তবু_সুর_ফিরে_আসে ৫ম পর্ব

0
184

#তবু_সুর_ফিরে_আসে

৫ম পর্ব

রেজোয়ান আর তার স্ত্রী সুমনা ন‌ওশাদ এর লিভিং রুমে ঢুকতেই কেয়ারটেকার রিয়াজ দৌড়ে এলো ! স্যার আসেন স্যার!
: তোমার স্যার কোথায় রিয়াজ?
: স্যার বাসায়ই আছে ! খবর দিচ্ছি , আপনি বসেন স্যার !
: তোমার স্যার জানে আমরা আসছি , ব্যস্ত হ‌ওয়ার কিছু নেই আসতে দাও ওকে !
: আমি যাচ্ছি স্যারের রুমে আপনি বসেন স্যার !
রিয়াজ ছুটে যাচ্ছে ন‌ওশাদের রুমের দিকে ! আনারের মা বাঁধা দিল ,
: খাড়ান, নতুন আম্মা স্যারের রুমে আপনি যাচ্ছেন যে ? আমি বলে আসতেছি !
তারপর ফিসফিস করে রিয়াজ কে বলল , এখন থেইকা হুঁশ করিয়েন রিয়াজ ভাই দোতলায় উঠার আগে । বাসায় আম্মা আছে ঠিক আছে !
: হুম বুঝলাম যাও স্যার রে খবর দাও !
: যাইতেছি !
আনারের মা দোতলায় উঠে দেখে ন‌ওশাদ তার রুম থেকে বের হয়ে আসছে ! পেছনে পেছনে আসছে হেরা !
: স্যার ,রেজোয়ান স্যার আর ম্যাডাম আসছে নিচে !
: আনারের মা আমাদের সবার ডিনার রেডি করবে এবং জলদি !
: জ্বি স্যার !
হেরার দিকে তাকিয়ে বলল, এসো হেরা !
ওরা নিচে নেমে গেল !
আনারের মা সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে ! পারুল আনারের মায়ের কাছে এসে বলল ,
: উনি কি স্যারের রুম থেইকা বাইর হ‌ইলো খালা ?
: কেন তোর কিসের মাথাব্যাথা , স্যারের বিয়া করা ব‌উ স্যারের রুম থেইকাই তো বাহির হ‌ইব ! আজাইরা কথা কস ! চল রান্না ঘরে মেহমান গো খাওয়ার ব্যবস্থা কর !
: আমার জ্বর আমি পারুম না !
: তাহলে এইখানে কি করস ? চোখের সামনে থে বিদায় হ ! আনারের মা নিচে কিচেনে র দিকে চলে গেল !
পারুল গেল বীথিকে ফোন দিতে !

ন‌ওশাদ কে দেখেই সুমনা হেসে বলে উঠলো,
: কনগ্রাচুলেশন বন্ধু ! সত্যি খুব খুব খুশি হয়েছি খবরটা শুনে !
কোথায় সেই ভাগ্যবতী মেয়েটি যে ন‌ওশাদ আজমীর স্ত্রী হয়ে এলো?
: সুমনা প্লিজ ভাই আর পিনচ করো না তোমার জামাই সকাল থেকে এই কাজ করছে ! ন‌ওশাদ হাসছে!
ওর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে হেরা !
সরো সামনে থেকে দেখি আগে ,যাকে দেখার জন্য ছুটে এলাম !
হেরা কে দেখে সুমনা এবং রেজোয়ান একটু চুপ করে গেল !
হেরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ন‌ওশাদ এর পাশে ! ও লজ্জা কিছুটা ভয় এবং সংকোচে তাকাতে পারছে না ! অপরিচিত মানুষ দের সামনে এসে দাঁড়াতে তার খুব অস্বস্তি লাগে সবসময়, আর এখন তো লজ্জায় তার চোখ খুলে তাকাতেই ইচ্ছে করছে না !
