মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ #৮ম_পর্ব

0
220

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#৮ম_পর্ব

দোকানের সবার চোখ অভ্রের দিকে। কারণ এই প্রথম মনে হয় কোনো বর উজ্জ্বল ম্যাজেন্টা রঙ্গের শেরওয়ানি পড়বে। শেরওয়ানি দেখে ফিক করে হেসে দিলো বিল্লাল এবং তরুন। অভ্রের শ্যাম মুখে জমলো মেঘ মেদুর। মুখখানা শক্ত হয়ে গেলো। ঐন্দ্রিলা তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমার পছন্দ হয় নি বাবু?”

শত রাগ হলেও তা গিলে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“তোর পছন্দকে অপছন্দ করার জো আছে। একটু উৎকট কিন্তু অসাধারণ”
“তাহলে যাও, পড়ে আসো। আমিও দেখি আমার বাবুকে কেমন লাগছে?”

ঐন্দ্রিলা ভ্রু নাচিয়ে কথাটা বললো। অভ্রকে কোনঠাসা করে অব্যক্ত আনন্দ হচ্ছে তার। শ্বাশুড়ির সামনে প্রেমের নাটক করতে যেয়ে বাধ্য হয়েই শেরওয়ানিটা পড়তে হলো অভ্রকে। এদিকে বিল্লার আর তরুনের হাসতে হাসতে চোখে পানি আসার যোগাড়। অভ্র তাদের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললো,
“হেসে নে, দোকানে গেলে পই পই করে হাসির হিসেব নেবো”

ব্যস হাসি উবে গেলো দুজনের। তরুন মুখ ঝুলিয়ে বললো,
“বউ এর রাগ আমাদের উপর ঝাড়া তো অন্যায় বিল্লাল ভাই”
“বিয়া করিস নি তো, তাই বুঝতেছিস না। বিয়ে সিংহকেও বেলাই বানায়ে দেয়”

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র এবং ঐন্দ্রিলা। নিজেদের একেবারে কার্টুনের মত লাগছে। কিন্তু মুখে প্লাস্টিকের হাসি অক্ষত। কিছু বলতে পারছে না। কানন এবং সাবেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। না পারতে কানন বলেই উঠলো,
“এখন ছেলেমেয়ের পছন্দ কিছু তো বলা যায় না”
“হ্যা, তবে একটু বেশি অসাধারণ পছন্দ, তাই না?”

ঐন্দ্রিলাকে ক্ষেপাতে অভ্র বলে উঠলো,
“না আন্টি কিসের অসাধারণ। ঐন্দ্রিকে তো আকাশ থেকে টুপ করে পড়া পরির মতো লাগছে”

অভ্রের কথাটা মাটিতে পড়তে দেবার মানুষ তো ঐন্দ্রিলা মোটেই নয়। তাই সাথে সাথেই দাঁত কপাটি বের করে বলল,
“আর তোকে একেবারে মাটি ফুড়ে বের হওয়া নায়কের মতো লাগছে। মানুষের চোখ ই সরছে না দেখ। কি করে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে আছে। আহা আমার জামাই! বিয়ের দিন আমি তো তোর প্রেমেই পড়ে যাব”
“আমি তো প্রতিদিন পড়ি। ইচ্ছে করে তোর স্ট্যাচু বানিয়ে রাখি। মাঝে মাঝে তো তোকেই স্ট্যাচু বানিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে”

শেষ কথাটা একেবারে আস্তে বলল অভ্র। ঐন্দ্রিলা না শোনার ভান করে বললো,
“কিছু বললি বাবু?”
“নাহ, কি বললাম বাবু? শপিং শেষ না তোমার?”
“উহু, জুতো কিনা বাকি। আমি তো ভেবেছি তোমাকে একেবারে লাল জুতো কিনে দিবো। খোকাবাবু যায় লাল জুতো পায়— বিয়েতে তোমার এন্ট্রিতেও এই গানটাই বাজবে ডিজেতে ভালো হবে না”

