#তবু_সুর_ফিরে_আসে
২৩ তম পর্ব
হেরা চিৎকার দিয়ে উঠলো , নানা ভাই !
তুমি কেমন আছো নানা ভাই ? ওপাশে হেরার নানা খুব চেষ্টা করে যাচ্ছে একটু কথা বলতে ! আজ দেড় মাস তিনি এই কন্ঠ টা শোনার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন ! জীবন কি তাকে আর একটু সময় দিবে না শেষ বারের মত প্রিয় নাতনি র সঙ্গে কথা বলতে !
হেরা !
কেমন আছো তুমি নানা ভাই ?
ভালো!
তুই ?
আমি অনেক ভালো আছি নানা ভাই অনেক ! হেরার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে ! খুব কষ্ট হচ্ছে নিজেকে সামলাতে তার !
নওশাদ খুব ভালো রে !
খুব ভালো নানা ভাই খুব ভালো ! আমার সামনে আছে ! তুমি চিন্তা করো না আমি এখানে খুব ভালো আছি !
সব সময় ভালো থাকবি !
হুম থাকব !
নওশাদ কে ভালো রাখবি !
হুম ! হেরা কান্নার দমকে কথা বলতে পারছে না! নওশাদ ওর ঘাড়ে হাত রাখালো !
হেরা !
বলো নানা ভাই ?
এখানে কখনো আসবি না মনে আছে না আমার কথা গুলো !
হুম মনে আছে !
আমি নেই শুনলেও কাদবি না শুধু দোয়া করবি !
নানা ভাই !
খুব ভালো থাকিস খুব । আমার দোয়া থাকবে সঙ্গে ! নওশাদ কোথায় ?
কথা বলবে , দিচ্ছি !
হেরা নওশাদের দিকে ফোন টা এগিয়ে দিল !
নওশাদ ফোন টা হাতে নিলো,
স্যার আপনি চিন্তা করবেন না চেয়ারম্যান সাহেব আপনাকে হসপিটালে নিয়ে যাবে ! আমি আসব আপনার কাছে !
দরকার নেই ! তুমি হেরা কে দেখো শুধু !
আপনি চিন্তা করবেন না , ও ভালো আছে !
আমি জানি ! ও খুব দুঃখি মেয়ে তুমি দেখে রেখো !
আপনি আমার উপর ভরসা রাখবেন স্যার !
আমি জানি তুমি ওকে ভালো রাখবে! আর কথা বলতে পারলেন না হেরার নানা আবার শ্বাস কষ্টের মত শুরু হয়ে গেছে উনার !
চেয়ারম্যান সাহেব ফোন টা কানে তুলে নিলো !
স্যার আপনি চিন্তা করবেন না এম্বুলেন্স শহর থেকে রওনা হয়ে গেছে ! স্যার কথা বলতে পারছেন এখন শ্বাস কষ্টের মত হচ্ছে একটু পর আবার কথা বলেন উনার সঙ্গে!
দরকার নেই পরে কথা বলব, আমি আপনার আপডেটের অপেক্ষায় থাকব চেয়ারম্যান সাহেব !
জ্বি স্যার আমি জানাচ্ছি ! স্যার আপনি কি সাইফুল স্যারের ছেলেদের কারো সঙ্গে কথা বলবেন ?
না আমি আপনি ছাড়া আর কারো সঙ্গে কথা বলতে চাইছি না ! আপনি কাইন্ডলি স্যারের চিকিৎসা টা শুরু করেন আমার লোক কালকে কুষ্টিয়া পৌঁছে যাবে ! তখন স্যারের সকল দায়িত্ব আমার লোক নিয়ে নিবে !
স্যার আপনি চিন্তা করবেন না সাইফুল স্যার আমারো স্যার ছিল আমি আমার দায়িত্ব টাও পালন করব !
থ্যাঙ্কস চেয়ারম্যান সাহেব !
নওশাদ ফোন কেটে তাকিয়ে দেখে হেরা সোফায় বসে নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে ! হেরার মাথায় হাত রাখলো সে ! হেরা প্লিজ কাঁদে না !
