এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৬.
চল্লিশ মিনিটের পথ আধ ঘন্টায় পাড়ি দিয়ে হসপিটালে এসে পৌঁছায় হিরণ। ভীষণ অস্থিরতা কাজ করছে তার ভেতর। গাড়ি হতে নামার পূর্বে মুখে সতর্কতার সহিত মাস্কটা পড়ে নেয় সে। অত:পর বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় হসপিটালের ভিতরের দিকে। কিন্তু হসপিটালের ভেতর প্রবেশ করতেই সে অবাক হয়। ইবাত? ও এই মুহুর্তে হসপিটালে কি করছে? ওর তো বাসায় থাকার কথা। মনের প্রশ্ন চেপে গিয়ে নীরবে ইবাতের দিকে এগোয় সে।
হিরণকে এগোতে দেখে ইবাত ভীত হয়ে পড়ে। স্যার নিশ্চয়ই সবার আগে প্রশ্ন করবে যে ইবাত এখানে কি করছে? তখন ইবাত কি জবাব দিবে? যে এই আহাম্মকের দলের নাকের নিচ দিয়ে ম্যাডাম পালিয়ে গিয়েছে? আর আহাম্মকের দল সেই খবর জানিয়ে ইবাতকে এখানে ডেকে এনেছে?
ইবাতের ভাবনার ভীড়ের মধ্যেই হিরণ তার সামনে এসে দাঁড়ায়। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নিচু গলায় প্রশ্ন করে,
“ তুমি এখানে কি করছো? বহ্নিকে রেখে কোথাও যেতে নিষেধ করি নি তোমায়? “
ইবাত কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই হিরণ লিফটের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,
“ এখানে আর কথা বলতে হবে না। উপরে চলো। সেখানে গিয়ে কথা হবে। “
ইবাত নীরবে হিরণের পিছু পিছু পা চালায়। উপরে গিয়ে স্যারকে বিষয়টা জানানোই উত্তম মনে করে সে। এখানে জানালে যদি কোনোরকম রিয়েক্ট করে বসে উনি?
__________
থমথমে একটা মুখ অতি শান্ত ভঙ্গিতে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত। তার ঠিক পাশের সিটেই বসে থাকা মানবী ভীত দৃষ্টি নত করে বসে রয়েছে। পড়নের হসপিটাল গাউনটা এখন হাঁটুর নিচ সমান রেইনকোটের আবরণে আর দেখা যাচ্ছে না। মনে তার অসংখ্য সংশয়। এ কেমন অদ্ভুত কাকতালীয় ঘটনা? পুরো চট্টগ্রাম শহরে কি গাড়ির অভাব, যে প্রতিবারই তার ঘুরেফিরে দূর্জয়ের গাড়িতেই উঠতে হয়? এই কালো জিপের সাথে কি অদ্ভুৎ এক ম্যাগনেটিক সম্পর্কে বাঁধা পড়লো সে!
হঠাৎ কানে ব্রেক কষার তীব্র শব্দ হলো। সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়েও সিট বেল্টের কারণে ফের সোজা হয়ে যায় বাণী। ভীত দৃষ্টি তুলে গাড়ির কাঁচ ভেদ করে সামনে তাকাতেই সে একটা ঢোক গিলে। সেই হাইওয়ের তুলনায়ও সুনসান জায়গায় এনে গাড়িটা থামিয়েছে দূর্জয়। কারণ কি? উদ্দেশ্য কি?
