এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৪.
চট্টগ্রাম শহরের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা আধুনিকতার ছোঁয়ায় মোড়ানো প্রাইভেট হাসপাতালটার সপ্তম তলা হতে তেরো তলা পর্যন্ত ফ্লোর গুলো সব প্রাইভেট কেবিনের আওতাভুক্ত। ডক্টর হুমায়রার তত্ত্বাবধানে মুহুর্তেই টপ ফ্লোরটা তথা থার্টিন্থ ফ্লোর সম্পূর্ণ খালি করার ব্যবস্থা করা হলো। সেই ফ্লোরে চিকিৎসাধীন পেশেন্টদের অন্য ফ্লোরের খালি কেবিন গুলোতে শিফট করা হলো যতদ্রুত সম্ভব। এই ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করা হুমায়রার একার পক্ষে এতো সহজ হতো না যদিও। কিন্তু ইবাতের একটা ফোন কলেই বিষয়টা অত্যন্ত সহজ হয়ে গেলো। হসপিটাল অথরিটির কাছে পৌঁছে গেলো সূক্ষ্ম আদেশ। চট্টগ্রাম শহরের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর স্ত্রী অসুস্থ। তার চিকিৎসার পাশাপাশি প্রাইভেসি মেইনটেইন এর দায়িত্বটাও হসপিটাল কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দিতেই তারা ব্যাপারটা আমলে নিলেন।
স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণ স্পিডে গাড়ি চালিয়ে বাণীকে নিয়ে হসপিটালে পৌঁছায় হিরণ। তার পিছু পিছু আরো দু গাড়ি ভর্তি লোক এসেছে নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে। তবে তাদের গেটাপ এবং ভঙ্গিমা এমন যেনো তারা অতি সাধারণ সিভিলিয়ান মাত্র। হসপিটালের সামনে নামতেই তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো সাধারণ মানুষের ভীড়ে।
ডক্টর হুমায়রা আগে থেকেই দুজন ওয়ার্ড বয়কে নিয়ে নিচে প্রস্তুত ছিলো হিরণ এবং বাণীকে রিসিভ করতে। তিনি বিলম্ব না করে অতি দ্রুত লোক সমাগম এড়িয়ে তাদের নিয়ে স্টাফদের জন্য বরাদ্দকৃত শূন্য লিফটে উঠে থার্টিন বাটনে প্রেস করে। মিনিট একের মধ্যে লিফট পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট ফ্লোরে।
বাণীর শ্বাসকষ্টের পরিমাণ বেড়েছে বৈ কমে নি বিন্দু পরিমাণ। গায়ের জ্বরটাও বেপরোয়া হয়ে পড়েছে বেশ। প্রাথমিক লক্ষণ এবং অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে হুমায়রা নিউমোনিয়ার আশংকাই করে। তবে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে সে বিশেষজ্ঞ ডক্টরের সাথে আলাপ করে কিছু টেস্ট করার ব্যবস্থা করে। উল্লেখ্য টেস্ট গুলোর মধ্যে মুখ্য হলো চেস্ট এক্স-রে এবং সিবিসি টেস্ট। তার পাশাপাশি পালস অক্সিমেটরি নামক ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাডে উপস্থিত অক্সিজেনের পরিমাণটাও মেপে নিলো।
টেস্ট গুলোর রিপোর্ট যথাসম্ভব দেওয়ার আদেশ দিয়েই হুমায়রা বাণীর প্রাথমিক জ্বর নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়। তবে তার পূর্বে সে হিরণকে বলে কেবিনের বাহিরে যেতে। হুমায়রার আদেশ শুনে হিরণ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
“ আমার বাহিরে যেতে হবে কেন? “
“ নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে হিরণ সাহেব। রোগটা ছোঁয়াছে। রিপোর্ট পজিটিভ হলে বাণীকে সম্পূর্ণ আইসোলেটেড করতে হবে আমাদের। তাই নিশ্চিত রিপোর্ট পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করা গুরুত্বপূর্ণ। “
হিরণ ম্লান দৃষ্টি মেলে একবার তাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে অবস্থিত ডক্টর হুমায়রা সহ আরো দুজন নার্সের দিকে। তারা তিনজনই মাস্ক, সার্জিক্যাল গ্লাভস ও ক্যাপ পরিহিত অবস্থায় আছে। আশংকাজনক রোগের সংক্রমণ হতে নিজেদের বাঁচানোর সকল ব্যবস্থাই তারা নিয়েছে। একপলক তাদের দেখে নিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে হিরণ তাকায় শুভ্র বেডে শুয়ে থাকা দুস্থ দেহের মালিকানার দিকে। প্রিয়তমার এহেন দশা হিরণের বিবেক কাঁপিয়ে তুলে। মনে মনে নিজেকে শুধায়,
“ ভুল করেছিস হিরণ। নিজের কথার বরখেলাপ করেছিস। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছিস। যার জন্য নিজের পাষবিক রূপটা খোলসে ঢেকে রাখার ওয়াদা করেছিলি তার সামনেই নিজের পশুর ন্যায় রূপটা নির্মোচন করেছিস। কষ্ট দিয়েছিস বাণীকে। আরো একবার। “
বিবেকের দংশন উদয় হতেই হিরণ আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। এলোমেলো পা ফেলে দ্রুত সেই কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে আসে। করিডোরের শেষ মাথায় উন্মুক্ত এক বারান্দা রয়েছে। সেই বারান্দায় এসেই হিরণ পকেট হতে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে। অত:পর লাইটারের সাহায্যে একটা সিগারেট জ্বালিয়েই দু ঠোঁটের ফাঁকে তা চেপে ধরে। শান্তি মিলছে না। সিগারেটের অসহন ধোঁয়ার সঙ্গে তার আত্মগ্লানি উঁড়ে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে না। নিজের অসহায় অভিব্যক্তি হিরণ কাকে বোঝাবে?
ওই কেবিনে অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকা মেয়েটা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মেয়েটার সাথে তার জীবন ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। একই দঁড়ির দুই প্রান্তে বাঁধা তারা। কিন্তু মেয়েটা বোকা। বড্ড বোকা। তাইতো বাঁধা দড়ি সহই সে ছুটে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়। এই বুদ্ধিহীন আচরণের ফলে মেয়েটা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তার পাশাপাশি দঁড়ির অপরপ্রান্তের মানুষটাও সেই আঘাতের ক্ষীণ অংশীদার হয়। কিন্তু বোকা মেয়েটা তা মানতে নারাজ।
সিগারেটে শেষ টানটা দিয়েই হিরণ অবশিষ্ট অংশটুকু নিজের বাম হাতের মুঠোয় পুরে আহত স্বরে শুধায়,
“ তোমাকে ভালোবাসার কথা আমার আর ইহ জনমে মুখ ফুটে বলা হবে না বাণী। সেই সুযোগ আমি নিজ পাপে হারিয়েছি। কিন্তু এই নিঝুম রাতের আকাশ সাক্ষী রইলো, আমি একটা জানোয়ার এটা যেমন সত্য, ঠিক একইভাবে আমি তোমার ভালোবাসায় আহত এটাও ধ্রুব সত্য। “
__________
দশজন যুবক পাথরের মূর্তির ন্যায় সটান দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের দলনেতা আব্রাহাম। সকলের কাধেই রয়েছে ব্যাগ প্যাক। দেখে যে কেউ মনে করবে একদল ভার্সিটি পড়ুয়া যুবক বোধহয় ভ্রমণ যাত্রায় বের হওয়ার জন্য তৈরী হয়েছে। যদি তারা জানতো তাদের উদ্দেশ্যটা কতো ভয়ংকর! এ কোনো ভ্রমণযাত্রা নয়, বরং মরণ যাত্রা। যেখানে মানুষ মারে, মানুষ মরে। শমসের মজুমদারের আলিসান বাড়ির ত্রী সীমানার ভেতর এই মুহুর্তে আব্রাহাম সহ তার সঙ্গীদের অবস্থান। অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে তারা শমসের মজুমদারের।
অবশেষে তাদের অপেক্ষার পালা শেষ হয়। বিশাল গেট পেরিয়ে বাড়ির সীমানায় প্রবেশ করে শমসের মজুমদারের গাড়িটা। গাড়ি হতে নেমেই শমসের মজুমদার মুখে স্বভাবসুলভ হাসি বজিয়ে রেখে আব্রাহামের দিকে এগোয়। আব্রাহাম রাশভারী স্বরে শুধায়,
“ আমরা প্রস্তুত স্যার। “
শমসের মজুমদারের হাসির রেখা দীর্ঘ হয়। তিনি এগিয়ে গিয়ে আব্রাহামের কপালে চুমু খেয়ে বলে,
“ আমি জানি তুমি আমার মান রাখবে। “
আব্রাহাম মৃদু উৎসুক গলায় প্রশ্ন করে,
“ হিরণ স্যার? উনারও উপস্থিত থাকার কথা ছিলো। “
শমসের বিশ্রী হাসি আঁকে আব্রাহামের কথার পিঠে। রহস্যময় গলায় বলে,
“ হিরণের কাছে আজকাল মিশনের থেকে পরিবার বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। হয়তো সেখানেই সময় দিচ্ছে। “
আব্রাহাম আর এই ব্যাপারে কথা বাড়ায় না। সে বিদায় নিয়ে প্রস্থান করতেই শমসের মজুমদার তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের পানে তাকায়। ছেলেটার নাম মানিক। শমসের মজুমদারের বিশ্বস্ত ডানহাত। শমসের মজুমদার পর্যন্ত সকল তথ্য পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে নিযুক্ত রয়েছে সে। শমসের ভ্রু কুটি করে প্রশ্ন করে,
“ কি ব্যাপার মানিক? হিরণের এখানে উপস্থিত না থাকার কারণ কি? “
মানিক তোতাপাখির ন্যায় বুলি খুলে বসে,
“ স্যার, আপনার আদেশ অনুযায়ী হিরণ স্যারের বাড়ির উপর যাদের নজর রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো তারা খবর পাঠিয়েছে। সন্ধ্যার দিকে হিরণ স্যারকে গাড়িতে করে বাড়ি থেকে বের হতে দেখা গিয়েছে। সঙ্গে উনার স্ত্রীও ছিলো। উনি নিজের স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছে। অসুস্থ খুব সম্ভবত। “
শমসের চৌধুরী বেশ ঠান্ডা গলায় শুধায়,
“ হিরণ একের পর এক ভুল করে যাচ্ছে। ও ভুলে যাচ্ছে ওর প্রায়োরিটি কি হওয়া উচিত। আমার এতো বছরের শিক্ষা ওই দুই দিনের মেয়ের মোহে ভুলতে বসেছে সে। “
মানিক বলে উঠে,
“ স্যার উনার করা ভুল যদি আপনার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়? তার আগেই কি উনাকে থামানো উচিত না? “
শমসের মজুমদার হাঁটতে হাঁটতে উঠোনের একপাশে রাখা আরামকেদারায় আয়েশ করে বসে। অত:পর বলে,
