মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ #১৪তম_পর্ব

0
144

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#১৪তম_পর্ব

কথা শেষ হবার আগেই সজোরে ঘুষির আঘাতে ছিটকে পড়লো সৌরভ। আকস্মিক ঘটনায় আপনাআপনি দুহাতে মুখ আটকে ধরলো ঐন্দ্রিলা। সৌরভের নাক থেকে গলগল করে রক্ত পড়লো। চোখ তুলে তাকাতেই দেখলো রুদ্রমূর্তি হয়ে অভ্র দাঁড়িয়ে আছে। তার চোয়াল কঠিন। চোখজোড়া জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড। সৌরভ কিছুটা সময় বেক্কলের মত চেয়ে রইলো। ঘটনার বিস্ময় কাটতে সময় নিলো তার মস্তিষ্ক। কিন্তু অভ্র তো অভ্র সেই সময়টুকুও দিলও না। তার আগেই তার কলার ধরে টেনে তুললো। আরোও একটা ঘুষি দিল। এই ঘুষিতে বোধহয় সৌরভের দাঁত নড়ে গেছে। থুথুর সাথে বেরিয়ে এলো একদলা রক্ত। অভ্রর তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বরং চাপা স্বরে রাগমিশ্রিত কন্ঠে বললো,
“বলেছিলাম তোকে, বলেছিলাম আমার পুতুলের থেকে দূরে থাক। আমার সাথে টেক্কা দিবি সামনাসামনি দে। কাপুরুষের মত অন্যকে কেন ব্যাবহার করবি”

আহত বাঘের মত গর্জালো যেন অভ্র। সৌরভের ঘাড় নুয়ে আছে তবুও তার তেজ কমলো না। শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আঘাত করলো সে অভ্রকে। ফলে দুকদম পেছনে ছিটকে পড়লো সে। সৌরভ ক্রুর হাসি হেসে বললো,
“তুই যতই চেষ্টা কর, তোর পুতুল তোর নয়। দেখ কিভাবে তোকে ছেড়ে নাচতে নাচতে চলে এসেছে। তুই হেরে গেছিস অভ্র। হেরে গেছিস। তুই চাইলে সবাইকে আয়ত্ত করতে পারবি না”

সৌরভের হাসির বিস্তৃতি বিষের মতো ঠেকলো যেন। নব্বই কেজি ওজনের মানুষটার শরীরে যেন হিংস্র পাশবিকতা ভর করলো। ফলে সংযমহীম ভাবে তেড়ে গেলো সে সৌরভের দিকে। অন্তরের জ্বলন্ত কুন্ড শান্ত করার জন্য যতটা হিংস্রতা প্রয়োজন ততটা হিংস্র হলো সে। একটা সময় লুটিয়ে পড়লো সৌরভ। আঘাতের পর আঘাতে নেতিয়ে পড়লো। অভ্র তাকে অবহেলায় ফেলে দিল মাটিতে। তার রাগের অগ্নি শান্ত হলো না। ক্রোধিত নয়ন এবার চাইলো একপাশে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কমলাশাড়ি পরিহিত মেয়েটার দিকে। প্রায় তেড়ে এসে গর্জন করে উঠলো,
“শান্তি হয়েছে তোর? ভালোবাসা ভালোবাসা নাটক কি শেষ হইছে নাকি আরোও বাকি আছে? আমার মানসম্মান ডুবিয়ে শান্তি হয়েছে? নাকি আরোও বাকি আছে। কি হলো উত্তর দিস না কেন?”

