিলো না গতরাতেই এখানে আসা?

পৌষ হঠাৎ করে উঠে বসলো। গতকাল বিয়ের সময় নিশ্চিত তৌসিফ তালুকদার একা যায় নি ওকে বিয়ে করতে। তার সাথে আরো কিছু মানুষ ছিলো। নিজের দুই ভাইকে রেখে তো আর তৌসিফ বিয়ে করে নি। এরমানে তৌফিক তালুকদার ও ছিলো সেখানে। আদরের ছোট ভাইয়ের বিয়ে দিয়েছেন নিজ হাতে নাকি সে জানেই না। মাথা চেপে ধরে পৌষ। উত্তর চাই তার। যদি তৌফিক তালুকদার জেনেই থাকেন তাহলে কেন এখনও পৌষ’র সম্মুখে আসছেন না?
আকাশকুসুম ভাবনার মাঝেই মিনু দৌড়ে এলো একটা ফোন হাতে। পৌষ’র হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়েই রসিয়ে রসিয়ে বললো,

— মামা কল দিয়েছেন ছোট ভাবী। হোল্ডে আছেন। নতুন বউ রেখে গিয়ে শান্তি পাচ্ছেন না৷ গিয়েছেন মিটিং এ। গুরুত্বপূর্ণ মিটিং অথচ আপনার চিন্তায় কাজে মন দিতে……

মিনুর হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিলো পৌষ। রাগে চোখ দুটো লাল হয়ে আছে ওর। এই মেয়েটাকে থাপড়ে দিতে পারলে বুকের অশান্ত ভাবটা কমতো। দু চোখের বিষ যেন এই মিনু। অসহ্যকর এক মেয়ে।
ফোনটা ছিনিয়ে নিতেই মিনু’র গায়ে লাগলো। কথা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো ঠাই। পৌষ এবার সত্যি ই ধৈর্যহারা হলো। এই কাজের মেয়ের সামনে নিজেকেই ছোট মনে হচ্ছে ওর। কখনো কাউকে ছোট করে না দেখা পৌষ আজ পরিস্থিতির কবলে পরে বদলে গেলো যেন। ধমকে উঠলো উচ্চ স্বরে,

— যাও এখান থেকে!

মিনু জলন্ত চোখে তাকিয়ে রইলো তবে নড়লো না। পৌষ অবাক না হয়ে পারলো না। স্ব শব্দে পুণরায় ধমক দিতেই মিনু দৌড়ে বেরিয়ে এলো। ঠাস করে দরজা লাগানোর শব্দ কানে এলো। পৌষ অবাকের উপর অবাক। এতটুকুন মেয়ের তেজ দেখো।
হোল্ড থেকে ফোনটা কানে ধরতেই তৌসিফের কণ্ঠ কর্ণগোচর হলো,

— পৌষরাত?

পৌষ উত্তর করলো না। তৌসিফ পুণরায় বললো,

— পৌষরাত? জানি শুনছো তুমি। কথা শুনো আমার। আমার লেট হবে একটু। মিটিং টা লেন্দি হবে এতটা ভাবি নি। একটু গুরুত্বপূর্ণ নাহয় তোমাকে প্রথম দিন একা ফিল করতে দিতাম না৷ প্লিজ দুপুরে খেয়ে নিও। শরীর খারাপ লাগবে নাহয়। বুঝেছো? পৌষরাত?

পৌষ কিছুটা বাজখাঁই গলায় বলে উঠলো,

— কাজের মেয়ে অলরেডি বলেছে। আপনাকে আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।

ইচ্ছে করে “কাজের মেয়ে” শব্দটা উচ্চারণ করলো পৌষ। তবে লাভ হলো না। তৌসিফ যেন শুনেও শুনে নি কথাটা। শুধু বললো,

— বউ আমার তুমি পৌষরাত। আমি ভাববো না তো কে ভাববে?

