তবু_সুর_ফিরে_আসে ২১তম পর্ব

0
170

#তবু_সুর_ফিরে_আসে

২১তম পর্ব

ন‌ওশাদ ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে অদ্ভুত এক অস্বস্তি নিয়ে হেরার জন্য নিজের ঘরে অপেক্ষা করছে। বুবু যা শুরু করেছে ! আজকে তো মাত্র এসেছে সামনের দিন গুলো তো পরেই আছে ! আর কি কি করবে কে জানে ?
ন‌ওশাদ ল্যাপটপ টা খুলে বসলো ! কিন্তু কাজে মন বসাতে পারছে না ! বারবার চোখ দরজায় চলে যাচ্ছে !
হঠাৎ দরজায় শব্দ হতেই তাকিয়ে দেখে, আনারের মা পানির বোতল নিয়ে এসেছে ! বেড সাইড টেবিলে রেখে চলে গেল !
ন‌ওশাদের এখন খুবই বিরক্ত লাগছে ! মনে হচ্ছে হেরাকে ডেকে বলি এ ঘরে আসার হলে চলে এসো ! পরোক্ষনে চিন্তা করলো আচ্ছা আমি এত মেজাজ খারাপ কেন করছি ! বুবু তো খারাপ কিছু বলেনি ! বিয়ে যখন হয়েছে এটাই তো স্বাভাবিক ছিল হেরার এই ঘরে থাকাটা ! আমার মনে যাই ছিল দশ জনের সামনে এভাবে হেরাকে হাসাহাসির পাত্রী বানিয়ে ফেললাম !
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে যথেষ্ট রাত হয়েছে , কি করছে হেরা ?
আবার দরজায় শব্দ হতেই ন‌ওশাদ এবার আর চোখ তুলে তাকালো না । আড় চোখে তাকিয়ে দেখে হেরা আর বুবু দরজায় দাঁড়িয়ে আছে !
ন‌ওশাদ ইচ্ছে করেই ল্যাপটপ থেকে চোখ সরালো না !
যাও নিজের ঘরে হেরা ! সকালে কথা হবে তোমার সঙ্গে । বুবু হেরাকে রুমে নিয়ে এসে বলল ।
হেরা চুপ করে আছে।
বাবু !
হুঁ !
এত রাতে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিস কেন , সকালে অফিস যাবি না ?
একটু কাজ আছে শেষ করতে হবে !
আমি যাচ্ছি হেরা থাকো , হেরার গালে হাত ছুঁয়ে দিয়ে বুবু রুম থেকে বের হয়ে গেল।
আজকের মতো এত অস্বস্তি আগে এই ঘরে ঢুকে হয়নি কখনো! হেরা কি করবে চিন্তা করছে। ন‌ওশাদ খুব মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করেই যাচ্ছে!
হেরা সোফায় গিয়ে বসলো ! গতকালকেও এই ঘরটাতে কতটা সহজ হয়ে আসা যাওয়া করেছে! আর আজ নিজেকে এই ঘরে থাকতে হবে ভেবে কেমন কেমন লাগছে। এর ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছে না হেরা ! বুবু মানুষটাকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। কত আদর করে কথা বলে সবার সঙ্গে। সবাই কে খুব শাসনের উপরেও রাখছে আবার। ন‌ওশাদ আর তার ভাইদের একটুক্ষনেই খুব খবরদারি করলেন তিনি। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় যে শ্বশুর সব কথা ভুলে যায় সেই মানুষ মেয়ে কে দেখে পুরো নরমাল। আজ তিনি জীবিত স্ত্রী না মৃত স্ত্রী কেই স্মরণ করলেন বারবার। এমনকি ছেলের ব‌উ গীতি যে মারা গেছেন সেটাও মনে করলেন । ছেলেটাও তার মত একা হয়ে গেছে বলে আফসোস করলেন। বুবু তখন হেরাকে দেখিয়ে বলেছে, আব্বা বাবুর জন্য চিন্তা করো না দেখো ওর আর তোমার দেখাশোনা র জন্য একটা পরী নিয়ে আসছি !
শ্বশুর হেরাকে দেখে বলল,ভালো করেছিস জান্নাত!
বৌমা ছাড়া এই বাসা চলবে কিভাবে ? আমার নিশাল দাদু ভাইকে কে দেখবে ? চোখের পানি ও ফেললেন তিনি। হেরার মাথায় হাত রেখে আদর করলেন।
হেরা মনে মনে ভাবছে হয়তো আবার কালকে সকালেই সব ভুলে যাবেন !
হঠাৎ ন‌ওশাদ বলল,হেরা কি ভাবছো ?
জ্বি !
কিছু যেন ভাবছিলে ?
তেমন কিছু না , আব্বা আজ কত নরমাল তাই না !
হুম, বুবুকে দেখে !
খুব ভালো লাগছে বুবুকে , সবাইকে কত আদর করেন !
শাসন করে সেটা দেখলে না তুমি !
হুম দেখলাম আপনারা সবাই কত ভয় পান ! হেরা হাসছে !
ও এমন‌ই আদরে, শাসনে রাখবে । অনেক বড় তো আমার থেকে !
তুমি এত জড়সড় হয়ে বসে আছো কেন , বি ইজি !
আমি ঠিক আছি! আপনার কিছু লাগবে ?
না কিছু লাগবেনা ! ন‌ওশাদ হেরার দিকে তাকালো, সন্ধ্যায় যে শাড়ি পড়ে ছিল সেই শাড়িটা পড়েই আছে এখনও হেরা! খোঁপার ফুল গুলো একটু নেতিয়ে পড়েছে । কিন্তু ওর মুখটা আগের মতই সুন্দর লাগছে! চোখ গুলো সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় সব সময়ই ! দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে নার্ভাস । ন‌ওশাদ ওকে নরমাল করার জন্য বলল, তুমি কি কোন কারণে ডিস্টার্ব ?
না তো !
হেরা এদিকে এসো ! ন‌ওশাদ ল্যাপটপ টা বন্ধ করে দিলো !
হেরা উঠে ন‌ওশাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
আজ এই মুহূর্ত থেকে এই ঘরে তোমার জীবন শুরু হলো ! তোমার না শুধু ,তোমার আর আমার দু’জনের ! এই ঘরে অনেক দিন থেকেই তুমি আসছো আজ তোমাকে দেখে খুব ডিস্টার্ব মনে হচ্ছে !
সেরকম কিছু না হেরা গলা নামিয়ে বলল।
প্লিজ তুমি এভাবে থেকো না , তাহলে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হবে !
না না আমি ডিস্টার্ব না ! একটা কথা বলব প্লিজ আপনি কিছু মনে করবেন না তো !
হ্যাঁ বলো । ন‌ওশাদ হেরার দিকে তাকিয়ে আছে!
আপনি কালকেই আমার কাছ থেকে সময় চাইছিলেন আর আজ বুবু আমাকে এই রুমে নিয়ে এলো ! আমি নিজেও প্রস্তুত ছিলাম না ! এটা ঠিক কক্সবাজারে দুই রাত আমরা এক ঘরে ,এক বিছানায় ছিলাম কিন্তু সেটা অন‌্য একটা ব্যাপার ছিল ! এই ঘর আর হোটেলের রুম পুরোই আলাদা ব্যাপার।
এই ঘরে ,এই বেডের সঙ্গে আপনার ইমোশন টা কে আপনার মত আমিও রেসপেক্ট করতে চাই !
তো ?
বলছিলাম বুবু যতদিন আছে আমি এই ঘরে এই সোফাটায় থাকব পরে না হয় আমার ঘরে চলে গেলাম !
ন‌ওশাদ খুব অবাক হয়ে গেল ! হেরা তুমি এত গভীর ভাবে চিন্তা করো আমি সত্যিই সারপ্রাইজ !
কাছে আসো , হাতটা দাও তোমার ! ন‌ওশাদ হেরার হাতটা ধরে পাশে বসালো হেরাকে !
তোমাকে আজকের পরে আর এই ঘর থেকে যেতে হবে না কোথাও ! হ্যাঁ সময় টুকু নিব তোমার কাছ থেকে তাই বলে তোমাকে এ ঘরের বাহিরে যেতে হবে না কখনো !
হ্যাঁ যদি না তুমি আমার সঙ্গে রাগ করে ঘরের বাহিরে চলে না যাও কিংবা আমাকে বের করে না দাও !
ন‌ওশাদ হাসছে!
ওমা ছিঃ আপনাকে কেন বের করে দিব !
ও তুমি বের হয়ে যাবে হেরা ?
না না আমি আপনার উপর রাগ করব‌ই না কখনো !
দেখা যাক রাগ করো কিনা !
হেরা বলল,আমি এই বড় সোফাটায় থাকলে কোন সমস্যা হবে আপনার ?
অবশ্যই সমস্যা হবে !
এত কিছুর র দরকার নেই হেরা । তুমি বিছানায়‌ই থাকবে !
প্লিজ আপনি আমার এই অনুরোধ টুকু রাখবেন ! আমিও আপনার মত নিশালের মায়ের উপর শ্রদ্ধা বোধ থেকেই থাকতে চাই না এই বিছানায় ! প্লিজ ! হ্যাঁ কেউ শুনলে বলবে বিছানায় থাকা এটা কোন কিছু হলো , আমি তো মানুষটাকেই দখল করে নিয়েছি ! কিন্তু এই বেডটা তো শুধু বেড না আপনার অনেক বড় স্মৃতি । আমি সেটা নষ্ট করতে চাই না !
ঠিক আছে ! আমি এর সমাধান জলদি করব ততদিন তোমার যা ইচ্ছা !
থেঙ্কস !
আচ্ছা হেরা , আমাকে দখল করে নিয়েছো বুঝি ?
হেরা সঙ্গে সঙ্গে জিব কাটলো না না আমি কথাটা সেভাবে বলিনি । কথার কথা হিসেবে বলেছি ! ছিঃ
আমি বুঝতে পেরেছি !
তোমাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে! আমি তো গাড়ি থেকে নেমে তোমাকে দেখে স্টপ হয়ে গিয়েছিলাম ! শাড়ি পড়লে তোমাকে অন্য রকম লাগে !
কেমন লাগে ?
বড় বড় লাগে !
ন‌ওশাদ ল্যাপটপ টা গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলল, তুমি আর নিশাল কি কথা বলছিলে বুবু আসার পর। আমি আব্বার ঘর থেকে দেখছিলাম ?
কখন ? ও আচ্ছা তখন ওর ছোট চাচী মজা করে বলছিল নতুন মাকে কেমন লাগলো ওর ! আমার জন্য ও অপ্রস্তুত হচ্ছে সেটাই বললাম ওকে।
এ গুলো কি কথা ! মিলা কথা বেশি বলে তাই বোঝে না কাকে কি বলতে হবে ! নিশাল কি ছোট বাবু নাকি যে এসব কথা ওকে বলতে হবে ! এদের কোন কান্ড জ্ঞান নেই !
বাদ দিন, নিশাল অনেক ম্যাচিউর ছেলে!
আমার সামনে এসব বলার সাহস পায় না এরা !
ন‌ওশাদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো !
হেরা তুমি তোমার ড্রেস চেঞ্জ করে নাও ! ন‌ওশাদের কথার সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রিসিটি চলে গেল । ঘর অন্ধকার হয়ে গেল !
কি ব্যাপার আইপিএস চালু হচ্ছে না কেন ?
ন‌ওশাদের বুকে একটা ধাক্কা লাগলো । একুশ বছর আগে সেই রাতেও ইলেকট্রিসিটি ছিল না । কিন্তু আজ তো ঝড় নেই ডিসেম্বরের শীতের রাত আজকে কেন ইলেকট্রিসিটি চলে গেল ! প্রকৃতি কি আবার তাকে পেছনে টানতে চাইছে ?
কি ব্যাপার ? ন‌ওশাদ বিরক্ত হয়ে রিয়াজ কে কল দিল !
সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রিসিটি চলে এসেছে !
হ্যালো রিয়াজ আইপিএসের কি সমস্যা ?
দেখতেছি স্যার !
ভালো করে দেখো ! এমন কেন হলো খেয়াল করো।
জ্বি স্যার !
ফোন রেখে ন‌ওশাদ কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইল!
তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো !
হেরা গলা নামিয়ে বলল, আসলে হয়েছে কি আমার কাপড় গুলো ও ঘরেই রয়ে গেছে ! এখন আনতে গেলে বুবুকে ডাকতে হবে !
না না ওকে ডেকো না , তুমি এখন এঘর থেকে বের হলে আমাকে কথা শোনাবে বুবু !
সেজন্যই বলছি আমি শাড়িটা পড়েই থাকি !
ঠিক আছে !
হেরা তোমাকে কিছুদিন থেকে একটা কথা বলব ভাবছি কিন্তু ভুলে যাই !
জ্বি বলুন !
তুমি এখানে এসেছো অনেক দিন হলো তুমি তোমার নানার সঙ্গে কথা বলেছো ?
হেরা মাথা নিচু করে ফেলল, না !
সে কি উনি তোমার কথা ভেবে চিন্তা করছেন হয়তো !
হেরা মাথা নিচু করেই বসে র‌ইল !
কালকে আমাকে বলবে আমি তুমি দুজনেই কথা বলব উনার সঙ্গে ঠিক আছে !
হেরা বলে উঠলো,না !
না কেন ? আশ্চর্য!
আসার সময় নানা আমাকে কিছু কথা বলে ছিলেন !
কি কথা ?
আমি যেন কখনও ওখানের কারো সঙ্গে যোগাযোগ না করি ! জীবনের পরিস্থিতি যাই হোক গ্রামে যেন ফিরে না যাই !
সে কি ! তুমি তো এখন ভালো আছো তোমার নানা শুনলে খুব খুশি হবেন !ন‌ওশাদ অবাক হয়ে বলল!
নানা জানেন আমি ভালো আছি!
কিভাবে , কথা হয়েছে ?
নানা আসার সময় বলেছেন, তুই ন‌ওশাদের সঙ্গে যখন যাচ্ছিস আমি জানি তুই খুব ভালো থাকবি ! ভুলেও এখানে ফিরে আসবি না ! আমি মরে গেছি শুনতে যদি পাস তাও দেখতে আসবি না ! এই গ্রাম, তোর মামারা , মামিরা আজকের পর তোর কেউ না ! তোর একমাত্র পরিচয় তুই ন‌ওশাদের স্ত্রী ! তোর কোন অতীত নেই , কোন শিকড় নেই ! তুই আজ থেকে যেভাবে ন‌‌ওশাদ রাখবে সেভাবে থাকবি । প্রয়োজনে ওর দাসী বাদি হয়ে থাকবি তাও এদিকে ফিরে আসবি না !
কি বলছো এসব হেরা !
হেরার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে ! সত্যি বলছি ! আমি সেদিন জানতাম না আপনি এরকম একটা বিয়েকে সন্মান দিবেন‌ ! আমি ধরে নিয়েছিলাম আপনার বাসায় সত্যি সত্যি কাজের মানুষ হয়ে থাকব ! তবুও থাকব ! ন‌ওশাদ হেরার হাত ধরলো !
হেরা বিয়েটা আমি ক্ষনিকের সিদ্ধান্তে করেছি ঠিক কিন্তু বিয়ে আমার কাছে বিয়েই কোন হাসি মজার ব্যাপার না !
আমি এখন বুঝি আপনি আসলে কেমন মানুষ ! আমার অনেক বড় ভাগ্য যে আপনার মত মানুষের সঙ্গে আছি ! আমি অনেক খারাপ খারাপ মানুষ দেখেছি তো জীবনে ! আপনি জানেন কতটা কষ্ট পেলে নানা আমাকে এই কথা বলে ! আমি নানার কথা রাখব , আমি যাব না !
কথা তো অন্তত ফোনে বলা যায় নাকি ?
না ! নানার মোবাইল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তারপর আর ঠিক হয়নি । মামিদের ফোনে ভুলেও ফোন দিব না ! হেরা কঠিন গলায় বলল!
আচ্ছা ঠিক আছে আমি ব্যবস্থা করব তুমি কথা বলবে সরাসরি তোমার নানার সঙ্গে দুই দিনের মধ্যে ! প্রয়োজনে আমার লোক ঢাকা থেকে ওখানে যাবে কথা বলিয়ে ফেরত চলে আসবে !
এত কষ্ট করতে হবে না।
আমি তোমার জন্য এতটুকু করতেই পারি হেরা !
আমি জানি ! আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করতে পারেন ! আমি আপনার এখানে স্বপ্নের মত বেঁচে আছি । প্রতিদিন প্রতিটা মুহুর্তে মনে হয়, কি জীবন পার করেছিলাম আর আজ আপনি আমাকে কোথায় এনে রেখেছেন !
হেরা কার্পেটে বসে সোফায় উপুড় হয়ে কাঁদছে !
তাকাও এদিকে হেরা !
ন‌ওশাদ ওর পাশে ফ্লোরে বসলো ,তাকাও আমার দিকে হেরা ! এই প্রসঙ্গ টা আসলে তুমি এভাবে কাঁদবে জানলে আমি তুলতাম না ! সরি !
আপনি জানেন না আমি যখন আপনার দিকে তাকিয়ে দেখি তখন কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে যায়।
এসব কথা বাদ দাও এখন !
প্লিজ আজ বলব আপনাকে !
আমি শুনতে চাইছি না !
আজকে ই বলব আর বলব না , আমি যখন এই বাসায় খেতে বসি আমার বারবার কি মনে হয় জানেন, এত কিছু আমার রিজিকে রেখেছেন আল্লাহ ! আমি বাড়িতে রান্না করতাম এত গুলো মানুষের রান্না কিন্তু খাওয়ার সময় আমার জন্য সামান্য কিছু থাকতো । কত দিন নানাকে দেয়ার পর আমার জন্য সামান্য খাবার ও থাকতো না । আমি নানাকে মিথ্যা বলতাম খেয়েছি ঠিক মত ! আমাকে একটা ভালো জামা এনে দিলে নানার ওষুধ কেনার টাকা থাকতো না ! আমাকে মামিদের পুরোনো , ছেড়া জামা গুলো দিতো পড়তে ! আমি ওসব নিতাম না আমার আত্মসম্মানে লাগতো।
আমি কলেজে গেছি বোরকা পড়ে । বোরকার নিচে জামা ছিল ছেঁড়া, ফাটা ! সেলাই করে করে পড়তাম ! তাও কারো দয়া দাক্ষিন্য নিতে ইচ্ছে করতো না !
আমার একটা ব‌ই কিনে দিতে নানাকে কষ্ট করতে হতো অনেক!
আপনি জানেন দশ হাজার টাকার জন্য ছোট মামি নুরুলের ভাইয়ের কথায় রাতে আমার ঘরের ছিটকিনি খুলে রেখে দিল ! একটা মেয়ে হয়ে পারলো এটা করতে ! সেই সব মানুষদের জন্য আমার ভেতরে কোন অনুভূতি নেই ! ঘৃণা ছাড়া ! আর সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি আমার মা বাবাকে !
ওরা আমার জীবনটাকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে রেখে গেছে ! একটা সময় নিজেকেও ঘৃণা করতাম। এই চেহারাটাকে ঘৃণা করতাম কেন এই চেহারা আল্লাহ দিয়েছে যার জন্য এত দূর্গতি আমার জীবনে !
ন‌ওশাদ হেরার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো !
আজ দেখুন আপনার দেয়া কি নেই আমার , আমি যে শাড়িটা পড়ে আছি, যে গয়না পড়ে আছি এগুলো কোন দিন চোখেও দেখিনি ! আরে খেতেই তো পারতাম না !
হেরা, প্লিজ হেরা এভাবে কাঁদে না তোমার শ্বাস কষ্ট হবে আবার !
সেজন্যই আমি চাই আপনি আপনার মত আমাকে সন্মান দিন ! যেদিন ইচ্ছা কাছে টানুন কিংবা দূরে সরিয়ে রাখুন আমি আপনার সিদ্ধান্ত কে সন্মান দিব ! প্রয়োজনে সারাজীবন আপনি দূরে রাখলেও দূরেই থাকব !
চুপ হেরা অনেক হয়েছে নাও প্লিজ স্টপ !
হেরা হাত দিয়ে চোখ চেপে ধরে কাঁদছে !
এখন কান্নাকাটি বন্ধ করো , ন‌ওশাদ হাত বাড়িয়ে হেরা কে নিজের দিকে টানলো !
দেখি হেরা ইস সুন্দর চোখ গুলো লাল করে ফেলেছে কেঁদে ! আমার‌ই ভুল হয়েছে আজকে রাতে এই প্রসঙ্গে টা তুলে ! কিভাবে ফোপাচ্ছে কেঁদে কেঁদে !
ন‌ওশাদ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার জন্য বলল, দেখি আমার পছন্দের টিপ টা কোথায় ? টিপ তো কপাল থেকে আকাশে উঠে গেছে , দাড়াও সুন্দর করে লাগিয়ে দিচ্ছি ! ন‌ওশাদ হেরার টিপ ঠিক ভাবে পড়িয়ে দিল তারপর আগের দিনের মত টিপের উপর চুমু খেল ! হাত দিয়ে হেরার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো । এখন ঠিক আছে , তোমার এই টিপটা দেখলে মনে হয় একটা তারা জ্বল জ্বল করছে । সুখ তারা !
হেরা কপাল থেকে টিপটা তুলে বাম চোখের উপর লাগালো ন‌ওশাদ হেরার মুখের উপর ঝুঁকে চোখে চুমু খেল, হেরা এবার টিপ তুলে নিজের গালে লাগালো ন‌ওশাদ গালে চুমু খেল , হেরা টিপটা নিজের নাকে লাগিয়ে দিল ন‌ওশাদ নাকে চুমু খেলো । এবার ন‌ওশাদ নিজেই টিপ টা তুলে হেরার ঠোঁটে লাগিয়ে দিল, হেরা সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঠোঁট হাত দিয়ে চেপে ধরলো !
ন‌ওশাদ হেসে বলল,হাত সরাও হেরা !
উঁহু !
ভালোই তো লাগছে খেলাটা চলুক না ! দেখি না টিপ কোথায় কোথায় নিয়ে যায় আমাদের !
উঁহু!
দেখি দেখি ! আমার সঙ্গে দুষ্টামি করে পারবে না ,আমি অনেক বড় দুষ্টো !
হেরা ন‌ওশাদের ঠোঁট দুটো হাত দিয়ে স্পর্শ করলো ! তার অনেক দিনের ইচ্ছে পূরণ করলো ! ন‌ওশাদের চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব সুখ সে স্পর্শ করে আছে ! তবুও কেন জানি হেরার চোখ ভিজে উঠলো আবার ! ন‌ওশাদ মাথা নেড়ে না করলো কান্না হবে না আর !
তোমার জন্য একটা জিনিস আছে এখানে হেরা !
কি ?
ন‌ওশাদ টেবিল থেকে বুবুর দেয়া বক্স টা হেরার হাতে তুলে দিলো !
কি আছে এটাতে ?
খুলে দেখো !
কিভাবে খুলব ?
দাঁড়াও খুলে দিচ্ছি ! ন‌ওশাদ বক্স খুলে চেইন টা বের করলো ! এটা বুবু আমাকে দিয়েছে তোমাকে দেয়ার জন্য !
এত গিফটের পর এটা কেন ?
এটা আমাদের দাদী বুবুকে দিয়েছিল বুবু এটা তোমাকে দিয়েছে কারণ টা ওর কাছ থেকে জেনে নিও!
কি কারণ ?
বুবু বলবে !
ঠিক আছে !
এখন এসো পড়িয়ে দেই ,তুমি পড়ে আছো দেখলে খুশি হবে বুবু !
হেরার পিছনে বসে ন‌ওশাদ আগের পড়া গয়না টা খুলে বুবুর দেয়া চেইন টা পড়িয়ে দিল !
হেরা কক্সবাজারে ঐ বদমাইশ লোকটা তোমার পিঠে হাত দিয়েছিল খুব কষ্ট পেয়েছিলে তাই না ?
খুব!
ন‌ওশাদ হেরার খোলা পিঠে ঠোঁট ছোয়ালো , হেরার সমস্ত শরীর ঝাকুনি খেয়ে উঠলো । ন‌ওশাদ অনেকক্ষণ ওভাবেও হেরার পিঠে নিজের গালটা লাগিয়ে বসে রইল ! ওর বুকের ভেতরে কেমন যেন এক তোলপাড় চলছে‌! কখনও সৃত্মি তাকে পিছনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কখনো তার মন হেরা কে আঁকড়ে ধরতে চাইছে ! অনেক ঝড় তার ভেতরে ব‌ইছে ! চুপ করে সে সেই ঝড় কে সামলানোর চেষ্টা করছে!
হেরা বুঝতে পারছে ন‌ওশাদ তার কষ্ট কমাতে চাইলেও নিজের কষ্টে কত টা ছটফট করছে ! না জানি কত পুরনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে উনার !
অনেক রাত হয়ে গেছে চলো ঘুমাই হেরা ! আর একটা কথা এখন থেকে সুমনার ডিজাইনের এত বড় গলা দিয়ে ব্লাউজ বানাবে না । তোমার এই সুন্দর পিঠ শুধু আমার দেখার জন্য । আর কেউ দেখলে আমার মেজাজ খারাপ হয় !
ঠিক আছে !
তুমি সোফায় থাকবে আমার তো খারাপ লাগছে হেরা !
কোন খারাপ লাগার কিছু নেই আপনি জায়গা মত গিয়ে শুয়ে পড়ুন তো !
আমি এই ইজি চেয়ারে থাকব !
কেন ?
উঁহু কথা শুনব না । আমি একজন কে সন্মান দিব সেটা ঠিক আছে কিন্তু আরেকজন কষ্ট করে শুয়ে থাকবে ওর কাছাকাছি তো থাকতেই পারি অন্তত !
ঠিক আছে!
ন‌ওশাদ ঘরের আলো নিভিয়ে দিলো !
পুরো অন্ধকার করবেন না আমার নিঃশ্বাস বন্ধ লাগে !
কিভাবে তোমার ভালো লাগে সেভাবে আলো দাও !
হেরা ঘরের কোনার দিকের একটা আলো‌ জ্বালিয়ে রাখলো !
আপনার কষ্ট হবে এভাবে ঘুমাতে ?
মোটেও না !

ন‌ওশাদ বড় ইজি চেয়ার টাতে আধ সোয়া হয়ে কমফোর্টার গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে ! চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছে, সে ভেবেছিল আজ হেরাকে বুবুর দেয়া চেইনটা দিবে না , কিন্তু কি হয়ে গেল সে নির্দ্বিধায় গিফট টা হেরাকে পড়িয়ে দিল ! আচ্ছা সে কি সত্যি সত্যি হেরা কে ভালোবাসে ফেলছে ? নিজের মনকে প্রশ্ন করলো! এটা ভালোবাসা হয়তো নয় কিন্তু কিছু অনুভূতি তো অবশ্যই তৈরি হচ্ছে ! আর সেই অনুভূতিটা তাকে ভালোলাগায় ভরিয়ে দিচ্ছে। দেড় মাস আগে সে কল্পনাও করতে পারেনি হেরাকে এত সহজে নিজের কাছে টেনে নিতে পারবে ! হেরার সৌন্দর্য তাকে টানছে কি ? সৌন্দর্য টানলে তো গত ছয় বছরে অনেক সুন্দরী রমণী তাকে অনেক ভাবে কাছে টানার চেষ্টা করেছে কিন্তু সে তো তাদের মোহে পড়েনি একবারও ! হেরার মাঝে কিছু একটা আছে যা তাকে বারবার চুম্বকের মত টানে । জীবনে অনেক খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন সে হয়েছে অনেক কিছু সে বোঝে তাই তো ন‌ওশাদের গীতির প্রতি ফিলিংস টাকে সে সন্মান দিচ্ছে ! এটাও আরো বেশি ন‌ওশাদ কে অভিভূত করেছে।
শুধু কৃতজ্ঞতা থেকে না হেরা তুমি ভালোবেসে আমাকে আঁকড়ে ধরো আমি তোমাকে নিয়েই বাকি জীবনটুকু বেঁচে থাকতে চাই!
চোখ মেলে দেখে হেরা ঘুমিয়ে গেছে ! সোফায় শুয়ে থাকবে কিভাবে সারা রাত মেয়েটা ? অনেক কষ্ট হবে তো !
হেরা যতদিন সোফায় থাকবে ন‌ওশাদ ঠিক করলো সেও হেরার পাশে ইজি চেয়ারে আধ শোয়া হয়ে থাকবে ! ওর নিজের কষ্ট হলেও !

সকালে ন‌ওশাদ হেরাকে ডেকে তুললো !
এই যে আমার বালিকা বধূ উঠেন !
হেরা হাসছে কথাটা শুনে !
সারা রাত খুব কষ্ট হয়েছে তাই না ?
মোটেও না ! কষ্ট তো আপনার হয়েছে আমার ধারণা !
আমি এই চেয়ারে আগেও ঘুমিয়েছি !
কেন ?
ব‌ই পড়তে পড়তে রাতে ঘুমিয়ে গেছি কত ! আমাকে ডেকে বিছানায় যাওয়ার কথা বলার তো কেউ ছিল না তাই সারারাত চেয়ারেই কেটে গেছে !
আপনি কিন্তু শুধু শুধু কষ্ট করলেন !
উঠো তো আমার কোন কষ্ট হয়নি বলছি না ! এই চেয়ারের ডিজাইনটাই আধ শোয়া হয়ে শোয়ার জন্য আরামদায়ক করে বানানো।

হেরা ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে ন‌ওশাদ অফিসের জন্য রেডি হয়ে গেছে! মানুষটা এখন যতক্ষণ বাসায় থাকবে ততক্ষণ ওর সামনে থাকবে ভাবতেই ভালো লাগায় হেরার মন টা ভরে যাচ্ছে।
বুবু উঠেছে হেরা ?
আমি ওদিকে যাইনি !
চলো দেখি !
দুই মিনিট আমি আসছি !
তুমি এসো আমি যাচ্ছি বলে ন‌ওশাদ রুম থেকে বের হয়ে গেল!
রুম থেকে বের হয়ে ন‌ওশাদ কি মনে করে নিশালের রুমে গিয়ে ঢুকলো !
নিশাল তখন‌ও ঘুমাচ্ছে ! ন‌ওশাদ ওর গায়ের কমফোর্টার টা ঠিক করে দিল ! আলতো করে ছেলের কপালে চুমু খেল ! মনে মনে ভাবছে , গীতি যাওয়ার পর ছেলেটা হঠাৎ করে বড় হয়ে গেছে !
যেদিন গীতি মারা গেল সে বুঝতেই পারেনি তার মা তাকে ছেড়ে চিরদিনের মত চলে গেছে ! বাসা ভর্তি হয়ে লোকজন যখন আসছে সে খুব খুশি ই হচ্ছিল এত এত মেহমান দেখে !
গীতির ডেড বডি দেখে অবাক হয়ে বলল, পাপা মাম্মা কে কি ডাক্তার ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে ইনজেকশন দিয়ে ?
ন‌ওশাদ নিশালের সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি ভেঙে পড়েছিল খুব !
সেই অবুঝ ছেলেটা আজ কত বড় হয়ে গেছে ! তার পাপাকে নিয়ে ভাবে ! ন‌ওশাদ ঘুমন্ত ছেলের পাশে বসলো ! ছোট থেকেই পা ভাঁজ করে কুড়িমুড়ি হয়ে ঘুমায় ! এত মায়া লাগে দেখলে ঘুমন্ত মুখটা ! গীতির মুখের আদল নিশালের চেহারায়! এর জন্যেই ন‌ওশাদ চোখ জুড়িয়ে দেখে ছেলেকে ।
ন‌ওশাদের চোখ টা ভিজে গেল ছেলেকে দেখে !
নিশাল চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে ছলছল চোখে পাপা তার পাশে বসে আছে ! খুব অবাক হলো সে !
পাপা কি হয়েছে ?
ন‌ওশাদ তাড়াতাড়ি সামলে নিলো নিজেকে । কিছু হয়নি তো বাবা !
তোমার কি শরীর খারাপ ?
না তো ! তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হলো তাই অফিস যাওয়ার আগে মনে হলো তোমার কাছে আসি ! এসে দেখি তুমি ঘুমাচ্ছ !
রাতে ফিজিক্স এর কিছু ম্যাথ করছিলাম তাই দেরি হয়েছে ঘুমাতে !
উঠতে হবে না এখন তুমি ঘুমাও !
না না উঠব অনেক বেলা হয়ে গেছে।
তাহলে ফ্রেশ হয়ে এসো একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করি !
আসছি ! নিশাল বেড থেকে নেমে দাঁড়ালো !
ন‌ওশাদ নিশালের ঘরের জানালার পর্দা গুলো সরিয়ে দিলো ! নিশাল অবাক হয়ে তার পাপাকে দেখছে !
পাপা অনেক দিন পর অফিস যাওয়ার আগে তার রুমে এলো ! তার কপালে আদর করলো ! সে জানে পাপার মন যখন খুব খারাপ থাকে মাম্মা কে যখন বেশি মিস করে তখন পাপা এরকম করে। রাতে ও ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ওর রুমে আসবে ওর পাশে বসে থাকবে । চুমু খাবে , চোখের পানি ফেলবে ! এবার ছুটিতে আসার পর থেকে দেখছে পাপা সেই আগের মত তার দিকে তাকিয়ে থাকে কখনো ছলছল চোখে কখনো মায়া ভরা চোখে ! নিশালের মনটা খারাপ হয়ে গেল !
নিশাল এসো তুমি আমি নিচে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য !
যাও পাপা আসছি আমি !
ন‌ওশাদ ছেলের ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো ! হেরা নেই ঘরে । ন‌ওশাদ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে র‌ইলো নিজের ঘরে !
হেরার কাপড় , গয়না , চুড়ি বিভিন্ন জায়গায় রাখা ! অনেক বছর পর মেয়েলি জিনিস পত্র তার রুমে ! জীবনটা কি আবার আগের ছন্দে ফিরবে ? বেড সাইড টেবিল থেকে ঘড়িটা নিয়ে পড়ার সময় হেরা আর তার কক্সবাজারে র ছবি গুলোর দিকে চোখ পড়লো ! ন‌ওশাদ রেজোয়ানের কান্ড কারখানা মনে করে হেসে উঠলো।
আজ শুনে যদি ঐ পাগল হেরা তার রুমে সিফট হয়ে গেছে তাহলে আরো কত কথা যে বলবে ! ন‌ওশাদ মনে মনে হাসলো !
ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই ন‌ওশাদ ল্যাপটপ এর ব্যাগটা নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল !

হেরা আজ সকাল সকাল শাড়ি পড়েছে ন‌ওশাদের জন্য। কালকে রাতে মানুষটা বলল শাড়ি পড়লে ওকে খুব ভালো লাগে ! তার খুব ইচ্ছে ন‌ওশাদের ভালো লাগায় জীবনটা সাজিয়ে ফেলতে ! তাইতো কখনো টিপ দিয়ে না সাজা সে এখন ন‌ওশাদের পছন্দের টিপ তার কপালে রাখতে ভালো লাগে!
হঠাৎ ঘাড়ের কাছে শিরশিরানি অনুভব হতেই পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে ন‌ওশাদ ওর পেছনে দাড়িয়ে ঘাড়ে ফুঁ দিচ্ছে !
আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম !
আমি তো চিনতেই পারেনি ডাইনিং এর পাশে কমড়ে শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে কোন নায়িকা দাঁড়িয়ে আছে !
আঁচল বেশি লম্বা হয়ে গেছে তাই !
ন‌ওশাদ চেয়ারে বসতে বসতে বলল, এত খাবার কেন ?
সবার পছন্দের ব্রেকফাস্ট করেছে আনারের মা ! বুবু , দুলাভাই খিচুড়ি পছন্দ করেন উনাদের জন্য তাই করেছে! আচ্ছা নিশাল কি পছন্দ করে ?
জানি না হেরা ! ওর পছন্দ জানার জন্য ওকে কি কাছে কখনো পাই আমি ? তবে থাই ফুড খুব পছন্দ করে এটা জানি !
আনারের মা বলতে পারবে ?
