এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ২০.

0
169

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২০.

তন্দ্রাভাবটা কেটে যেতেই বাণীর কানে ভেসে আসে আরও দু একবার কলিংবেলের শব্দ। বাণী দরজার পীপহোল দিয়ে তাকাতেই দেখে সকালের সেই মুখটা। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ইলিয়াস কাঞ্চন। এবার আর বাণী তেমন একটা ভয় পায় না। বরং স্বাভাবিক ভাবেই দরজা খুলে। ইলিয়াস কাঞ্চন কোনো ভনিতা না করে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে উঠে,

“ ম্যাডাম আপনার জন্য লাঞ্চ। “

বাণী নীরবে প্যাকেটটা নিয়ে বাহিরের দিকে উঁকি মারে। দূর হতে সে দেখতে পায় উঠোনের ওদিকটায় আরো দু’জন কাটকাট চেহারার যুবককে দেখা যাচ্ছে। সেই পানে তাকিয়ে থেকে বাণী ইলিয়াসকে প্রশ্ন করে,

“ আপনারা খেয়েছেন? “

ইলিয়াস কাঞ্চন ইঞ্জিন দ্বারা চালিত রোবটের ন্যায় জবাব দেয়,

“ না ম্যাডাম। “

বাণীর অদ্ভুত মায়া লাগে। ছেলেগুলো সকাল থেকে বাহিরে দাঁড়িয়ে তাকে পাহারা দিচ্ছে। ওদের উঠোনে চেয়ার পেতে বসতে দিলে কেমন হয়? কিন্তু মনের ভাবনাটা আর প্রকাশ করার সাহস পায় না বাণী। এটা তার নিজের বাড়ি নয়। অন্যের বাড়ি। বাড়ির মালিকের অনুমতি ব্যতীত তার ঘরের আসবাবপত্রে হাত দিতেও বাণীর মনে সায় দেয় না। তাই সে কেবল বলে,

“ আপনারাও খেয়ে নিয়েন। “

“ ওকে ম্যাডাম। “

বাণী দরজা ভিড়িয়ে দিতে নিলেই ইলিয়াস কাঞ্চন ফের বলে উঠে,

“ ম্যাডাম। “

বাণী প্রশ্নবোধক দৃষ্টি মেলে তাকাতেই ইলিয়াস একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ আপনার জন্য। “

বাণী উৎসুক দৃষ্টি মেলে খামটা হাতে নেয়। দরজাটা লক করে সেই খাম হাতে বসার ঘরে গিয়ে একটা সোফায় বসে। খামটার উপরে কিছু লেখা নেই। নাম পরিচয়হীন সম্পূর্ণ। খামটা খুলতেই ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা ভাজ করা সফেদ কাগজ। বাণী ধীর হাতে কাগজের ভাজ খুলে। সঙ্গে সঙ্গে সে দেখতে পায় সম্পূর্ণ কাগজ জুড়ে বহু পরিচিত একজন হাতের লেখা। বাণী নীরবে পড়তে শুরু করে,

বাণী তালুকদার,

এই মুহুর্তে হেডকোয়ার্টারে একটা নীরব রুমে এই কাগজ এবং কলম হাতে বসে আছি আমি। যুদ্ধের ঘন্টা বেজেছে। সেই যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে আমার মনে পড়লো তোমার সঙ্গে একটা জরুরী হিসেব মেটাতে হবে আমায়। সেজন্য ঘড়ি ধরে ঠিক পাঁচ মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে এই নীরব রুমে ছুটে এসেছি। কাগজ কলম হাতে নিয়ে লিখতে বসেছি।

এগারো বছর আগে, স্কুলের ব্যাক ফিল্ডের বাস্কেটবল কোর্টে দাঁড়িয়ে আমি তোমাকে অনেকগুলো কথা বলেছিলাম। যথেষ্ট দুর্ব্যবহার করেছি সেদিন তোমার সাথে। এই উপলব্ধিটা আমি সেদিনই করতে পেরেছিলাম। কিন্তু তোমার সাথে আর কখনোই আমার দেখা হয় নি। না পেয়েছি ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ। তাই আজ বলছি, আমার সেদিনের ব্যবহারের জন্য আ’ম সরি।

