#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#১১তম_পর্ব
“আমাদের ভাল ছাত্র শুনেছি শহর ছেড়ে পালিয়েছে। এই শহরেই থাকবে না সে। মানতে হবে অভ্র, তুই আসলেই বস। ঐ বইপোকাটাকে কি জব্দ না করলি, একেবারে পালিয়ে গেলো”
কথাটা কানে আসতেই ঐন্দ্রিলা থমকে গেলো। ঐন্দ্রিলার মনে হলো কেউ উত্তপ্ত শিশা তার কেনে ঢেলে দিয়েছে। কি নিদারুণ যন্ত্রণা। হৃদয় ভাঙ্গনের যন্ত্রণায় দগ্ধ সে। ফলে এই যন্ত্রণা সৃষ্টিকারীর চক্রান্ত সম্মুখে আসায় আর শান্ত থাকতে পারলো না। ঐন্দ্রিলা শক্ত হয়ে গেলো। অভ্রের হাসিমুখখানা দেখে হৃদয় দহন ক্ষোভ তীব্র হলো। ফাকা ক্লাসে তখন অভ্র এবং তার বন্ধুরা। কি নির্লজ্জভাবে হাসছে। বিল্লাল হাসতে হাসতে বললো,
“ভালো মুখের আড়ালে কি চাপাবাজ ভাব…..”
বিল্লাল কথাটা শেষ করতে পারলো না তার আগেই হনহন করে ক্লাসে প্রবেশ করলো ঐন্দ্রিলা। তার রুদ্রমূর্তি দেখে সকলের হাসি মিলিয়ে গেলো মুহূর্তেই। সবার মুখভাব খানিকটা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হলেও অভ্র নির্বিকার। হাই বেঞ্চের উপর বসে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। ঐন্দ্রিলা তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্ষুদ্ধ স্বরে শুধালো,
“সৌরভের নামে রটনা তুই ছড়িয়েছিস? তুই সবাইকে বলেছিস ও সেলসম্যানের জব করে”
বিল্লাল ব্যগ্র স্বরে বলল,
“ঐন্দ্রিলা তুমি ভুল বুঝছো”
“আমি তোমার সাথে কথা বলছি না বিল্লাল”
বিল্লাল আর কথা বলার সাহস পেলো না। ঐন্দ্রিলার চোখে ক্রোধের অগ্নি দাউদাউ করে জ্বলছে। সে অভ্রের মুখোমুখি হয়ে শ্রান্ত স্বরে বললো,
“তুই আসলে এতোটা জঘন্য কাজ করেছিস?”
অভ্র শান্ত কন্ঠে নির্লজ্জের মত বললো,
“আমি রটনা ছড়াই নি। যা সত্য তা সত্য। এখানে লুকানোর কি আছে? এখন সে যদি সত্যির ভয়ে কলেজ ছেড়ে পালায় আমার কি দোষ!”
অভ্রের কথাটায় হতভম্ব হয়ে গেলো। এতোটা দায়সারা ভাব সে কি করে দেখাচ্ছে। সত্য লুকানোর কিছু নেই, কিন্তু যদি কোনো সত্যের জন্য কারোর জীবনে অন্ধকার নেমে আসে সেই সত্যের থেকে মিথ্যের আড়ালে থাকাই কি শ্রেয় নয়। ঐন্দ্রিলা উত্তেজিত স্বরে শুধালো,
“কিন্তু কেনো? ও কি ক্ষতি করেছে তোর?”
