এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ২১.

0
191

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২১.

[ সতর্কতা : এই পর্বের কিছু অংশে স্ল্যাং ওয়ার্ডস এবং তার পাশাপাশি খুনের বিবরণ রয়েছে। তাই প্রাপ্তমনস্ক না হলে সেই ব্যাপার গুলো এড়িয়ে যাবেন। ]

সকাল থেকে বাড়িটা মাথায় তুলে রেখেছে বহ্নি। না মুখে তুলেছে দানাপানি, না তোয়াক্কা করছে কারো অনুনয়ের। কেবল একটাই কথা তার। মাম্মাকে চাই। হিরণ গতরাত হতে এখনো বাড়ি ফিরে নি। কোথায় নিরুদ্দেশ হয়েছে কে জানে! তবে হিরণ যদি বাড়ি ফিরে শুনে তার মেয়ে সকাল থেকে অভুক্ত তাহলে যে কি অবস্থা হবে তা ভাবতেই রাধুনি লিজা ভয়ে তটস্থ হয়ে যাচ্ছে। তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন বাচ্চাটাকে খাওয়ানোর। এক পায়ে দাঁড়িয়ে থেকে একের পর এক বহ্নির সকল প্রিয় খাবার রান্না করে মুখের সামনে নিয়ে ধরেছে। কিন্তু বহ্নি তা মুখে তো তুলেই নি উল্টো আরো রাগ করে দুপুর থেকে নিজের রুমের দরজা ভিতর থেকে লক করে বসে আছে।

লিজা বহ্নির রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বলে,

“ বহ্নি মামণি, দরজা খুলো। মাম্মা এসে পড়বে তো। এরকম করলে মাম্মা কষ্ট পাবে। “

বহ্নি ভিতর থেকে চেঁচিয়ে উঠে,

“ লায়ারস। মাম্মা, পাপা আসবে না। “

“ কেনো আসবে না? তোমাকে রেখে উনারা কোথায় যাবে? “

“ তাহলে সকাল থেকে কেউ একবারও আমার সাথে ফোনে কথা বলে নি কেনো? “

বহ্নির এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না লিজা। সে কিভাবে জানবে স্যার আর ম্যাডাম নিজেদের মেয়ের সাথে কেনো কথা বলছে না? এক চাপে সারাদিন এই বাচ্চা মেয়েটার পিছনে দৌড়ে লিজা ক্লান্ত। তার ধৈর্য্য শক্তিও আর মানছে না। তিনি শেষ বারের মতো ক্লান্ত গলায় বলে,

“ বের হও মামণি। তোমার পাপা খুব রাগ হবে। “

বহ্নি এবার আর কোনো জবাব দেয় না। লিজা আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সে ক্লান্ত পায়ে দো তলা থেকে নিচে নেমে আসে। যা হওয়ার হবে। তার পক্ষে আর সম্ভব নয় এই বাচ্চার পিছনে দৌড়ানো।

__________

গর্জন তোলা সমুদ্রের ধারে নীরবে বসে আছে হিরণ। অনিমেষ চেয়ে আছে দূর সমুদ্রের জলরাশির পানে। কেন জানি মনে হচ্ছে এইবার বাণীকে খুঁজে পাওয়া এতটা সহজ হবে না। আগের দু’বার বাণী একা পালিয়েছিলো। এবার কারো সঙ্গে পালিয়েছে। সেই কেউটা যে সাধারণ কেউ নয় তা বুঝতে মোটেও অসুবিধা হচ্ছে না হিরণের। সাধারণ কেউ হলে নিশ্চয়ই এভাবে সব প্রমাণ মিটিয়ে পালাতে পারতো না?

গভীর ভাবনার অতলে ডুবে থাকা হিরণকে কাছ হতে দেখছে ইবাত। গত রাত থেকে এক মুহুর্তের জন্যও সে হিরণকে একা ছাড়ে নি। এই শান্তশিষ্ট স্যারকে তার মোটেও ভালো লাগছে না। হিরণের স্বভাব অনুযায়ী এতক্ষণে দশ বারোটা লাশ ফেলে দেওয়ার কথা। কিন্তু হিরণ সেরকম কিছুই করছে না। কেবল শান্ত গলায় বাণী ম্যাডাম আর তার সাহায্যকারীকে খুঁজে বের করার আদেশ দিয়ে এই সমুদ্র পাড়ে এসে বসে আছেন।