বাণী এই এগারো বছরে বহু কিছু বদলেছে। দুটো আলাদা পথের পথিক আমরা। কিন্তু দেয়ার ইজ সামথিং লাইক কলড ডেস্টিনি। আলাদা পথের দুই পথিক হওয়া সত্ত্বেও মহান আল্লাহ বারবার আমাদের এক মোড়ে এনে সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দিচ্ছে। বিষয়টা নেহাৎই কাকতালীয় নাকি উনার মর্জি তা আমার জানা নেই। যেখানে যাচ্ছি সেখান থেকে ফেরার সম্ভাবনা কতদূর তা-ও আমার জানা নেই। কিন্তু যদি আল্লাহ হায়াত রাখেন এবং আমি ফিরে আসি তবে আমি নিজের প্রশ্নের উত্তর আদায় না করে তোমাকে যেতে দিবো না।

আর… থাক। আমার পাঁচ মিনিট প্রায় ফুরিয়ে এলো। তাই এখানেই এই চিঠির সমাপ্তি টানছি।

ইতি,
মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়।

টানা হাতের লেখার ছোট ছোট শব্দগুলোয় আরেকবার চোখ বুলায় বাণী। তার যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে খুব। দূর্জয় ক্ষমা চেয়েছে? আত্মগরিমায় ভরপুর মানুষটা ক্ষমা চাইতেও জানে? অবশ্য এই সরিটা কি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো? বাণীর তো মনে হয় না। তার মনে হয় দূর্জয়ের এগারো বছর আগে বলা প্রতিটা কথা যথার্থ ছিলো। আপন ভাবনা গুলো একপাশে রেখে বাণীর মস্তিষ্কে হঠাৎ বেজে উঠে দূর্জয়ের লেখা চিঠির তিনটি শব্দ। ‘যুদ্ধের ঘন্টা বেজেছ’। কিসের যুদ্ধ?

বাণী দ্রুত বসার ঘরে একবার চোখ বুলায়। একটা ছোট বেতের গোল টেবিলের উপর হতে রিমোটটা হাতে নিয়ে টিভি অন করে। কিন্তু বেচারি নিরাশ হয়। টিভিতে ডিশের লাইনের সংযোগ নেই। বাণী রিমোট ছেড়ে দ্রুত উঠে দরজার কাছে এগিয়ে যায়। দরজা খুলে বাহিরে উঁকি দিয়ে মৃদু কম্পিত গলায় ডাকে,

“ ইলিয়াস কাঞ্চন। “

ডাকতে দেরি কিন্তু বান্দার হাজির হতে দেরি হয় না। রোবটের ন্যায় জবাব দেয়,

“ জি ম্যাডাম। বলুন। “

“ এই বাসায় টিভিতে ক্যাবল কানেকশন নেই। তাই নিউজ দেখতে পারছি না। বাহিরে কিসের যুদ্ধ চলছে? কি হয়েছে? আমাকে বলবেন? “

ইলিয়াস কাঞ্চনকে ভাবুক দেখায়। চট্টগ্রাম শহরের বুকের কালো অধ্যায়ের কথা ম্যাডামকে জানানোর আগে কি একবার স্যারের অনুমতি নেওয়া উচিত? কিন্তু সেই অনুমতি চাওয়ার সুযোগ তো আপাতত নেই। ভাবুক কাঞ্চন ফের তাকায় উদগ্রীব বাণীর মুখপানে।

__________

নীরব অডিটোরিয়ামে হুটহাট শোনা যাচ্ছে ক্ষীণ ফুপিয়ে কান্না করার শব্দ। কিন্তু তা বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না। তার পূর্বেই অস্ত্রধারী আতঙ্কবাদীরা অস্ত্রের বলে সেই স্বরে মাটি চাপা দিয়ে দিচ্ছে। ভয়ে আতংকিত মুখগুলো যখন প্রাণ শঙ্কায় ভীত তখন সেই অডিটোরিয়ামের এককোণে নির্জীব এক নারী দেহ অসাড় হয়ে ফ্লোরে পড়ে রয়। চেতনাহীন সেই রমণীকে দূর হতে সবার অগোচরে অতি সাবধানে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে এক জোড়া তীক্ষ্ণ ঈগল চোখ। এই মেয়েটাও ভীতু। অন্য সবার মতো দূর্বল। নাহয় সামান্য এক কুপানোর দৃশ্য দেখে কেউ জ্ঞান হারায় নাকি?