“সেই কৈফিয়ত আমি তোকে দিবো না ঐন্দ্রিলা”
অভ্রের কন্ঠ উত্তেজনাহীন, ধীর, শীতল। তার দৃষ্টি কঠিন। ঐন্দ্রিলার হুট করে মনে হলো এই জগতের সবচেয়ে জঘন্য কোনো পুরুষের সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে। এতোকাল অভ্রের অসভ্যতা, বেয়াদবি সবকিছু সহ্য করেছে ঐন্দ্রিলা। খুব একটা গায়ে মাখায় নি। তাকে বিরক্ত লেগেছে, অপছন্দ করেছে। কিন্তু ঘৃণা করে নি। কারণ ঘৃণা এমন একটা বিষয় যা হুট করেই করা যায় না। অনেক গভীর তাৎপর্য আছে এই ঘৃণা নামক শব্দে। কাউকে ঘৃণা করার জন্য অনেক কারণ প্রয়োজন হয়। কিন্তু ঐন্দ্রিলা ভুল ছিলো তার সকল চিন্তাধারা মুহূর্তেই ভুল হয়ে গেলো। অভ্র খুব স্বাভাবিক ভাবে বসে আছে। তার কিছুই কিছু যায় আসে না। অথচ তার জন্য একটি ছেলের জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেলো। সামান্য অনুতাপ নেই এই ছেলের চোখে। কিন্তু অভ্র তো এমন ছিলো না। একই সাথে বড় হবার দরুন এতটুকু তো জানে ঐন্দ্রিলা। কারোর অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে কখনোই মজা করে না। তাহলে তো বিল্লাল বা প্রশান্তদের সাথে এতোটা ঘনিষ্টতা হতো না। হুট করেই স্মরণ হলো ঐন্দ্রিলার ডায়েরিটির কথা। মস্তিষ্কের কোষের মাঝে প্রবল রেষারেষি হলো। অবিশ্বাস্য স্বরে বললো,
“আমি ওকে পছন্দ করি বলেই কি তুই ওকে টার্গেট করেছিস? আমার সাথে তোর শত্রুতা আছে জানতাম। কিন্তু সেই শত্রুতার জন্য এতোটা নিচে নামবি কল্পনাও করি নি। তোর একবার বিবেকে বাধলো না? তোর জন্য একটা ছেলেকে পরীক্ষার কিছুদিন আগে কলেজ বদলাতে হলো। আরে শত্রুতা তোর আমার সাথে, ওকে কেনো টার্গেট করলি? আমার ভাবতেই গা গুলাচ্ছে। বমি পাচ্ছে। এতোটা হীন মনমানসিকতা তোর?”
ঐন্দ্রিলার চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো। ডুকরে কান্না পেলো। হৃদয় দগ্ধ হচ্ছে ঘৃণায়। অভ্র এবার নড়ে চড়ে বসলো। মেঘমন্দ্র স্বরে বললো,
“হ্যা, আমি এমন ই। কিছু করার নেই। আমি ভালো সাজার নাটক করতে পারি না। আমার মনে যা, বাহিরেও তাই। তোর ওই সৌরভের মত চাপাবাজি আমার দ্বারা হয় না। যদি তোর মনে হয় আমি হীন মানসিকতার। তবে তাই। যা খুশি ভাবতে পারিস। এখন সিনক্রিয়েট বন্ধ কর প্লিজ, ক্রিঞ্জ লাগছে। একটা ছোটলোকের জন্য”
কথাটা শেষ হবার আগেই লম্বাটে শ্যাম গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো ঐন্দ্রিলা। রুদ্র স্বরে বললো,
“ঘৃণা শব্দটা অনেক কঠিন মনে হতো, তবে তোর জন্য জানলাম মনে অসীম ঘৃণা জন্মানোর জন্য একটা মুহূর্তই যথেষ্ট”
বলেই ক্লাসরুম ছাড়লো ঐন্দ্রিলা। আর কোনো কথা শোনার ইচ্ছে তার হলো না। অভ্রের মুখশ্রী দেখার ইচ্ছেও হলো না। সেদিন এক আকাশ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাসায় ফিরেছিলো ঐন্দ্রিলা। রাগ হলে সে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙ্গে। কিন্তু সেদিন তেমন কিছু হয় নি। শুধু ঘরের দরজা বন্ধ রেখেছিলো। দিন পার হলেও সেই দরজা খুলে নি। অবশেষে দরজা ভাঙ্গান সালাম সাহেব। মেয়ে কেমন শান্ত, অসাড়, জড় পুতুলের মত হয়ে ছিলো। কোনো কথা বলে নি। কারণ শুধালেও উত্তর দেয় নি ঐন্দ্রিলা। অভ্রের ঘরের সাথে লাগোয়া জানালাটি বন্ধ করে দিলো। তিনদিন পর বাবার কাছে আবদার করলো,
“আমি কলেজ যাব না”
“তাহলে পরীক্ষা?”
