তবু_সুর_ফিরে_আসে ১২ তম পর্ব

0
187

#তবু_সুর_ফিরে_আসে

১২ তম পর্ব

ন‌ওশাদ ড্রাইভ করছে আর হেরা কে খেয়াল করছে ! কখনো কখনো উত্তেজনায় চোখ বন্ধ করে ফেলছে আবার খুলছে হেরা ! ন‌ওশাদ কুড়িল ফ্লাইওভার দিয়ে একবারে তিনশ ফিটের দিকে চলে গেল ! পূর্বাচল পর্যন্ত গিয়ে আবার গাড়ি ঘুরালো !
এখানে এত অন্ধকার কেন ?
আমরা ঢাকার বাহিরে চলে এসেছি !
এবার গাড়ি নিয়ে এয়ার পোর্ট রোডের দিকে গেল ! ফ্লাই ওভারের উপর একটু ধীরে ধীরে চালালো ! যেন হেরা দেখতে পারে !
এই রাস্তা টা আপনার ভালো লাগে ?
হুম !
সুন্দর !
বিকেল বেলায় খুব ভালো লাগে কেন জানি !
অনেক চ‌ওড়া রাস্তা টা !
হুম! চলো এখন তোমাকে ঢাকার ভেতর টা দেখাই!
অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে না , আপনি তো এই সময়ে ঘুমিয়ে যান অলরেডি !
আজ না হয় একটু রাত করেই ঘুমালাম ! তোমার ভালো লাগছে না হেরা ?
হুম খুব ভালো লাগছে !
তাহলে আর কি এই ভালো লাগা টুকুর জন্য এক রাত একটু দেরিতে ঘুমানো যায় ! তুমি ইচ্ছে করলে রুফটপ টা খুলে দাঁড়াতে ও পারো !
না বাবা আমার ভয় লাগছে এমনিতেই আপনি যে স্পীডে চালাচ্ছেন !
আমি খুব ভালো ড্রাইভ করি হেরা যদিও ইদানিং ড্রাইভ করা হয় না ! তুমি আমার উপর আস্থা রাখতে পারো !
ঠিক আছে !
ন‌ওশাদ হেরাকে নিয়ে ঘন্টা দেড়েক এলোমেলো ঘুরলো ! তারপর বাসায় ফিরে এলো !
হেরা এত আনন্দ পেয়েছে ন‌ওশাদ ওর চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পারছে !
দোতলায় সিঁড়ি দিয়ে যখন উঠছে দুজন ন‌ওশাদ হেরাকে বলল,
চা খাবে ?
এখন চা খেলে ঘুম আসবে না তো ? আপনার খেতে ইচ্ছে করছে ?
হুম !
আমি বানিয়ে আনব ?
তোমাকে ই আনতে হবে হেরা বাসার সবাই ঘুমিয়ে গেছে !
তাহলে দুই মিনিট সময় দিন আমি আনছি বলে হেরা আবার নিচে নেমে গেল কিচেনের দিকে!
দু দিন রান্না করে হেরা কিছুটা জেনেছে কিচেনে কোন জিনিসটা কোথায় আছে !
চা পাতা যখন ফুটছে হেরা চুলার পাশেই দাঁড়ানো ন‌ওশাদ কিচেনে এসে ঢুকলো !
হেরা ইতস্তত করে বলল,হয়েই গেছে আর এক মিনিট লাগবে !
টেইক ইওর টাইম আমি ভাবলাম একা কষ্ট করছো যাই গিয়ে কমপ্যানি দেই !
হেরা হাসলো কষ্টের কিছু নেই এক কাপ চা বানাতে কষ্ট কিসের ?
চা নিয়ে দুজন উপরে উঠে এলো !
আমার রুমের বারান্দায় বসি চলো !
চলুন !
তোমার ঘুম আসছে না তো ?
না !