আব্রাহাম নিজের দৃষ্টি রুহীর উপর থেকে সরিয়ে তাকায় অডিটোরিয়ামের ডানপাশে। যেখানে একটা নিথর লাশ পড়ে রয়েছে। লাশটা আর কারো নয় বরং শিক্ষিকা রুনা ফারহানার। ভদ্রমহিলা পেট ব্যথায় তীব্র চেঁচামেচি করছিলো। আব্রাহামের দলের এক রাগচটা সদস্য যার নাম মুবিন, সে মহিলার সেই চেঁচামেচি সহ্য করতে পারে নি। সোজা ধারালো এক অস্ত্র হাতে নিয়ে এসে মহিলার পিঠে ও বুকে দুটো কোপ বসায়। আব্রাহাম তখন কেবল রুহীকে নিয়ে অডিটোরিয়ামের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো। এরকম এক দৃশ্য দেখে দু’জনেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। আব্রাহাম দৌড়ে এগিয়ে যায় মুবিনের দিকে এবং রুহীর মস্তিষ্ক এই ধাক্কা সামলাতে না পারে নিশ্চল হয়ে যায়। দরজার সামনেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় সে। রুমে উপস্থিত সকল শিক্ষার্থী নিজেদের শিক্ষিকার প্রতি সেই নৃশংসতার সাক্ষী হয়। দু একজন গা গুলিয়ে উক্ত জায়গায়ই বমি করে দেয়। সকল হোস্টেজের মনেই তখন প্রতিধ্বনি হচ্ছে একটাই কথা,

“ এরকম ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হওয়ার থেকে মৃত্যু বরণ করা ঢের সহজ। “

আব্রাহাম মুবিনকে থামাতে গেলে তাদের হাতাহাতির মাঝেই মুবিন আরেকটা কোপ বসায় রুনা ফারহানার দেহে। তবে এবারের কোপটা রুনা ফারহানার গলার কাছটায় লাগে। মুহুর্তেই দেহটা ঝাকি তুলতে তুলতে সকলের সামনে নিশ্চুপ হয়ে যায়। সেই থেকে যে রুহী জ্ঞান হারিয়েছে এখনো তার জ্ঞান ফিরে নি। অবশ্য আব্রাহাম কাউকে তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করার আদেশ দেয়ও নি। হৃদয়বান দূর্বল মেয়েটার প্রতি এটা আব্রাহাম যেনো কোনো দয়া করলো। আব্রাহাম মনে মনে শুধায়,

“ তুমি ঘুমাও রুহী। এই তান্ডবলীলা স্ব চোক্ষে সহ্য করতে পারবে না তুমি। তোমার ঘুমে কেউ ব্যাঘাত ঘটাবে না আজ। “

__________

কলেজ এরিয়ার চারিদিকটা সম্পূর্ণভাবে সামরিক বাহিনী নিজেদের অধীনে নিয়ে এসেছে। এই এরিয়ার ধারে কাছেও কোনো সাধারণ মানুষ কিংবা সাংবাদিকদের আনাগোনার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। যদিও হোস্টেজদের পরিবারের সদস্যরা ইতিমধ্যে সেখানে ভীড় জমিয়ে কান্নার রোল জুড়ে বসেছে, তবে তাদের সামলানোর দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে পুলিশের কাধে। কিছু সংখ্যক পুলিশ যেখানে শান্তনা মূলক কথা দ্বারা তাদের শান্ত রেখে সাহস জোগানোর চেষ্টা করছে, সেখানে অন্য প্রান্তে কিছু সংখ্যক পুলিশ চামারের ন্যায় আচরণ করছে তাদের সঙ্গে। এরই মাঝে রয়েছে সাংবাদিকদের ভীড়। যারা সন্তানের প্রাণ আশংকায় ভীত বাবা মা’র দিকে ক্যামেরা তাক ছুড়ে যাচ্ছে অদ্ভুৎ সব প্রশ্ন।

