এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৮.
জারিয়াহকে নিজের ঠিকানায় পৌঁছে দিয়েই সৈন্যরা নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে আসে। এক তাবুতে তিনজন প্রবেশ করতেই রাফি ফিসফিসিয়ে প্রত্যয়কে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে,
“ তুই সিম আর মেমোরি কার্ড খুলে নিয়ে এসেছিস কেনো? কি করবি? “
প্রত্যয় হাতের ল্যাপটপটা রেখে পকেট থেকে সিম ও মেমোরি কার্ড বের করে বলে,
“ এদের কার কার সাথে কন্ট্যাক্ট আছে আর ফোনে আরো কোনো তথ্য পাওয়া যায় কি-না জানতে হবে না? “
বন্ধুর বুদ্ধিমত্তা দেখে রাফি মুগ্ধ হয়। ফিসফিসিয়ে বলে,
“ আমি এনগেজড না হলে এখনি তোর এই স্মার্ট কাজের পুরষ্কার হিসেবে তোকে একটা চুমু খেতাম। “
প্রত্যয় চোখ গরম করে দূরে সড়ে বলে,
“ এক ঘুষি মেরে তোর নাক ফাটিয়ে দিবো শালা। “
রিদওয়ান এতক্ষণ ভাবনায় মশগুল ছিলো। আচমকা বন্ধুদের মনযোগ আকর্ষণের উদ্দেশ্যে বলে,
“ আমি হিসাব মিলাতে পেরেছি। “
প্রত্যয় ও রাফি দু’জনেই ভ্রু কুচকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“ কিসের হিসাব? “
রিদওয়ান চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিচু গলায় বলে,
“ এই পুরোটা একটা ট্র্যাপ ছিলো। বেজন্মা, বর্বরগুলোর ইনটেনশন ছিলো এই এট্যাক গুলোর মাধ্যমে এই দেশকে ডিফেম করা। গত কয়েকমাসে যেই গুটি কয়েক দেশে ওরা এই টেরোরিস্ট অ্যাটাক গুলো চালাচ্ছে এর পিছনে একটাই কারণ। যেনো আমাদের দেশ গুলোর সাথে এই দেশের কূটনৈতিক ঝামেলা সৃষ্টি হয়। সেই ঝামেলার কারণে যেনো আমরা এই দেশে সাহায্য পাঠানো কিংবা সাপোর্ট করাটা বন্ধ করে দেই। আর এতে তো ওদের লাভ। পশ্চিমা দেশ গুলো এই বর্বরদের সাপোর্ট করছে অলরেডি। অন্যদিকে একটা দেশের সব সাপোর্ট সিস্টেম বন্ধ করে তাদের পঙ্গু বানানোর জন্য এরা হায়েনার মতো হাজার হাজার মানুষের প্রাণ নিয়েছে, নিচ্ছে এবং নিবে। দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্র এটা। কি নিখুঁতভাবে পুরো ঘটনাটা সাজিয়েছে। কি ভয়ংকর পরিকল্পনা দেখছিস?
প্রত্যয় আর রাফি মনযোগ দিয়ে রিদওয়ানের কথা শুনে। আর সঙ্গে সঙ্গে তারা পুরো ব্যাপারটা রিলেট করতে পারে। প্রত্যয় বিস্মিত গলায় হিসাব মিলিয়ে বলে,
“ ইউ আর জিনিয়াস রিদওয়ান। পুরো হিসাব মিলে গিয়েছে। এই অসভ্য গুলোর পরিকল্পনা শুনে আমি মোটেও অবাক হচ্ছি না। এদের দ্বারাই কেবল সম্ভব এমন ভয়াবহ একটা হত্যাযজ্ঞ চালানো। “
রাফি দ্রুত গলায় বলে,
“ আমাদের এখনই মেজরকে এই ব্যাপারে ইনফর্ম করতে হবে। উই কান্ট ওয়েট। লেট’স কল হিম। “
__________
সন্ধ্যা সাতটার দিকেই বাসায় ফিরে আসে হিরণ। গতকাল রাতের সেই ইন্সিডেন্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত মেয়ের মুখোমুখি হতে হয় নি তার। এই সন্ধ্যা বেলায় বাসায় ফিরেও সে আর সেচ্ছায় বহ্নির রুমে গেলো না। কেবল একজন হেল্পিং হ্যান্ড দিয়ে বাণীর কাছে খবর পাঠায় রেডি হয়ে নিতে। বাণী খবরটা পেতেই রুমের দরজা ভেতর থেকে লক করে টিভির ভলিউম সম্পূর্ণ বাড়িয়ে দিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে থাকে। কারো আদিখ্যেতা সহ্য করার মতো ধৈর্য্য নেই এই মুহুর্তে তার।