অভ্র পারে না ঐন্দ্রিলাকে কাঁচা গিলে খেতে। রাগে গা জ্বললেও দাঁত কামড়ে তা দমালো। সাবেরা তখন পেছন থেকে বলল,
“ঐন্দ্রিলা, অভ্র কি নার্সারির বাচ্চা নাকি, লাল জুতো পড়বে। মেজেন্টা শেরওয়ানি তুমি জিদ করেছো। কিনেছি আর না। এবার তোমরা ড্রেস বদলে এসো”

অভ্র যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। মনে মনে হবু শ্বাশুড়ি মাকে হাজারবার ধন্যবাদ দিলো। নয়তো কল্পনার থেকে ভয়ংকর রুপে ঐন্দ্রিলা তাকে সাজাতো। ফোঁস করে অন্তস্থলে চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেই ঐন্দ্রিলা বললো,
“কি বাবু? এক্ষণি হাপিয়ে গেলে? এখনো অনেক কিছু বাকি আছে”

ঐন্দ্রিলার মুখখানা উজ্জ্বল। অভ্র দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“তুই আগুন নিয়ে খেলছিস”
“উহু, আমি শুধু তুর্কিনাচন নাচাচ্ছি”

বলেই অভ্রের মুখে হালকা চাপড় দিলো। অভ্র নিলীন চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। মস্তিষ্কে জেদ চেপেছে। সে অন্তত হারবে না।

******

ঐন্দ্রিলার বাড়ির সকাল হলো নীলাদ্রির চিঠি দিয়ে। পাঁচ দিন পর ঐন্দ্রিলার বিয়ে অথচ সে এখনো আসে নি। বরং কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে চিঠি পাঠিয়েছে। সকালবেলা কুরিয়ার বয় একেবারে সালাম সাহেবের হাতে চিঠি দিয়ে গেছে। সে অন্য কারোর হাতে দিবে না। কারণ নীলাদ্রি স্পেশালভাবে বলেছে জরুরী ডকুমেন্ট তাই যেনো সালাম সাহেবের হাতেই দেওয়া হয়। সালাম সাহেবের সকালবেলা একেবারে মুহূর্তেই গুমোট হয়ে গেলো। কারণ চিঠিতে সে গোটা গোটা হরফে লিখেছে,

“পরম শ্রদ্ধেয় বাবা,
তোমার পত্র আমি গতকাল সন্ধ্যায় পাইয়াছি। তোমার মত উচ্চশিক্ষিত মানবের পিতার মুখে এমন অশ্রাব্য ভাষা শোভা পায় না। ব্যাপারটি অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। ছাগলের বাচ্চা গালি দ্বারা তুমি আমাকে অপমান করো নাই। করিয়াছো নিজকে। আর আমি বান্দরবানে কোনো অপ্রয়োজনীয় অনাবশ্যক বাজে কাজ করি না। আমি এখানে জীবনদর্শন বানাইতেছি যা ভবিষ্যতের আলোকদর্শী হইবে। তোমার অর্থের প্রতি আমার মোহ কোনোকালেই ছিলো না। তুমি তোমার অর্থ দিয়ে প্রাসাদ বানাও নাকি গরিবে দান তাহা তোমার নিজস্ব ব্যাপার৷ আমার তাহাতে কিছুই যায় আসে না। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। আমার ভগিনীকে বিবাহ দেবার সময় আমাকে তোমরা স্মরণ করো নাই। তাই তার বিবাহে আমার প্রয়োজনীয়তা নাই। আমি শুধু মেহমানের মতই আসিবো, পেট ভরিয়া খাইবো আর তোমার আয়োজনের নিন্দা করিবো। এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত।

ইতি
তোমার একমাত্র উচ্চশিক্ষিত পুত্র,
ডাবল মাস্টার্স, নীলাদ্রি

[বিঃদ্রঃ আমি আমার মুঠোফোনকে ৫০০ মিটার উচ্চ পাহাড় থেকে ফেলিয়া দিয়াছি। সুতরাং আমাকে ফোন করিবার বৃথা প্রয়াস করিও না। আমি আমার মাতার জন্য একটি একখানা গোপন নাম্বার দিয়াছি। যা কেবল আমার মাতাই ব্যবহার করিবে]

