এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৮.

0
155

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৮.

নীরব ভঙ্গিতে রুমে প্রবেশ করেই দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দেয় বাণী। হিরণের চোখের অগাধ রাগ তার দৃষ্টি এড়ায় নি। কি হয়েছে আবার? সেই পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে মওকুফ করা ক্ষমার হিসেব কি আজ মেটাবে নাকি? কথা গুলো ভাবতে ভাবতে বাণী রুমের এককোণে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রয়।

কেবিনেটের উপর থাকা স্পিকারে লাউড ভলিউমে মিউজিক প্লে করে দিয়ে হিরণ অস্থির ভঙ্গিতে সম্পূর্ণ রুম জুড়ে পায়চারি করছে। মিউজিক প্লে করার কারণ হলো যেনো তাদের রুমের ভেতরকার দ্বন্দ্ব মেয়ের কান পর্যন্ত না পৌঁছায়। প্রচন্ড রাগে নাকি রাগ ঠান্ডা করতে তার এই অস্থিরতা তা ঠাওর করা যাচ্ছে না ঠিক। অতি মাত্রার রাগে তার চোখ ক্ষানিকটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। আচমকা তার পায়চারি বন্ধ হয়ে যায়। শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। অত:পর বেশ থমথমে গলায় বলে,

“ আমার এতো বছরের সতর্ক শিকল ভেঙে পালিয়ে গিয়ে মস্ত বড় ভুল করেছো তুমি। “

বাণী মাথা নত রেখে ভাবলেশহীন গলায় শুধায়,

“ আবার পালাবো। যতবার সুযোগ পাবো ততবার পালিয়ে যাবো। কখনো না কখনো আপনি ঠিকই বিরক্ত হয়ে পিছু নেওয়া ছেড়ে দিবেন। “

হিরণের সংবরণ করা রাগটা বাণীর বলা প্রথম কথাটুকুতে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সে ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে এসে বাণীর পাশের দেয়ালে এক হাতের সাহায্যে আঘাত করে চেঁচিয়ে উঠে,

“ কি বললে? তোমার কোনো ধারণা আছে কি করেছো তুমি? তোমার এই ভুলের কারণে আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করার মতো ট্রাম্প কার্ডের সন্ধান পেয়ে গিয়েছে তারা। বিষয়টার ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারছো তুমি? “

হিরণের ক্ষিপ্র পায়ে এগিয়ে আসা দেখে চোখ বুজে ফেলেছিলো বাণী। সেই চোখ জোড়া মেলে তাকায় সে হিরণের বলা কথাগুলো শেষ হতে। হিরণ তার পানেই চেয়ে ছিলো। সেই হিংস্র চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বাণী উত্তর দেয়,

“ আপনার থেকে ভয়াবহ আর কি হতে পারে? “

হিরণের হিংস্র চোখ জোড়া মুহুর্তেই শীতল হয়ে আসে। বাণীর বলা সামান্য কথাটা তার বিবেকের দোরগোড়ায় তাকে দুঃসহ যন্ত্রণার ভেতর ফেলে দিচ্ছে। ক্ষানিকটা সময় সেভাবেই পেরিয়ে যায়। হিরণ নীরবে ধীরে বাণীর কাছ থেকে সরে দাঁড়ায়। সবসময়ের শক্ত চিত্তটা বেশ শীতল ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় সোফার দিকে। যাওয়ার পথে স্পিকারে চলমান গানটাও বন্ধ করতে ভুলে না সে।

হিরণ সোফায় বসে চুপচাপ পিঠ এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে নেয়। পরিবেশটা নিঃশব্দতার ভুবনে তলিয়ে যায়। অসহ্য অনলে দগ্ধ হিরণের প্রতিটা রন্ধ্র তাকে চিৎকার করে জানান দিচ্ছে এই যাতনা আর সহে না। ভিতরটা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেলেও মুখে খুব শীতল স্বরে বলে,

