এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৩.

0
321

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩.

লম্বা করিডোর পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদেহী নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম পরিহিত এক পুরুষ। চলার পথে যাদের মুখোমুখি হচ্ছে সকলেই আপন অবস্থানে দাঁড়িয়ে পড়ছে সাথে সাথে। এক হাত তুলে কপালে চেপে জানাচ্ছে স্যালুট। কিন্তু সেই পুরুষ সেদিকে তোয়াক্কা না করে আপাতত দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে নির্দিষ্ট এক রুমের দিকে। একটা বিশাল আকারের দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই সে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয় খানিকটা। সেই সিংহ দ্বারের একপাশে দেয়ালের সাথে এটাচড রয়েছে আধুনিক কালো রঙের একটি ডিভাইস। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ফিঙ্গার প্রিন্ট সেন্সর। নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলটা সেই সেন্সর ডিভাইসে চেপে ধরতেই এক ধরনের সবুজ সিগন্যাল লাইট জ্বলে উঠে। বিশাল আকারের সেই অটোম্যাটেড দরজা আপন গতিতে দু’দিকে ধীরে ধীরে সরে যায়। খুলে যায় প্রবেশ পথ। যার অর্থ হলো ‘ইউ হ্যাভ দ্যা এক্সেস টু এন্টার দিজ রুম নাও’। এই রুমে প্রবেশের জন্য দুটি জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত ফিঙ্গার প্রিন্ট এবং দ্বিতীয়ত ইউনিফর্ম। যেহেতু এই দুটি জিনিসই তার কাছে রয়েছে তাই সে আর অপেক্ষা না করে প্রবেশ করে ভেতরে।

সুবিস্তীর্ণ রুমের মধ্যিখানে সাদা রঙের আয়তাকার আকৃতির বিশাল এক টেবিলের দু পাশে বসে রয়েছে চারজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাদের গায়েও রয়েছে নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম। টেবিলের এক মাথায় দু’হাতে ভর দিয়ে সামান্য ঝুকে দাঁড়িয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ব্যস্ত চল্লিশার্ধ এক বলিষ্ঠ পুরুষ। কঠোর শৃঙ্খলার ভেতর আবদ্ধ জীবনের প্রভাবে মুখশ্রী জুড়ে মধ্য বয়স্কের ছাপ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। নাম তার জুলফিকার মুজতবা।

জুলফিকারের গুরুত্বপূর্ণ কথার মাঝখানেই মিটিং রুমে প্রবেশ করে সপ্তবিংশতি এক পুরুষ। টেবিলের সামনে এসেই সে দু’হাত পিঠের পিছনে নিয়ে ভাজ করে স্থির ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। মুখশ্রী জুড়ে তার লেপ্টে আছে গম্ভীরতা। সেই গম্ভীর মুখশ্রীর দিকে এক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে জুলফিকার শান্ত স্বরে বলে উঠে,

“ দ্যা ওয়েট ইজ অভার নাও। ইট’স টাইম টু হান্ট। তুমি কি প্রস্তুত? “

শক্ত চিত্তের পুরুষ স্পষ্ট গলায় জবাব দেয়,

“ সদা প্রস্তুত। “

জুলফিকার তার সামনে থাকা ল্যাপটপে কিছু একটা করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সাথে সাথেই তার পিছনে থাকা বিশাল প্রজেক্টের স্ক্রিনে ভেসে উঠে সাত জন যুবকের ছবি। প্রত্যেকের ছবির নিচে ইংরেজিতে গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে তাদের সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য। জুলফিকার বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে উঠে,

“ এই অপারেশন কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেই বিষয়টা মাথায় রেখেই হেডকোয়ার্টার থেকে তোমাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সাথে থাকবে প্লাটুনের সবথেকে দক্ষ সাতজন লেফটেন্যান্ট। আশা করছি ইউ উইল নট লেট আস ডাউন মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়। “

দূর্জয় মুখভঙ্গি স্থির রেখে জবাব দেয়,

“ আই এম অনারড টু সার্ভ মাই কান্ট্রি স্যার। “

জুলফিকার সহ উপস্থিত বাকি চারজনের মুখে ফুটে উঠে মৃদু হাসি। নামের আগে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদবীর অধিকারী জুলফিকার মুজতবা বলে উঠে,

