এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ১৩.

0
219

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৩.

২০১৩ সাল। বর্ষার কোনো এক বিকেল। ধরাপটে নেমেছে আকাশ ভেঙে তীব্র বর্ষণ। জনমানবহীন পাকা রাস্তায় জপজপ শব্দ তুলে দৌড়াচ্ছে এক কিশোরী। গায়ে পরিহিত অভারসাইসড টি শার্ট এবং লেগিংসটা বৃষ্টিতে ভিজে গায়ের সাথে আষ্টেপৃষ্টে রয়েছে। খোলা চুলের আগা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু পানি। কাধে তার বিশাল সাইজের একটা গিটারের ব্যাগ প্যাক। তার পায়ের গতি স্থির হয় স্কুলের কাছাকাছি একটা সুনসান রাস্তায় এসে। এই রাস্তাটা সাধারণত সাধারণ মানুষ এড়িয়ে চলারই চেষ্টা করে সবসময়। তার অন্যতম কারণ হলো রাস্তার দু ধারে থাকা সারিবদ্ধ বিশাল বাঁশ ঝাড়। লোকমুখে শোনা যায় জায়গাটা খুব একটা সুবিধার না। অশরীরীদের আবাস্থল স্থানও বলা হয় এই জায়গাটাকে।

কিন্তু বাণী সেই লোকমুখে বলা কথাগুলো কখনো কানে তুলে নি। এসব ব্যাপারে ভয়ডর তার সবসময়ই কম। তার বাসা থেকে স্কুলে পৌঁছানোর শর্টকাট রাস্তা এটা। বাণী সর্বদা শর্টকাট প্রেমী মেয়ে। যেখানে এই রাস্তা ধরে পনেরো মিনিটে স্কুলে পৌঁছানো যায়, সেখানে অযথা পয়ত্রিশ মিনিট ঘুরে অন্য রাস্তা দিয়ে স্কুলে যাওয়ার কোনো মানে খুঁজে পায় না সে।

তবে আজ ঘটনা ভিন্ন। আজ সে স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এতক্ষণ দৌড়ে এই রাস্তায় এসে থামে নি। আজ সে অন্য উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে। তার সিক্ত নয়নযুগলের অশ্রু বৃষ্টির পানি বারবার ধুয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। বাণী নীরবে নিজের কাধের গিটারের ব্যাগপ্যাকটা নামিয়ে ছুড়ে রাস্তার একপাশে ফেলে দেয়। বুকের ভেতরটা খান খান হয়ে যায় তার। কষ্টের ভার বইতে না পেরে বাণী নিজেও রাস্তার ধারে বসে পড়ে। কান্নারত মুখশ্রী হাঁটুর ভাজে আড়াল করতেই এতক্ষণের নীরব কান্না এবার সুর তুলে। কি করুণ সেই কান্নার সুর! যেনো সত্যিই কোনো অশরীরী কাঁদছে।

সময় গড়ায়। হৈ হৈ হুঙ্কার তুলে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। সরু চিকন বাশগুলোও সেই বাতাসের প্রকোপে এদিক সেদিক দুলছে অবিরত। ঠিক সন্ধ্যা নামার আগ পর্যন্ত চলে বাণীর অশ্রু বিসর্জন এবং মেঘ জমা আকাশের করুণ বর্ষণ। যেই মুহুর্তে বৃষ্টি থেমে গেলো সেই মুহুর্তে যেনো বাণীও নিজের সম্বিত ফিরে পেলো। আদ্র হাতের পিঠ দিয়ে দু চোখের পাতায় জমে থাকা জল মুছে নেয় সে। কাকভেজা শরীর মৃদু থরথর করে কাঁপছে। বলা হয় কিশোরী হৃদয় বড়োই নাজুক প্রকৃতির হয়ে থাকে। অনেকটাই স্বচ্ছ কাঁচের ন্যায়। সামান্য আঘাতেই ভেঙে গুড়িয়ে যায়। তবে একটা বিষয়ে কাঁচ ভাঙার সঙ্গে হৃদয় ভাঙার পার্থক্য রয়েছে। তা হলো কাঁচ ভাঙে তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে। কিন্তু কিশোরী হৃদয় ভাঙে অতি নীরবে। কোনো শব্দ হয় না তাতে।

