#আঁধারে_প্রণয়কাব্য
#পর্ব____৮
#নিশাত_জাহান_নিশি
“ঐ কা’লনাগিনী মেয়েটা আমার ছেলের মাথাটা খেয়েছে! তাকে যদি পেতাম কষে দুইটা থাপ্পর দিতাম!”
__________________________
“রাই কোথায় ফায়েয? রাই আসেনি?”
বিষণ্ন ও বিষাক্ত কণ্ঠে সাদিদ প্রশ্ন ছুড়ল ড্রাইভিংয়ে মনোনিবেশ করা ফায়েযের দিকে। এয়ারপোর্টে পৌঁছার পর থেকেই সাদিদ অস্থির ও উচাটন দৃষ্টিতে কেবল এদিক ওদিক তাকিয়ে রাইকেই খুঁজছিল। এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার পর ফায়েযের পাশে রাইকে দেখতে না পেয়ে সাদিদ ভেবেছিল ফায়েয হয়ত সাদিদকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য রাইকে গাড়িতে রেখে এসেছে! ফায়েয প্রতিবারই বিভিন্নভাবে সারপ্রাইজ দেয় ফায়েযকে।
সেই আশা ও প্রত্যাশা নিয়ে সাদিদ গাড়িতে ওঠেও নিরাশ হলো। একবুক যন্ত্রণা নিয়ে অতঃপর সে ফায়েযের দিকে প্রশ্ন ছুড়তে বাধ্য হলো। ফায়েয নিশ্চুপ ও নির্বিকার। প্রত্যুত্তর করার মত কোনো উপযুক্ত উত্তর নেই তার কাছে। তবে এই খুশির মুহূর্তে সাদিদের মনোক্ষুণ্ণ করতে চাইলনা ফায়েয। বাহানা খুঁজতে লাগল সে। অবশেষে ফায়েয শুকনো হেসে আমতা আমতা করে বলল,
“আপুর শরীরটা একটু খারাপ জিজু তাই আসতে পারেনি। তুমি চিল থাকো, এত ব্যাস্ত হয়ো না। বাড়ি গেলে তো দেখা হবেই।”
সাদিদ রুক্ষ হাসল। বিক্ষিপ্ত শ্বাস ফেলে মাথা নুইয়ে নিলো। আচমকা চোখ ওঠিয়ে ফায়েযের উদগ্রীব মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“শরীর খারাপ যদি কোনো বাহানা হয়ে থাকে তবে নির্বিঘ্নে বলে দে আমায়। মিথ্যা শান্তনা আমার ভালো লাগেনা আর। রাই আমাকে পিক করতে আসেনি এটা আমি স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিব। যেমনটা গত কয়েকমাস ধরে মেনে নিচ্ছি। মূলত মানিয়ে নিচ্ছি। কেননা, বিয়ের প্রথম বছর রাই আমার প্রতি এতটা উদাসীন ছিলনা, তাই তার এই হঠাৎ পরিবর্তন আমাকে ভাবালেও শুধরে যাবে বলে সেই আশায় আছি।”
ফায়েয নিগূঢ় দৃষ্টিতে পাশ ফিরে ভুক্তভোগী সাদিদের দিকে তাকালো। সাদিদ জোরপূর্বক হাসল। কণ্ঠে স্বাভাবিকতা এনে বলল,
“মিথ্যা বলতে পারিসনা যখন মিথ্যা বলতে যাস কেন? আচ্ছা বাদ দে, আজ আমি খুব এক্সাইটেড। দীর্ঘ দুই বছর পর। ভাবতে পারছিস? দীর্ঘ দুইবছর পর রাইয়ের সাথে আমার সামনাসামনি দেখা হবে। রাইও নিশ্চয়ই আমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে।”
সাদিদের হাসিখুশি মুখ ও প্রবল উচ্ছ্বাসের আড়ালে ঢেকে যাওয়া করুন বিরহ ও গাঢ়-গভীর আঘাতের ছাপ ফায়েয বেশ সূক্ষ্মভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে। সাদিদের দুঃখটা ফায়েয বেশ কাছ থেকেই অনুভব করতে পারছে। রাইয়ের ওপর ক্ষোভ জমিয়ে ফায়েয ভেতরে ভেতরে আঙার হতে লাগল! রাগে রঙিন হয়ে ওঠে বিড়বিড় করে বলল,
“যদি সম্ভব হত আমি তোমাকে গলা টি’পে খু*ন করে ফেলতাম আপু! শুধু তুমি আমার বোন বলে বার বার আটকে যাচ্ছি। একটা ছেলে সব সহ্য করতে পারে আপু তবে বিশ্বাসঘাতকতা নয়!”