“ লেফটেন্যান্টদের কাছে ইতিমধ্যে অর্ডার পৌঁছে গিয়েছে। দেই’ল বি কামিং সুন। আধঘন্টার মধ্যেই ইউ ক্যান মিট অল অফ দেম ইন দ্যা গ্রাউন্ড। “

__________

রাতের অন্ধকারটা কাটা পড়েছে গ্রাউন্ডের চারিদিকে জ্বলজ্বল করা ইলেক্ট্রিক্যাল বাতির সুফলে। উন্মুক্ত সবুজ মাঠ জুড়ে রয়েছে সমান করে ট্রিমিং করা ঘাসের সমারোহ। ঘন্টা ক্ষানেক আগে থেমে যাওয়া বৃষ্টির প্রমাণ চিহ্ন হিসেবে ভেজা ঘাসগুলোকে খুব সতেজ দেখাচ্ছে।

আচমকা শান্ত মাঠের ঘাসগুলো ব্যাপক বাতাসের প্রকোপে অস্থির হয়ে উঠলো। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো তীক্ষ্ণ সাঁই সাঁই শব্দ। আকাশ হতে নেমে এলো এক সামরিক হেলিকপ্টার। এই বিমানের নাম মিল এমআই ১৭। রাশিয়ায় তৈরী দুই টার্বাইন যুক্ত এই পরিবহন হেলিকপ্টার খুব বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া ব্যবহার হয় না। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। হেলিকপ্টারের ভেতর থাকা মানুষ গুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মূলত তাদের সুরক্ষিত ভাবে আগমন নিশ্চিত করার জন্যই লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা নিজের সিনিয়র কর্নেলের অনুমতি নিয়ে এই হেলিকপ্টার পাঠিয়েছে।

বত্রিশ জন সৈন্য সদস্য ধারণ ক্ষমতাকারী বিমানটা মাটি হতে ক্ষানিকটা উঁচুতে এসেই স্থির হলো। বিমানের উপরের অংশের ব্লেডের মতো ধারালো পাখাটা তখনও শব্দ তুলে একটি শক্ত মাস্তুলকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। বিমানের একদিকের দরজাটা খুলে যেতেই সেই দরজা দিয়ে পরপর সাতজন যুবক সুকৌশলে লাফিয়ে মাঠে নেমে পড়ে। পিঠে তাদের বিশাল বিশাল ব্যাগ প্যাক। তারা নেমে পড়তেই বিমানটা শব্দ তুলে ফের প্রস্থান করে সেখান থেকে।

সুঠাম দেহী সাতজন পুরুষ আলাদা আলাদা প্লাটুনের লেফটেন্যান্ট হওয়ার সুবাদে পরস্পর পরিচিত নয়। আপাতত তারা নিজেদের মধ্যে কোনো কথা বলছেও না। বরং আগ্রহী দৃষ্টি মেলে চারিদিকে তাকিয়ে দেখছে। গ্রাউন্ডের সীমানা প্রান্তে বেশ কিছু বন্দুকধারী নিরাপত্তা কর্মীকে দেখা যাচ্ছে। এছাড়া আর একটাও কাক পক্ষী নেই চারিদিকে।

সাতজনের মধ্যে কিছুটা চঞ্চল দৃষ্টির যুবক হতাশ স্বরে সুধায়,

“ এ কি দিন এলো আমাদের সামরিক বাহিনীর? আমার মতো শত্রুদের জমকে অভ্যর্থনা জানাতে কেউ এলো না? “

বাকি ছয়জন সরু চোখে সেই যুবকের দিকে তাকাতেই তাদের পিছন হতে ভেসে আসে বুট শু পরিহিত কারো হেঁটে আসার আভাস। মুহুর্তেই সাতজন সম্পূর্ণ পিছনে ঘুরে ফিরে তাকায়। অন্ধকার ছাপিয়ে এগিয়ে আসা দীর্ঘদেহী ইউনিফর্ম পরিহিত পুরষের দিকে তাদের দৃষ্টি স্থির হয়।

দূর্জয় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে সোজা হয়ে তাদের মুখোমুখি দাঁড়ায়। কোনো ভনিতা না করে বেশ শান্ত গলায় বলে উঠে,

“ আমি মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়। আপনারা যেই অপারেশনের জন্য এই মুহুর্তে এখানে উপস্থিত আছেন সেই অপারেশন আমার আন্ডারেই লিড হবে। “

