এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ২৯.

0
201

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৯.

[ এই উপন্যাসটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এটাতে দৃশ্যমান কোনো ঘটনার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। তবে হ্যাঁ গল্পের প্রয়োজনে বর্তমান পৃথিবীর করুণ অবস্থা আমি কিছু জায়গায় তুলে ধরেছি। আর আজকের পর্বে কিছু স্ল্যাং ওয়ার্ডস ইউজ করেছি। সেটা মাথায় রেখে পড়বেন। ]

নিজের ম্যানেজারের সঙ্গে ব্যবসার হিসেব নিয়ে আলাপনে ব্যস্ত ছিলো শমসের মজুমদার। সেখানে সকাল সকাল মানিকের আগমন হওয়ায় তিনি আলাপ থামায়। ম্যানেজারকে বিদায় করে দিয়ে মানিকের উজ্জ্বল মুখপানে চেয়ে হেসে প্রশ্ন করে,

“ কোনো গুড নিউজ মানিক? “

মানিক হেসে মাথা নাড়ে। পকেট থেকে নিজের ফোন বের করে। অত:পর ফোনটা শমসের মজুমদারের দিকে বাড়িয়ে দেয়। শমসের মজুমদার আগ্রহ নিয়ে ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখেও হাসি ফুটে উঠে। কৌতুক মিশ্রিত গলায় প্রশ্ন করে,

“ সাথের মালটা কে? “

“ মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবার অতি নিকটবর্তী লোক। জুলফিকারকে ফলো করতে করতে আমি মেজর পর্যন্ত পৌঁছেছি। “

শমসের মজুমদার এবার কিছুটা সিরিয়াস মুখ করে বলে,

“ খালি হাতে ফিরে এলে কেনো তবে? “

“ স্যার জায়গাটা খুব সিকিউরড। গতকাল সারারাত আমি ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে মশার কামড় খেয়ে ওখানকার গতিবিধি বুঝার চেষ্টা করেছি। “

“ তা গতিবিধি বুঝতে পেরেছো? “

“ জি স্যার। “

“ তাহলে আর দেরি কেনো? “

শমসেরের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরেই মানিক হাসে।

__________

আজ সকালের নাস্তাটা ঘরে মেয়ের সঙ্গে সেড়েই বেরিয়েছেন জুলফিকার মুজতবা। তিনি নিজেও খুব করে উপলব্ধি করছেন যে নিশাকে তিনি ঠিকঠাক সময় দিতে পারছেন না। মেয়েটা কেমন মনমরা হয়ে থাকে সারাদিন। প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছাড়া সেধে তেমন একটা কথা বলে না। জুলফিকার খুব ভালো করেই বুঝতে পারে নিশার তার সঙ্গে কথা বলতে জড়তা কাজ করে। কিন্তু এই জড়তা ভাঙার উপায় জুলফিকারের জানা নেই। নিজের মেয়েকে জুলফিকার খুব ভালোবাসে। কিন্তু তা প্রকাশ করতে জানে না সে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায় জুলফিকার। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় নাঈমাকে বাসায় আসতে বলবে। নিশা হয়তো মা’কে পেলে খুশি হবে। আর তাছাড়াও জুলফিকারের উদ্দেশ্য মা মেয়েকে আলাদা করা ছিলো না কখনো।

ফোনের রিংটোনের আওয়াজে জুলফিকার ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে। স্ক্রিনে ভেসে উঠা নামটা দেখতেই সে দ্রুত কলটা রিসিভ করে। সালাম দিয়ে শুধায়,

“ কেমন আছেন ভাবী? “

“ আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন ভাইয়া? নিশার এখন কি অবস্থা? “

“ আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি। নিশার ফিজিওথেরাপি চলছে। ধীরে ধীরে হাঁটার চেষ্টা করছে। “

“ যাক আলহামদুলিল্লাহ। ইনশাআল্লাহ নিশা দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে। “

ফোনের এপাশ থেকে জুলফিকার কেবল মৃদু হাসে। নীরবতা ভেঙে সেই নারী বলে উঠে,

“ ভাইয়া আসলে আমি দূর্জয়কে কল করছিলাম। কিন্তু ওকে ফোনে পাচ্ছি না। ও কোথায়? ভালো আছে তো? “