“ কি চাও তুমি বাণী? আমি মরে যাই? তোমার সামনে নিজের বিধ্বংসী রাগটা আমি কেন সংবরণ করি বুঝতে পারো না? এইটুকু যথেষ্ট না? “

হিরণের শীতল প্রশ্নের পিঠে বাণী তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,

“ দয়া করছেন বুঝি? কে বলেছে আপনাকে নিজেকে সংবরণ করে আমার উপর দয়া করতে? কৃতদাসীর উপর কেউ দয়া করে নাকি? “

বাণীর উচ্চারণ করা কৃতদাসী শব্দটা হিরণের কানে বিঁধে। অসহ্য যন্ত্রণাটা গলাধঃকরণ করে সে উচ্চারণ করে,

“ নিজেকে আজেবাজে নামে সম্বোধন করা বন্ধ করো। “

বাণী আর কোনো কথা না বলে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। বদ্ধ দরজার নবটা ঘোরাতেই তার হাতটা থেমে যায়। পিছনে না ফিরেই সে শান্ত গলায় বলে উঠে,

“ নিরানব্বইটা ভালো কাজ করা মানুষ যেমন কখনো একটা খারাপ কাজ করে খারাপ মানুষ ট্যাগ পায় না, একইভাবে নিরানব্বইটা খারাপ কাজ করা মানুষ একটা ভালো কাজ করে কখনো ভালো মানুষের ট্যাগ পায় না। “

কথাটুকু বলেই বাণী রুম থেকে বেরিয়ে যায়। একবারও আর ফিরে পিছনে তাকায় না। হিরণ চোখ বুজে রয়। বাণীর উচ্চারণ করা প্রতিটি শব্দই তার কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌঁছেছে। কি সুকৌশলে সে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো যে তার কাছে হিরণের নিরানব্বইটা খারাপ কাজই মুখ্য। সেই মুখ্য বিষয়ের পিঠে হিরণের বাণী ও বহ্নির প্রতি ভালোবাসাটা অতি নগন্য এবং ঠুনকো একটা জিনিস।

মনের উঠোনে টইটই করে ঘুরে বেড়ানো ভয়কে বালি চাপা দিয়ে ফোন বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করে হিরণ। অপরপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই হিরণ শক্ত কণ্ঠে আদেশ করে,

“ বাড়ির চারিদিকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা দ্বিগুণ এবং জোরদার করো। আমার অনুমতি ব্যতীত যেন এই বাড়ির ভেতর একটা মাছিও প্রবেশ করতে না পারে। আমার অনুপস্থিতিতে বাণী আর বহ্নির উপর চব্বিশ ঘণ্টা যেনো নজর রাখা হয়। ওদের গায়ে একটা টোকাও যদি পড়ে তাহলে আমি কি কি করতে পারি তা সবাইকে মনে করিয়ে দাও। “

কঠিন বাক্যের আদেশ বর্তানো শেষ হতেই হিরণ ফোন রেখে দেয়। উঠে রুম থেকে বেরিয়ে সোজা নিচে কিচেনে চলে যায়। কিচেনে উপস্থিত একজন রাধুনি হিরণকে দেখেই তটস্থ স্বরে প্রশ্ন করে,

“ কিছু লাগবে স্যার? “

হিরণ মাথা নেড়ে না বলে থমথমে গলায় আদেশ করে,

“ যেতে পারো। “

দুই শব্দের আদেশ পেতেই রাধুনি হাফ ছেড়ে বাঁচলো। দ্রুত পায়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। হিরণ গায়ের ধূসর রঙা ব্লেজারটা খুলে একটা চেয়ারের উপর রাখে। অত:পর বেশ শান্ত ভঙ্গিতে সাদা রঙের শার্টের হাতা গুটিয়ে ফ্রিজের দরজাটা খুলে। ফ্রিজের এককোণে রাখা অর্ধ গোলাকার কেকের ট্রে টা বের করে নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসে সে। ছুরির সাহায্যে বেশ সুকৌশলে এক স্লাইস কেটে একটা প্লেটে নিয়ে কাটা চামচ দিয়ে সামান্য কেক মুখে তুলে। মেয়ে আর মেয়ের মা’র বানানো বেমানান স্বাদের কেকটা বেশ তৃপ্তিসহই খেলো সে। বহ্নির ভাষায় বললে, হিরণের হন্টেড লাইফে এই বিদঘুটে কেকটার স্বাদ অনেকটা ফেইরি টেলের মতোই।

