এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৯.

0
147

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৯.

লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবার জরুরি তলবে মিটিং রুমে হাজির হয়েছে সামরিক বাহিনীর ১১ জন দক্ষ লেফটেন্যান্ট। ইতিমধ্যে সকলের কানে পৌঁছে গিয়েছে যে লেফটেন্যান্ট কর্নেলের মেয়েকে কেউ তুলে নিয়ে গিয়েছে। বিষয়টার সাথে কে বা কারা জড়িত থাকতে পারে তা ইতিমধ্যে সবাই অনুমান করতে পারছে। মিটিং রুমে আরো উপস্থিত রয়েছে দু জন কর্নেল এবং একজন কম্পিউটার অপারেটর। ষোলকলা পূর্ণ হয় মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়ের আগমনে।

দূর্জয় মিটিং রুমে প্রবেশ করেই চিন্তিত গলায় শুধায়,

“ স্যার, নিশার কোনো আপডেট পাওয়া গিয়েছে? কিংবা ওর এড্রেস ট্রেস করা সম্ভব হয়েছে? “

জুলফিকার মুজতবা নত মাথাটা সামান্য নেড়ে না জানায়। একজন কর্নেল জুলফিকারকে আশ্বস্ত করে বলে,

“ ডোন্ট ওয়ারি জুলফিকার। বেস্ট ফোর্স পাঠানো হবে। তোমার মেয়ের কিছু হবে না। “

কর্নেলের কথাটুকু শেষ হতেই কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা একজন সামরিক অপারেটর বলে উঠে,

“ স্যার! অনলাইন ওয়েবসাইটে একটা ভিডিও পাবলিশড করা হয়েছে। আমি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে ভিডিওটা প্লে করছি। দেখুন। “

জুলফিকার সহ সকলেই উদগ্রীব নয়নে বিশাল মাল্টিমিডিয়া স্ক্রিনের দিকে তাকায়। মুহুর্তেই সফেদ স্ক্রিনে ভেসে উঠে কলেজ ইউনিফর্ম পরিহিত এক মেয়ের কান্নারত মুখশ্রী। ক্যামেরার পানে তাকিয়ে তার অস্ফুটে উচ্চারিত আব্বু ডাকটা জুলফিকারের কানে পৌঁছাতেই তার পিতা সত্তার নরম কোমল অবয়বটা মুখে ফুটে উঠে। কিন্তু মুহুর্তেই বিকট শব্দে মেয়েকে চিৎকার করে উঠতে দেখে তার সেই কোমল অবয়বটা উবে গেলো। সে আর্তনাদ করে উঠলো,

“ নিশা! “

সেই এগারো জন লেফটেন্যান্টের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সাইফ এতক্ষণ হতভম্ব দৃষ্টি মেলে দেখছিলো স্ক্রিনের নিশা নামক মেয়েটাকে। আরো ছয় জোড়া হতভম্ব দৃষ্টি তখন তার দিকে নিবদ্ধ। এই মেয়েটা তবে লেফটেন্যান্ট কর্নেলের মেয়ে? এই প্রশ্নটা মাথায় উঁকি দিতেই সাইফ বিষম খেলো। অজান্তে করা ভুলের জন্য মাথা ঠুকে মরে যেতে মন চাইলো। ছিচেকাদুনি এই মেয়েটা যদি সাইফের নামে লেফটেন্যান্ট কর্নেলের কাছে নালিশ করে তখন কি কি হতে পারে সেই হিসেব কষতে যখন ব্যস্ত সাইফ ঠিক সেই মুহুর্তে তার চোখের সামনে স্ক্রিনে ভেসে উঠলো আরেকটা দৃশ্য। একজন আতঙ্কবাদী বেরহমের সাথে গুলি করে মেয়েটার পা বরাবর। সাথে সাথে মেয়েটা তীব্র আর্তনাদ করে রক্তাক্ত পা চেপে ধরলো। এইটুকু দৃশ্য দেখেই সাইফের মেজাজ চরম বিগড়ে গেলো। শক্ত গলায় সে উচ্চারণ করে,

