মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ #১৫তম_পর্ব

0
392

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#১৫তম_পর্ব

অভ্রের দৃষ্টি তার ঐন্দ্রির দিকেই। মেয়েটার চোখ ম্লান। অনেকক্ষণ পর ডান হাতে ঐন্দ্রিলার মাথাটা টেনে বুকের সাথে মিশালো। হঠাৎ প্রশস্ত বুকের উষ্ণতায় হৃদয়ের বিষাদপাথরগুলো গলতে লাগলো যেন। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো বিষাদসিন্ধুর জলধারা। নিশ্চুপ ঐন্দ্রিলা। চোখ থেকে অনবরত ঝরছে অশ্রুধারা। ভিজে যাচ্ছে অভ্রের শেরওয়ানি। ঐন্দ্রিলা বোঝার পূর্বেই তার অভিমানী অশ্রু জোড়া ভিজিয়ে দিল গাল। যেন বছর গড়িয়েছে কিন্তু কাঁদা হয় নি। এতো যন্ত্রণা কেনো হচ্ছে, এতোটা কষ্ট সে কি করে পুষে রেখেছিলো। তার উপরে সে যার উষ্ণতায় গলে যাচ্ছে সে মানুষটি মোটেই তার প্রিয়র তালিকাবদ্ধ নয়। ঘৃণ্য মানুষের বুকে এতটা উষ্ণতা থাকে। যে ছিলো চক্ষুশূল, যার প্রতি ঘৃণায় অন্ধ ছিলো হৃদয়; তার শরীরের গন্ধে কি সেই উষ্ণনুভূতি আছে? খানিকক্ষণ এভাবেই কেটে গেলো। নিস্তব্ধ পরিবেশে বিষাদবিলাশ হলো আড়ালে। ডেটল দিয়ে পরিষ্কার করা হাতটা তখন মাথায় আলতো করে বুলিয়ে খুব কোমল স্বরে অভ্র বললো,
“তুই শুধু ভেড়াদের আমদানী কি করে করিস?”

কথাটায় তাচ্ছিল্য ছিলো না, ছিলো না উপহাসের রেশ। তবুও ঐন্দ্রিলা ডুকরে কেঁদে উঠলো। সময় নিলো না। মিশে গেলো তার প্রশস্থ বক্ষস্থলে। শব্দ করে ফুপালো। দুটো হাত জড়িয়ে ধরলো কোমড়। অভ্র কপাল কুঁচকে বললো,
“আমার শেরওয়ানিতে সর্দি লাগিয়ে দিলি তো”

কিন্তু মাথায় আলতো করে হাত বুলানোতে বিরতি হল না। ফলে মেয়েটি থামলো না। বরং শক্ত হলো বাঁধন। কত যন্ত্রণা পুষে রেখেছে সেটা কি জানে অভ্র? তার জীবনে সব ই তো ফাজলামি। সে কি করে বুঝবে হৃদয় ভাঙ্গনের দুঃখ। অভ্র বিদ্রুপ টেনে বললো,
“ইশ! এই নাকের জল আর চোখের জলে তো চিপচিপে হয়ে গেলাম রে। তুই এতো বাজে ভাবে কেন কাঁদিস ঐন্দ্রিলা। কাঁদতে হবে সৌন্দর্য নিয়ে। নাহ, তোর কান্না একেবারেই সুন্দর না। তুই কান্নায় ফেল মেরেছিস”

ফলে আরোও শব্দ করে কাঁদলো ঐন্দ্রিলা। এই পাজি ছেলের বুকে হুমড়ি খেয়েই কেনো কাঁদতে হবে তার? কয়েকটা কিল মারলো বুকে। তবে নড়লো না একচুল। নিবিড়ভাবে লেপ্টে রইলো অভ্রের বুকে।