বলেই ডান হাতে নরম গালজোড়া চেপে ধরলো সে। শক্ত, রুক্ষ্ণ হাতের চাপে দাগ পড়ে গেলো মেয়েটির গালে। কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না। শুধু শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এই দৃষ্টিতে কোনো আকাঙ্খা নেই, আক্ষেপ নেই, অভিমান নেই; কেবল শূন্যতা। নিগূঢ় শূন্যতা। হৃদয় ভাঙ্গার শব্দটা কেউ শুনলো না। রাগী, জেদি মেয়েটার অন্তরটা পুড়ে গেলো কেউ টের পেলো না। কেউ দেখলো না এতোকাল সযত্নে আগলে রাখা প্রণয়কুড়িটা যে খসে গেছে। মরে গেছে বিশ্বাসের বটবৃক্ষ। কই কেউ তো মাতম করলো না। কেউ তো কাঁদলো না। অভ্র কিছুসময় তাকিয়ে রইলো সেই শুন্যতায়। নিজের প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কিছুই দেখলো না। সামান্য বল প্রয়োগ করে ছেড়ে দিল ঐন্দ্রিলার গাল। ঐন্দ্রিলা একটা শব্দ করলো না। অভ্রের রাগ আবার বৃদ্ধি পেলো। আবার প্রহার করলো সৌরভকে। এর মধ্যেই পুলিশ নিয়ে হাজির হলেন সালাম সাহেব। সাথে বিল্লাল। সালাম সাহেব অফিসারকে বললেন,
“লাফাঙ্গাটা এরেস্ট করুন অফিসার”

******

পুরোনো থানা। দেওয়াল থেকে চুন খসে পড়ছে। পুরোনো ফ্যানটা শব্দ করে ঘুরছে। থানার এস.আই আয়েশ করে মুখে পান গুজছেন। অভ্র থানায় কারাবন্দি। লকাপের লোহার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হাত ফুলে গেছে। চামড়া চিরে রক্ত বেরিয়েছে। তা অযত্নে শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে। ঠোঁটের কাছটায় হালকা আঁচড় লেগেছে। শ্বশুরের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে সে। তার ক্ষুদ্ধ চাহনীতে সালাম সাহেব শুকনো ঢোক গিললেন। তারপর বোকা হেসে বললেন,
“ব্যাপার না আমিও তোমার শ্বাশুড়ির জন্য জেলে গেছি। এখন তোমাকে আমার যোগ্য মেয়ে জামাই মনে হচ্ছে”
“আপনাদের বাবা-মেয়ের কামকাজে তো মনে হচ্ছে না আদৌ আমি আপনার মেয়ে জামাই হব। মেয়ে পালাবে, আর শ্বশুর আমাকে জেলে বন্দি করবে”

সালাম সাহেব একটু লজ্জিত হলেন। শিকের ভেতর থেকে হাত ঢুকিয়ে কাঁধে হাত রেখে বললো,
“বাবা, চিন্তা কইরো না। আমি লয়ারকে ফোন করেছি এখন ই সব ঠিক হয়ে যাবে”

এস.আই এর সামনে বসে রয়েছে সৌরভ এবং ঐন্দ্রিলা। সৌরভের একটা দাঁত ভেঙ্গে গেছে। নাক ভাঙ্গা। রক্ত পড়ছে। সেখানে টিস্যু ঢুকিয়ে রেখেছে। মাথা উপরে করে রেখেছে। মুখ থেকে চেনার উপায় নেই। ঐন্দ্রিলার শুন্য দৃষ্টি। এস.আই পান চাবাতে চাবাতে বললো,
“কাহিনী কি ম্যাডাম?”

সৌরভ সাথে সাথেই বললো,
“আমাকে মেরে মুখ নাকের নকশা পালটে দিয়েছে অফিসার। আর কি কাহিনী শুনতে চান?”
“না আমার বউ নিয়ে পালাবি আর তোরে আমি চুমা খাবো”

বিল্লাল হাত জোর করে বলল,
“আব্বা আমার, ভাষা ঠিক কর”

এস.আই ধমকে উঠলো অভ্রকে,
“এই চিৎকার করবি না”
“আপনি আমার জামাইকে কেন ধমকাচ্ছেন? ও কি মিথ্যে বলেছে নাকি? আমার মেয়ে এই লম্পট কিডন্যাপ করেছে”

সালাম সাহেবের দিকে সূঁচালো দৃষ্টিতে তাকালো এস.আই। তার অভ্রের দিকে তাকিয়ে মুখ খিঁচিয়ে বললো,
“এই আতরাঙ্গা আপনার জামাই?”

অভ্র মুখ শক্ত করে বলল,
“এই শেরওয়ানি আমার বউ এর পছন্দ”

এস.আই এবার মাথা নাড়িয়ে ঐন্দ্রিলার দিকে তাকালো। শুধালো,
“ম্যাডাম কাহিনী কি বলুন। এই ছেলে আসলেই আপনাকে কিডন্যাপ করেছে?”