প্রশ্নটা শুনতেই জুলফিকার বুঝতে পারে দূর্জয় ইচ্ছে করেই সুহালা বেগমের কল রিসিভ করছে না। দীপ্তর মৃত্যুর পর থেকে ছেলেটা আরো গিল্টে ভুগছে। নিজের মা’র কাছ থেকে ভাইয়ের সত্যিটা লুকানোর গিল্ট ফিলিংস ছেলেটাকে খুব পোড়াচ্ছে। জুলফিকার সত্যটা ঢাকা দেওয়ার জন্য অযুহাত দেখিয়ে বলে,

“ ভালো আছে ভাবী। কাজের চাপে একটু ব্যস্ততায় দিন কাটছে ওর। “

ফোনের অপরপাশ হতে দূর্জয়ের মা সুহালা বেগম এবার সামান্য ইতস্তত করে বলে,

“ ভাইয়া, দূর্জয় আজ প্রায় সাত মাস ধরে বাড়ি ফিরছে না। ওকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিলো। আমি ভাবছিলাম চট্টগ্রাম এসে ক’টা দিন থেকে যাবো। “

জুলফিকার মুজতবা সঙ্গে সঙ্গে বিষম খায়। তার মনে পড়ে যায় গতকাল মাত্র দূর্জয় তাকে জানিয়েছে যে তার পরিচিত এক ক্লাসমেট খুব বড় এক বিপদে পড়েছে। তাকে আপাতত সে নিজের বাবার চট্টগ্রামের বাড়িটাতে রেখেছে। তাকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্যই সে সেদিন জুলফিকারকে বলেছিলো হসপিটালের সিসিটিভি ফুটেজ ডিলিট করার ব্যবস্থা করতে। এমন অবস্থায় যদি সুহালা বেগম চট্টগ্রামে আসেন তবে সিচুয়েশন আরো কম্পলিকেটেড হয়ে দাঁড়াবে। জুলফিকার সুহালা বেগমকে একটা বুঝ দিয়ে বলেন,

“ ভাবী এখানে আপনার নিজস্ব বাড়ি আছে। আপনি চাইলে যখন খুশি তখন আসতে পারেন। কিন্তু সত্যি বলতে এই মুহুর্তে আসলে দূর্জয় আপনাকে একদমই সময় দিতে পারবে না। খুব ব্যস্ততায় সময় কাটছে ওর। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই ও কিছুটা ফ্রি হবে। তখন না-হয় আপনি এসে ওর কাছে থেকে গেলেন অনেকদিন। দূর্জয়ও তখন আপনাকে সময় দিতে পারবে। “

জুলফিকার মুজতবার বুঝ পেয়ে সুহালা বেগম তা মেনে নেন। তিনি হেসে বলেন,

“ আচ্ছা তা-ই নাহয় হবে। “

“ আপনি দূর্জয়কে নিয়ে একদমই দুঃশ্চিন্তা করবেন না ভাবী। “

“ আপনি ওকে আগলে রেখেছেন দেখেই আমি কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকতে পারি ভাইয়া। ও ছাড়া আর আমার আছে কে বলুন? “

__________

চট্টগ্রামের সুনামধন্য এক গার্লস কলেজে ঘটিত টেরোরিস্ট অ্যাটাকে আটকৃত টেরোরিস্ট গুলো আজ এক সপ্তাহর বেশি সময় ধরে সেনাদের সেলে আটক অবস্থায় রয়েছে। এই দিনগুলোয় সৈন্যরা কম টর্চার চালায় নি জানোয়ারগুলোর উপর। কিন্তু এরা লোহার তৈরী। মরবে তবুও মুখ খুলবে না। প্রত্যেকের চেহারার নকশা বদলে গিয়েছে মার খেতে খেতে। তবুও এদের মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। কোনো ধরনের ইমোশনাল ব্লেকমেইলিং পর্যন্ত এদের ছুঁতে পারে না। জানোয়ার গুলো পৃথিবীর সকল কিছুর প্রতি মায়া ত্যাগ করেছে।

