এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৯.
[ সতর্কতা : এই পর্বের দু একবার কিছু স্ল্যাং ওয়ার্ডস ইউজ করা হয়েছে। কারো তাতে সমস্যা থাকলে সেই শব্দগুলো এড়িয়ে যাবেন। ]
বন্দুকের নলটা ঠিক কণ্ঠনালির কাছে ঠেকেছে। তর্জনী আঙুল দ্বারা কেবল ট্রিগার চাপার দেরি। সামান্য চাপ পড়লেই বুলেটটা রুহীর কণ্ঠনালি চিড়ে বের হবে। এরকম পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের কি রূপ প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত? ভয়, আতংক, উৎকণ্ঠা? কিন্তু রুহীর মধ্যে সেসব কিছুই কাজ করছে না। এই বুলেট এখন আর কি-ই বা করতে পারবে? তার বিশ্বাস তো ভেঙে গুড়িয়েই দিয়েছে এই পরিচিত মুখোশধারী ভিন্ন পুরুষটা। প্রতারণার খঞ্জরে রক্তাক্ত করে দিয়েছে তার ভেতরটা।
অশ্রু জর্জরিত নয়ন যুগলের পানে চেয়ে আব্রাহাম মৃদু হেসে বলে,
“ থ্যাঙ্কিউ জান। তোমার সাহায্য ছাড়া এই মহান প্ল্যান ম্যাপ রেডি করা সম্ভব হতো না কখনো। “
আব্রাহামের মুখে উচ্চারিত কথাটা অডিটোরিয়ামে উপস্থিত সকলের কর্ণগোচর হয়। রুহীর সহপাঠীরা অবিশ্বাস্য সুরে চেচিয়ে উঠে,
“ রুহী, তুই এদের হেল্প করেছিস? “
শিক্ষিকা রুনা ফারহানাও ঘৃণা মিশ্রিত স্বরে প্রশ্ন করে,
“ অসভ্য মেয়ে, তুমিও এদের সাথে মিলিত? “
রুহী জবাব দিতে পারে না। সে নীরব ও নিরুত্তর রয়। শিক্ষার্থীদের শোরগোল আরেকটু বেড়ে যায়। সকলেই রুহীকে নানারকমের প্রশ্ন করে যাচ্ছে। আব্রাহাম চটে যায় উচ্চস্বরে। সে চট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। পিস্তলটা সকলের দিকে তাক করে বাজখাঁই গলায় বলে উঠে,
“ যার মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হবে তাকে গুলি করে চিরতরে তার মুখ বন্ধ করে দিবো। “
মুহুর্তেই সবগুলো গলার স্বর হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। গান পয়েন্টে সকলেই ভীত হয়ে পড়ে। আব্রাহাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে সকলকে দেখে নিয়ে অডিটোরিয়াম হতে বেরিয়ে যায়। পিছনে রয়ে যায় এক ঝাঁক প্রাণ হারানোর ভয়ে উৎকণ্ঠিত মানুষ।
__________
নাস্তা সেড়ে প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ খেয়ে বসে আছে বাণী। একা ঘরটা এ পর্যন্ত বেশ কয়েক বার ঘুরে দেখেছে সে। ছিমছাম সৌখিন মানুষের হাতে যে বাড়িটা সাজানো তা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু বাণীর পা জোড়া বারবার গিয়ে থামে সেই রুদ্ধ দুয়ারে। মনে জাগে মৃদু চাপা কৌতূহল। রুমটা বন্ধ কেন সেই উত্তর খুঁজে পায় না সে। হয়তো সেই রুমটা এই বাড়ির মালিকের খুবই ব্যক্তিগত জায়গা। বাণী আর সেদিকে পা মাড়ায় না। অন্যের বাড়িতে তার অনুপস্থিতিতে তারই ব্যক্তিগত ব্যাপারে এতো উঁকিঝুকি মারাটা যথেষ্ট কুরুচিপূর্ণ কাজ।