*****

ঐন্দ্রিলা দুহাত নিয়ে চোখ মুছছে। চোখজোড়া ফুলে গেছে। ফুপাচ্ছে এখনো। নাক টানছে ক্ষণে ক্ষণে। অশ্রুর সাথে ভালোবাসা, বিশ্বাস সব জ্বলাঞ্জলি দিয়েছে। শ্বাসে টান লেগেছে। অভ্র তার শেরওয়ানি নিয়ে খুব চিন্তিত। বুক বাঁকিয়ে বলল,
“ইশ! আমার শেরওয়ানির মানইজ্জত সব তোর নাকের সর্দিতে ধুয়ে গেলো। ছে”

ঐন্দ্রিলা হাসলো মৃদু। কিল দিল বাহুতে। কিন্তু এই সামান্য কিলে কিচ্ছু হলো না তার। হাত পা টানা দিয়ে বললো,
“চল”
“কোথায়?”

কন্ঠে কৌতুহল ছলকালো ভীষণভাবে। অভ্র স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“বিয়ে করবো”
“তুই পাগল?”
“শোন ঐন্দ্রিলা, এতোটা সময় তোর সব ন্যাকামি সহ্য করেছি। এখন যদি বলিস বিয়ে করবি না, ঠাটিয়ে চড় লাগাবো”

অভ্রের কথায় রাগ প্রকাশ পেলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো ঐন্দ্রিলা। হতাশ স্বরে বলল,
“এতো রাতে তোকে বিয়ে করানোর জন্য কাজী বসে আছে তো। শ্বশুর লাগে তো তোর?”

ঐন্দ্রিলার কথা পাত্তা দিল না সে। বিল্লালকে ফোন দিল সময় নষ্ট না করে। বিল্লাল ফোন ধরতেই বললো,
“কাজী কি আছে, নাকি চলে গেছে?”
“ব্যাটাকে বেঁধে আসছিলাম। যে রোগা পটকা। বেহুশ হয়ে গেছে মনে হয়। তরুন গার্ড দিচ্ছে”
“ব্যাটার বাধন খোল। এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত খাওয়া। একটা ডিম খাওয়া। এনার্জির প্রয়োজন। বিয়ে পড়াতে হবে তো। দেখা গেলো অর্ধেক বিয়েতে বেহুশ হয়ে গেলো। তখন কাজী পাবো কই?”

অভ্রের আদেশ শুনে হতবাক বিল্লাল ব্রেক লাগালো তার মোটরসাইকেলে। উৎকুন্ঠিত স্বরে বলল,
“বিয়ে? তোরা এখন বিয়ে করবি?”
“তো কি কাজীর থোবড়া দেখার জন্য বেঁধে রাখতে বলেছি?”

বলেই খট করে ফোন কেটে দিল। তারপর বলল,
“যা মুখ ধুয়ে আয়। আটা ময়দা ধুয়ে আয়। আমার বউ হবে ন্যাচারাল বিউটি। কিন্তু তুই সেই বিউটির ধারে কাছেও পড়িস না। এই আটা ময়দায় আরোও সারারাগুলের মতো লাগছে। যা ধুয়ে আয়”

অভ্রের আদেশের সুর শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ঐন্দ্রিলা। আজ অভ্রকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কেনো ঘৃণা করত সেই কারণটাও ঠুংকো হয়ে গেছে। হাসলো আনমনে। আজ সত্যি সত্যি তার আর অভ্রের বিয়ে।