চিঠিটা পড়ে রাগে গজগজ করতে লাগলেন তিনি। সাবেরা তখন চা খাচ্ছিলো। চিরচিরিয়ে সাবেরাকে বললেন,
“দেখেছো ছাগলের বাচ্চাটা কি লিখেছে, সে নাকি মেহমানের মত আসবে। গিলবে, আবার নিন্দাও করবে। সে উচ্চশিক্ষিত আর আমি তো মূর্খ। সাবেরা আমি কিন্ত তোমার এই গাধাপুত্রকে আসলেই ত্যাজ্য করবো”

সাবেরা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
“সেটা তুমি আর তোমার ছেলে বুঝে বেড়াও। আমার মেয়ের বিয়েটা ভালো ভাবে হলেই আমার শান্তি। খবরদার, বাপ বেটা যদি বিয়েতে ঝামেলা কর তাহলে খবর আছে”
“আমি ঝামেলা করছি? আর এই ছাগলের বাচ্চাটা কিছু করছে না। বলে কি না মোবাইল পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছে। গাধা কোথাকার। ডাবল মাস্টার্স করে পৃথিবী উদ্ধার করে দিয়েছে সে। সারাজীবন প্রথম হয়েছে কিন্তু বুদ্ধি হয় নি। আমার ইচ্ছে করছে ওর সব সার্টিফিকেট জ্বালিয়ে দিতে”

কথা বলার আগেই মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি চলে এলো। হু হা করে হেসে বাদশাহ নামক ছেলেটাকে বললেন,
“বাদশাহ, একটা পেন আর পেপার নিয়ে আসো। কুইক”
“কেন স্যার?”
“চিঠি লিখবো”
“আবার?”
“চুপ, নিয়ে আসো”

বাদশাহ কাগজ কলম নিয়ে আসতেই সালাম সাহেব দ্বিতীয় চিঠি লিখলেন,

“অপদার্থ নীলাদ্রি
যেহেতু তুমি বলিয়াছো তোমাকে ত্যাজ্য পুত্র করিলে তোমার কিছুই যায় আসে না। সুতরাং এই মুহূর্তক্ষণেই তোমাকে আমি পুত্র হিসেবে বহিষ্কার করিলাম। আমার গৃহে তোমার স্থান নেই। আজ মধ্যাহ্নে তোমার ঘরখানা আমি ভাঙ্গিয়া ফেলিবো। সব জিনিস ফেলিয়া দিনো। ডেটল আর ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পরিষ্কার করাইবো। তারপর তাহা হইবে আমার আড্ডাখানা। হুহাহাহাহাহা

ইতি
তোমার প্রাক্তন পরম শ্রদ্ধেয়
পিতা”

[বিঃদ্রঃ তুই শুধু ছাগলের বাচ্চাই না, মহা ছাগলের বাচ্চা]

চিঠি লিখে বাদশাহকে বললেন,
“এখন দোকান থেকে চকচকে খাম কিনবে। তারপর গাধাটাকে কুরিয়ার করে পাঠাবে। সাথে এক বস্তা কাঠাল পাতাও কুরিয়ার করবে। কুরিয়ার বয়টি যেনো ওকে দু তিনটা পাতা নিজ হাতে খাইয়ে আসে”

বাদশাহ মুখ ঝুলিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। মানুষটির মাথায় যে উচ্চপর্যায়ের সমস্যা আছে তাতে সন্দেহ নেই।

******

অভ্রের চোখজোড়া টকটকে লাল। গত কয়েকদিন যাবৎ যে তার ঘুম হচ্ছে না তাতে সন্দেহ নেই। বিয়ের এমন প্রভাব পড়বে সেটা অকল্পনীয় ছিলো। বিল্লাল তাকে দেখছে। একটা সময় সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বললো,
“খাবি?”