দুঃসহ যন্ত্রণা বুকে পুষে কম্পিত চিত্ত তুলে উঠে দাঁড়ায় বাণী। নিজের অতি প্রিয় গিটারের সঙ্গে নিজের চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া হৃদয়টাকেও অবহেলার সহিত রাস্তার এককোণে ফেলে রেখে প্রস্থানের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সে। পিছনে ফিরে তাকায় না একবারও। অবশ্য ফিরে তাকানোর মতো অবস্থায়ও ছিলো না সে। কয়েক ঘন্টা বৃষ্টিতে ভেজার ফলস্বরূপ কতদূর যাওয়ার পরই চেতনা হারিয়ে মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে যায় সে।

__________

বর্তমান,

গায়ে অসহন জ্বর। জ্বরে কাবু হয়ে ঘোরের মধ্যে কাতরাচ্ছে বাণী। গায়ের চামড়া যেন জলন্ত অগ্নিকুণ্ড হয়ে আছে। যে ছুঁয়ে দেওয়ার স্পর্ধা করবে সেই এই তীব্র উত্তাপে ভস্ম হয়ে যাবে। আচানক মাথায় আদুরে নারী হাতের ছোঁয়া পেতেই বাণী ভারী চোখের পাতা মেলে তাকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সে পারে না। ভাঙা গলায় অস্পষ্ট সুরে গোঙ্গায়,

“ মা। “

ডক্টর হুমায়রা অভিজ্ঞ হাতে একবার বাণীর কপালটা ছুঁয়েই নিজের হাতটা সরিয়ে ফেলে। অত:পর একটা ডিজিটাল থার্মেমিটারের একাংশ মৃদু কম্পিত ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে গুজে দেয়। এক মিনিট সময় গড়াতেই থার্মোমিটার হতে ভেসে আসে মৃদু এলার্ম জাতীয় শব্দ। হুমায়রা থার্মোমিটারটা হাতে নিয়ে চশমা ভেদ করে দেখে নেয় বাণীর শরীরের তাপমাত্রা। দেখতেই তিনি চিন্তিত গলায় শুধায়,

“ একশো চার ডিগ্রী! “

বিছানার শিয়রেই দাঁড়িয়ে ছিলো হিরণ। হুমায়রার কথা শুনেই সে উদ্বেগ মিশ্রিত স্বরে প্রশ্ন করে,

“ নিউমোনিয়া হওয়ার আশংকা আছে? “

“ কতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছে? “

এই বাড়ির নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে বাড়ির প্রতিটা কোণাতেই রয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা। ব্যাক ইয়ার্ডও সেই ইলেক্ট্রিক ক্যামেরার নজরদারির বহির্ভূত নয়। ডক্টর হুমায়রাকে কল করেই একজন মেইডকে বাণীর ভেজা কাপড় পরিবর্তনের দায়িত্ব দিয়ে হিরণ সেই সিসিটিভি দ্বারা ধারণকৃত ফুটেজ দেখতে বসে।

ঠিক রাত ৩ টা বেজে ১৩ মিনিটে তীব্র বর্ষণ মাথায় নিয়ে বাড়ির ব্যাক ইয়ার্ডে গিয়ে হিজল গাছটার নিচে বসে বাণী। গাছের আড়ালে বসায় পিছন হতে আর বাণীর মুখ দেখা যায় না। তবে কান্নার দমকে তার কম্পিত পিঠ সিসিটিভিতে স্পষ্ট দেখা যায়। কাঁদতে কাঁদতে একটা সময় বাণী মাটি খামচে ধরে দু’হাতের মুঠোয়। এরকম করে প্রায় এক ঘন্টা বারো মিনিটের মাথায় তার নিস্তেজ দেহ ধীরে ধীরে একপাশে হেলে পড়ে।

সিসিটিভি ফুটেজ অনুসারে সময়ের হিসাব দিয়ে হিরণ বলে উঠে,

“ প্রায় চার ঘন্টা। “

পয়ত্রিশ বছর বয়সী ডক্টর হুমায়রার ভ্রু কুচকে আসে হিরণের কথার পিঠে। একটা মেয়ে তিন ঘন্টার অধিক সময় ধরে বৃষ্টিতে ভিজে চেতনাহীন অবস্থায় পড়ে ছিলো, অথচ একটা মানুষও তা দেখলো না? মনে মনে এই প্রশ্ন জাগলেও ডক্টর হুমায়রা মুখ ফুটে আর তা আর জিজ্ঞেস করে না। এই বাড়ির ব্যক্তিগত ব্যাপার হতে সে যত সম্ভব দূরে থাকারই চেষ্টা করে সবসময়।