“ আপনার কি মনে হয় ভেতরে আপনার সন্তান কি অবস্থায় আছে? আপনার কি নিজের সন্তানের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ হয়েছে? “

টিভির নিউজ চ্যানেলের দিকে স্থির এক জোড়া দৃষ্টির মালিক তীব্র ঘৃণা মিশ্রিত স্বরে বলে উঠে,

“ কি অদ্ভুৎ কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রশ্ন! “

চৌধুরী নিবাসের প্রায় সকল সদস্যরাই আজ বাসায় উপস্থিত। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে এরকম একটা নিউজ দেখার পরে তরী রশীদ বাদে আর কেউই বাসা থেকে বের হয় নি। টিভির সামনে বসে থাকা সকলে পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর বলা কথাটার গভীরতা উপলব্ধি করে। এইতো বেশিদিন না। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে কেবল ছয় মাস পিছিয়ে গেলেই এরকম একটা দিনের সাক্ষী হয়েছিলো তারা। যখন তাদের ঘরের ছেলে এবং ছেলে সমতুল্য মেয়ে জামাই আতঙ্কবাদীদের কব্জায় বন্দী ছিলো। সেদিন চৌধুরী এবং রশীদ পরিবারের সকলেও এদের মতো নিজেদের সন্তানকে অক্ষুণ্ণ অবস্থায় ফিরে পাওয়ার প্রার্থনায় মশগুল ছিলো। আফজাল চৌধুরী মনে মনে মানত করেছিলেন যে ছেলে দুটোর জন্য সদকা হিসেবে মসজিদে এতিম শিশুদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করবে। তূর্য ও শোভন যেদিন সুস্থ হয়ে নিজ নিজ বাড়ি ফিরে সেদিন আফজাল সাহেব নিজের মনের সুপ্ত মানত পূরণ করেছিলেন।

লিভিং রুমের একপাশে একটা সোফায় বসে থাকা শোভন সবার অগোচরে নীরবে সেখান থেকে প্রস্থান করে। নিজের রুমে ফিরে এসে দরজাটা ভেতর থেকে লক করে অতি গোপন এক স্থান হতে বের করে উচ্চপদস্থ একজন সম্মানিত ব্যক্তি হতে পাওয়া একটা চিঠি। যেখানে লেখা রয়েছে,

শোভন মুহতাশিম চৌধুরী,

আমি যখন এই চিঠি লিখছি তখন আপনি হাসপাতালে জীবন মরণের পাঞ্জা লড়ছেন। অফিসার শোভন বিশ্বাস করুন যখন আমাকে এই মিশনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় এবং আমি হোস্টেজ লিস্টে আপনার নামটা দেখি তখন আমি বাকহারা হয়ে পড়ি। এইতো কিছুদিন পূর্বেই তো আমাদের দেখা হলো। তরতাজা এক প্রাণকে আমি এমন এক কেস নিয়ে তদন্ত করতে দেখি যেই কেসকে উপরমহল হতে অপ্রয়োজনীয় বলে বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু আপনি সেদিন সেই আদেশের তোয়াক্কা করেন নি। দুর্দম্য সাহস নিয়ে একাই কেসটার ছক কষতে শুরু করেন। সকল অর্ডারের বিরুদ্ধে গিয়ে। আমার বিশ্বাস আপনি খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবেন। নিজের পরিবারের জন্য আপনি সুস্থ হবেন। এই দেশের বুকে একজন শোভন মুহতাশিমের প্রয়োজন বলেই আপনি সুস্থ হবেন। এই চিঠিটা পড়ার জন্য হলেও আপনাকে সুস্থ হতে হবে।

আপনি চিন্তা করবেন না। এই কেসটা আমি এখানেই ছেড়ে দিবো না। এই কেসের সাথে জড়িত প্রতিটা কেঁচোকে তাড়া করবো। তারা যেই গর্তেই গিয়ে লুকিয়ে থাকুক না কেনো আমি সেই গর্ত খুড়বো প্রয়োজনে। ইনশাআল্লাহ গর্ত হতে কেঁচো ও সাপ দুটোকেই বের করতে সক্ষম হবো। হতেই হবে। কারণ যেখান থেকে শোভনদের দায়িত্বের ইতি ঘটে সেখান থেকেই দূর্জয়দের সেই দায়িত্বের ভার বইতে হয়।

May our country live long.