এতসব রঙের কথা পৌষ’র ভালো লাগে না। রং তামাশাভরা কথা শুনিয়ে শুনিয়ে ই হয়তো মেয়ে ফাঁসায় এই লোক। ফোন কেটে চুল খামচে ধরে পৌষ। বিরবির করে বলে,

— আমি পা*গল হয়ে যাব।
.
দুপুর দিকে গোসল করে চুল আঁচড়ে পৌষ রুমে পায়চারি করছে। সমান তালে নখ কেটে যাচ্ছে দাঁত দিয়ে। অতি টেনশনে দাঁত দিয়ে নখ কেটে টেনশন কমায় পৌষ। হেমু ভাই দেখলেই দিতো এক ধমক। চৈত্র তখন দাঁত কেলিয়ে হেসে বলতো, “আপা নেইল কাটারের খরচ বেঁচে যাচ্ছে”। মেঝো চাচি আবার এটা দেখে বলতো ইনি, মিনি নাকি ওকে দেখেই দাঁত দিয়ে নখ কাটা শিখেছে। পৌষ অবশ্য এসবে পাত্তা দেয় না। ওর ধারণা কেউ কাউকে দেখে কিছু শিখে না। মানুষ স্বাধীন চেতা। জ্ঞান বুদ্ধি হওয়ার পর মানুষ সেটাই করে যেটা তার মন চায়। আরেকজনকে দেখে সে হয়তো ধারণা নেয় কিন্তু বদ অভ্যস আয়ত্ত তো আর ঐ মানুষ টা করে দেয় না।

মন বিষিয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে পৌষ’র। ইচ্ছে করে ফোনটা গতরাত অফ করে রেখেছিলো। নাহলে এতক্ষণে কল এসে যেতো। পৌষ চাচ্ছে না আপাতত কারো সাথে কোন প্রকার বাক্য বিনিময় করতে। কেন কথা বলবে পৌষ? কি দায় তার? জাহান্নামে ঠেলে দিয়ে কল দিয়ে ঢং করে জিজ্ঞেস করবে কেমন আছে সে। পৌষ চায় না ওর রাগ ভাঙুক। কোনদিন না ভাঙুক এই রাগ। এই রাগে পৌষ’র মরণ হোক তবুও না ভাঙুক। তৌসিফের উপর রাগটা কতটা যু্ক্তিযুক্ত পৌষ’র মস্তিক তা বুঝে উঠতে পারছে না। যেখানে আপন মানুষেরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সেখানে তৌসিফ কোন ক্ষেতের মুলা?

— মামা তো এখন বাসায় নাই। গোসল ক্যান করলেন ছোট ভাবী?

বিষ্ময়ে চোয়াল ফাঁক হয়ে গেলো পৌষ’র। এতটুকু মেয়ের মুখের এ কি ভাষা? হ্যাঁ পৌষ মানছে গ্রামের মেয়েটা একটু চটপটে হয়। মুখের লাজ তার কম তাই বলে এসব প্রশ্ন করছে সে? হায় কপাল! কি দিন চলে এসে পৌষ’র? এখন কি না হাঁটুর সমান মেয়েকে ও উত্তর দিবে কেন গোসল করেছে? সকালে ও নিশ্চিত এই কারণে পৌষ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো মিনু? তরতর করে রাগ উঠে গেলো পৌষ’র মাথায়। হাত-পা ঝিমঝিম করে উঠলো রাগে। এক হাত ঘাড়ের পেছনে বুলাতে বুলাতে দাঁত চেপে বললো,

— বের হও।

মিনু সরলো না। বরং খিলখিল করে হাসতে হাসতে জানালো,

— ওমা! ছোট ভাবী রেগে যাচ্ছেন কেন? মামা আপনাকে খেতে যেতে…..