“শুধু পরীক্ষাগুলোই দিতে যাব”
সালাম সাহেব এবং সাবেরা মেয়েকে জোর করলেন না। মেয়ের পরীক্ষা খুব ভালো হল না। একটা বছর কোথাও চান্স পেলো না। অবশেষে দ্বিতীয় বর্ষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। অতি ঘনিষ্ঠতার জন্য পিউও এক বছর বিরতি দিলো। এতো পড়ে কি হবে? সেদিনের ঐতিহাসিক ঝগড়ার পর থেকে অভ্রকে একেবারে এড়িয়ে চলতে লাগলো। সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসা মিয়ে গেলো, অনুভূতি ম্লান হলো। সেই সাথে ম্লান হলো ঘৃণা। তাইতো পাঁচবছর পর আবারো তার সাথে মুখোমুখি হলো। অভ্র তার কলেজের সামনে মারামারি না করলে বোধহয় এমনটা হত না। এড়িয়ে তো চলছিলো ঐন্দ্রিলা। নিজের উপর তীব্র রাগ হল ঐন্দ্রিলা। তার ঘৃণা এতোটা ঠুংকো? বাহিরে দরজা সজোরে ধাক্কাচ্ছেন সালাম সাহেব। ঐন্দ্রিলা ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গেলো। দরজা খুললো। খুব শান্ত স্বরে বললো,
“আমি ঠিক আছে বাবা”
সালাম সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়ের মুখখানা মলিন লাগছে। চোখজোড়া ফুলে আছে। তিনি ঐন্দ্রিলার মাথায় হাত রেখে বললো,
“তোমার কি মন খারাপ মা?”
“না বাবা, আমার মন খারাপ না”
স্পষ্ট মিথ্যে কথা। এই মিথ্যে কথাটা বলতে বলতে ঐন্দ্রিলার অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সালাম সাহেব মেয়ের মাথায় আদুরে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
“মন খারাপ করবে না। আমি বাদশাহকে বলে দিবো। ও তোমার ঘরের ভাঙ্গা জিনিসগুলো পরিষ্কার করে দিবে।“
“আচ্ছা। মা কোথায় বাবা? খুব দরকারি কথা আছে”
*****************
সাবেরা তার ভেজা কাপড়গুলো মেলছিলো বারান্দায়। ধরনীর বিষন্নতা কেটে মুঠো মুঠো রোদ হাসছে তার বুকে। বৃষ্টির জন্য যে কাপড়গুলো ভিজে গেছে যেগুলো শুকাতে হবে। হ্যাপিদের খাওয়া শেষ। সে খাওয়ার সময় বারবার ঐন্দ্রিলার ঘরের দিকে তাকাচ্ছিলো, ব্যঙ্গ করে বলছিলো,
“ভাবি, ভাতিজী আমার এখনো আগের মত রাগী। দেখো শ্বশুরবাড়ির লোক ফিরিয়ে না দিয়ে যায়”
“সেটা নিয়ে তোমার চিন্তা না করলেও হবে। আমি কি মরে গেছি? আমার মেয়েকে বের করে দিবে আর আমি দেখবো? আমি ওদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবো”
সালাম সাহেব বোনের কথার প্রেক্ষিতে উত্তর দিলেন। হ্যাপি অভিযোগের সুরে বলল,
“ভাইজান শুধু আমাকে ভুল বুঝেন। আমি তো ভাতিজীর জন্য চিন্তা করি বলেই বলছি”
সাবেরা প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলল,
“হ্যাপি, তুমি চিন্তা কর না। তোমার ভাতিজী সে। তুমি যেহেতু সংসার করতে পেরেছো সেও পারবে। আর না পারলে তো তোমাদের বংশের বদনাম হবে”
হ্যাপির মুখখানা আবার চুপসে গেলো। তার বর মাংসের বাটি এগিয়ে বলল,
“তুমি কথা বেশি বল, খাও। খাইলে মাথা ঠান্ডা থাকবে”
