প্রেমসুধা #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ৮

0
270

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৮

দেহ এবং মন। এদের দন্ধ আজন্মকাল। এই মন হাজারবার বারণ করে। অস্বীকার করে পরিস্থিতি। কিন্তু এই দেহ? সে বারণ মানতে নারাজ। মনের খোঁড়াক এবং দেহের চাহিদা দুটো ভিন্ন জিনিস। এদের কম্পেরিজন চলে না। এই দেহের কাছে মন হেরে যায়। এই হারা যে কতটা হীনমন্নতার তা সে জানে যে ভুগেছে।

পৌষ’র মন চাইছে নিজের এই দেহটাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে। কেন সে নিয়ন্ত্রণ হারালো? কেন তৌসিফের পরশে সে গলে গেলো? কেন দেহের উপর জোড় খাটাতে পারলো না? তৌসিফের দোষ এখানে নেই। সে শুধু তার পুরুষ হাতের দক্ষ আদর পৌষ’র মুখময় দিয়েছে। কেন পৌষ সেই আবেশে ঘোরে চলে গেল? কেন স্বেচ্ছায় নিজেকে ঠেলে দিলো তৌসিফের কাছে?
দুই হাতে মুখ চেপে কেঁদে উঠলো পৌষ। কান্নার শব্দ যাতে বাইরে না যায় তাই ওরনাটা গুজে দিলো মুখে। ওর শব্দহীন কান্নায় গুমোট এক পরিবেশ সৃষ্টি হতে হতেই হঠাৎ পৌষ’র খেয়াল হলো ওয়াশরুমে কান্না করা উচিত না। এতে করে এখানে উপস্থিত জিন আলিঙ্গন করে। ভয়ে শিওরে উঠে তারাতাড়ি ওখান থেকে বেরিয়ে আসলো ও। তৌসিফ রুমে না থাকায় কিছুটা সস্তিও পেলো বটে।

হঠাৎ কিছু ঝাঁঝালো কণ্ঠ ওর কানে আসা মাত্র পৌষ রুমের বাইরে উঁকি দিলো। চোরের মতো বুঝার চেষ্টা করলো কি হচ্ছে এখানে। পরক্ষণেই মনে হলো পৌষ কেন চোরা চোখে দেখবে ও দেখবে বীরের চোখে। এ কথা মনে হতেই ঢ্যাং ঢ্যাং পা ফেলে সামনে বারলো ও। এই বিলাসবহুল ফ্ল্যাটটা ওর দেখা হয় নি। তবে কথার শব্দ কোথা থেকে আসছে তা বুঝতে পেরে পৌষ সামনে বাড়লো। অপরিচিত কিছু মুখের মাঝে শুধু তৌসিফ আর তায়েফা’কেই চিনলো ও। পিছু ঘুরে থাকায় তৌফিক তালুকদারকে চিনলো না। তখনই হঠাৎ তৌসিফ দেখলো পৌষ এদিকে আসছে। ওর দিকে তাকিয়ে তৌসিফের রাগ হলো। গরম চোখ দিয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। পৌষ একবার তাকাতেই থামকালো। ভরকালো। ইশারায় তৌসিফ ওকে যেতে বলতেই পৌষ ত্যাড়ার মতো দাঁড়িয়ে রইলো ঠাই। দাঁত চেপে এবার তৌসিফ ওখান থেকেই বললো,

— ভেতরে যাও।

তৌসিফের কথা শুনেই বাকিরাও তাকালো পৌষ’র দিকে। যেই না তৌফিক তালুকদার তাকালো ওমনিই পৌষ ফাটা চোখে দেখলো। সমান তালে চোয়ালটা নড়তে লাগলো। কেন জানি কান্নার আগেই মেয়েটার চোয়াল কাঁপে। ঠোঁট দুটো অনবরত কাঁপতে থাকে। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তৌসিফ এবার দ্রুত পদচারণ করে এগিয়ে আসতে নিলেই পৌষ তারাতাড়ি তৌফিক তালুকদারের কাছে ছুটে আসতে চায়। তবে পারে না। তৌসিফ আগেই ওকে ধরে ফেললো। ছুটার আপ্রাণ চেষ্টা করে ও লাভ হলো না। অপর দিকে তৌফিক তালুকদার নির্বাক। সে কথা বলছে না। কেন এগিয়ে আসছে না পৌষ খুঁজে পেলো না? তৌসিফের শক্তির সাথে পৌষ পারলো না। ওকে টেনে রুমে এনে কিছুটা ছুঁড়ে মা’রে বিছানায়। মুখ উল্টে পরলো পৌষ। নরম বিছানা। ব্যাথা পাওয়ার প্রশ্ন উঠে না তবে পৌষ কেঁদে উঠলো। তৌসিফ দরজা আটকে ওর সামনে এসেই টেনে তুলে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

— আক্কেল নেই তোমার? এভাবে ওরনা ছাড়া বাইরে কেন এসেছিলে? ভেতরে যেতে বললেও শুনলে না। কতগুলো পুরুষ ছিলো ওখানে পৌষরাত?