সময় গড়ায়। আধঘণ্টা বসে অপেক্ষা করে হিরণ। কিন্তু বাণীর নেমে আসার কোনো লক্ষণ না দেখে বাধ্য হয়ে নিজেই উঠে উপরে যায়। দরজায় সামান্য নক করে বলে,
“ বাণী দরজা খুলো। “
টিভির ভলিউম বাড়ানো থাকলেও হিরণের ডাক মা মেয়ে শুনতে পায়। বহ্নি সাথে সাথে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
“ মাম্মা তুমি ভয় পেও না। আমি আছি না? আই ক্যান হ্যান্ডেল হিম। “
এরকম সিরিয়াস একটা সিচুয়েশনে মেয়ের কথা বলার ভঙ্গি দেখে নীরবে হাসে বাণী। মেয়ের গাল টিপে দিয়ে বলে,
“ আমি ভয় পাচ্ছি না মা। আই নো আমার বহ্নি সোনা সাথে আছে। “
বহ্নি কিছু একটা ভেবে বিছানা ছেড়ে নেমে নিজের টয় বক্স থেকে একটা ম্যাজিক স্টিক নিয়ে বলে,
“ আমরা পাপার উপর ম্যাজিক স্পেল করি মাম্মা? যাতে পাপা ফ্রিজ হয়ে যায়? আর তোমাকে হার্ট না করে। “
বাণী আবারও মলিন হাসে। হেসে মেয়ের সামনে গিয়ে হাঁটু ভেঙে বসে প্রশ্ন করে,
“ বহ্নি, ধরো মাম্মা কখনো তোমাকে নিয়ে এখান থেকে অনেক দূরে চলে গেলাম, যেখানে পাপা আর আমাদের খুঁজে পাবে না অথবা আমাকে হার্ট করতে পারবে না। তুমি কি পাপাকে রেখে মাম্মার সাথে যেতে রাজি হবে? “
বহ্নি ভাবুক হয়। পরপর নরম গলায় প্রশ্ন করে,
“ এখান থেকে দূরে গেলে তুমি হ্যাপি হবে মাম্মা? “
“ হ্যাঁ, মা। খুব হ্যাপি হবো। “
“ তাহলে আমি যাবো। “
বাণী হেসে মেয়ের কপালে একটা চুমু খেয়ে তাকে কোলে নিয়ে বিছানায় বসায়। দরজার ওপাশ থেকে হিরণের আহ্লাদ মিশ্রিত ডাক এখনো অব্যাহত আছে। বাণী বিরক্ত হয়ে একটা হেডফোন নিয়ে বহ্নিকে পড়িয়ে দিয়ে মিউজিক প্লে করে দেয়। চোখের ইশারায় বলে,
“ তুমি বসে গান শুনো, আমি এখুনি আসছি। “
বলেই বাণী ধীরে ধীরে দরজার কাছে এগিয়ে যায়। দরজা খুলে বের হতেই হিরণের মুখোমুখি হয় সে। বিরক্তি মাখা গলায় শুধায়,
“ আমি যাবো না বলেছি না? “
হিরণ শীতল গলায় বলে,
“ আমি তোমার কাছে জানতে চাই নি তুমি যাবে কি-না। ইউ হ্যাভ টু কাম উইথ মি। “
বাণী হেসে জানতে চায়,
“ না গেলে কি করবেন হ্যাঁ? আবার টেনে নিয়ে রেপ করবেন? নাকি নিজের বিধ্বংসী রাগ ঝাড়বেন? বলুন কি করবেন। দিজ ইজ অল ইউ ক্যান ডু। “
হিরণ হিম শীতল গলায় বলে,
“ আই জাস্ট ওয়ান্ট টু হিল ইউ। “
হিরণের এমন গা জ্বালানো কথায় বাণীর রাগ হয়। সে বহ্নির রুমের দরজাটা ভালো করে আটকে দিয়ে দ্রুত পায়ে নিচে নামে। হিরণ প্রথমে অবাক হলেও সে-ও পিছুপিছু নামে। বাণী খাবার টেবিলের কাছাকাছি যেতেই দেখে দু’জন হেল্পিং হ্যান্ড রাতের খাবার রান্না করতে ব্যস্ত কিচেনে। বাণী তাদের উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠে,
