#তবু_সুর_ফিরে_আসে
৬ষ্ঠ পর্ব
ফজরের নামাজের পরে নওশাদ অনেকক্ষণ ঘুমালো ! অন্যদিন অফিসে যাওয়ার আগে হাঁটাহাঁটি করে আজ রুম থেকে বের হয়নি । শোয়েব নওশাদ এর রুমের দরজায় নক করছে ! গতকাল তার মায়ের শরীর খারাপ থাকায় সে এই বাসায় ছিল না ! নওশাদ এর লাগেজ ও গুছিয়ে দিতে পারেনি ! এখন তাড়াহুড়া করে গুছিয়ে দিতে হবে !
নওশাদ দরজা খুলে দিল !
সরি মামা আপনার লাগেজ গুছানো হয়নি , এখন গুছাব ! আপনার কি শরীর খারাপ ?
না ঠিক আছি ! কালকে অনেক রাত পর্যন্ত রেজোয়ান আর সুমনা ছিল তাই ঘুমোতে দেরি হয়ে গেছে !
শোয়েব নওশাদ এর লাগেজ গুছিয়ে দিল !
শোয়েব আমি আজ আর অফিসে যাব না সোজা এখান থেকে এয়ারপোর্টে যাব !
ঠিক আছে মামা !
ব্রেকফাস্ট করতে যাই চলেন মামা ?
তুমি যাও আমি আসছি !
নওশাদ একটা আকাশী পলো টি শার্ট আর নেভী ব্লু ট্রাউজার পড়ে রুম থেকে বের হয়ে এলো ! গেস্ট রুমের দরজার সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়ালো । তারপর সোজা সিঁড়ির দিয়ে নিচে নেমে এলো!
ডাইনিং টেবিলে শোয়েব অপেক্ষা করছিল !
নওশাদ চেয়ারে বসে আনারের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
তোমার নতুন আম্মা উঠেছে ?
: জ্বি স্যার ! ডাকতাম ?
: না থাক ,ওর ব্রেকফাস্ট দিয়ে এসো রুমে!
শোয়েব মনে মনে চাইছিল মামা যাকে বিয়ে করে এনেছে তাকে দেখতে! কিন্তু কালকে অফিস থেকে সোজা তাদের বাসায় চলে গিয়েছিল এখন পর্যন্ত দেখাই হয়নি !
অবশ্য এত তাড়াহুড়া র কিছু নেই একই বাড়িতে যখন থাকা হচ্ছে দেখা হবেই !
শোয়েব নওশাদকে বলল, মামা বীথি আর যুথী খালামনিরা যদি আসে বাসায় ?
বুঝলাম না ? নওশাদ চোখ তুলে শোয়েবের দিকে তাকালো!
না মানে আপনার অনুপস্থিতিতে এসে যদি ঝামেলা করে মামির সঙ্গে তাই বলছিলাম !
না এসব করবে না ! আর তুমি তো আছোই ওদের সামলে নিও !
জ্বি মামা !
শোয়েব আব্বা এবং হেরা দুজনের খেয়াল রাখতে হবে তোমার !
আপনি চিন্তা করবেন না আমি আছি মামা !
নওশাদ খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লো ! তুমি খাওয়া শেষ করো আমি রুমে যাচ্ছি শোয়েব ।
শোয়েব উঠে দাঁড়ালো ।
নওশাদ উপরে নিজের রুমে ঢুকে তার কিছু ওষুধ ব্যাগে ঢুকালো । শোয়েব এর কথাটা শুনে একটু চিন্তায় পড়লো বীথি, যুথী হেরার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না তো ?
হেরার তো কারো উপর দায় নেই , সে তো জোর করে বিয়েতে বাধ্য করেনি আমাকে ! ইনফেক্ট নওশাদ কে কেউ বাধ্য করেনি বিয়ে করতে ! সে স্বেচ্ছায় হেরাকে বিয়ে করেছে !