হুম !
ন‌ওশাদের খুব ভালো লাগছে হেরা নিশালের পছন্দ অপছন্দ গুলো আগ্রহের সাথে জানতে চাইছে দেখে।

দুপুরে হেরা ননাসের পাশে বসে আছে । তিনি তাদের ফ্যামিলি র গল্প বলছেন ! হেরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে ! গল্প বলেন আর হাসেন হেরার এত ভালো লাগছে মানুষটাকে !
আম্মা ছিল সারা বছরের রোগী ! বিভিন্ন অসুখ ছিল ! অসুখের চেয়ে বেশি আম্মা কাহিল হয়ে যেত অসুখের কথা ভেবেই। বাবুকে আমি রাখতাম সব সময় ! ওর জন্য আমার ফিলিংস অন‌্যদের চেয়ে বেশি বুঝলে এটা বলতে আমি কখনোই দ্বিধা করি না ! আর বাবু ও আমার জন্য পাগল। দুই বছর আগে আমি অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি হলাম ফ্লোরিডা তে ! একদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি বাবু আমার পাশে ছলছল চোখে বসে আছে। সে সব ফেলে ছুটে আসছে ফ্লোরিডা ! কোন কাজে ইউএসএ গেলে আমাকে দেখে আসবেই ! এই হলো আমার ভাই ! ওর জন্য আমি চিন্তায় থাকতাম ও একা ছিল বলে ! গীতি মারা যাওয়ার পর হাজার বার বললাম বিয়ে কর ! করবে না ! আমি ওর একা জীবন টা চিন্তা করে অস্থির হয়ে থাকতাম ! এখন আমি নিশ্চিন্ত হেরা ! তুমি এসে গেছো ! হেরার হাত ধরলো জান্নাত আজমী !
ওর আর নিশালের খেয়াল রেখো হেরা ! ভাইটা আমার কাজের মধ্যে ডুবে নিজের নিঃসঙ্গ জীবনটাকে এড়িয়ে যেতে চায় তুমি ওর পাশে পাশে থাকবে সব সময় ! আমার মন বলছে তুমি পারবে !
হেরা মাথা নিচু করে শুনছে !
আর একটা কথা নিশালের খালাদের একটু পশ্রয় কম দিবে ওদের আমি কম বুঝি । কেমন যেন জটিল মনে হয় ! যাই হোক ওরা এত দিন নিশালের খেয়াল রেখেছে আমি দূরে থাকি কিছু করতে পারিনা ছেলেটার জন্য। এখন থেকে তুমি তোমার ছেলের খেয়াল রাখবে ! বাবুর ছেলে মানে তোমার ছেলে !
ঠিক বলেছি হেরা ?
হেরা মুখ তুলে বলল, জ্বি বুবু !
শুনে খুশি হলাম ! যাও এখন রেস্ট নাও অনেক জ্ঞান দিয়েছি তোমাকে ! বলেই জান্নাত আজমী হেসে দিলেন !
হেরা বুবুর দিকে তাকিয়ে বলল, বুবু আপনি এত সুন্দর চেইন টা আমাকে দিয়েছেন থ্যাঙ্কস বুবু !
কেন দিয়েছি জানো?
উনি বলল এটার একটা কারণ আছে আপনার কাছ থেকে জানতে !
জান্নাত আজমী হাসলেন , বাবু বলেনি কারণ টা ?
না !
হেরার হাত ধরে তিনি বললেন , এটা তোমাকে দেই নাই হেরা ! তোমার কাছে এটা আমানত র‌ইলো এটা যার তুমি একদিন এটা তাকে দিবে !
কাকে বুবু , হেরা অবাক হয়ে বলল!
তোমার আর বাবুর মেয়ে কে !
হেরা প্রথমে বুঝেনি দুই সেকেন্ড লাগলো কথাটা বুঝতে ! তারপর লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল।
এখন তোমার কাছে থাক যার জিনিস তুমি তাকে তাড়াতাড়ি দিলেই খুব শান্তি পাব আমি ! যাও !
হেরা বুবুর ঘর থেকে বের হয়ে মনে মনে হাসলো কিছুক্ষণ ! লজ্জাও পেলো । ন‌ওশাদ কারণ টা বলেনি উনিও লজ্জা পেয়েছেন বলতে ভেবে হেরা হাসছে !
নিজের ঘর খুব সুন্দর করে গোছালো সে ! ন‌ওশাদের প্রতিটা কাপড় গুছিয়ে রাখলো ! তার কাপড়ের ভেতর থেকে সেই নীল গেঞ্জি টা বের করে কিছুক্ষণ ন‌ওশাদের গায়ে রং ঘ্রাণ নিলো ! এই ঘরটাতে আসার পর ওর মনে হচ্ছে ন‌ওশাদ সারাক্ষণ ওর পাশে পাশে আছে এক অন্য রকম ভালো লাগছে তার !
কিন্তু ভুলেও সে ন‌ওশাদের বেডের কাছে যাচ্ছে না । কিন্তু তার খারাপ লাগছে না মনে হচ্ছে সে মানুষ টাকে সঠিক সন্মান দিচ্ছে !

বিকেলে নিশাল সাইকেল চালানোর জন্য সাইকেল বের করেছে ! কলেজ থেকে এলে সাইকেল নিয়ে আশেপাশে ঘুরে সে ! সঙ্গে ড্রাইভার সবুজ আরেক টা সাইকেল নিয়ে থাকে ! ইদানিং নিশালের সঙ্গে সবুজ সারাক্ষণ থাকে বাসার বাহিরে গেলে। এটা তার স্যারের কঠিন আদেশ ! রিয়াজ বলছে , তোর গাড়ি জাহান্নামে যাক তুই ছায়ার মত ভাইয়ার সঙ্গে সঙ্গে থাকবি ! গাড়িতে ব‌ইসা মোবাইলে সিনেমা দখবি আর ভাইয়া একলা মার্কেটে বন্ধুদের সাথে ঘুরব যদি এমন হ‌ইছে তাহলে তুই শেষ সবুজ ! মনে থাকে যেন !
ভাইয়া যদি না থাকতে দেয় ?