“ গেট দ্যা হেল আউট অফ হেয়ার। “
তার চিৎকারে হেল্পিং হ্যান্ড দু’জনই কেঁপে উঠে। তারা অসহায় ভঙ্গিতে হিরণের দিয়ে তাকায়। হিরণ ইশারায় সম্মতি জানাতেই তারা সুরসুর করে বাড়ির বাহিরে চলে যায়। কখনো কখনো তাদের মনে হয় তাদের স্যার আর ম্যাডাম দুইজনই পাগল। এই পাগলদের পাল্লায় পড়ে তাদেরও এখন পাগল প্রায় অবস্থা।
হেল্পিং হ্যান্ডরা বেরিয়ে যেতেই বাণী টেবিলের উপর থেকে কাঁচের গ্লাস তুলে ফ্লোরে ছুড়ে মারে। অত:পর চেঁচিয়ে উঠে,
“ নিন। ভেঙে দিলাম। এখন এটাকে কিভাবে হিল করবো বলুন? কোন হসপিটালে নিয়ে গেলে এটার ট্রিটমেন্ট পসিবল? কেউ পারবে না এটাকে হিল করতে। নো ওয়ান। দিজ ইজ এক্স্যাক্টলি হোয়াট ইউ ডিড টু মি। আই ক্যান নেভার হিল। আপনি সেই উপায়ই রাখেন নি। তাই ফারদার নিজের এই লেইম দরদ নিয়ে আমার সামনে আসবেন না। “
বলেই বাণী চলে যেতে নিলে হিরণ শান্ত গলায় বলে,
“ দোষটা কি সম্পূর্ণ আমার একারই বাণী? “
বাণী অবাক হয়ে তাকায়। প্রশ্ন করে,
“ তাহলে কি আমার দোষ? “
“ তুমি রাজি থাকলে আমরা খুশি হতে পারতাম। “
“ নিজের ভাইয়ের রক্ত দিয়ে কাবিননামা সই করতাম? “
“ সেইদিন কখনোই আসতো না যদি তুমি শুরুতেই বিয়ের জন্য রাজি হতে। “
বাণী প্রশ্ন করে,
“ গিভ মি ওয়ান রিজন যেটার জন্য আমি রাজি হতাম। আপনি কখনোই আমাকে কোনো কারণ দেন নি যার জন্য আমি আপনার প্রতি সদয় হবো। চেনা নেই জানা নেই একজন অপরিচিত লোক আমাকে টাকার বিনিময়ে কিনে এনে বন্দী করে রেখে কিনা আমার থেকে এক্সপেক্ট করে আমি হাসিমুখে সবটা মেনে নিবো। আর ইউ কিডিং উইথ মি? “
“ তোমার মুখের কথা যথেষ্ট ছিলো বাণী। একবার বলে দেখতে। তুমি যেরকম চাও ঠিক সেরকম হয়ে দরকারে তোমার সামনে এসে দাঁড়াতাম। “
“ ফর গড সেক স্টপ ইট। আপনি কোন ফ্যান্টাসিতে ভুগেন তা আমার জানা নেই। কিন্তু আমি আপনার মতো ফ্যান্টাসিতে ভোগী না। আপনি যেই লাইফ লিড করছেন ইট ইজ টোট্যালি ইউর চয়েজ। আপনি নিজে কখনো চেষ্টা করেছেন নিজের লাইফস্টাইল পরিবর্তন করার? আমার জন্য কিংবা বহ্নির জন্য কখনো এই পথ থেকে ফিরে আসার কথা ভেবেছেন? ভাবেন নি। তাহলে আমার কিসের ঠেকা পড়েছে যে আপনাকে পরিবর্তনের চেষ্টা করবো?… “
এতদূর বলতেই আচমকা বাহির হতে কিছু একটা বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে। সেই সঙ্গে কিছু লোকের চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ। বাণী আর হিরণ বিস্মিত হয়। কিছু বুঝে উঠার আগেই বাহিরের গোলা বর্ষণের শব্দে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা কেটে যায়। হিরণ এক মুহুর্ত দেরি না করে দ্রুত নিজের পিস্তল বের করে জানালার ধারে এগিয়ে যায় পরিস্থিতি বুঝার জন্য। পরিস্থিতি আঁচ করতেই সে দ্রুত গলায় বলে,
“ বাণী উপরে যাও। বহ্নির কাছে গিয়ে দরজা লক করে থাকো। ভুলেও খুলবে না। “