ইবাতের ভাবনার মাঝেই হিরণ আচমকা মৃদু হেসে বলে উঠে,

“ বাণীকে আমি নিজের করেছি। কিন্তু বাণী আমার হয় নি। “

হিরণের কথার ধরণ দেখে ইবাতের বড্ড মায়া হয়৷ সে মানছে তার স্যার খারাপ। কিন্তু ম্যাডাম কি একটু কনসিডার করতে পারতো না? স্যারের অনুভূতিকে সামান্য মূল্যায়ন করতে পারতো না? ইবাত নিশ্চিত বাণী ম্যাডামের এক কথায় স্যার দুনিয়া এঁফোড়-ওঁফোড় করে দেওয়ার আগেও দ্বিতীয় বার ভাববেন না।

ইবাতের ভাবনার মাঝেই তার ফোন বেজে উঠে। সে কল রিসিভ করতেই অপরপাশ হতে বলা কথা শুনে ফোন কানে ধরে চিন্তিত গলায় হিরণের উদ্দেশ্যে বলে,

“ স্যার, বহ্নি দুপুর থেকে রুমের দরজা লক করে বসে আছে। গত এক ঘন্টা ধরে ওর কোনো সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। প্লিজ চলুন। “

মেয়ের কথা শুনতেই যেনো হিরণ সম্বিত ফিরে পায়। দ্রুত পায়ে উঠে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। বাণীর ভাবনায় সে এতটা বিভোর হয়ে ছিলো যে নিজের মেয়ের কথা ভুলে গিয়েছিলো সে। হিরণ ফ্রন্ট সিটে উঠে বসতে বসতে আদেশের গলায় বলে,

“ দ্রুত চালাও। আমার মেয়ে অপেক্ষা করছে। “

__________

সন্ধ্যা সবে নামলো বলে। অডিটোরিয়ামের মেঝেতে বসে থাকা ভীত সন্ত্রস্ত মেয়েগুলো আর সহ্য করতে পারছে না এই জীবন মরণ ক্ষণ। তবুও তাদের ঠোঁট চেপে এই পরিস্থিতি সহ্য করতে হচ্ছে। কারণ তারা কেউই তাদের শিক্ষিকা রুনা ফারহানার মতো করুণ পরিণতি চায় না।

পুরো বিকেল জুড়ে আব্রাহাম ছাদের চিলেকোঠা ঘরের জানালা দিয়ে বাহিরে আর্মিদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করেছে। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো কোনো আর্মির মতিগতিই সে ঠিক ঠাওর করতে পারে নি। এদের যেনো হোস্টেজদের জীবন নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। না আছে আতঙ্কবাদীদের মারার কোনো তাড়া। সবটা পরখ করে অডিটোরিয়ামের দিকে পা বাড়ায় সে।

অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করে সঙ্গে সঙ্গেই তার চোখ গেলো রুমের এককোণে। মুহুর্তেই তার ভ্রু কুচকে গেলো। উক্ত কোণের মেঝেটা খালি দেখেই সে সঙ্গে সঙ্গে রুমে উপস্থিত সকল মেয়ের মুখপানে চায়। এতো এতো মুখের ভীড়ে ভীত দূর্বল মেয়েটার মুখ না দেখে সে আগ্রহী গলায় অডিটোরিয়ামে উপস্থিত একজন আতঙ্কবাদীকে প্রশ্ন করে,

“ এই কোণায় যেই সেন্সলেস মেয়েটা ছিলো ও কোথায়? “

উক্ত আতঙ্কবাদীর মুখের কোণে বিশ্রী হাসি ফুটে উঠে। সে বেশ রসালো গলায় বলে,

“ মুবিনের খিদা লাগসিলো খুব। টসটসে মাল দেইখা আর লোভ সামলাইতে পারে নাই। খাইতে নিয়ে গেসে। “

আব্রাহাম রাগে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়। এক প্রহর! কেবল এক প্রহরের জন্য একা রেখে গিয়েছিলো, আর এই সুযোগটাই লুফে নিয়েছে মুবিন। আব্রাহাম লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে প্রশ্ন করে,