বাণী খাবার টেবিলে মাথা এলিয়ে বসে। চোখের সামনে ভেসে উঠে বহ্নির চেহারাটা। সেই মায়া চোখের বাচ্চাটাই তার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ। নাহয় এই জীবনের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই বাণীর। মাথা এলিয়ে দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাণীর ক্লান্ত চোখ জোড়া বুজে আসে। ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতেই তার চোখের পাতায় ভেসে উঠে অতীত।
__________
সময়টা ২০১৩ সাল। ১৪২০ বঙ্গাব্দ। সময়টা বর্ষাকাল। বাণীদের ব্যাচের ও লেভেল এক্সাম শুরু হতে বাকি কেবল দেড় মাস। গত দেড় বছরের অধিক সময়ে বেকবেঞ্চার বাণী তালুকদার মই বেয়ে একটু একটু করে নিজের রোলটা টেনে শাহরিয়ার দূর্জয় নামক ছেলেটার পিছনে এনে স্থির হয়েছে। সবসময় নিজের দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ানো মেয়েটা রাতারাতি নিজের জীবন নির্দিষ্ট রুটিনের আয়ত্ত্বে এনেছে। সন্ধ্যা ছয়টা হতে রাত নয়টা পর্যন্ত সময়টা ফিজিক্স, ম্যাথ, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি বিষয়ক টিউটরদের পিছনে ব্যয় করেছে। দশটার পর থেকে রাত একটা পর্যন্ত সময়টা পাড় করেছে নিজের মতো করে পড়ে। কোনো দিক দিয়ে কোনো খামতি রাখে নি সে। তার এই আমূল পরিবর্তন দেখে তার পরিবার বিষম খেলেও মনে মনে খুশি হয়। ভেবে নেয় হয়তো বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাণীর মধ্যে সিরিয়াসনেস কাজ করছে।
ও লেভেল এক্সাম শুরু হওয়ার দেড় মাস পূর্বে স্কুল জীবনের সমাপ্তি উদযাপন করতে শিক্ষার্থীরা মিলে তথাকথিত র্যাগ ডে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে স্কুল প্রাঙ্গণে। স্যার, ম্যাডামদের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করে বাণী আরমিনকে নিয়ে ছুটে যায় গ্রাউন্ড ফ্লোরের ওয়াশরুমে। আয়নায় নিজেকে ভালো করে পরখ করে ইউনিফর্মের উপর র্যাগ ডে এর সাদা টি শার্টটা গায়ে জড়িয়ে নেয় সে। আরমিন বান্ধবীর স্পেশাল ডে তে তাকে সুন্দর করে তৈরী করতে ব্যস্ত। উঁচু করে বাধা পোনিটেলটা খুলে উন্মুক্ত চুলগুলো চিরুনীর সাহায্যে আঁচড়ে দেয় সে। নিজের ব্যাগ হতে লিপটিন্ট বের করে বাণীর ঠোঁটে তা মেখে দিতে দিতে বিজ্ঞের ন্যায় প্রশ্ন করে,
“ আমি তোকে যেই সিনেমার লিস্ট দিয়েছিলাম সেগুলো দেখেছিস? ভালো করে প্র্যাক্টিস করেছিস তো? “
বাণী মুখ লটকে জবাব দেয়,
“ ঘন্টা শিখেছি। ধ্যাৎ! সিনেমার ডায়লগ মুখস্থ করে গেলে ও ভাববে আমি মেমোরাইজ করা পড়া টিচারের সামনে উগড়ে দিতে এসেছি। “
আরমিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিরিয়াস মুখ করে বলে,
“ আচ্ছা, সিনেমার ডায়লগ বাদ। শোন, তুই জাস্ট যাবি আর বলবি আই লাভ ইউ৷ শেষ। সিম্পল। “
বাণী নীরবে শুনলো আরমিনের কথা। শুনতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে বলতে ঠিক ততটাই কঠিন।
বাণী প্রশ্ন করে,
“ তোর কি মনে হয়? ও আজকে আসবে? “