“ জানোয়ারের বাচ্চা। “

তার উচ্চারণ করা শব্দটা কর্নেল কিংবা অন্যদের কানে না পৌঁছালেও তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা লেফটেন্যান্টদের কানে ঠিকই পৌঁছালো। রাফি, জুনায়েদ, প্রত্যয়, সাদাত, রিদওয়ান, ফারদিন সকলেই এক পলক সাইফকে দেখে নিয়ে ফের স্ক্রিনের দিকে মনযোগ দেয়। আতঙ্কবাদীর বলা হুমকিসরূপ কথাটা দিয়ে ভিডিও ক্লিপ শেষ হতেই জুলফিকার রাগ মিশ্রিত সুরে আদেশ করে,

“ এখনই এই ভিডিও কোন জায়গা থেকে পাব্লিশ করা হয়েছে সেই ইনফরমেশন বের করো। “

কম্পিউটার অপারেটর একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে কানে হেডফোন গুজে ডিউটি এবং অর্ডার পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিছু সময়ের ব্যবধানেই সে কাঙ্ক্ষিত এড্রেস ট্রেস করে ফেলে। চট্টগ্রামের নির্জন এক পাহাড়ি এলাকার এড্রেসটা সম্পর্কে জুলফিকারকে অবহিত করতেই জুলফিকার কর্নেল হতে অনুমতি নিয়ে ছয় সদস্যের একটা বিশেষ টিম উক্ত স্থানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানায়। সেই ছয় জন সদস্যের দলের মধ্যে সাইফ এবং প্রত্যয়ও রয়েছে। দূর্জয় উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,

“ স্যার, অনুমতি থাকলে আমিও যেতে চাই। “

জুলফিকার দূর্জয়ের আবদার নাকোচ করে বলে,

“ তোমার উপর অন্য দায়িত্ব আছে দূর্জয়। বাকি পাঁচজন সহ তুমি রইস দিলদারের সন্ধানে যাবে। “

অর্ডার না মানা দূর্জয়ের স্বভাবের বহির্ভূত কাজ। সে মাথা নেড়ে এগিয়ে গিয়ে জুলফিকারকে জড়িয়ে ধরে। এই মানুষটার সাথে তার কেবল প্রফেশনাল লাইফের নয় বরং ব্যক্তিগত এবং আত্মিক একটা সম্পর্কও আছে। দূর্জয়ের মরহুম পিতা শাহরিয়ার রিফাতির সঙ্গে জুলফিকার মুজতবার ভাতৃত্ব সমতুল্য বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিলো। সেই সম্পর্ক এতটাই গভীর ছিলো যে প্রাণপ্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর পরও তার সন্তানকে একা ছেড়ে দেয় নি জুলফিকার। নিজের সন্তানের ন্যায়ই ভালোবেসেছে, স্নেহ করেছে, একজন মেন্টরের ন্যায় সঠিক গাইডলাইন দিয়েছে। বেহিসাবি এই ভালোবাসা ও স্নেহের প্রতিদান হিসেবে দূর্জয় এই মানুষটার প্রতি সবসময় মনে লালন করে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

দূর্জয় আলিঙ্গন মৃদু দৃঢ় করে শুধায়,

“ নিশা উইল বি ব্যাক সেফলি। “

__________

সাইলেন্সার বসানো রিভলবারটা নিশানা বরাবর তাক করে গুলি ছুড়তেই তা সদূরে অবস্থিত গোলাকার এক নিশানা চিত্র ভেদ করে চলে গেলো। টের পেলো না কোনো কাক পক্ষী। সঠিক নিশানায় গুলি ছুড়তেই পঞ্চাশর্ধো শমসের মজুমদারের মুখে এক দাম্ভিক ভাব ছড়িয়ে পড়লো। আত্মঅহংকারে ফুলে ফেঁপে উঠলো তার বুক। খোলা আকাশের নিচে বাড়ির পেছনের সবুজ এই খোলা মাঠটা তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত। এখানে দাঁড়িয়ে সারাদিন সে পিস্তল চালালেও তাকে কেউ কিছু বলতে পারবে না।

শমসের মজুমদারের পাশে দাঁড়ানো যুবকটার ফোন হঠাৎ বেজে উঠতেই তার মনযোগে ব্যাঘাত ঘটে। শমসের আড়চোখে তাকায় যুবকের পানে। কিছুক্ষণ কথা বলে যুবক ফোনটা রেখেই হাসিমুখে বলে উঠে,

“ লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা পর্যন্ত আপনার ম্যাসেজ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে স্যার। “

শমসের বাকা হেসে শুধায়,

“ আমরা শক্তিশালী কেন জানো? “

“ কেন স্যার? “

পিস্তলের নলের মাথায় সামান্য ফু দিয়ে ধোঁয়া উড়ানোর মতো করে শমসের বলে উঠে,

“ করাণ আমাদের কোনো দূর্বলতা নেই। পরিবার পরিজন এসব হলো মানুষের দূর্বলতার জায়গা। কিন্তু যেই পুরুষ পরিবার দিয়ে বাঁধা নেই সে সবথেকে শক্তিশালী পুরুষ। “

শমসের বলা কথার সাথে একমত পোষণ করে যুবক মাথা নাড়ায়। হাতে থাকা পিস্তলটা এবার গাছে বসে থাকা এক পাখির দিকে তাক করে শমসের বলে,

“ কিন্তু আমার এই তিলে তিলে তৈরী করা সংঘের খুঁটির মধ্যে ত্রুটির দেখা মিলেছে। আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে স্ত্রী সন্তান নিয়ে সংসার পেতে বসেছে সে। ভেবেছে আমি কখনো জানতে পারবো না। কিন্তু ও হয়তো ভুলে গিয়েছে আমি কে। যেই পাপের সাম্রাজ্যের খুঁটি ও সেই সাম্রাজ্য আমি স্থাপন করেছি। ওর মতো এতিমকে গড়ে তুলেছি নিজের মতো করে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মস্ত বড় ভুল করেছি। বাচ্চা সাপটা দুধ কলা খেয়ে কালসাপে পরিণত হয়েছে। ওর দূর্বলতায় হাত দিলে যে আমাকে ছোবল মারার আগে একবারও ভাববে না তা খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে। “

কথাটুকু বলেই শমসের সেই পাখির দিকে তাক করে রাখা রিভলবারের ট্রিগার পুল করলো। মুহুর্তেই মৃত শালিক পাখির দেহটা লুটিয়ে পড়লো মাঠে। যুবকটা এতক্ষণ খুব মনযোগ দিয়ে শমসেরের কথা শুনলো। অত:পর ইতস্তত গলায় প্রশ্ন করলো,

“ আপনার কি অর্ডার স্যার? ছোবল মারার আগেই কি বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া উচিত? “

“ না। এখনই না। বহুদূর পর্যন্ত এসে মাঝপথে আমি সব ভেস্তে দিতে চাই না। ওর প্রয়োজন পড়বে আমার। একবার প্রয়োজন মিটুক তারপর ওকে দেখে নিবো আমি। “

“ স্যার? জুলফিকার মুজতবার মেয়ের ব্যাপারে কি আদেশ আপনার? ইতিমধ্যে সৈন্যরা নিশ্চয়ই এড্রেস ট্রেস করে রেস্কিউর উদ্দেশ্যে রওনাও দিয়ে দিয়েছে। “

শমসের মৃদু বাকা হেসে বলে,

“ আমার চিতা সাহসী সৈন্যদের অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে রেখেছে। “

শমসেরের কথার অর্থ বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো যুবকের। বুঝতে পেরে সে-ও পৈশাচিক হাসি দিয়ে উঠলো।

__________

নিরিবিলি কফিশপটায় বসে তীক্ষ্ণ ও সতর্ক দৃষ্টি মেলে চারিদিকটা পরখ করতে ব্যস্ত লেফটেন্যান্ট সাদাত সরকার। মোর্শেদ হতে রইস দিলদারের সম্ভাব্য কিছু ঠিকানা জোগাড় করে সিভিল গেটাপে বিচ্ছিন্ন ভাবে তার তালাশে বেড়িয়েছে দূর্জয় এবং তার দলের পাঁচজন যুবক। মোর্শেদের মুখে শোনা রইস দিলদারের বাহ্যিক বিবরণ অনুযায়ী সন্দেহভাজন কাউকেই এখনো চোখে পড়ে নি সাদাতের। আল্লাহ ভালো জানেন অসভ্যের বাচ্চাটা কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে!