প্রশ্নগুলো মনে উঁকি দিতেই নীরব গাড়ির ভেতর গম্ভীর স্বরটা প্রশ্ন ছুড়ে,
“ হোয়াট ইজ রং উইথ ইউ? “
বাণীর মাথাটা মৌমাছির মতো ভোঁ ভোঁ করছে। আপাতত বুঝ দেওয়ার জন্য মনে মনে একটা উত্তর সাজায় সে। অত:পর তা বলার জন্য মুখ খুলতে নিলেই দূর্জয় তাকে সতর্ক করে,
“ আমি কোনো ধরনের মিথ্যা শোনার জন্য প্রস্তুত নই। ডোন্ট প্লে উইথ মাই পেসেন্স। স্পষ্ট ভাষায় শুধু সত্যিটুকু বলো। “
বাণীর কণ্ঠরোধ হয়ে আসে। এ কি বিপদে পড়লো সে! কি করবে সে? সেনা সদস্য এই দূরদর্শী পুরুষ হলফ করে তার মিথ্যা ধরতে সক্ষম। কোনো কূল কিনারা না পেয়ে বাণী একহাত বাড়িয়ে নিজের পাশে গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু দরজাটা খুলে না। উল্টো দূর্জয় বিরক্ত মিশ্রিত গলায় শুধায়,
“ দরজাটা লকড। অযথা চেষ্টা চালানো বন্ধ করো৷ “
বাণী দূর্জয়ের কথাটা শুনে। নীরবে নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসে সে। সিটের গায়ে পিঠ এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে নেয়। শরীরটা দূর্বল লাগছে বেশ। জ্বরটা আবার বাড়ছে নাকি? বাড়তেও পারে। গাড়ির বোনাট হতে সামনের সিটে এসে বসার সময় গায়ে রেইনকোটটা জড়ানো থাকলেও বাতাসের দাপটে বৃষ্টির পানির সংস্পর্শ হতে বাঁচতে পারে নি সে।
দূর্জয় এক পলক বাণীকে পরখ করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। অসুস্থ মনে হচ্ছে মেয়েটাকে। কে জানে তার বিহাইন্ড দ্যা স্টোরি কি? দূর্জয় বাণীকে সময় দেয়, অপেক্ষা করে।
আচমকা বাণী অদ্ভুৎ ভঙ্গিতে দৃষ্টি মেলে তাকায়। ভীত সেই দৃষ্টি। অস্থির গলায় দূর্জয়কে শুধায়,
“ আপনি একজন সোলজার তাই না? কোন পদে আছেন আপনি? আপনার ক্ষমতা কতদূর? “
বাণীর অদ্ভুত তিনটা প্রশ্ন শুনে দূর্জয়ের ভ্রু কুচকে আসে। তবুও সে স্বাভাবিক গলায় পাল্টা প্রশ্ন করে,
“ সেই ব্যাপারে তোমার কৌতূহলের কারণ জানতে পারি? “
বাণী অস্থির গলায় জবাব দেয়,
“ ইট ইজ এ সিরিয়াস ম্যাটার। দয়া করে আমাকে বলুন। “
দূর্জয় বাণীর চোখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটার গুরুত্ব উপলব্ধি করে। অত:পর বেশ ছোট এক শব্দে নিজের পরিচয়, পদ এবং ক্ষমতা সম্পর্কে জানায়,
“ মেজর। “
বাণী আন্দাজ করে একজন সৈন্য সদস্য হিসেবে এই পদটা খুব সাধারণ কিংবা ছোট কোনো পদ নয়। এর গুরুত্ব এবং গাম্ভীর্য রয়েছে। তাই সে সাহস সঞ্চয় করে আবদার সুরে বলে,
“ একটা সাহায্য করুন। “
দূর্জয় সরু চোখ মেলে প্রশ্ন করে,
“ কি ধরনের সাহায্য? “
দূর্জয়ের প্রশ্নের পিঠে বাণী রুদ্ধস্বরে অনেকগুলো কথা বলে চুপ হয়। সবটা শুনে দূর্জয় বেশ অবাক হয়। এতক্ষণ সে বাণীর কেসটা যতটা জটিল ভাবছিলো এই মুহুর্তে বাণীর কথা শুনে সে আরো জটিল কিছু আন্দাজ করছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছে বাণী তালুকদারের বর্তমানটা রহস্যে ঘেরা অমীমাংসিত একটা কেসের মতো। যেই কেসটা মীমাংসা করার প্রবল আগ্রহ দূর্জয় নিজের মধ্যে টের পাচ্ছে।
দূর্জয় শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,
“ আমি তোমাকে এই সাহায্যটা ঠিক কি কারণে করবো বলতে পারো? “
বাণী চোখ বুজে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। অত:পর উত্তর দেয়,
“ আপনার মধ্যে এই মুহুর্তে আগ্রহ কাজ করছে। যেই আগ্রহ দমনের একমাত্র উপায় আমার মুখে উচ্চারিত সত্য। আপনি আমাকে এই সাহায্যটা করুন, বিনিময়ে আমি আপনাকে সত্যটা জানাবো। “
__________
দমবন্ধ পাখির ন্যায় ছটফট করছে ডক্টর হুমায়রা। পা জোড়া সমতল ভূমির স্পর্শ পেতে ব্যকুল হয়ে রয়েছে। গলা দিয়ে চাইলেও কোনো শব্দ বের করতে পারছে না সে। কানের কাছে ভেসে আসে পুরুষালী গলায় হিসহিসিয়ে বলা কিছু কথা,
“ কিভাবে পালালো? এতগুলো মানুষ নিযুক্ত থাকতে কি করে পালালো? “
ডক্টর হুমায়রার অবস্থা দেখে সকলে ভয়ে তটস্থ হয়ে রয়৷ সবথেকে বেশী ভীত দেখাচ্ছে বাণীকে পাহারা দেওয়ার দায়িত্বে নিযুক্ত নার্সকে। তার খুব বলতে ইচ্ছে হয়,
“ আপনার স্ত্রী একজন ধূর্ত মহিলা। তিনি আমার চোখে ধূলো ছুড়ে পালিয়েছে। “
কিন্তু সে আর কথাটা বলার সাহস পায় না। ইবাত ইতিমধ্যে এগিয়ে এসে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য শুধায়,
“ স্যার, প্লিজ কাম ডাউন। ম্যাডামকে খুঁজতে হবে আগে। “
হিরণের কানে যেনো ইবাতের বলা কথাগুলো পৌঁছালো না। সে আরো দৃঢ়ভাবে হুমায়রার গলা চেপে ধরে। ইবাত গলার স্বর নিচু করে ফের বলে,
“ স্যার এটা হসপিটাল। নিজেকে সামলান। পরিস্থিতি বিগড়ে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। “
হিরণ ফোস ফোস করতে করতে হুমায়রার গলাটা ছেড়ে দেয়। মুহুর্তেই তিনি টাইলস বসানো ফ্লোরে বসে পড়েন। দু হাতে গলা ধরে কাশতে শুরু করেন। খানিকটা অক্সিজেনের অভাবে যেনো মরতে বসেছিলো।
হিরণ চেঁচিয়ে উঠে,
“ বাণী কিভাবে পালালো? “
হিরণের বাজখাঁই গলার দাপটে ভীত নার্স এইবার মুখ খুললো,
“ উনি ওয়াশরুমে যেতে চেয়েছিলেন। আমি উনাকে সাথে করে নিয়ে ওয়াশরুমে যেতেই উনি আচমকা শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যান। আমি দ্রুত ডক্টরকে ডাকতে কাউন্টার এরিয়ার ওদিকে ছুটি। ডক্টর হুমায়রা সহ ফিরে এসে দেখি ওয়াশরুমের দরজার সামনে আপনার একজন লোক পড়ে আছেন আর ম্যাম কোথাও নেই। “