যে মানুষ টি তাকে বাঁচিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে , মানুষটি তার স্বামী কিন্তু চোখ খুলে উনাকেই দেখা হয়নি ভালো করে তার!
জীবনের কি অদ্ভুত খেলা , কোথায় ছিল সে এখন কোথায় চলে এসেছে !
ন‌ওশাদ এর ডাকে তার খেয়াল হলো !
: হেরা উনাদের কথাই তোমাকে বলছিলাম উপরে ! আমার দুই বন্ধু ! ইউনিভার্সিটি তে আমরা তিনজন একসাথে পড়াশোনা করেছি !
হেরা চোখ তুলে তাকালো !
সুমনা অবাক হয়ে বলল ,
: ন‌ওশাদ এত দেখি একেবারে হলুদ গোলাপ ফুল ! কোথায় পেলে তুমি ? সুমনা হেরার হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসালো !
: নাম যেন কি বললে ? আমি কিন্তু ভাবি বলতে পারব না, বাচ্চা বয়সী একটা মেয়ে !
: হেরা !
: খুব সুন্দর নাম ! সত্যি ন‌ওশাদ আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি তোমার ব‌উ দেখে ! রেজোয়ান তুমি কিছু বলছো না যে ?
: আমি আমার বন্ধুকে দেখছি , তুমি কথা গুলো যখন বলছো সুমনা , তখন ন‌ওশাদ ব্লাস করছে তাকিয়ে দেখো !
: সত্যি ন‌ওশাদ ? সুমনা ন‌ওশাদের দিকে তাকালো!
: আরে না রেজোয়ান শালা তোর চোখ নষ্ট আর মাথা তো অনেক আগে থেকেই নষ্ট !
: এখন তো তুমি এটা বলবেই বন্ধু ! তোমার সঙ্গে হিসাব পড়ে হবে আমার !
সুমনা হেরার জন্য ঘুরে ঘুরে এত শপিং করলে দিচ্ছো না কেন ওকে ? রেজোয়ান বলল!
: হ্যাঁ তাই তো দিচ্ছি দাড়াও !
সুমনা হেরার হাতে শপিং এর ব্যাগ গুলো তুলে দিল ! তোমার জন্য সামান্য কিছু গিফট !
হেরা ন‌ওশাদ এর দিকে তাকালো !
ন‌ওশাদ চোখ দিয়ে ইশারা করলো নেয়ার জন্য !
এই প্রথম সে ন‌ওশাদ এর মুখটা দেখলো ! ফর্সা সুন্দর লম্বা একজন মানুষ ! চোখে চশমা পড়া ! গতকাল থেকে একবার ও সাহস হয়নি মানুষটাকে দেখার ! মানুষটার সঙ্গে তার বয়সের অনেক ব্যবধান কিন্তু তার কাছে এই মানুষটা ফেরেস্তা তুল্য ! তিনি যদি সময় মত না আসতেন তাহলে তাকে চিনু মিয়া হুজুর লাইলি আপার মত দোড়রা মেরে মেরেই ফেলতো !
তিন বছর আগে এরকম শালিশ বসিয়ে তাদের গ্রামের লাইলি আপাকে দোড়রা মারা হয়েছিল ! লাইলি আপা তিন দিন পর মারা যায় ।
তার সামনে বসা মানুষ টা কালকে যদি না আসতো শালিসের সময় তাহলে আজ সে কোথায় থাকত সে জানে না ! তাই তার কাছে এই মানুষটা এখন তার জীবনের রক্ষাকর্তা ।
হেরা তুমি তো অনেক সুন্দর ! আমি তো প্রথম নজর দেখে কথাই বলতে পারছিলাম না ! সুমনা হেরার হাত ধরে বলল!
হেরা মাথা নিচু করে শুনছে !
পড়াশোনা কি করেছো ?
অনার্স ভর্তি হয়েছিলাম পড়তে পারিনি !
সমস্যা নেই এখন পড়াশোনা করতে পারবে !