সিগারেট দেখে অভ্রের চোখ চকচক করে উঠলো। হামলে সিগারেটের প্যাকেটটা নিলো। ঐন্দ্রিলার যন্ত্রণায় তার জীবন দূর্বিষহ। এইতো সেদিন ঝড়ের গতিতে এসে তার সদ্য কেনা বেনসনের প্যাকেটটা ফেলে দিলো। তারপর ন্যাকা স্বরে বললো,
“বাবু, তুমি আমার আগে মরতে চাও। আমাকে বিধবা করতে চাও। এখন থেকে তুমি সিগারেট খাবে না”

শুধু এতেই ক্ষান্ত হলো না, সে কানন এবং ইদ্রিশ সাহেবকেও নিজের দলভুক্ত করে ফেললো। ফলে বাসায় সিগারেট খাওয়া মিশন ইমপসিবল হয়ে গেলো। উপর থেকে দাদা তো আসেন ই। ঐন্দ্রিলা যেমন নাচায় তিনিও নাচেন। সকাল সকাল হলে মুখ উঠিয়ে চলে আসে। অভ্র কি পড়বে সেটাও যেন তার বলা প্রয়োজন। গতকাল সব কাপড়চোপড় ছবিরনকে নিয়ে ধুইয়ে দিলো। আর অভ্রের জন্য নিয়ে এলো একটা ফুললতাপাতা ছাপার শার্ট। কোনো পোশাক না থাকায় অভ্রকে বাধ্য হয়ে সেই শার্ট পড়তে হলো। ঘরে অভ্রের অপছন্দের তরকারি প্রতিদিন রান্না হচ্ছে। ঐন্দ্রিলার ঘরের জানালা সবসময় খোলা থাকছে। অভ্র শান্তিতে নিঃশ্বাস নিলেও কোথাতে “বাবু” ডাক শুনতে পাচ্ছে। আজ সকালে স্বপের মধ্যে, “বাবু” ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেছে। সকাল ছয়টার সময় হবু বউকে নিয়ে ফুলের দোকানে যেতে হয়েছে। বিল্লাল হাসতে হাসতে বলল,
“ঐন্দ্রিলা তো এককাঠি উপরে, বিয়ের আগেই তোর জীবনে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে”

অভ্র রাগী স্বরে বলল,
“হাসিস না। একেই আমার জীবনে আগুন জ্বলছে আর তুই হাসছিস? এই তুই আমার বন্ধু?”
“এতোই বিরক্ত হয়ে বিয়ে ভেঙ্গে দে”
“তাহলে তো আমি হেরে যাব। সেটা তো হবে না”

বলেই দুর্বোধ্য হাসলো। বিল্লাল দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই দুজন থামবার নয়। বিয়ের দিন যে কি হবে সেটা ভেবেই ভয় হচ্ছে।

******

বিনা নোটিশে শাড়ি পরে বের হবার ফরমান দিয়েছে অভ্র। আজকে নাকি তাদের প্রি ওয়েডিং ফটোশুট। শুনেই ঐন্দ্রিলা ক্ষেপে গেলো। অভ্র হাসি মুখে বলল,
“বাবু, সারপ্রাইজ”

মায়ের সামনে অভ্রের মাথা ফাটাতে পারলো না ঐন্দ্রিলা। সাবেরা বেশ প্রসন্ন জামাইয়ের উপর। বিয়েতে কোনো জামাই এতোটা ভাবে? শপিং, ডেকোরেশন সব কিছুতেই অভ্র বেশ সোচ্চার হয়ে কাজ করছে। দগ্ধময়ী দুপুরে কাতান শাড়ি পরে বের হতে হলো ঐন্দ্রিলাকে। শাড়ির ভার বোধ দশ কেজি হবে। উপরে পিচ গলানো গরম, স্তব্ধ প্রকৃতি ঝলসে যাচ্ছে তাপে। মেকাপ, খোপা সব মিলিয়ে যেনো ঐন্দ্রিলার হাল বেহাল। অভ্র বাইকে অপেক্ষা করছে ঐন্দ্রিলার জন্য। ভারী শাড়ি নিয়ে কোনো মতে বের হলো ঐন্দ্রিলা। ঘামে ঘাড় ভিজে গেছে। অভ্রের মজা লাগছে খুব এতোদিনের বদলা এক দিনেই নিবে সে। শহর ছাড়িয়ে নিরিবিলি একটা রেস্টুরেন্টে গেলো তারা। বিশাল বড় একটি জায়গায় একতালা রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টের পাশে বিশাল সবুজে ঘেরা জায়গা। সুউচ্চ গাছের ছাউনির পাশে স্বচ্ছ পানির স্রোত। তার মাঝে খিলে আছে অসংখ্য পদ্ম। এখানেই ফটোশুট হবে। অভ্র স্যুট পড়ে এসেছে। কালো স্যুটে নব্বই কেজি ওজনের সুঠাম দেহী সৌম্য পুরুষকে খুবই চমৎকার দেখাচ্ছে। সেই সাথে লাল কাতানে ঐন্দ্রিলা। ফটোগ্রাফার ছবি তুলছে আর প্রশংসা করছে। এর মাঝে ইচ্ছাকৃতভাবে ঐন্দ্রিলার সাথে ঘনিষ্ট হয়ে ছবি তুললো অভ্র। তথাকথিত রোমান্টিক ছবি তুলতে যখন কোমড় চেপে ধরল সে, ঐন্দ্রিলা কটমটিয়ে তাকালো। অভ্র নির্লজ্জ হেসে বলল,
“একটু হাসো বাবু, শ্বাশুড়ি মা কিন্তু বলেছেন। ভালো না হলে আমার ছবি তোলাবেন”