দূর থেকে ফলো করবি চোখের আড়াল করবি না ভুলেও ! বন্ধুর বাসার গেটে বসে থাকবি নড়বি না !
সেজন্য সবুজ নিশালের সঙ্গে সঙ্গে সব জায়গায় যাচ্ছে।
আজ নিশাল সাইকেল চালানোর মুডে আছে তাই সাইকেল পরিস্কার করছে লোকজন !
হেরা নিচে এসে দেখে নিশাল সাইকেল এর পাশে দাঁড়িয়ে আছে !
কি করছো নিশাল ?
ও আপনি !
একটা কথা বলব নিশাল !
জ্বি !
তুমি প্লিজ আমাকে তুমি বলে ডেকো ! আপনি ডাকলে আমার কেন জানি বেশি মুরুব্বি মনে হয় নিজেকে !
আচ্ছা ঠিক আছে চেষ্টা করব !
হেরা ভাবেনি নিশাল এত সহজে ব্যাপার টা মেনে নিবে ! ও কিছুটা অবাক হলো!
আন্টি পাপার কি হয়েছে ?
কেন ?
আমার মনে হচ্ছে পাপার কোন কারণে খুব মন খারাপ ! আজ সকালে আমার ঘরে এসে চুপচাপ বসে ছিল !
মন খারাপ মনে হয় না , তোমাকে খুব ফীল করেন উনি তাই তোমার কাছে থাকতে চাইছে !
তাই ! কিন্তু পাপা তো খুব ব্যস্ত আমার কাছে থাকার সময়ই পায় না !
থাকতে চায় তোমার কাছে কিন্তু তুমি কি ভাবো সে জন্য মনে হয় লজ্জা পায় !
আপনি প্লিজ পাপার খেয়াল রাখবেন পাপা মন খারাপ করে থাকলে অসুস্থ হয়ে যায় !
হেরা অবাক হয়ে দেখছে এত ছোট ছেলেটা বাবার জন্য কত ফিলিংস নিয়ে ঘুরে কিন্তু বাবার সামনে একেবারে বিপরীত হয়ে থাকে !
হঠাৎ হেরা নিশাল কে বলে উঠলো, তুমি পাপাকে খুব ভালোবাসো?
নিশাল তাকিয়ে আছে চুপ করে !
তাহলে পাপার কাছাকাছি থেকো যখন বাসায় থাকেন উনি । উনি তোমার মাম্মা কে খুব মিস করে তুমি কাছে থাকলে উনার ভালো লাগবে !
আপনার খারাপ লাগে না পাপা মাম্মা কে মিস করলে ?
না, খারাপ লাগবে কেন , আমি তো জানি তোমার মাম্মা কে উনি অনেক ভালোবাসেন। যাকে ভালোবাসি আমরা সে কাছে না থাকলে , তাকে তো মিস করব‌ই তাই না ?
নিশাল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো হেরার দিকে !
হেরা হাসলো নিশালের অবাক হ‌ওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে।
তোমার সাইকেল টা দিবে আমাকে নিশাল আমি চালাব ?
নিশাল হেরার কথা শুনে হা হয়ে গেল !
তুমি সাইকেল চালাতে পারো আন্টি ?
হুম ছোটবেলায় শিখেছি !
পড়ে যাবে না তো ?
আরে না ঠিকই পারব দেখো !
গ্রেট চলো তুমি আমি দুজনে চালাই এক সঙ্গে !
সাইকেল তো একটা তোমার !
এটা পাপার সাইকেল আমার টা আছে আনতে বলছি দাঁড়াও ! নিশাল সবুজ কে ওর সাইকেল টা আনতে বলল!
তোমার পাপা সাইকেল চালায় কখন ?
পাপা সাইকেল চালায় না এক আংকেলের সাইকেল এর ইন্ড্রাসট্রি আছে তিনি কার্টেসি হিসেবে পাপা কে এই সাইকেল টা দিয়েছে । অনেক দামী সাইকেল এটা ! আমি আসলে হঠাৎ হঠাৎ চালাই পাপার টা। আর আমার টা সবুজ ভাই চালায় ! এখন তুমি চালাও পাপার টা আমি আমার টা চালাব কেমন !
ঠিক আছে!
তুমি সেলোয়ার কামিজ পড়ে পাড়বে তো আন্টি ?
পারব পারব । একটা কথা, তোমার পাপা কে বলবে না কিন্তু আমি সাইকেল চালাচ্ছি !
ওকে ঠিক আছে ! তুমি শুধু ব্যথা পেও না!
ওরা দুজন সাইকেল চালিয়ে বাসার সামনে দিয়ে রাস্তায় ঘুরছে ! নিশালের খুব মজা লাগছে ! সে কল্পনাও করতে পারেনি আন্টি সাইকেল চালানো জানে !
জান্নাত আজমী দোতলার জানালা থেকে নিশাল আর হেরার সাইকেল চালানো দেখে খুব মজা পাচ্ছেন ! তার ভালো লাগছে ছেলেটা হেরাকে মেনে নিয়েছে দেখে ! যাক সবচেয়ে বড় চিন্তা টা কমলো তার !
নিশাল আর হেরা সাইকেল চালাচ্ছে বাসার সব কাজের মানুষ অবাক হয়ে দেখছে । আনারের মা হেসে গড়িয়ে পড়ছে ! তবে সবাই কে নিশাল কঠিন নির্দেশ দিয়েছে এটা যেন ভুলেও পাপার কানে না যায় !
বাসার সামনের রাস্তায় যখন দুজন সাইকেল চালাচ্ছে রোডের মাথায় তখন ন‌ওশাদের গাড়ি এসে হাজির । দূর থেকে ন‌ওশাদ নিশাল কে দেখতে পেল সঙ্গে সঙ্গে কঠিন ধাক্কা খেল ওর সঙ্গী হিসেবে হেরাকে সাইকেল চালানো অবস্থায় দেখে !
গাড়ি টা থামাও তো বাহার !
বাহার গাড়ি সাইড করে দাঁড় করালো !
ন‌ওশাদ বাসা থেকে একটু দূরে নেমে গেল ! নিশাল আর হেরা সাইকেল চালানোয় ব্যস্ত থাকায় খেয়াল ই করেনি একটু দূরে ন‌ওশাদের গাড়ি।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here