দীর্ঘ আধঘণ্টা জার্নির পর অবশেষে ফায়েয গাড়ি নিয়ে তাদের গন্তব্যে ফিরল। সাদিদ ও ফায়েয গাড়ি থেকে নামল। গাড়ির পেছনের সিট ও গাড়ির ডিক্কি পর্যন্ত সুটকেস ভর্তি কেবল রাইয়ের পছন্দের ব্র্যান্ডের সাজগোজের সামগ্রী, বিভিন্ন ওয়েস্টার্ন ড্রেস, শাড়ি, চকলেটস ও স্বর্ণ গহনা! কোনোকিছুর কমতি রাখেনি সাদিদ। রাইয়ের চাহিদার উর্ধ্বেও তার চিন্তাভাবনা। এমন স্বামী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সাদিদের এহেন উন্মাদনা দেখে ফায়েয হতবাক হয়ে গেল। বারংবার তাকে একটা বিষয়ই ভাবাচ্ছিল, “এই মোমের মত নরম ও পরিষ্কার মনের মানুষটিকে অবহেলা করে রাই কিভাবে পরকীয়ায় জড়ালো? বিবেকে বাঁধলনা তার? বুকটা একবারও কাঁপলনা তার?” রাইয়ের বোকামীর কথা ভেবে ফায়েয ঠাট্টার হাসি হাসল। একই মায়ের পেটের দুই ভাই-বোন তারা। অথচ দুজনের মধ্যে কত পার্থক্য!
সাদিদ পাগলামী জুড়ে দিলো। বাড়ির আঙিনায় দাড়িয়ে থেকেই সাদিদ চিৎকার করে রাইকে উৎফুল্ল গলায় ডেকে বলল,
“রাই? কোথায় তুমি? আমি এসে গেছি। প্লিজ একবার দর্শন দিয়ে আমার চোখ দুটোকে শান্ত করো।”
সাদিদের কণ্ঠস্বর পেয়ে মালিহা চৌধুরী ছুটে গেলেন রাইয়ের রুমে। ঘুমে মগ্ন রাই! সাদিদ এলো কি না এলো এতে কোনো হেলদোল নেই তার। মালিহা চৌধুরী তড়িঘড়ি করে রাইকে ঘুম থেকে ডেকে ওঠালেন। হুলুস্থুল গলায় বললেন,
“সাদিদ ডাকছে তোকে। নিচে যা।”
ঘুমে চোখ টেনে মেলতে পারছেনা রাই। বসা থেকে ওঠে বার বার হেলেদুলে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। ঘুম ঘুম আবেশে অস্ফুটে গলায় তার মাকে বলল,
“সাদিদ এসেছে তো আমি কি করব মা? আমাকে এভাবে ঘুম থেকে ডেকে ওঠালে কেন? জানোনা আমি রাতে অনেক লেইট করে ঘুমাই?”
