এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৮.
গণমাধ্যম জুড়ে চলছে ব্যাপক সোরগোল। আজ সকালেই চট্টগ্রামের বেসরকারি একটি কলেজের ভেতর হতে ভেসে আসে ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ। স্থানীয়দের মধ্যে কিছুজন সেই গোলাগুলির উৎস খুঁজতে কলেজ প্রাঙ্গণে পা রাখতেই বিল্ডিংয়ের ভেতর হতে নিক্ষেপ করা হয় বোমা। পরিস্থিতি আরো বিরূপ রূপ ধারণ করলে সকলে আন্দাজ করতে পারে তার ভয়াবহতা। মিনিট পনেরোর মধ্যে পুলিশ ক্রাইম এরিয়াতে পৌঁছে সম্পূর্ণ এরিয়া ঘেরাও করে ফেলে। খবর পৌঁছে যায় সামরিক বাহিনীর প্রতিটি সেক্টরেও। আরো একবার! আরো একবার দেশের মাটি কুলষিত করার খেলায় মত্ত হয়েছে দস্যু আতঙ্কবাদীরা। এবার কয়টা তাজা প্রাণ ঝড়বে কে জানে?
__________
হেডকোয়ার্টার অফিসটার পরিবেশ আজ বেশ গরম। সকলে তস্ত্র পায়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। স্পেশাল টিমের মেজর এবং সাতজন লেফটেন্যান্ট মিটিং রুমে সম্পূর্ণ তৈরী হয়ে উপস্থিত রয়েছে। অপেক্ষা কেবল একটা অর্ডারের। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা এবং আরো উচ্চপদস্থ লোকেরাও উপস্থিত মিটিং রুমে।
কন্ট্রোল রুম হতে তাদের কাছে খবর এসেছে কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের আজ শিক্ষা সফরে যাওয়ার কথা ছিলো। বাকি সব শিক্ষার্থীদের জন্য কলেজ বন্ধ ছিলো আজ। সকাল ছয়টা বাজে সকল শিক্ষার্থীরা কলেজ প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়। কিন্তু বাস আসতে দেরি করছিলো বিধায় শিক্ষকদের আদেশ অনুসারে তারা সকলে নিজ নিজ ক্লাসে গিয়ে বসে। সকাল সাতটা বাজে বাস এসে উপস্থিত হয় কলেজ প্রাঙ্গণে। তবে কিছু বুঝে উঠার আগেই বাসের ভেতর হতে একদল যুবক কলেজ গেটের দারোয়ান সহ কিছু সংখ্যক শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে নাম না জানা বিদেশি অস্ত্র দ্বারা গুলি ছুড়ে। মুহুর্তে কলেজের ভেতর অবস্থানরত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আতংকিত হয়ে পড়ে। তারা বেরোনোর পূর্বেই অস্ত্রধারীরা কলেজের দালানের ভেতর প্রবেশ করে। অস্ত্রধারী যুবকদের একদল দ্রুত চলে যায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জিম্মি করার উদ্দেশ্যে এবং বাকি একদল দালানের সকল প্রবেশ দ্বার রুদ্ধ করে দিতে মননিবেশ করে।
খবরটুকু শুনতেই জুলফিকারের বুক মোচড় দিয়ে উঠে। এই কলেজেরই দ্বিতীয় বর্ষের বিজ্ঞান বিভাগে নিশা অধ্যয়নরত। নিশা যদি এখন হসপিটালাইজড না থাকতো তাহলে আজ ওই জিম্মি শিক্ষার্থীদের একজন তার মেয়েও হতে পারতো। ভাবনাটা মনে উঁকি দিতেই জুলফিকার দাঁত চিবিয়ে বলে উঠে,
“ জানোয়ারের বাচ্চারা এবার শিক্ষার্থীদের টার্গেট করেছে। “
সাইফ রাগচটা স্বভাবের। এই পরিস্থিতিতে তার রাগ আরো তুঙ্গে। সে তুখোড় গলায় বলে উঠে,