বীথির সঙ্গে কথা বলা দরকার ! কিন্তু যাওয়ার আগে তো সম্ভব হচ্ছে না ! এসব নিয়ে যখন ভাবছে আনারের মা এসে দরজায় দাঁড়ালো!
স্যার আপনার চা !
হুম !
তোমার নতুন আম্মা কে একটু আসতে বলো তো !
জ্বি স্যার বলতেছি !আনারের মা গেস্ট রুমের দিকে ছুটে গেল!
নওশাদ চিন্তা করলো হেরাকে একটু বলে যাওয়া ই ভালো হবে বীথি আর যুথীর বিষয়ে !
হেরার ভবিষ্যৎ টা চিন্তা করতে হবে ওর ! হেরা কি চায় সেটা আগে জানতে হবে ! বাহির থেকে ফিরে হেরার সঙ্গে কথা বলবে !
নওশাদের মনটা সকাল থেকেই কেমন ভার হয়ে আছে কেন জানি! ভালো লাগছে না কিছু ! খুব ক্লান্ত লাগছে !
স্যার ?
তাকিয়ে দেখে আনারের মা দাঁড়িয়ে আছে !
নতুন আম্মা গোসল করে ! আমি বইলা আসছি আসতেছে !
ঠিক আছে যাও !
নওশাদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিজে রেডি হতে গেল !
কিছুক্ষণ পর দরজায় খুব হালকা হাতে টোকা দিচ্ছে কেউ ! নওশাদ বুঝতে পারছে হেরা এসেছে ! শার্ট টা গায়ে চাপিয়ে দরজা খুলে দেখে হেরা দাঁড়িয়ে আছে !
লাল রঙের একটা সেলোয়ার কামিজ পড়া ! মাথায় ওড়না টা দেয়া !
ভেজা চুল গুলো ছাড়া ! ফর্সা গোল মুখে ঐ দুটো চোখ দেখলেই নওশাদের ভেতরটা কেমন যেন হয়ে উঠে!
সদ্য গোসল করেছে বলেই হেরার মুখটা আরো বেশি স্নিগ্ধতায় ভরা !
নওশাদ মুগ্ধ হয়ে দেখছে ! ওর মনটা ভালো হয়ে গেল হেরাকে দেখে।
শান্ত গলায় বলল, ডেকেছেন আমাকে ?
ও হ্যাঁ, এসো ভেতরে !
হেরা ঘরে ঢুকতেই নওশাদ নিজেই দরজা টা বন্ধ করলো !
তোমার গলা ভার কেন ? কান্নাকাটি করেছো নাকি হেরা ?
না আমার একটু ঠান্ডা লেগেছে তেমন কিছু না এসি তে থেকে আমার অভ্যাস নেই তো !
খারাপ লাগলে এসি বন্ধ করে দিবে ! দাঁড়িয়ে আছো কেন বসো !
হেরা নওশাদ এর রুমের কর্নারে রাখা সুন্দর কাঠের দুটো চেয়ার আছে সে একটা চেয়ারে গিয়ে বসলো!
নওশাদ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে আড় চোখে হেরা কে খেয়াল করছে !
ব্রেকফাস্ট করেছো ?
জ্বি !
হেরা আমি কিছুক্ষণ পর চলে যাচ্ছি দেশের বাহিরে। পাঁচ দিনের মত থাকব আমি ছাড়া বাসার সবাই আছে তোমার কোন অসুবিধা হবে না !
কোথায় যাচ্ছেন ?
বুলগেরিয়া ইউরোপের একটা দেশ !
জানি ক্যাপিটালের নাম টাও খুব সুন্দর !
তুমি জানো নামটা , আমি ই তো জানি না ?
সোফিয়া !
বাহ্ !
ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার সময় পড়েছিলাম ! তারপর প্রাইমারি স্কুলের টিচারের চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলাম তখন অনেক কিছু পড়তে হয়েছে।
তোমার চাকরী হয়েছিল নওশাদ অবাক হয়ে বলল !