দুজন ন‌ওশাদের রুমের ছাদ বারান্দায় এসে বসলো ! বুঝলে গীতির খুব শখ ছিল গাছের, ফুলের ! ছাদে খুব সুন্দর বাগান ওর হাতেই তৈরি করা ! ও যাওয়ার পর এসব মালি করে কিন্তু আমার কাছে কেন জানি গীতির মত মনে হয় না ! এই নিয়ে রাগ করে মালি বদলেছি কয়েকবার তারপর মনে হলো গীতি যতটা দরদ নিয়ে করতো অন‌্য কেউ কি করবে? তাই এখন আর বাগান , গাছ এসব নিয়ে মাথা ঘামানো বাদ দিয়েছি ! এই ছাদ বাগান টা আমার আর গীতির খুব পছন্দ ছিল ! গীতি যাওয়ার পর আমি অনেকটা সময় এখানে বসে সময় কাটাতাম ওর কথা ভেবে!
ন‌ওশাদ চায়ের মগে চুমুক দিল ! দুজন‌ই চুপ করে রইলো !
হেরা কি বলবে বুঝতে পারছে না ! নিজের মৃত স্ত্রী কে কতটা মিস করেন উনার কথা শুনলেই বোঝা যায় ! হেরার খুব মায়া লাগে যখন মানুষ টা গীতি নামের মানুষটার কথা বলে! কতটা ভালোবাসা থাকলে ছয় বছর পরেও মানুষ টার জন্য কষ্ট পান উনি হেরা বুঝতে পারছে !
হঠাৎ ন‌ওশাদ বলল, চা ভালো হয়েছে হেরা !
আপনাকে দেখে এখন ক্লান্ত মনে হচ্ছে !
সত্যি ই এখন টায়ার্ড লাগছে ! আজ গলফে বেশি সময় ছিলাম !
তাহলে ঘুমিয়ে পড়ুন অনেক রাত হয়েছে !
হুম ! চলো রুমে ঢুকি !
হেরা ন‌ওশাদের রুমে ঢুকে নিজের রুমের দিকে যেতে নিলো ন‌ওশাদ পেছন থেকে বলে উঠলো , থ্যাঙ্কস হেরা এত রাতে ভালো চা বানিয়ে দেয়ার জন্য !
থ্যাঙ্কস আপনাকেও আজ আমাকে এত গিফট দেয়ার জন্য ! গিফট পেয়ে আমার অভ্যাস নেই কিন্তু আজ জীবনের প্রথম এত দামি দামি গিফট পেয়েছি খুব ভালো লাগছে !
আরে ধুর এসব তোমার পাওয়ার ই কথা ছিল ! আর গয়নার কথা বলছো এই সামান্য কয়টা জিনিস এর জন্য থ্যাঙ্কস লাগবে না ! একটা কথা বলব , তোমার যা কিছু লাগবে কোন লজ্জা করবে না নির্দ্বিধায় আমার কাছে এসে বলবে ! মনে থাকবে ? হাজব্যান্ড হিসেবে এটা আমার দ্বায়িত্ব!
হেরা মাথা কাত করলো ! আসি এখন ?
হ্যাঁ ! ন‌ওশাদ হেরার দিকে তাকিয়ে চোখের পলক ফেলল আর সুন্দর করে একটা হাসি দিল !
উনি এরকম ভাবে হাসলে হেরার খুব ইচ্ছে করে উনার ঠোঁট গুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে !
হেরা বের হয়ে গেল ! ওর মনে অদ্ভুত এক ভালো লাগায় ভরে গেছে আজ ! আজ সারাটা দিন স্বপ্নের মত ছিল ! একা একা বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে সারাদিন ন‌ওশাদের সঙ্গে কাটানো সময় গুলো কে নিয়ে ভাবছে ! আর বারবার নিজের গাল দুটো স্পর্শ করছে ! ওর কাছে মনে হচ্ছে ন‌ওশাদের হাতের স্পর্শ টা সে এখনো গালে অনুভব করছে ! লজ্জায় চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল হেরা !

পরদিন খুব সকাল সকাল উঠে ন‌ওশাদ ভালুকায় তার সিরামিকস ফ্যাক্টরি তে চলে গেল ! বিদেশি বায়ার দের একটা দল ভিজিটে এসেছে তাদের এটেনড করতে হবে ! সকাল সকাল না বের হলে টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত অনেক জ্যামে বসে থাকতে হয়!