নার্সের কথা শেষ হতে না হতেই হিরণের সেই গার্ড বলে উঠে,
“ স্যার আমি নার্সকে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে দেখে কেবিনে প্রবেশ করি ম্যাম ঠিক আছে কি-না দেখার জন্য। কিন্তু হঠাৎ মাথায় ভারী কিছুর আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন জ্ঞান ফিরে তখন শুনি ম্যামকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। “
হিরণ রেগে কিছু একটা বলতে নিবে তার পূর্বেই ইবাত উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে বলে,
“ স্যার এই মুহুর্তে রেগে কোনো লাভ নেই। আমাদের আগে সিসিটিভি ফুটেজ চেক করতে হবে। তাহলে আমরা জানতে পারবো ম্যাডাম কোথায় গিয়েছে। “
অতি রাগে হিরণ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো। তবে ইবাতের কথাটা তার মস্তিষ্কে পৌঁছে। মুহুর্তেই সে হুকুম জারি করে গত এক ঘন্টায় ধারণকৃত সিসিটিভি ফুটেজ ম্যানেজ করে দ্রুত নিয়ে আসতে। ইবাত এক মুহুর্ত দেরি না করে হসপিটালের কন্ট্রোল প্যানেল এরিয়ায় দৌড়ে চলে যায় সিসিটিভি ফুটেজের ক্লিপ ম্যানেজ করে নিয়ে আসার জন্য।
হিরণ অস্থির পায়ে পায়চারি করতে থাকে কাউন্টার এরিয়া জুড়ে। ডক্টর হুমায়রা তখনও ফ্লোরে বসে অক্সিজেনের ঘাটতি অনুভব করছে। চোখমুখ তার সম্পূর্ণ কালো হয়ে গিয়েছে। মনে মনে সে-ও অনুভব করে তীব্র ক্ষোভ। সেই ক্ষোভের জোরেই হুমায়রা হিরণের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে,
“ মানুষের উপর রাগ ঝাড়ার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন, যে আপনি কি এমন করেছেন যে আপনার স্ত্রী আপনার থেকে পালাতে চায়? নিজের মস্তিষ্ক দিয়ে বিবেককে প্রশ্ন করুন দোষটা কার? “
হিরণ ক্ষিপ্র দৃষ্টি মেলে হুমায়রার পানে তাকায়। তার বিগড়ে যাওয়া মেজাজে ডক্টর হুমায়রার প্রশ্নটা আরো বিরূপ প্রভাব ফেলে। হিরণ রাগী সুরে আদেশ করে,
“ আমার চোখের সামনে থেকে এই মহিলাকে নিয়ে যাও। আমি আর এর চেহারা দেখতে চাই না। “
বিশ মিনিটের ভেতরই ইবাতের কল আসে হিরণের কাছে। হিরণ কিছু বলবে তার পূর্বেই ইবাত বলে উঠে,
“ স্যার, ম্যাডাম ফায়ার এক্সিট ওয়ে দিয়ে পালিয়েছে। উনাকে বেসমেন্টের দিকে যেতে দেখা গিয়েছে সর্বশেষ। কিন্তু বেসমেন্টে যাওয়ার পর আর কি হয়েছে তা জানা যায়নি। পার্কিং এরিয়ার সিসিটিভি ফুটেজ ডিলিট করে ফেলেছে কেউ। “
ইবাতের বলা কথাগুলো শুনতেই হিরণ অবাক হয়। ডিলিট করে ফেলেছে মানে? কে করেছে? প্রশ্নটা মাথায় উঁকি দিতেই হিরণ গরম গলায় শুধায়,
“ বাণীকে কেউ সাহায্য করছে ইবাত। খুঁজে বের করো। বাণী আর ওই সাহায্যকারী দু’জনকে খুঁজে বের করো যেকোনো মূল্যে। “
__________
নীরব রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে সাদাত। রাস্তার মাথায় থাকা একটা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রাস্তাটা মৃদু আলোকিত হয়ে রয়েছে। ফুটপাতের একপাশে শুয়ে রয়েছে দুটি অলস কুকুর। সাদাতের হাঁটার ভঙ্গি আপাতত খুবই সাধারণ। টানটান সোজা হয়ে বুক চওড়া করে দাঁড়ানোর কোনো লক্ষণ নেই তার মাঝে। থাকবেই বা কেনো? এটা তার খুব একান্ত সময়। যেখানে পেশাগত বাধ্যবাধকতার কোনো বালাই নেই। কেবল রয়েছে সে, এই নিস্তব্ধ রাত এবং তার কানে চেপে ধরা মুঠোফোনটি। যেই মুঠোফোনের অপরপ্রান্তে অন্য এক শহরে রয়ে যাওয়া তার আপনজনেরা রয়েছে। সাদাত মিষ্টি হেসে শুধায়,
“ সাওদার রেজাল্ট শুনলাম আম্মু। অনেক খুশি হয়েছি। দেখে নিও তোমার এই মেয়ে ঠিকই একদিন বিসিএস ক্যাডার হতে পারবে। “
ফোনের অপর পাশ হতে মধ্যবয়স্কা একজন পৌঢ় নারী চিন্তার আঁচ সহ বলে উঠে,
“ তুই কবে আসবি বাবা? এই মিশন আর কতদিন চলবে? “
“ নিশ্চিত না আম্মু। তুমি দোয়া রেখো যেনো নিরাপদে ফিরতে পারি। “
“ আমার সব দোয়া তো তোদের জন্যই। “
“ আচ্ছা আম্মু, আমি কালকে সুযোগ বুঝে কিছু টাকা পাঠাবো। সাওদাকে ওর পছন্দ মতো জামা কিনে দিও। সায়রা আর তোমার জন্যও কিছু কিনে নিও। সামনে কোরবানির ঈদ আসছে। “
“ এসবের কি দরকার? ওদের কি জামাই নেই নাকি? আর ঈদ তো এখনও অনেক দূরে। “
“ দরকার কি দরকার না এতো কিছু ভাবতে হবে না তো। তুমি শুধু যা বলছি তা করো। আর… “
মাঝপথেই সাদাতের কথা থেমে যায়। তবে তার পা জোড়া থামে না। বরং পায়ের গতি মৃদু ধীর হয়ে আসে। দৃষ্টি হয় সতর্কপূর্ণ। আপনজনের সাথে ফোনালাপের ইতি টেনে বলে,
“ আচ্ছা আম্মু, পরে কথা হবে। এখন রাখি। “
কথাটুকু বলেই ফোনটা পকেটে ভরে সে আচমকা পিছনে ফিরে তাকায়। শূন্য জনমানবহীন রাস্তায় কারো অস্তিত্ব নেই। সাদাত নীরবে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে।
লম্বা বিল্ডিংটার আড়ালে একটা ছায়া সটান ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেকেন্ড ত্রিশ পাড় হতেই সে অতি সাবধানে মাথাটা বের করে রাস্তায় উঁকি মারে। রাস্তাটা শূন্য দেখতেই সে বেশ অবাক হয়। সতর্ক দৃষ্টি মেলে ভালোভাবে চারিদিকটা পরখ করে। না। একটু আগে রাস্তায় ফোনালাপে ব্যস্ত পুরুষের কোনো চিহ্ন এই মুহুর্তে দেখা যাচ্ছে না। চোখের পলকে কোথায় চলে গেলো?