সুমনা তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু দেখছে হেরার মুখটা ! সে রেজোয়ান এর কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনে এসেছে ! খারাপ লাগছে তার এই বয়সে কত মানসিক , শারীরিক অত্যাচার মেয়েটা সহ্য করেছে !
সুমনা হেরা কে হাত ধরে টেনে দাঁড় করালো চলো তোমাকে এই বাসাটা দেখাই হেরা ! তারপর ন‌ওশাদ এর দিকে ফিরে বলল,
: তোমার ব‌উ কে নিয়ে ঐ দিকে গেলাম ন‌ওশাদ !
: যাও।

ওরা উঠে চলে যেতেই রেজোয়ান ন‌ওশাদ এর দিকে তাকিয়ে বলল ,
: সরি বন্ধু অসময়ে চলে আসছি তুমি ব‌উ এর সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলে !
: রেজোয়ান দয়া কর আমার উপর, সেরকম কিছু না শুধু কালকে চলে যাব বলে ওর সঙ্গে কথা বলছিলাম!
: আমি অন্য কিছু বলছিলাম নাকি ন‌ওশাদ , বিয়ে করতেই মাথায় শুধু ঐ জিনিস ঘুরছে তোর ! আমি গল্প করার কথাই বলছিলাম! তুই কি বুঝে নিসিস তুই জানিস !
: সেন্স অব হিউমার তাই না, তোকে আমি চিনি না শালা তুই কি বলতে চাইছিস !
: ফান না ন‌ওশাদ সিরিয়াসলি বলছি , মেয়েটা অনেক বাচ্চা বয়সী একটা মেয়ে তুই তোর মত করে গড়ে নে দেখবি খুব সুখী হবি বন্ধু!
: এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা ওর বয়স কম রেজোয়ান !
: কি হয়েছে এতে ?
: লোকজন, সমাজ , আত্মীয়-স্বজন কি ভাবছে !
: সবাইকে নিয়ে ভাবতে হবে না তোর ! তুই তোর ভবিষ্যৎ টা নিয়ে চিন্তা কর বন্ধু ! অনেক বছর একা ছিলি, তোর একাকিত্বের ভাগ নিতে আসছে কেউ তখন ?
ন‌ওশাদ তাকিয়ে আছে অন্য দিকে ! আমি সেই কথা ভাবছি না রেজোয়ান।
আমি মেয়েটির ভবিষ্যৎ টা নিয়ে ভাবছি ! আমার বয়সী একটা মানুষের সঙ্গে জীবন কাটানো ওর জন্য ঠিক হবে !
মানে ? তোর মত একজন ভালো মানুষ পাবে ও জীবনে ? তোর বয়স কত ছিচল্লিশ ! নায়ক সালমান খানের বয়স তিপ্পান্ন , ওর জন্য পনের বছরের মেয়েরাও পাগল !
রেজোয়ান আমি সালমান খান না !
দেখতে কিন্তু সালমান খানের মত ইয়ং ই আছিস এখনো তুই ! আমার চুল পেকে গেছে তোর তো একভাগ চুল ও পাকেনি !
তুই বুঝতে পারছিস না রেজোয়ান ওর আমার বয়সের তফাত টা একটা সময় বাজে একটা ব্যাপার হয়ে সামনে আসবে !
রেজোয়ান গলা নামিয়ে বলল, মেয়েটিকে রেপ করা হয়েছিল বলে তুই কি দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছিস ! সত্যি করে বল ?
এরকম ঘটনা ঘটেনি হেরার সঙ্গে !
তুই না বললি অফিসে ?
আমার সঙ্গে কথা হয়েছে মেয়েটির , তাকে তুলে নিয়ে যায় ছেলে গুলো কিছু করার আগেই সাপে কামড় দেয় ওদের লিডার কে ওরা ছেলেটিকে নিয়ে হসপিটালে চলে যায় হেরা কে ফেলে কিন্তু বাড়িতে ফিরে ও কাউকে বলার‌ই সুযোগ পায়নি যে ওর সঙ্গে কিছু হয়নি । সবাই ধরেই নেয় যা ঘটার ঘটে গেছে !