“ আসবে না কেন? গত দুই সপ্তাহ ধরে ক্লাস অফ। হয়তো শুধু র্যাগ ডে থাকলে আসতো না। কিন্তু স্কুলে বেসিক ফর্ম ফিল আপের ডেটও আজকে। অবশ্যই আসবে। “
দুই বান্ধবী রেডি হয়ে বের হয় দূর্জয়কে খুঁজতে। স্কুলের মাঠে সব স্টুডেন্টরা আনন্দে মেতে রয়েছে। শেষ স্মৃতি হিসেবে একে অপরের টি শার্টে লিখে দিচ্ছে কিছু সংখ্যক শব্দ। সব ভীড়ে খুঁজেও যখন দূর্জয়ের কোনো হদিস মিলে না তখন বাণীর খেয়াল হয় দূর্জয় কোথায় থাকতে পারে। বাণী যাওয়ার আগে আরমিন তাকে জড়িয়ে ধরে বেস্ট অফ লাক জানায়।
স্কুলের পিছনে শুনসান বাস্কেটবল কোর্টে পা রাখতেই বাণী দেখে কাঠের একটা বেঞ্চিতে মাথা নত করে বসে আছে কাঙ্ক্ষিত মানুষ। বাণীর মুখে হাসি ফুটে উঠে। সে এগিয়ে গিয়ে নিঃশব্দে বেঞ্চির একপাশে বসে। প্রফুল্ল গলায় বলে উঠে,
“ ইয়ো টপার! তোমার সাদা টি শার্টে কেউ মার্কারের দাগ বসিয়ে দিবে সেই ভয়ে এখানে এসে লুকিয়ে আছো? অবশ্য আমার টি শার্টেও আমি এখনো কাউকে দাগ বসাতে দেই নি। ভাবলাম রোল ওয়ানকেই নাহয় সবার আগে সেই সুযোগ দিবো। “
বলে বাণী নিজের হাতের মার্কারটা দূর্জয়ের সামনে ধরে। দূর্জয় মাথা তুলে তাকায় না। না কোনো প্রতুত্তর করে। দূর্জয়ের কোনো মতিভ্রম না দেখে বাণীও নীরব হয়ে যায়। মনে মনে কথাগুলোকে সাজিয়ে নেয়। মিনিট এক পরে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বলে,
“ আই হ্যাভ টু সে সামথিং। “
বাণীর আর বাকিটা মুখে বলার সাহস হয় না। সে নীরবে উঠে গিয়ে দূর্জয়ের পিছনে দাঁড়ায়। হাতে থাকা লাল রঙের মার্কারটা দিয়ে সফেদ টি-শার্টে ইংরেজিতে লেখে,
“ I Love U “
বাণী যতটা না জলদি লেখাটা লিখে দূর্জয় তার চেয়েও দ্রুত মাথা সোজা করে বাণীর দিকে ফিরে দাঁড়ায়। বিস্ফোরিত চোখে এক পলক বাণীকে দেখে নিয়ে নিজের শার্টের উপর পরিহিত টি শার্টটা খুলে হাতে নিয়ে তাতে লেখা তিনটি শব্দ পড়ে। অত:পর রক্তিম দৃষ্টি মেলে বাণীর দিকে তাকিয়ে চেচিয়ে উঠে,
“ এই বেশরম মেয়ে! ন্যূনতম লজ্জা নেই তোমার মাঝে? বহুদিন ধরে তোমার এই নাটক সহ্য করছি আমি। অল্প বয়সে যে এতো পেঁকে গিয়েছো তোমার বাসায় জানে? কি মনে করেছো তুমি? ফার্স্ট বেঞ্চে বসা, পড়াশোনার প্রতি হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে যাওয়া, এই মুখে রঙচঙ মাখা এসবের কারণ আমি বুঝি না? আমাকে ইম্প্রেস করার জন্য এতো পরিশ্রম? অথচ আমি শুরু থেকেই তোমার প্রতি বিরক্ত এটা বোঝার মতো সামান্য কমনসেন্স তোমার মধ্যে কাজ করে না? তুমি রিলেটেড প্রতিটা বিষয়ই আমার কাছে খুব বিরক্তিকর লাগে। তোমার গান, তোমার গিটারের টুংটুং শব্দ, তোমার উচ্চশব্দের হাসি, তোমার এই অতিরিক্ত এক্সট্রোভার্ট আচরণ, আমার দিকে তাকিয়ে তোমার বেহায়ার মতো ফ্লায়িং কিস ছোড়া। ইচ এন্ড এভ্রিথিং এবাউট ইউ ইজ ইরিটেটিং। আর তোমার সাহস কিভাবে হয় আমার পারমিশন ছাড়া আমার গায়ে হাত দেওয়ার? তার উপর আবার বেহায়ার মতো এসব লিখে বেড়াও। হোয়াট ডু ইউ থিংক? তুমি এভাবে আমার টি শার্টে আই লাভ ইউ লিখে দিলেই আমি হাসতে হাসতে তোমার প্রপোজাল এক্সেপ্ট করবো? আই জাস্ট হেট দিজ ব্লাডি থিং। “