সাদাত নিষ্প্রভ দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে আছে একটা সেলের বাহিরে। তার দৃষ্টি স্থির সেলের দরজার মধ্যে ছোট্ট ফাঁক গলে ভিতরের অন্ধকার কুটিরে। এই সেলটার ভিতরে সেই টেরোরিস্ট গুলোকে রাখা হয়েছে। আজ ক’দিন ধরে এদের খাবার দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। যেনো ক্ষুধার তাড়নায় হলেও এরা মুখ খুলে। কিন্তু এরা মাটি কামড়ে পড়ে আছে। তবুও মুখ খুলছে না। আজ এদেরকে এক নতুন ধরনের থেরাপি দেওয়া হবে। শালারা যতক্ষণ না মুখ খুলবে ততক্ষণ এদের ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে আদর আপ্যায়ন অব্যাহত থাকবে।

সাদাত হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নেয় সময়টা। সকাল সাতটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। রাফি, প্রত্যয়, রিদওয়ানদের যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে প্রায়। সাদাত আর দাঁড়িয়ে না থেকে সেখান থেকে প্রস্থান করে। এই মুহুর্তে বন্ধুদের বিদায় জানানো তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

___________

সামরিক বাহিনীর ইউনিফর্ম পরিহিত রাফি, প্রত্যয় এবং রিদওয়ান সম্পূর্ণ তৈরী যাওয়ার জন্য। সাইফ, সাদাত, জুনায়েদ, ফারদিনের থেকে বিদায় নেয় তারা হাস্যজ্বল মুখে। অত:পর মুখোমুখি হয় মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়ের। তারা যখন মেজরকে স্যালুট করতে প্রস্তুত তখন তাদের অবাক করে দিয়ে দূর্জয় নিজের দু-হাত মেলে দেয় আলিঙ্গনের জন্য। উপস্থিত সকলেই বেশ অবাক হয় তাতে। তবে প্রত্যয় দ্রুত বিস্ময় কাটিয়ে দূর্জয়ের আলিঙ্গন গ্রহণ করে। জুনিয়রকে বুকে জড়িয়ে ধরে দূর্জয় তার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ ভুলে যেও না, যেই প্রমাণই পাও না কেনো, তা সবার আগে জুলফিকার স্যার অথবা আমাকে জানাবে। “

এক এক করে বাকি দু’জনকে আলিঙ্গন করেও দূর্জয় একই কথা বলে। প্রত্যয়, রাফি এবং রিদওয়ান ভালো করেই জানে মেজর এরকম একটা কথা কেনো বলেছে। তাদের কাছে অর্ডার আছে যেনো সকল আপডেট সবার আগে কর্নেল জুবায়ের শিকদারের কাছে পৌঁছানো হয়। কিন্তু এই লোকটা খুব একটা পছন্দের না তাদের। ঠিক পছন্দ না বললে ভুল হবে, তাদের কাছে লোকটার ব্যবহার অবিশ্বাসযোগ্য ঠেকে। একজন সৈন্যের কাছে তার ফার্স্ট প্রায়োরিটি নিজের দেশের সুরক্ষা। সেই সুরক্ষার খাতিরে এমন দু একটা অর্ডারের থোড়াই কেয়ার করলে কোনো ক্ষতি নেই তারা মনে করে।

বিদায়ের পালা শেষ হতেই সৈন্যরা প্রাথমিক ভাবে সামরিক হেলিকপ্টারে চড়ে বসে। তারা আগে এখান থেকে ঢাকায় যাবে। সেখান থেকে বাকিদের সঙ্গে একসাথে ফিলিস্তিনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে তারা। হেলিকপ্টার ধীরে ধীরে ভূমি ছেড়ে আকাশপথে ঊর্ধ্বগমণ শুরু করতেই তিনজন আরো একবার জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকায়। দেখে নেয় পরিচিত মুখগুলো। কে জানে এটাই যদি কারো শেষ যাত্রা হয়?

