#হৃদয়হরণী
#পর্ব:১৬
#তানিশা সুলতানা
গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ গুলো প্রতিনিয়ত ভেতরে ভেতরে গুমরে মরে। তারা তাদের মনোভাব কারো সামনে প্রকাশ করতে পারে না। নিজের কষ্ট আনন্দ ভালো লাগা খারাপ লাগা কাউকে বোঝাতে পারে না বলেই তাদের ভেতরে সারাক্ষণ রক্তক্ষরণ হয়৷ পাওয়া না পাওয়ার হিসেব গুলো একা একাই সমাধান করতে হয়। সাদি হচ্ছে সেই প্রকৃতির মানুষ।
কখনো একটু অসুস্থ হলে বাসার কাউকে বলে নি। সারা রাত জ্বরে পুরেছে তবুও কখনো মাকে বা অন্য কাউকে ডাকে নি।
একবার সাদির পা ভেঙেছিলো। দুইদিন ভাঙা পা নিয়ে নিজের রুমে পড়ে ছিলো। কাউকে বলে নি তার সমস্যার কথ। এটা অবশ্য খুব ছোট বেলায়। তখন সাদি ক্লাস এইট এ পড়তো।
সাদি এমনিতেই সারাদিন রুমে থাকে বলে কেউ তাকে দেখতে আসে নি৷ সাবিনা বাড়িতে ছিলো না। তিনি থাকলে অবশ্যই দিনে কয়েকবার আসতো সাদিকে দেখতে। তো পরের দিন সাবিনা বেগম কি মনে করে যেনো বাড়িতে ফিরেই সাদির রুমে আসে আর দেখতে পায় তার ছেলে পা ধরে কাতরাচ্ছে। জ্বরে শরীর পুরে যাচ্ছে। চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিলেন তিনি। হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিলো।
আজ ওবদি জানা যায় নি কিভাবে সাদির পা ভেঙেছিলো।
পাশাপাশি দুটো রুম। পাশের রুম থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আসছে। রাত বারোটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট।
সাদি ছোঁয়ার রুম থেকে বেরিয়েছে এগারোটা নাগাদ।
ইডিয়েট টা এখন পর্যন্ত কেঁদেই চলেছে। সাদি জানে যতখন সে গিয়ে কাঁদতে মানা করবে না ততখন পর্যন্ত কেঁদেই যাবে
সাদি ইচ্ছে করেই যাচ্ছে না। মেয়েটা দিন দিন অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। ভীষণ বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে কানে হেডফোন গুঁজে নেয় সাদি। হৃদয় কাঁপছে তার। হার্টবিট দ্রুত লাফাচ্ছে। অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু কেনো? হৃদয়হরণীকে দুঃখ দেওয়ার জন্য? তাকে আঘাত করাতে নিজের হৃদয়টা জ্বলছে?
__
নতুন ভোর নতুন দিনের সূচনা।
সকালের ফুরফুরে হাওয়া পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর মনমাতানো পরিষ্কার আকাশ। মন ভালো করতে সক্ষম।
সাদি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে রান্না চাপায়। এসএসসির পর থেকে সে পরিবার থেকে দূরে থেকেছে সেই সুবাদে রান্না থেকে শুরু করে ঘর মোছা সব কাজে পারদর্শী সে।
পরোটা ডিম ভাজা করলা ভাজা ডিম সিদ্ধ ব্যাস সাদির রান্না শেষ।
সে নিজের মতো অফিসের জন্য তৈরি হয়ে খেয়ে চলে যায়। ছোঁয়ার খোঁজ নেয় না।
প্রচন্ড কান্না করে ঘুমানোর ফলে ভালো ঘুম হয়েছে ছোঁয়ার। ঘুম ভাঙতেই আড়মোড়া ভেঙে উঠে দেখে দশটা বেজে গেছে। তারাহুরো করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। এ বাবা রান্না করতে হবে তো। নাহলে সাদি খাবে কি?