******

পিউ কাঁদছে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে। সাবেরা তাকে অনেক বকাবকি করেছেন। কেনো যেন এক বন্ধু আকাম করলে সেই আকামের পুরো দোষটা পড়ে সাথে দাঁড়ানো বন্ধুর ঘাড়ে। সে হয়তো সেই আকামে জড়িত থাকে না। কিন্তু পিউ ঐন্দ্রিলার এই গোল্লাছুটের মুখ্যম সাক্ষী এবং মদকদাতা। ফলে গালি খাওয়া তার জন্য ফরজ। কিন্তু প্রথমে অভ্রের বকাঝকা এরপর সাবেরার বকাঝকায় একেবারে চুপসে গেছে সে। নীলাদ্রি তার পাশে বসে আছে। তার হাতে ঠান্ডা পানি। তার মুখখানা বেজার। সে বাবার আয়োজনের নিন্দা করতে পারছে না। কারণ তার বোন পালিয়েছে। তার বোনের জন্য চিন্তা হচ্ছে। মেয়েটা এতো বেকুবের বেকুব। উন্নত পর্যায়ের গর্দভ না হয়ে কেউ বিয়ে ছেড়ে পালায়? পিউ হিচকি তুলে কাঁদছে। নীলাদ্রি গম্ভীর স্বরে বললো,
“আমার বোন না হয় বেকুবের বেকুব। কিন্তু তুমি এই বেকুবের সাথে তাল দিলে?”
“বুদ্ধিটা আমার ছিলো নীলাদ্রি ভাই। অভ্রকে জব্দ করতে চেয়েছিলাম। ও অনেক কাঁদিয়েছে ঐন্দ্রিলাকে”
“তুমি আমাকে হতাশ করলে পিউ। আমি ভাবতাম তুমি খুব চালাক মেয়ে। নাহ, ঐন্দ্রিলার সাথে থাকতে থাকতে তুমিও বেকুব হয়ে গেছো”

পিউ এতোকাল নিজেকে বেশ বুদ্ধিমতী ভাবতো। কিন্তু নীলাদ্রির কথা শুনে মনটা বসে গেলো। বোকারাম যদি বলে তুমি বেকুব, তাহলে বুঝতে হবে তুমি আসলেই বেকুব। পিউ কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আপনি কি আমার উপর রাগ করলেন নীলাদ্রি ভাই?’

নীলাদ্রি খুব সুন্দর করে হাসলো। নির্মল, নিষ্কলঙ্ক হাসি। পিউ এর মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বলল,
“নাহ, আমার তোমার উপর রাগ হয় না পিউ”

সালাম সাহেব মাত্র ফিরে এসেছেন। কাজীর বাধন বিল্লাল খুলে দিয়েছে। তাকে দুটো সেদ্ধ ডিম, দুটো আম এবং একগ্লাস ঠান্ডা শরবত দেওয়া হয়েছে। মানুষটির অবস্থা ভালো নয়। রুগ্ন শরীরটা ভয়ে যেকোন সময় টপকে যেতে পারে। বিল্লাল তার কাছে ক্ষমা চাইলো। সোফায় বসে থাকা গম্ভীর পৌঢ় চেহারায় ভাঁজ। তীব্র ভাঁজ। রাত বারোটা বাজে। এখন তার বড় নাতীর বিয়ে হবে। তার পরিবারের কারোর বিয়ে এমন অদ্ভুত ভাবে হয়েছে কিনা মনে আসছে না। কি বিদিককিচ্ছির বিয়ে, প্রথমে বউ পালালো, বর জেলে গেলো। এখন তারা আসছে, বিয়ে করবে। এই বিয়ে কি টিকবে আদৌ? এদিকে তার ছেলে আর ছেলের বউ বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। একজনের মুখ হাসি হাসি, একজনের মুখ গোমড়া। কারণ একটাই ছেলের বিয়ে হবে। একটু আগে অবশ্য ভিন্ন পরিস্থিতি ছিলো। একটু আগে এক হাসছিলো, আনন্দ নিয়ে টফিতে ক্রিকেট দেখছিলো, আফগানিস্তান ভার্সাস বাংলাদেশ খেলায় হাইলাইট। আরেকজন কাঁদছিলো। কারণ ছেলের বউ পালিয়ে গেছে। এদের উপর ভরসা করা মানেই বৃথা। আউওয়াল সাহেব মনে মনে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিলেন, পাথরের মত কঠিন সিদ্ধান্ত। নাতী বিয়ে করছে করুক। কিন্তু তিনিও তার দাদা। এতো সহজে হাল উনি ছাড়বেন না। তার সিদ্ধান্ত নেওয়া শেষ। সিদ্ধান্ত নেবার পর তিনি বেশ সগর্বে হাসলেন।