উনার ভাবনার মাঝেই হিরণ বলে,

“ বাণীর আগেও একবার নিউমোনিয়া হয়েছিল। কোনো সমস্যা হবে না তো আবার? “

“ কবে হয়েছিলো? “

“ এগারো বছর আগে। বেশ অনেকদিন ভুগেছিলো। “

ডক্টর হুমায়রা কপালে ভাজ নিয়েই একটি ছোট নোটপ্যাডের সাদা কাগজে কলমের কালো কালি বসিয়ে ইংরেজিতে কিছু শব্দগুচ্ছ লেখে। অত:পর কাগজটা ছিড়ে হিরণের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

“ আপাতত এই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মেডিসিন গুলো দিতে হবে। আশা করছি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে। “

ডক্টর হুমায়রা প্রেসক্রিপশন বুঝিয়ে দিয়ে চলে যেতেই হিরণ ইবাতকে ডেকে তাড়াতাড়ি মেডিসিন আনতে পাঠিয়ে দেয়। অত:পর বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে বাণীর মাথার কাছে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা বহ্নিকে। বহ্নি নিজের ছোট ছোট হাত দিয়ে বাণীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম সুরে বলে উঠে,

“ মাম্মা উঠো। আমি ডাকছি তো। “

হিরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের পাশে বসে তাকে টেনে নিজের কোলে নিয়ে বলে,

“ অনেক বেলা হয়েছে মা। এখনো নাস্তা করো নি তুমি। “

বহ্নি মলিন মুখে বলে,

“ মাম্মা তো সিক। আমাকে কে খাইয়ে দিবে? “

“ পাপা আছি না? “

বহ্নি মলিন মুখে একবার বাণীকে দেখে নিয়ে অত:পর রাগী স্বরে শুধায়,

“ আই হেইট রেইন পাপা। “

হিরণ অবাক সুরে প্রশ্ন করে,

“ কেন? “

“ বৃষ্টির কারণেই মাম্মা সিক হয়েছে। “

মেয়ের ক্রোধ মিশ্রিত কথা শুনতেই হিরণের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে। বাণী অসুস্থ হয়ে পড়ায় সামান্য এক বৃষ্টির প্রতি বহ্নির এতো ক্ষোভ? যদি বহ্নি কখনো জানে যে বাণীর এই অবস্থার জন্য দায়ী বৃষ্টি নয় বরং হিরণ, তখন কি বহ্নি হিরণকেও ঘৃণা করবে? ভাবনাটা মনে উঁকি দিতেই হিরণের অন্তঃপুরটা গুমরে উঠে। বাণী সহ গোটা পৃথিবীর ঘৃণা সহ্য করার ক্ষমতা আছে তার। কেবল বহ্নির চোখে নিজের জন্য ঘৃণা কখনো সহ্য করতে পারবে না সে। এর থেকে মৃত্যু শ্রেয়।

হিরণ চোখ তুলে বাণীর পানে তাকায়। আরামদায়ক কোম্ফর্টারের নিচে অনেকটা কুঁকড়ে আছে জীর্ণ শীর্ণ নারী দেহটা। লাবণ্যহীন মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে কেমন ম্লান দেখাচ্ছে। বেদনার্ত দৃশ্যটা হিরণের মনে মেঘের আনাগোনা সৃষ্টি করে। তার মনে পড়ে যায় গতরাতে বাণীর বলা কথাটা,

“ আমার মেয়ে আপনার জন্য রহমত নয় বরং আপনার সবথেকে বড় শাস্তি। “

সত্যিই কি তাই? সৃষ্টিকর্তা কি হিরণকে ধ্বংস করার অস্ত্র হিসেবেই বহ্নিকে পাঠিয়েছে? শয়তানকে ধ্বংস করার অস্ত্র কি তবে তার নিজের অংশই?

__________

ফোনালাপে ব্যস্ত রাফি খেয়ালই করেনি কখন তার পিছনে ছয়জন মানুষ এসে রোবটের ন্যায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। কলটা কেটে পিছনে ফিরে তাকাতেই সে আচমকা এতো গুলো মুখ দেখে ভয় পেয়ে যায়। অত:পর নিজেকে সামলে নিয়ে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ তোরা এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? “

সাইফ চোখ সরু করে প্রশ্ন করে,

“ শালা একজন আর্মি হয়ে বাঘের মতো স্পষ্ট গলায় না গর্জে কার সাথে মিনি বিড়ালের মতো মিনমিন করে কথা বলছিলি? তুই দেখি পুরো আর্মি জাতির কলঙ্ক। “