না ! হেরা মাথা নিচু করে ফেলল ! লিখিত পরীক্ষায় টিকেছিলাম কিন্তু ভাইভা পরীক্ষা দিতে দেয়নি নুরুল।
কেন ?
নওশাদ হেরার সামনের চেয়ারটাতে এসে বসলো ! নুরুল তো কম শিক্ষিত ছিল সে চায়নি আমি চাকরি করি ! ভার্সিটিতে পড়তে গেলাম প্রথমে হলে সিট পাইনি একটা বাসায় কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে সাবলেট থাকতাম । সেই বাসা থেকে ক্লাস করতে যাওয়া আসার পথে প্রতিদিন ডিস্টার্ব করতো ! বাসায় ঢুকে পড়তে চাইতো জোড় করে! বাড়ির মালিক আমাকে বললেন বাসা ছেড়ে দিতে । মামারা ও বলল পড়াশোনা বাদ দে । আমার তো মতামতের কোন জোড় ছিল না কারো উপর ! নানা তার পেনশন এর টাকায় আমাকে লেখাপড়া করিয়েছেন ! নানার খুব শখ ছিল আমাকে পড়াবেন। বিসিএস পরীক্ষা দেয়াবেন !
তোমার কি ইচ্ছে ছিল?
চুপ করে রইলো হেরা !
আগে যা ইচ্ছে ছিল সেগুলো না হয় দেখা যাবে পরে, তুমি আবার পড়াশোনা শুরু করো হেরা !
হেরা অবাক হয়ে বলল, কিভাবে ? আমার তো ইয়ার লস গিয়েছে!
নওশাদ বলল, সেসব কোন ব্যাপার না তোমাকে একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি করে দেই !
না না অনেক টাকার ব্যাপার , লাগবে না !
কত টাকার ব্যাপার ? পাঁচ লাখ, দশ লাখ ?
এ-ত টাকা? হেরা বড় বড় চোখে তাকালো !
নওশাদ হেসে দিল !
আমি বুলগেরিয়া থেকে আসি তোমাকে ভালো একটা ভার্সিটিতে ভর্তি করে দিব তুমি পড়াশোনা করবে ঠিক আছে ! কোন সাবজেক্টে পড়তে চাও সেটা তুমি চিন্তা করে রেখো !
ভার্সিটিতে পড়তে হলে আমাকে এই বাসার বাহিরে যেতে হবে একা ,নুরুল আর তার লোকজন ঠিকই আমাকে খুঁজে বের করে তুলে নিয়ে যাবে তখন ! আমার পড়াশোনা র দরকার নেই ! হেরা আতংকিত চোখে নওশাদ এর দিকে তাকিয়ে আছে!
নওশাদ হেরার সামনে এসে দাড়ালো ! তারপর বলল, হেরা তোমার আমার ক্ষমতা সম্বন্ধে কোন ধারণাই নেই । তাই ভয় পাচ্ছো এই ঢাকা শহরে শখানেক নুরুল কে আমি নওশাদ আজমী পকেটে নিয়ে ঘুরি ! যে কোন সময় ইচ্ছে করলেই পকেটে পিসে মেরে ফেলতে পারি কেউ টেরই পাবে না !
নওশাদ এর দিকে অবাক হয়ে তাকালো হেরা ।
কি ,তাকিয়ে কি দেখছো ?
আপনার অনেক টাকা, অনেক ক্ষমতা ?
নওশাদ হেসে দিল !
যাদের টাকা থাকে অটোমেটিক তাদের কাছে ক্ষমতা চলে আসে ! আমার অনেক টাকা নেই, তবে আছে কিছু টাকা !
আমি তো জানি যাদের অনেক টাকা থাকে তারা অনেক কঠিন মানুষ হয়, বয়স্ক হয়, অনেক খারাপ ও হয় !
আর কি কি হয় হেরা ? নওশাদ হাসছে
অনেক গম্ভীর থাকে , মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে !
আমাকে তোমার কেমন মানুষ মনে হচ্ছে ?
অনেক ভালো মানুষ , হাসি খুশি মানুষ হেরা গলা নামিয়ে বলল।
বয়স্ক মানুষ মনে হচ্ছে না ?
না !
নওশাদ এর খুব মজা লাগছে হেরার সঙ্গে কথা বলে ! মেয়েটার মধ্যে কত সরলতা ।
বুঝলে হেরা টাকা দিয়ে মানুষের ভেতরের গুন গুলো পরিমাপ করা যায় না ! আমার আজকের এই অর্থ বিত্ত অর্জন করতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে এই পরিশ্রম করতে গিয়ে আমি আমার ভেতরের আমি টাকে হারিয়ে যেতে দেইনি ! তাই তোমার কাছে মনে হচ্ছে আমি হাসি খুশি মানুষ ! আমি আরো হাসিখুশি ছিলাম গীতি আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর একা হয়ে গেছি !
উনার একটা ছবি দেখাবেন আমাকে ?
শিওর দেখাচ্ছি দাঁড়াও !
নওশাদ বেড সাইড ড্রয়ার থেকে গীতির ছবির ফ্রেম টা বের করলো !
এই যে গীতি আরা !
হেরা হাতে নিল ফ্রেমটা, ছবিটা দেখলো !
আপনার ছেলে দেখতে উনার মত তাই না ? পাশে রাখা নিশালের ছবির দিকে তাকিয়ে বলল হেরা।
হুম ! নিশাল মায়ের মত দেখতে !
হেরা ছবিটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখলো !
নওশাদ বলল, হেরা এই বাসা এত দিন নানান জনের কথায় চলেছে । যারা এই কাজ নিজ দ্বায়িত্বে করতো তাঁরা তোমার উপর একটু রাগ থাকবে ! তাদের উপর তুমি মন খারাপ করে থেকো না !ওরা সবাই আমার আপন জন । আমি নিজেও ওদের উপর রাগ করে থাকতে পারব না কষ্ট দিতে পারব না !
কিন্তু হ্যাঁ এটাও ঠিক তুমি এখন আমার পার্ট অব লাইফ তোমাকে কেউ কষ্ট দিক সেটাও আমি মেনে নিব না ! তোমার যে কোন সমস্যা হলে সবার আগে আমাকে জানাবে , কেউ কোন কথা শোনালেও !
হেরা মাথা নিচু করে নওশাদ এর কথা গুলো শুনছে !
বীথিকে কে তো ঐ দিন দেখলে , ও একটু রাগী টাইপের । মাথা গরম করে তোমাকে কিছু বলে ফেলতে পারে, আমি খেয়াল রাখছি সেরকম কিছু যেন না হয় কখনো! তারপরও তুমি আমাকে বলবে । ও মেয়ে হিসেবে খুব ভালো বুঝলে ।তো হঠাৎ বিয়ে করেছি তাই সবাই একটু শকে আছে !
আর কেউ বিয়েটা কিভাবে হলো, কোন পরিস্থিতিতে হলো , তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় কিভাবে হলো কখনো প্রশ্ন করলে বলবে সবার সব প্রশ্নের উত্তর আমি দিব ! আমাকে প্রশ্ন করতে !
ঠিক আছে !
কিছুক্ষণ চুপ থেকে নওশাদ বলল,
তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব হেরা ?
তোমার বাবা মা বেঁচে আছে ?
হেরা মাথা নিচু করে ফেলল আবার !
জ্বি বেঁচে আছে !
তাহলে তাদের যে দেখলাম না , স্যার তোমাকে মানুষ করেছেন কেন সেটাও বুঝলাম না !
