#হৃদয়হরণী
#পর্ব:২
#তানিশা সুলতানা
জ্বলন্ত আগুন সব কিছুই পুরিয়ে ফেলছে। সাদির ছবিটার সব টুকুই প্রায় পুরে গেছে শুধু চোখ দুটো পুরে নি। ওই ওবদি আগুন এখনো পৌঁছায় নি৷ ছোঁয়া সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মায়ারাজার চোখ দুটো। এই ছবিটা আঁকড়ে বেঁচে আছে সে। প্রতিদিন ছবিটা দেখতে থাকতো। ছবিতে কতো শত চুমু খেয়েছে। বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে।
আর আজকে চোখের সামনেই ছবিটা ছাই হয়ে যাচ্ছে।
কলিজা কাঁপছে ছোঁয়ার। সাদির শার্টটা পুরে ছাই হয়ে গেছে। চকলেট বক্সে এখনো আগুন জ্বলছে।
সাদির চোখে যখন আগুন পৌঁছায় ছোঁয়া চিৎকার করে ওঠে। দুই হাতে চেপে ধরে জ্বলন্ত আগুনে।
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে ছোঁয়া। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। কলিজা ফেঁটে যাচ্ছে তার।
জীবন এতো কঠিন কেনো? ভালোবাসলে এতো কষ্ট পেতে হয় কেনো?
ছোঁয়ার চিৎকারে নাজমা বেগমের কলিজ কেঁপে ওঠে। তিনি ছোঁয়ার রুমের দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। মেয়েটা তার ভীষণ নাজুক স্বভাবের। একটু বেশিই চঞ্চল। কিন্তু আজকে কি হলো তার আদরের বাচ্চার? এরকম তো আগে কখনো হয় নি। আগে তো এমন করে নি৷ আজকে কি হলো?
তিনি কল করে তার স্বামী সেলিমকে। সেলিম অফিসের কাজে ব্যস্ত। ফোন ধরতে পারে না। তাই কল করে সাদিকে। সাদি তার বড় ভাসুরের ছেলে। একই বিল্ডিংয়ে ওপর নিচে থাকে তারা। সাদিকে অনেক করে রিকোয়েস্ট করার পরেও তাদের সাথে থাকে না। ৫ তালায় সাদি থাকে আর চার তালায় ছোঁয়ারা।
সেলিমের কাজের সূত্রে বই বাচ্চা নিয়ে ঢাকাতে থাকে তিন বছর হলো।
আর কাকতালীয় ভাবে সাদির ছোঁয়ার কলেজেই চাকরি হয়ে যায়।
সাদি কলেজ থেকে বের হয়ে কলেজের পাশের কফিশপে ঢুকে কফি খাচ্ছিলো। একটু ফাঁক পেলেই সে এখানে কফি খেতে চলে আসে। এই শপের কফি দারুণ লাগে তার।
সবেই কফির মগে ঠোঁট ছোঁয়াবে তখনই ফোন বেজে ওঠে। ফোনের স্কিনে কাকিমা নামটা দেখে কপালে তিনটে ভাজ পড়ে সাদির। বিরক্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। ছোঁয়া যে সব বলে দিয়েছে বুঝে যায় সে।
এবার কাকিমাকে কিছু কড়া কথা শোনানোর প্রস্তুতি নেয় সাদি। চোখ মুখ শক্ত করে কল রিসিভ করে। কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তখনই ভেসে আসে নাজমার কান্নার শব্দ
“আব্বা কোথায় তুমি? আমার ছোঁয়া কেমন করছে। তোমার চাচাকে ফোনে পাচ্ছি না।
এক মুহুর্তের জন্য থমকে যায় সাদি। কি হয়েছে ছোঁয়ার জিজ্ঞেস করতে গিয়েও গলায় কথা আটকে যায়। ফোনটা কেটে ওয়ালেট থেকে হাজার টাকার নোট বের করে কফির মগের নিচে রেখে তারাহুরো করে বেরিয়ে যায় কফিশপ থেকে।
ছোঁয়ার চিৎকার থেকে গেছে। স্থির হয়ে ফ্লোরে পড়ে গেছে সে।
সাদি আসতেই নাজমা বেগমের কান্নার আওয়াজ বেরে যায়।
” রিলাক্স কিচ্ছু হয় নি। আমি দেখছি
নাজমাকে শান্তনা দিয়ে বলে সাদি। তারপর পকেট থেকে এক্সট্রা চাবি বের করে দরজার লক খুলে।
নাজমা বেগম মেয়ের অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে। মেয়ের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নেয়। দুই হাতে ফোসকা পড়ে গেছে। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। সাদা কলেজ ড্রেসে ছাই লেগে আছে। কোমর সমান লম্বা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে।
সাদি মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার অর্ধেক পুরে যাওয়া চোখ দুটো দেখে চিনতে খুব বেশি সময় লাগে নি। চকলেট বক্স পুরোপুরি পুরে নি৷ এটা দেখেও সে চিনতে পেরেছে। কয়েকবছর আগে দিয়েছিলো ছোঁয়াকে। তখন তারা এক সাথে থাকতো।
পাগলামির মাত্রা এতোটা ছাড়িয়ে গেছে? এতোটা আশা করে নি সাদি। এই মেয়েটা তার জন্য এতো পাগল কবে হলো?