কথাটুকু শেষ করতে না করতেই দূর্জয় নিজের হাতের টি শার্টটা দু হাতে টেনে হিচড়ে ছিড়ে ফেলে। তার দু চোখ ঠিকরে যেনো আগুন বের হচ্ছে। নিঃশ্বাসের গতি এলোমেলো। হয়তো সর্বদা ঠান্ডা থাকা মানুষ গুলো রেগে গেলে এরকমই তান্ডব লীলা চালায়। বাণী নীরবে দেখে দূর্জয়ের ধ্বংসলীলা। অপমানে থমথমে মুখশ্রী কালো হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। চোখে জমে থাকা অশ্রু গড়িয়ে পড়ার সুযোগ খুঁজছে কেবল। কিন্তু বাণী সেই সুযোগ দেয় না। আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না সে। দৌড়ে কাউকে কিছু না বলে সেখান থেকে প্রস্থান করে। সাইকেলের গতি বাড়িয়ে পৌঁছে যায় বাসায়। সবার অগোচরে বাসায় প্রবেশ করতে চাইলেও হঠাৎ একজন যুবক এসে তাকে টেনে বসার ঘরে নিয়ে যায়। প্রফুল্ল গলায় জানায়,
“ আই হ্যাভ এ গুড নিউজ। “
বাণীকে নিরুত্তর তাকিয়ে থাকতে দেখে যুবক হেসে জানায়,
“ আমি কানাডায় যেই ইউনিভার্সিটির জন্য এপ্লাই করেছিলাম সেখান থেকে মেইল এসেছে। আ’ম গোয়িং টু কানাডা নাও। “
যুবকের কথা যেনো বাণীর বুকের দাউদাউ করা আগুনে কিছুটা ঘি ঢালে। তার কাছে অসহ্যকর ঠেকে সবকিছু। দূর্জয় নামক সেই ছেলে, সায়াহ্ন নামক নিজের এই বড় ভাই। সবার কথাগুলো যেনো কেবল তাকে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্যেই। বাণী মা, বাবা, ভাইয়ের আনন্দের মজলিশ ছেড়ে নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। বিছানার দিকে এগোতে নিলেই তার চোখে পড়ে বিছানার এককোণে রাখা তার কালো রঙা গিটারটা। সাথে সাথেই তার মনে পড়ে যায় দূর্জয়ের বলা সেই কথাটা,
“ তোমার গিটারের টুংটুং শব্দ, তোমার গান এভ্রিথিং এবাউট ইউ ইজ ইরিটেটিং। “
বাণীর দুঃখগুলো ক্রোধে রূপ নেয়। রাখবে না সে এই গিটার। ছুড়ে ফেলে দিবে। গাইবে না আর কোনো গান। ছেড়ে দিবে চির জীবনের জন্য। আজকের এই দিনটা সে নিজের জীবনের স্মৃতি পাতা হতে ছিড়ে ফেলে দিবে।
আচমকা কলিংবেলের শব্দে বাণীর তন্দ্রা কেটে যায়। বেরিয়ে আসে অতীতের পাতা থেকে। পুরনো স্মৃতিচারণে তার বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। কিছু পাতা কখনো জীবন থেকে মুছে ফেলা যায় না। শাহরিয়ার দূর্জয়ও বাণীর জীবনের সেরকমই এক অধ্যায়।
__________
রুহীদের শিক্ষিকা রুনা ফারহানা বত্রিশ বছর বয়সী এক নারী। এক সন্তানের জননী এই নারী দ্বিতীয় বারের মতো অন্তসত্তা। একমাস হয়েছে তিনি জানতে পেরেছেন এই ব্যাপারটা। সবেমাত্র চারমাস। সামনের মাস থেকেই উনি চাকরিটা ছেড়ে দিতেন। কিন্তু এসবের মাঝে এরকম একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে কে জানতো? বিপদ কি আর বলে কয়ে আসে?