ইতি,
মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়।

সম্পূর্ণ চিঠিটায় একবার চোখ বুলিয়ে শোভন জানালা দিয়ে একবার বাহিরে তাকায়। বিড়বিড়িয়ে বলে,

“ আল্লাহ আপনার সহায় হোক মেজর দূর্জয়। “

__________

সামরিক বাহিনীর জিপে করে ‘Do not cross the line’ এর সীমানা অতিক্রম করে ভিতরে প্রবেশ করে স্পেশাল টিমের সদস্যরা। সামরিক বাহিনীর দখলে কলেজ সীমানার বাহিরে টাঙানো তাবুর ভেতর প্রবেশ করতেই তাদের দেখা হয় সেখানে দায়িত্বে থাকা বাকি সেনা সদস্যদের সঙ্গে। মেজর দূর্জয় রেডিও ইঞ্জিনিয়ারের টেবিলের কাছে এগিয়ে যেতে যেতে প্রশ্ন ছুড়ে,

“ টিল নাও এনি নেগোসিয়েশন করা সম্ভব হয়েছে? “

“ নো স্যার। টেরোরিস্টরা আমাদের কোনো কথার বিপরীতেই সাড়া দেয় নি। তাড়া সম্ভবত নেগোসিয়েশন করতে ইন্টারেস্টেড না। ঠিক গতবারের মতো। “

উত্তরট শুনে দূর্জয় কানে হেডফোন গুজে কিছু শোনার চেষ্টা করে। কিন্তু আশানুরূপ কোনো লাভ হয় না এতে। কারণ কলেজ ভবনের কাছে গিয়ে রেডিও সিস্টেম ইন্সটল করা সম্ভব হয় নি। আতঙ্কবাদীদের গুলি ছোড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাবুতে উপস্থিত সাত লেফটেন্যান্টের মধ্যে সাইফ ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ খালি যদি কর্ণেল স্যারের অর্ডার না থাকতো তাহলে আমি এক্ষুনি ভিতরে গিয়ে সবগুলা বাঙ্গির পুতেরে পুইত্তা রাইখা আসতাম। “

সাইফের কথা বাকি ছয়জনের কানে পৌঁছায়। কিন্তু তারা কোনো জবাব দেয় না। দূর্জয় সম্পূর্ণ সিচুয়েশন অবজারভা করে নিজের পকেট হতে হ্যান্ডহেল্ড ট্রান্সিভার বের করে। মুহুর্তেই হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা এবং আরো উচ্চপদস্থ কর্ণেলদের সঙ্গে কানেক্টেড হতেই দূর্জয় তাদের এখানকার সিচুয়েশন এনালাইসিস সম্পর্কে জানায়। দূর্জয় সাহস নিয়ে বলে,

“ স্যার অর্ডার দিন। আমরা ইন্সটেন্ট প্ল্যান ম্যাপ রেডি করছি ভিতরে প্রবেশ করার। “

কর্ণেল জুবায়ের শিকদার দূর্জয়ের কথায় বাগড়া দিয়ে বলে,

“ নো দূর্জয়। এখন ভিতরে প্রবেশ করা ঠিক হবে না। এখান থেকে যেই প্ল্যান ম্যাপ রেডি করে তোমাদের পাঠানো হয়েছে কেবল সেই অনুযায়ীই তোমরা কাজ করবে। “

দূর্জয় শান্ত গলায় বলে,

“ স্যার, ৮৭ জন হোস্টেজ এই মুহুর্তে প্রাণ ভয়ে তটস্থ হয়ে রয়েছে ওই কলেজের ভেতর। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত আসার অপেক্ষা করলে খুব দেরি হয়ে যাবে। আর তাছাড়াও রাতের অন্ধকারে পাওয়ার সাপ্লাই কেটে ভিতরে প্রবেশ করাটাও সেফ না। ভবনের কোথায় কোথায় বিপদ ওঁৎ পেতে রয়েছে আমাদের জানা নেই। আমার টিম মেম্বারদের সেফটি আর থাকবে না তাতে। “