আমার বাবা সিঙ্গাপুর থাকত আমার যখন পাঁচ কি ছয় বছর বয়স তখন তিনি কোথায় যেন আরেকটা বিয়ে করে ফেলেন ! আমার মা আর আমাকে নানা ভাই নিজের কাছে নিয়ে আসেন তখন ! নানা ভাইয়ের স্কুলেই পড়তাম আমি !
তোমার মা ,তিনি কোথায় ?
আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি তখন মা আমাকে ফেলে একজনের সঙ্গে পালিয়ে চলে যান ! আসলে ঐ সংসারে আমাকে নিতে চায়নি আর মামারা আমাকে রাখবে কেন তাই কাউকে না জানিয়েই মা হঠাৎ একদিন চলে গেল ! নানা ভাই আর নানু আমাকে ফেলতে পারেনি তাই অনেক কষ্ট করে মামা মামী দের ইচ্ছা র বিরুদ্ধে আমাকে বড় করেছেন ! তারপর যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন থেকে শুরু হয় গ্রামের ছেলেদের অত্যাচার ! আমি বাড়ি থেকে বেরই হতাম না ! যার মা বাবা এভাবে তাকে ফেলে চলে যায় তার জীবন যে কতটা দূর্বিশহ আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না ! গ্রামের মহিলারা আমাকে নিয়ে সারা জীবন কত হাসি তামাশা করতো ! এমনকি আমার দুই মামি সারাক্ষন উঠতে বসতে মায়ের জন্য কথা শুনাতে !
ঘরে বাহিরে কি এক যন্ত্রণার জীবন আমি পার করেছি আমি জানি আর নানা ভাই জানে !
হেরা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো !
নুরুল ছেলেটা আমার এক ক্লাস উপরে পড়তো আমাদের স্কুলে! বখাটে ছেলে পড়াশোনা নেই, মারামারি, নেশা করা এসব করে বেড়ায় ! ওর জন্য স্কুলেও কত মানসিক অত্যাচার সহ্য করেছি ! সবাই ভালো রেজাল্টের জন্য প্রাইভেট টিচারের কাছে পড়তো, নানার এত টাকা ছিল না আমি কোন স্যারের কাছে পড়তে পারি নাই ! নানাই পড়াতো !
কলেজে উঠতেই ছেলেদের অত্যাচার আরও বেড়ে গেল ! কলেজ ছিল বাড়ি থেকে দূরে , যাওয়া আসার পথে নুরুল দলবল নিয়ে পুরো রাস্তা মটরসাইকেল নিয়ে পিছনে পিছনে যেত ! কোন মেয়েকে আমার সঙ্গে কলেজে যেতে দিত না তাদের ফ্যামিলি। একা কলেজে যেতে পারতাম না !
কলেজ বন্ধ করলাম বাসায় বসে পড়তাম! মামীদের সংসারের সব কাজ করে দিতে হতো ! তারপর পড়তে বসতে পারতাম ! একটা সময় নুরুল সন্ধ্যা হতেই বাসার চালে ঢিল ছুড়া শুরু করলো ! গভীর রাত পর্যন্ত একটু পর পর চালে ঢিল ছুড়তো ! বৃষ্টির মত ঢিল ছুড়তো কখনো।
ঘরের পিছনে গিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত আওয়াজ করতো ! নাম ধরে ডাকাডাকি করতো !
কি যে লজ্জার বিষয় ছিল! চেয়ারম্যান , গ্রামের মাতব্বর দের কাছে বলেও কোন লাভ হয়নি।
তারা নানাকে, মামাদের বলতো মেয়েকে সামলে রাখেন ! বিয়ে দিয়ে দেন। মামারা বিয়ে দিতে চাইলো ! আমিও ভাবলাম বেঁচে ই যাব হয়তো ! কিন্তু বিয়ের সম্বন্ধ আসলে তাদের হুমকি ধমকি দিয়ে বিদায় করেছে।
আমার খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করলো চুপিচুপি নানা মামারা। কোথা থেকে শুনলো নুরুল ,ঐ ছেলেকে মেরে পা ভেঙ্গে দিল। খালাতো ভাই টা তাও বিয়ে করতে চাইলো কিন্তু খালু আর তাদের ফ্যামিলি রাজি হলো না !