হ্যাপি ক্ষণিকের জন্য শান্ত হয়েছে। কিন্তু বড় ননদ শাহানা আসলে গল্প পালটে যাবে। সাবেরার চিন্তা হয়। ঐন্দ্রিলা খুব অনুভূতিকাতর মেয়ে। মানুষকে অতি সহজে বিশ্বাস করার রোগ আছে তার। অতিরিক্ত বিশ্বাস করে হৃদয় ভেঙ্গে গেলে কান্নাকাটি করে, রাগ দেখায় নির্জীব বস্তুর উপর। মেয়েটিকে নিয়ে তাই খুব ই চিন্তা হয় সাবেরার। অভ্রকে তার মনে ধরেছে। সে চায় একটা এমন মানুষের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে যার মাঝে কপটতা নেই। অভ্রের মাঝে অন্তত কপটতা লক্ষ হয় নি। তাই বিয়েটা হোক তিনি চান। তবে মেয়ের মনোস্থিতি বুঝতে পারছেন না। মা মেয়ের নিকটতম বান্ধবী। কথাটা ঠিক কতটা সত্য সাবেরার জানা নেই। কারণ ঐন্দ্রিলার বান্ধবী সে আদোপি কখনো হতে পারে নি। মেয়ের প্রতি তার ভালোবাসা হয়তো পরিমাপ করা যাবে না। কিন্তু স্বভাবের দিক থেকে উভয়ই একই হওয়ায় কোথাও না কোথাও একটি অভেদ্য দেওয়াল আছে। সাবেরা নিজ থেকে সেই দেওয়াল ভাঙ্গতে কখনো আগ্রহী ছিলেন না। মেয়েও মায়ের মত তাই সেও দেওয়াল ভাঙ্গে নি। তাই তাদের সম্পর্ক সর্বদা রুক্ষ্ণ। বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেও সম্পর্কটা আগের মত ম্লানই আছে। মাঝে যাও একটু স্বস্তি পেয়েছিলেন। আজ পাচ্ছেন না। সাবেরা হাতে কাপড় নিয়ে বেখেয়ালি চিন্তায় মগ্ন যখন তখন ঐন্দ্রিলার চিকন গলা কানে আসে,
“মা, বিয়েটা আমি করবো না”
সাবেরা ভ্রু কুঞ্চিত করে মেয়ের দিকে তাকায়। গম্ভীর স্বরে বলেন,
“কারণ?”
“আমি অভ্র পছন্দ করি না, এটা কি কারণ নয়?”
“খুব নগণ্য কারণ”
“কি? এটা নগণ্য লাগছে?”
“হ্যা, লাগছে”
সাবেরার কথায় ঐন্দ্রিলা কঠিন মুখে তাকিয়ে আছে। সাবেরা তাকে অবলোকন করলেন। তারপর শান্ত স্বরে বললেন,
“তুমি কি পছন্দ কর ঐন্দ্রিলা?”
মায়ের কথায় বিমুঢ় চাইলো ঐন্দ্রিলা। কি উত্তর দেওয়া উচিত। হ্যা, সে তো পছন্দ করতো। কিন্তু অনুভূতিগুলো কি এতোকাল সজীব আছে? তার থেকে বড় কথা, যাকে পছন্দ করে, সে কি এখনো তাকে পছন্দ করে? ঐন্দ্রিলাকে চুপ করে থাকতে দেখে সাবেরা কঠিন স্বরে বলে,
“মেহমানরা আসতে শুরু করেছে ঐন্দ্রিলা। আশা করি তুমি সেই ব্যাপারটা মাথায় রাখবে। তুমি যেমন চাচ্ছো, সব তেমন হচ্ছে। কাননের মত শ্বাশুড়ি তুমি আতশ কাঁচ দিয়ে খুঁজলেও পাবে না। অহেতুক জেদ করো না। বিয়েটা এত ছেলেখেলা নয়। আজ বললে, কাল বললে হ্যা”
“আমি প্রথম থেকেই না করেছি”
“কিন্তু যুতসই কারণ তো দেখাও নি। এখন আমার মাথা খেও না। ঘরের অবস্থা তো বারোটা বাজিয়েছো। যাও আরো|ও পাঁচটা শো পিচ ভাংগো। ভালো লাগবে। তারপর ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমাও। তোমার ঘুমের প্রয়োজন।“
মায়ের কথায় ব্যথিত হলো ঐন্দ্রিলা। কাতর স্বরে বললো,
“আমি তোমার বোঝা মা?”