“ স্যার আপনি অর্ডার দিন শুধু। আমরা স্পেশাল টিম কেবল আপনার অর্ডারের অপেক্ষায় রয়েছি। ওদের নিশ্চিহ্ন করে দিবো আমার দেশের মাটি থেকে। “
কর্নেল জুবায়ের শিকদার ঠান্ডা গলায় বলে উঠে,
“ তোমাদের প্রতি বিশ্বাস আছে আমাদের। তবে কিছু জিনিস মাথায় রাখতে হবে। আগে সেখানে পৌঁছে পরিস্থিতি বুঝবে। পরিস্থিতি না বুঝে এবং অর্ডার ব্যতীত কোনো পদক্ষেপ নিবে না। আর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আতঙ্কবাদীদের মৃত নই জীবিত চাই আমরা। ওরা মরে গেলে ওদের সংঘ সম্পর্কে কিছু জানার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে আমাদের। যতক্ষণ না পরিস্থিতি খুব বিগড়ে যাবে ততক্ষণ ফায়ার করবে না। প্রতিটা জিম্মি এই বাংলার তরুণ প্রাণ। ওদের জীবন অনেক মূল্যবান। বিষয়টা মাথায় রাখবে। “
দূর্জয় পাথরের মূর্তির ন্যায় স্থির দাঁড়িয়ে থেকে জবাব দেয়,
“ রজার দ্যাট স্যার। “
__________
দূর্জয় যাওয়ার পর থেকে বাণী ঠাই বিছানায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। হৃৎপিণ্ড প্রবল গতিতে লাফাচ্ছে। মেয়েটাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা হচ্ছে তার। বহ্নি নিশ্চয়ই তার মাম্মার পথ চেয়ে আছে? নাস্তাটাও মুখে তুলেছে কিনা কে জানে! আচ্ছা, হিরণ বাণীর প্রতি রাগটা মেয়ের সামনে প্রকাশ করবে না তো? বহ্নিকে ঘিরে নানারকম দুঃশ্চিন্তায় বাণীর মন ছটফট করছে। মুক্তির প্রশান্তিটাও তার কাছে তেতো ঠেকছে। বাণী বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
“ মাম্মা তোমাকে ভুলে যাই নি মা। ওই আজাব থেকে আমাদের একসঙ্গে পালানো অসম্ভব ছিলো। মাম্মা তোমাকে প্রমিজ করছি যত দ্রুত সম্ভব তোমাকে ওখান থেকে নিয়ে আসবো। আমার বুকে লুকিয়ে রাখবো তোমাকে। “
বাণীর কথা শেষ হতে না হতেই কলিংবেলটা শব্দ তুলে বেজে উঠে। বাণী ভীত হয়। এই মুহুর্তে কে এলো? দূর্জয় না চলে গিয়েছে? সে ছাড়া আর কে আসতে পারে? হিরণ নয়তো? ভয় জেকে ধরে বাণীকে। দূর্বল শরীর টেনে সে ধীর পায়ে বিছানা ছেড়ে নামে। বিড়াল ছানার মতো কদম ফেলে বেরিয়ে আসে বেডরুম হতে। চারিদিকটা পরখ করতে করতে কলিংবেলের শব্দ অনুসরণ করে সে মেইন দরজার কাছে পৌঁছে যায়। দরজার মধ্যিখানে একটা পীপহোল দিয়ে বাহিরে তাকাতেই সে দেখতে পায় ক্লিন শেভ করা চিকন দেখতে একটা আগুন্তকঃ ছেলে দাঁড়িয়ে আছে দরজার অপরপ্রান্তে। বাণী কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করে,
“ কে? “
অপরপ্রান্ত হতে স্পষ্ট এবং পরিষ্কার গলায় সেই যুবক উত্তর দেয়,
“ ম্যাডাম আমি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ইলিয়াস কাঞ্চন বলছি। আমি আপনার নিরাপত্তার দায়িত্বে আছি। দূর্জয় স্যারের অর্ডার অনুযায়ী আমি আপনার জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছি। “