বাধ্য হয়ে হেসে ছবি তুললো ঐন্দ্রিলা। ফটোসেশন হেসে ঐন্দ্রিলার অবস্থা একেবারে নাজেহাল। পা ব্যাথায় ছিড়ে যাচ্ছে। ঘামে মেকাপ গলে পড়ছে। ফটোগ্রাফারকে খাইয়ে, টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দিলো অভ্র। ঐন্দ্রিলা রেস্টুরেন্টের ভেতর উচু জুতো খুলে গা এলিয়ে বসলো। তার নাজেহাল অবস্থা দেখে খুব মজা লাগলো অভ্রের। এসে বলল,
“তুই বয়, আমি অর্ডার করে আসি”

ঐন্দ্রিলা উত্তর দিলো না। রাগে সে বাকশক্তি হারিয়েছে। এখন শুধু একটু শান্তির নিঃশ্বাস নিবে সে। অভ্র চলে গেলে গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। তখন ই একটি ভারী স্বর কানে এলো,
“ঐন্দ্রিলা”

স্বরটি শুনতেই বিশাল ধাক্কা লাগলো হৃদয়। তড়িৎ গতিতে পাশে ফিরলো ঐন্দ্রিলা। তার সম্মুখে গৌঢ় বর্ণের সাদা শার্ট পড়া যে সুপুরুষটি দাঁড়িয়ে আছে তাকে চিনতে সময় নিলো ঐন্দ্রিলার হৃদয়। হুট করেই মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেলো। অস্পষ্ট স্বরে বলল,
“সৌরভ?”

সৌরভ নামক পুরুষটি মিহি হাসলো। সেই অমায়িক, শান্ত হাসি। ধক করে উঠলো চিত্তস্থল। পাঁচ বছর পুরোনও স্মৃতিগুলো ক্যামেরার রিলের মতো মস্তিষ্কের সেলুলয়েড পর্দায় ফুটে উঠলো। ম্লান, ঝাপসা হৃদয়টা আবারো স্পন্দিত হলো জীবনের প্রথম ভালোবাসার জন্য। প্রথম ভালোবাসা, যতই পুরোনো হোক না কেনো তার স্মৃতিগুলো হৃদয় প্রকোষ্ঠে থেকেই যায়। পাঁচ বছরেও সেই অনুভূতিগুলো ক্ষয়ে যায় না। ঐন্দ্রিলার গলায় দলা পাকালো কিছু বলতে পারলো না। সৌরভ নিজ থেকেই শুধালো,
“কেমন আছো?”

উত্তর এবারো এলো না। শুধু মৌনতা। ঐন্দ্রিলার মনে হলো পালিয়ে যেতে পারলেই বোধহয় শান্তি। শুষ্ক ঠোঁটটা জিহবা দিয়ে ভেজালো। তন্মধ্যে চলে এলো অভ্র। সৌরভকে দেখেই তার মুখখানা শক্ত হয়ে গেলো। অভ্রকে চিনতে পারলো সৌরভ। হেসে শুধালো,
“কেমন আছিস তুই?”
“ভালো? তুই”

খুব ছোট উত্তর। নির্লিপ্ততা কন্ঠে। সৌরভ হাসলো,
“ভালো, তোরা একসাথে নাকি?”