ও গড কি বলিস রেজোয়ান অবাক হয়ে বলল !
হুম!
দুই বন্ধু চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ!
ন‌ওশাদ একটা কথা বলতে চাইছিলাম , তুই তোর আত্মীয় স্বজনদের জনে জনে হেরার পুরো ঘটনা এক্সপ্লেইন করতে যাবি না প্লিজ! সবাই সব কিছু সহজ ভাবে নিতে নাও পারে ! মেয়েটা তার প্রাপ্য সম্মান টুকু পাবে না তখন !
আমার স্ত্রী র পরিচয়ে সে যতদিন আমার জীবনে থাকবে হেরা কে সবার প্রাপ্য সন্মান দিতেই হবে ! আফটার অল শী ইজ মাই ওয়াইফ!
আর তুই ?
মানে ?
ন‌ওশাদ তুই ওকে ওর প্রাপ্য অধিকার দিবি না ?
ন‌ওশাদ একটুক্ষন চুপ করে থেকে বলল , ওর ভালোর জন্যই আমার কাছ থেকে বেশি কিছুর দরকার নেই! একটা দূরত্ব আমাদের মাঝে থাকতেই হবে !
ন‌ওশাদ !
প্লিজ রেজোয়ান আমাকে বোঝার চেষ্টা কর একটু !
ঠিক আছে এই বিষয়ে আমরা পরে কথা বলব ন‌ওশাদ !

হেরা কে নিয়ে সুমনা বাসার লনে এসে দাঁড়ালো! লনের একপাশে সুন্দর বাগান করা । সেখানে বেতের চেয়ার পাতা সুমনা চেয়ারে বসতে বসতে বলল , এখানেই বসি চলো !
হেরা সুমনার পাশের চেয়ারটাতে বসলো।
এই বাসাটা দেখছো হেরা, এর ডিজাইন ন‌ওশাদ এর করা ! আর কার পছন্দের দিকে খেয়াল রেখে বানানো জানো ? গীতির !
গীতির কথা বলেছে ন‌ওশাদ তোমাকে ?
হেরা মাথা নেড়ে না করলো !
তুমি জানো গীতি কে ?
না !
গীতি ন‌ওশাদের ব‌উ ! ছয় বছর আগে গীতি স্ট্রোক করে মারা যায় ! একদম হঠাৎ করে ! ও আমাদের বয়সী ছিল। ন‌ওশাদ আর গীতির ছোটবেলার প্রেম। তারপর বিয়ে! তোমার বর কে এখন দেখছো, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আরো নায়কের মত ছিল দেখতে। ছাত্র হিসেবে মারাত্মক মেরিটোরিয়াস , এত সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতো ন‌ওশাদ, ছবি আঁকতে পারে ! এই বাসায় যত পেইন্টিং দেখবে সব ন‌ওশাদ এর আঁকা! কথা বলা ,চাল চলন সব দেখে মেয়েরা পাগল ছিল কিন্তু ন‌ওশাদ পাগল ছিল গীতির জন্য।
পড়াশোনা করা অবস্থায়ই বিয়ে করে গীতিকে ! আজকের ন‌ওশাদ এর এই উত্থান সব গীতির উৎসাহ, ধৈর্য্যরে ফল ! ন‌ওশাদ খুব ভালোবাসে গীতিকে । এখনো ভালোবাসে হেরা !
তোমাকে একটা কথা বলব হেরা, ন‌ওশাদ একজন অসাধারণ মানুষ। পৃথিবীর প্রতিটি মেয়ে এমন স্বামী চায় তার জীবনে। এই বিত্ত বৈভবের জন্য না কিন্তু , চায় কারণ সে খুব আন্ডারস্ট্যান্ডিং, লয়াল, রেশনাল একজন মানুষ বলে !
ও যাকে ভালোবাসে সবকিছু দিয়ে ভালোবাসে আবার যাকে ঘৃণা করে খুব বেশি ঘৃণা করে!
