এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১. ( অবতরণিকা )
নিস্তব্ধ রাতে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দিক বেদিক ভুলে শরীরের সমস্ত শক্তি খরচ করে প্রবল বেগে দৌঁড়াচ্ছে এক নারী। পড়নে তার এক সাদা রঙের থ্রি পিস। কোমর সমান খোলা কেশ গুচ্ছ বাতাসের প্রকোপে এলোমেলো ভঙ্গিতে উঁড়ছে। নগ্ন পায়ের পাতায় মেখে আছে কর্দ মাটি। বার বার ভীত নয়নে সে পিছু ফিরে তাকাচ্ছে। পাছে আবার কেউ তাকে ধাওয়া করে কিনা সেই ভয়! দৌঁড়ের ফলে তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও সে থামে না। পাপের সাম্রাজ্য ছেড়ে বেরোতে হলে তার থামলে চলবে না।
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সে যতই এগোচ্ছে ততই মনে হচ্ছে তার পায়ের অদৃশ্য শিকল ধীরে ধীরে ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। আচমকা সেই নারী লক্ষ্য করে অন্ধকার জঙ্গলের সীমানা পেরিয়ে দূরে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় এক হাইওয়ে রোড দেখা যাচ্ছে। মুহুর্তেই সেই নারীর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে এক অদম্যকে জয় করার পার্থিব হাসি। প্রাণপণে সে ছুটে এগিয়ে যায় সেই হাইওয়ের দিকে। দৌড়ানোর সময় গাছের এক ডালের সাথে তার গলার ওড়না আটকে যায়। সেই নারী দৌড় থামিয়ে পিছনে ফিরে দু’হাতে ওড়না টেনে ছোটানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এতে উল্টো ওড়না ছিড়ে ওড়নার অর্ধেকটা তার হাতে চলে আসে এবং বাকি অর্ধেক সেই ডালেই আটকে রয়।
বিচলিত নারী অপেক্ষা না করে সেই অর্ধেক ওড়নাটুকুই হাতে নিয়ে হাইওয়ের দিকে ফের ছুটতে শুরু করে। কিছু মুহুর্তের ব্যবধানেই সে সুনসান হাইওয়ে তে পৌঁছে যায়। উদগ্রীব নয়ন মেলে সে চারিদিকে তাকায়। সম্পূর্ণ হাইওয়ে তে একটা গাড়িরও অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না। দূর দূর পর্যন্ত কোনো দোকানও চোখে পড়ছে না।
কিছুক্ষণ আগে যেই আশার আলো তার মনে জন্মেছিলো মুহুর্তেই সেই আশার আলো চোরাবালির অতলে হারিয়ে যেতে শুরু করে। আশাহত দৃষ্টি মেলে সেই নারী আকাশ পানে চায়। গুমোট আকাশ ভেঙে যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে। ক্লান্ত এই শরীরকে টেনে আর দৌঁড়ানো সম্ভব নয় তার পক্ষে। এবারও কি তবে সে ব্যর্থ হবে? ফিরতে হবে সেই জাহান্নাম তুল্য পাপের রাজ্যে?