“তোমার বেশি বোঝার বাতিকটা এবার ছাড়ো ঐন্দ্রিলা”
ঐন্দ্রিলা দাঁড়ালো না। তীব্র অভিমান নিয়ে মায়ের ঘর ছাড়লো।
***************
সকালের রোদের তেজটা ম্লান। তবুও সালাম সাহেবের মস্তিষ্কের পারদ থার্মোমিটারের পারদ ভেঙ্গে ফেলতে যথেষ্ট। তিনি রাগে কিটমিট করছেন। তার শানিত দৃষ্টি বাড়ির পূর্বের মোটা বটবৃক্ষের উপর। নিচে কাঠের স্তুপ জমা। উপরে মিস্ত্রী দিয়ে কিছু একটা বানানো হচ্ছে। নীলাদ্রি নির্বিকার ভাবে একটা বই এ মুখ গুজে রয়েছে। সালাম সাহেব গজগজ করে বললেন,
“এটা কি?”
নীলাদ্রি মুখ তুলে চাইলো। খুব স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“সেটাকে ট্রি হাউস অর্থাৎ বৃক্ষ বাড়ি বলে। ছিঃ বাবা তুমি এতোটুকু জানো না”
“ছোট গাধা আমি জানি এটা ট্রি হাউস বলে কিন্তু এতা বানানোর হেতু কি?”
“আমি চিন্তা করেছি যেহেতু তুমি আমার ঘর অযাচিত ভাবে ছলনা করে হস্তক্ষেপ করেছো সেহেতু এই গাছের উপর ই আমি বাড়ি বানাবো। এখানেই থাকবো। আজ থেকে আমি নীলাদ্রি মজুমদার না, নীলাদ্রি দি বৃক্ষমানব”
গতকাল তীব্র বৃষ্টিতে কোনো মিস্ত্রী পাওয়া যায় নি। নীলাদ্রি থেকেছিলো বাদশাহর সাথে। সে হার মানতে শিখে নি। অত্যন্ত গোয়ার বাবার কাছে তো একেবারেই না। এর মাঝেই পিউ আসলো বাড়ি। সালাম সাহেবকে সালাম দিলো। সালাম সাহেব সালামের উত্তর দিলেন। পিউ তার রাগে রক্তিম মুখ থেকে বললো,
“আংকেল কিছু হয়েছে? “
“আমার গাধা পুত্রের জন্মের পর কিছুই হয় নি মা। ওই যে দেখো রোদে গা শুকাচ্ছে গাধাটা। সে নাকি এখন বৃক্ষমানব হবে। আমার মনে হয় প্রেসারটা বাড়ছে। আমার এখন ঠান্ডা পানি খেতে হবে। এখন ই”
বলেই একা একা বকবক করতে করতে ভেতরে চলে গেলো সে। পিউ ধীর পায়ে নীলাদ্রির কাছে গেলো। মিষ্টি করে বলল,
“নীলাদ্রি ভাই, ভালো আছেন?”
নীলাদ্রি তার বই থেকে মুখ তুললো। অসম্ভব চমৎকার হাসি দিয়ে বললো,
“পিউ”
পিউ এর মনে হলো তার নামটি এতোটা সুন্দর করে বোধ হয় কেউ ডাকতেই পারে না। হৃদয়ে অদ্ভুত শান্তি অনুভূত হলো। নীলাদ্রি নরম স্বরে বলল,
“আমি ভালো আছি, তুমি ভালো আছো?”
“জি, আপনি কবে এলেন”
“এই তো কালকে”
“এখানে কি হচ্ছে?”