একজন ওয়েটার গরম গরম ধোঁয়া উঠা একটা কফির কাপ সাদাতের সামনে এনে রেখে চলে যায়। সাদাত সেই অপ্রয়োজনীয় কফি কাপটার দিয়ে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করে না। তার অতি মনযোগের মধ্যে কানে থাকা ব্লু টুথ ডিভাইস হতে ভেসে আসলো মেজর দূর্জয়ের কণ্ঠস্বর,

“ হান্টার ৩। এনি আপডেট? “

সাদাত চারিদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে জবাব দিলো,

“ নো স্যার। স্টিল নো সাসপেক্টেড ডিটেক্টেড। “

কথাটুকু শেষ করতেই সাদাতের চোখ স্থির হলো ঠিক তার বামে তিন টেবিল সামনে বসা এক নারীর দিকে। মুহুর্তেই সাদাতের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। তার তীর্যক দৃষ্টি ঠাহর করতে পেরেই সেই নারী অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। এলোমেলো দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে হাতে থাকা জিনিসপত্রগুলো ব্যাগে চালান করে দিলো। টেবিলের উপর বিলটা রেখে বিনাবাক্য ব্যয়ে সেই নারী মুহুর্তেই কফিশপ থেকে প্রস্থান করলো।

সাদাত বিচক্ষণ দৃষ্টি মেলে একবার কফিশপের চারদিকে তাকালো। কফিশপের তিন কর্নারে থাকা তিনটা সিসিটিভি ফুটেজ একবার দেখে নিয়েই সে-ও বিলটা টেবিলের উপর রেখে বড় বড় কদম ফেলে বেড়িয়ে গেলো কফিশপ থেকে।

কফিশপের দুই গলি পরে নিস্তব্ধ রাস্তা ধরে হাঁটছে এক নারী। প্রবল আগ্রহ ভরা দৃষ্টি মেলে দেখছে চারিদিকটা। পড়নে তার সাদা রঙের একটা টি শার্ট এবং জিন্সের প্যান্ট। তার উপর হাঁটু সমান অলিভ রঙের একটা ওভারকোটও পড়েছে সে। রেড ওয়াইন রঙের চুলগুলোকে উঁচু করে পোনিটেল করে রেখেছে। আচমকা তার কাধে ঝুলন্ত কালো সাইড ব্যাগটায় টান পড়তেই সেই নারী হতভম্ব দৃষ্টি মেলে ফিরে তাকালো। পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চির এক টগবগে যুবককে চোখে পড়লো তার। সহজ করে বলতে গেলে সুদর্শন দেখতে এই পুরুষ চেহারা সে এই প্রথম দেখছে না।

একটু আগে সেই ভিন্টেজ কফিশপটাতেও এই পুরুষের নজরকাড়া মুখশ্রী তার চোখে পড়েছিলো। এবং চোখে পড়তেই তার অবচেতন মন বলে উঠেছিলো এই সুপুরুষটা দেখতে অনেকটা নাইন্টিসের আর্জুন রামপালের মতো দেখতে। কিন্তু ভদ্র দেখতে এই পুরুষ হঠাৎ অভদ্রের ন্যায় তার ব্যাগ ধরে কেন টান দিলো তা বুঝতে পারছে না সে। শুধু ব্যাগ টান মেরেই ক্ষান্ত হয়নি বরং তার ব্যাগ হতে তার ব্যাক্তিগত ডায়েরিটাও বের করে নিয়েছে। মেয়েটা রেগে গিয়ে বলে,

“ আরে আরে করছেন কি? “

সাদাত মেয়েটার কথার তোয়াক্কা না করে ডায়েরির কিছু পাতা উল্টে একটা পৃষ্ঠা বের করে তা একটানে ছিড়ে ফেলে। মেয়েটা আঁতকে উঠে বলে,

“ পাগল নাকি? “

সাদাত ব্যাগ এবং ডায়েরিটা মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে সেই কাগজটা কুটি কুটি করে ছিড়ে ফেলে। মেয়েটা এবার চটে উঠে বলে,

“ এক্সকিউজ মি? এমন অভদ্রের মতো আচরণের মানে কি? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া আমি কত কষ্ট করে স্কেচটা করেছি?