__________

বিকেলের এই সময়টা মূলত শিফট চেঞ্চিং এর সময়। সারাদিন অন্য দু’জন দূর্জয়ের বাড়ির বাহিরে নিরাপত্তা দিলেও বিকেলের এই সময়টায় শিফট চেঞ্জ করে ইলিয়াস কাঞ্চন এবং তার সঙ্গী ডিউটিতে আসে। ঠিক বিকেল থেকে সারারাত পর্যন্ত তারা বাণীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। ইলিয়াস এবং তার সঙ্গী সবে ডিউটিতে এসেছে।

তারা যখন উঠোন জুড়ে টহল দিতে ব্যস্ত তখন আচমকা ইলিয়াসের সঙ্গী আহসান বলে উঠে তার প্রকৃতির ডাক এসেছে। সে এখনই রাস্তার ওপাশের ঝোপ থেকে এক নাম্বার কাজ সেড়েই এসে পড়বে। ইলিয়াস বিরক্ত হলেও বলে দ্রুত আসতে। আহসান প্রস্থান করতেই ইলিয়াস একা একা চারিদিকে টহল দিতে থাকে। সময় পেরোয়। দশ মিনিট, বিশ মিনিট পেরিয়ে প্রায় ত্রিশ মিনিট হতেই ইলিয়াস বিরক্ত হয়। আহসানের একটা বদভ্যাস আছে। এটা সেটার উছিলায় দূরে গিয়ে সিগারেটে দু চারটে টান মারার। তাই এই ব্যাপারে খুব একটা মাথা ঘামায় না ইলিয়াস।

কিন্তু আচমকা উঠোন পেরিয়ে রাস্তার অপরপাশের ঝোপঝাড় হতে অদ্ভুৎ কিছু শব্দ ভেসে আসতেই ইলিয়াস সতর্ক হয়ে যায়। দ্রুত নিজের সিভিল পোশাকের পিছন হতে একটা পিস্তল বের করে হাতে নেয়। বাড়ির দরজার কাছে গিয়ে কলিংবেল চাপে দ্রুত। মিনিট পেরোতেই ভিতর থেকে বাণী অভ্যাসগত স্বরে প্রশ্ন করে,

“ কে? “

“ ম্যাডাম আমি। ইলিয়াস কাঞ্চন। আপনি দরজা ভালো করে লক করে বসুন। ভুলেও দরজা খুলবেন না। সম্ভব হলে দ্রুত দূর্জয় স্যারকে কল করুন। আই থিংক সামথিং ইজ ফিশি হেয়ার। “

অনর্গল বলা কথা গুলো কানে পৌঁছাতেই বাণী ভীত হয়ে পড়ে। সামথিং ইজ ফিশি মানে? কি হয়েছে বাহিরে? হিরণ? ওর লোকেরা কি বাণীর সন্ধান পেয়ে গিয়েছে? ভাবনাটা বাণীর মাথায় উঁকি দিতেই সে তিরতির করে ঘামতে শুরু করে। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ইলিয়াস কাঞ্চনের কথা মতন দরজার দুটো ছিটকানিই ভালো করে আটকে দেয়। ডাইনিং টেবিলের কাছ থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে তা দিয়ে দরজায় ঠেক দেয়।

অত:পর দ্রুত গতকাল দূর্জয়ের দেওয়া ফোনটা থেকে দূর্জয়ের সেভ করা নাম্বারটা ডায়াল করে। একবার, দুবার, তিনবার করে পরপর ছয়বার কল দেয়। কিন্তু কলটা রিসিভ হয় না। বাণী ভীত হয়ে রয়। তার গলা শুকিয়ে চৌচির হয়ে আছে। আচমকা দরজায় জোরে করাঘাতের শব্দে তার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠে। এই করাঘাতের শব্দ বেশ হিংস্র ধরনের। বাণীর অন্তর আত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠে এক একটা দানবীয় হাতের করাঘাতের শব্দে। সে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে দৌড়ে যায়। কেবিনেট হাতড়ে একটা ধাঁরালো ছুরি হাতে নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দেয়। রুমের এককোণে মেঝেতে বসে রয় সে শক্ত করে ছুরি হাতে। অসহায় লাগছে তার খুব। হিরণ তাকে পেলে আস্ত রাখবে না। ম্যানিয়াকটার মাথা বিগড়ে আছে নিশ্চয়ই। বাণীকে ছিড়ে খাবে।

অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি মেলে বাণী হাতের ফোনের পানে চায়। কিছু একটা ভেবে দ্রুত দূর্জয়ের নাম্বারে একটা ম্যাসেজ সেন্ড করে। অত:পর ফোনটা দ্রুত সাইলেন্ট করে বিছানার নিচে লুকিয়ে ফেলে। সে খুব ভালো করেই টের পায় বাড়ির মেইন দরজাটা ভেঙে কিছু মানুষ বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেছে। কয়েক জোড়া পায়ের এগিয়ে আসার শব্দ বাণীর রক্ত হীম করে তুলে। তবুও সে হাতের ছুরিটা শক্ত করে ধরে রয়। সে চেষ্টা করবে। যতদূর সম্ভব বাঁচার চেষ্টা করবে।

__________

হিরণের পক্ষে বহ্নিকে সামলানো খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথম প্রথম এটা সেটা বলে মেয়েটাকে বুঝ দেওয়া যেতো। কিন্তু এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। এতোদিন হয়ে গিয়েছে অথচ বাণী এখনো কেনো ফিরছে না সেই প্রশ্ন করতে করতে বহ্নি হাপিয়ে উঠেছে। মেয়ের প্রশ্নের তাড়ায় হিরণের অন্তর্নিহিত ক্ষোভ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। সেই ক্ষোভ মেটাতে সে প্রায় প্রতিদিনই একটা না একটা খুন করে চলেছে। তবে এসব ব্যাপারে সে এখন খুব সতর্ক হয়েছে। ভুল করেও ঘরের ত্রী সীমানায় ভায়োলেন্স জাতীয় কিছু করে না। পাছে না আবার তার মেয়ে কিছু জেনে যায়!

হিরণের মনে হয় সে একদল গরুকে ঘাস খাইয়ে পালে। এরা জাবরকাটা ছাড়া আর কোনো কাজ পারে না। একটা মেয়ে মানুষ কি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে নাকি? তাকে খুঁজে পেতে এতো দেরি কেনো হবে নাহয়? হিরণের সব রাগ জমা হয়ে আছে বাণীকে সাহায্য করা সেই সাহায্যকারীর প্রতি। এই মানব সেবাকারীকে খুঁজে পেলে হিরণ সোজা তার গলায় নিজের সংগ্রহের সবথেকে ধাঁরালো চাপাতি চালাবে। অসভ্য কুকুরটার গলার সবগুলো রগ কেটে দিবে। গলাকাটা মুরগির মতো তড়পাতে তড়পাতে যখন তার আত্মা দেহ ত্যাগ করবে তখন হিরণ তৃপ্তির ঢেকুর তুলবে।

সবে মাত্র বাসায় ফেরা হিরণ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে এসব ভাবনায় মশগুল ছিলো। সময়টা এখন তিনে সন্ধ্যা। বাড়ির সীমানার বাহিরে পরিবেশটা দেখতে কেমন ভুতুড়ে লাগছে। বাহিরের দুটো ল্যাম্পপোস্ট আজকে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফলস্বরূপ আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়ির সীমানার বাহিরটা। আচমকা ফোন শব্দ তুলে বেজে উঠতেই হিরণের ভাবনায় ভাটা পড়ে। সে ছাঁই রঙা প্যান্টের পকেট হতে ফোন বের করে। অসময়ে শমসের মজুমদারের কল পেয়ে বেশ বিরক্ত অনুভব করে। তবুও কলটা রিসিভ করে সে। ফোনের অপরপাশ হতে শমসের হেসে বলে উঠে,

“ হিরণ, শুনলাম তোমার খাঁচা থেকে নাকি পাখি উঁড়ে গিয়েছে? “

হিরণ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ তিনে সন্ধ্যা বেলা কি মদ্যপান করেছেন নাকি? কিসব আবোলতাবোল বকছেন? “

শমসের মজুমদার হিরণের কথায় খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। তিনি নিজের মতো বলে উঠে,