কর্নেল জুবায়ের শিকদার দূর্জয়ের কথার পিঠে তেতে উঠে,

“ ডোন্ট ফরগেট ইউর আইডেন্টিটি দূর্জয়। ইউ আর এ সোলজার। তোমার একমাত্র কাজই হচ্ছে অর্ডার মানা। আর আমাদের অর্ডার সবসময় দেশ ও জাতির সুরক্ষার উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে। আর ইউ আর টকিং এবাউট দ্যা লেফটেন্যান্টস সেফটি? তোমার কি মনে হয় ইট ইজ এবাউট দেয়ার লাইফ? হোস্টেজদের উদ্ধারের জন্য জীবন দিতে হলেও ওরা দিবে। এ নিয়ে এতো ভাবাভাবির কি আছে? আর তবুও যদি তুমি এই বিষয়ে ভাবতে চাও তাহলে আমাকে এই মিশনের দায়িত্ব অন্য কারো হাতে দিতে হবে। “

জুবায়ের শিকদারের বলা কথাগুলো পৌঁছায় তাবুতে উপস্থিত সকলের কানেই। দূর্জয়ের রাগে শরীর কাপছে। সচরাচর সে সর্বদাই নিজের উচ্চপদস্থ সকলকেই সম্মান করে যদি সে সম্মানের যোগ্য হয়। কিন্তু এই কর্নেল জুবায়ের শিকদারের প্রতি দূর্জয়ের একরাশ বিরক্তি ও রাগ জমা রয়েছে। স্বাধীনতার পরে এই দেশের মাটিতে এভার ভিউ রেস্টুরেন্টের সেই টেরোরিস্ট অ্যাটাকের ঘটনাটা ফার্স্ট হোস্টেজ কেস ছিলো সামরিক বাহিনীর জন্য। একটা হোস্টেজ সিচুয়েশন ট্যাকেল দেওয়ার জন্য যেরকম বুদ্ধিসম্পন্ন হতে হয় তার লেশমাত্র কর্নেল জুবায়ের শিকদারের মধ্যে খুঁজে পায় না দূর্জয়। কিন্তু এই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র টু শব্দ করার সাহস দেখাতে গেলেই জুবায়ের শিকদার অতি কৌশলে বুঝিয়ে দেয়,

“ আমার অর্ডারের বাহিরে গেলে তোমার চাকরি বিপদে পড়বে মেজর দূর্জয় শাহরিয়ার। “

দূর্জয় কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই হ্যান্ডহেল্ড ট্রান্সিভার খ্যাত ওয়াকি টকির অপরপাশ হতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা বলে উঠে,

“ ফোলো দ্যা অর্ডার মেজর দূর্জয়। “

“ বাট স্যার… “

“ আই সেইড ফলো দ্যা অর্ডার মেজর দূর্জয়। “

এবার কিছুটা তেজ মিশিয়েই কথাটুকু বলে জুলফিকার। কর্নেল জুবায়েরের অর্ডারের সঙ্গে সে নিজেও সম্পূর্ণ একমত নয়। কিন্তু তার কাছে আর কোনো উপায় নেই। দূর্জয়কে এমন কোনো কাজ করার সুযোগ দিবে না সে যাতে দূর্জয়ের চাকরি হুমকিতে পড়ে। তাই সেই পিতৃ স্নেহ তুল্য অনুভূতি হতেই তিনি দূর্জয়ের মঙ্গলের জন্যই এমন কঠোর আচরণ করেন। দূর্জয় শক্ত গলায় জবাব দেয়,

“ রজার দ্যাট স্যার। “

হ্যান্ডহেল্ড ট্রান্সিভারটা ডিসকানেকটেড করে দূর্জয় মিনিট এক পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। চোখ বুজে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ছেড়ে সে নিজের রাগটা ধাতস্থ করার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে সে রাগে হাতের কাছের একটা পানির বোতল তুলে মেঝেতে আছাড় মারে। তার এহেন আচরণে কেঁপে উঠে তাবুতে উপস্থিত সকলে। দূর্জয় কারো দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,

“ প্রস্তুতি নাও। আমরা সন্ধ্যার পর ভবনে প্রবেশ করবো। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here