__________

লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবার অফিস রুমে কড়া নাড়তেই ভেতর হতে একটা ভরাট স্বর বলে উঠে,

“ কাম ইন। “

দূর্জয় রুমের ভেতর প্রবেশ করেই অভ্যাসবশত দু হাত পিঠের পিছনে ভাজ করে আরামে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠে,

“ মোর্শেদের জবানবন্দি রেকর্ড করে এসেছি স্যার। “

জুলফিকার সামান্য বাকা হেসে প্রশ্ন করে,

“ কি জানতে পারলে? “

“ রইস দিলদার নামক একজন ভারতীয় মোর্শেদকে একটা হিউজ এমাউন্টের ক্যাশ বান্ডেল অফার করেছিলো এই কাজটার জন্য। মোর্শেদ সেই অফার নাকোচ করে নি। ৬ মাস আগে সেদিন খুব সকাল বেলা ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়ে হতে সেই যুবক দলকে নিজের গাড়িতে তুলে মোর্শেদ। পথিমধ্যে একটা হাইওয়ে রেস্তোরাঁতে নেমে তারা দুপুরের খাবারও খেয়েছিলো। অত:পর সেখান থেকে বনানীর এভার ভিউ রেস্টুরেন্টের কাছাকাছি আসতেই তারা গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। এর বেশি কিছুই জানে না সে। “

জুলফিকারকে এবার সামান্য চিন্তিত দেখালো। সে মনে মনে ছক কষে কিছু একটা মিলিয়ে বলে উঠে,

“ দূর্জয় এই কেসের মূল হোতা পর্যন্ত পৌঁছানো এতো সহজ হবে না। আমার মস্তিষ্ক বলছে রইস দিলদারকে ধরলেও আমরা সরাসরি মূল কালপ্রিটের পরিচয় জানতে পারবো না। “

দূর্জয় বলে উঠে,

“ মেইন কালপ্রিট বহু সময় নিয়ে বেশ সাজিয়ে এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তা নিশ্চিত। তার পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য সকল ক্লু খুঁজে বের করবো আমি। দেখা যাক এখন এই রইস দিলদার হতে কি ক্লু পাই আমরা। “

জুলফিকার মাথা নেড়ে প্রশ্ন করে,

“ তোমার টিমের যুবকেরা কোথায়? ওদের আজ সন্ধ্যার পর থেকে কোথাও দেখি নি। “

“ ওদের জন্য আপাতত নতুন কোনো অর্ডার ছিলো না বিধায় হাফ ডে অফ দিয়েছি স্যার। আশা করছি কোনো সমস্যা নেই। “

“ না। ভালো করেছো। “

কথাটুকু বলেই জুলফিকার ফের ডাকে,

“ দূর্জয়? “

“ ইয়েস স্যার। “

“ আজকের রাতটা একটু রেস্ট করো। আর তোমার কলের অপেক্ষায় থাকা মানুষটাকে একবার কল করে খোঁজ নাও। ইট ইজ এন অর্ডার। “

জুলফিকারের বলা কথাটা কাকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না দূর্জয়ের। দূর্জয়ের শক্ত, কঠোর, তেজী স্বরটা উচ্চারণ করে,