“আমার ঘর তৈরি হচ্ছে। এখন থেকে আমি গাছে থাকবো। আমার ঘর শত্রুপক্ষ দখল করে ফেলেছে। ঘরটা তৈরি হলে তুমি এসো। আমার হাতের প্যাকেট কফি খাওয়াবো। আসলে কফিটা আগ থেকে প্রস্তুত করা। আমি শুধু গুলিয়ে তোমাকে দিব”
পিউ হাসলো। এই বোকারামের প্রতি এতো মায়া কেন হচ্ছে? আশ্চর্য। নীলাদ্রি একটু থেমে বলল,
“তোমার বান্ধবীর মাথার সমস্যাটা আবার দেখা গেছে। গতকাল ভাঙচুর করেছে খুব। তুমি বরং ওকে একটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। আমার মনে হয় ওর মাথার ব্যাধিটা ছোয়াচে। তোমার হয়ে গেলে বিপদ”
“কেনো?”
নীলাদ্রি উত্তর দিলো না। মিটিমিটি হাসলো। পিউ উত্তর চাইলোও না। তার জানা দরকার বান্ধবীর মস্তিষ্কের এখনের অবস্থা।
***********
অভ্র অন্যমনষ্ক হয়ে বসে আছে। তার সামনে হাজারো কাজ কিন্তু সে করছে না। শুধু ভুল হচ্ছে তার কাজে। সামান্য যোগেও তার ভুল। কোথাও একটা বিশ্রী উদাসীনতা, শুন্যতা। বিল্লাল তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ছেলেটি একগুয়ে স্বভাব তাকে বিরক্ত করছে। ফলে হিনহিনে স্বরে বলল,
“ঐন্দ্রিলাকে সত্যিটা বলে দিলেই তো হয়”
অভ্র ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকাল তার দিকে। অবুঝের মত বললো,
“কোন সত্য?”
“যে সত্যের জন্য তোদের এত মারামারি কাটাকাটি”
“কাজ কর না। নাক খাড়া বলে, সবার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাবি এটা ঠিক নয়”
“তুমি আমাকে ঠিক বেঠিক শিখাতে এসো না। অভ্র, তোদের বিয়ে হচ্ছে। আর কয়টা দিন বাকি? রাত পোহালেই হলুদ”
অভ্র চুপ করে রইলো। বিল্লালের মেজাজ খারাপ হলো। বিরক্তি নিয়ে বললো,
“সারাজীবন কারোর ভালোবাসা না পেলেও আফসোস নেই, তবে কারোর ঘৃণার পাত্র হয়ে থাকিস না। এখন বুঝছিস না। কিন্তু একটা সময় পাগলের লাগবে।“
বলেই বিল্লাল বেড়িয়ে গেলো। অভ্র তাকিয়ে রইলো রেজিস্টারের দিকে।
***************
বাসা থেকে বেশ দূরের একটি রেস্টুরেন্টে বসে রয়েছে ঐন্দ্রিলার। অপেক্ষা একজনের। এই অপেক্ষাটা সে পাঁচ বছর আগেও করেছিলো। কে বলেছে অনুভূতিরা ম্লান হয়। ম্লান হলে কি একটা ম্যাসেজের প্রেক্ষিতে ছুটে আসে কেউ? ঐন্দ্রিলার সামনে কোল্ড কফি। খেতে ইচ্ছে করছে না। শুধু নাড়াচড়া করছে সে। ঠিক তখনই গাঢ় স্বর কানে এলো,
“অনেকক্ষণ অপেক্ষা করালাম?”
ঐন্দ্রিলা মাথা তুলে তাকালো। সৌরভের সেই স্নিগ্ধময় হাসি। ঐন্দ্রিলা মাথা নাড়ালো। সৌরভ বসলো ঠিক তার বিপরীতে। একটা কোল্ড কফি আর স্যান্ডুইজ অর্ডার করলো। খাবার আসলে স্যান্ডুইজটা এগিয়ে দিলো ঐন্দ্রিলার দিকে। ঐন্দ্রিলা নরম স্বরে বলল,
“খাবো না”
“তা বললে হয়, এই প্রথম আমার সাথে বেরিয়েছো তুমি?”
ঐন্দ্রিলা তাকিয়ে রইলো তার দিকে। সৌরভ ম্লান স্বরে বলল,
“আমি এখনো তোমায় ভালোবাসি ঐন্দ্রিলা”……………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি