এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৩৪.

0
192

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৪.

আজ ঠিক কতটা দিন পর মেয়েকে এভাবে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে সেই হিসেব ভুলে বসেছে বাণী। শুধু একটু পর পরই মেয়ের মুখে চুমু খেয়ে আওড়াচ্ছে,

“ আ’ম সরি মা। মাম্মা তোমাকে একা রেখে গিয়েছিলো। “

বহ্নি কোনো জবাব দেয় না। সে এতটুকুতেই খুশি যে তার মাম্মা সুস্থ হয়ে গিয়েছে। মনে মনে ঠিক করে আর কখনো মাম্মাকে রেইনে ভিজতে দিবে না সে। সে চায় না তার মাম্মা আবার অসুস্থ হয়ে হসপিটালে থাকুক এতদিন।

খাবার টেবিলে বহ্নিকে কোলে বসিয়ে তাকে নিজের হাতে ভাত মেখে খাওয়াতে ব্যস্ত বাণী। হিরণ তখন সবে উপর থেকে গোসল সেরে রেডি হয়ে নেমেছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে এই প্রশান্তিদায়ক দৃশ্যটুকু দেখে তার ঠোঁটের কোণে অস্ফুটে হাসি ফুটে উঠে। নিজের ঘরকে আবার পরিপূর্ণ অনুভব হচ্ছে তার। বাণী অবহেলায় সিঁড়ির পানে তাকাতেই হিরণকে লক্ষ্য করে। হিরণের ঠোঁটের হাসি দেখে সে ঘৃণায় চোখ নত করে ফেলে। হিরণের হাসিও মিইয়ে যায়।

সে নিচে নামতেই রান্নাঘর হতে একজন হেল্পিং হ্যান্ড বেরিয়ে এসে বাণীকে প্রশ্ন করে,

“ ম্যাডাম, স্যারের জন্য খাবার সার্ভ করবো? “

প্রশ্নটা শুনে বাণীর রাগ হয়। এসব আলগা আধিক্যেতা জাতীয় প্রশ্ন শুনলেই রাগে তার গা জ্বলে। সে কাটকাট গলায় জবাব দেয়,

“ এসব তো আমার দেখার বিষয় না। যার যখন খেতে ইচ্ছে হবে সে তখন খেয়ে নিবে। “

হেল্পিং হ্যান্ডের মুখ কালো হয়ে আসে। হিরণ নিজেই আগ বাড়ি বলে,

“ খাবার সার্ভ করতে হবে না। আমার খিদে নেই। “

বহ্নি ঘাড় ঘুরিয়ে পাপার দিকে তাকায়। দাঁত বের করে হেসে বলে,

“ পাপা! “

হিরণ মেয়ের পানে তাকিয়ে মৃদু হেসে হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নেয়। বের হবে সে এখন। যাওয়ার আগে টেবিলে বসে থাকা বাণীর দিকে এগিয়ে যায়। মাথা সামান্য নুইয়ে বহ্নির কপালে চুমু খায়। তবে তার দৃষ্টি স্থির বাণীর মুখপানে। বাণী কঠিন হয়ে চুপচাপ বসে রয়। হিরণ বেরিয়ে যাওয়া আগে শুধু মেয়ের কানে কানে বলে যায়,

“ মাম্মাকে বেশি বিরক্ত করো না। সব দুষ্টুমি জমিয়ে রেখো। পাপা আসলে পাপাকে ইচ্ছেমতো জ্বালিও। “

হিরণ ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়িতে উঠে বসে। ড্রাইভিং সিটে আগে থেকেই ইবাত বসেছিলো। হিরণ এসে পাশে বসতেই সে গাড়ি স্টার্ট দেয়। ড্রাইভিং এর ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে সে স্যারের ক্ষত বিক্ষত মুখটা দেখে নেয়। মনে মনে খুব মায়া হয় তার। স্যারকে এই ক্ষত কে উপহার দিয়েছে তা তার ভালো করেই জানা আছে। বাণী ম্যাডাম ছাড়া আর কারো সাহস নেই এমনটা করার। রাগে ইবাত অস্ফুটে বলে উঠে,