“ শি ইজ অলরাইট স্যার। স্টিল আই উইল কল হার। “

তেজী স্বরে দু বাক্যে জবাব দিয়েই দূর্জয় বেরিয়ে আসে জুলফিকারের রুম থেকে। রেসিডেন্সিয়াল এরিয়াতে বেরিয়ে আসতেই জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। তার সাথে কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকা মানুষটার মুখের উপর বারবার মিথ্যা বলতে তার অসহনীয় যন্ত্রণা হয়। সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই দূর্জয় ব্যস্ততার অজুহাতে যথাসম্ভব তার সাথে কথা বলা এড়িয়ে যায়। বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা সত্যটা গত একবছরে কাউকে জানতে দেয় নি সে। বেশ কায়দা করে মিথ্যার আড়ালে সত্যটা চেপে গিয়েছে। কারণ সে বেশ ভালো করেই জানে অপেক্ষারত সেই মানুষটার কাছে দূর্জয়ের বলা মিথ্যাটা সহনীয় হলেও সত্যটা সে সইতে পারবে না। সেজন্যই তো দূর্জয়ের এতো আয়োজন!

__________

মেঘের আবরণ সড়ে গিয়ে দুপুরের তপ্ত রোদের হাতছানি যখন ধরাপটে তখনকার চিত্র। কোলাহলে মুখর কলেজের রাস্তার মোড়ে একটা সাদা রঙের মাইক্রো গাড়ি থেমে আছে। গাড়ির ভেতর রয়েছে চারজন মানুষ। সামনের দু’জনের দৃষ্টি কলেজ গেটের দিকে নিবদ্ধ হলেও পিছনে বসা দু’জনের দৃষ্টি একটা ছবির দিকে নিবদ্ধ। বারবার ছবিটাতে চোখ বুলিয়ে মুখশ্রীটা মুখস্থ করে নিতে ব্যস্ত তারা। প্রাপ্ত আদেশে কোনো ভুল করার অবকাশ যেনো না হয় সেই নিশ্চয়তা দিতেই এতো মনযোগ তাদের।

মিনিট পাঁচেক পরে ফ্রন্ট সিটে বসে থাকা একজন বলে উঠে,

“ এই মেয়েটাই না? “

পিছনে বসে থাকা দুটি মানুষ চোখ তুলে সামনে তাকায়। বেশ সতর্ক দৃষ্টি মেলে পরখ করে কলেজ ইউনিফর্ম পরিহিত মেয়েটাকে। লম্বা চুলগুলো একটা বিনুনি করা, অতি ধীর তার পায়ের গতি, বোকা বোকা চোখ মেলে বান্ধুবীদের কথা শুনতে ব্যস্ত মেয়েটাকে দেখতেই ব্যাক সিটে বসা একটা গম্ভীর স্বর আদেশ করে,

“ গাড়ি স্টার্ট দাও। “

আদেশটুকু কানে যেতেই ড্রাইভিং সিটে বসা মানুষটা লুকিং গ্লাসে নিজের মাস্ক দিয়ে চেহারা ঠিকঠাক ভাবে ঢাকা কিনা তা একবার নিশ্চিত হয়ে নেয়। বাকিরাও মাস্ক দ্বারা মুখটা ঢেকে নেয়। গাড়িটা স্টার্ট দিয়েই সমীচীন গতিতে কলেজের গেটের দিকে এগোয় তারা। ব্যাক সিটে বসে থাকা একজন খুব কৌশলে চলন্ত মাইক্রোর একপাশের দরজা খুলে দেয়। কিছু বুঝে উঠার আগেই নির্দিষ্ট শিকারকে একটানে চলন্ত গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। এতক্ষণ সমীচীন গতিতে চলা মাইক্রোটা স্পিড বাড়িয়ে দেয় মুহুর্তেই। চঞ্চল পরিবেশটা মুহুর্তেই থমথমে হয়ে যায়। ঘটনার সাক্ষী সকলে হতভম্ব ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয় সেই নাম্বার প্লেটহীন মাইক্রোটার দিকে।