প্রশ্নটার মাধ্যম্যে সত্যতা জানার প্রয়াস। ঐন্দ্রিলা এখনো মৌন। সৌরভের দিকে তাকাতে পারছে না। শরীর কাঁপছে। হৃদয়টা কোন্দল করছে সেই প্রথম ভালোবাসাকে দেখে। অভ্র একনজর ঐন্দ্রিলার রক্তশুন্য মুখখানা দেখে বলল,
“হ্যা, আগামী সপ্তাহে আমাদের বিয়ে। এসেছি ফটোশুটের জন্য”

কথাটা শুনতেই সৌরভের মুখের হাসি গায়েব। এদিকে ঐন্দ্রিলার শরীরে যেনো ঝাকুনি লাগলো। অভ্র স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“আসিস কিন্তু বিয়েতে দাওয়াত রইলো”

তখন কেউ সৌরভকে পেছন থেকে ডাকলো। যেতে হবে এখন। ঐন্দ্রিলা এখন নতমস্তক। সৌরভ ঐন্দ্রিলার উদ্দেশ্যে বললো,
“আসি”

সৌরভ চলে গেলো কিন্তু ঐন্দ্রিলা স্বাভাবিক হলো না। সারাটাসময় চুপ করে রইল। এতোটা সময়ের বাবু, বাবু খেলা এখন স্তব্ধ। অভ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে ঐন্দ্রিলাকে। কিছু খেলো না সে। খাবার নেড়ে চেড়ে বলল,
“আমি বাসায় যাব, ভালো লাগছে না”

মনের অসুখে শরীর কি ভালো লাগে? অভ্রের মুখশ্রীর ধার বাড়লো। বিল চুকিয়ে খাবারগুলো পার্সেল নিয়ে যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলো টেনে ধরলো ঐন্দ্রিলার হাত। সাথে সাথেই এক ঝটকায় ঐন্দ্রিলা তা ছাড়িয়ে দিলো। তার চোখজোড়া লাল হয়ে আছে। মুখখানা শক্ত। কারণ বুঝতে বাকি রইলো না, অভ্র ভৎসনা করে বলল,
“পাঁচ বছর পুরোনো প্রেমের সাথে দেখা হওয়ায় কি মুড সুইং হলো?”

কথাটা আঁতে লাগলো ভীষণ ভাবে। শান্ত ঐন্দ্রিলা ক্ষীপ্র হয়ে উঠলো। অন্তস্থলের চাপা ঝড় তান্ডবের রুপ নিলো। ক্ষোভে ফটে পড়লো,
“তুই কি বুঝবি ভালোবাসার? তোর কাছে সবই তো ফাজলামি”

কথাটা শেষ হবার আগেই ঐন্দ্রিলার গাল চেপে ধরলো অভ্র। বলিষ্ট হাতের চেপে ব্যাথায় কুকড়ে উঠলো সে। ক্ষিপ্র স্বরে বললো,
“আমার ওইসব বা’ল বোঝা লাগবে না। তুই একটা জিনিস বুঝে রাখ, বিয়েটা তোর আমার সাথেই হচ্ছে”

অভ্রের এমন আচারণে ভেতর থেকে আরোও গুড়িয়ে গেলো ঐন্দ্রিলা। পাঁচ বছর পুরোনো বিষাদ, ক্ষোভে ঝাঝড়া হলো হৃদয়। সজোরে ধাক্কা দিলো সে অভ্রকে। তারপর অতর্কিতে তার গালে সজোরে চ’ড় বসিয়ে বলল,
“আমি তোকে ঘৃণা করি অভ্র, সারাজীবন করবো। শুধু তোর জন্য আমার ভালোবাসা আমার হলো না। ঘৃণা করি তোকে”…………

চলবে

[সবাইকে ঈদ মোবারক। ভালো কাটুক আপনাদের ঈদ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here