আমার কষ্টে বুকটা ভেঙে যাচ্ছে কেন ?
আমার দিকে তাকাও !
আমি চেয়ারম্যান সাহেব কে বলে দিয়েছি , স্যার একটু স্ট্যাবল হলেই ঢাকায় নিয়ে আসবে ! এখন স্যারের ট্রিটমেন্ট করা আমার দায়িত্ব ! স্যার ভালো হলে এই বাসায় রেখে দিব কেমন তোমার কাছে! পারবে না আমাদের সঙ্গে তোমার নানার টেক কেয়ার করতে তুমি ?
হেরা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, পারব !
এখন কান্নাকাটি করো না প্লিজ !
হুম !
নওশাদ হেরার মাথায় হাত রাখলো ! দোয়া করো যেন স্যার ভালো হয়ে যায় !
হেরা চোখের পানি ওড়নার কোনা দিয়ে মুছলো !
বীথি জান্নাত আজমী র সঙ্গে নওশাদের বিয়ের প্রসঙ্গ তুললে!
বুবু যত কথাই বলেন , এই বিয়ের সবচেয়ে বড় দাম দিবে নিশাল !
কেন ?
একদিন হেরার বাচ্চা হবে !
তো সমস্যা কোথায় ?
সমস্যা তখনই হবে বুবু আপনি আমি কেউ থাকব না , নিজের বাচ্চা পেলে নিশালকে অবাঞ্চিত ভাববে না হেরা এর কি গ্যারান্টি ?
পৃথিবীতে কোন কিছুর কি গ্যারান্টি দেয়া যায় বীথি ?
সেটাই তো বলছি !
সব আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও !
তাই তো দেখছি এ ছাড়া তো আর কোন উপায় নেই !
এটাই সবার জন্য মঙ্গল ! বাবু কি যথেষ্ট নয় তার ছেলের জন্য ? তোমরা যে কি ভাবো আমি বুঝি না !
জান্নাত আজমী চুপ করে রইলেন।
ডিনার করে যাবে কিন্তু !
না বুবু মেয়েরা বাসায় বুয়ার কাছে !
ও আচ্ছা তাহলে আটকাবো না তোমাকে ! এবার সংসার টা সুন্দর করে করছো তো বীথি !
জ্বি বুবু দোয়া করবেন !
সব সময় করি তুমি আমার নিশালের কত যত্ন করেছো তোমার জন্য মন থেকে দোয়া করি বোন !
বীথি মনে মনে বলল, চেয়ে তো ছিলাম খালা না নিশালের মায়ের দায়িত্ব টা নিতে ! আপনার ভাই ই তো রাজি হলো না ! এখন গাইয়া মেয়ে বিয়ে করে আহ্লাদ করে । সবার সামনে দিয়ে হাত ধরে টানাটানি করে ! আদিখ্যেতা !
বীথি দীর্ঘ শ্বাস ফেলল ! আসি তাহলে বুবু !
ঠিক আছে এসো তুমি আমি আছি ! গ্রামের বাড়ি যাব শ্বশুর শ্বাশুড়ি র আত্মার শান্তি চেয়ে মিলাদের আয়োজন করি সব সময় । এটা করে ফিরে আসব আবার ! বাবু যাবে ব্যাঙ্কক ও যাওয়ার আগেই চলে আসব ! হেরা নয়তো একা থাকবে কিভাবে এই বাসায় বলো !
দুলাভাই কবে যাবে ব্যাঙ্কক ?
এই সপ্তাহে ই !
ঠিক আছে আসব তখন বুবু !
যুথী কে ও আসতে বলো !
জ্বি !
বীথি উঠে গেল ! একবার ভাবলো নওশাদের সঙ্গে দেখা করে যাবে !
মনে মনে বলল ধুর ! তারপর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল !
রাতে নওশাদকে চেয়ারম্যান সাহেব ফোন দিয়ে জানিয়েছে কুষ্টিয়ার একটা প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে হেরার নানাকে ! ওখানে একটু স্ট্যাবল হলেই ঢাকায় নিয়ে আসা যাবে তার আগে সম্ভব না ! নওশাদ শোয়েব কে বলে দিয়েছে একজন দায়িত্বশীল লোককে কালকে সকালে কুষ্টিয়া পাঠিয়ে দিতে । চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল ব্যবস্থা সে করবে ওখানে ! নওশাদ শুধু চেয়ারম্যান এর উপর ভরসা করে থাকতে চাইছে না !
শোয়েব নিজেই যেতে চেয়েছিল নওশাদ বলে দিল ওর যাওয়ার দরকার নেই দায়িত্বশীল কাউকে পাঠালেই হবে !
রাতে রুমে ঢুকে দেখে হেরা ঘর অন্ধকার করে জায়নামাজে বসে আছে ! নওশাদ জোর করে ডিনার করাতে নিয়ে গিয়েছিল , সামান্য কিছু খেয়েই চলে এসেছে সে ! বুবু ও কিছুক্ষণ স্বান্তনা দিল হেরাকে !
নওশাদ ইচ্ছে করে আলোটা জ্বালালো না ! বোঝা যাচ্ছে কান্নাকাটি করছে হেরা ! নওশাদের ও খারাপ লাগছে খুব! ওর ইচ্ছে করছে হেরা কে নিয়ে যেতে ওর নানার কাছে ! নামাজ থেকে উঠলে আর একবার বুঝিয়ে বলবে সে যদি রাজি হয় তাহলে কালকে সকালেই হেরাকে নিয়ে কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়বে ! একবার চোখের সামনে নানাকে দেখলে ওর মনটা শান্ত হবে আশাকরি !
হেরা নামাজ শেষ করে উঠেছে ! বেড সাইড ল্যাম্প টা জ্বালিয়ে কিছু একটা খোঁজ করছে আশেপাশে !
কিছু খুজছো ?
হ্যাঁ ! আমার ইনহেলার টা !
শ্বাস কষ্ট হচ্ছে ?
কাশি হচ্ছে !
হঠাৎ !
ও একটু মনে হচ্ছে খারাপ লাগছে ! ঠান্ডা পানি দিয়ে ওজু করেছি গলাটা বসে গেছে!
কান্নাকাটি করেছো তাই বসে গেছে ,ঠান্ডার ওষুধ খেয়েছো !
ওষুধ লাগবে না !
হেরা ইনহেলার টা নিয়ে মুখে স্প্রে করলো সোফায় বসে ! নওশাদ ওর পাশে গিয়ে বসলো !
তুমি এত বেশি মন খারাপ করো না হেরা ! স্যার এখন ডাক্তারের ট্রিটমেন্ট এর মধ্যে আছে রাতটা যাক দেখবে ভালো খবর আসবে ! তুমি কালকে আবার কথা বলবে ! এক কাজ করি চলো আমরা কালকে ভোরে রওনা হয়ে যাই !
না !
না কেন ? আমরা তো গ্রামে যাব না কুষ্টিয়া শহরে থাকব !
আমি ও বাড়ির কারো সামনে যেতে চাই না !
ও বাড়ির কাউকে তোমার দেখার দরকার নেই তুমি তোমার মত নানাকে দেখবে আমি তোমার সঙ্গে থাকব ! প্লিজ হেরা তোমাকে দেখলে তোমার নানার ভালো লাগবে খুব !
আচ্ছা ঠিক আছে !
তাহলে সকাল সকাল আমরা বেড়িয়ে পড়ব কেমন !
জ্বি !
এখন ঘুমিয়ে যাও আমাদের সকাল সকাল উঠতে হবে !
হেরা চুপচাপ শুয়ে পড়লো !
নওশাদও ঘড়িতে এলার্ম সেট করে শুয়ে পড়লো এর দেড় ঘণ্টা পর মাঝ রাতে ফোনের রিং এ ঘুম ভাঙলো ওর ! তাকিয়ে দেখে চেয়ারম্যান এর ফোন ! নওশাদের মনে একটা আশঙ্কা এসে ভর করলো, খারাপ কিছু নয়তো !
হ্যালো চেয়ারম্যান সাহেব ! গলাটা নামিয়ে কথা বলছে নওশাদ।
সরি স্যার এত রাতে ডিস্টার্ব করলাম, পাঁচ মিনিট আগে সাইফুল ইসলাম স্যার মারা গেছেন ! ডাক্তারের চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। বয়স হয়েছিল যথেষ্ট !
আমি বুঝতে পেরেছি!
আপনারা কি আসবেন স্যার ?
আমি আপনাকে জানাচ্ছি !
ঠিক আছে স্যার !
ফোন রেখে নওশাদ উঠে বসলো ! হেরা ঘুমাচ্ছে ! ঘুম থেকে ডেকে তুলে ওকে কি এখনই খবর টা দিবে, ভাবছে সে ! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত তিনটা বাজে ! নওশাদ উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো ! বাহিরে খুব কুয়াশা পড়েছে সঙ্গে অনেক শীত ! দুই মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে রুমের ভিতরে ঢুকে গেল সে ! হেরার কাছে গিয়ে ওর গায়ে কমফোর্টার টা ঠিক করে দিল ! কি আরামে ঘুমাচ্ছে ! তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ টা আজ চিরদিনের মত এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে এখনো সে জানে না ! কতটা কষ্ট মাখা একটা দিন তার জন্য অপেক্ষা করছে আজ ! এরকম একটা অন্ধকার রাতে সেও তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ টাকে হারিয়ে ছিল তাই সে জানে কোথায় কষ্ট হয় !
নওশাদ হেরার কাছে গিয়ে বসলো ! ঘুমন্ত হেরার মাথায় হাত টা রাখতেই হেরা চোখ খুলে তাকালো !
কিছু বলবেন ?
না তোমাকে দেখছিলাম !
কেন যেন বুকের ভেতরে একটা চাপা কষ্ট হচ্ছে , মনে হচ্ছে দম টা আটকে আসছে !
শ্বাস কষ্ট?
সেই টাইপের না ! বুঝাতে পারছিনা আপনাকে বুকে কেমন চাপ দিয়ে ব্যথা হচ্ছে আবার পরোক্ষনেই মনে হচ্ছে বুকের ভেতরে সব ফাঁকা !
ঠিক হয়ে যাবে হেরা তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো ! নওশাদ হেরার গালে হাত রাখলো।
একটু পর পর ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছে !
আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই !
আপনি সারাদিন অফিস করবেন আমার জন্য জেগে থাকতে হবে না ! আর কতক্ষন পর তো এমনি উঠে যেতে হবে ! আচ্ছা আপনি যে বললেন নানা ভাই কে এই বাসায় রাখবেন , মামা রা আপত্তি করে যদি ওদের কি বলবেন ?
নওশাদ হেরার দিকে তাকিয়ে আছে ওর কথার কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না !
আপনি দেখবেন একবার ঠিক চিকিৎসা পেলে নানা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে ! আমি এখানে এনে অনেক যত্ন করবো ! কোন কষ্ট পেতে দিব না ! অনেক কষ্ট করেছে নানা ভাই আমার জন্য এবার একটু শান্তিতে থাকুক ! আমার কি যে ভালো লাগছে আপনার কথা টা শুনে আপনাকে বলে বুঝাতে পারব না ! আপনি এত ভালো কেন বলুন তো , আমার জন্য কত কি করছেন ! আগে আমাকে বাঁচিয়েছেন এখন নানা ভাই কে সুস্থ করতে চাইছেন ! আপনি আসলেই একজন অন্যরকম মানুষ ! নওশাদ হেরার হাত ধরলো !
তুমি অনেক ভালো হেরা !
কি যে বলেন আমি আপনার নখের ও যোগ্য না ! আচ্ছা আমরা কখন বের হয়ে গেলে ভালো হবে বলুন তো ! আমরা কি কালকেই সঙ্গে করে নানা ভাই কে নিয়ে আসতে পারব এই যেমন ধরুন এম্বুলেন্সে করে ?
নওশাদ চুপ করে দেখছে হেরা কে, কিভাবে খবর টা দিবে সে বুঝতে পারছে না !