“ পাষণ্ড। “

হিরণের মনযোগ ফোনে স্থির ছিলো। কিন্তু ইবাতের অস্ফুটে বলা কথাটা তার কর্ণগোচর হয়। সে চোখ তুলে প্রশ্ন করে,

“ কাকে পাষাণ বলছো? “

ইবাত নিজের রাগটুকু চেপে রাখতে পারে না। অতি সাহস জুগিয়ে বলে উঠে,

“ স্যার বেয়াদবি ক্ষমা করবেন। কিন্তু বাণী ম্যাডাম কাজটা মোটেও ভালো করে নি। নিশানা আরেকটু এপাশ ওপাশ হলেই আপনার চোখের খুব বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যেতো। “

হিরণ ভ্রু কুচকে বলে,

“ কিন্তু সেরকম কিছু তো হয় নি। আর তুমি কি বাণীকে উদ্দেশ্য করে ওই শব্দ ব্যবহার করেছো? “

“ উনি পাষাণ না হলে কি আপনার সাথে এমনটা করতে পারতো? নারী জাতির অন্যতম গুণ নাকি হলো মায়া। কিন্তু উনার মধ্যে কেনো আপনার প্রতি মায়া কাজ করে না? এতটা নির্দয় কেনো উনি? “

ইবাতের চাপা ক্ষোভ হিরণকে মৃদু হাসতে বাধ্য করে। সে শীতল গলায় বলে,

“ কে বলেছে ওর মধ্যে মায়া নেই? ওর সকল মায়া একজনকে ঘিরেই। বহ্নি ওর মায়ার কেন্দ্রবিন্দু। “

ইবাত তাচ্ছিল্যপূর্ণ হেসে শুধায়,

“ স্যার আপনি কি ভুলে গিয়েছেন বহ্নির জন্মের ঘটনা? “

হিরণ নীরব বনে যায়। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে অতীত। প্রেগন্যান্সির সম্পূর্ণ জার্নিতে বাণী উন্মাদ আচরণ করেছিলো। সুযোগ পেলেই আত্মহত্যা করার চেষ্টা করতো। নিজের প্রতি যত ধরনের অবহেলা সম্ভব সব করেছিলো। হিরণের উপর দিয়ে তখন অন্যরকম এক ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো।

২০১৯ সালের মে মাসের ঘটনা। যখন বহ্নি এই পৃথিবীতে এসেছিলো। কি ভয়ংকর কালবৈশাখীর সম্মুখীন হয়েছিলো চট্টগ্রাম শহরটা! নিরাপত্তার খাতিরে হিরণ বাণীকে হসপিটালে নিয়ে যায় নি। বাড়িতেই ডক্টর নার্স সব জোরো করে ফেলেছিলো। কাল বৈশাখীর সেই রাতে বাচ্চা মেয়েটা দুনিয়ায় এসেছিলো। কিন্তু ডক্টর হুমায়রা জানায় বাচ্চাটা খুব দূর্বল। ক্ষীণ তার নিঃশ্বাসের গতি। চব্বিশ ঘণ্টাও যদি টিকতে পারে তবে তা মিরাক্কেল হবে।

বাণী তখন প্রসব বেদনা কাটিয়ে অচেতন অবস্থায় ছিলো। হিরণ ছিলো দিশেহারা। কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলো না কোনো। অদ্ভুৎ এক অসহায়ত্বের মধ্যে দিয়ে সেই রাতটা পাড় করে সে। খুব সকালে যখন বাণীর জ্ঞান ফিরে তখন ডক্টর হুমায়রা বাণীকে বাচ্চার অবস্থার কথা জানায়। বাণীর মধ্যে কোনো উৎকণ্ঠা ছিলো না। ছিলো না কোনো চিন্তার ছাপ। সে নির্লিপ্ত রয়। বাচ্চাকে তার কাছে এনে দেয়ার পর সে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কোলে তুলে নেয় না। হিরণ এবং বাচ্চাটার প্রতি তার মনে পুষে ছিলো তীব্র ঘৃণা। হিরণ অবাক হয় না। ওই পরিস্থিতিতে বাণীর এরকম আচরণই স্বাভাবিক ছিলো।

কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে হিরণ সাহস করে নিজেই মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। দীর্ঘ জীবনে সেই প্রথম হিরণ কোনো বাচ্চার সান্নিধ্যে এসেছিলো। তাও নিজের বাচ্চা। ডক্টরকে বাণীর খেয়াল রাখতে বলে, বহ্নিকে নিয়ে সে নিজের রুমের সিঙ্গেল সোফাটায় নীরবে সারাদিন বসে রয়। নিজের বলিষ্ঠ হাতের বন্ধনে দূর্বল বাচ্চাটাকে একটা কবুতরের ছানা মনে হচ্ছিলো হিরণের। খুব নরম, হালকা, তুলতুলে। মুসলিম রীতি অনুযায়ী বাচ্চা জন্মের সঙ্গে সঙ্গে সর্ব প্রথম তাকে কোলে তুলে তার কানের কাছে আজান দিতে হয়। কিন্তু হিরণ সেসব রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে মেয়ের কানের কাছে সর্বপ্রথম উচ্চারণ করে,

“ তুমি কি আমার ভুল? “

দূর্বল বহ্নি চোখ মেলে তাকায় না। হিরণ ফের স্থির দৃষ্টিতে মেয়ের পানে তাকায়। তার মন জবাব দেয় এই বাচ্চাটা তার ভুল হতে পারে না। হিরণের কীর্তিকালাপ ভুল হলেও এই বাচ্চাটা কোনো ভুল নয়। এতো স্নিগ্ধ একটা প্রাণ বড়জোড় হিরণের জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি হতে পারে। হিরণ কিছু একটা ভেবে ফের ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ তুমি আমার বহ্নি। “

ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলো বলেই হয়তো বহ্নি বেঁচে গিয়েছিলো। তবে শরীর তখনো অত্যাধিক দূর্বল। স্বাভাবিক বাচ্চাদের তুলনায় ওজনটাও যথেষ্ট কম। পেটে থাকাকালীন মায়ের শারীরিক অযত্নের ফলে পুষ্টিহীনতা দেখা দিয়েছিলো তার। দিন পেরিয়ে সপ্তাহ আসে। দেখতে দেখতে একুশটা দিন পাড় হয়। বাণী বহ্নির মুখ দেখতেও নারাজ রয়। কেউ ভুল করেও বহ্নিকে তার রুমে নিয়ে আসলে সে চিৎকার চেঁচামেচি করে তাকে তাড়িয়ে দিতো। হিরণ তখন বহ্নিকে নিয়ে দিশেহারা। ডক্টর সাজেস্ট করেছিলো পুষ্টির ঘাটতি পূরণের জন্য ব্রেস্টফিডের বিকল্প নেই। কিন্তু বাণীর ক্ষোভের কারণে হিরণ বাধ্য হয়ে বহ্নিকে ইনফ্যান্ট ফরমুলা মিল্ক তৈরী করে খাওয়াতো।

একুশতম দিনে হিরণ সাহস সঞ্চয় করে বহ্নিকে নিয়ে বাণীর রুমে প্রবেশ করে। বেশ রাত হওয়ায় বাণী তখন ঘুমে বিভোর। হিরণ নিঃশব্দে বহ্নিকে বিছানায় বাণীর একপাশে শুইয়ে দেয়। অত:পর দু’পাশে বালিশ দিয়ে বর্ডার টেনে দেয় যেনো ভুল করেও বাণী ঘুমের ঘোরে বহ্নির উপর না এসে পড়ে কিংবা বহ্নি নিচে না পড়ে যায়। সন্তর্পণে কাজটুকু শেষ করেই হিরণ রুম থেকে বেরিয়ে যায়। দরজার অপর পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে অপেক্ষা করতে থাকে।

বিশ পঁচিশ মিনিটের মাথায়ই বহ্নির ঘুম ভেঙে যায় খিদের চোটে। সে গলা ফাটিয়ে কান্না শুরু করে। বাণীর গভীর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। সে তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠে বসে। প্রথমে ভয় পেলেও বিছানায় নিজের পাশে বহ্নিকে দেখে তার ভ্রু কুচকে আসে। সেও বহ্নির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে,