হেরা ঘুম ভেঙ্গে রুম থেকে বের হয়ে শুনে ন‌ওশাদ ব্রেকফাস্ট না করেই চলে গেছে! ওর খুব ইচ্ছে করছে মানুষ টাকে ফোন দিয়ে কথা বলতে! কিন্তু আগে কখনো সে উনার সঙ্গে ফোনে কথা বলেনি ! থাক ব্যস্ততার মাঝে ফোন দিলে বিরক্ত হবেন !
হেরা ন‌ওশাদের রুমে গিয়ে ঢুকলো ! আনারের মা এখনো ঘর গোছাতে আসেনি !
উনার রাতের পড়া গেঞ্জি, ট্রাউজার বিছানার উপর পড়ে আছে! বিছানাও গোছানো হয়নি !
হেরা হঠাৎ করে ঠিক করলো সে গুছিয়ে দিবে !
সঙ্গে সঙ্গে পুরো ঘর একটু ক্ষনে ই গুছিয়ে ফেললো হেরা !
ন‌ওশাদের গেঞ্জি টা হাতে নিয়ে হেরা কিছুক্ষণ ধরে বসে রইল !
নীল রঙের এই গেঞ্জি টা কালকে রাতে বাহির থেকে এসে পড়েছিল ন‌ওশাদ ! এই গেন্জিটাতে উনাকে খুব সুন্দর লাগে দেখতে !
হেরা গেঞ্জি টা নিজের রুমে নিয়ে এলো ! কিছুক্ষণ গেঞ্জি টা থেকে ন‌ওশাদের গায়ের ঘ্রাণ টা নিলো ! তারপর নিজের কাপড়ের সঙ্গে আলমারি তে গুছিয়ে রেখে দিল !
এই কাজ টা করার সময় সে নিজের ভেতরে একটা উত্তেজনা অনুভব করছিল! মনে হচ্ছিল খুব গোপন একটা কাজ সে করছে ! মনে মনে ভাবছে আচ্ছা আমি কি পাগল হয়ে গেলাম নাকি !
আনারের মা ঘরে ঢুকলো হেরা সঙ্গে সঙ্গে আলমারি লাগিয়ে ফেলল!
কিছু বলবে আনারের মা ?
আম্মা রাতে কখন আসছেন আপনারা আমি কতক্ষণ ব‌ইসা থাইকা ঘুমায় গেছি !
আমাদের অনেক রাত হয়েছে ফিরতে ! এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি?
আমার ঘরে ।আমার একটা ভাইয়ের ছেলে এখানে একটা বিল্ডিং এর সিকিউরিটি গার্ড। ওর সঙ্গে কথা বলছিলাম!
আমার যে কি ভালা লাগছে আম্মা স্যার আর আপনারে দেখে ! কত জামানা পর স্যার আনন্দে আছে গো আম্মা !
আগে তোমার স্যার কি করতো ?
আগের আম্মা মারা যাওয়ার পর স্যার সকালে উইঠা বাসার নিচে হাঁটাহাঁটি করত কিছুক্ষণ তারপর রুমে ব‌ইসা পেপার পড়তো তারপর নাস্তা খায়া অফিস চ‌ইলা যাইতো ! ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা আর যদি দাওয়াত থাকতো তাইলে রাত এগারোটা এর বেশি দেরি করতো না !
বিকালে খেলতে যায় কোন কোন দিন সেদিন আটটার মধ্যে চলে আসে ! দাদার সঙ্গে একটু ক্ষন বসে তারপর নিজের ঘরেই বসে থাকতো ! ব‌ই পড়তো, মোবাইল এ কথা কয় আর স্ট্যাডি রুমে ল্যাপটপ এর সামনে কাম করে ! কোন আনন্দ পাইতে দেখি নাই ! কিন্তু কালকে আপনার সাথে বাইরে যখন গেছে স্যারের মুখটাতে আম্মা আনন্দ দেখছি আমি ! সব আপনার জন্য আম্মা !