তুমি তো বয়সে অনেক ছোট ধীরে ধীরে বুঝতে পারবে।
হেরা সুমনার দিকে তাকিয়ে শুনছে কথা গুলো!
হেরা ন‌ওশাদ আর তোমার বয়স এর ব্যবধান অনেক। একটা কথা কি , বয়স কিছু না যদি তুমি মানুষটার প্রতি আগ্রহী থাকো, মানুষটার জন্য ভালোবাসা অনুভব করো তাহলে ই দেখবে তুমি সুখী ! সুখ কখনো বয়সের মুখাপেক্ষী হয় না !
তুমি মনে রাখবে এই সংসারটা তোমার , ন‌ওশাদ এর জীবনটা ভালো রাখার ওর সঙ্গী হয়ে উঠার দ্বায়িত্ব তোমার !
ন‌ওশাদ মানুষটা তোমার ! মানুষটাকে যত তাড়াতাড়ি আপন করে নিবে দেখবে ও এত ভালো একটা মানুষ তোমার জীবনটা বদলে দিবে তার ভালোগুলো দিয়ে!
হেরার খুব লজ্জা লাগছে কথা গুলো শুনে !
আপু উনি আমার জীবনটা বদলে দিয়েছেন , আমাকে যেখান থেকে তুলে এনেছেন তিনি আপনাকে আমি বলে বোঝাতে পারবো না !
আমি জানি সব , তুমি পিছনে ফিরে আর তাকাবে না ঠিক আছে! যা খারাপ ছিল সব তুমি ফেলে এসেছো এখন থেকে সব দেখবে ভালো হবে! আর একটা কথা বলি গীতি যাওয়ার পর এই বাড়ি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে গীতির দুই বোন আর ন‌ওশাদ এর ছোট ভাইয়ের ব‌উ রা। একদল করে নিশালের আর মৃত গীতির কাঁধে ভর দিয়ে আর আরেকদল করে ন‌ওশাদ এর বাবার কাঁধে ভর দিয়ে! মানে ঐ দুজনের ভালো করছে তারা সেই উছিলা দিয়ে । তোমাকে আগে নিশাল আর ন‌ওশাদ এর বাবার ভরসার জায়গা হতে হবে দেখবে এমনি এমনি বাকিরা তাদের অবস্থান বুঝে সরে যাবে!
মোটকথা তোমাকে এই সংসারের দ্বায়িত্ব টা নিজের করে নিতে হবে ! সবচেয়ে আগে ন‌ওশাদ কে নিজের করে নিতে হবে !
তুমি কোথায় ছিলে, কি ছিলে ওসব নিয়ে চিন্তা করো না । এখন শুধু তুমি ন‌ওশাদ আজমী র স্ত্রী এটা মনে রেখো !
হেরা মনে মনে ভাবছে , এটা কিভাবে সম্ভব উনার উপর আমার কি জোর !
আনারের মা ওদের কাছে এগিয়ে এলো,
ম্যাডাম আর আম্মা আপনাদের স্যার ডাকে ! ডিনার দিসি টেবিলে !
চলো হেরা !

সুমনা আর হেরা লিভিং রুমে এসে ঢুকলো। হেরার মাথায় যথারীতি ঘোমটা দিয়ে ঢাকা !
সুমনা ন‌ওশাদ এর পাশে বসে বলল, তোমার ব‌উ এর সঙ্গে গল্প করছিলাম ! খুব মিষ্টি একটা মেয়ে !
কি কথা বলছিলে ?
বললাম এখন এই সংসার, এই বাড়ি এবং ন‌ওশাদ আজমী সব তোমার ! তুমি তোমার দ্বায়িত্ব যত তাড়াতাড়ি বুঝে নিবে তত ভালো।
ন‌ওশাদ বলল, ও কি বলল ?
বলেনি কিছু , চুপচাপ শুনলো !
তুমি ওকে নার্ভাস করে দিয়েছো হয়তো সুমনা ! এত কঠিন কঠিন কথা বলে !