“ শুনো মানিক। আমি পরিবার ও আপনজনহীন একজন শক্তিশালী মানুষ। আমাকে দমানোর কোনো রাস্তা আমি খোলা রাখিনি। অনেকে হয়তো মনে করে হিরণকে আমি আমার একাকিত্ব দূর করার জন্য এতিমখানা থেকে তুলে এনে নিজের ছায়াতলে রেখেছি। কিন্তু মূর্খের দল এ জানে না যে শমসের মজুমদার নিজের হৃদয় কেটে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে। যেখানে হৃদয়ই নেই সেখানে মায়া দয়া থাকবে কি করে? হিরণকে এডপ্ট করার একটাই কারণ, বিশ্বস্ততা। আমার এমন একজনের খুব প্রয়োজন ছিলো যাকে আমি নিজের মন মতো গড়ে তুলতে পারবো। হিরণ হয়েছেও তাই। আমার আদর্শে বড় করেছি ওকে। ওই একটুখানি বয়সে ওকে অস্ত্র আর মদের সাথে পরিচয় করিয়েছি। আমার মদের ব্যবসার সম্পূর্ণ হালখাতা সামলানো শিখেছে ওইটুকু বয়সে। একটা সময় ও আমাকেও ছাড়িয়ে যায়। আমার ব্যবসা ছেড়ে নিজের আলাদা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে। শালা মদ ছেড়ে অস্ত্রের ব্যবসা শুরু করে। অস্ত্রের নেশায় এতটাই ডুবে গিয়েছে ও যে লেলিহান শিখার ন্যায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। পোষ্য কুকুর নিজের মালিকের প্রতি যতটা অনুগত থাকে ও ঠিক ততটাই অনুগত ছিলো ও। কিন্তু আজকাল কুকুরটা নিজের মালিকের দিকেই সুযোগ পেলে ঘেউ ঘেউ করার সাহস দেখাচ্ছে। যার একমাত্র কারণ ওই নারী আর শিশু। ও হয়তো ভাবছে মালিকের দিকে ঘেউ ঘেউ করে ও খুব বীর বাহাদুর হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ও বুঝতে পারছে না যে ওই নারী আর শিশুর কারণে ও ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ছে। ওর এই দূর্বলতাই ওকে আপনাআপনি শেষ করে দিবে। আপাতত আমার ওকে নিজের মিশনের জন্য প্রয়োজন। প্রয়োজন মিটে গেলে ওই কুত্তার বাচ্চাকে নিজের অওকাদ মনে করিয়ে দিবো। “
শমসের মজুমদারের কথার পিঠে আর কোনো টু শব্দ করে না মানিক। মনে মনে সে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করে। বেশ হবে ওই জানোয়ারটা শায়েস্তা হলে। একবার হিরণকে সরাতে পারলে শমসের মজুমদারের সবথেকে কাছের মানুষ হিসেবে মানিক হিরণের জায়গা দখল করবে। যেই ক্ষমতার এতো আত্মগরিমা ওই জানোয়ারের সেই ক্ষমতা মানিকের আওতায় থাকবে তখন।
__________
আর্মিদের থাকার জন্য রয়েছে মেসের ব্যবস্থা। সেই মেসেই একই রুম শেয়ার করে থাকে সাইফ এবং সাদাত। রাতের খাবার সেড়ে সবেমাত্র রুমে ফিরলো তারা। সাদাত বিনাবাক্য ব্যয়ে নিজের সিঙ্গেল বেডটায় গা এলিয়ে দিয়ে একপাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। দূর হতে দেখে যে কেউ মনে করবে সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু সাদাতের চোখে এখনো ঘুম নামে নি। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের চোখে সহজে ঘুম নামেও না। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে রাত্রি বেলায় যখন বালিশে মাথা গুজে তখন তাদের মাথায় কিলবিল করে পারিবারিক বিভিন্ন চিন্তা। সাদাতের ক্ষেত্রে সেই চিন্তার পরিমাণ একটু বেশিই। এই মিশনে আসার পূর্বেই তার বাবা মারা গিয়েছে। সাদাত তখন অন্য মিশনের কারণে ফিল্ডে ছিলো এক সপ্তাহ। তার বাবার মৃত্যুর খবরটা সে পায় ঠিক দু’দিন পরে। ততক্ষণে দাফনকাজ শেষ। একমাত্র ছেলে হয়েও নিজের বাবার জানাজা পড়ার সুযোগটুকুও তার ভাগ্যে জুটে নি। সেই আফসোস এখনো ভিতরে ভিতরে সাদাতকে কুড়ে খায়। সঙ্গে রয়েছে নিজের মা আর ছোট বোন দু’টোর চিন্তা। চট্টগ্রাম হতে অদূরে খুলনা জেলায় যাদের অবস্থান। একা তিনটা মেয়ে মানুষকে আল্লাহ ছাড়া আর কারো আমানতে রেখে আসতে পারে নি সাদাত। মানুষ রূপী জানোয়ার ভর্তি দেশে মা, বোন, স্ত্রী কিংবা কন্যা সন্তানকে একা রেখে তাদের নিরাপত্তার আশংকায় এমন বহু সাদাতই নির্ঘুম রাত পাড় করে।
ঠিক তার পাশে তিন হাত দূরে থাকা অপর সিঙ্গেল বেডটায় সোজা হয়ে সিলিংয়ের পানে চেয়ে রয়েছে সাইফ। খাওয়ার পরে ক্ষানিকের আড্ডায় আজ সকলে নিজের পরিবার নিয়ে গল্প করছিলো। কি মিষ্টি খুনসুটিময় সেই গল্প গুলো! কতো কতো চরিত্র রয়েছে সেই গল্প গুলোতে! মা – বাবা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানি, চাচা-চাচি ইত্যাদি। সাইফ কেবল হাসিমুখে সবার গল্প গুলো শুনে যাচ্ছিলো। আচমকা রিদওয়ান প্রশ্ন করে উঠে,
“ কি রে! সাইফ মামা! তোর ফ্যামিলি সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। তোকে কখনো বাসায় কল করতেও দেখি না। তোর ফ্যামিলি কই থাকে? চাঁটগাইয়া নাকি? “
সাইফ তখন খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেসে জবাব দেয়,
“ আসছি একা, যামু একা। “
তার কথার ভাবার্থ বুঝতে না পেরে ফারদিন প্রশ্ন করে,
“ মানে? “
সাইফ তখন মৃদু বিরক্তি দেখিয়ে বলে,
“ মানে আমার বাপ-মা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন এসব কিছু নাই। আই হ্যাভ অনলি মি। “
কথাটা বলেই সাইফ সবার বিস্মিত মুখশ্রী দেখে ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,
“ ওহ সরি। তোগোর মতন তিনটা ছাগল আর তিনটা পাগলও আছে আমার জীবনে। “
সাইফের সেই কথার পরে কেনো জানি আড্ডা নিজের প্রাণ হারায়। সবকটা মুখ কেমন যেনো আঁধারে তলিয়ে যায়। সবারই হয়তো মনে মনে সাইফের জন্য মায়া লাগছিলো। কিন্তু এই মায়াটা তো সাইফ কখনো চায় নি। সে তো বেশ আছে নিজের এই একা জীবনে। কোনো ঝামেলা নেই, কোনো ঝঞ্জাট নেই। না আছে কোনো মাথা ব্যথা। পরিবার থাকা কি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ? কই? সাইফ তো দিব্যি পরিবার পরিজনহীন জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। কখনো কোনো অভিযোগ তার মনে উঁকি দেয় নি।
আপন ভাবনায় বুদ থেকেই সাইফ মনে মনে নিজের সিঙ্গেল বেডটার উদ্দেশ্যে বলে,
“ ধ্যাৎ শালা! তুই আর আমি সিঙ্গেলই ভালা। “
__________
রাতে ঘুমানোর আগে নার্স এসেছে নিশার পায়ের ব্যান্ডেজ বদলে দিতে। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে থাকা নিশা একবার পাশ ফিরে তিন সিটের সোফাটার দিকে তাকায়। নাঈমার কেবল মাত্র চোখ লেগে এসেছে। সারাদিন তিনি একপায়ে দাঁড়িয়ে নিশার দিকে খেয়াল রাখেন। মায়ের ক্লান্ত দেহটাকে ক্ষানিকের আরাম হতে ডেকে তুলতে মন চায় না নিশার। সে চুপচাপ বসে রয় নিজের মতো।