জুনায়েদ চুইঙ্গাম চিবুতে চিবুতে বলে উঠে,

“ আরে বুঝোস না? বাঘ কার সামনে বিড়াল হয়ে যায়? “

রাফি কোনো ভনিতা না করে জবাব দেয়,

“ গার্লফ্রেন্ডের কল ছিলো। “

ফারদিন অবাক গলায় প্রশ্ন করে,

“ তোর গার্লফ্রেন্ডও আছে? কই আগে বলিস নি তো। “

প্রত্যয় রাফির চিন্তিত মুখশ্রী পরখ করে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে,

“ তোকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। অল গুড? “

রাফি এবার হতাশ ভঙ্গিতে কাঠের তৈরী বেঞ্চিতে বসে পড়ে। তার দু’পাশে বসে সাইফ এবং প্রত্যয়ও। বাকিরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়। সাদাত সিরিয়াস গলায় প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে রাফি? কোনো সমস্যা? “

রাফি উদাস গলায় বলে উঠে,

“ অন্যার বাবা ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। “

ফারদিন ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ অন্যা কে? “

রিদওয়ান পাশ হতে ফারদিনের মাথায় একটা চটা মেরে বলে উঠে,

“ বলদ ওর গার্লফ্রেন্ডের কথা বলতেসে। “

সাইফ ওদের কথায় ফোঁড়ন কেটে বলে উঠে,

“ তোদের সম্পর্কের কথা বাসায় জানিয়ে বিয়ে ভাঙতে বল তাহলে। “

রাফি জবাব দেয়,

“ ওর বাসায় জানে আমাদের ব্যাপারে। কিন্তু ওর বাবা রাজি হয় নি। “

সাদাত প্রশ্ন করে,

“ তোর মধ্যে অপছন্দ করার মতো কি পেলো? “

রাফি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ ওর বাবা ডিফেন্সের লোক পছন্দ করে না। অনেকটা পুরান ধাঁচের লোক উনি। চিন্তা চেতনাও তেমন। উনার মতে ডিফেন্সের ছেলেদের নাকি চরিত্রে সমস্যা থাকে। আমরা নাকি নেশা পানিতে আসক্ত হই। আর তাছাড়াও আমাদের জীবনের কোনো গ্যারান্টি নেই। “

এতটুকু শুনতেই সাইফের মাথায় রক্ত উঠে যায়। সে রাগী গলায় বলে উঠে,

“ ভুলে যা ওই মেয়েরে তুই। এমন শশুর তুই ডিজার্ভ করস না। আমরা যেখানে এদের জন্য নিজেদের জীবন বাজি রেখে লড়ে যাচ্ছি আর এরা কিনা আমাদের ব্যাপারে এতো চিপ ধারণা পুষে। “

সাত বন্ধুর আলাপে ভাটা পড়ে দূর্জয়ের আগমনে। সবাই সাথে সাথে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। দূর্জয় শান্ত গলায় বলে উঠে,

“ পনেরো মিনিটের মধ্যে মিটিং রুমে সবাইকে দেখতে চাই। “

এক বাক্যের আদেশটুকু ছুড়ে দিয়েই দূর্জয় শান্ত ভঙ্গিতে সেখান থেকে প্রস্থান করে। গতকাল রাতে রইস দিলদারের মুখে সেই ভবিষ্যৎ বাণী শোনার পর থেকেই তার চালচলন পূর্বের তুলনায় অধিক শান্ত হয়ে গিয়েছে। উপরে উপরে ঠান্ডা থাকলেও দূর্জয়ের ভেতরে বয়ে চলেছে অস্থিরতা। মনে ঘুরছে অসংখ্য প্রশ্ন। কি হবে? কোথায় হবে? কিভাবে হবে?

__________

সন্ধ্যা নামতে না নামতেই বাণীর জ্বর হু হু করে বেড়ে গেলো। শুধু জ্বর বাড়লেও বিষয়টা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতো না। কিন্তু জ্বরের পাশাপাশি অবচেতন অবস্থায় তার তীব্র শ্বাসকষ্টও শুরু হয়। এই পরিস্থিতি দেখে বহ্নি ও হিরণ দু’জনেই ভয় পেয়ে যায়। হিরণ দ্রুত বহ্নিকে ইবাতের সাথে রুমের বাহিরে পাঠিয়ে দিয়ে ডক্টর হুমায়রাকে কল করে বাণীর শারীরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানায়। ডক্টর হুমায়রা বিলম্ব না করে বলে,

