এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৩১.

0
200

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩১.

আচমকা আননোন এক নাম্বার হতে কল পেয়ে ভ্রু কুচকে রয় জামিল। তবুও কলটা রিসিভ করে ফোন কানে চেপে ধরতেই অপর পাশ হতে গম্ভীর তবে অশান্ত গলা বলে উঠে,

“ মেজর শাহরিয়ার দূর্জয় বলছি। এক্স্যাক্ট এক মিনিটের মধ্যে আমি গাড়ি নিয়ে বেরোবো। পথে কোনো চেকিং অথবা কোনো ধরনের বাঁধা চাইছি না। আই হ্যাভ টু বি সামহোয়্যার এজ ফাস্ট এজ পসিবল। সেই অনুযায়ী বেরোনোর পথে যেনো কোনো ব্যারিকেডের সম্মুখীন আমায় না হতে হয়। দায়িত্বটা আপনাকে সঁপে দিলাম। ক্লিয়ার মাই ওয়ে ইন দিজ ওয়ান মিনিট। “

কথাটুকু বলেই ফোনটা রেখে দেয় অপর পাশের ব্যক্তি। জামিল বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে চেয়ে রয় ফোনের পানে? মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়? যেই লোকটাকে প্রতিদিন জামিল বড়ো বড়ো চোখ মেলে এই হেডকোয়ার্টারে প্রবেশ করতে দেখে? রেড রুমে এই লোক বন্দীদের কাছে কিরূপ আতংক তা সম্পর্কে জামিল টুকটাক শুনেছে। আর তাতেই সে এই লোকটাকে জমের মতন ভয় পায়।

আচমকা ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে নিজের হাতের ঘড়ির কাঁটার পানে তাকায় জামিল। দূর্জয়ের বেঁধে দেওয়া এক মিনিট সময়ের মধ্যে কেবল চল্লিশ সেকেন্ড অবশিষ্ট রয়েছে। তৎক্ষণাৎ সে চেঁচিয়ে উঠে,

“ মেজর গাড়ি নিয়ে বের হবেন। ব্যারিকেড সরানোর অর্ডার এসেছে। গেট ক্লিয়ার করো ফাস্ট! ত্রিশ সেকেন্ড হাতে সময় আছে। “

__________

শাঁ শাঁ শব্দ তুলে কালো রঙা জিপ গাড়িটা হেডকোয়ার্টার ছেড়ে বেরিয়ে আসে। যত এগোচ্ছে গাড়ির গতিও ততই ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। আবহাওয়ার অবস্থা নেহাৎই বাজে। অসময়ে ঝড় নামবে বুঝি। স্টিয়ারিংয়ে বলিষ্ঠ ডান হাতটা স্থির রেখে অপর হাতে তিনটা নাম্বার পরপর ডায়াল করে চলেছে দূর্জয়। কল হচ্ছে, তবে কেউ রিসিভ করছে না।

মনটা এতো কু গাইছে কেনো? ওই মেয়েটা ঠিক আছে তো? প্রশ্নটা মনে উঁকি দিতেই দূর্জয়ের চিন্তিত মুখশ্রী মলিন বর্ণ ধারণ করে। অবচেতন মন নীরব প্রার্থনা চেয়ে বসে,

“ ও যেনো সেফ থাকে। “

__________

মেঝেতে পড়ে রয়েছে একটি রক্তে মাংসে গড়া দেহ। সময়ের ব্যবধানে যা এখন লাশ হিসেবে বিবেচিত। জুলফিকার মুজতবা মুখ কালো করে চেয়ে রয়েছেন সেই লাশের পানে। সেল নং এ থ্রি তে কেমন ভুতুড়ে একটা পরিবেশ বিরাজ করছে। আজ সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু যে মোটেও স্বাভাবিক নয় তা এই সেলে উপস্থিত সকলেরই জানা। সাদাত থমথমে গলায় বলে উঠে,

“ কেউ একজন চায় না আমরা সফল হই। সেই কেউ টা আমাদের মধ্যেরই কেউ। “

জুলফিকার মুজতবা সাদাতের কথার সঙ্গে একমত। আজ সন্ধ্যার এই ঘটনা তাকে সম্পূর্ণ এলোমেলো করে দিয়েছে। মিটিং শেষ হতেই সাদাত আচমকা কল করে জানায় যে বন্দী টেরোরিস্টদের মধ্যে একজন এই টেরোরিস্ট অ্যাটাক জড়িত সকল তথ্য জানাতে রাজি হয়েছে। তবে শর্ত হলো সে কেবল জুলফিকারকেই এই ব্যাপারে জানাবে। জুলফিকার সঙ্গে সঙ্গে মিটিং ছেড়ে রওনা হয় সেল এ থ্রি য়ের উদ্দেশ্যে। তবে সেলে পৌঁছাতেই তিনি দেখে আঘাতে জর্জরিত আতঙ্কবাদীর দেহটা কেমন নিথর হয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে।