“ কেউ আছে? এই বাচ্চাকে নিয়ে যাও এখান থেকে। “

বাণীর চিৎকার শুনে নিচ থেকে একজন হেল্পিং হ্যান্ড দৌঁড়ে আসে। কিন্তু দরজার বাহিরে হিরণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে থেমে যায়। হিরণ চোখের ইশারায় চলে যেতে বললেই সেই মহিলা সুরসুর করে নিচে চলে যায়।

সময় গড়ায়। কিন্তু কেউ আসে না। বাণী বিরক্তিতে দুই হাতে নিজের কান চেপে ধরে। বহ্নির কান্না থামে না বরং ক্রমান্বয়ে আরো বাড়তে থাকে। বাণী দুই হাতে নিজের মাথার চুল মুঠো করে ধরে চেঁচিয়ে উঠে,

“ চুপ করবে তুমি? কেনো যন্ত্রণা দিচ্ছো? “

ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না থামে না। বাণী অসহায় অনুভব করে। সবে কুঁড়ি পেড়িয়ে আসা এই জীবনে সে কখনো কোনো বাচ্চা কোলে তুলে নি। তার জানা নেই একটা নবজাতক শিশুর সঙ্গে কিভাবে ডিল করতে হয়। সে ফ্যালফ্যাল করে বহ্নির দিকে তাকিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে তার চোখের কোণে অশ্রু এসে ভীড় করে। অস্ফুটে সে প্রশ্ন করে,

“ তুমি বেশি অসহায় নাকি আমি? “

প্রশ্ন করে বাণী নিজেই অনভিজ্ঞ হাতে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয়। বহ্নির মাথার কাছেই একটা ছোট্ট ফিডারে সে ফর্মুলা মিল্ক দেখতে পায়। সেই ফিডারটা খুলে বহ্নির মুখে দিতেই তার কান্না ধীরে ধীরে কমে আসে। পুরোপুরি শান্ত হয়ে যায়। বাণী অশ্রু সিক্ত দৃষ্টি মেলে বাচ্চাটাকে দেখতে থাকে। খাওয়ানো শেষ হতেই কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বহ্নি ঘুমায় না। ফ্যালফ্যাল করে নিজের মা’কে দেখতে থাকে। ছোট ছোট আঙুল দ্বারা ছুঁয়ে দেখারও চেষ্টা করে। বাণী মেয়ের চোখে চোখ রেখে ধরা গলায় বলে আসে,

“ আমি তোমার বাবাকে খুব ঘৃণা করি। সেই ঘৃণা এতটাই তীব্র যে আমি তোমাকেও মেনে নিতে পারছি না। তোমার অস্তিত্বই তোমার বাবাকে ঘৃণা করার অন্যতম কারণ। “

এই পর্যায়ে বাণীর চোখ দিয়ে টুপটুপ করে পানি পড়তে শুরু হয়।

“ আমার কি দোষ বলো? আমি তোমার থেকেও বেশি অসহায়। “

বহ্নি মনযোগ শ্রোতার মতো মায়ের সকল অভিযোগ শুনতে ব্যস্ত। বাণী রুগ্ন মেয়ের পানে তাকিয়ে বলতে থাকে,

“ আ’ম সরি। আ’ম রিয়েলি সরি। তুমি আমাকে খুঁজেছো খুব তাইনা? আমি আমার অনুভূতি বুঝে উঠতে পারি নি। এখনো পারছি না। তোমার এই অবস্থা আমার জন্য হয়েছে তাই না? আমার অবহেলার কারণে তুমি এতো দূর্বল। আমি এসবের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না বিশ্বাস করো। তুমি অনাকাঙ্ক্ষিত আমার জন্য। আমি খুব খারাপ মা। আমাকে মাফ করে দাও বাচ্চা। প্লিজ মাফ করে দাও… “