__________

শান্ত হেডকোয়ার্টারটা অশান্ত হয়ে উঠলো এক নারীর আগমনে। জরুরি ভিত্তিতে একজন সৈনিক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবাকে এসে জানালো একজন নারী তার সাথে দেখা করার জন্য এসেছে। জুলফিকার মুজতবা অনুমতি দেয় সেই নারীকে প্রবেশ করার। কিছু মুহুর্তের ব্যবধানেই তার রুমে ক্ষিপ্র পায়ে প্রবেশ করে মধ্যবয়স্কা একজন মহিলা। সেই নারীর আগমনের ধাক্কা সামলানোর পূর্বেই জুলফিকারের ইউনিফর্মের কলার সেই নারীর হাতের মুঠোয় চলে যায়। কান্না জর্জরিত হিংস্র নারী স্বর বলে উঠে,

“ আমার মেয়ে কোথায় জুলফিকার? “

অদ্ভুৎ এবং অপ্রত্যাশিত প্রশ্নটা শুনে বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয় জুলফিকার। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ এই প্রশ্ন আমাকে করার মানে কি? নিশার কি তোমার সাথে থাকার কথা না? “

“ আমার মেয়ে কলেজ থেকে বাসায় ফিরে নি। কলেজের সামনে থেকে আমার মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। “

জুলফিকার বিস্মিত গলায় শুধায়,

“ কি বলছো নাঈমা? কারা করেছে এই কাজ? “

জুলফিকারের শেষ প্রশ্নটা শুনে নাঈমা ক্ষুধার্ত বাঘিনীর ন্যায় ফুসে উঠে,

“ আমার মেয়ের বা আমার কারো সাথে কোনো শত্রুতা নেই জুলফিকার। কিন্তু তোমার আছে। আল্লাহ জানে কোন হায়নার দল আমার নিষ্পাপ মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গিয়েছে। আমার মেয়ের সামান্যতম ক্ষতি আমি মেনে নিবো না। ধ্বংস করে দিবো সব। “

নাঈমার ক্ষুদ্ধ অভিযোগ ও হুমকি জুলফিকার কানে তুলে না। সে জোর করে নাঈমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে গলা উঁচু করে একজন সৈনিককে ডাকে। রুমের বাহিরে অপেক্ষারত সৈনিক ভিতরে প্রবেশ করতেই জুলফিকার আদেশ দেয়,

“ ম্যাডামের জন্য পানি আনাও। উনার দিকে খেয়াল রাখো। “

দায়িত্ব হতে ছোট্ট আদেশটুকু দিয়েই জুলফিকার ব্যস্ত হাতে ফোনে একটা নাম্বারে ডায়াল করতে করতে বেরিয়ে যায়। অপরপাশ হতে কলটা রিসিভ হতেই জুলফিকার ব্যস্ত গলায় বলে,

“ এখনি মিটিং রুমে উপস্থিত হতে বলো সবাইকে। রাইট নাও! “

__________

অন্ধকার রুমে পাটির উপর বসে থাকা রমণী ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে চারিদিকে তাকাতে ব্যস্ত। বাহিরের পৃথিবীর একবিন্দু আলোও এই রুমে প্রবেশের সুযোগ নেই। না বুঝার অবকাশ আছে এখন দিন নাকি রাত। কলেজ ইউনিফর্ম পরিহিত রমণী থেকে থেকে ভীত গলায় ডাকছে,

“ আম্মু? আম্মু? “

কিন্তু তার ডাকের পিঠে আম্মু নামক মানুষটার কোনো উত্তর মিলছে না। পায়ের ব্যথায় ক্লান্ত রমণী এবার শব্দ তুলে কান্না করে উঠলো। পত্রিকা পড়ার বদৌলতে তার ভালোই ধারণা আছে তার সাথে এই মুহুর্তে কি কি খারাপ ঘটনা ঘটতে পারে। ভয়ংকর সম্ভাবনা গুলো মনে উঁকি দিতেই রমণীর ভয়ে মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হয়।