সাদাতের কাছে তিনি এর ব্যাখ্যা চাইলে সাদাত জানায় আননোন একটা নাম্বার থেকে কল আসায় সে কথা বলতে শুধু কিছু মুহুর্তের জন্য বাহিরে গিয়েছিলো। কিন্তু যখন কেউ রেসপন্স করছিলো না ফোনের অপরপাশ থেকে তখন সে ফোন কেটে ভেতরে চলে আসে। আর সঙ্গে সঙ্গে দেখে ছেলেটা আর নেই। এই ব্যাপারে সে দায়িত্বরত সবাইকে জিজ্ঞেস করার পর সবাই একই উত্তর দিয়েছে। কেউ কিছুই জানে না। একজন আশংকা করে বলেছিলো যে থেরাপির ডোজটা খুব সম্ভবত বেশি হয়ে গিয়েছিলো, তাই ছেলেটা পটল তুলেছে।

জুলফিকার চোখ তুলে সাইফ এবং সাদাতের পানে তাকায়। সত্যের এতো কাছে পৌঁছে তা না জানতে পারার আক্ষেপ দু’জনের মুখেই ফুটে আছে। জুলফিকার কেবল থমথমে গলায় বলে,

“ এই ব্যাপারে এখন কোনো রিয়েক্ট করার দরকার নেই। এমন ভাব ধরো যেনো সত্যিই ছেলেটা হাই ডোজ টর্চার সইতে না পেরেই মারা গিয়েছে। দূর্জয় আসুক। মিটিং হবে এই ব্যাপারে। এন্ড ওয়ান মোর থিং। ডোন্ট ট্রাস্ট এনিওয়ান এনিমোর। প্রতারক আমাদের মধ্যেই আছে। “

__________

দীর্ঘ পথটা গাড়ির তুমুল গতির দরুন অতী স্বল্প সময়েই পাড় করে এসেছে দূর্জয়। বাড়ির সীমানার কাছে আসতেই সে গাড়িটা ব্রেক কষে দ্রুত পায়ে শূন্য উঠোন পেরিয়ে দরজার কাছে পৌঁছায়। শক্ত কাঠের তৈরী দরজাটার উপর কেমন ঝড় গিয়েছে তা ভাঙা লকটা দেখেই স্পষ্ট আন্দাজ করা যাচ্ছে। দূর্জয়ের শরীর অজানা আশঙ্কায় ছমছমে অনুভব করে। বিদঘুটে আবহাওয়াকে পিছনে ফেলে সে ঘড়ের ভেতর পা রাখে। পুরো ঘরটা অন্ধকারে নিমজ্জিত। দূর্জয় হাত বাড়িয়ে লিভিং রুম এবং ডাইনিং রুমের লাইটটা জ্বালায়। সতর্ক দৃষ্টি মেলে চারিদিকটা পরখ করে। উঁহু। সব ঠিকঠাক আছে। ধুকপুক করতে থাকা বুক নিয়ে এবার দূর্জয় ধীর পায়ে বাণীর থাকার রুমটার দিকে পা বাড়ায়।

রুমের দরজার কাছে পা রাখতেই আকাশটা তীব্র গর্জন করে ঝিলিক দিয়ে দিনের আলোর মতো চারিদিকটা ফর্সা করে তুলে। সেই আলোটা রুমের জানালা ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করে রুমটা আলোকিত করে তুলে ক্ষনিকের জন্য। মুহুর্তেই রুমটা ফের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। সেই ক্ষনিক বজ্রপাতের মুহুর্তে রুমের যেই দশা দূর্জয়ের সামনে ভেসে উঠে তা দেখে তার রক্ত হিম হয়ে আসার কথা। কিন্তু সেরকম কিছু হয় না। বরং দূর্জয় রুমের লাইটটাও জ্বেলে দিয়ে ফের দেখে রুমটাকে। এলোমেলো বিছানার চাদর, ভাঙা আসবাবপত্র, মেঝেতে পড়ে থাকা ফল কাটার ছুরি এবং কয়েক বিন্দু তাজা রক্ত। যেনো কোনো ধ্বংসলীলা চলেছে এই রুমে।