“ কোথায় নিয়ে গিয়েছে? “

প্রশ্নটা করলেও আর উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়ায় না আব্রাহাম। রাইফেল হাতে দ্রুত কদমে বেরিয়ে যায়। তাদের মধ্যের কথাপোকথন শুনতে পায় অডিটোরিয়ামে উপস্থিত বাকি মেয়েরা। তাদের মধ্যে কিছু মেয়ে এরকম কথা শুনে ভয়ে তটস্থ হয়ে উঠে। তারমানে লোকগুলো শুধু খুনি নয় বরং মেয়ে খেকোও। কিছু মেয়ে যখন নিজ সম্ভ্রমের চিন্তায় ব্যস্ত তখন বাকি মেয়েরা মনে মনে খুশি হয়। রুহী নামক ওই মেয়ের সাথে এমনটাই হওয়া উচিত। একজন আতঙ্কবাদীর সাহায্যকারীর সাথে এরকম ঘটনায় তারা মোটেও চিন্তিত নয়।

__________

কলেজ ভবনের ভিতরের সম্পূর্ণ দো তলাটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও রুহী কিংবা মুবিনকে না পেয়ে আব্রাহাম দ্রুত তৃতীয় তলায় যায়। তখনই তার কানে ভেসে আসে তৃতীয় তলার করিডোরের শেষ মাথায় অবস্থিত ক্লাসরুম হতে ক্ষীণ মেয়েলি কান্নার সুর। আব্রাহাম দ্রুত পায়ে দৌড়ে সেই ক্লাস রুমের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু ভিতরে প্রবেশের সুযোগ নেই। দরজাটা ভেতর থেকে লক করা। আব্রাহাম ক্লাসরুমের জানালার থাই গ্লাস দিয়ে ভিতরে তাকাতেই তার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। সে চিৎকার করে মুবিনের নাম ধরে ডাকে। মুবিনের কানে সেই ডাক পৌঁছায় না।

আব্রাহাম একটা লম্বা নিঃশ্বাস টেনে দরজার সামনে গিয়ে জোরালো পায়ে লাত্থি বসায়। একবার, দু’বার, তিনবার। পরপর কয়েকটা লাথি দরজায় পড়তেই বিশাল কাঠের দরজার ছিটকানি ভেঙে খুলে পড়ে। খুলে যায় দরজা। মুবিন উঠে দাঁড়াবে তার পূর্বেই তার ঘাড়ের কাছে শক্তপোক্ত একটা হাতের থাবা পড়ে। এক টানে তাকে সোজা করে দাঁড় করিয়েই আব্রাহাম এলোপাথাড়ি ঘুষি মারতে শুরু করে। অকথ্য ভাষায় গালি দিতে দিতে বলে উঠে,

“ শুয়োরের বাচ্চা! তোরে এই জায়গায় ফষ্টিনষ্টি করতে নিয়ে আসছি? মাইয়া মানুষ দেখলেই লোভ সামলাইতে পারোস না? শালা খা*কির পোলা। কই হাত দিসোস তুই? তোর এতো বড় কলিজা হয়ে গেসে? “

কথাটা বলেই মুবিনের নাক বরাবর আরো দু তিনটা ঘুষি বসায় আব্রাহাম। আচমকা আঘাতে মুবিন প্রথমে নিজেকে সামলাতে না পারলেও এই পর্যায়ে এসে সে-ও আর চুপ থাকে না। বরং আব্রাহামকে প্রতিরোধ করতে তার পেট বরাবর ঘুষি মারে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,

“ তোর এতো দরদ কেন এই মাগীর জন্য? পিরিত উথলায় পড়তেসে? মায়ায় পড়সোস? “

মুবিনের প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় না আব্রাহাম। সে আপাতত নিজের মধ্যে নেই। অতি রাগে সবসময় তার শরীর কাপে। এখনো তাই হচ্ছে। কিন্তু সেদিকে তোয়াক্কা করে না আব্রাহাম। হুশ জ্ঞান খুইয়ে সে ঘাত প্রতিঘাতের খেলায় মত্ত হয়। দু’জনের সাপে নেউলে মারামারির মাঝেই ক্লাস রুমের একটা টেবিলের নিচ হতে কান্না দমানোর জন্য নাক টানার শব্দ শোনা যায়। মুহুর্তেই আব্রাহামের দৃষ্টি স্থির হয় সেই পানে। ভীত রুহী হাঁটুতে মুখ গুজে গা কাপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করছে। একদিনে পরপর এতগুলো ঘটনা ওকে ট্রমাটাইজড করে তুলেছে। প্রতারণা, চোখের সামনে খুন হতে দেখা এবং সব শেষে মলেস্টিং এর শিকার হওয়া। আজকের মতো আর কি বাকি আছে তার জীবনে ঘটার?