মুহুর্তেই সাতজন যুবক একহাত তুলে স্যালুট করে স্কাউটের ভাষায় আরামে দাঁড়ায়। দূর্জয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে একবার সাতজনের মুখশ্রী দেখে নেয়। আধঘন্টা আগে স্ক্রিনে দেখে আসা এই সাতজনের নাম সে ভুলে নি। তবুও সে বলে,

“ সকলে এক এক করে নিজেদের নাম বলুন এবং আপনি কেন নিজেকে এই অপারেশনের উপযুক্ত বলে মনে করেন তার একটা কারণ বলুন। “

সর্ব ডানে দাঁড়িয়ে থাকা চঞ্চল দৃষ্টির যুবক সর্বপ্রথম মুখ খুলে,

“ লেফটেন্যান্ট তামজিদ সাইফ। আমি নিজেকে এই অপারেশনের জন্য উপযুক্ত মনে করি কারণ আমি কখনো ময়দান ছেড়ে পালাই না, বরং শত্রুকে সেই ময়দানে দাফন করাই আমার একমাত্র লক্ষ্য। “

সাইফের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যাম যুবক কাটকাট স্বরে বলে উঠে,

“ লেফটেন্যান্ট আরাফাত প্রত্যয়। আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য, যুদ্ধের ময়দানে শহীদের মর্যাদা লাভ করা। তাই এতো গুরুত্বপূর্ণ এক অপারেশনের জন্য আমি নিজেকে যোগ্য মনে করি। “

দূর্জয় সরু দৃষ্টি মেলে প্রত্যয় নামক যুবককে আগাগোড়া পরখ করে। যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হওয়া প্রত্যেক সেনার বুকে লালিত এক স্বপ্ন। দেশের জন্য জীবন দিতে যেই সেনা দ্বিধা বোধ করে সে কখনোই একজন সৈন্য হওয়ার মর্যাদা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না। কিন্তু প্রত্যয় নামক এই যুবকের বুকে শুধু শহীদ হওয়াটাই যেন একমাত্র সুপ্ত ইচ্ছে নয়। বরং দূর্জয়ের মনে হচ্ছে সে শহীদ হওয়ার উছিলায় গভীর ভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে ইচ্ছুক।

প্রত্যয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের কথা শুনে দূর্জয় ভাবনা ছেড়ে বের হয়। এই মুহুর্তে বেশ চিকন এবং লম্বা করে এক যুবক আপন পরিচয় দিচ্ছে।

“ লেফটেন্যান্ট সাদাত সরকার।… “

পর্যায়ক্রমে এক এক করে বাকি চারজনও নিজেদের নাম এবং উপযুক্ত মনে হওয়ার কারণ জানায়। অবশিষ্ট চারজনের নাম হলো ইমতিয়াজ রাফি, রিদওয়ান ইশরাক, ফারদিন ইসলাম এবং জুনায়েদ রওফ। প্রাথমিক পরিচয় পর্বটুকু শেষ হতেই দূর্জয় সাতজনকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আগামীকাল সকাল সাতটায় তোমাদের সাথে দেখা হবে। গুড নাইট। “

দুই বাক্যের কথাটুকু শেষ করেই দূর্জয় বিলম্ব না করে সেখান থেকে প্রস্থান করে। পিছনে রয়ে যায় সেই সাত যুবক। সাইফ হতাশ গলায় বলে,

“ এ কার আন্ডারে আমার অভিযান করতে হবে? মেজরের মুখ দেখেই তো আমার মনের সুপ্ত রসিকতারা নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেললো। তার উপর আবার এখন বাজছে প্রায় রাত সাড়ে তিনটা। ঘুমাতে ঘুমাতে চারটা বাজবে। মাত্র দুই ঘন্টা ঘুম নসিব হলো আমার ভাগ্যে? এরকম চলতে থাকলে তো অভিযান শেষে আমি দু চোখের নিচে বিশাল ডার্ক সার্কেল গিফট পাবো। “

রাফি শান্ত পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে ঘুম জড়ানো স্বরে বলে উঠে,

“ আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো যে অন্তত দুই ঘন্টার জন্য হলেও কপালে ঘুম নসিব হয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে আফসোস করতে থাকলে সেটাও হারাবে। “