দূর্জয়ের নাম শুনে মৃদু ভরসা খুঁজে পেলেও বাণী রিস্ক নেয় না। সে আশেপাশে খুঁজে ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগোয়। রান্নাঘর হতে একটা ছুরি হাতে বেরিয়ে এসে দরজার কাছে এগোয় সে। মনে মনে দোয়া পড়তে পড়তে দরজাটা সামান্য খুলে বাহিরের দিকে উঁকি দেয় সে। সাথে সাথে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা তার দিকে একটা পলিথিনের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে,
“ ম্যাডাম নাস্তা করে ওষুধ খেয়ে নিবেন আর স্যার বলেছেন আপনি যেই রুমে আছেন সেই রুমের কাবার্ডে উনার মায়ের কিছু জামা আছে। আপনার অসুবিধা না হলে বলেছে সেগুলো আপনি ইউজ করতে পারেন। “
কাটকাট গলায় বলা ছেলেটার কথা শুনে বাণী অবাক হয়। ধীর গলায় বলে,
“ আচ্ছা। “
দরজা লক করে ভেতরে এসে টেবিলের উপর পলিথিনটা রাখে বাণী। পলিথিনের ভেতর হতে বেরিয়ে আসে একটা পারুটির প্যাকেট, একটি নিওটেলা জার, একটা জ্যামের জার এবং এক ডজন কলা ও আপেল। বাণী থম মেরে একটা চেয়ার টেনে বসে রয়। ইলিয়াস কাঞ্চন নামক ওই সেকেন্ড লেফটেন্যান্টের কথাটা তার মাথায় ঘুরছে। দূর্জয় বাণীকে নিজের মায়ের শাড়ি ইউজ করার পারমিশন দিয়েছে? বিষয়টা অবিশ্বাস্য বটে। দূর্জয় নামক একগুঁয়ে ছেলেটা আজকাল শেয়ারিং করাও শিখে গিয়েছে?
ডাইনিং রুমটা হতে চারিদিকটা আরেকবার চোখ বুলিয়ে দেখে বাণী। একটা ডাইনিং, একটা বসার ঘর, একটা রান্নাঘর এবং তিনটা বেডরুম। দুটো বেডরুমের একটায় এতক্ষণ বাণী ছিলো এবং অপর বেডরুমটাও খোলা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বসার ঘরের অপরপাশে থাকা রুমটার দরজা লকড দেখা যাচ্ছে। বাণীর মনে প্রশ্ন জাগে, রুমটা লকড করে রাখা কেন?
__________
সম্পূর্ণ কলেজের বিল্ডিংটায় বোম সেট করে ফেলেছে আতঙ্কবাদীরা। বহিরাগত কেউ প্রবেশ করার চেষ্টা করতে গেলেই সাথে সাথে এক্সপ্লোশন হয়ে মারা পড়বে। প্ল্যান ম্যাপ অনুযায়ী সম্পূর্ণ বিল্ডিংটা নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে এসেছে আব্রাহাম। শেষ ছাদের দরজাটার এখানে বোম সেট করে উঠে দাঁড়াতেই একজন যুবক আব্রাহামের পিছনে দাঁড়িয়ে বলে,
“ ভাই! সব জিম্মিদের দো তলার অডিটোরিয়ামে একত্রিত করেছি। “
আব্রাহাম উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঝেড়ে বলে,
“ পুরো বিল্ডিং তালাশ করেছিস? আর কেউ অবশিষ্ট নেই তো? “
“ না ভাই। “
আব্রাহাম বলে,
“ চল তাহলে। স্টুডেন্টসদের ক্লাস নেওয়া হোক তাহলে। “
আব্রাহামের কথার পিঠে হাসি ফুটে উঠে সেই যুবকের মুখে।
__________
অডিটোরিয়াম জুড়ে প্রায় পঞ্চাশের উপর আতংকিত মুখ বসে আছে ফ্লোরে। সকলেই তাকিয়ে আছে মাস্ক পরিহিত অস্ত্রধারী যুবকদের পানে। কেউই জানে না কি এদের উদ্দেশ্য। সাধারণ শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে এরা কি’বা হাসিল করতে পারবে?