পরাজয় মেনে নিয়ে অসাড় হয়ে আসা নারী দেহটা মুহুর্তেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে হাইওয়ের মধ্যখানে। চোখ ফেটে তার গড়িয়ে পড়ে কষ্ট চিহ্ন। তার সাথে পাল্লা দিয়ে আকাশও গর্জন তুলে বর্ষণ নামায়। ক্লান্ত রমণীর সম্পূর্ণ চিত্ত মুহুর্তেই ভিজে যায় বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটায়। সে মুখ তুলে ঊর্ধ্বপানে চায়। চরম অভিমান ও ক্লেশ সেই চাহনিতে। যেন নীরবে উপরওয়ালার সাথে কোনো বোঝাপড়ায় মশগুল সে।
আচমকা কি হলো কে জানে। এক বিকট শব্দ ভেসে আসলো দূর হতে। সাথে সাথেই রাস্তার দু ধারের ল্যাম্পপোস্টের আলো নিভে গেলো। সম্পূর্ণ রাস্তা ডুবে গেলো অন্ধকারে। ক্লান্ত নারী ভয়াবহ চমকে উঠে। অসাড় দেহ টেনে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। সাথে সাথেই কাছে কোথাও আবার বিকট শব্দ তুলে বজ্রপাত হয়। দুই হাতে কান চেপে ধরে ভীত নয়ন জোড়া বুজে নেয় রমণী। ঠিক সেই মুহুর্তেই রাস্তার ডানদিক হতে ভেসে আসে গাড়ির হর্ণের শব্দ। চমকে চোখ মেলে তাকাতেই দেখে অন্ধকার চিরে এক ফালি আলো এসে পড়েছে তার মুখশ্রী জুড়ে। ভালো করে লক্ষ্য করতেই বুঝতে পারে এই আলোর উৎস হচ্ছে দ্রুত বেগে অগ্রবর্তী গাড়ির হেডলাইট হতে।
__________
অন্ধকার রাস্তায় হেডলাইটের আলোয় আচমকা মাঝ রাস্তায় এক নারী অবয়ব দেখতে পেয়েই গাড়ির মালিক তড়িঘড়ি করে ব্রেক কষে। কিন্তু ততক্ষণে খুব দেরি হয়ে যায়। গাড়ির অগ্রভাগের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে সেই নারী দেহ লুটিয়ে পড়ে রাস্তার একপাশে। এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও গাড়ির মালিকের চোখে মুখে কোনো আতংক নেই। যেন আতংকিত হওয়া এই পুরুষের ধাচে নেই। বরং সে বেশ বিরক্ত হয়। এই অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনার জন্য মনে মনে আহত নারীকেই দোষারোপ করে সে। কি দরকার ছিল হাইওয়ের মতো রাস্তার মধ্যিখানে এসে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকার?
খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে আসে এক দীর্ঘ সুঠাম দেহী পুরুষ। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়তেই তার কালো শার্টটা শরীরের সাথে লেপ্টে যায়। স্পষ্ট হয় তার পুরুষালী দেহের গঠন। কালো শার্টের সাথে মিলিয়ে কালো বেল্ট এবং প্যান্টও গায়ে শোভা পাচ্ছে। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় সে দেখতে থাকে রাস্তার একপাশে পড়ে থাকা আহত নারী দেহটাকে। কাল গুণে কবি ঠিকই বলেছিলেন ‘নারী মানেই বিপদ’৷ কোন কবি বলেছিলেন সেটা মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হলো এই মুহুর্তে কি সে নিজের অতিব গুরুত্বপূর্ণ কাজটার জন্য নির্দিষ্ট ঠিকানায় আগে পৌঁছাবে নাকি এই নারী নামক উটকো ঝামেলাকে বয়ে হসপিটাল নিয়ে যাবে?
প্রশ্নগুলো মনে উঁকি দিতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। এগিয়ে যায় সেই আহত নারীর দিকে। এক হাঁটু ভাজ করে সেই নারীর পাশে বসে সে। রাস্তায় উবুড় হয়ে পড়ে থাকা নারীর মুখশ্রী জুড়ে লেপ্টে আছে ভেজা চুল। সেই চুলের আড়ালেই রয়ে যায় তার মুখখানা। গাড়ির মালিক সেই মুখ দেখার প্রয়োজন বোধ করলো না। সে সোজা নারীর বাম হাতের কব্জি একহাতের মুঠোয় নিয়ে দু আঙুলের সাহায্যে ধমনি পরীক্ষা করে। বেঁচে আছে। ছোট করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আগুন্তকঃ পুরুষ।
অত:পর বিচক্ষণ দৃষ্টি মেলে ফের পরখ করে নারীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত। সাথে সাথেই তার ভ্রু জোড়া কুচকে আসে। বেশ ভূষা দেখে এই নারীকে ভদ্র পরিবারের মেয়ে মনে হলেও, এই নারীর বর্তমান অবস্থা মোটেও সংতোষজনক নয়। নগ্ন পায়ের পাতায় কোনো জুতা নেই। অর্ধেক ছেড়া ওড়নাটাও আগুন্তকের দৃষ্টি এড়ায় না। মুহুর্তেই তার মস্তিষ্কে খেলে যায় এক ভয়াবহ ভাবনা। এই আনফরচুনেট এক্সিডেন্টের পূর্বে কি এই নারী কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে?