মালিহা চৌধুরী কপাল কুঁচকে নিলেন। রাইয়ের মাথায় গাড্ডা মেরে রি রি করে বললেন,
“এত বড়ো হয়ে গেছিস অথচ এখনও স্বামী সংসার চিনলি না? কবে তোর ঘটে একটু বুদ্ধি হবে বল তো? তোকে নিয়ে আমি আর পারলাম না।”
রাই ঘুমে টালমাটাল হয়ে পুনরায় বিছানায় শুয়ে পরল! মালিহা চৌধুরী বিরক্ত হয়ে ফোঁস করে শ্বাস ফেললেন। তবুও মেয়েকে কোনো প্রকার শাসন করলেন না! সাদিদ অনেকক্ষণ যাবত বাড়ির আঙিনায় দাড়িয়ে রাইয়ের রুমের বেলকনিতে উচ্ছ্বসিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিল। শেষ অবধি রাইয়ের দেখা না পেয়ে সাদিদ মনমরা হয়ে গেল। ফায়েয পরিস্থিতি সামলে নেয়ার দায়িত্ব নিলো! হেঁটে এসে সাদিদের কাঁধে হাত রেখে রসিক গলায় বলল,
“মন খারাপ করোনা জিজু। আপু নিশ্চয়ই আটা, ময়দা মাখতে ব্যাস্ত। তুমিতো জানোই জিজু আপু সাজগোজ কতটা ভালোবাসে। তুমি এখানে একটু দাঁড়াও। আমি আপুকে ডেকে নিয়ে আসছি।”
সাদিদ কিছু বলার পূর্বেই ফায়েয দৌঁড়ে চলে গেল রাইয়ের রুমে। রাইকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে ফায়েযের মাথায় রক্ত ওঠে গেল। রাইকে জাস্ট মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছিল তার। কোনোদিকে কালক্ষেপণ না করে ফায়েয গড়গড় করে এক বোতল পানি রাইয়ের গাঁয়ে ঢেলে দিলো! রাই ঘুম থেকে আঁতকে ওঠল। ফায়েয দাঁতে দাঁতে চেপে বেকুব হয়ে বসে থাকা রাইকে শাসিয়ে বলল,
“স্টু’পিট কোথাকার। তোমার যদি জিজুকে এতই অপছন্দ হয় কিংবা পরকীয়া করে তুমি এতই শান্তি পাও তবে জিজুকে ডিভোর্স দিয়ে দাও! তবুও একটা ছেলের সাথে সম্পর্কে থেকে, তাকে আশায় রেখে তার জীবনটাকে এভাবে নষ্ট করে দিওনা।”
রাই রাগে কটমট করে ওঠল। সমস্ত শরীর তার কাকভেজা হয়ে গেল। এই ভেজা অবস্থাতেই বসা থেকে দাড়িয়ে সে চোয়াল উঁচিয়ে ফায়েযকে বলল,
“আপন বোনের চেয়ে বাইরের একটা ছেলের প্রতি টান বেশি তোর? সাদিদের পক্ষ নিয়ে তুই আমাকে এভাবে হেনস্তা করতে পারলি? আবার ডিভোর্সের কথাও বলছিস?”
“প্রথমত আমি কারো পক্ষে নই আপু। যার অন্যায় তার বিপক্ষে আমি। দ্বিতীয়ত, দুই নৌকোয় পা দিয়ে চলার চেয়ে নৌকা একটা বেছে নাও এটাই তোমার জন্য ভালো হবে। জোর করে জিজুর সাথে সংসার করার কোনো প্রয়োজন নেই তোমার। আর তোমার নওশাদকে আমি দেখে নিব! সামনে পরলেই তার চোখ দুটো আমি উপড়ে ফেলব। আমি কতটা জালিয়াত তা নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে?”
রাই নত হয়ে এলো। নওশাদকে মারার হুমকি দেয়াতে সে সম্পূর্ণ নরম হয়ে গেল। কোমল স্বরে ফায়েযকে বলল,
“নওশাদকে কিছু করবিনা তুই। আমি সাদিদের সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করব!”
রাই ওয়াশরুমে গেল। ফায়েয রুম থেকে বের হয়ে রাইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ফ্রেশ হয়ে রাই নাইট ড্রেস পাল্টে নীল রঙের একটি শাড়ি পড়ে রুম থেকে বের হতেই ফায়েয রাইকে নিয়ে বাড়ির আঙিনায় চলে এলো। রাইকে এক পলক দেখামাত্রই সাদিদ থমকে গেল। তার সকল খারাপ লাগা, দুঃখ, কষ্ট, অভিমান ও অভিযোগ সব নিমিষেই দূর হয়ে গেল। চোখ দুটিতে খুশির অশ্রু চিকচিক করে ওঠল। ঠোঁটের কোণে ফুরফুরা হাসি ফুটে ওঠল। আবেগী হয়ে দু-হাত বাড়িয়ে সে রাইকে কাছে ডাকল। রাই জোরপূর্বক হেসে বাধ্য হয়ে সাদিদকে জড়িয়ে ধরল। ফায়েয পিছু ঘুরে নিলো। কপাল ঘঁষতে ঘঁষতে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,
“এভাবে কতদিন আমি হুমকি দিয়ে জিজুর সাথে আপুর সংসারটা টিকিয়ে রাখব? একদিন না একদিন তো জিজু সত্যিটা জানতে পারবেই। তখন কি হবে? পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিব আমি?”
রাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে দিন দুনিয়া ভুলে গেল সাদিদ। ভেতরটায় সুখ সুখ অনুভব হতে লাগল। রাইয়ের প্রতি পুষে রাখা সমস্ত রাগ রাইয়ের ছোঁয়ায় গলে যেতে লাগল। দীর্ঘ দুইবছর ধরে এই শান্তির জায়গাটিকেই প্রচন্ড পরিমাণে মিস করছিল সাদিদ। পক্ষান্তরে, রাই বিরক্ত হচ্ছিল। ভীষণ বিরক্তবোধ করছিল। হাঁসফাঁস করা গলায় সে বিড়বিড় করে বলল,
“ধ্যাত, এই ক্রিঞ্জ লোকটা যে কবে আবার ফ্রান্সে ফিরে যাবে! এই কয়েকদিন তো আমি নওশাদের সাথেও যোগাযোগ করতে পারবনা। কি যে হবে! নওশাদকে ছাড়া কিভাবে থাকব আমি? তাকে ছাড়া তো আমার একমুহূর্তও চলেনা।”
______________________
সানামের হলের সামনে গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষারত ফায়েয। বেশ অনেকক্ষণ যাবত সানামকে অনর্গল কল করেও সানামের খোঁজ খবর পাচ্ছিলনা সে। অস্থির হয়ে ওঠে ফায়েয গাড়ি থেকে নেমে হলের গেইটের ভেতরে প্রবেশের পূর্বেই আচমকা দূরদৃষ্টি পরল তার সানামের রুমের ছোটো বেলকনিটির দিকে। সদ্য গোসল করে সানাম মাথায় টাওয়াল প্যাচিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে দঁড়িতে কাপড় মেলে দিচ্ছে। ফায়েয ব্যাস্ত হয়ে সানামকে ডাকার পূর্বেই সানাম তার কাজ শেষ করে রুমে ঢুকে গেল। ফ্রিজ খুলে দেখল কেবল দুটো ডিমই পরে আছে ফ্রিজে। অথচ পেটে সাংঘাতিক ক্ষুধা তার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সানাম বলল,
“কি খাব এখন? শুধু ডিম পোজ?”
পার্স ঘেটে সানাম হিসাব কষে দেখল তার বেতনের বারো হাজার টাকার মধ্যে সাত হাজার টাকাই ধার দেনাতে চলে যাবে আর বাকি পাঁচ হাজার টাকা চলে যাবে মাসের বাজার খরচে। কিন্তু এইমাসটা কোনো রকমে চলে গেলেও পরবর্তী মাসগুলোতে সে কি করবে? আর্জেন্ট চাকরীর বেশ প্রয়োজন তার। আজ থেকেই চাকরী খোঁজার অন্বেষনে নেমে পরতে হবে তাকে। এসব ভাবতে ভাবতেই তার রুমের দরজায় টোকা পরল। সানাম গলা ছেড়ে বলল,
“কে?”
“আমি সাজিয়া বলছি। তোর জন্য নিচে কেউ অপেক্ষা করছে। যা দেখা করে আয়।”
সানাম কপাল কুঁচকালো। গভীর চিন্তায় ডুবে বলল,
“আমার সাথে আবার কে দেখা করতে এলো? আতিফ নয় তো? নিশ্চয়ই ধারের টাকা চাইতে এসেছে।”
মাথায় টাওয়াল প্যাচিয়েই সানাম নিচে চলে গেল। গেইটের ভেতরে পায়চারি করতে থাকা ফায়েযকে দেখে সানাম তাড়াহুড়ো করে মাথা থেকে টাওয়াল খুলে চুলগুলো ঝেড়ে নিলো। মাথায় বড়ো ঘোমটা টেনে ফায়েযের দিকে হেঁটে গেল। সানামকে দেখে ফায়েয থামল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সানামের দিকে তাকালো। রুক্ষ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“ফোন কোথায় আপনার? বেচে দিয়েছেন নাকি চুরি হয়ে গেছে?”
সানাম অবাক গলায় বলল,
“হঠাৎ আমার ফোনের পেছনে পরলেন কেন?”
“সকাল থেকে আপনাকে কতবার কল করেছি কোনো আইডিয়া আছে আপনার?”