রাফিকে অনুসরণ করে জুনায়েদও তার পিছু পিছু যেতে যেতে বলে উঠে,

“ তাছাড়া আমার মেজরকে বেশ পছন্দ হয়েছে। চেহারার মধ্যে ব্যক্তিত্বের ছাপ স্পষ্ট। “

রাফি আর জুনায়েদের পিছু পিছু বাকিরাও এগিয়ে গেলে সাইফ ফের হতাশ গলায় সুধায়,

“ এই ছয়জন দেখি আস্ত উজবুক। সমস্যা নেই। আমার মতো রঙ পুরষের সাথে থাকতে থাকতে এদের ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট লাইফও রঙে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। “

সবশেষে সাইফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় বাকিদের পিছু পিছু। আগামীকাল তাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক নতুন ভোর।

__________

কাঠের তৈরী সরু বিছানার মধ্যিখানে হেলান দিয়ে বসে আছে বাণী। আনমনে ডুবে আছে সে আপন ভাবনার জগতে। এতো বছর পর আচানক দূর্জয়ের সাথে দেখা হওয়াটা যেন তার মস্তিষ্কের সকল সাজানো পরিকল্পনা এলোমেলো করে দিয়েছে। বাণী মনে মনে নিজেকে সুধায়,

“ এলোমেলো হলে চলবে না। এতদূর এসে ধরা পড়তে চাই না আমি। দূর্জয়ের সাথে আমার সাক্ষাৎ কেবলমাত্র একটা এক্সিডেন্ট ছিলো। সেই কাকতালীয় এক্সিডেন্টে বিভোর হয়ে ধরা পড়লে সব শেষ হয়ে যাবো। এটাই শেষ সুযোগ আমার। “

বাণীর ভাবনার মাঝেই একটা ছোট্ট কোমল হাত তার গাল ছুঁয়ে দেয় আলতো করে। বাণীর ধ্যান ভাঙে। সে চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকায়। তার বুকের সাথে লেপ্টে মাথাটা সামান্য উঁচু করে তার দিকে তাকিয়ে আছে ল্যাভেন্ডার রঙের ফ্রক পরিহিত এক শিশু। সেই ছোট্ট মানবী কোমল স্বরে প্রশ্ন করে উঠে,

“ তুমি কিভাবে ব্যথা পেয়েছো মাম্মা? “

ছোট্ট মুখটার পানে তাকাতেই বাণীর মুখে মৃদু হাসি ফুটে। সে নরম গলায় বলে,

“ মাম্মা তোমাকে বলেছিলাম না যে আমরা হাইড এন্ড সিক খেলছি? “

ছোট্ট মানবী উপর নিচে সামান্য মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। বাণী তার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলে,

“ গেম খেলতে নিয়েই মাম্মা পড়ে গিয়ে সামান্য ব্যথা পেয়েছি। তুমি চিন্তা করো না মা। সেড়ে যাবে। “

পাঁচ বছর বয়সী শিশুটা কিছুক্ষণ বাণীর চেহারার পানে চেয়ে থেকে প্রশ্ন করে,

“ পাপা আমাদের খুঁজে ফেললে কি আমরা হেরে যাবো মাম্মা? “

পাপা শব্দটা শুনতেই বাণীর মুখ মলিন হয়ে যায়। সে কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে মৃদু স্বরে বলে উঠে,

“ বহ্নি, মা আমার। মাম্মা তোমাকে তিনটা পয়েন্ট মেমোরাইজ করিয়েছি। তোমার মনে আছে সেগুলো? “

বহ্নি প্রফুল্ল গলায় জবাব দেয়,

“ ইয়েস মাম্মা। “

বাণী হেসে বলে,

“ বলো তো সেগুলো কি কি? “

বহ্নি এবার মায়ের বুক থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে। বিচক্ষণ শিশুর ন্যায় নিজের হাতের আঙুল দ্বারা গণনা করতে করতে জবাব দেয়,

“ পয়েন্ট ওয়ান, মাম্মা ছাড়া আর কাউকে ট্রাস্ট করবো না। পয়েন্ট টু, কেউ কোনো কুয়েশ্চন করলে কোনো উত্তর দিবো না। পয়েন্ট থ্রি, আমি গুড গার্ল হয়ে মাম্মার সব কথা শুনবো। “

মেয়ের কথা শেষ হতেই বাণী হেসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“ এখন ঘুমিয়ে পড়ো মা। “