আমি তো কিছুই করি নাই আনারের মা !
আপনে সাথে আছেন এতেই স্যার খুশি !
কি জানি আমি তো কিছু বুঝি না !
স্যারের ঘর কি আপনে গুছাইছেন ?
হুম !
সুন্দর হ‌ইছে আম্মা ! স্যার আসলে বলব ?
না থাক কোন দরকার নেই !
আচ্ছা বলব না ! আপনে কি আজকেও রান্না করবেন কিছু ?
চলো যাই বসেই তো আছি কিছু করার নাই !
চলেন রান্নাঘরে যাই !

হেরার ন‌ওশাদের জন্য এখন রান্না করতে ভালো লাগছে ! এই প্রথম সে আনন্দ নিয়ে রান্না করে! মামি দের সংসারে তো তার উপর গছিয়ে দিতো সব মামি রা ! একটু ভুল হলেই কথা শোনাতে ছাড়তো না ! নানা অবশ্য সব সময় প্রশংসা ই করতো ! হেরা জানে ওকে খুশী করার জন্যেই প্রশংসা করতো নানা ! সব সময় কি আর ভালো হতো ওর রান্না ! জীবনে তো কেউ হাতে ধরে শিখিয়ে দেয়নি কিছু ! ভুল করতে করতে শিখেছে ! মেয়েদের মায়েরা আদর করে ভালোবেসে কত কিছু শিখায় ওর জীবনে ওসব আর হলো কোথায় !
হেরা একটা আইটেম রান্না করলো ! বাকি রান্না জরিনা বুয়া করে ফেলেছে আগেই !
হেরা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে ন‌ওশাদের স্ট্যাডি রুমে ঢুকলো !
এত এত ব‌ই সে অবাক হয়ে গেল! ইস নানা ভাই যদি এমন একটা ঘর পেতো তাহলে সারাদিন ব‌ই নিয়ে বসে থাকতো ! হেরার ও ব‌ই পড়ার অভ্যাস অনেক। সে এক দিক থেকে দেখছে কি পড়বে চিন্তা করছে !
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পার্থিব ব‌ইটা বের করলো তার খুব প্রিয় একটা ব‌ই ! বান্ধবী সালমার কাছ থেকে এনে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলেছিল সে ! বারবার পড়লেও এসব ব‌ই মন ভরে না ! তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় এর কবি ! নিতাইচরনের কবি হয়ে উঠা সব সে এক সময় গোগ্রাসে গিলেছে ! খুসবান্ত সিং এর ট্রেন টু পাকিস্তান , নেলসন ম্যান্ডেলার অটোবায়োগ্রাফি লং ওয়াক টু ফ্রিডম , অরুন্ধতী রয়ের গড অব স্মল থিংস এসব ব‌ই পড়তে বলতো সব সময় নানা ! ভার্সিটিতে যে তিন মাস সে পড়েছিল লাইব্রেরী থেকে এসব ব‌ই নিয়ে রাত দিন পড়েছে! আর্নেস্ট হেমিংওয়ে দ্য সান অলসো রাইজ , অস্কার ওয়াইল্ড এর দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান সব এখানে থরে থরে সাজানো রয়েছে! হেরার ইচ্ছে করছে সব আবার পড়তে!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প গুচ্ছ আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পার্থিব আর রবার্ট ফ্রস্ট এর স্টপিং বাই উডস কবিতার বই এই তিন টা নিয়ে নিজের ঘরে এসে ঢুকলো !