রেজোয়ান সুমনার দিকে তাকিয়ে বলল ,
চলো তাড়াতাড়ি ডিনার করে বিদায় নেই ।‌ন‌ওশাদের কালকে সকালে ফ্লাইট ওর ঘুমাতে হবে ! আরো কাজ থাকতে পারে !
ন‌ওশাদ এর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলো রেজোয়ান!

ওরা চারজন এক সঙ্গে ডিনার করলো । হেরার এত লজ্জা লাগছিল সবার সঙ্গে খেতে। ন‌ওশাদ ওর দিকে তাকালেই ওর কেমন ভয় ভয় লাগে । গা কেমন ছমছম করে ! হেরা নাম টা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে ! কিন্তু মানুষ টা এত সুন্দর , এত ভালো। কত সুন্দর করে নরম গলায় কথা বলে। বন্ধু আর বন্ধুর ব‌উ এর দুষ্টামি করা কথা গুলো শুনে লজ্জা পাচ্ছিল। আবার কি দৃঢ়তা নিয়েও কথা বলে, কালকে রাতে কিভাবে সবার সামনে ওর পরিচয় টা দিল ! অনেক টাকার মালিক হয়তো কিন্তু বাড়ির কাজের লোক থেকে শুরু করে বন্ধু সবার সঙ্গে কত ভালো ব্যবহার করে !
হেরাকে শুরু থেকে আপনি আপনি করে কথা বলেছে! হেরা কে কেউ কখনো আপনি করে কথা বলেনি !
সুমনা কেও হেরার খুব ভালো লাগছে ! খুব আপন মনে হচ্ছে উনাকে। ওর সঙ্গে ওর নানা, নানু ছাড়া কেউ খুব একটা ভালো ব্যবহার তো করেনি কোন দিন , এখানের মানুষ দের ব্যবহার ওকে খুব অবাক করছে ।
যাওয়ার সময় সুমনা, ন‌ওশাদ আর হেরার ছবি তুলে দিলো !
ন‌ওশাদ তোমার মোবাইল টা দাও ?
কেন ?
দাও , লক খুলে !
ন‌ওশাদ সুমনার হাতে ওর মোবাইল টা তুলে দিল !
তুমি আর হেরা দাঁড়াও ছবি তুলে দিচ্ছি !
সুমনা খুব বেশি কি দরকার ?
পরে বুঝবে কতটা দরকার ছিল ন‌ওশাদ আজমী !
হেরা কে টেনে সুমনা ন‌ওশাদ এর পাশে দাঁড় করালো ঘোমটা সরিয়ে তারপর ছবি তুলে দিল !

ন‌ওশাদ এর কাছে মোবাইল টা দিতে দিতে সুমনা বলল,খুব বেশি সময় লাগবে না ছবিটা তোলা যে জরুরি ছিল বুঝতে। এই ধরো আগামীকাল প্লেনটা টেক অফ করে ঢাকার আকাশে যখন‌ই উঠবে, তখন‌ই মনে পড়লো কাউকে রেখে অনেক দূরে চলে যাচ্ছো ! তখন এই ছবিটা দেখতে ইচ্ছে করতেই পারে ন‌ওশাদ !
সত্যি বলছো সুমনা ?
হান্ড্রেড পার্সেন্ট মিলিয়ে নিও !
সুমনা আর ন‌ওশাদ গলা নামিয়ে কথা গুলো বলছিল !
হাসতে হাসতে ন‌ওশাদ বলল, সে রকম কিছু হবে না সুমনা !
হবে হবে , বিয়ে এমন এক জিনিস পাথর কে গলিয়ে নদী বানিয়ে দেয় !
তাই বুঝি ? হাসছে শুধু ন‌ওশাদ !
হেসো না আমার কথা মিলিয়ে নিও !
রেজোয়ান এসে ন‌ওশাদ কাছে দাঁড়ালো !
তুই ফিরবি কবে ?
সব মিলিয়ে পাঁচ দিন থাকব !