আব্রাহাম একপলক রুহীর অবয়ব দেখে। অত:পর মুবিনের ডানহাতের মুঠোয় পেচানো রুহীর ইউনিফর্মের উপরের ক্রসবেল্টটা টেনে নিজের হাতে নিয়ে তা দ্বারা মুবিনের গলা পেচিয়ে ধরে। চোখের পলকেই মুবিনের নড়াচড়া করার সব পথ বন্ধ করে দিয়ে নিজের পাশের চেয়ারের দিকে তাকায় সে। চেয়ারটার উপর একটা পিস্তল, একটা চাপাতি ও মুবিনের গায়ের শার্টটা রাখা। আব্রাহাম অতি শান্ত ভঙ্গিতে একহাতে চাপাতিটা তুলে নেয়। তা দেখে মুবিন চিৎকার করে উঠে। কিন্তু সেই চিৎকার দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তার পূর্বেই আব্রাহাম নিজের হাতের চাপাতি মুবিনের গলায় চালায়। অদ্ভুৎ গড়গড় শব্দে রুহী কান্না চাপিয়ে সামান্য মাথা তুলে তাকাতেই তার সম্পূর্ণ শরীর গুলিয়ে উঠে। আরো একটা খুনের সাক্ষী হয় সে। এইবারের খুনটা আরো বেশি ভয়াবহ।

আব্রাহামকে দেখতে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় লাগছে। তার মুখভাব দেখে রুহীর তাকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে। যেই মুখের সরল হাসি দেখে রুহীর কিশোরী মনে প্রেমের তুফান উঠতো আজ সেই মুখ দেখেই রুহীর ভয় হচ্ছে। আব্রাহামের হাত সম্পূর্ণ রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। রুহীর মস্তিষ্কে সূক্ষ্ণ চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। সে ফের মাথা হাঁটুতে গুজে আরেকটু ভিতরের দিকে চেপে বসে।

মুবিনকে সম্পূর্ণ শেষ করেই শান্ত হয় আব্রাহাম। তাজা রক্তে সম্পূর্ণ ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে। আব্রাহাম অতি শান্ত ভঙ্গিতে হাতের চাপাতিটা রেখে চেয়ারের উপর থাকা মুবিনের শার্টে নিজের হাতের রক্ত যতটুকু সম্ভব মুছে নেয়। দু দন্ড অপেক্ষা করে বুক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যায় দূরে টেবিলের নিচে বসে থাকা ভীত তন্ত্র রুহীর কাছে। কোনো ভনিতা না করে রুহীর ডান হাতের কব্জি ধরে একটানে তাকে টেনে টেবিলের নিচ থেকে বের করে আনে। রুহী চোখ খিচে বন্ধ করে রেখে অস্ফুটে উচ্চারণ করে,

“ লাশ… আমি তাকাবো না। “

আব্রাহাম তাকিয়ে দেখছে রুহীকে। মেয়েটা নিজের মাঝে নেই আপাতত। আব্রাহাম অতি নীরবে নিজের গায়ের কালো টি শার্টের উপর পরিহিত কালো জ্যাকেটটা খুলে রুহীর কাধে চাপিয়ে দিয়ে তার হাত চেপে ধরে শান্ত গলায় বলে,

“ চলো। “

__________

তাজা রক্তের গন্ধ হতে দূরে আসতেই আব্রাহাম বলে উঠে,

“ চোখ খুলো। “

রুহী জোরে জোরে মাথা ঝাকিয়ে না বলে। সে চোখ মেলে তাকাবে না। কোনমতেই তাকাবে না। আব্রাহাম এবার ধমকে উঠে,

“ চোখ খুলতে বলেছি রুহী। “

আব্রাহামের ধমকে রুহী আবার কেদে ফেলে বললো,

“ সব দুঃস্বপ্ন নয় কেন? “

“ আমার দিকে তাকাও রুহী। তাকিয়ে দেখো এখানে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। “

রুহী এবার চোখ মেলে তাকায়। অশ্রু জর্জরিত চোখ মেলে দেখে চারিদিকটা। আসলেই এই ক্লাস রুমে এখন সে আর আব্রাহাম ব্যতীত কেউ নেই। এই বিষাক্ত পরিবেশ আর সহ্য হচ্ছে না রুহীর। এই ট্রমার ভার বয়ে বেড়ানো সম্ভব নয় তার পক্ষে। সে হাঁটু ভেঙে আব্রাহামের সামনে বসে আকুতি করে,

“ মেরে ফেলবে আমাকে? মেরে ফেলো প্লিজ। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। “