“ ওকে এক্ষুনি হসপিটাল নিয়ে আসুন। “

বাণীর জন্য হিরণের চিন্তা আকাশসম হলেও সে হুমায়রার কথা মানে না। জেদ ধরে বলে,

“ সম্ভব না। যা যা প্রয়োজন সব নিয়ে বাসায় আসুন আপনি। বাসায় ওর ট্রিটমেন্ট হবে। “

ডক্টর হুমায়রা এবার ক্ষানিকটা বিরক্ত হয় বটে। সে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে কাটকাট গলায় বলে উঠে,

“ দেখুন হিরণ সাহেব, পেশেন্টের গুরুতর শারীরিক অবস্থা তার ডক্টর হিসেবে আমি আপনার চেয়ে ঢের ভালো বুঝি। বহ্নির জন্মের সময়ও আপনার এই একরোখা জেদের জন্য মেয়েটা মরতে মরতে বেঁচেছে। এখনো যদি আপনি সেই একই পরিস্থিতি ফেস করতে চান তবে আপনি আপনার জেদ নিয়ে থাকুন। “

অন্য সময় হলে ডক্টর হুমায়রার এহেন কথার পিঠে হিরণ ক্ষিপ্র রূপ ধারণ করতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। অলরেডি তার ভুলের সাজা মেয়েটা ভুগছে। বাণীর ভোগান্তি বাড়িয়ে দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হিরণের নেই। তাই সে বাধ্য হয়ে বলে,

“ আমি ওকে নিয়ে আসছি। কিন্তু ওর সিকিউরিটি আর প্রাইভেসির দায়িত্ব সম্পূর্ণ আপনার। সেই অনুযায়ী নিজের মেডিক্যাল টিম সিলেক্ট করুন। আমি কোনো ধরনের মিসম্যানেজমেন্ট মেনে নিবো না। “

কলটা কেটেই হিরণ দ্রুত গায়ে টি শার্ট বদলে একটা শার্ট জড়িয়ে নেয়। অত:পর রুম থেকে বেরিয়ে ইবাতকে ডেকে বলে,

“ বহ্নিকে তোমার দায়িত্বে রেখে যাচ্ছি। টেক কেয়ার অফ হার। আমার মেয়ের সামান্য অযত্ন যেনো না হয়। “

ইবাত সহ সকলকে বহ্নির দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েই হিরণ ফের রুমে প্রবেশ করে। বিছানার কাছে এগিয়ে গিয়ে বাণীকে তুলতে নিলেই বাণী তপ্ত চোখ জোড়া মৃদু মেলে তাকায়। হিরণকে দেখতেই তার নিঃশ্বাস আরো অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। ভাঙা গলায় এলোমেলো কিছু শব্দ আওড়ায়,

“ খুনি… খুনি আপনি। খুন করেছেন। “

বাণীর হ্যালুসিয়েশন হচ্ছে। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে সেই কালো রাতের স্মৃতি। সেই হিজল গাছটার সাথে বাঁধা অবস্থায় হেলে থাকা রক্তাক্ত লাশ। সেই লাশের সামনে থেকে টেনে হিচড়ে বাণীকে বাড়ির ভেতর নিয়ে আসা। অত:পর চার দেয়ালের একটা রুমের ভেতর বাণীর আবদ্ধ আত্ম চিৎকার। নিজেকে বাঁচানোর আর্তনাদ। তার অস্তিত্বের কালো অধ্যায় হিসেবে হিরণের আধিপত্য ও বিচরণ।

সবটা চোখের পাতায় ভেসে উঠতেই বাণীর বদ্ধ চোখের কার্ণিশ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। হিরণ ততক্ষণে তাকে নিয়ে গাড়ির কাছে পৌঁছে গিয়েছে। একজন এসে গাড়ির দরজাটা খুলে দিতেই হিরণ বাণীকে সাবধানতার সহিত সিটে বসাতে নেয়। সেই মুহুর্তে বাণী হিরণের কানের কাছে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে উঠে,

“ আমি মুক্ত হবো। হাজার চেষ্টা করেও আমাকে বেঁধে রাখতে পারবেন না। প্রয়োজন হয় তো আপনাকে খুন করবো। “

শেষের কথাটুকু খানিকটা ফিসফিসিয়েই বললো বাণী। তার ফিসফিসিয়ে মৃদু স্বরে বলা কথাটা হিরণের বুকে ঝড় তুললো। সে বুঝতে পারলো বাণী আপাতত নিজের মধ্যে নেই। তাই সে চুপচাপ বাণীকে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটটায় বসিয়ে দিয়ে বাণীর সিট বেল্ট বেঁধে দিতে দিতে বলে উঠে,