গোসল করলো নামাজ পড়লো ! তার নানা খুব পরহেজগার মানুষ এখানে এসে দেখলো ন‌ওশাদ যত ব্যস্ত‌ই থাকুক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে! হেরা মাঝখানে কয়দিন নামাজ পড়েনি জীবনের হঠাৎ রদবদল হ‌ওয়ায় কেমন যেন অভ্যাস গুলো ও রদবদল হয়ে গিয়েছিল এখন সে আবার আগের মত নামাজ বাদ দেয় না ! এবং নিজেই অবাক হয় একটা সময় শুধু দোয়া চাইতো খারাপ মানুষ দের থেকে মুক্তি আর আজ কিভাবে কিভাবে যেনো ন‌ওশাদ তার দোয়াতে সামিল হয়ে গেছে ! প্রতি নামাজে সে ন‌ওশাদ এর ভালোর জন্য দোয়া করে ! এই মানুষটা এখন তার জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ তার জন্য সে যত দোয়া চায় তত কম হবে ! নানা আর ন‌ওশাদ এর ভালো ছাড়া আর কিছু চাওয়ার নেই আল্লাহর কাছে তার !
নামাজ শেষ করেই ব‌ই খুলে বসলো ! কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়ে রবিঠাকুরের গল্প গুচ্ছ পড়লো ! পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে গেল এক সময় !

ন‌ওশাদ দুপুরের পর পরই বাসায় ফিরে এলো ! বায়ারদের সঙ্গে লাঞ্চ করলো রেস্টুরেন্টে ! তারপর সোজা বাসায় চলে এলো ! দোতলায় উঠে নিজের ঘরে না ঢুকে হেরার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো ! দরজা চাপানো একটু ফাঁক হয়ে আছে ! ন‌ওশাদ একবার নক করলো কোন সাড়া শব্দ নেই!
আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখে হেরা ঘুমাচ্ছে বুকের উপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প গুচ্ছ । পাশে পার্থিব আর রবার্ট ফ্রস্ট এর কবিতার বই রাখা !
ন‌ওশাদ বুকের উপর থেকে ব‌ইটা নিয়ে বন্ধ করে পাশে রেখে দিল ! ওড়না গায়ে ছিল না বলে গলার নিচের সেই দাগটা দেখা যাচ্ছে ! ন‌ওশাদ মনে মনে ঠিক করলো একজন ভালো স্ক্রীনের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে হবে এবং আজ‌ই ! হেরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই দাগ থেকে মুক্তি পাবে ওর মনের যন্ত্রণা টা তত তাড়াতাড়ি কমবে !
নভেম্বর মাসের দুপুর তাও যে গরম মেয়ে টা এসি ছাড়েনি সে জন্য ঘামছে ! ন‌ওশাদ এসি ছেড়ে হেরার গায়ে পাশে রাখা চাদরটা মেলে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল !

হেরার ঘুম ভাঙলো বিকেলের আগেই ! গায়ে চাদর আর এসি দেখে বুঝলো এটা আনারের মায়ের কাজ । হেরা উঠে এসি অফ করে দিলো ! দরজা খুলে দিল! তার কাছে মনে হচ্ছে ন‌ওশাদ এখনো ফিরেনি ! দোতলায় ন‌ওশাদ থাকলে কাজের লোকজন খুব একটা থাকে না ! দোতলায় লোকজন আছে মনে হচ্ছে তার মানে উনি আসেননি !
হেরা আবার ব‌ই পড়া শুরু করল! শীর্ষেন্দুর পার্থিব টা পড়া শুরু করলো ! মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল একেবারে ব‌ই এর ভেতরে ডুবে গেল ! বাহিরে হলকা ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে ! বৃষ্টি দেখেই
ব‌ই হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে একটা সময় ও গুন গুন করে গান গাইতে শুরু করলো ! তার শোয়ার ভঙ্গি টা একটু বিচিত্র ছিল বিছানা থেকে মাথা একটু ঝুলিয়ে চুল গুলো ফ্লোরে বিছিয়ে চোখ বন্ধ করে সে গাইছে,
‘ যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরী
কদম‌ গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি।
উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো
ঝলকে ঝলকে নাচিবে বিজলী আলো
তুমি চলে এসো..
এক বরষায়..’
ন‌ওশাদ গিয়েছিল গলফ খেলতে ! বৃষ্টি দেখেই ফিরে এসেছে! সঙ্গে শোয়েব! দুজন দোতলার সিঁড়ি দিয়ে যখন উপরে উঠে এলো করিডোর থেকেই গুনগুন গানের আওয়াজ পেলো !