সৌরভ সাথে সাথেই আকুতিময় স্বরে বললো,
“ঐন্দ্রিলা সত্যিটা বলো। তুমি নিজে আমার কাছে এসেছো বলো। তুমি তো দেখেছো অভ্র কি করে আমাকে বেহরমের মতো মেরেছে। আমার চাকরি আছে, সংসার আছে। তুমি মিথ্যে বলো না”

ঐন্দ্রিলা তাকিয়ে রইলো সৌরভের দিকে। একটা মানুষ কতটা স্বার্থপর এবং আত্মকেন্দ্রিক হতে পারে না। ছেলেটির মাঝে বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই, আত্মগ্লানি নেই। সে এখনো নিজেকে সঠিক বলে মানছে। ভাবছে সে যা করেছে তা উপযুক্ত। ঐন্দ্রিলার নিজের উপর বিদ্রুপ করে হাসলো। সে এই ছেলেটির জন্য আকুল হয়েছে, কেঁদেছে। ঐন্দ্রিলার কাছে মনে হলো পৃথিবীতে ভালোবাসা নেই। বিশ্বাস নেই। সব মিথ্যে। সবাই স্বার্থপর। নিঃস্বার্থ বলে কোনো শব্দ নেই। ঐন্দ্রিলার ভেতরের কালবৈশাখী প্রবল রুপধারণ করলেও চোখ ক্লান্ত, শুষ্ক। কারণ কেউ গলা টিপে হত্যা করেছে তার সেই নিষ্পাপ অনুভূতিগুলোকে। ঐন্দ্রিলা ধীর স্বরে বলল,
“জি, এই ছেলেটা আমাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছে”

নিষ্ঠুর মিথ্যে কথা। কিন্তু এই মিথ্যে বলতে কষ্ট হলো না ঐন্দ্রিলার। সৌরভ অস্থির হয়ে বললো,
“তুমি মিথ্যে কেন বলছো?”
“কেনো মিথ্যে বলার ঠেকা কি শুধু তোমার?”

ঐন্দ্রিলার বিদ্রুপে অবাক হলো সৌরভ। এস.আই তাকে ধমক দিয়ে ঐন্দ্রিলাকে শুধালো,
“কি চান আপনি? কি করবো আমরা?”
“সেটা আপনারা জানেন”

ঠিক সেই সময়ে বিল্লাল উকিল নিয়ে উপস্থিত হলো। ঐন্দ্রিলা উঠে বেরিয়ে গেলো থানা থেকে। থমথম পরিবেশ। বাতাস নেই। দমবন্ধ লাগছে। কাদলে হয়তো মনটা হালকা হত কিন্তু কান্না আসছে না। ভেতরে কি হলো জানা নেই। তবে মিনিট বিশেকের মধ্যে ছাড়া পেলো অভ্র। সৌরভকেও কিছু করা হলো না বোধ হয়। কারণ খোড়াতে খোড়াতে সেও বের হলো। ঐন্দ্রিলা সেদিকে তাকালো না। সে তাকিয়ে রইলো বিষন্ন আকাশের দিকে।

সৌরভের হাতে মেডিসিন আর হরলিক্সের বোতল ধরিয়ে দিল অভ্র। তারপর ঘাড়টা ধরে নিজের কাছে নিয়ে হিনহিনে স্বরে বললো,
“আজকের মত ছেড়ে দিলাম তোকে। আর কখনো আমার পুতুলের ধারে কাছেও ঘেষবি না। আমার পুতুলের সাথে খেলার অধিকার শুধু আমার”

বলেই ছেড়ে দিল সে সৌরভকে। অভ্রের দিকে রাগী দৃষ্টিবান ছুড়লেও লাভ হলো না।

বিল্লাল এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো ঐন্দ্রিলার পাশে। ঐন্দ্রিলা তখনো শান্ত। নড়লো না, সরলো না। বিল্লাল শান্ত স্বরে বললো,
“তুমি এতো বুদ্ধিমতী হয়ে এত বোকার মত কাজ করলে কি করে? ভাগ্যিস সৌরভের কোনো অন্য মতলব ছিলো না। নয়তো কোথায় খুজতাম তোমাকে আমরা? ভাগ্যিস তোমার সাথে তোলা সেলফি ও কিছু কলেজের বন্ধুদের পাঠিয়েছে। তারাই অভ্রকে ছবিটা পাঠিয়েছে। তাইতো ও ছুটে এসেছে”
“তোমরা সবাই জানতে?”