— চুপ! বেয়াদব কোথাকার! বের হ এক্ষুনি। যা আমার রুম থেকে। চোখের সামনে এলে থাপ্পড়ে গাল লাল করে দিব। ফালতু, ঝুনা পোলাপাইন।

মিনু’র হাসি মুখটা সহসা থমথমে হয়ে এলো। এত বড় অপমান আর এতগুলো কড়া কথা ওকে শুনালো এই একদিনের মেয়ে? টলমলে চোখ দুটোতে শুধু রাগের লেলিহান দেখতে পেলো পৌষ। মিনু শুধু নীরব রইলো। মাথাটা নিচু করে চলে গেলো বাইরে। এ যেন অতি গম্ভীর ভাব নিয়ে বড় একজনের প্রস্থান ঘটলো। চুল থেকে পেঁচানো টাওয়ালটা খুলে ফেললো পৌষ। রাগে ছুঁড়ে মা’রলো ফ্লোরে। তার মাথা এখন ভোঁ ভোঁ করছে। মনে হচ্ছে গাড়ির ইঞ্জিন চালু দিয়েছে কেউ ওর মাথায়। ধপ করে বিছানায় উল্টো হয়ে শুয়ে পরলো ও। কোন নোংরা জায়গায় এসে পরলো পৌষ?

______________________

পিহা ছোট ছোট পা ফেলে হেমন্ত’র রুমের সামনে এলো। দরজা ভেরানো দেখে ধীর পায়ে রুমে ও ঢুকলো ও। বিছানায় এলোমেলো কিছু কাপড় রাখা দেখে পিহা যতটুকু পারলো ভাজ করলো। এত কাপড় সে ভাজ করতে পারে না। হেমন্ত ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলো এলোমেলো কাপড়গুলো তার কেউ ভাজ করেছে তবে এটা ভাজ বলা যাচ্ছে না। পেঁচিয়ে আরো কাপড়ের বারোটা বাজিয়ে রেখেছে। তার চোখ পরলো বারান্দায়। দিন দাহারে গাছে পানি দিচ্ছে পিহা। না চাইতেও এবার হেসে ফেললো হেমন্ত। নিজের কাপড়গুলো গোছাতো গোছাতে বললো,

— পিহু রাণী?

— হ্যাঁ বলো।

— কাপড় ভাজ করেছিস?

— করলাম তো।

— এখন কি করিস?

— গাছে পানি দেই হেমু ভাই। দেখে যান।

— এই দুপুরে গাছে পানি? ম’রে যাবে না?

— দুপুরে খাবার খেলে কি আমি,আপনি ম’রে যাই? ম’রি না তো। তাহলে গাছ কেন ম’রবে হেমু ভাই?

হেমন্ত কাপড়গুলো ড্রয়ারে রেখে বারান্দায় এলো। পিহা গুজো হয়ে গাছে পানি দিচ্ছে। পেছন থেকে ওর চুলে টান দিলো। পিহা হাসি মুখে তাকালো। হাতে একটা বেগুনি রঙের ফুল নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,

— বো*ম গাছের চাড়া কে লাগালো হেমু ভাই?

— পৌষ।

পিহা হেসে উঠলো। এই গাছ বাড়ীর আশেপাশে অযথা হয়ে থাকে। বেগুনী রঙের ফুল ধরে। গাছের বিচিগুলো শুকিয়ে গেলে বাচ্চারা ওগুলো পানিতে ফেলে এতেই ঠুসঠাস শব্দ তুলে ওগুলো ফুটতে থাকে। এজন্য অঞ্চল ভেদে এটাকে এখানে বলে বো*ম ফুল। পৌষ’র ভীষণ পছন্দের এটা। রাস্তা থেকে টুকিয়ে এনে বাড়ীতে লাগিয়েছে ও তাও হেমন্তের রুমের বারান্দায়। রোজ সকালে এসে বিচি তুলে নিয়ে যাবে।

পিহা রুমের দিকে পা বাড়িয়ে বললো,

— বিচিগুলো আপাকে দেখতে গেলে নিয়ে যাব। ঠিক আছে?