এই কদিন হেরা এই বাসায় একা থাকতে পারবে ?
আশাকরি অসুবিধা হবে না , বাড়ি ভর্তি লোকজন আর শোয়েব তো আছেই !
সুমনা হেরার হাত ধরে বলল, তোমার যে কোন কিছু লাগলে আমাকে ফোন দিবে । আনারের মায়ের কাছে বললেই আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দিবে ! ন‌ওশাদ থাকবে না এমনকি ন‌ওশাদ কে কিছু বলতে পারছো না মুখ ফুটে সোজা আমাকে একটা কল দিবে ! আমি কিন্তু ন‌ওশাদ কে বকতেও পারি !
হেরা ঘাড় কাত করলো !
ন‌ওশাদ আমি এসে হেরা কে নিয়ে যাব টেইলার্স এর কাছে নিব যে ড্রেস গুলো এনেছি বানাতে দিতে হবে !
ঠিক আছে সুমনা তোমার যা ইচ্ছা করো হেরাকে নিয়ে !
সুমনা হেরা কে জড়িয়ে ধরলো !
আসি !

সুমনা আর রেজোয়ান এর গাড়ি টা বের হয়ে যাওয়ার পর ন‌ওশাদ আর হেরা দাঁড়িয়ে র‌ইল কিছুক্ষণ ।
কেমন লাগলো ওদের হেরা ?
ভালো!
ওদের এই হাসি খুশি, উল্লাস টা আমার খুব ভালো লাগে বুঝলে!
এখন উপরে যাই চলো !
দুজন উপরে উঠে এলো । তোমার তো আব্বার সঙ্গে দেখা হয়নি হেরা ?
জ্বি না !
চলো আব্বা জেগেই আছে তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই !
ন‌ওশাদ হেরাকে নিয়ে তার আব্বা র ঘরে ঢুকলো !
ফরহাদ আজমী টিভিতে নিউজ চ্যানেল দেখছে !
ন‌ওশাদ আর হেরা কে দেখে চোখ তুলে তাকালো !
তারপর হেরার দিকে তাকিয়ে বলল,
বড় বৌমা তোমার উপর আমার অনেক রাগ !
হেরা একটু ভড়কে গেল !
ন‌ওশাদ ফিসফিস করে বলল , আব্বা ভেবেছে তুমি গীতি আরা ! কিছু মনে করো না !
থাক কিছু বলার দরকার নেই উনি আমাকে না হয় তাই ভাবুক !
ন‌ওশাদ হেরার কথায় অবাক হলো ! মেয়েটা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে ! ওর খুব ভালো লাগলো ব্যাপার টা।
কি বড় বৌমা কথা বলছো না কেন ? এভাবে তুমি এই বাসাটা কাজের মানুষের কাছে ফেলে , আমাকে অসহায় এর মত ফেলে বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারলে?
ন‌ওশাদ এগিয়ে এলো , আব্বা ও আর যাবে না ঠিক আছে !
হুম আর কখনো যাবে না বুড়ো মানুষ একা থাকি সারাক্ষণ !
হেরা এসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো শ্বশুর কে !
হেরার মাথায় হাত দিয়ে তিনি বললেন, ভালো থাকো । ন‌ওশাদ তোমার সঙ্গে ঝগড়া করলে তুমি আমার কাছে এসে বলবে, রাগ করে বাবার বাড়ি যাবে না । এই বাড়ি তোমার , তুমি কেন যাবে প্রয়োজনে ন‌ওশাদ কে বের করে দিব !
আর বাবু তুই কি রে ব‌উ এর সঙ্গে ঝগড়া করিস। আমাকে দেখেছিস তোর মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে কোন দিন ?
ন‌ওশাদ হাসছে !
আব্বা তুমি রাতের ওষুধ খেয়েছো ?
হুম খেয়েছি !
তাহলে ঘুমাও আর একটা কথা আমি কয়দিনের জন্য দেশের বাহিরে যাচ্ছি !
বৌমা যাচ্ছে তোর সঙ্গে ?