ছায়াটা এবার সোজা হয়ে সম্পূর্ণ বেরিয়ে এলো বিল্ডিংয়ের আড়াল হতে। ধীর পায়ে সতর্ক দৃষ্টি মেলে এগোতে এগোতে পৌঁছে যায় সামনের দিকে। ফুটপাত ধরে রাস্তার মাঝামাঝি এসে দাঁড়ায় সে। ফোনালাপে ব্যস্ত সেই পুরুষের খোঁজে বিশেষ দৃষ্টিটা বর্তায় চারিদিক জুড়ে।
ঠিক সেই মুহুর্তে ফুটপাতের পাশে দুই বিল্ডিংয়ের মধ্যকার অতি সরু গলি হতে এক জোড়া হাত তার মুখ চেপে ধরে এবং হাত টেনে গলির ভেতর তাকে নিয়ে যায়।
সেই ছায়া মানবীকে দেয়ালের সঙ্গে এমনভাবে চেপে ধরেছে সাদাত যেনো সামান্য নড়ার সুযোগটুকুও নেই। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মানবীর দিকে স্থির করতেই মৃদু আলোয় দেখতে পায় গায়ে লম্বা রেইনকোট, জিন্স এবং বুট শু পরিহিত নারী অনেকটা অপ্রস্তুত দৃষ্টি মেলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। অপ্রস্তুত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকা সেই নারীকে চিনতে এক মুহুর্ত দেরি হয় না সাদাতের। সে জ্বলজ্বল করা রাগী দৃষ্টি মেলে হিসহিসিয়ে বলে উঠে,
“ উদ্দেশ্য কি তোমার মেয়ে? আমাকে ফোলো করছো কেনো? কে পাঠিয়েছে তোমাকে? “
সেই নারী চোখের ইশারায় বলে তার মুখ থেকে হাত সরাতে। সাদাত এক মুহুর্ত মেয়েটার হাবভাব পর্যবেক্ষণ করে মেয়েটার মুখ থেকে নিজের হাত সরায়। তবে অন্য হাতে শক্ত করে তার বাহু ধরে রাখে এ বুঝিয়ে দিতে যে পালানোর কোনো উপায় নেই।
সাদাত আশা করছিলো মেয়েটা হয়তো আমতা আমতা করবে কিংবা কোনো সাফাই গাইবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটা হেসে রহস্যময় গলায় বলে উঠে,
“ কি বস? কেসটা কি বলো তো? তুমি কি খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ যাকে রাতের আঁধারে মানুষের ফোলো করার সম্ভাবনা রয়েছে? “
প্রশ্নের প্রেক্ষিতে পাল্টা প্রশ্ন সাদাতের ভারী অপছন্দ। সে গরম চোখ জোড়া পাকিয়ে বলে,
“ সেদিন ক্যাফেতে লুকিয়ে আমার স্কেচ বানাচ্ছিলে, আজ আবার আমাকে ফোলো করছো। তোমার উদ্দেশ্য কি তা স্পষ্ট গলায় বলো। “
মেয়েটা এবার সামান্য গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলে উঠে,
“ আমি কেনো ফলো করতে যাবো তোমাকে? চট্টগ্রাম শহরটা তোমার নিজের সম্পত্তি নাকি? আমি নিজের মতো হাঁটছিলাম শুধু। “
মেয়েটার বলা কথাটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না সাদাতের। তবুও সে অতি অপ্রয়োজনীয় বস্তুর ন্যায় মেয়েটাকে শক্ত হাতের বাঁধন হতে মুক্তি দেয়। আঙুল দিয়ে শাসিয়ে শুধায়,
“ আর কখনো আমার ত্রি সীমানার মধ্যে দেখলে কিন্তু মোটেও ছেড়ে দিবো না। “
কথাটা বলেই সাদাত হনহনিয়ে সেই গলি হতে বেরিয়ে যায়। অগ্যাত নারীর মুখে ফুটে উঠে প্রফুল্ল হাসি। নাইন্টিসের আর্জুন রামপালের গোমড়া এডিশন পুরুষ তাকে না ছাড়লেও বিষয়টা তেমন একটা মন্দ হয়না। ভাবনাটা মনে উঁকি দিতেই উক্ত নারী দ্রুত পা চালিয়ে গলি হতে বেরিয়ে এসে রাস্তার দিকে তাকায়। পিছন হতে সেই পুরুষকে রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে দেখে সে মৃদু গলা উঁচু করে পিছু ডাকে,