ন‌ওশাদ দাঁড়িয়ে গেল! বুঝতে পারছে গানটা গাইছে কে !
শোয়েব ও বুঝতে পারছে তার মামা কেন দাঁড়িয়ে গেছে তিনি গায়িকার কাছে যাবেন এখন!
মামা আমি রুমে যাচ্ছি ! ওরা আসলে আপনাকে খবর দিব !
হুম!
শোয়েব তিনতলায় উঠে গেল! ওর ইচ্ছে হচ্ছিল চিকন গলার গানটা আরো একটু শুনতে! মনে মনে বলল বাহ্ রূপের সঙ্গে সঙ্গে গুন ও আছে দেখছি মেয়েটির !
হেরা চোখ বন্ধ করে তখন‌ও গাইছে তার প্রিয় গানটা ,
যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো
এক বরষায়…
হঠাৎ চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে দরজায় ন‌ওশাদ দাঁড়িয়ে ! ও মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে রেখে ছিলো বলে ন‌ওশাদ এর পা নিচে আর মাথা উপরে মনে হচ্ছে ! হেরা এত লজ্জা পেল ঝট করে উঠে বাথরুমে র দিকে দৌড় দেয়ার সময় দরজার চৌকাঠে ধুম করে কপালে বাড়ি খেলো !
ঘটনার আকস্মিকতায় ন‌ওশাদ হতভম্ব ! কি হলো এটা ?
ন‌ওশাদ আসলে এই কয়দিনে বুঝতে পারেনি ! হেরা কে যতটা শান্ত শিষ্ট দেখা যায় আসলে সে তা না ! খুব চঞ্চল একটা মেয়ে! একটা সময় মেয়েটা পাখির মত উড়ে বেড়াতো সারা বাড়ি ! অনেক দুষ্টুমি করতো ! সবার কাছ থেকে বকাঝকা ও খেতো এর জন্য ! কিন্তু জীবনের পরিস্থিতি তাকে কিছু টা পরিবর্তন করে দেয় কয়েক বছরে ! তবে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি যেমন পরিবর্তন করা যায় না ঠিক তেমনি স্বভাব আবার স্বাভাবিক পরিবেশ পেলে আগের মত হয়ে আসতেই পারে!
দরজায় ভালো ই বাড়ি খেয়েছে হেরা ! ন‌ওশাদ ডেকে উঠলো হেরা , হেরা !
বাথরুমের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো!
আমার মনে হচ্ছে তুমি অনেক বড় ব্যথা পেয়েছো !
প্লিজ বের হ‌ও !
হেরা দরজা খুলে বের হয়ে এলো !
কোথায় ব্যথা পেয়েছো দেখি ?
হেরা চুপ করে আছে!
ন‌ওশাদ তাকিয়ে দেখে হেরার কপাল ফুলে গেছে !
ও মাই গড ! অনেক উঁচু হয়ে ফুলে গেছে তো ! বরফ লাগাতে হবে! ন‌ওশাদ রুম থেকে বের হয়ে গেল! সিঁড়ির কাছে গিয়ে আনারের মা কে ডেকে বলল, বরফ নিয়ে আসো তাড়াতাড়ি!
আনারের মা বরফ নিয়ে ছুটে এলো !
তোমার আম্মার কপালে লাগিয়ে দাও তো বরফ ! আমার একটা জরুরী ফোন এসেছে আমি কথা বলে আসছি ! ন‌ওশাদ হেরার রুম থেকে বের হয়ে গেল!
কিভাবে এত বড় ব্যথা পাইলেন আম্মা ? কতটা ফুলছে !
বাথরুমে র দরজায় বাড়ি খেয়েছি ! ও কিছু না ঠিক হয়ে যাবে!
ন‌ওশাদ ফোনে কথা বলা শেষ করে এসে দেখে আনারের মা হেরার কপালে বরফ দিচ্ছে !
আমার কাছে দাও আনারের মা !