সাদাত কাগজের টুকরো গুলো রাস্তায় ফেলে দাঁতের সাথে দাঁত পিষে বলে উঠে,

“ কারো পারমিশন ছাড়া তার স্কেচ করাটাও অভদ্রতার কাতারে পড়ে। হোপ ইউ উইল কিপ ইট ইন মাইন্ড ফ্রম নাও অন। “

কথাটুকু বলেই সাদাত আর পিছনে ফিরে না তাকিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। মেয়েটা একপলক রাস্তায় অবহেলায় পড়ে থাকা নিজের স্কেচের পানে তাকিয়ে ফের চোখ তুলে সামনে চাইলো। দেখতে আর্জুন রামপালের মতো হলে কি হবে? আচরণ একদম বাংলা সিনেমার খচ্চর চৌধুরী সাহেবের মতো। অহংকারী, অভদ্র, জাদরেল কোথাকার!

__________

ট্র্যাকড এরিয়ার কাছাকাছি এসেই সামরিক হেলিকপ্টারটা আকাশপথে নির্দিষ্ট একস্থানে স্থির হয়। নিরাপত্তার কারণে সরাসরি ট্র্যাকড প্লেসে হেলিকপ্টার নিয়ে যাওয়ার অনুমতি নেই। চিকন শক্ত তারের মতো দঁড়ি ধরে সমতলে নেমে আসে ছয়জন সৈন্য। সমতলে নেমেই তারা সবাই আপন পজিশনে দাঁড়িয়ে নিজেদের রাইফেল তাক করে ধরে। সম্পূর্ণ এরিয়াটা একবার পরীক্ষা করে নিয়েই তারা কাঙ্ক্ষিত এড্রেস অনুযায়ী এগিয়ে যায়। পাহাড়ি এই এরিয়াটায় জনমানবের কোনো বসতি নেই বললেই চলে। শত্রুরা বেশ ভালো জায়গার সন্ধান জানে বলতেই হয়।

সাইফ সরু দৃষ্টি মেলে সামনে একপা একপা করে এগিয়ে যাচ্ছে। এখানে আসার পথে প্রত্যয় তাকে জানিয়েছে যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং তার স্ত্রীর বেশ কয়েক বছর আগেই ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। নিশা নামক সেই মেয়েটাও তার মায়ের সাথেই থাকে। তাহলে সেদিন নিজের আম্মুকে কল না করে আব্বুকে কল করেছিলো কেন নালিশ করার জন্য? সাইফ নিজের ভাবনাকে দুটো গালমন্দ করে বলে,

“ ধ্যাৎ! যেই মাইয়্যার বাপ আর্মিতে ওই মাইয়্যা তো বিপদে পড়লে আগে নিজের বাপরেই কল করবো! “

এরকম আরো অপ্রয়োজনীয় ভাবনায় বুদ হয়েই একটা ইটের তৈরী একতলা বাসার কাছে পৌঁছে যায় তারা। ছয়জন সৈন্য সুকৌশলে সম্পূর্ণ বাসা চারিদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। রাইফেল এমন দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছে যেন গোলাবর্ষণের জন্য প্রস্তুত তারা। বিচক্ষণ ছয় জোড়া চোখ চারিদিকটা আরেকবার পরখ করে নিয়েই তাদের কষা ছক অনুযায়ী দুজন অতি সাবধানে একতলা বাড়িটার নীল রঙা কাঠের দরজার সামনে গিয়ে অবস্থান নিলো।

প্রত্যয় দরজার দিকে রাইফেল তাক করে ধরতেই সাইফ মনে মনে বিসমিল্লাহ বলে এক লাথি মারতেই পুরনো দরজাটা স্ব শব্দে খুলে যায়। দরজার বাহির থেকে খালি রুমটা একবার পর্যবেক্ষণ করে ভিতরে পা রাখে সাইফ। তার পিছু পিছু প্রত্যয় সহ আরো দুজন ভিতরে প্রবেশ করে। বাকি দুজন বাহিরে রয়ে যায় পাহাড়া দেওয়ার জন্য। দুই রুমের বাসাটার প্রথম রুমটা সম্পূর্ণ খালি দেখে এবার দ্বিতীয় রুমে প্রবেশের জন্য প্রস্তুতি নেয় সাইফ। মনে মনে আরো একবার বিসমিল্লাহ বলে দরজাটা আলতো ধাক্কা দিতেই তা খুলে যায়।