“ প্রথমে আমি ভেবেছিলাম পাখিটা খুব কুৎসিত দেখতে। কিন্তু এখন এই বাঙালি রূপে দেখে তো আমার মাথায় অন্য চিন্তা আসছে। এতো সুন্দর জিনিস তুমি আমার থেকে আড়াল করে রেখেছিলে? “

হিরণের আচমকা গলার স্বর পরিবর্তন হয়। সে সিরিয়াস গলায় প্রশ্ন করে,

“ যা বলার সরাসরি বলেন। “

“ তুমি নিজেই শুনে নাও। “

মুহুর্তেই ফোনের অপর পাশ থেকে ভেসে আসে এক নারী স্বরের চিৎকার। এই স্বর হিরণের খুব পরিচিত। সে সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেলে। অদ্ভুৎ ভঙ্গিতে নিঃশ্বাস ছাড়ে। শমসের মজুমদার নিজেই আবার বলে উঠে,

“ শুধুমাত্র জোর করে একটু কোলে বসিয়েছি। এতেই চিৎকার করে আমার কানের পর্দা ফাটিয়ে দিচ্ছে। তুমি তো ভালো করেই জানো আমার অযথা চিৎকার চেঁচামেচি করা পছন্দ না। এই পাখির সঙ্গে কি করা যায় বলো তো? “

হিরণ রাগ সংবরণ করতে পারে না। তেঁতে উঠে বলে,

“ কুত্তার বাচ্চা তোর হাত কেটে দিবো। কই হাত দেস তুই? “

আবারও ফোনের ওইপাশ থেকে চিৎকার ভেসে আসে। শমসের মজুমদার বেশ রসালো গলায় বলে,

“ এই নরম তুলতুলে শরীর এতোদিন একা ভোগ করেছো তুমি? একবারও এই বাপটার কথা মনে পড়ে নি? বাপকে অভুক্ত রেখে কিভাবে হজম করলে তুমি? “

হিরণ আবারও চিৎকার করে উঠে।

“ খা*কির বাচ্চা তুই মরবি। আমার হাতে মরবি। “

হিরণের চিৎকার এতো জোরে ছিলো যে তার রুমের দরজার কাছে বহ্নি এসে উপস্থিত হলো। কিন্তু পাপার এই ভয়ংকর রূপ আর অজস্র গালিগালাজ শুনে সে ভীত হয়ে পড়ে। ছোট বাচ্চাটা ভয়ে গুটিসুটি মেরে দরজার সঙ্গে লেপ্টে রয়। নিচ থেকে ইবাত এবং একজন হেল্পিং হ্যান্ডও দৌড়ে উঠে আসে হিরণের দরজার কাছে। হিরণের এই রূপ দেখে এবং বহ্নিকে দরজার কাছে দেখে ইবাত দ্রুত সেই হেল্পিং হ্যান্ডকে ইশারা করে বহ্নিকে এখান থেকে নিয়ে যেতে। হেল্পিং হ্যান্ড মহিলাটা একটা ঢোক গিলে বহ্নির হাত ধরে টেনে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করে। হিরণ তখনও গালিগালাজ করে শমসেরকে একের পর এক হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। ফোনের অপর পাশে থাকা শমসের তা শুনে হাসে। কুকুরের লেজে সে পা দিয়েছে। কুকুর তো ঘেউঘেউ করবেই। সে আর কোনো কথা না বলে ফট করে কলটা কেটে দেয়।

হিরণের মাথা বিগড়ে যায় মুহুর্তেই। রাগে সে লাথি মেরে সিঙ্গেল সোফাটা উল্টে ফেলে। অত:পর দ্রুত বেডসাইড কেবিনেট থেকে একটা রিভলবার বের করে প্যান্টের পিছন দিকে ভরে নেয়। গায়ের কোটটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে সে ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে যায়। ইবাত চিন্তিত গলায় জানতে চায় কি হয়েছে। হিরণ কেবল যাওয়ার আগে এইটুকু বলে,

“ শমসের খা*কির বাচ্চা বাণীকে খুঁজে পেয়েছে। আমি অর্ধেক গার্ড সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি বাসায় থাকো। বহ্নির দিকে খেয়াল রাখো। আমার মেয়েকে তোমার ভরসায় রেখে যাচ্ছি। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here