ফ্রেশ হয়ে কিচেনে গিয়ে দেখে ভাত তরকারি পর্যন্ত রান্না করে রেখে গেছে সাদি। ছোঁয়া ঠোঁট কামড়ে হাসে
“বাহহহ আনরোমান্টিক জামাই হলে কি হবে? কাজ করতে জানে।
যাকক আমার আর কষ্ট করতে হবে না। আমি বাচ্চাদের বড় করবো আর উনি রান্নাবান্না করবো।
ভাবতে ভাবতে ছোঁয়া দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। আর বাচ্চাকাচ্চা। যে লেভেলের নিরামিষ জীবনে একটা চুমু খাবে কি না এতেও সন্দেহ। বাচ্চাকাচ্চার কথা ভাবা তো বিলাসিতা। চুমুহীন জীবন পার করতে হবে।
হতাশার শ্বাস ফেলে ছোঁয়া খেতে বসে যায়। এক গ্লাস দুধ হরলিক্স দিয়ে গুলে রাখা একটা সিদ্ধ ডিম আর একটা পরোটার মধ্যে ডিম শশা অল্প পেঁয়াজ দিয়ে রোল বানানো তা আবার কাগজ দিয়ে মুরে রেখেছে। ছোঁয়া খেতে শুরু করে। খেতে খেতেই কলিং বেল বেজে ওঠে। দুধ টুকু এখনো খাওয়া বাকি। এক চুমুকে দুধ শেষ করে দরজা খুলে। একটা মধ্যবয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। ছোঁয়া তাকে সালাম দেয়। মহিলাটি সালাম ফিরিয়ে পরিচয় দেয় তিনি এই বাসার মালিক। ছোঁয়াদের সামনের ফ্লাইটে থাকে।
ছোঁয়া তাকে ভেতরে আসতে বলে। মহিলাটি আসে। সোফায় বসে ছোঁয়াও বসে মহিলাটির পাশে।
” তা মেয়ে বিয়ে করেছো নাক ফুল কোথায় তোমার?
“আর আন্টি বলো না আমি তো নাকই ফুঁটো করি নি।
” নাক ফুল হলো বিবাহিত মেয়ের চিহ্ন। আর স্বামীর মঙ্গল অমঙ্গলের এতো বেপার এই নাক ফুল।
“আপনি নাক ফুটো করতে পারেন?
” বোকা মেয়ে এখন তো পার্লার থেকেই নাক ফুঁটো করা যায়।
“আমাকে নিয়ে যাবেন আন্টি?
” ঠিক আছে। এখুনি চলো।
“কিন্তু আন্টি এখন তো আমার কাছে টাকা নেই।
” লাগবে না। একশত টাকা নিবে। আমি নাহয় দিয়ে দিবো। তুমি পরে আমায় ফেরত দিও।
ছোঁয়া খুশি হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
“ঠিক আছে
পরনের জামা পাল্টে চুল গুলো পরিপাটি করে ছোঁয়া মহিলাটির সাথে বেরিয়ে পড়ে। মহিলার নাম রুণা। ভীষণ শৌখিন মহিলা। কথায় কথায় জানতে পারে ওনার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে অনার্সে পড়ছে আর মেয়ে ছোঁয়ার সেম ইয়ার।
এবং দুজন একই কলেজের। ছোঁয়া মনে মনে খুশি হয়। যাক এক সাথে যেতে পারবে কলেজে।
ভীষণ নাজুক প্রকৃতির মেয়ে ছোঁয়া। একটুতেই তার শরীর খারাপ হয়। এই যে পার্লার থেকে নাক ফুঁটো করেছে। ইয়া মোটা একটা নাক ফুল ঢুকিয়ে দিয়েছে নাকে। ভীষণ ব্যাথা করছে তার।
কিন্তু প্রকাশ করছে না।
বাড়ির নিচেই ছিলো পার্লার।
ছোঁয়া এবার বাসায় ফিরে শুয়ে পড়ে। নাকের ব্যাথায় জ্বর আসবে মনে হচ্ছে। এমনিতেই রাতে কেঁদেছে গলা ব্যাথা হয়ে আছে।