ফ্লোরের উপর বিছানো পাটিতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে এক রমণী। তার সাদা পাজামার একপাশটা রক্তে লাল হয়ে আছে। গুলি করা স্থানে হয়তো রক্তক্ষরণ বন্ধের জন্য একটা কাপড় দ্বারা শক্ত করে বেধে রাখা হয়েছে। খোলা দ্বারের ভেতর এই দৃশ্যটুকু দেখেই সাইফের মুখটা প্রচণ্ড রাগে লাল রঙ ধারণ করে। শালা কাপুরুষের দল। নারীর কাধে পিস্তল রেখে গুলি চালানো পুরুষরা কাপুরুষই বটে। সাহস থাকলে এরা লেফটেন্যান্ট কর্নেলের মেয়েকে না তুলে লেফটেন্যান্ট কর্নেলের সাহসী যোদ্ধা সাইফকে তুলে আনতো। সাইফ তখন এদের বুঝিয়ে দিতো কত মাছে কত কাটা!

ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে সাইফ ভেতরে প্রবেশ করতেই তার পিছু পিছু বাকি তিনজন প্রবেশ করে। কারো উপস্থিতি টের পেতেই নিশা ভীত দৃষ্টি মেলে তাকায়। তার ভয় আরো গাঢ় হয় সাইফ এবং প্রত্যয়ের চেহারা দেখে। সে একটা ঢোক গিলে ভয়ে চিৎকার দেওয়ার প্রস্তুতি নিতেই সাইফ তাকে আশ্বস্ত করে বলে,

“ ঘাবড়াবেন না। আমি লেফটেন্যান্ট তামজিদ সাইফ। আপনার আব্বু লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা আমাদের পাঠিয়েছেন আপনাকে উদ্ধার করার জন্য। “

আব্বুর কথা শুনতেই নিশা সামান্য ভরসা খুঁজে পায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই সাইফকে এগিয়ে আসতে দেখে সে চেঁচিয়ে উঠে,

“ আসবেন না। “

সাইফ ভ্রু কুচকে তাকাতেই নিশা অতি সাবধানে উঠে বসে নিজের গায়ে জড়ানো ময়লা শালটা সরিয়ে ফেলে। সাথে সাথে সাইফ সহ বাকি তিনজনের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। নিশার পেটের কাছে বাধা ওই ভয়ংকর সাংঘাতিক জিনিসটা দেখেই সাইফ ব্যস্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠে,

“ ব্রিং দ্যা ডিফিউজ কিট রাইট নাও। “

প্রত্যয় এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। সাইফ ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে নিলেই নিশা ফের কান্নারত গলায় চিৎকার করে উঠে,

“ প্লিজ আসবেন না। শুধু দূর থেকেই আমার আম্মু আব্বুকে কল করুন। আমি উনাদের সাথে শেষ বারের মতো কথা বলতে চাই। “

সাইফ নিশার ভীত স্বরে করা আবদার ও নিষেধকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নিশার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে। তার বিচক্ষণ দৃষ্টি টাইম বোমের দিকে নিবদ্ধ। তেরো মিনিট সাতাশ সেকেন্ড। সময়টা দেখে নিয়েই সাইফ ফের ধমকের সুরে চেঁচালো,

“ সময় নেই। দ্রুত ডিফিউজ কিট নিয়ে এসো। “

এবার বাকি দু’জনও দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো ডিফিউজ কিট আনার উদ্দেশ্যে। সাইফ এবার টাইম বোমটা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সরাসরি নিশার চোখে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বলে উঠে,

“ চিন্তা করবেন না মিস ইয়াসমিন। আমি খুব দুর্দান্ত বোম ডিফিউজার। আপনাকে অভিযোগের কোনো সুযোগ দিবো না। “

নিশা কান্না বিরতি দিয়ে ফোলা ফোলা চোখ মেলে বোকা স্বরে প্রশ্ন করে,

“ আর যদি আপনি ব্যর্থ হন? “

সাইফের মেজাজ গরম হয়ে যায় নিশার এমন কথায়। মনে মনে বলে,

“ শালার পুরা মাইয়া জাতই একটা ব্যাডবাজ। “

মনে মনে এটা বললেও সাইফ বেরস সুরে উচ্চারণ করে,

“ তাহলে দুজনেই মরবো। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here