কই কখনো তো তাকে বিরক্ত করে নি। শুধু আশেপাশের মানুষদের থেকেই শুনে এসেছে সাদি।
বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে সাদির। এই শহরে আর নয়।
নাজমা বেগম সাদির সাহায্যে ছোঁয়াকে বিছানায় তোলে। সাদি শুধু একটু হাতটা ধরেছিলো।
ছোঁয়ার হাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় সাদি।
ডাক্তারকে কল করে বেরিয়ে যায় এই বাড়ি থেকে।
মাগরিবের আজানের সময় চোখ মেলে তাকায় ছোঁয়া। মাথার ওপরে সাদা দেয়ালটার দিকে বেশ কিছুখন তাকিয়ে থাকে। অনুভব করতে পারে তার মাথায় কারে হাতের অস্তিত্ব। ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে তাকাতেই দেখতে পায় বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে ছোঁয়ার।
হাত উঁচু করে বাবার হাতটা ধরতে যেতেই বুঝতে পারে তার হাতে ব্যান্ডেজ করা।
ছোঁয়াকে নরতে দেখে সেলিম মুচকি হেসে মেয়ের কপালে চুমু খায়।
“ভালো লাগছে মামনি?
” আমি এখনি এই শহর ছাড়তে চাই বাবা। এখানে থাকবো না আমি।
কারণ জানতে চায় না সেলিম। কারণ তিনি জানে হাজার বার জিজ্ঞেস করলেও তার মেয়ে কারণ বলবে না।
“মা পনেরো দিন পরে তো আমরা এমনিতেই যাবো।
” আমি এখুনি যাবো বাবা। এই মুহুর্তে যাবো। আর একটা ঘন্টাও এখানে থাকবো না আমি।
চিৎকার করে বলে ওঠে ছোঁয়া। চোখে পানি চলে এসেছে তার। সেলিম মেয়ের ব্যবহারে অবাক হয়।
গলা উঁচু করে কথা বলার সাহস পায় না তার মেয়ে। আর আজকে বাবার সামনে চিৎকার করছে?
ভয় করছে তার মেয়েকে দেখে। তবুও শান্ত গলায় বলে।
“ঠিক আছে। এখুনি যাবে তুমি।
আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
ছোঁয়া চোখ বন্ধ করে ফেলে। সেলিম চোখের পানি মুছিয়ে দেয়।
নাজমা খাবার নিয়ে চলে আসে।
সেলিম খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে বলে ওঠে
” খাবারটা শেষ করো। তারপর যাবো আমরা।
ছোঁয়া উঠে বসতে যায়। কিন্তু পারে না। নাজমা বেগম ধরে বসিয়ে দেয়।
সেলিম খাইয়ে দিতে থাকে।
আর তখনই ফোন করে সিফাতকে।
সিফাতের আসতে বেশি সময় লাগে না। নিজেদের গাড়ি থাকাতে দুই ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যায়।
বাবা মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে ছোঁয়া গাড়িতে বসে পড়ে। হাত দিয়ে কিছুই ধরতে পারছে না সে।
সিফাতও ওনাদের থেকে বিদেয় নিয়ে রওনা হয়।
ছোঁয়া ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ সিফাত গাড়ি থামিয়ে ফেলে। ছোঁয়া বিরক্ত হয়ে তাকায় সিফাতের দিকে
“কি হলো জিজু? থামলে কেনো?
সিফাত গাড়ির কাঁচ নামিয়ে ভালো করে দেখে বলে
” ওইটা সাদি না?
ছোঁয়া চমকে তাকায়। সত্যিই তো সাদি। ব্যাগ হাতে বাস স্ট্যান্ডে বসে আছে। বুক কেঁপে ওঠে ছোঁয়ার। এই লোকটার মুখোমুখি হবে না বলে প্রিয় শহর ছাড়ছে তবুও লোকটাকে দেখতে হলো?
“বোনু দুই মিনিট বস। আমি জাস্ট যাবো আর আসবো
বলেই সিফাত চলে যায়।
সাদির সামনে দাঁড়িয়ে বলে
” তুই এখানে?
সাদি সিফাতকে দেখে খুশি হলেও প্রকাশ করে না। ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে যায়
“বাড়ি ফিরছি। তোর গাড়ি কোথায়?
বলতে বলতে গাড়ির দিকে চলে আসে। সিফাত সাদির পেছন পেছন আসে। আর প্রশ্ন করে লাভ হবে না। কারণ সাদি জবাব দেবে না। তাই চুপচাপ থাকে।
সাদি গাড়ির পেছনের দরজা খুলে বসে পড়ে। ছোঁয়াকে সে খেয়াল করে নি।
চলবে