আর কিছু ভাবতে পারে না সে। মৃদু উদ্বেগ মিশ্রিত স্বরে ডাকে,
“ এক্সকিউজ মি মিস? “
আগুন্তকের ছোট্ট তিন শব্দের প্রশ্নের পিঠে কোনো সাড়া দেয় না সেই নারী। বাধ্য হয়ে নিজের ঠান্ডা হাত বাড়িয়ে সেই নারীর মুখের উপর থেকে কিছু চুল সড়িয়ে দেয় সে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠে সেই নারী মুখশ্রী। কপালের একপাশ ফেটে রক্ত ঝড়ায় গালের একপাশটা রক্তে রাঙা হয়ে আছে। সেই রক্ত ধুয়ে নেওয়ার চেষ্টায় মত্ত বৃষ্টির পানি। উন্মোচিত নারী মুখখানার দিকে আগুন্তকের দৃষ্টি স্থির হতেই খুব কাছে কোথাও ফের বজ্রপাত হলো। সেই বজ্রপাতের সাথে আগুন্তকের বুকের ভেতরও শব্দ করে ঝংকার দিয়ে উঠে। নিজের শৃঙ্খলবদ্ধ জীবনে এই মানবীর পরিপূর্ণ নারী রূপে আগমন তা-ও এরকম এক পরিস্থিতিতে বেশ অপ্রত্যাশিত ঠেকে তার কাছে। রক্ত মাখা শীতল গালটা আলতো হাতে ছুঁয়ে অস্ফুটে সে বলে উঠে,
“ বাণী। “
__________
মস্ত আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে ধারাপটে। থেমে থেমে তীক্ষ্ণ স্বরে ডেকে উঠছে গুমোট আকাশটা। বৃষ্টির প্রবল ধারায় ও তীব্র বাতাসের বেগে শহরের আনাচে কানাচে ইলেক্ট্রিসিটির বড্ড সংকট দেখা দিয়েছে। কিন্তু হসপিটালগুলোতে সেই সংকট দেখা দিলো না মোটেও। কৃত্রিম ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবহার করে ঠিকই দেওয়া হচ্ছে সেখানে চিকিৎসা সেবা।
তীব্র মাথাব্যথা নিয়ে ধীর গতিতে চোখ মেলে তাকায় বাণী। জ্ঞান ফেরার সাথে সাথেই তার নাকে গিয়ে ঠেকে নাম না জানা বহু মেডিসিনের গন্ধ। সাথে সাথেই তার শূন্য পেটটা গুলিয়ে আসে। চোখ বুজে নেয় ফের। মনে পড়ে যায় সেই সুনসান হাইওয়েতে ঘটে যাওয়া এক্সিডেন্টের কথা। আতংকিত চোখ জোড়া মেলে তাকায় সে এবার। উদ্বিগ্ন দৃষ্টি মেলে চারিদিকটা পরখ করে বুঝতে পারে সে এখন কোনো এক হসপিটালের প্রাইভেট কেবিনে শয্যারত অবস্থায় আছে। কেবিনের এককোণে ঝুলন্ত দেয়াল ঘড়ি থেকে সময়টাও দেখে নেয় সে। রাত ১টা বেজে ২৪ মিনিট।
বাণী কোনো ভাবেই মনে করতে পারছে না যে সে এই হসপিটালে কিভাবে পৌঁছালো। সেই গাড়ির মালিক কি তাকে আহত অবস্থায় হসপিটালে নিয়ে এসেছে? নাকি সে ধরা পড়ে গিয়েছে? দ্বিতীয় প্রশ্নটা মনে উঁকি দিতেই বাণীর সমস্ত অঙ্গ শিউরে উঠে। পরমুহূর্তেই মনে মনে নিজেকে এ বলে আশ্বস্ত করে যে সে যদি ধরাই পড়তো তাহলে তারা তাকে হসপিটালে নিয়ে এসে সেবা শুশ্রূষা করতো না কখনো।