পরিস্থিতি আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না দূর্জয়ের। তার দৃষ্টি স্থির মেঝেতে পড়ে থাকা ছুরি এবং রক্তের পানে। বাণী যে প্রতিরক্ষার চেষ্টা করেছিলো তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ এই ছুরিটা। কিন্তু ছুরিতে লেপ্টে থাকা এবং মেঝেতে পড়ে থাকা সেই বিন্দু বিন্দু রক্ত গুলো কার তা ঠিক জানা নেই দূর্জয়ের। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে মেঝেতে এক হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে দূর্জয়। এক বিন্দু রক্ত নিজের তর্জনী আঙুলের ডগায় তুলে সে-ই পানে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ কার রক্ত তুমি? বাণী তালুকদারের নাকি অজ্ঞাত কোনো জানোয়ারের? “

উপরে উপরে দূর্জয় যথেষ্ট ঠান্ডা স্বরে প্রশ্নটুকু উচ্চারণ করলেও ভেতর ভেতর তার হৃদযন্ত্র উন্মাদ আচরণ করছে। হিরণ নামক ওই কালটাকে কখনো দেখে নি দূর্জয়। তবুও লোকটার প্রতি এক বুক ঘৃণা মনে পুষে রেখেছে সে। কাপুরুষটা আবার বাণীর সঙ্গে কি করতে পারে সেই আশংকা ক্ষণে ক্ষণেই দূর্জয়কে নিস্তেজ করে তুলছে। সেই নিস্তেজ ভাবটা কিছু মুহুর্তের জন্য তার মস্তিষ্কেও হানা দেয়। তাইতো সে ভুলে বসে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা পয়েন্ট। কিন্তু হঠাৎ তা মনে পড়তেই সে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। ত্রস্ত পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে তাকায় বাড়ির পূর্ব পাশের দেয়ালাটার দিকে। সাদা দেয়ালটা আড়াল হয়ে আছে সাদা এবং গোলাপি বাগানবিলাসের বিস্তৃত ডাল পালার ফলে। সেই ডাল পালার মধ্যেই অতি সাবধানে এবং আড়ালে লুকায়িত আছে একটা সিসিটিভি ক্যামেরা যা এক সপ্তাহ পূর্বেই দূর্জয়ের আদেশে ইন্সটল করা হয়েছে। এই সিসিটিভি ক্যামেরাই এখন শেষ ভরসা। এর সাহায্যে হিরণ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হলেই কেবল বাণী মিলবে।

ভাবনাটুকু মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই আচমকা বাড়ির পেছন হতে কিছু শুকনো পাতার মড়মড়ে শব্দ ভেসে আসে। দূর্জয় সতর্ক হয়। কালো রঙের পিস্তলটা হাতে নিয়ে সাবধানের সহিত সে বাড়ির পিছন দিকে পৌঁছায়। কিন্তু মাটির উপর মাথা চেপে ইলিয়াসকে উঠে বসতে দেখেই সে ডাকে,

“ ইলিয়াস! “

আচমকা দূর্জয়ের কণ্ঠ শুনে ইলিয়াস বহু কষ্টে ভারী মাথা নিয়ে চোখ তুলে তাকায়। অত:পর অপরাধী গলায় বলে,

“ স্যার, আ’ম সরি। কিছু বুঝে উঠার আগেই কেউ পিছন থেকে জোরে মাথায় আঘাত করে। আর কিছু মনে নেই আমার। ম্যাম ঠিক আছেন? “

“ ও নেই। “

__________

ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি নেমেছে ধারাপটে। গাড়ির ফ্রন্ট সিটে নীরবে বসে থাকা বাণীর মাথা নত। বুকটা শঙ্কায় দুরুদুরু করছে। হিরণ তাকে বাড়িতে না নিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছে এই চিন্তাটা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এই অন্য কোথাওটা কোথায় তা বাণীর জানা নেই। তবে সে নিশ্চিত হিরণ এতো কিছুর পর বাণীকে আস্ত রাখবে না। এই মুহুর্তে বাসায় গেলে যে বহ্নি বাণীর বুকে লেপ্টে রবে তা হিরণ ভালো করেই জানে। তাই হয়তো নিজের খায়েশ মেটানোর জন্যই এই অন্য কোথাও এর আবির্ভাব। বহ্নি যেনো হিরণের আক্রোশের মাঝে বাধা না হতে পারে সেজন্য এই অভিনব পদ্ধতি।