নার্স তার গাউনটা হাঁটুর উপর তুলতেই সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো পা উন্মুক্ত হয়। নিশার বুক ভয়ে ডিপ ডিপ করছে। এই কয়দিন ড্রেসিং চেঞ্জ করার সময় নাঈমাই পাশে দাঁড়িয়ে সবটা খেয়াল রেখেছে। নিশা ভয়ে চোখ বুজে রেখেছিলো। এখন পর্যন্ত সে একবারও নিজের পায়ের সেলাইয়ের জায়গাটা দেখে নি।
কিন্তু আজ ঠিক করেছে সে নিজে তাকিয়ে থেকে জায়গাটা দেখবে। যেই ক্ষত আর দাগ তার সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে তার মুখোমুখি হতে না জানলে জীবনটা পাড় করা খুব কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে তার জন্য।
সাদা ব্যান্ডেজের কাপড় সড়ে যেতেই একটা বিভৎস দৃশ্য দেখে নিশা। সেই দৃশ্যের ভার তার মস্তিষ্ক সইতে পারে না। আচমকা চিৎকার করে উঠে সে। দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেলে সে। চোখ জোড়া দৃঢ় করে বুজে রয়।
তার চিৎকারে ইতিমধ্যে নাঈমার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। জুলফিকারও কেবল মেয়েকে দেখার জন্য হেডকোয়ার্টার হতে সরাসরি হসপিটালে এসেছিলো। কিন্তু নিশার কেবিনের দরজার কাছাকাছি আসতেই চিৎকারের শব্দ শুনতে পেয়ে সে তড়িঘড়ি করে কেবিনে প্রবেশ করে। দ্রুত মেয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে কি হয়েছে। নাঈমাও একই প্রশ্ন করছিলো মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে।
নিশা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“ আম্মু আমার পা দেখতে অনেক বিশ্রী হয়ে গিয়েছে। কি বাজে কালো দাগ! অনেক বাজে দেখতে আম্মু। “
আসল কারণ বুঝতে পেরে নাঈমা আর জুলফিকার দু’জনেরই হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠে। জুলফিকার চোখের ইশারায় নার্সকে বলে দ্রুত ড্রেসিং সেড়ে বেরিয়ে যেতে। নার্স নিজের কাজ সেড়ে চলে যায়। নিশা তখনও মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদছে। মেয়ের কান্না দেখে নাঈমাও আর স্বাভাবিক থাকতে পারে না। মায়ের মনে হানা দেয় অদ্ভুত সব চিন্তা। মেয়ে মানুষের শরীরে দাগ থাকাটা কোনো অভিশাপের থেকে কম নয়। এই সেলাইয়ের দাগ যে কোনো দিন যাবে না সেই বিষয়ে ডাক্তার নিশ্চিত করেছে। যদিও অন্য উপায় আছে। সেটা হলো প্লাস্টিক সার্জারি।
নাঈমা কান্নারত গলায় বলে,
“ আম্মু এই দাগ দূর করে দিবো মা। আমি দ্রুতই সবথেকে ভালো প্লাস্টিক সার্জিশিয়ান খুঁজে বের করবো। প্রয়োজন পড়ে তো দেশের বাইরে নিয়ে যাবো। তুমি চিন্তা করো না। “
নাঈমার কথায় জুলফিকারের মেজাজ চড়ে যায়। সে গরম গলায় বলে,
“ আজেবাজে কথা বলা বন্ধ করো। ওসব করতে গেলে ইনফেকশনের হাই রিস্ক আছে তা কি তুমি জানো না? “
নাঈমা এবার রাগী গলায় বলে,