বাণী ভীত হয়। পরিস্থিতির গাম্ভীর্যতা টের পেয়ে সে এক মুহুর্ত দেরি না করে দ্রুত উপরে চলে যায়। বহ্নির রুমে প্রবেশ করেই সে দরজা লক করে দেয়। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে সে যখন বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে ব্যস্ত তখন তার চোখ পড়ে বিছানায় বসে থাকা বহ্নির দিকে যে কিনা অবাক দৃষ্টি মেলে নিজের মাম্মাকে দেখছে।
__________
টিয়ার শেলের ঝাঁঝালো ধোঁয়ায় চোখটা খুব জ্বলছে। শ্বাস নালি হয়ে সেই ধোঁয়াটা ভেতরে প্রবেশ করে আরো বেশি পীড়া দিচ্ছে। চারিদিকে তখন গুলি বর্ষণের শব্দ। তীব্র জ্বালা নিয়েই ইবাত চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করে। স্পষ্ট দেখতে না পারলেও সে এলোমেলো গুলি ছুড়তে ব্যস্ত। কারণ সে টের পেয়েছে যে চারিদিক হতে কোনো এক দল তাদের ঘিরে ফেলেছে। যেকোনো সময়ই তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়বে। কিন্তু কে কিংবা কারা তা ইবাতের জানা নেই। শমসের ছাড়াও স্যারের শত্রুর অভাব নেই। ব্যবসার সমীকরণে অনেক মানুষের পেটেই লাথি মেরেছে হিরণ। তাদের কোনো দল নাকি?
ইবাত গুলি ছুড়তে ছুড়তে পিছিয়ে যেতে থাকে। ঠিক ওই মুহুর্তেই হিরণ পিস্তল হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ইবাতের কাছে এসে জানতে চায়,
“ কোন শুয়োরের বাচ্চার কলিজা এতো বেড়ে গেসে যে আমার বাড়ির ত্রী সীমানায় পা রেখেছে? “
ইবাত উত্তর দিতে পারে না। তার আগেই বাহির থেকে আরেকটা টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা হয়। এবার হিরণও কাশতে শুরু করে। ইতিমধ্যে ধোঁয়ার সুযোগটা লুফে নিয়ে বিপরীত দল হিরণের বেশ অনেক জনকে গুলি ছুড়ে জর্জরিত করে ফেলেছে। হিরণ পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ চেপে ধরে কাশতে কাশতে লক্ষ্য করে তার বাড়ির উঁচু দেয়াল টপকে কালো দড়ি জাতীয় কিছু একটার সাহায্যে একদল বাড়ির সীমানার ভিতরে প্রবেশ করছে। পরনে তাদের জংলী ছাপের ইউনিফর্ম। হিরণ, ইবাতসহ সকলেই আঁতকে উঠে। সেনাদল এখানে? হিরণ লাগাতার গুলি ছুড়তে ছুড়তে বলে উঠে,
“ কুত্তার বাচ্চারা ঠিকানা খুঁজে পেলো কিভাবে? “
স্যার উত্তেজিত হয়ে পড়েছে টের পেতেই ইবাত ঘামতে শুরু করে। এখানে বুলেট অপচয় করার মানে হয় না। তাদের বাঁচতে হলে এই মুহুর্তেই পালাতে হবে এখান থেকে। সে দ্রুত হিরণের বাহু চেপে ধরে তাকে টেনে বাড়ির ভেতর নিয়ে যেতে যেতে বলে,
“ স্যার আমাদের এক্ষুনি পালাতে হবে। স্যার সময় অপচয় করা যাবে না। চলুন। “
ইবাতের তাড়া পেতেই হিরণের মস্তিষ্ক সচল হয়। বুঝতে পারে এইখান থেকে এই মুহুর্তে না পালালে খুব বড় এক ঝামেলায় ফাসবে সে। এই কুকুর গুলোকে সে পরে শায়েস্তা করে নিবে কিন্তু এই মুহুর্তে পালানো অতি প্রয়োজনীয়। হিরণ, ইবাত দ্রুত আরো সাত আটজন সহ ঘরের ভেতর প্রবেশ করে দরজা আটকে দেয়। হিরণ দ্রুত উপরের দিকে যেতে নিলেই ইবাত তাড়া দেয়,
“ স্যার। উপরে কোথায় যাচ্ছেন? “
হিরণ গরম গলায় জবাব দেয়,