“ এক্সকিউজ মি! “
সাদাত চলন্ত পা জোড়া থামিয়ে ফিরে তাকায়। ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
“ হোয়াট? “
“ আমি স্নিগ্ধা। নামটা মনে রেখো। “
সাদাতের চোখে মুখে ফুটে উঠে দ্বিরুক্তিভাব। স্নিগ্ধা! এর থেকে অপ্রয়োজনীয় নাম সে জীবনেও শুনে নি।
__________
মফস্বল এরিয়ার ভেতর বাইকটা প্রবেশ করতেই রাফি চরমভাবে চমকালো। সাইফ এদিকে বাইকটা নিচ্ছে কেনো? প্রশ্নটা মনে চেপে না রেখে সে মুখে উচ্চারণ করে,
“ এদিকে কোথায় যাচ্ছিস? “
প্রফুল্ল মনে বাইক চালাতে ব্যস্ত সাইফ রাফির প্রশ্নে বিরক্ত হয়। সেই বিরক্তি তার গলায় স্পষ্ট ফুটে উঠে,
“ বালামার। এতো প্রশ্ন করস কেন? “
বাইকের একদম পিছনে বসে থাকা প্রত্যয় সাইফের মুখে গালিটা শুনে নাক সিটকে বলে,
“ এগুলো কি ভাষা সাইফ? “
সাইফ দ্বিতীয় দফা বিরক্তি নিয়ে উত্তর দেয়,
“ বাংলা ভাষা বুঝোস না? “
কেউ আর কোনো কথা বলার সুযোগ পেলো না। তার পূর্বেই বাইকটা এসে থামলো মরিচ বাতি দ্বারা সজ্জিত একটা বাড়ির সামনে। বাড়ির পানে তাকাতেই রাফি আর প্রত্যয় অবাক হয়। তবে তাদের কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সাইফ বাইক থেকে নেমে চাবিটা রাফির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“ সামনে আগায় বস। আমি বলার সাথে সাথে বাইক স্টার্ট দিবি। একদম মেইন রোডে গিয়ে বাইক থামাবি। “
প্রত্যয় কিছুই বুঝতে পারছে না। সে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
“ তুই কি করতে চাচ্ছিস? “
সাইফ নিজের হাতে কিছুক্ষণ আগের কেনা কালো মিষ্টির প্যাকেটটা নিয়ে প্রত্যয়কে বলে উঠে,
“ তুইও কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ নিচে নাম। “
প্রত্যয় সরু ভ্রু জোড়া মেলে তাকানোর পূর্বেই সাইফ অতি যত্নে র্যাপিং করা মিষ্টির প্যাকেট হাতে বাড়ির ভেতর চলে যায়। রাফির খুব ভয় করছে। সাইফ কি করতে চাইছে তা ঝাপসা আন্দাজ করতে পারছে সে।
একতলা বাড়িটার উঠোন ডিঙিয়ে প্রধান দরজার সামনে গিয়ে দু বার কলিংবেল বাজাতেই একজন ভদ্রলোক দরজাটা খুলে। আগ্রহী গলায় প্রশ্ন করে,
“ কে আপনি? “
সাইফ মুখে প্রাণখোলা হাসি মেখে বলে উঠে,
“ আসসালামু আলাইকুম আংকেল। অন্যা বাসায় আছে? ওর বন্ধু আমি। বিয়ে উপলক্ষে একটা গিফট দেওয়ার ছিলো। “
“ ওয়ালাইকুম আস সালাম। অন্যা তো বাসায় আছে। কিন্তু তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না বাবা। “
“ সমস্যা নেই আংকেল। আপনি অন্যার থেকে জেনে নিয়েন। একটু কষ্ট করে যদি ওকে ডেকে দিতেন। আসলে আমার খুব তাড়া আছে তো। ফ্লাইট আছে আমার। দেশের বাহিরে চলে যাবো দেখে ওর বিয়েটা এটেন্ড করতে পারবো না বিদায় গিফট নিয়ে এসেছি। “