জিম্মিদের মধ্যে রয়েছে কেবল একজন মহিলা শিক্ষক। তিনি ভয় মিশ্রিত সুরে একজন আতঙ্কবাদীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে,
“ আমাদের বন্দী করেছেন কেনো? আমরা কি করেছি? “
শিক্ষিকার সেই প্রশ্নের পিঠে আআতঙ্কবাদীরা বিশ্রী ভঙ্গিতে হাসে। ঠিক সেই মুহুর্তে দরজা হয়ে বিশাল অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করে মাস্ক, কালো টিশার্ট, প্যান্ট এবং লেদারের জ্যাকেট পরিহিত এক যুবক। তার পিছু পিছু আরো দু’জন যুবকও অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করে। সকল জিম্মিদের দৃষ্টি স্থির হয় দরজার দিকে। আব্রাহাম বিশাল রাইফেলটা পাশের এক যুবকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের কালো প্যান্টের পিছন হতে একটা পিস্তল বের করে। পিস্তল বের করতে দেখে এক মুহুর্তের জন্য সকল জিম্মিরা ভয়ে চিৎকার করে উঠে। কিন্তু মাস্ক পরিহিত সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টির যুবকটা তাদের দিকে তাকাতেই তাদের গলার স্বর হারিয়ে যায়।
আব্রাহাম মাঝামাঝি অবস্থিত একটা চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসেই গম্ভীর স্বরে শুধায়,
“ গুড মর্নিং স্টুডেন্টস। “
তার চোখের অচেনা সেই দৃষ্টি এবং রাশভারী গলার স্বর শুনে জিম্মিদের মধ্যে হতে একজন কিশোরী বিস্ময় মিশ্রিত সুরে উচ্চারণ করে,
“ আব্রাহাম! “
পিনপতন নীরবতা পূর্ণ রুমে সেই ক্ষীণ আওয়াজ বেশ স্পষ্ট শোনা যায়। আব্রাহামের দৃষ্টি গিয়ে ঠেকে জিম্মিদের মধ্যে কলেজ ইউনিফর্ম এবং তার উপর একটা জ্যাকেট পড়ে থাকা রমণীর দিকে। দৃষ্টি মিলন হতেই রমণীর বুকে যেনো কেউ ছুরি চালায়। সে কোনো কিছুর পরোয়া না করে উঠে দাঁড়ায়। সাথে সাথে আব্রাহাম ব্যতীত উপস্থিত সকল আতঙ্কবাদীরা তার দিকে রাইফেল তাক করে ধরে। রমণীর সহপাঠীরা ফিসফিসিয়ে তাকে বলতে থাকে বসে পরার জন্য। কিন্তু রমণীর কানে পৌঁছায় না কোনো সতর্ক বার্তা। সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি মেলে এগিয়ে যায় আব্রাহামের দিকে।
আব্রাহাম পায়ের উপর রাখা পা টা নামায়। সোজা হয়ে বসে সে। রমণী ঠিক তার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। অবিশ্বাস্য চোখ জোড়া জলে টইটম্বুর হয়ে রয়েছে। চরম দুঃসাহসিকতা দেখিয়ে রমণী হাত বাড়িয়ে একটানে আব্রাহামের মুখের মাস্কটা খুলে ফেলে। সম্পূর্ণ মুখশ্রী উন্মোচিত হতেই রমণীর জলে টইটম্বুর চোখ জোড়া হতে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। চেনা মুখটার সঙ্গে এই পরিস্থিতিতে সাক্ষাৎ হওয়ায় রমণীর বুকের পাঁজরে যেনো টান পড়লো। রমণীর বিস্ময়ভরা ছলছল দৃষ্টি সেই মুখপানে চেয়ে বলে উঠে,
“ এটা ছিলো তোমার সারপ্রাইজ? “
আব্রাহাম হাতের পিস্তলটা সুকৌশলে ধরে তার নলটা রমণীর থুতনির নিচ দিয়ে ধরে। ট্রিগারে আঙুল রেখে একগাল হেসে বলে,
“ তোমার পছন্দ হয়েছে তো রুহী? “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]