আমি ভয়ে চুপসে থাকতাম! নানা বলতো আল্লাহ কে ডাক একদিন আল্লাহ রহমতের ফেরেশতা পাঠাবেন সেদিন কোন নুরুল কিছু করতে পারবে না দেখিস !
আমি রাতভর তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে কাদতাম ! কিছুক্ষণ দম নিয়ে হেরা বলল, এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারব না ভেবেছিলাম হঠাৎ মটরসাইকেল চুরির মামলায় নুরুল আর তার লোকজন ধরা খায় সেই মাসে আমি পরীক্ষা দিয়ে ফেলি কিন্তু দুই মাস পর জামিন নিয়ে আবার চলে আসে সব । দুইটা গোল্ডেন ফাইভ পেয়েও পড়াশোনা করা হলো না আমার !
নানা ভাই বলতো পড়াশোনা করলেই মুক্তি পাবি যা পাবি শুধু পড়বি ! বিদ্যা কখনো বিফলে যায় না !
আল্লাহ কে ডাকতাম তাই ওরা আমার গায়ে হাত তোলার আগেই আল্লাহ হেফাজত করেছে কিন্তু কেউ তো বিশ্বাস করলো না !
আপনি বিশ্বাস করছেন তো আমাকে ? হেরার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে !
নওশাদ হেরার মাথায় হাত রাখলো !
আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি হেরা ! আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে, তোমার যত পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করবে আমি করাব ! আর ঐ নুরুল দের নিয়ে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই আমি আসি, এখানে বসে ওদের আমি টাইট দিব !
না থাক ওরা অনেক ভয়ংকর পরে আমার জন্য আপনার ক্ষতি করুক আমি চাই না !
আমার ক্ষতি করার সাহস পাবে না ! আমি বললাম না ওদের মত গুন্ডা আমি পকেটে নিয়ে ঘুরি ! ঠিক আছে তুমি যখন ভার্সিটিতে যাবে তোমার জন্য আমি পার্সোনাল সিকিউরিটি দিব যে তোমাকে প্রটেক্ট করবে প্রয়োজনে লাইসেন্স করা অস্ত্র নিয়ে ! হেসে দিল হেরা , এত কিছু লাগবে না !
তুমি নওশাদ আজমী র রেসপনসিবিলিটি দেখো সে কি করতে পারে তোমার জন্য!
নওশাদ ও হাসছে!
মন খারাপ করো না । আচ্ছা তুমি আসার পর তোমার নানার সঙ্গে কথা বলোনি, তিনি হয়তো চিন্তা করছেন তুমি একবার কথা বলবে ?
আজ না থাক !
যখন ইচ্ছা হবে ফোন দিয়ে কথা বলো ! ভয়ের কিছু নেই !
ঠিক আছে !
আপনার গোছানো শেষ , কখন বের হবেন ?
এই তো আধা ঘন্টা র মধ্যে ! সুমনা আসতে পারে তোমাকে নিয়ে যেতে তুমি যেতে পারো তোমার ভালো লাগবে ওর সঙ্গে !
ঠিক আছে !
ও আচ্ছা একটা কথা হেরা তোমার কিছু লাগলে আনারের মা কে বলবে কিংবা লিখে দিও রিয়াজ কে দিয়ে এনে দিব !
মৃদু গলায় হেরা বলল,আমার একটা জিনিস লাগতো !
হ্যাঁ বলো আমাকে আমি বলে দিচ্ছি !
হেরা চুপ করে রইলো ! লজ্জা লাগছে ওর চাইতে ! কারো কাছে কিছু চাইতে এমনিতেই খুব লজ্জা লাগে ওর, উনার কাছে চাইতে আরো লজ্জা লাগছে!