অভ্র, ঐন্দ্রিলা আসতে সবার প্রশ্নের বানে জর্জরিত হতে হলো ঐন্দ্রিলাকে। অভ্র তখন হুংকার ছেড়ে বললো,
“আগে বিয়ে হবে, তারপর সব প্রশ্নোত্তর”

সাবেরা মেয়ের দিকে তাকালো। কিন্তু ঐন্দ্রিলা মায়ের দিকে একবারও তাকালো না। হয়তো আজ এতটা হেনস্তা হতে হত না। মা যদি একটু তার কথাটা শুনতো। এতটা জোর জবরদস্তি না করত তাহলে এতো বিশ্রী সিদ্ধান্ত নিত না ঐন্দ্রিলা। সে একবারো ঐন্দ্রিলাকে বুঝতেও চায় নি। এখনো মহিলার ভাবমূর্তি অবিচল। কই একবার তো জড়িয়ে ধরতে পারতো সে। বলতে কি পারতো না,
“তুই কি কেঁদেছিস মা?”

না সে করে নি। সে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। রুগ্ন কাজী অবশেষে বিয়ে পড়ালো। তিন কবুলের মাধ্যমে ঐন্দ্রিলা সারাজীবনের জন্য মিশে গেলো সৈয়দ মাহাবুল হক অভ্রের সাথে। হয়ে গেলো বাকুয়ি বাড়ির বউ। অভ্র পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বললো,
“বউ, প্রস্তুত তো??”

ঐন্দ্রিলা হেসে বললো,
“প্রস্তুতি তুই নে। তোর জীবন যদি জিঙ্গালালা না করেছি আমার নাম ঐন্দ্রিলা মজুমদার নয়”
“বাবু তোমার নাম এমনেও এখন ঐন্দ্রিলা মজুমদার নয়। এখন তুমি মিসেস সৈয়দ মাহাবুল হক অভ্র”
“মরে যা”

মুখ খিঁচিয়ে বললো ঐন্দ্রিলা। অভ্র হেসে বললো,
“মরে গেলে পা ছড়িয়ে কাঁদবি”
“স্বপ্নে”

অভ্র হাসলো। অবশেষে সে বিবাহিত। শুধু তাই নয়, তার পুতুল এখন শুধু তার। এর মাঝেই আউওয়াল সাহেবের গম্ভীর স্বর কানে এলো,
“অভ্র এদিকে শোনো, কথা আছে”

******

অভ্র আউওয়াল সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আউওয়াল সাহেবের চোখজোড়া শান্ত। অভ্র তখন দাদাজানের সাথে খুব বাজে ব্যবহার করেছিলো। ঐন্দ্রিলা চলে যাওয়ায় মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। তাই বিনয়ী স্বরে বললো,
“দাদাজান, তখনের কাজের জন্য আমি দুঃখিত। ক্ষমা করবেন”

অভ্রের অনুতাপকে মোটেই মূল্য দিলেন না আউওয়াল সাহেব। বরং মেঘমন্দ্র স্বরে বললেন,
“আমাদের চুক্তির কথা স্মরণ আছে তো অভ্র?”

হুট করে দাদার কথায় চমকে গেলো অভ্র। বিমূঢ় চেয়ে রইলো কিছুটা সময়। দাদা তার চাহনী অগ্রাহ্য করে বললো,
“আমি চুক্তিটা ভাঙতে চাচ্ছি”

দাদার এহেন কথায় অস্থির হলো অভ্র। উৎকুন্ঠিত স্বরে বলল,
“মানে টা কি? আমি তো চুক্তির শর্ত পূরণ করেছি। আমি বিয়ে করেছি”
“তাতে কি? তোমার কি মনে হয় তোমার এই ছেলেমানুষী আমি মেনে নিবো? এই বিয়ের ভবিষ্যত কি?”

অভ্র কিছু বলতে গেলে দাদা খুব ঠান্ডা স্বরে বলল,
“যদি এক বছরের মাথায় আমাকে তুমি প্রমাণ করতে পারো তোমাদের বিয়ের ভিত্তি আছে, তাহলেই আমি আমাদের চুত্তি অনুযায়ী তোমাকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দিব”………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here