কথাগুলো বলতে বলতে বাণী ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। দরজার অপর পাশ হতে সবটাই হিরণের কর্ণগোচর হয়। সে নীরবে দরজায় মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়। সবটাই তার ভুল। তার ভুলের শাস্তি এতদিন তার মেয়ে পেয়েছে। তার ভুলের শাস্তি এতদিন বাণী পেয়েছে। আর নিজের ভুলের শাস্তি হিসেবে সে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছে। সেই রাতের পর থেকে গত ন’টা মাস ধরে সে বিবেকের দংশন দ্বারা তাড়িত হচ্ছে। প্রেগন্যান্সির সময় বাণী যতবার সুইসাইড এটেম্পটের ট্রাই করেছে প্রত্যেকবার হিরণের নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসতো। রাতের ঘুম উবে গিয়েছিলো। চোখ বুজলেই মনে হতো এই বুঝি বাণী আবার কিছু একটা করে বসলো। বাণীর মানসিক অবস্থা এতটাই বিপর্যস্ত হয়েছিলো যে বাধ্য হয়ে একবার বিছানার সঙ্গে তার দু হাত বেধে রাখতে হয়েছিলো। যেনো নিজের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। সেই দৃশ্য মনে পড়লে এখনো হিরণের বুকে কাঁপন ধরে।

অতীত যাত্রা সেড়ে হিরণ চোখ মেলে তাকায়। জন্মের পর বাণী একুশ দিন নিজের মেয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলো এইটা সবার চোখে পড়েছে। কিন্তু বাণী ঠিক কি কারণে এরকম আচরণ করেছিলো তা সকলের অজানা। হিরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইবাতের উদ্দেশ্যে বলে,

“ বাণীকে কখনো ভুল বুঝবে না ইবাত। ও বহ্নিকে খুব ভালোবাসে। তুমি শুধু আমার পক্ষের ঘটনার সাক্ষী তাই এমনটা বলছো। বাণীকে বোঝার সাধ্যি তোমার নেই। “

হিরণের এহেন কথা শুনে ইবাত বিরক্ত হয়। লোকটা কিসের তৈরী? এখনো তিনি বাণী ম্যাডামের হয়েই সাফাই গাইছেন!

__________

ফিলিস্তিনে সময় তখন বিকেল ৭ টা বেজে ৩৫ মিনিট। ত্রাণ বিলানোর কাজ শেষ করে সৈন্যরা যে যার তাবুতে অবস্থান করছে তখন। রাতের খাবার কিছুক্ষণ আগে সেড়েই যে যার তাবুতে প্রবেশ করেছে। সারাদিনের ক্লান্তির ফলে সবাই এখন বিশ্রাম নেওয়ার প্রতি অধিক মনযোগী। আগামীকাল সকালের আগে কেউই আর কাউকে বিরক্ত করবে না। ঠিক এই সুযোগে প্রত্যয়, রাফি এবং রিদওয়ান নীরবে নিজেদের তাবু ছেড়ে বেরিয়ে আসে। আর মাত্র তিনদিন এই দেশে আছে তারা। এই তিনদিনের মধ্যেই তাদের সত্যিটা উদঘাটন করতে হবে যেকোনো মূল্যে।

রহস্য উদঘাটনের প্রথম ধাপ হিসেবে ট্রেস করা লোকেশনটা গুগল ম্যাপে বসিয়ে জায়গাটা এখান থেকে ঠিক কতটা দূরে তা মেপে নেয় তিনজন। পায়ে হেঁটে গেলে প্রায় একঘন্টার দূরত্ব। তিন সৈন্যের জন্য একঘন্টা পায়ে হেঁটে যাওয়া খুব বড়ো কোনো বিষয় নয়। কিন্তু সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে বিপদহীন ভাবে উক্ত স্থানে পৌঁছানোটাই আসল বিষয়।

কারো দৃষ্টি যেনো আকর্ষণ না হয় সেজন্য প্রত্যয়, রাফি, রিদওয়ান ইউনিফর্ম ছেড়ে সিভিল গেটাপে রেডি হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে করে নিয়েছে সম্পূর্ণ লোডেড পিস্তল।