— গুনি নি।

তৌসিফ অবাক হলো। গুনে নি মানে? পুরুষ গুনে নি? তৌসিফ কি এটা জিজ্ঞেস করেছে? কিছু বলার আগেই পৌষ ওরনা পেঁচিয়ে নিলো। উঠে দাঁড়াতেই তৌসিফ ওর হাত টেনে ধরে বললো,

— কোথায়?

— বাইরে।

— কি দরকার?

— তৌফিক তালুকদারের সাথে কথা আছে আমার।

ভ্রু জোড়া মুহুর্তে ই কুঁচকে গেলো তৌসিফের। বড় ভাইয়ের সাথে পৌষ’র কি কথাই বা থাকতে পারে? সন্দেহের বশেই জিজ্ঞেস করলো,

— কি কাজ বড় ভাইয়ের সাথে?

— আপনাকে বলতে বাধ্য নই আমি।

ঝাঁঝালো গলায় বলেই নিজ হাত ছাড়াতে চাইলো ও। তৌসিফ ওকে টেনে ধরে বললো,

— হাজার বার বাধ্য তুমি পৌষরাত। আর রইলো বাকি কথা, এই কাটা ঠোঁট নিয়ে কোথায় যাচ্ছো? নিশ্চিত ভাসুরের সামনে লজ্জা পাবে।

পৌষ তেঁতে উঠে বললো,

— উনি আমার ভাসুর নন৷ ছাড়ুন আমাকে। উনি তো আমাকে দেখলো তাহলে কেন কথা বললো না? আমি কি কোন দোষ করেছিলাম? কেন কথা বললো না?

তৌসিফ বুঝে উঠতে পারছে না কি কথা থাকতে পারে। জিজ্ঞেস করেও লাভ হচ্ছে না। ও নিজ থেকেই বললো,

— বাবু আসবে কাল সেটাই বলতে এসেছে। এখন ঝামেলা করো না পৌষরাত। ছেলেটা অনেকদিন পর বাসায় আসছে।

“বাবু” কাল আসবে শুনা মাত্র ই থম মেরে গেলো পৌষ। তৌসিফ ওকে শান্ত হতে দেখেই ওর মাথায় হাত রাখে। ঝট করে ওর হাত সরিয়ে দেয় পৌষরাত। তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে,

— আপনার লজ্জা লাগবে না কাল?

তৌসিফ ভাবলো হয়তো বিয়ের কথা বলছে। তাই সোজা ভাবে বললো,

— বাবু সবচাইতে বেশি চাইতো যাতে আমি বিয়ে করি। নতুন ভাবে সব শুরু করি।

তাচ্ছিল্য হাসলো পৌষ। তৌফিক থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে বললো,

— বাবু খুব বেশি ই খুশি হবে।

— হওয়ার কথা।

— হ্যাঁ অবশ্য ই হবে। একশত বার হবে।

তৌসিফ বুঝলো না ওর কথা। ওকে বসতে বলে বাইরে গেলো কথা বলতে। তবে মাথায় গেঁথে রইলো পৌষ’র বলা প্রতিটা কথা।

_________________

হক বাড়ীর পরিবেশের পরিবর্তন ঘটালো গেলো না। আজ চৈত্র’র সাথে বড়সড় একটা কান্ড ঘটে গেলো। বাড়ীর শান্ত ছেলেটা আজ বাবা’র সাথে বেয়াদবি করেছে। বিষয়টা ক্ষুদ্র হলেও আগে থেকেই বাবা’র উপর ক্ষেপে থাকা চৈত্র আজ ফুঁসে উঠেছে। কেন পৌষ আপা’কে এমন বাড়ীর বউ করা হলো? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে যখন ওর বাবা ছেলেকে ধমক দিলো তখনই চৈত্র ঝাঁঝালো গলায় বললো,

— হ্যাঁ হ্যাঁ কেন দিবে না বিয়ে? সম্পত্তি কম পরে যাবে না তোমাদের? নাহলে কেন বড়লোক বাজে পুরুষের সাথে বিয়ে দিতে হলো?

কথাগুলো বলা মাত্র ই সজোরে এক টানা চড় পরলো ওর গালে। হেমন্ত বাসায় না থাকায় ঘটনাটা ঘটেছে। বাবা’র হাতে চড় খেয়ে চৈত্র থেমে যায় নি উল্টো রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,

— পারবে এই শরীরের জোর দেখাতে। এছাড়া তোমরা ভাইয়েরা আর পারই বা কি?