না ও এখানেই থাকবে !
তুই চিন্তা করিস না আমি আছি সবার খেয়াল রাখব, চিন্তা করিস না !
ঠিক আছে আব্বা , তুমি আছো আমার আর চিন্তা কিসের ! ন‌ওশাদ হাসলো!
যা এখন ঘুমিয়ে পর গিয়ে কালকে অনেক দূর যাবি !
ন‌ওশাদ বাবার রুম থেকে বের হয়ে বলল,
হেরা আব্বার কথা মনে থাকে না ,একেক সময় একেক পিরিয়ড এ স্টে করে । কখনো ভাবে আমি এখনও স্টুডেন্ট, কখনো আরেকটু বড় , আম্মা মারা গেছে সেই কবে সেটাও মনে থাকে না ডাকাডাকি করে আম্মার নাম ধরে ,বয়স হয়েছে ।
আমি বুঝতে পেরেছি !
তুমি কি এখন ঘুমাবে তা না হলে আমার রুমে আসতে পারো হেরা ?
কথাটা বলেই ন‌ওশাদ এর অবাক লাগলো নিজের উপর । সে কি হেরার সঙ্গে সময় কাটাতে চাইছে ? হেরার সঙ্গটা উপভোগ করছে ?
পরোক্ষনে ই মুখ ফিরিয়ে বলল,
না থাক তুমি যাও রেস্ট নাও ! কালকে সকালে যাওয়ার আগে কথা হবে !

হেরা গেস্ট রুমে ঢুকে যাওয়ার পর, ন‌ওশাদ নিজের রুমে ঢুকলো! মনে মনে চিন্তা করছে মাত্র তো চব্বিশ ঘন্টা হলো মেয়েটিকে বিয়ে করেছে সে ! যার সঙ্গে তার বয়স, মানসিকতার কিছুরই মিল নেই কিন্তু সে কিভাবে ওর সঙ্গটা চেয়ে বসলো ? তাহলে কি ওর ভেতরের একাকীত্ব টা চাইছে কেউ একজন আসুক ওর কাছে ! এত বছর তো এভাবে কাউকে কাছে পেতে ইচ্ছে করেনি ? ছয়টা বছর তো কম না!
ইচ্ছে করলেই সে কত ভাবেই একাকিত্ব টা ঘোচানোর চেষ্টা করতে পারতো কিন্তু কখনো তার মনে হয়নি কারো সঙ্গ খোঁজার!
বন্ধুদের ব‌উ থেকে শুরু করে , বিজনেস গন্ডির পরিচিত , মিডিয়ার সেলিব্রিটি কত মেয়ে তার দিকে কত ইঙ্গিত করেছে গত ছয় বছরে ,কখনো তো মনে হয়নি কাউকে নিয়ে নিভৃতে একটা সন্ধ্যা কোন রেস্টুরেন্টে বসে কাটাই অন্য চিন্তা তো অনেক দূরের ব্যাপার !
তার এক ইশারায় কত মেয়েই তার দুই হাতে ধরা দিত ! কিন্তু এমন কোন দূর্বল মুহুর্ত তার জীবনে আসেনি যে সে কারো প্রতি এক বিন্দু আগ্রহী হবে! মনের বা শরীরের কোন প্রয়োজনে ই না ! নিজের আশেপাশে এক কঠিন দেয়াল সে তুলে রেখেছে!
তবে এই মুহূর্তে তার কি হলো ?
খুব লজ্জা লাগছে নিজের কাছে ই !
ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছে এরকম একটা বিয়ে তার কপালে লিখা ছিল !
গীতির জায়গায় কাউকে বসাতে পারবে না ভেবেই সে গত ছয় বছর পার করেছে ! আজ একটা কম বয়সী মেয়ের সঙ্গে জীবন টা বেঁধে গেছে !
কি হবে এই বিয়ের ভবিষ্যৎ ?
ন‌ওশাদ চোখ বন্ধ করে চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে গেল!

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here