দীর্ঘ হাইওয়ে এবং জঙ্গলের ন্যায় জায়গা পেরিয়ে একটা দো তলা বাসার সামনে এসে গাড়ি থামায় হিরণ। মূল শহর থেকে দূরে শুনসান নীরবতায় আচ্ছন্ন জায়গার মধ্যে এই বাড়িটি হিরণের ব্যক্তিগত প্রোপার্টির অংশ। বৃষ্টি হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য গাড়ির সামনে স্টোর বক্সের ভেতর একটা ছাতা সবসময় মজুদ থাকে। সেখান থেকে কালো রঙা ছাতাটা হাতে নিয়ে তা মেলে গাড়ি ছেড়ে নামে হিরণ। অপর পাশে গিয়ে নীরবে গাড়ির দরজা খুলে ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে রয়। অপেক্ষা করে বাণীর বেরিয়ে আসার।

বাণী সময় নেয়। মনকে বুঝ দেয় কেউ তাকে বাঁচাতে আসবে না। কোনো পথ খোলা নেই তার কাছে। আরো একবার হিরণের কাছে বন্দী সে। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বাণী ঝিম ধরা শরীরটাকে টেনে গাড়ি ছেড়ে নামে। হিরণের ধরে রাখা মাথার উপরের ছাতাটাকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে সে এলোমেলো পায়ে বাড়ির পথে হাঁটা ধরে। লম্বা শাড়ির আঁচলটা মাটিতে লুটিয়ে রয়েছে। বাণীর এমন বেখাপ্পা হাঁটার ধরণ দেখে হিরণ দ্রুত গাড়ির দরজা আটকে পায়ের গতি বাড়ায়। এগিয়ে গিয়ে শাড়ির আঁচলটা পিছন হতে নিজের হাতে তুলে নেয়। হাত বাড়িয়ে ছাতাটা আরেকটু মেলে বাণীর মাথার উপর ধরে। বাণী একটুও টু শব্দ করে না। নির্দিষ্ট ব্যসের ছাতাটা বাণীর উপর ধরার ফলস্বরূপ হিরণ বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পায় না। কাকভেজা হয়ে ঘরে প্রবেশ করে।

ঘরে পা রাখতেই বাণী অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে,

“ শাস্তির পালা তাই-না? শাস্তি হিসেবে আমাকে চাই তাই তো? কি করবো? উপরে যাবো নাকি এখানেই? বলুন। কৃতদাসীর জন্য আজ কি অপেক্ষা করছে জানতে আগ্রহী আমি। “

মলিন মুখের ঠান্ডা স্বরটা হিরণ নীরবে শুনে। অত:পর দরজা লক করে হাতের ভেজা ছাতাটা ফ্লোরের উপর রেখে বাণীর দিকে এগিয়ে যায়। বাণী নিশ্চল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়। হিরণ এসে কোনো কথা না বলে বাণীকে পাজাকোলে তুলে উপরের দিকে হাঁটা ধরে। বাণী বাধা দেয় না। ইঞ্জিন চালিত রোবটের ন্যায় নীরব রয়। উপরতলার তিনটি বেড রুমের কেবল একটাতেই প্রয়োজনীয় ফার্নিচার রয়েছে। সেই রুমটাতেই বাণীকে নিয়ে প্রবেশ করে হিরণ। বাণীকে বিছানায় নামিয়ে দরজাটা লক করে দেয়। অত:পর ভেজা কাপড়েই লেদারের সিঙ্গেল সোফাটায় গিয়ে বসে। দৃষ্টি তার বাণীর দিকে নিবদ্ধ।

বিছানার উপর পা তুলে হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছে দৃষ্টি নত করে রাখা দেহের মালিক। মলিন মুখটা তুলে এক মুহুর্তের জন্য তাকাচ্ছে না হিরণের পানে। হিরণ সেই আশা রাখেও না। নিজের উপর হিরণের স্থির দৃষ্টি না তাকিয়েও অনুভব করতে পারছে বাণী। আর যতবার এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করছে ততবারই সে শরীরটা আরো গুটিয়ে নিচ্ছে। সময় গড়ায়। বাণীও মাথা তুলে তাকায় না আর হিরণও নিজের দৃষ্টি ফেরায় না৷ এতক্ষণ ধরে বাণী পাথর বনে থাকলেও ধীরে ধীরে তার স্বত্বা নরম রূপ ধারণ করে। নিজের প্রতি আফসোসে তার বুক ফেটে কান্না পায়। সেই কান্না দমানোর চেষ্টায় সে নিজের ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাখে। কিন্তু তাতেও লাভ হয় না। উল্টো তাতে ঠোঁট জোড়া তার টলমল চোখের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মৃদু কেঁপে কেঁপে ওঠে। বিষন্ন অনুভূতি যখন সহ্য সীমার বাহিরে চলে যায় তখন দুঃখগুলো নোনাপানি হয়ে টপটপ করে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসে। অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি নত রেখেই বাণী অস্ফুটে বলে উঠে,