“ ডোন্ট বি ষ্টুপিড ইবাত। বাণী আর বহ্নিকে ফেলে যাবো আমি? নেভার। “
“ স্যার ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড আমাদের হাতে এতো সময় নেই। “
ইবাত কথাটুকু উচ্চারণ করতে করতে বাহিরে গোলাগুলির পাশাপাশি দরজায় শক্তিশালী পা দ্বারা আঘাতের শব্দ ভেসে আসে। ইবাত দ্রুত হিরণের হাত চেপে ধরে বলে,
“ স্যার আপনার বেঁচে থাকাটা জরুরি। উই আর লুজিং পাওয়ার হেয়ার। বাণী ম্যাডাম আর বহ্নি উইল বি সেফ। আরাভ আর আয়ান উনাদের নিয়ে আসবে। আমাদের এখুনি বের হতে হবে। “
হিরণ তবুও যেতে রাজি হয় না। ইবাত সহ আরো কয়েকজন একপ্রকার ওকে টেনে হিচড়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। ইবাত ইশারায় আরাভ আর আয়ানকে বলে যেনো বাণী ও বহ্নিকেও পিছু পিছু নিয়ে আসে। মুখে এটা বললেও ইবাত জানে বাণী ও বহ্নিকে নিয়ে আরাভরা কখনোই পৌঁছাতে পারবে না। তাদের হাতে এতো সময় নেই। কিন্তু এক সঙ্গে সবাই ডোবার থেকে দু জনকে সাময়িক ডুবতে দেওয়া উত্তম বলে মনে হয় তার। আর তাছাড়াও পাপে তারা জড়িত। বাণী ম্যাডাম আর বহ্নি এসব সম্পর্কে জানে না। বাংলার নীতিবান সৈন্যরা নিশ্চয়ই তাদের কোনো ক্ষতি করবে না?
মস্তিষ্ক এরকম বিভিন্ন চিন্তার হিসাব দ্বারা যখন আলোড়িত, সেই সময় গ্রাউন্ড ফ্লোরের এক নির্দিষ্ট রুমের ভেতর প্রবেশ করে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়ে দিয়ে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হয় হিরণেরা। এই সুরঙ্গ পথ দুই কিলোমিটার দীর্ঘ। এরকম সিচুয়েশনের জন্য হিরণ এই পথ তৈরী করেছিলো। কিন্তু কে জানতো, আজ যখন সত্যিই এই পরিস্থিতি এসেছে তখন তাকে বাণী আর বহ্নিকে ফেলে যেতে হবে তার। হিরণ মলিন মন নিয়েও দ্রুত পালানোর জন্য সুরঙ্গ পথ ধরে এগোতে শুরু করে। তার পিছু পিছু বাকিরাও। ইবাত তাদের অনুসরণ করার জন্য পথ বন্ধ করতে নিলেই হিরণ বাধ সাধে। অস্ফুটে বলে,
“ বহ্নি আর বাণীকে নিয়ে ওরা আসবে। পথ খোলা রাখো। “
ইবাত আর প্রতুত্তর করে না। হিরণের কথা মেনে নেয়।
__________
রুমের লাইট বন্ধ করে রুমের এককোণে মেয়েকে কোলে জড়িয়ে বসে আছে বাণী। ভয়ে তার শরীরের প্রতিটা লোমকূপ দিয়ে শীতল হাওয়া বইছে। বাহিরের এই গোলাগুলির শব্দ তার কলিজা কাপিয়ে তুলছে। বুকের ভেতরটা অবিরত ধ্বক ধ্বক করছে। কোলে বসে থাকা বহ্নি অবুঝের ন্যায় তাকিয়ে আছে। তার কানে এখনো হেডফোন। মিউজিক চলছে হাতে থাকা ছোট ব্লু টুথ রেডিও হতে।
আচমকা নিজের রুমের দরজায় কারো করাঘাতের শব্দে বাণী কেপে উঠে। গলা শুকিয়ে যেনো তৃষ্ণার্ত পথিকের ন্যায় খাঁ খাঁ করছে। এই দরজায় করাঘাতের শব্দটা বড্ড অপরিচিত। হিরণ এভাবে দরজায় করাঘাত করে না। তাহলে কে? মনে মনে আল্লাহকে ডাকে সে। প্রার্থনা করে যেনো ওই জালিম লোকটার পাপের শাস্তি বহ্নিকে না ভুগতে হয়। এই পরিস্থিতিতে বাণীর সকল চিন্তা, ভয় এবং উৎকণ্ঠা বহ্নিকে ঘিরেই।