রুহীর আকুতি আব্রাহামের মন ছুঁতে পেরেছে কিনা তা বুঝা গেলো না। আব্রাহাম কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই আচমকা সম্পূর্ণ ভবন অন্ধকারে তলিয়ে গেলো। দো তলা থেকে ভেসে এলো একঝাঁক মেয়ের চেঁচামেচির আওয়াজ। আচমকা ঘটনা ঠাওর করতে আব্রাহামের মিনিট খানেক সময় লাগে। কিন্তু বুঝতে পেরেই সে সাথে সাথে নিজের পকেট থেকে রিভলবার বের করে ডানহাতে শক্ত করে ধরে। অপর হাতে রুহীর হাত আঁকড়ে ধরে তাড়া দিয়ে বলে,

“ উঠো তাড়াতাড়ি। “

রুহী কিছু বললো কিনা সেদিকে আর খেয়াল নেই আব্রাহামের। সে শক্ত হাতে রুহীকে টেনে অন্ধকারের মধ্যেই বেরিয়ে আসে দ্রুত পায়ে। তিন তলা হতে দো তলায় নামার পথে বার কয়েক রুহী পড়ে যেতে নিলেও আব্রাহামের শক্ত বাধনের জোরে আর পড়ে নি।

দো তলায় নামতেই মেয়েগুলোর চেঁচামেচি আরো স্পষ্ট শোনা গেলো। সেই সঙ্গে শোনা গেলো এলোমেলো গুলি বর্ষণের শব্দ। আব্রাহাম করিডোরের মাথায় দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠে,

“ একটাও যেনো না বাঁচে। “

কথাটুকু শেষ করেই সে দ্রুত রুহীর হাত ধরে নেমে আসে গ্রাউন্ড ফ্লোরে। ফ্রন্ট গেটের দিকে না গিয়ে পিছনের ব্যাক গেটের দিকে পা বাড়াতে নিলেই আব্রাহাম অনুধাবন করে সেই দরজা দিয়ে কেউ প্রবেশের চেষ্টা করছে। নিশ্চয়ই এই বাংলার সৈনিকেরা! আব্রাহাম রুহীর হাত ধরে দ্রুত অন্যদিকে পা বাড়ায়। একাউন্টস রুমের ভেতর প্রবেশ করতেই সে কোনো কথা না বলে রুহীর হাত ছেড়ে দেয়। দ্রুত পকেট থেকে একটা টর্চ লাইট বের করে সেটার আলো দিয়ে দরজার সামনে সেট করা বোমের চাবি ফেরত জায়গা মতো রাখে। অতি সাবধানে কাজটুকু শেষ করেই সে উঠে রুহীর হাত ধরে দরজা খুলে তাকে বাহিরে ঠেলে দিয়ে বলে উঠে,

“ পিছনে ফিরে তাকাবে না। যাও। “

রুহী নিজের গায়ে জড়ানো জ্যাকেটটা শক্ত করে চেপে ধরে বাকহারা হয়ে আব্রাহামের পানে তাকিয়ে আছে। ভবনের এই পূর্ব পাশটায় সাধারণত কখনো কারো আনাগোনা দেখা যায় না। আজও ঠিক তাই। তবে যেকোনো মুহুর্তে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এদিকটায় পৌঁছে যাবে। রুহীকে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আব্রাহাম ধমকে বলে,

“ যাচ্ছো না কেনো? “

রুহী কোনো জবাব দেয় না। সে একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে আব্রাহাম সিদ্ধান্ত নেয় সে নিজেই এই মেয়ের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিবে। ভাবনা অনুযায়ী কাজ করতে গিয়েও আব্রাহামের হাত থেমে যায়। সরাসরি চোখ তুলে রুহীর দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলে,

“ আমি তোমাকে ভালোবাসিনি। কখনোই না। তোমার জীবন ভিক্ষা দেওয়ার পিছনে একটাই কারণ। আমি ঋণী থাকতে চাই না তোমার কাছে। “

কঠিন কথাগুলো উচ্চারণ করে এক মুহুর্তও অপেক্ষা করে না আব্রাহাম। তড়িৎ গতিতে রুহীর মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দেয়। দরজার বাহিরে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা রুহী দিন দুনিয়া ভুলে বসলো। তার কানের কাছে কেবল বাজতে থাকলো আব্রাহামের বলা কথাগুলো। এতটা সহজ? প্রতারণা আর ভালোবাসার দ্বন্দ্বে রুহী চিৎকার করে উঠে,