আজ প্রথমদিন হওয়াতে সাদিকে একটু তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দেয়। এখানে কাজ করে ভালো লেগেছে সাদির। অফিসের বস এবং কলিগরা খুবই ভালো এবং রুচিশীল। তার থেকে বেশি ভালো লাগার বিষয় হলো সাদির একটা মেয়ে বন্ধু যার সাথে প্রায় ছোট থেকেই বেরে উঠেছে ইরা সেও এখানেই জব করে। এবং দুজন একই ডিপার্টমেন্টে।
ছুটির পরে একটা রেস্টুরেন্টে বসেছে সাদি এবং ইরা। ইরা ছোট থেকেই প্রচন্ড কথা বলে। এখনো তার ব্যতিক্রম নয়৷ এটা ওটা বলেই যাচ্ছে। সাদি শুধু শুনছে। ইরার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে সাদি হাতে গোণা কয়েকটা কথা বলেছে আর ইরা বলেই যাচ্ছে বলেই যাচ্ছে।
সাদি মনে মনে বলে “বাড়িতে এক ইডিয়েট এখানে আরেক ইডিয়েট ”
“সাদি মহুয়ার সাথে দেখা হয়েছিলো। তার ডিভোর্স হয়ে গেছে।
সাদি খাওয়ায় মনোযোগ দিয়েছে। ইরার কথা শুনলেও কোনো প্রতিক্রিয়া করে না। ইরাও আর দ্বিতীয় বার বলে না
” তোর বউয়ের সাথে দেখা করাবি না? পাপন বললো ভীষণ দুষ্টু না কি? তোকে নাকে দঁড়ি দিয়ে ঘুরায়।
বলেই শব্দ করে হেসে ওঠে ইরা।
“আজকেই চল
ইরা লাফিয়ে ওঠে। ইসস আজকেই যাবে? তারাহুরো করে খেতে থাকে সে। সাদির মত বদলানোর আগেই যেতে হবে।
নিজের কাছে থাকা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে সাদি। ইরাকে ইশারায় ছোঁয়ার রুম দেখিয়ে নিজের রুমে ঢুকে পড়ে।
ইরা এদিক ওদিক দেখতে দেখতে ছোঁয়ার রুমে ঢুকে। কম্বল মুড়িয়ে বিছানায় শুয়ে আছে ছোঁয়া।
রুমে কারো ঢোকার আওয়াজ পেয়ে চোখ না খুলেই বলে ওঠে
” এসেছেন? জলদি আমার নাকে পরপর কয়েকটা চুমু খেয়ে দিন তো। প্রচন্ড ব্যাথা করছে।
ইরা মুখ টিপে হাসে। পাপনের কথা সে বিশ্বাস করে নি৷ সাদির মতো গম্ভীর জোয়ান একটা ছেলেকে বাচ্চা একটা নাকানিচুবানি খাওয়াতে পারবে? এটা বিশ্বাস করার যোগ্য?
ইরা যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই বেরিয়ে যায়। সাদির রুমে ঢুকে পড়ে।
সাদি সবেই চেঞ্জ করে বেরিয়েছে।
“সাদি তোর বউ তোকে ডাকে। তার না কি চুমমমমমমমমু খেতে ইচ্ছে করছে।
দাঁত কেলিয়ে বলে ইরা। সাদি বিরক্ত হয়।
ইরার দিকে এক পলক তাকিয়ে বেরিয়ে যায়।
” অবেলায় শুয়ে আছো কেনো?
ছোঁয়া পিটপিট করে চোখ খুলে
“আমার নাকে ব্যাথা
ডাক্তার বলেছে সাদমান চৌধুরী চুমু খেলে সেরে যাবে।
রিনরিনিয়ে বলে ছোঁয়া।
” হাতেও ব্যাথা এখানেও চুমু প্রয়োজন। চুমুর অভাবে ব্যাথা সারছে না।
সাদি ফোঁস করে শ্বাস টানে৷ ইরা দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে শুনছিলো আর কিটকিট করে হাসছিলো। মেয়েটা ভারি মিষ্টি। বেশ মনে ধরেছে ইরার।
“ইরা এসেছে তোমার সাথে দেখা করতে। ফ্রেশ হয়ে এসো।
বলেই সাদি চলে যেতে নেয়
” আমার ব্যাথা না কমলে ফ্রেশ হবো কি করে? আপনি কি ব্রাশ করেন নি?
চলবে