আর লাগবে না , হেরা বলে উঠলো!
আনারের মা বরফের বাটিটা ন‌ওশাদের হাতে তুলে দিল ! তারপর রুম থেকে বের হয়ে গেল!
ন‌ওশাদ হেরার সামনে বসে বরফ কপালের ফোলা জায়গাটতে ধরলো !
এটা কি হলো ব্যাপার টা হেরা ? তুমি এভাবে দৌড় দিলে কেন ?
হেরা চুপ করে চোখ নিচে নামিয়ে আছে !
বলো ?
হঠাৎ আপনাকে দেখে লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলাম!
তাই বলে দিকবেদিক না দেখে দৌড় দিতে হবে ?
সরি !
সরি তো আমার বলা উচিৎ নক না করে তোমার দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম !
ছিঃ আপনি সরি বলছেন কেন ?
কত বড় ব্যথা পেলে !
আমার এইসব এ অভ্যাস আছে ! জীবনে কত ব্যথা পেয়েছি !
তাই বলে কি সব সময় ব্যথা পেতেই হবে !
ন‌ওশাদ এর ফোনে রিং হচ্ছে !
ন‌ওশাদ লাইন টা কেটে দিল ! আরো কিছুক্ষণ বরফ লাগিয়ে দিল ! তোমার তো আবার ঠান্ডা র সমস্যা আর দরকার নেই বরফের ঠান্ডা লেগে যাবে ! ন‌ওশাদ উঠে দাঁড়ালো ! বেশি ব্যথা হলে নাপা খেয়ে নিও একটা ! হেরা ঘাড় কাত করলো ! আপনি দুপুরে খেয়েছেন ?
হুম কখন ! তুমি খাওনি ?
খাব এখন !
সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে এখনো খাওনি ? আমার জন্য লাঞ্চে অপেক্ষা করবে না ! ঠিক আছে ! ডিনার আমরা এক সঙ্গে করতে পারি লাঞ্চ এ অফিসে থাকি আর ছুটির দিনে বাহিরে কাজ থাকলে কখনো কখনো বাহিরে ই লান্চ করে আসা হয় ! এই যে আজ যেমন বায়ার দের সঙ্গে লাঞ্চ করতে হলো !
সরি হেরা আমার খোঁজ নেয়া দরকার ছিল তুমি খেয়েছো কিনা ! এখন খেয়ে নাও !
খাব !
যাওয়ার সময় ন‌ওশাদ পেছন ফিরে বলল, বলতে ভুলে গেছি তোমার গানের গলা তো সুন্দর ! গানটা ভালো ছিল হেরা ! গানের বাকি অংশটুকু পরে শুনব ন‌ওশাদ হাসছে !
হেরা খুব লজ্জা পেয়ে গেল !

নিচে ড্রয়িং রুমে শোয়েব এর বড় বোন আর তার দুই মেয়ে অপেক্ষা করছে ন‌ওশাদ এর জন্য ! শোয়েব এর বড় বোন এসেছে তার মেয়েদের এই বাসায় রেখে যেতে ! ওরা আপাতত কিছুদিন এই বাসায় থাকবে ! মেয়েদের বাবা পুলিশ অফিসার পোস্টিং ঢাকার বাহিরে হয়েছে । শোয়েব দের বাসা পুরান ঢাকা। এত দূর থেকে প্রতিদিন ভার্সিটিতে আসা অসম্ভব। ওদের ভার্সিটি এই বাসার কাছে ন‌ওশাদ ই বলল এখানে থাকতে !
মেয়ে দুইটার বয়স কাছাকাছি ! হেরার সমবয়সী বলেই ন‌ওশাদ চাইছে ওরা থাকলে হেরার ভালো লাগবে !
ন‌ওশাদ এর প্ল্যান হেরাকে একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি করে দিবে ! পড়াশোনা তে গ্যাপ হয়েছে বলে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়ার পক্ষপাতী সে না ! সে চায় হেরা পড়াশোনা কমপ্লিট করে নিজের একটা পরিচয় তৈরি করুক !

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here