উত্তাপ বিহীন দুপুরটা আজ অন্য দিনের মতো স্বাভাবিক নয়। চারিদিকের পরিবেশটা কেমন গুমোট এবং থমথমে। আব্রাহাম আর অডিটোরিয়াম রুমের দিকে পা মাড়ায় নি। তবে দূর হতেই বিভিন্ন আদেশ দিয়ে চলেছে সে। যেই আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে অন্য আতঙ্কবাদীরা। যার মধ্যে অন্যতম হলো প্রতিটা কাঁচের জানালাই ঢেকে দেওয়া হয়েছে মোটা কাপড়ের পর্দা দ্বারা। যেনো বাহির হতে কেউ তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম না হয়।
পুরো অডিটোরিয়ামে সবাই যখন একসঙ্গে জোড়ো হয়ে বসে একে অপরকে সাহস ও ভরসা জুগিয়ে যাচ্ছে ঠিক সেই মুহুর্তে অডিটোরিয়ামের এককোণে মাথা নত করে অন্যদিকে ফিরে বসে আছে এক রমণী। সবার থেকে বিচ্ছিন্ন। দূর হতেই সে আঁচ করতে পারছে সবার ঘৃণ্য দৃষ্টি। চোখদুটো তার ফ্লোরের দিকে নিবদ্ধ। দৃষ্টি তুলে তাকানোর অবস্থায় নেই সে। এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতেও তার মধ্যে মৃত্যুভয় কাজ করছে। আজ এই আতঙ্কবাদীদের হাতে প্রাণ গেলেও বুঝি তার কিছু যায় আসে না।
অতিরিক্ত টেনশন এবং দীর্ঘক্ষণ নিচে বসে থাকার ফলেই বোধহয় রুনা ফারহানা তলপেটে তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করছে। ব্যথাটা ক্রমশ কেবল বাড়ছে বৈ কমছে না। প্রেগন্যান্সির সময়টাতে প্রায়ই মহিলাদের একটু পর পর প্রসাবের চাপ অনুভব করে। মিসেস রুনাও তার ব্যতিক্রম নয়। মধ্যে দু একবার তিনি নিজের সমস্যার কথা জানিয়ে আতঙ্কবাদীদের নিকট আবেদন করেছে যেনো তাকে দুই মিনিটের জন্য ওয়াশরুমে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু হৃদয়হীন পশু গুলো উনার আবেদন অগ্রাহ্য করে। রুনা ফারহানারো আর পিস্তলের বিরুদ্ধে গলা উঁচু করে কিছু বলার আর সাহস হয় না। কিন্তু এই পর্যায়ে তলপেটের ব্যথাটা অসহনীয় ঠেকছে তার কাছে। সইতে না পেরে আচমকা তিনি পেট চেপে ধরে তীব্র স্বরে আর্তনাদ করে উঠে।
অডিটোরিয়ামে উপস্থিত সকলের দৃষ্টিই নিবদ্ধ হয় তার দিকে। একজন আতঙ্কবাদী এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে,
“ এই মাগী। চিল্লাস কেন? এক্কেবারে পেট বরাবর গুলি কইরা বিষ ব্যথা ছুটামু। “
মিসেস রুনা কোনো প্রতুত্তর করতে পারে না। বরং চিৎকার করতে করতে একপাশে হেলে পড়লে একজন শিক্ষার্থী নিজের কোলে উনার মাথাকে আশ্রয় দিয়ে ব্যকুল স্বরে বলে উঠে,
“ ম্যাম অসুস্থ। প্লিজ উনাকে অন্তত যেতে দিন। একজন কমে গেলে নিশ্চয়ই আপনাদের বড় কোনো ক্ষতি হবে না? “
শিক্ষার্থীর কথা শুনে একজন আতঙ্কবাদী ক্ষিপ্র পায়ে এগিয়ে এসে রাইফেলের অপরপাশের মাথা দিয়ে তার পিঠে আঘাত করে বলে,
“ এই খা*কি মাগী। খুব জবান চালাইতেসোস? দিমু কাইট্টা? “
আতঙ্কবাদীর উগ্র আচরণে ভীত হয় সকলে। মুহুর্তেই এক বিশৃঙ্খল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। রুহী নীরব দর্শকের ন্যায় দেখে সেই দৃশ্য। সে অনেকটা দরজার কাছেই বসে ছিলো। সব আতঙ্কবাদীরা যখন শিক্ষার্থীদের শাসাতে ব্যস্ত সেই সুযোগে সবার দৃষ্টির অগোচরে রুহী অডিটোরিয়াম হতে বেরিয়ে আসে সামান্য মুক্ত অক্সিজেনের আশায়। নিঃশ্বাসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে হঠাৎ করে।