ঐন্দ্রিলার প্রশ্ন বুঝতে পারলো বিল্লাল। হেসে বললো,
“হ্যা। জানতাম। আমি তোমাকে অনেকবার বলতেও চেয়েছি। তুমি শুনতে চাও নি। সৌরভকে তুমি যেমন দেখেছো তাই বিশ্বাস করেছো। সৌরভ কখনোই তোমাকে ভালোবাসে নি। ওর টার্গেট ছিলো অভ্রকে হারানো। তুমি ওর জন্য সেই সোনার হরিণ ছিলে যাকে দিয়ে অভ্রকে বধ করা যায়। বিশ্বাস করা বা ভালোবাসা ভুল না। কিন্তু অন্ধ বিশ্বাস করাটা খারাপ। আমাদের জানার বাহিরে অনেককিছু থাকে। তুমি কতটা দেখেছিলে তাকে। পাঁচ ঘন্টা, ছয় ঘন্টা। তার বাহিরে সে কেমন তা কিন্তু তুমি জানতে না। যাকে গে, বাদ দাও। যা গেছে তা গেছে। এবার এগুলো ধরো”

বলেই কিছু ঔষধ আর মলম হাতে ধরালো ঐন্দ্রিলার। তারপর বলল,
“পাগলটার হাতের অবস্থা খুব খারাপ। কিন্তু আমি বললে মোটেই ড্রেসিং করাবে না। বলবে পুরুষ মানুষের এসব লাগে না। কিন্তু তুমি বললে শুনবে”
“কেনো? আমি কে?”

ঐন্দ্রিলার শীতল প্রশ্নে হাসলো বিল্লাল। তারপর বললো,
“এই উত্তর হয়তো ওই পাগলের কাছেও নেই। তবে আমি জানি তুমি বললে শুনবে।“

বিল্লাল চলে গেলো। ঐন্দ্রিলা দাঁড়িয়ে রইলো ঠায়। তার দৃষ্টি হাতের জিনিসগুলোর দিকে। একটু পর অভ্র এলো। ব্যস্ত গলায় বলল,
“ডেকেছিস কেন, বিল্লাল বললো তোর আমার সাথে কথা আছে। সৌরভ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলবো না। যা করেছি বেশ করেছি। ওকে খু ন করিনি তোর ভাগ্য ভালো”

ঐন্দ্রিলা অলস ভঙ্গিতে একটা বেঞ্চে বসলো। তারপর ক্লান্ত স্বরে বললো,
“আমার সামনে বয়”

অভ্র ভ্রু কুচকালো, চোখ ছোট করলো। কিন্তু একটু পর বসলো ঠিকই। ঐন্দ্রিলা তার হাতটা নিজের হাতে নিলো। হাতের অবস্থা খুবই সূচনীয়। ফুলে গেছে। মধ্যঙ্গুলিটা একটু বেঁকে গেছে। সব রাগ এই হাত দিয়ে উজার করেছে। ঐন্দ্রিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডেটল ভেজালো তুলোয়। নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে দুজনের মাঝে। বাতাস থমকে আছে। রাতের আকাশে আলোর ছিটেফোঁটা নেই। শুধু জ্বলছে থানার বাহিরের একটি দুশো বিশ ভোল্টের লাইট। ঐন্দ্রিলা অভ্রর হাতে ডেটল লাগাতেই সে “সসস” করে উঠলো। ঐন্দ্রিলা তখন ফু দিল হাতে। কোনো কথা নেই। অভ্রের দৃষ্টি তার দিকেই। মেয়েটার চোখ ম্লান। অনেকক্ষণ পর বাম হাতে ঐন্দ্রিলার মাথাটা টেনে বুকের সাথে মিশালো। হঠাৎ প্রশস্ত বুকের উষ্ণতায় হৃদয়ের বিষাদপাথরগুলো গলতে লাগলো যেন। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো বিষাদসিন্ধুর জলধারা…………….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here