“ সেড়ে উঠো আগে। হাতে বন্দুক তুলে দিবো। বুকের যে পাশটায় ইচ্ছা গুলি ছুড়ে ঝাঁঝড়া করে দিও। “

__________

শান্ত কেবিনটায় সুঠাম দেহের পুরুষের আগমন ঘটতেই নিশার চোখ মুখ চিকচিক করে উঠলো। সে প্রফুল্ল গলায় বলে,

“ দূর্জয় ভাইয়া! “

দূর্জয় ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে এগিয়ে যায় প্রথমে নাঈমার দিকে। সালাম দিয়ে প্রশ্ন করে,

“ ভালো আছেন আন্টি? “

নাঈমাও মৃদু হেসে অভিযোগের সুরে বলে,

“ আলহামদুলিল্লাহ। কোথায় থাকো তুমি? অনেকদিন ধরে তোমার সাথে দেখা হয়না। তোমার সব সম্পর্ক কি শুধু লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবার সঙ্গেই? আমার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই? “

“ এরকম কথা বলে আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না প্লিজ আন্টি। আমার ব্যস্ততা সম্পর্কে তো আপনি জানেনই। এখনো বহু গুরুত্বপূর্ণ একটা কেসের মাঝে সময় করে বোনকে দেখতে আসলাম। “

নাঈমা হেসে দূর্জয়ের কাধে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

“ আমি তাহলে এখন আর তোমাদের বিরক্ত না করি। তোমরা কথা বলো। আমি গিয়ে একটু ক্যানটিন থেকে কফি খেয়ে আসছি। “

নাঈমা চলে যেতেই দূর্জয় এগিয়ে গিয়ে নিশার বেডের পাশের টুলটায় বসে বলে,

“ এখন শরীর কেমন? “

নিশা হেসে বলে,

“ ঠিক আছি। ডক্টর বলেছে ফিজিওথেরাপি নিলে আমি হাঁটতেও পারবো। “

দূর্জয়ের মুখশ্রী সামান্য মলিন রূপ ধারণ করে। নিশাকে সে ছোটবেলা থেকে চিনে। তার নিজের আপন ছোট বোন থাকলে তাকে যতটা স্নেহ করতো নিশাকেও ঠিক ততটাই স্নেহ করে দূর্জয়। সেই সুবাদেই সে জানে যে এই মেয়েটা কতটা নরম ও ভীতু প্রকৃতির।

দূর্জয় প্রশ্ন করে,

“ ভয় পেয়েছিলে খুব? “

নিশা সাহসী ভাব নিয়ে বলে,

“ একজন আর্মির মেয়েকে এই প্রশ্ন করা তোমাকে মানায় না ভাইয়া। “

দূর্জয় হেসে নিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নিশা তখন উদাস মুখে বলে,

“ কিন্তু একটা আফসোস রয়ে গিয়েছে। “

“ কি আফসোস? “

“ ওই কাপুরুষদের মুখে থুথু মারতে পারলে হয়তো আত্মতৃপ্তি পেতাম। “

দূর্জয় ও নিশার টুকটাক আলাপ চলে প্রায় বেশ কিছুক্ষণ। আচমকা একটা কল আসতেই দূর্জয় বেরিয়ে যেতে নিলে নিশা পিছু ডাকে,

“ ভাইয়া। “

দূর্জয় পিছু ফিরে শুধায়,

“ হ্যাঁ বলো। “

নিশা কিছু একটা বলতে চেয়েও সে শেষ পর্যন্ত আর বলে না। মাথা নেড়ে কিছু না বলতেই দূর্জয় বেরিয়ে যায়। নিশার মনে তখন খচখচ করতে থাকে দূর্জয়কে না বলা কথাটা। সেদিন তাকে বন্দী করা ওই টেরোরিস্টদের মধ্যে মাস্ক পরিহিত একজন যুবককে তার অনেক পরিচিত মনে হয়েছে। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও নিশা মিলাতে পারছে না কে হতে পারে! তাই অযথা দূর্জয়ের চিন্তা বাড়িয়ে না দিতেই সে এই বিষয়টা চেপে যায়। মনে মনে নিজেকে শুধায়,

“ আমিই হয়তো বেশি ভাবছি। আমার পরিচিত কেউ দেশের শত্রু হতে যাবে কোন দুঃখে? “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here