রুহী নিজের ইউনিফর্মের গলার কাছটা সামান্য টেনে ধরে এলোমেলো পা ফেলে লম্বা করিডোর পেরিয়ে অন্যদিকে মোড় ঘুরতে নিলেই একজোড়া হাত তাকে টেনে একপাশে নিয়ে যায়। রুহী ঝাপসা চোখে সেই হাতের মালিককে দেখতেই তার অস্থিরতার মাত্রা আরো বেড়ে যায়। আব্রাহাম চোখ কুচকে বলে,
“ বেরিয়ে এসেছো কিভাবে? খুব সাহস বেড়েছে? প্রতি পদে এখানে বোম সেট করা। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই তোমার শরীর টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। “
রুহী আব্রাহামের কথায় গুরুত্ব দেয় না। সে বুক টেনে নিঃশ্বাস নিতে নিতে আবার পা বাড়াতে নিলেই আব্রাহাম ফের তার হাত টেনে ধরে। ধমকের সুরে বলে,
“ সমস্যা কি তোমার? কি করতে চাইছো? “
রুহী অস্পষ্ট গলায় বলে,
“ ওয়াশরুম যাবো। “
আব্রাহাম মিনিট এক রুহীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তার হাত ধরে বলে,
“ ছুটে পালানোর চেষ্টা করবে না। আমি যেখানে যেখানে পা রাখবো সেই পথ অনুসরণ করে আসো। “
__________
মুখে পানির ঝাপটা মারতেই সামান্য ধাতস্থ হয় রুহী। সিংকের পানি ছিটে এসে তার ইউনিফর্মের অনেকটাই প্রায় ভিজে গিয়েছে। তবুও সেদিকে মাথা ব্যথা নেই তার। এতক্ষণের দলা পাকিয়ে গলায় আটকে থাকা কান্না এবার বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে। বেসিনের দুই পাশে হাতে ভর দিয়ে মাথা নত করে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে সে। কত রাত! কত রাত সেই মানুষটার সাথে নিজের কলেজের প্রতিটা কোণা নিয়ে গল্প করে বেরিয়েছে সে। মনখোলা রুহী যদি ঘূনাক্ষরেও টের পেতো প্রতারকটার উদ্দেশ্য তাহলে হয়তো নিজের মুখে ও মনে তালা মেরে রাখতো। এতোগুলো প্রাণ আজ যেই বিপদে পড়েছে সেই বিপদের একাংশের জন্য হলেও রুহী নিজেকে দায়ী অনুভব করছে। এতোগুলা মানুষের প্রাণের দায় বয়ে তো সে পরপারেও শান্তি পাবে না। এপারে লোকে তাকে লানত দিবে। সেই ভাবনা মাথায় উঁকি দিতেই রুহী এবার কাঁদতে কাঁদতে কপাল চাপড়ে উঠে। সব তার দোষ। একজন আতঙ্কবাদীকে হৃদয়ে জায়গা দেওয়ার কি কোনো শাস্তি আছে আইনে? যদি থেকে থাকে তবে সেই শাস্তি ঠিক কতটা ভয়ংকর?
বাথরুমের খোলা দ্বারের সামনে পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছে আব্রাহাম। না এগিয়ে যাচ্ছে মিছে প্রেয়সীর কান্না মুছতে, আর না তাকে কোনোধরনের তাড়া দেখাচ্ছে। মিনিট খানেক পর রুহী নিজেই নিজেকে সামলে নেয়। রক্তিম চোখের অশ্রু মুছে পানির কলটা বন্ধ করে সে। শান্ত পায়ে এগিয়ে যায় আব্রাহামের দিকে। আব্রাহাম যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে নিলেই রুহী তার হাত ধরে বাঁধা দেয়। আব্রাহাম ভ্রু কুচকে তাকাতেই রুহী অর্ধ ভেজা দেহটা আরেক পা এগিয়ে নিয়ে ধীর গতিতে আব্রাহামের বুকের ঠিক বা পাশটায় মাথা গুজলো।
সারাজীবন বহু পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে আব্রাহাম। কিন্তু এরকম বিস্ময়কর পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়ে নি সে। নিজের সকল কীর্তিকলাপের পর রুহীর এমন কান্ডের কোনো অর্থবহ মানে খুঁজে পায় না সে। আব্রাহামের এসব ভাবনার মাঝেই তার বুকের বা পাশ হতে থমথমে নারী স্বর বলে উঠে,
“ শেষবারের মতো তোমার হৃৎস্পন্দন শোনার লোভ সামলাতে পারলাম না। কিন্তু আফসোস! আজকে এই বুকের মাঝে শুধু একজন প্রতারকের হৃৎস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি আমি। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]