“উঁহু। আমিতো ফোন ধরিইনি। তাই বলতে পারছিনা।”
সানামের আলাভোলা মুখের দিকে তাকিয়ে ফায়েয প্রসঙ্গ বাড়ালোনা। রাগ নিমিষেই ক্ষান্ত হয়ে এলো তার। গাল টেনে দিতে ইচ্ছে করলেও সেই ইচ্ছেকে লোহার পিন মেরে দমিয়ে রাখল! নির্জীব গলায় বলল,
“রেডি হয়ে আসুন।”
“কেন? কোথায় যাব আমরা?”
“আমি যেখানে নিয়ে যাব সেখানেই যাবেন। কেন আমার ওপর ট্রাস্ট নেই?”
পলকবিহীন দৃষ্টিতে সানাম ফায়েযের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখে না বললেও চোখের ইশারায় বুঝালো বিশ্বাস আছে! চোখ নামিয়ে সানাম মিহি কণ্ঠে বলল,
“একটু ওয়েট করুন। আমি রেডি হয়ে আসছি।”
সানাম প্রস্থান নিলো। ফায়েয হল গেইট থেকে বের হয়ে সোজা গাড়িতে ওঠে বসল। হলের প্রত্যেকটা মেয়ে সানামের দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মিটিমিটি হেসে তাকে কৌশলে ক্ষেপাচ্ছিল। তবে সাহস পাচ্ছিলনা তার সামনে এসে কিছু বলার। সানাম এসব টিপ্পনী অগ্রাহ্য করে তার রুমে ফিরে গেল। বার বার শ্রেতার রুমের দিকেই নজর পড়ে তার। এই প্রথম শ্রেতা সানামকে কিছু না বলে না জানিয়ে কোথাও গেল। এই নিয়ে সানামের আক্ষেপের কমতি নেই।
আজ নীল চুড়িদার পরল সানাম। ভেজা চুলগুলো দুমড়ে মোচড়ে সে খোঁপা বেঁধে নিলো। মাথায় ঘোমটা টেনে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। যেতে যেতে সানাম শ্রেতার বয়ফ্রেন্ড তাওহীদের নাম্বারে অনেকগুলো মিসড কল দিলো। কলটি বারবার বন্ধ আসছিল। সানাম বিরক্ত বোধ করল। নাক ফুলিয়ে বলল,
“হানিমুনে গেলেও তো নতুন কপোত-কপোতীরা তাদের ফোন বন্ধ করে রাখেনা। বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড হয়ে তারা যেভাবে ফোন বন্ধ করে রেখেছে।”
ফায়েযের গাড়িতে ওঠে বসল সানাম। ফায়েয চোখ থেকে চশমা খুলল। সরাসরি সানামের দিকে না তাকিয়ে বরং সে লুকিং গ্লাসের সাহায্যে সানামের দিকে তাকালো। সিট বেল্ট বাঁধতে ব্যাস্ত সানাম। অমনোযোগী সানামের দিকে ফায়েয শক্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“চোখে এই বিশাল সমুদ্র নিয়ে ঘুরে বেড়ান কিভাবে আপনি?”
সানাম ভড়কে ওঠে ফায়াযের দিকে তাকালো। পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,
“আপনার কথার মানে বুঝলাম না।”
“চোখ ফোলা কেন? রাতে জেগে কেঁদেকেটে নিশ্চয়ই দিনের বেলায় ঘুমের কারণে অফিসে ঠিক টাইমে পৌঁছাতে পারেন না?”
সানাম মাথা নুইয়ে নিলো। বিষণ্ন গলায় বলল,
“এখন তো চাকরীটাও চলে গেল।”
“বাহ্ গ্রেট নিউজ। তাহলে এবার বাড়ি ফিরে যান!”
আপাদমস্তক গরম হয়ে গেল সানামের! প্রসঙ্গ পাল্টে ক্ষিপ্ত গলায় বলল,
“অনামিকার সাথে আর কথা হয়েছে আপনার?”