“ তুমি মিথ্যা বলছো। তাই না? কখনো ভালোবাসো নি? এক মুহুর্তের জন্যও না? “

দরজার অপরপ্রান্তে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আব্রাহামের তরফ থেকে কোনো প্রতুত্তর আসে না। সে নীরব রয়। রুহী ফের চিৎকার করে,

“ তোমার পরিণতি কি হবে? “

রুহীর এই প্রশ্নের পিঠে এবার আব্রাহাম সোজা হয়ে দাঁড়ায়। এই মেয়ে এরকম পরিস্থিতিতেও তার পরিণতির কথা ভাবছে? আব্রাহাম মনে মনে শুধায়,

“ বোকা রুহী। দুনিয়া তোমাকে লানত দিবে। এই দেশ তোমাকে ধিক্কার জানাবে। আমার নাম মুখেও আনলে তুমি কলঙ্কিত হবে। অথচ তুমি সেধে কলঙ্ক কুড়াচ্ছো। “

__________

দরজার সামনে থাকা বোম গুলোকে ডিফিউজ করে স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা ভিতরে প্রবেশ করতেই মেজর দূর্জয় চোখ এবং হাতের ইশারায় অর্ডার দেয় তার টিমের সাত জনকে দো তলায় যেতে এবং ব্যাক আপ টিমের সদস্যদের আদেশ দেয় ভবনের বাকি ফ্লোর গুলোয় অভিযান চালিয়ে কোনো আতঙ্কবাদী পেলে যেনো তাদের জীবিত আটক করা হয়। মেজরের আদেশ পেতেই
লেফটেন্যান্টরা অর্ডার অনুযায়ী উপরের দিকে চলে যায়। দূর্জয় নিজের হাতের রাইফেলটা সু কৌশলে ধরে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় গ্রাউন্ড ফ্লোরের করিডোরের দিকে। তার মাথায় পরিহিত সামরিক বাহিনীর ক্যাপের উপর সেট করা টর্চের আলোয় অন্ধকার কিছুটা ঘুচেছে বৈকি। সেই আলোয় এক পা দু পা করে সতর্ক দৃষ্টি মেলে এগিয়ে যাচ্ছে দূর্জয়।

__________

হেডকোয়ার্টারের মিটিং রুমে উপস্থিত লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবা হ্যান্ডসেট ট্রান্সিভারের মাধ্যমে নিজের সৈন্যদের সঙ্গে কানেক্টেড থেকে সকল আপডেট নিতে ব্যস্ত। ঠিক সেই মুহুর্তে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা একজন সৈনিক মৃদু চেচিয়ে ডাকে,

“ স্যার! স্যার একটা ওয়েবসাইট থেকে একজন আতঙ্কবাদীর ফেস রিভিল করা হয়েছে। “

কথাটুকু শুনতেই জুলফিকার দ্রুত পায়ে সেই কম্পিউটার টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই সে দেখে জঙ্গি সংগঠনের একটা অফিশিয়াল ওয়েবসাইট হতে একজন আতঙ্কবাদীর মাস্ক বিহীন ছবি দেওয়া হয়েছে। জুলফিকার দু দন্ড বড় বড় চোখ মেলে সেই ছবির পানে তাকিয়ে রয়। তার বিশ্বাস হচ্ছে না স্ক্রিনের এই দৃশ্য। সে দ্রুত ট্রান্সিভারে দূর্জয়ের সঙ্গে কানেকটেড হয়ে শুধায়,

“ মেজর দূর্জয়! ক্যান ইউ হেয়ার মি? “

দূর্জয় সবে তখন এক এক করে সবগুলো রুম চেক করছিলো। কিন্তু জুলফিকারের চিন্তিত স্বরের বিপরীতে সে ১০৫ নম্বর রুমের দরজা খুলতে খুলতে জবাব দেয়,

“ ইয়েস স্যার। “

“ একজন আতঙ্কবাদীর ফেস রিভিল করে ওয়েবসাইটে আপলোড দেওয়া হয়েছে এইমাত্র। ছবিটা… “

জুলফিকারের আর কোনো কথা পৌঁছায় না দূর্জয়ের কানে। খোলা দরজার ভেতর নির্মোচিত রুমের আঁধারে উপস্থিত ছেলেটাকে দেখে তার নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়। সে আর এক পা-ও আগানোর সাহস পায় না। অস্ফুটে উচ্চারণ করে,

“ দীপ্ত! “

টর্চের আলোয় স্পষ্ট সেই মুখশ্রীর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে মৃদু হাসি। সে ম্লান হেসে বলে,

“ ভাইয়া। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here