প্রত্যয়, রাফি, রিদওয়ান তখন কেবল আব্দুল্লাহ আজাম মসজিদ পেরিয়ে সরু পথ ধরে সাবধানে এগিয়ে যাচ্ছে। আচমকা রাফি পায়ের গতি থামিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। হিসহিসিয়ে বলে,

“ আমার কেনো মনে হচ্ছে কেউ আমাদের ফলো করছে? “

রাফির কথা শুনতেই প্রত্যয় ও রিদওয়ান সতর্ক হয়ে চারিদিকে তাকায়। কিন্তু নিজেদের ত্রী সীমানায় কোনো মানুষের অস্তিত্ব না দেখে তারা আবার সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু করে। হঠাৎ আবার পিছনে শুকনো পাতা মাড়ানোর শব্দ হতেই তিনজন সতর্ক হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন ভাবে চারিদিকে কারো অস্তিত্ব খুঁজতে শুরু করে। রিদওয়ান হাতের টর্চের আলোর সাহায্যে এগিয়ে যায় সরু পথের ধারে একটা ছোট টিলার কাছে। টিলার চারিদিকে ঘুরে ঘুরে আলোর সাহায্যে কাউকে খুঁজতে গিয়েই আচমকা সে ভয়ে চাপা চিৎকার করে উঠে। প্রত্যয় আর রাফি বেশি দূরে ছিলো না। তারা রিদওয়ানের ভীত চিৎকার শুনতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে সেই টিলার কাছে এগিয়ে যায়। এরকম অন্ধকার জায়গায় লম্বা বোরখার ন্যায় সাদা আলখেল্লা পরিহিত রমণীকে দেখে যে কেউ ভয় পেতে বাধ্য। মাথার অর্ধেক ভাগ তার সবুজ রঙা একটা শাল দিয়ে ঢাকা। তার হালকা নীলাভ চোখ পানে তাকিয়ে রিদওয়ান অবাক গলায় বলে,

“ জারিয়াহ? “

জারিয়াহ দৃষ্টি নত করে কাচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। প্রত্যয় আর রাফি মেয়েটাকে এক দেখায়ই চিনতে পারে। কিন্তু তারা এই ভেবে অবাক যে এই মেয়ে তাদের ফলো করছে কেন? প্রত্যয় গলার স্বর মৃদু গম্ভীর করে ইংরেজিতে জানতে চায়,

“ আমাদের ফলো করছিলে কেনো? “

জারিয়াহ ইংরেজি বুঝতে পারে। কিন্তু বলার অভ্যাস নেই বলে সে এতটা গুছিয়ে বলতে পারে না। তবুও অগোছালো শব্দে ইংরেজিতে সে জানায়,

“ আমি জানি আপনারা কোনো গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছেন। “

জারিয়াহর কথা শুনে তিনজনই বেশ অবাক হয়। রিদওয়ান প্রশ্ন করে,

“ তোমার এমনটা কেনো মনে হলো? “

“ আমি আপনাদের উপর নজর রাখছিলাম। আপনাদের দৃষ্টি সন্দেহজনক ছিলো। “

জারিয়াহর কথা শুনে রাফি বাংলায় বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ এই মেয়ে গোয়েন্দা সংস্থার অধিদপ্তরে কাজ করে নাকি? “

রিদওয়ান সেদিকে পাত্তা না দিয়ে কিশোরী মেয়েটাকে আগাগোড়া পরখ করে নেয়। বয়স ১৮ ছুঁয়েছে কিনা সন্দেহ! তবুও এতো বড়দের মতো কথাগুলো কেন যেনো মেয়েটার সাথে মানানসই লাগছে। রিদওয়ান ধীমি গলায় প্রশ্ন করে,

“ তোমার উদ্দেশ্য কি জারিয়াহ? “

“ আমি আপনাদের সাহায্য করতে চাই। “

প্রত্যয় ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ আর ইউ সিরিয়াস? “

“ হ্যাঁ। “

রিদওয়ান এবার শীতল গলায় প্রশ্ন করে,

“ বিনিময়ে তোমার কি চাই জারিয়াহ? “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here