বলেই রুমে চলে যায় ও। জৈষ্ঠ্য ছুটলো ওর পিছনে। ইনি, মিনি আর পিহা ও বাদ রইলো না। সমান তালে ইনি, মিনি কেঁদে যাচ্ছে। এই মুহুর্তে বিরক্ত ই হলো। কেন তোদের একসাথে কাঁদতে হবে? জন্ম একসাথে হলেই কি সব একসাথে হতে হবে? চৈত্র রেগে দিয়ে দিলো এক ধমক,

— আমার রুমে কি? যা বের হ্! থাপ্পড়ে গাল লাল করে দিব। ভ্যা ভ্যা সারাক্ষণ শুধু।

সবসময় আদর আদর কথা বলা চৈত্র ভাই যে এভাবে ধমকে দিবে কে জানতো। এবার কাঁদতে কাঁদতে দুটো চৈত্র’র কোলে উঠে বসলো। দুই পাশ থেকে গলা জড়িয়ে ধরে হিচকি তুলে বললো,

— তোমাল বেতা ওচ্ছে বাই। আমি গালে পাপ্পি দেই। বেতা থাতবে না। দেই?

দুটো একসাথে একই কথা বললো। চৈত্র’র রাগ পরে গেলো। দুটোর মাথায় আদর করে দিতেই গদগদ হয়ে ওরা চৈত্র’র গালে চুমু খেলো। জৈষ্ঠ্য ওদের সামনে এসে বললো,

— কি দরকার ছিলো এভাবে তর্ক করার? লাভ কি হলো? হেমু ভাই থাকলে নাহয় এক কথা ছিলো।

চৈত্র ইনি,মিনিকে কোলে বসিয়েই বললো,

— এই প্রতিবাদটা আগে করতে পারলে পৌষ আপা আজ এখানে থাকতো।

পিহা মাথাটা নিচু করে বললো,

— হেমু ভাই শুনলে রেগে যাবে।

চৈত্র হতাশ হয়ে গেল। পৌষ আপা’কে ওরা অনেক ভালোবাসে।
.
হেমন্ত বাসায় ফিরলো রাতে। পিহা পইপই করে সবটা জানাতেই হেমন্ত হাসলো। পিহা অবাক হলো হেমু ভাই’কে হাসতে দেখে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বললো,

— তুমি হাসছো?

— তো কাঁদব?

— চৈত্র ভাই অনেক রেগে ছিলো।

— তুই বুঝবি না। যাহ ঘুমাতে যা।

— পরে যাব। তুমি খাবে না। চাচি ডেকলো তো।

— খাব।

পিহা যেতেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো হেমন্ত। আজ একটু বেশিই ক্লান্ত লাগছে।

________________

রাতে আজ কিছুতেই একসাথে ঘুমাবে না পৌষ। ও গিয়ে লুকালো পাশের রুমে। না জানি দিনের ঘটনার পর এই লোক লাই পেয়ে বাদরের মতো গাছে উঠে কি না? বলা তো যায় না। রিক্স নিতে চায় না পৌষ। দরজাটা লক করে শুয়ে পরলো পৌষ। রাত গভীর। দুটো বাজে। খুট করে লকটা খুলে তৌসিফ রুমে ঢুকলো। ক্ষুধায় পেট চু চু করছে পৌষ’র। রাত বাড়ার সাথে সাথেই ক্ষুধা বাড়ে ওর। সারাদিন না খেলেও চলে তবে রাতে খেতেই হবে। যেই না উঠবে ওমনিই ওকে কোলে তুলে নিলো তৌসিফ। আচমকা এমন হওয়াতে ভুত ভুত বলে চিল্লায় পৌষ। তৌসিফ ধমকে উঠে বললো,

— আরে আমি।

— নামান আমাকে অসভ্য লোক।

— কে অসভ্য তা না ই বললাম।

— নামান বলছি।

তৌসিফ নামালো রুমে নিয়ে। টেবিলে বসিয়ে বললো,

— খেয়ে ঘুমাও।

খাবার দেখে না করলো না পৌষ। চুপ করে খেয়ে নিলো। ক্ষুধা লাগাতে একটু বেশি ই খেলো। হাত ধুঁয়ে উঠে যেতে নিলেই তৌসিফ আটকে ধরলো। নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,

— পৌষরাত। কথা ছিলো শুনবে?

— না।

মুখের উপর এমন কথা আজ পর্যন্ত কেউ বলে নি তৌসিফ’কে। তৌসিফ পৌষ’র গালে হাত ছুঁয়ে কিছু বলতে নিলেই ওর হাত সরালো পৌষ। তৌসিফ পুণরায় সেই হাত ধরতেই পৌষ ঝটকা মে’রে সরিয়ে দিলো। এবার তৌসিফ যেন ক্ষেপলো কিছুটা। পৌষ’র গাল দুটো অল্প চেপে ধরে এগিয়ে আসতেই আচমকা পৌষ ওকে সজোরে ধাক্কা মে’রে দৌড়ে চলে গেল পাশের রুমে। দরজা লক করে এবার ছিটকিনি টাও তুলে দিলো। ওর চোখে এখনও ভাসছে আজকে তৌফিক তালুকদারের সেই নির্লিপ্ত চাহনি।

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here