“ মেরে ফেলুন তবুও আমাকে আর ছুঁবেন না প্লিজ। “

হিরণ এতক্ষণ বাণীকে পরখ করতে করতে ঘোরে ডুব দিয়েছিলো। বাণীর কণ্ঠস্বর তার কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই সে বলে উঠে,

“ হু? “

বাণী একইভাবে দৃষ্টি নত রেখেই শব্দহীন কান্নার দমকে কম্পিত স্বরে বলে,

“ আই হেট মাইসেল্ফ বিকজ অফ ইউ। নিজেকে আপনার থেকে বাঁচাতে না পারার যন্ত্রণায় আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছে। দয়া করুন। ডোন্ট টাচ মি এগেইন। “

শেষের কথাটুকু বলার সময় বাণী ফুপিয়ে উঠে। হিরণ কিছু বলে না। নীরবে উঠে যায়। নিচ থেকে একটা কাঁচের গ্লাসভর্তি পানি এনে তা বাণীর দিকে এগিয়ে ধরতেই বাণী ক্ষুব্ধ হয়। তীব্র ঘৃণা ভরা ক্রোধে সে সেই গ্লাসটা হাতে নিয়ে সজোরে ছুড়ে মারে হিরণের দিকে। আক্রোশ মিশ্রিত স্বরে বলে,

“ দূরে থাকতে বলেছি না? “

আচমকা আক্রমণ সামলে উঠার জন্য হিরণ পাশ ফিরতে নিলেও শেষ রক্ষা হয় না। কাঁচের গ্লাসটা দ্বারা তীব্র বেগে চোখের একপাশে আঘাত লাগে। মুহুর্তেই হিরণের মস্তিষ্ক এক মুহুর্তের জন্য ব্ল্যাক আউট হয়। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসে। একহাতে চোখের পাশটা চেপে ধরতেই উপলব্ধি করে সেখান থেকে গলগলিয়ে তরল রক্ত বের হচ্ছে। এতদূর টের পেতে না পেতেই পরপর দু তিনটে তীব্র আঘাত ফের অনুভব করে সে পিঠে। বাণী এখনো থামে নি। আঘাত চালিয়ে যাচ্ছে। বিছানার সাইড কেবিনেটের উপর হতে কাঁচের তৈরী যে ক’টা শোপিজ পেয়েছে সবগুলো হিরণের দিকে ছুঁড়ে মেরে চিৎকার করে,

“ আই হেট ইউ। “

এতদূর বলেই সে ত্রস্ত পায়ে বিছানা ছেড়ে নেমে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই হিরণ ঝাপসা চোখ ছেড়ে বাণীকে দরজার সঙ্গে চেপে ধরে। হিসহিসিয়ে বলে,

“ মারো, কাটো যা ইচ্ছা করো। তবে বাহিরে পা দেওয়ার অনুমতি নেই তোমার। “

বাণী দু হাতে হিরণের বুকে ধাক্কা মারে। ক্ষুব্ধ স্বরে শুধায়,

“ মরতে পারেন না আপনি? মরে আমাকে আর আমার মেয়েকে শান্তি দিতে পারেন না? উপরওয়ালা কি আপনাকে দেখে না? “

হিরণ বাণীর চোখের পানে তাকিয়ে রয়। কোনটার যন্ত্রণা বেশি বুঝতে পারছে না? চোখের পাশের ক্ষতটার নাকি বুকের ক্ষতটার? যন্ত্রণাটুকু মনে লুকিয়ে রেখে সে শীতল গলায় প্রশ্ন করে,

“ আমি মরলে খুশি হবে তুমি? “

“ কোনো সন্দেহ আছে তাতে? “

হিরণ সামান্য ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলে,

“ সরি। তোমার এই ইচ্ছেটা পূরণ করা সম্ভব নয়। তোমার জন্য আমি মারতে রাজি আছি, তবে মরতে নয়। বহু কিছু পেরিয়ে তোমাকে পেয়েছি। মরে গেলে আফসোস বুকে রয়ে যাবে। “

বাণী ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন ছুড়ে,

“ আপনি আমায় আদৌ পেয়েছেন? “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here