চুপচাপ কেন বলো কি লাগবে ? নওশাদ হ্যান্ড ব্যাগ এ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ভরতে ভরতে তাকালো !
আমাকে কাঁচের বা অন্য যে কোন ইমিটেশন এর একজোড়া চুড়ি এনে দিতে বলবেন কাউকে ! আমার নানু বলতো বিবাহিত মেয়েদের হাত খালি থাকতে হয় না ! অমঙ্গল হয় হাজব্যান্ডের ! শেষের কথাটুকু বিড়বিড় করে বলল হেরা !
নওশাদ অবাক হয়ে তাকালো ! হেরা নিজের পায়ের আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে ওর সামনে । কিন্তু এই লজ্জা মাখা মুখটা দেখতে নওশাদের এত ভালো লাগছে মনে হচ্ছে সময় থেমে যাক ও এই মুখটা অনন্ত কাল দেখতে থাকুক।
তার মঙ্গল, অমঙ্গল এর চিন্তা করছে মেয়েটি ! অনেক বছর পর কেউ তার জন্য অলংকারে সাজতে চাইছে ! বোকা মেয়ে জানে না দুটো হাতের চুড়িতে কারো ভালো, মন্দ আটকে থাকে না !
ঠিক আছে হেরা আমি কাউকে বলে দিব ! এক কাজ করো সুমনা কে বলে দেই আমি, ওর সঙ্গে গিয়ে পছন্দ করে কিনে আনো তুমি !
না থাক আপনি আসুন তারপর , আমি যাব না কোথাও !
ঠিক আছে আমি এনে দিতে বলছি !
শোয়েব হুট করেই দরজা খুলে রুমে ঢুকে পড়লো । এত দিনের অভ্যাস তার । কিন্তু আজ রুমে ঢুকেই সে পুরো হতভম্ব হয়ে গেল । নওশাদ আর হেরা কে দেখে।
এই প্রথম সে হেরা কে দেখছে !
তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না ! শুধু তাকিয়ে আছে । তার মনে হচ্ছে একটা পরী হয়তো চলে এসেছে ঘরে ! নওশাদ এর ডাকে তার হুঁশ হলো!
শোয়েব তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়নি হেরার তাই না ?
সরি মামা আমি জানতাম না ! সরি !
ইটস ওকে , হেরা ও আমার ভাগ্নে শোয়েব ! ও আমার খুব প্রিয় একটা মানুষ আমার এসিস্ট্যান্ট, থাকে এই বাসায় তোমার যা লাগবে , যে কোন অসুবিধা হলে ওকে বলবে !
জ্বি !
শোয়েব হেরা কে তা তো বুঝতেই পারছো !
জ্বি মামা !
নাও সী ইজ ইওর এনআদার রেসপনসিবিলিটি ! আমি থাকব না নানা ভাই আর ওর খেয়াল রেখো!
জ্বি মামা !
আমি নিচে যাচ্ছি মামা আপনি আসেন !
আচ্ছা কি বলতে এসেছিলে ?
আপনার পাসপোর্ট আর ল্যাপটপ ঠিক মত ঢুকিয়েছেন কিনা সেটাই বলতে এসেছি !
নিয়েছি !
আমি যাই আপনি আসেন !
শোয়েব যাওয়ার সময় আরেক বার হেরার দিকে তাকালো! ওর চোখে মুখের মুগ্ধতা, হতভম্ব ভাব কাটছে না !
বীথি খালামনি তো ঠিক কথাই বলেছে কম বয়সী একটা মেয়ে । এত সুন্দর কোন মেয়েকে সে সামনাসামনি কখনো দেখেনি ! বিয়েটা কিভাবে হলো এখনো মামা তাকে বলেনি ! এখন তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে !
নওশাদ আর হেরা রুম থেকে বের হয়ে এলো ! নওশাদ তার আব্বার ঘরে গিয়ে বিদায় নিয়ে এলো ! তারপর দুজনে ড্রয়িং রুমে এসে বসলো! শোয়েব কিসব ফাইল এনে দিল এগুলো সঙ্গে গুছিয়ে নিলো নওশাদ।
হেরা সোফায় বসে দেখছে নওশাদ কে। নীল শার্ট আর গ্রে কালারের প্যান্ট পড়া মানুষটাকে কত সুন্দর লাগছে। কি অদ্ভুত সুন্দর করে কথা বলে সবার সঙ্গে। আজ তিন দিন হয়েছে এই বাড়িতে এসেছে সে কিন্তু কারো সঙ্গে একটু উঁচু গলায় কথা বলতে দেখেনি। সেদিন বীথি নামের মানুষ টা এত রাগারাগী করলো কিন্তু এই মানুষ টা একটু ও বিচলিত হলো না !
হেরার সঙ্গে কত সুন্দর ব্যবহার করে ! যত দেখছে মানুষ টা কে তত সে মুগ্ধ হচ্ছে। হেরা তার বিবাহিতা স্ত্রী ইচ্ছে করলেই হেরাকে সে নিজের অধিকার দিয়ে দখল করে নিতে পারে হেরার বাঁধা দেয়ার কোন অধিকার বা উপায়ও নেই কিন্তু না , তিনি একবারও সেরকম চোখে তাকাচ্ছেন ও না। হেরার কাছে অদ্ভুত লাগছে ব্যাপার টা!
সারাজীবন তো এক দুইজন ছাড়া সব পুরুষই দেখলো যারা চোখের দৃষ্টি দিয়েই গিলে ফেলতে চেয়েছে তাকে।
কিন্তু এই মানুষটা তো তাকে শুধু অবাক না মুগ্ধ করে দিচ্ছে।
নওশাদ একবার চোখ তুলে ওর দিকে তাকালো । লজ্জা পেয়ে হেরা চোখ নামিয়ে ফেলল সঙ্গে সঙ্গে !
পারুল চায়ের ট্রে নিয়ে এসে পাশে দাঁড়ালো ! চার দিন জ্বরে ভুগে আজ সে একটু ঠিক হয়েছে।
নওশাদ চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে হেরার দিকে তাকালো।
হেরা কে পারুল কাপ তুলে দিল। সে মুগ্ধ হয়ে দেখছে হেরা কে ! তার কাছে মনে হচ্ছে সিনামার নায়িকাদের মতো সুন্দর একটা মানুষ তার সামনে ! স্যার যেমন সুন্দর উনার বউটাও অনেক সুন্দর হইছে !
হুদাই বীথি খালাম্মা এই মানুষটা র পিছে লাগছে , আহারে কি সুন্দর মুখ মাইয়াটার !
শোয়েব পারুলের দিকে তাকিয়ে বলল , যাও আনারের মা কে আসতে বলো !
আনারের মা কে নওশাদ বলল,
আব্বার খেয়াল রেখো । আর তোমার নতুন আম্মা কিছুই জানেনা এই বাসার, তুমি সব সময় সঙ্গে সঙ্গে থেকো !
স্যার আপনি চিন্তা কইরেন না !
নওশাদ উঠে দাঁড়ালো !
শোয়েব আনারের মা কে ইশারা করতেই আনারের মা চলে গেল সেখান থেকে ।
মামা আমি গাড়ির কাছে আছি ! শোয়েব ও উঠে চলে গেল !
হেরা চায়ের কাপ নামিয়ে দাঁড়ালো !
তুমি ভয় পেয়ো না হেরা এখানে সবাই তোমার খেয়াল রাখবে।
হেরা সব সময় যেভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সে চুপচাপ ই দাঁড়িয়ে রইল সেভাবে!
নওশাদ তাকিয়ে আছে হেরার দিকে!
আসি তাহলে হেরা !
জ্বি!
হেরার খুব বলতে ইচ্ছে করছে সাবধানে থাকবেন , কিন্তু তার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হলো না !
( চলবে )