ফায়েয বুঝতে পারল সানাম এখনও তার পরিবারের প্রতি অসন্তুষ্ট। তাই প্রসঙ্গ বাড়ালো না সে। গাড়ি ছেড়ে দিলো ফায়েয। নীরব কণ্ঠে বলল,
“অনামিকার সাথেই দেখা করতে যাচ্ছি।”
মিনিট পাঁচেক দুজনের মধ্যে নীরবতা বিরাজ করল। সানামের খোঁপা করা ভেজা চুল থেকে ভেসে আসা মিষ্টি ঘ্রাণ ক্রমাগত ফায়েযের নাকে শুরশুরি দিচ্ছিল! ফায়েযের অনুভূতিকে বিরক্ত করছিল সেই ঘ্রাণ। চোখ খোলার পর এই মিষ্টি ঘ্রাণটা আরও তীব্রতর হবে বলে ফায়েয আচমকা রুক্ষ গলায় সানামকে বলে ওঠল,
“চুলটা খুলুন।”
সানাম থতমত খেয়ে ওঠল। কপালে ঘাম জমে গেল তার। মনে হলো বিশাল ভয় পেয়েছে সে। বুকে থুঃ থুঃ ছিটিয়ে সানাম ফায়েযের দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকালো। ফায়েয পাশ ফিরে সানামের দিকে তাকিয়ে তাজ্জব হয়ে গেল। হটকারি গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“ভয় পেয়েছেন আপনি?”
সানামের গাঁ থরথর করে কাঁপতে লাগল। গাঁয়ের সমস্ত লোম শিউরে ওঠল। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। কিছু বলতে গিয়েও বার বার থেমে যাচ্ছিল। বেশ পালপিটিশান হতে লাগল তার। ফায়েয উদ্বিগ্ন হয়ে গাড়িটি রাস্তার একপাশে দাড় করালো। উত্তেজিত হয়ে সানামের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“কি হয়েছে সানাম? এমন করছেন কেন আপনি?”
সানাম কাঁপা কাঁপা হাতে তার পার্স ব্যাগ থেকে একটি খাবার ট্যাবলেট বের করল। ফায়েয তড়িঘড়ি করে পানির বোতলটি সানামের দিকে এগিয়ে দিলো। ট্যাবলেটটি খেয়ে সানাম গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বসল। চোখ জোড়া বুজে ধীর কণ্ঠে ফায়েযকে বলল,
“প্যানিক অ্যাটাক।”
ফায়েযের চোখেমুখে গভীর শোক। মনে মেঘ জমে এলো তার। নিজেকে অসহায় অনুভব হতে লাগল। চোখের সামনে তার প্রিয় মানুষটা নিস্তেজ হয়ে গেল। কতটা মানসিক আঘাত পেলে মানুষ প্যানিক অ্যাটাকের শিকার হয়। যদি অধিকার থাকত তবে ফায়েয এখনি বেশ শক্ত করে সানামকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরত। সানামের সব কষ্ট সে নিমিষেই ভুলিয়ে দিতো! এই দায়িত্বটা আদো ফায়েয কখনও নিতে পারবে কিনা সেই বিষয়ে ফায়েয যথেষ্ট সন্দিহান। তবে ফায়েয ভেবে নিলো সানামের সাথে সে আর কখনও ধমকের স্বরে কথা বলবেনা।
_________________________
“তাওহীদের” সাথে আজ কফি ডেটে যাবে সিফরা। দুই পরিবারের সবারই মত আছে এতে। আজ দ্বিতীয় বারের মতো তাওহীদের সাথে দেখা হবে তার। মনে যদিও শান্তি নেই তার তবে পরিবারের দিকে চেয়ে মানিয়ে নিতে হবে! গাঁয়ে টাওয়াল জড়িয়ে রুমে প্রবেশ করল সিফরা। ওয়াশরুমে জামা কাপড় পাল্টাতে পারেনা সে। জামা হালকা ভিজে গেলে সেই জামাটি পরতে পারেনা সে। টাওয়ালটি খুলে বিছানার ওপর রাখা লাল রঙের কুর্তীটি সে হাতে নিতেই আচমকা দরোজা ঠেলে সিফরার ছোটো চাচা রায়হান সিফরার রুমে ঢুকে পরল! সিফরা চিৎকার করে কুর্তীটা গাঁয়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“চাচা আপনি নক না করে আমার রুমে ঢুকলেন কেন? এক্ষুণি আমার রুম থেকে বের হয়ে যান।”
রায়হানের বিন্দুমাত্র অনুতাপ বোধ নেই। সিফরার দিক থেকে সে চোখটাও সরালো না! বরং হা করে সিফরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“সমস্যা কি? আমিতো তোর বাবার মতই!”
#চলবে_____?