— যাস।

পিহা বিছানা ঝাড়ু হাতে খাট ঝাড়তে নিলেই পেছন থেকে তা নিয়ে নিলো হেমন্ত। পিহা’কে সরিয়ে দিয়ে বললো,

— অনেক কাজ করেছেন আকামের চামচি। এবার বসুন। আমার কাজ আমি করে নিচ্ছি।

পিহা ছোট টুলটাতে বসলো। পা নাড়াতে নাড়াতে বললো,

— কিভাবে বুঝলে পৌষ আপা আমাকে এসব করতে বলেছে?

— ওর কাজ তুই নিশ্চিত সেধে সেধে করবি না?

পিহা দাঁত বের করে হাসলো। বললো,

— তোমার কাছে তো এখন বউ নেই হেমু ভাই। তাই খাতির লাগাতে আসলাম।

— ওমা তাই নাকি?

— হ্যাঁ।

— তাহলে আমার বউয়ের দায়িত্ব তোকে পালন করার জন্য কতটাকা দিতে হবে?

— হাহ্। কি যে বলো? বউরা কি টাকা নেয় নাকি?

— বউ তো নেয় না কিন্তু তুই তো আর বউ না আমার। নাটক করে লাভ নেই আর। রাতে পাবি। এখন ভাগ।

পিহা চট করে উঠে দাঁড়ালো। হাসি হাসি মুখটা এখন নেই। মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই হেমন্ত প্রশ্ন করলো,

— কি হলো?

পিহা আর দাঁড়ালো না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো হেমন্ত’কে। কাঁদতে কাঁদতে বললো,

— বড় বাবা এটা কেন করলো? পৌষ আপা’কে নিয়ে এসো না হেমু ভাই।

হেমন্ত পিহা’র মাথায় হাত রাখলো। কিছু বলার আগেই জৈষ্ঠ্য আর চৈত্র এসে হাজির। দুটো হেমন্তের দুই কাঁধে জড়িয়ে ধরে কিছু বলার আগেই ইনি,মিনি দৌড়ে এলো৷ দুটো একসাথে হেমন্তের দুই পা জড়িয়ে ধরে কিছুটা বাঁদরের মতো ঝুলে পরলো। এই পাঁচ বাঁদরের বাদরামী বন্ধ আজ অনেক ঘন্টা। এদের সরদার ছাড়া এরা একা নিঃস্ব। শয়তানের দল শয়তানি করতে পারছে না। যেই হেমন্ত এদের ধমকে ধমকে রাখতো সরদারের অভাবে এরা সেই হেমন্তের কাছে এসেছে। সবগুলোকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বিছানায় বসালো। এদের মন ভালো করা কঠিন কাজ নয় তবে আজ কঠিন ই মনে হলো। শরীর থেকে নামালেও আবার বেয়ে বেয়ে ইনি, মিনি হেমন্তের কোলে উঠলো। দুটোকে দুই পায়ে বসিয়ে হেমন্ত জিজ্ঞেস করলো,

— কাচ্চি খাবি?

কেউ কথা বললো না। হেমন্ত পুণরায় বললো,

— মাওয়া ট্যুর হবে নাকি রাতে? ইলিশ, ভাত খেতে যাবি?

এবারে সবাই মাথা নাড়ালো। কেউ যাবে না। অথচ এমনি সময় এরা সারামাস ভর হেমন্ত’কে পটায় ঘুরতে নিতে। তপ্ত শ্বাস ফেললো হেমন্ত। ইনি, মিনি একসাথে বলে উঠলো,

— হেমু বাই, আপা নাই কেন?

দুটোর এখনও তোতলানো ভাবই কাটলো না এদের হেমন্ত কি উত্তর দিবে? কেন নেই পৌষ?

#চলবে…..

[ প্রেমসুধা আপনাদের এতটা ভালো লাগবে ভাবি নি। অসংখ্য ধন্যবাদ সকলকে। আপনার সবচেয়ে পছন্দ আর ভালোবাসার চরিত্র রোদ আদ্রিয়ান আছে আমার লিখা ই-বুক চিনি তে। পড়া হয়েছে তো?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here