“ তো কি আমার মেয়ে সারাজীবন এই দাগ সহ্য করবে? “
“ মেয়েটা জানে বেঁচেছে নাঈমা। সেটার জন্য শুকরিয়া আদায় করো। “
নাঈমা এবার নিশাকে ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠে,
“ তুমি সবসময়ই একজন অযোগ্য পিতাই রয়ে যাবে জুলফিকার। মেয়েকে বিয়ে দিতে গেলে এসব নিয়ে কতো ঝামেলা হতে পারে সেই চিন্তা তোমার মাথায় আছে? তুমি এসব না ভাবলেও আমি ভাবি। “
নিশা কান্না থামিয়ে ফোলা ফোলা চোখ মেলে দেখতে থাকে নিজের আম্মু আব্বুর তাকে নিয়ে ঝগড়া। জুলফিকারও একইভাবে চেঁচিয়ে উঠে,
“ হ্যাঁ। খুব ভাবো তুমি। তোমার ভাবার নমুনা আমি দেখতে পাচ্ছি। তোমার কি মনে হয় আমি কোনো অশিক্ষিত পাত্রর হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিবো? কেবলমাত্র অশিক্ষিতদেরই এসব নিয়ে মাথাব্যথা থাকবে। “
নাঈমা ও জুলফিকারের এই কথা কাটাকাটি চলতেই থাকে। ভুলে যায় তারা কেবিনে উপস্থিত আরেকজন মানুষের অস্তিত্ব। নিশা আচমকা আবার ডুকরে কেঁদে উঠে। সব কিছু অসহ্যকর ঠেকছে তার কাছে। দমবন্ধ লাগছে তার। কেমন হতো যদি নিশার অস্তিত্বই না থাকতো? তাহলে নিশ্চয়ই আম্মু আব্বু ঝগড়া করার কোনো কারণ খুঁজে পেতো না আর? কারণ তাদের সব ঝগড়াই হয় নিশাকে ঘিরে।
__________
নিজের ব্যক্তিগত রুমটায় প্রবেশ করতেই দূর্জয় এগিয়ে গেলো কাঠের তৈরী আলমারির দিকে। আলমারির একপাশের দরজাটা খুলতেই তার চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো দরজার ভেতরের অংশে কাঠের সাথে অতি সুনিপুণ কায়দায় আটকে থাকা আয়তকৃতির ছবিটা। দূর্জয়ের অতি ব্যক্তিগত এবং ভালোবাসার তিনজন মানুষকে ছবিটাতে বন্দী করা হয়েছে। ছবিটার পানে দু দন্ড তাকাতেই দূর্জয় প্রচন্ড ক্লান্ত অনুভব করে। বুকটাও বেদম ভারী অনুভূত হচ্ছে।
এই ভার বয়ে বেড়ানো হতে সাময়িক বিরতি নিতেই বোধহয় সে আলমারির সেই তাকের ভেতর হতে মোটা কাপড়ে আবৃত একটা বাদ্যযন্ত্র বের করে। অতি সাবধানে সেই কাপড়ের ভেতর হতে কালো রঙা বাদ্যযন্ত্রটা বের করে চার দেয়ালে আবদ্ধ রুমটার ভেতর একটা কাউচে বসে সে। অতি যত্নের সহিত কালো বাদ্যযন্ত্রটাকে নিজের কোলে বসিয়ে সুকৌশলে তা-তে নিজের দু’হাতের সাহায্যে সুর তুলে। গম্ভীর স্বর ছেড়ে খালি গলায় আওড়ায়,
“ ঘুণে খাওয়া মেঘে কালো হয়ে যায় এ হৃদয় যখন
একা একা শুধু অকারণেই ঝরে বৃষ্টি এমন,
আজও তাই অবাক রঙে এঁকে যাই
সাদা কালো রঙ মাখা ফানুসের মুহুর্ত রাঙাই,
ভীষণ কালো মেঘ পুড়ে ছাই আবেগে আজও তাই
অবাক জোছনায় পোড়া চোখ তবুও সাজাই।
এই সন্ধ্যায় দু-চোখ সাগরে
বুকের পাঁজরে ভেসে যায়।
অবাক জোছনায় লুকিয়ে রেখেছি
ভেজা চোখ দেখাইনি তোমায়।
এই অবেলায় তোমারই আকাশে
নীরব আপোষে ভেসে যায়।
সেই ভীষণ শীতল ভেজা চোখ
কখনো দেখাইনি তোমায়।
কেউ কোথায় ভালো নেই যেন নেই
কতকাল আর হাতে হাত অবেলায়।
কতকাল আর ভুল অবসন্ন বিকেলে
ভেজা চোখ দেখাইনি তোমায়। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]