বাণীর ভাবনার মাঝেই বাহির থেকে একটা পুরুষালী গলা বলে উঠে,
“ ম্যাডাম আমি আরাভ। দরজা খুলুন। পরিস্থিতি ভালো না। আপনাদের দ্রুত এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে। হিরণ স্যারের অর্ডার। “
বাণী কথাটুকু শুনে। অত:পর সামান্য ভরসা খুঁজে পায়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় সে দরজা খুলবে। এই পরিস্থিতিতে বহ্নিকে নিয়ে এখানে থাকা সম্ভব নয়। সে যেই না দরজা খোলার উদ্দেশ্যে উঠতে নেয় সেই মুহুর্তে আবার পরপর দুটো গুলি বর্ষণের শব্দ ভেসে আসে। এবার আরো কাছ থেকে, আরো নিকট থেকে, ঠিক দরজার অপর পাশ হতে। বাণী এবার ভয়ে মৃদু গোঙিয়ে উঠে। তার ভয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে দরজায় জোরে জোরে কারো আঘাতের শব্দ ভেসে আসে। এই বুঝি দরজাটা ভেঙে ফেললো। বাণীর এবার ভয়ে চোখে অশ্রু এসে ভীড় করে। সে দ্রুত মেয়ের কপালে একটা চুমু খেয়ে মেয়েকে নিজের বুকে লুকিয়ে নেয়। যেই খুনাখুনির সাক্ষী সে কখনো নিজের মেয়েকে হতে দেয় নি আজ বুঝি তার নিষ্পাপ মেয়ে সেই দৃশ্যেরই সাক্ষী হবে?
একের পর এক ভয়ংকর শব্দ তুলে হওয়া আঘাতে অবশেষে দরজাটার লক ভেঙে যায়। স্ব শব্দে দরজাটা খুলে যেতেই বাণী ভয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে ফেলে। অন্ধকার রুমটায় কেউ একজন ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে সে তা স্পষ্ট টের পাচ্ছে। এগিয়ে এসে তার মুখের দিকে খুব সম্ভব আলো জাতীয় কিছু একটা তাক করেছে তাও টের পায় বাণী। তবুও সে চোখ মেলে না। সে এই ভয়ংকর দৃশ্যটুকুর সাক্ষী হতে রাজি নয়। জীবনটা তবে হিরণের কোনো এক শত্রুর হাতেই শেষ হবে তার? এতো বছর ধরে তার বেঁচে থাকাটা বৃথা ছিলো? মুক্তির স্বাদ আর তার পাওয়া হলো না?
“ হেই বাণী। ইট’স মি। ভয় পেও না। “
হঠাৎ খুব কাছে পরিচিত স্পষ্ট কণ্ঠস্বর কানে এসে পৌঁছাতেই বাণীর ভাবনার ইতি ঘটে। চকিতে চোখ মেলে তাকায় সে। অন্ধকার রুমে সামনে হাঁটু ভেঙে বসা মানুষটার হাতের টর্চের আলোয় বাণী দেখতে পেলো ইউনিফর্ম পরিহিত পুরুষটাকে। মুখে রুমাল জাতীয় কিছু একটা বাঁধা। কিন্তু সেই বজ্রের ন্যায় গম্ভীর এবং ঈগলের ন্যায় বুদ্ধিদীপ্ত চোখ জোড়া চিনতে ভুল করে না বাণী। একটুও ভুল করে না। সামনের মানুষটা বাণীর বিস্ময় ভরা দৃষ্টি দেখে সামান্য নরম গলায় জানতে চায়,
“ ডিড আই স্ক্যার ইউ? “
বাণী উত্তর দিতে পারে না। সে চরম আপ্লুত হয়। এই মানুষটা এসেছে। তাকে মুক্ত করতে এসেছে। ভাবনাটা বাণীর চোখের টলমল করা অশ্রুকে গাল ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। সামনের মানুষটা তা দেখে। মুখে বাধা রুমালের আড়ালে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে শুধায়,
“ এটাই শেষবার বাণী তালুকদার। আর কখনো পালাতে হবে না তোমার। এই ত্রিসীমানার গন্ডি পেরোলেই তুমি মুক্ত। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]