ঘরের কর্তা ভদ্রলোককে খানিকটা দ্বন্দ্বে ভুগতে দেখা গেলো। তবুও তিনি গলা উঁচু করে ডাকেন,
“ অন্যা। অন্যা। দেখো তো তোমার কোন বন্ধু এসেছে। “
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে শাড়ি পরিহিত গায়ে হলুদের সাজে সজ্জিত এক রমণী। দরজার কাছে আসতেই তার ভ্রু কুচকে যায়। অবাক সুরে প্রশ্ন করে,
“ আপনি কে? “
সাইফ আর এক মুহুর্ত দেরি না করে র্যাপিং প্যাকেটটা ভদ্রলোকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে অন্যার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে,
“ রাফিকে ভালোবাসো? “
প্রশ্নটা শুনতেই অন্যার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সে ভীত দৃষ্টি মেলে নিজের বাবার দিকে তাকায় যিনি আপাতত রেগেমেগে আগুন গলায় প্রশ্ন করে যাচ্ছেন,
“ এই ছেলে? কে তুমি? “
সাইফ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ফের প্রশ্ন করে,
“ চুপ থেকো না অন্যা। এন্সার মি। এটাই তোমার শেষ সুযোগ। রাফিকে ভালোবাসো? “
অন্যা ভীত ও কাপা গলায় উত্তর দেয়,
“ বাসি। “
সাইফ আর দেরি না করে খপ করে অন্যার একহাত ধরে বাহিরের দিকে ছুটে। পিছনে অন্যার বাবা চেঁচিয়ে উঠে। উনার চেচামেচিতে ঘরের ভেতর হতে অন্যার মা আর বোনও বেরিয়ে আসে। আকস্মিক পরিস্থিতির ধাক্কা সামলাতে না পেরে অন্যা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু গেট পেরিয়ে বাহিরে আসতেই তার সেই চেষ্টা থেমে যায়। অস্ফুটে উচ্চারণ করে,
“ রাফি। “
রাফি অবাক ও বিমূঢ়। সাইফ দেরি করে না। অন্যাকে বাইকের সামন এনে দাঁড় করিয়ে বলে,
“ বাইকে উঠো। দেরি করো না। ফাস্ট। “
অন্যা অপ্রস্তুত দৃষ্টি মেলে সবার পানে তাকায়। তার মস্তিষ্কে এখানো ঠিকঠাক কিছু ধরছে না। সাইফ এবার রাগী সুরে ধমকে উঠে,
“ এই রাফি বাইক স্টার্ট দে। “
রাফি সঙ্গে সঙ্গে বাইক স্টার্ট দেয়। সাইফ ততক্ষণে ধাক্কিয়ে অন্যাকে বাইকে তুলে দিয়েছে। চোখের পলকে বাইকটা রাস্তা ধরে বেরিয়ে যেতেই সাইফ লক্ষ্য করে প্রত্যয় অবাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেনো এইমাত্র কি হলো তার কিছুই সে বুঝতে পারে নি। সাইফ আর দেরি না করে প্রত্যয়কে ধাক্কা মেরে চেঁচিয়ে উঠে,
“ শালা মারা খাওয়ার জন্য দাঁড়ায় আছোস? “
প্রত্যয় কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই দেখে বাড়ির ভেতর হতে একজন ভদ্রলোক লুঙি একহাতে ধরে চেঁচামেচি করতে করতে বেরিয়ে আসছে। তাকে দেখে প্রত্যয়ও সাইফের পিছু পিছু ছুটে বলে উঠে,
“ তুই একদিন আমাদের আধ-পাগল বানিয়ে ছাড়বি সাইফ। “
সাইফ ছুটতে ছুটতে জবাব দেয়,
“ পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না রে পাগলা। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]