বহ্নি মায়ের বাধ্য মেয়ে। সে এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে চোখ বুজে নেয়। বাণী মেয়ের কাধ সমান রেশমের ন্যায় চুলে হাত বুলিয়ে দিতেই বহ্নি গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। ঘুম নামে না কেবল বাণীর চোখে। তার মাথায় কিলবিল করছে অসংখ্য চিন্তা। আজকের রাতটা এখানে তার মাথা গুজার ঠাই হয়েছে। কিন্তু আগামীকাল? আগামীকালের মধ্যেই তার বহ্নিকে নিয়ে চট্টগ্রাম ছেড়ে বের হতে হবে যেকোনো মূল্যে। এই জাহান্নাম ছেড়ে যত দূরে যাওয়া যায় সে পালিয়ে যাবে।

__________

রাতের আঁধার চিড়ে ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু হয়েছে। মৃদু হাওয়া বয়ে আসছে খোলা জানালা দিয়ে। সেই হাওয়ায় রুমের বেবি পিংক রঙের পাতলা ফিনফিনে পর্দাটা উড়ে স্থানচূত্য হয়। সাদা আর গোলাপি মিশেলের রঙ করা রুমটার প্রতিটা কোণা বিভিন্ন সফট টয়স দিয়ে পরিপূর্ণ। যে কেউ রুমে প্রবেশ করে প্রথম দর্শনেই নিশ্চিত হতে পারবে যে এটা একটা বাচ্চার রুম। সেই রুমের মধ্যিখানে বিছানার এককোণে দু’হাতের উপর থুতনি ঠেকিয়ে বসে রয়েছে এক পুরুষ। অতি রক্তিম চোখ জোড়া নিবদ্ধ বেড সাইড কেবিনেটের উপর রাখা একটা ফোটো ফ্রেমের দিকে। পরিপূর্ণ এক নারী হাস্যজ্বল মুখে একটা বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে তার পানে চেয়ে রয়েছে। বাচ্চাটা একহাতে একটা খেলনা নিয়ে সেটা নিয়ে খেলতে ব্যস্ত। আনমনে নিজেদের ভুবনে ডুবে থাকা দুই মানবীর এই ছবিটা তোলা হয়েছিলো তাদের খুব অজান্তে।

আচানক দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। ক্রোধিত পুরুষ নিজের রক্তিম দৃষ্টি সেই ফোটো ফ্রেমের দিকে স্থির রেখে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিতেই একজন যুবক বেশ ধীরে দরজার নব ঘুরিয়ে রুমে প্রবেশ করে।

চোখ দুটো বন্ধ করে গভীর ভাবে নিঃশ্বাস ছেড়ে রুমে প্রবেশ করা যুবকের দিকে তাকাতেই সেই পুরুষের চোখ জোড়া বড় হয়ে গেলো। ব্যস্ত পায়ে উঠে সে এগিয়ে যায় সেই যুবকের দিকে। চিলের ন্যায় ছোবল মেরে ছিনিয়ে নেয় তারা হাতে থাকা শুভ্র ওড়নার অর্ধেক অংশ। যুবকটা মাথা নত রেখে বলে,

“ জঙ্গলের অপর প্রান্তের শেষ মাথায় হাইওয়ে যাওয়ার পথে একটা গাছের কাছে এটা পাওয়া গিয়েছে। আর… “

ক্রোধিত পুরুষ অধৈর্য্য গলায় প্রশ্ন করে,

“ আর? “

যুবকটা কিছু বলতে ভয় পাচ্ছে। সে বেশ কাচুমাচু করছে কথা বলতে। অধৈর্য্য সেই পুরুষ রাগে এবার একটা ধমক দিয়ে উঠতেই সেই যুবক নিজের অপর হাতে থাকা ছোট সাদা মুক্তার দুলটা এগিয়ে দিয়ে ভীত গলায় বলে উঠে,

“ আমরা খুঁজতে হাইওয়েতে যাই। সেখানে হাইওয়ের একপাশে আমরা এই কানের দুলটা খুঁজে পাই। আনফরচুনেটলি সেখানে রাস্তায় ক্ষানিকটা রক্তও পড়ে ছিলো। হতে পারে ওটা উনারই রক্ত। “

ক্রোধ এবং ভয়ে মিশ্রিত অনুভূতির জোয়ারে মনটা বেশ বিষিয়ে উঠে অধৈর্য্য পুরুষের। সে আর কিছু বলতে পারে না। নীরবে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় সে জানালার কাছে। অত:পর বেশ শান্ত গলায় বলে উঠে,

“ আমার জান নিয়ে পালানোর অপরাধে মন চাইছে এই মুহুর্তে তোমাকে জানে মেরে ফেলি বাণী। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here