আশ্বাস দিয়ে মনকে শান্ত করে বাণী আহত দেহ টেনে উঠে বসে। বেডের পাশে ছোট কেবিনেটের উপর থাকা প্লাস্টিকের পানির বোতলটা দেখে গলায় প্রচুর তৃষ্ণা অনুভব করে সে। সতর্ক দৃষ্টি মেলে আশেপাশে একবার তাকিয়ে বোতল হতে সে কিছুটা পানি পান করে নেয়। মনের সুপ্ত ভয়টা মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরনে বিষাদের ন্যায় আঘাত করছে। এখান থেকে পালাতে হবে তার অতিদ্রুত। পৌঁছাতে হবে অপেক্ষারত কারো কাছে।
__________
শুভ্র ওড়না দিয়ে অর্ধেক মুখশ্রী আড়াল করে অনেকটা নেকাবের মতো বেধে রেখেছে বাণী। অশান্ত উন্মুক্ত চোখ জোড়া ভয়ে তটস্থ হয়ে চারিদিকে নজর বুলাতে ব্যস্ত। তার কেবিনের বাহিরে একজন পুরুষ অনেকটা পাহারাদারের ন্যায় দাঁড়িয়ে ছিলো। আড়াল হতে এই দৃশ্য দেখার পর হতে বাণীর ভয় হচ্ছে। কোনো মতে সে ওই লোকের চোখ ফাঁকি দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এসেছে। একবার এই হসপিটাল থেকে বের হতে পারলে সে হাফ ছেড়ে বাঁচে।
__________
বাহিরে তখন তুমুল বর্ষণ। কালো শার্ট পরিহিত পুরুষ বলিষ্ঠ হাতে সু কৌশলে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছে। আচমকা ফোন বেজে উঠতেই তার মনোযোগ বিঘ্নিত হয়। এক পলক ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায় সে। স্ক্রিনে ভেসে উঠা নামটা দেখতেই সে কানে ব্লুটুথ দ্বারা চালিত ইয়ার বাড গুজে নেয়। কল রিসিভ করে শক্ত পুরুষালি কণ্ঠে বলে,
“ বলো হাসান। “
ফোনের অপরপাশ হতে বলা শব্দগুচ্ছ শুনে তার নির্লিপ্ত মুখায়ব শক্ত রূপ ধারণ করে। রাগ মিশ্রিত সুরে কিছু একটা আদেশ দিয়ে কল কেটে দেয়। গাড়ির স্পিড বাড়ায়। মিনিট পাঁচ একের মধ্যে পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট হসপিটালে। দ্রুত গাড়ি পার্ক করে রেখে বেরিয়ে আসে সে। কল লিস্ট হতে ফের হাসানের নাম্বার ডায়াল করে ফোন হাতে রেখে ব্যস্ত পায়ে মেইন এন্টারেন্সের দিকে এগিয়ে যায়।
__________
মেইন এন্টারেন্স হয়ে বেরিয়ে আসার সময় অসাবধানবসত সু বলিষ্ঠ, কঠোর পোক্ত একটা দেহের সঙ্গে ধাক্কা লাগতেই বাণী জড়বুদ্ধির ন্যায় কুঁকড়ে যায়। কোমল স্বরে ক্ষমা সূচক শব্দ সরি উচ্চারণ করেই সে চোখ তুলে তাকায় আগুন্তকঃ মানুষটার দিকে। মুহুর্তেই তার বুকের কোণের অচিন খাঁচায় কিছু একটা ধক করে উঠে। ক্ষাণিকক্ষণ আগে পানি পান করে তৃষ্ণা মেটানো গলায় যেন চৈত্রের খরা নামে। তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা আগুন্তকের দৃষ্টিও তার উপর নিবদ্ধ বুঝতে পেরেই যেনো বাণীর রক্তশূণ্য মুখশ্রী বরফের ন্যায় জমে যায়। মস্তিষ্ক জুড়ে আলোড়ন করে উঠে কেবল একটি নাম।
“ শাহরিয়ার দূর্জয়। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]