তখনই রুমের দরজা স্ব শব্দে খুলে যায়। অন্ধকার রুমে পাশের রুম হতে অনেকটা আলোর রেখা প্রবেশ করে। সেইসাথে প্রবেশ করে একজন যুবক ও দুইজন ত্রিশার্ধো পুরুষ। কাটকাট চেহারার মাস্ক পরিহিত যুবকের হাতে রয়েছে একটা ক্যামেরা। সেই ক্যামেরার পানে তাকিয়ে রমণী আরেক দফা ভয় পেয়ে যায়।

গম্ভীর মুখশ্রীর যুবক রমণীকে একবার দেখে নিয়ে বলে উঠে,

“ ইয়াসমিন মুজতবা নিশা। “

আগুন্তকঃ যুবকের মুখে নিজের নামটা শুনেই নিশার ভয়ে কপোকাত হৃদয়টা একটুখানি হয়ে যায়। সে সাথে সাথে কান্না মিশ্রিত গলায় বলে,

“ ভাইয়া আমাকে যেতে দিন। প্লিজ আমাকে যেতে দিন। “

আগুন্তকঃ যুবক রাশভারী গলায় বলে,

“ অবশ্যই যেতে দিবো। আগে তোমাকে আমাদের একটা কাজ করতে হবে। “

“ কি কাজ? “

নিজের হাতের ক্যামেরাটা দেখিয়ে যুবক বলে,

“ শুধু নিজের বাপকে হাই জানাবে। ব্যস। এইটুকুই। “

এহেন অদ্ভুত কথা শুনে নিশা অবাক হওয়ার সুযোগ পেলো না। তার আগেই সেই যুবক ক্যামেরা অন করে তার দিকে তাক করলো। নিশা বোকা বোকা চোখ মেলে একবার ক্যামেরার দিকে তো একবার ক্যামেরার পিছনে থাকা যুবকের দিকে তাকায়। যুবক চোখ রাঙাতেই নিশা ফোলা ফোলা চোখ ক্যামেরার দিকে তাক করে অস্ফুটে উচ্চারণ করে,

“ আব্বু! “

ছোট্ট ডাকটা শেষ হতে না হতেই একটা তীক্ষ্ণ শব্দ শোনা গেলো। নিশা নিজের রক্তাক্ত বাম পা চেপে ধরে বিকট স্বরে আর্তনাদ করে উঠে। নিশার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ত্রিশার্ধো দুই পুরুষের মুখও কাপড় দ্বারা বাঁধা। তাদের একজনই এইমাত্র নিশার পা বরাবর গুলি ছুড়েছে। গুলি ছোড়া শেষ হতেই সে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,

“ লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা। শুনলাম সাপের সন্ধানে আপনি একদল চিতা নিয়ে গর্ত খুড়ছেন। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না গর্ত খুড়ে যেই সাপ বের হবে তার বিষ এতটাই ভয়ংকর যে আপনি আর আপনার চিতাবাঘের দল তার এক ছোবলেই প্রাণ হারাতে বাধ্য। তাই অযথা এই খোড়াখুড়ির কাজ বন্ধ করুন। আর যদি না করেন তাহলে পরবর্তী বুলেটটা আপনার মেয়ের মাথায় ছোড়া হবে। “

ক্যামেরাটা অফ করতেই ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে নিশা পাটির উপর লুটিয়ে পড়লো। আর্তনাদ করার আর কোনো সুযোগ দেওয়া হলো না তাকে। মুখের ভেতর গুজে দেওয়া হলো একটা বড় কাপড়ের দলা। ব্যথাটুকু আর সইতে না পেরে মুহুর্তেই সে জ্ঞান হারায়। সেই দৃশ্য দেখে পুরুষ দুইজন ঠাট্টা করে বলে,

“ কর্নেলের মেয়ের দেখি মুরগির থেকেও করুণ অবস্থা। “

রাশভারী যুবক অবশ্য সেদিকে তোয়াক্কা করলো না। সে সোজা রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটা ফোনকল রিসিভ করে। ফোনের অপরপাশ হতে এক নারী কণ্ঠ ভেসে আসতেই সে প্রতুত্তর করে,

“ আ’ম মিসিং ইউ মোর। শীঘ্রই দেখা হবে। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here