নানা ভাই আমাকে দেখে খুব অবাক হবে , এত সুন্দর কাপড় পড়ে এত গয়না পড়া আমাকে দেখলে তো নানা ভাই হাসবে । বলবে তুই সত্যিই বউ হয়ে গিয়েছিস হেরা !
নওশাদ হেরার হাত টা শক্ত করে চেপে ধরলো ! হেরা আমরা মানুষরা খুব অসহায় একটা প্রাণী আমরা সৃষ্টির সেরা জীব হলে কি হবে আমাদের চেয়ে বেশি অসহায় আর কোন প্রাণী নেই ! কারণ কি জানো , আমাদের ভেতরে কষ্ট আছে, আমাদের ভেতরে প্রিয়জনকে হারানোর ভয় আছে , আর আমরা আশা করি, স্বপ্ন দেখি এসব কিছু আমাদের অসহায় করে দেয় আমাদের দূর্বল করে দেয় !
ঠিক বলেছেন আপনি !
আমরা আমাদের প্রিয়জনকে হারিয়ে বছরের পর বছর কষ্টে থাকি আর কোন প্রাণী থাকে না ! তারা কিছুক্ষণ পর জীবনের প্রয়োজনে জীবনকে এগিয়ে নেয় ! হেরা আমার মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো মানুষ না হয়ে পাখি হলেই ভালো হতাম ! কষ্ট কম থাকতো !
হেরা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,ওদের ও কষ্ট আছে হয়তো !
থাকলেও বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকে না ! হেরা পৃথিবীর কঠিন রূপ মানুষ ছাড়া আর কেউ সবচেয়ে বেশি অনুভব করে না ! একদিন মরে যেতে হবে এটা মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী হয়তো জানেই না ! আমরা মানুষ রা সেই সত্য টা খুব যত্ন করে ভুলে থাকি !
হেরা নওশাদের সব কথার মানে বুঝতে পারছে না যদিও, তবু নওশাদের কথা গুলো শুনতে ওর ভালো লাগছে ! মন থেকে অজানা ভয়টা কমে যাচ্ছে !
হেরা আল্লাহ যাকে সুস্থ করে তুলতে চান তার কোন চিকিৎসার ও প্রয়োজন হয় না আবার যাকে এই পৃথিবী থেকে নিয়ে যেতে চান পৃথিবীর কোন চিকিৎসা, আয়োজন তাকে আটকে রাখতে পারে না ! তোমার নানা ভাই আমাকে কোন চেষ্টাই করার সুযোগ দেননি ! আমি খুব চেয়েছিলাম উনাকে ঢাকায় এনে চিকিৎসা করাব তারপর এখানে আমাদের কাছে রাখব কিন্তু কিছুই করার সুযোগ দেননি তিনি আমাকে হেরা !
হেরা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নওশাদের দিকে , মানে ?
স্যার নেই হেরা ! রাত তিনটার দিকে স্যার চলে গেছেন !
নওশাদ ভেবেছিল হেরা খবর টা শুনে হয়তো চিৎকার দিয়ে কাঁদবে ! কিন্তু হেরা শুধু তাকিয়ে আছে ওর দিকে ! কিছুই বলছে না !
তুমি আমার কথাটা বুঝতে পেরেছো ?
হুম !
তুমি আর আমি সকাল হলেই কুষ্টিয়া যাব ঠিক আছে!
গিয়ে আর কাকে দেখব বলুন ? আমার জন্য তো কেউ অপেক্ষা করে নেই ! আমার জীবনের একটা পার্ট ক্লোজ হয়ে গেল তাই না ! আমার জন্য ভাবে , আমাকে ভালোবাসে এমন কেউ আর রইলো না পৃথিবীতে ! নওশাদ হেরা কে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে !
হেরা এভাবে বলো না ! জানেন এতটুকু ছোট যখন আমি তখন নিজের কাছে নিয়ে এসেছিল নানা ভাই ! হাত ধরে অক্ষর শিখিয়েছে , পড়তে শিখিয়েছে । নিজে হাতে খেতে পারতাম না মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে ! এরকম শীতের রাতে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতো । আমার ছোট ছোট হাত গুলো নিজের গায়ের ওমে গরম করে দিতো ! রাতে ভয় পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেলে সূরা পড়ে ফুঁ দিয়ে দিতো ! স্কুলে ক্লাস নেয়ার সময় আমি সঙ্গে সঙ্গে থাকতাম নানার ! বাবার আদর পাইনি নানা ভাই ই আমাকে বাবার আদর , নানার আদর , মা চলে যাওয়ার পর মায়ের আদর দিয়েছে ! আমার এমন কপাল, যন্ত্রণা আর দুশ্চিন্তা ছাড়া জীবনে কিছু ই দিতে পারিনি নানা ভাই কে ! নওশাদ নিজের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে আছে হেরা কে। হেরা নওশাদের বুকে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে।
আমরা ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে যাব কেমন !
কোথায় , আর গিয়ে কি হবে ?
তুমি শেষ বারের মত তোমার নানাকে দেখবে !
নাহ্ যে চোখ আমাকে দেখে শান্তি পাবে না তার কাছে গিয়ে আর কি লাভ বলুন ! আমি চেয়েছিলাম একটু শান্তি দিতে নানা ভাই কে সেটা যখন আর সম্ভব না এখন নানার কথা মত আমি আর ওখানে যাব না !
দেখবে না ?
থাক জীবিত মুখটাই আজীবন আমার চোখে ভেসে থাকুক!
ঠিক আছে তুমি যা চাইবে হেরা !
হেরা কাঁদছে !
নওশাদ ওকে বাঁধা দিচ্ছে না ,কাদুক কেঁদে কেঁদে হালকা হোক !
সারারাতই হেরা কেঁদেছে ! সকালে ননাস থেকে শুরু করে নিশাল বাড়ির প্রতিটি মানুষ ওকে স্বান্তনা দিয়েছে ! নওশাদ আজ আর অফিস যায়নি ! হেরার পাশে বসে আছে ! হেরা অনেক ভেঙ্গে পড়েছে ! স্বাভাবিক যে মানুষ টা তাকে আগলে রেখেছে, জীবনের সব কিছু শিখিয়েছে , পরম মমতায় জড়িয়ে থেকেছে তার জন্য এরকম কষ্ট হওয়ারই কথা !
দুপুরের দিকে হেরা নওশাদকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমার জন্য আপনি বাসায় বসে রইলেন কত কাজ থাকে আপনার !
আজ সবচেয়ে জরুরি কাজ তোমার পাশে থাকা হেরা !
নওশাদ বাকি দিনটুকু হেরার কাছেই বসে রইলো ! হেরার শরীর ও খারাপ করেছে ! কান্নাকাটি করে সর্দি ,কাশি শুরু হয়ে গেছে ওর !
দুপুরের দিকে ঘুমাচ্ছে যখন নিশাল দরজায় নক করলো ! নওশাদ ইজি চেয়ারে শুয়ে আছে।
আসব পাপা ?
এসো !
কি অবস্থা আন্টির ?
ঘুমাচ্ছে এখন !
অনেক কান্নাকাটি করেছে ?
হুম !
সোফায় ঘুমাচ্ছে কেন ?
নওশাদ এর কি উত্তর দিবে ভাবছে ! থাক ওর যেখানে ভালো লাগে ঘুমাক ! তুমি কি বীথির বাসা থেকে এলে ?
হ্যাঁ পাপা বসি নাই বেশিক্ষণ লাঞ্চ করেই চলে এসেছি ! আন্টির জন্য মন খারাপ লাগছিল !
নওশাদ ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে ! ছেলেটার মনটা নরম স্বভাবের ! হেরার কষ্ট দেখে খারাপ লাগছে ওর !
যাও রেস্ট নাও বাবা, তোমার আন্টি উঠলে এসো কাছে ওর ভালো লাগবে !
ঠিক আছে আমাকে ডেকো !
হুম!
দুই দিন হেরা সারাক্ষণ সোফায় কমফোর্টার গায়ে জড়িয়ে পড়ে রইলো ! আনারের মা ওর মাথার চুল আঁচড়ে দিচ্ছে পাশে বসে গল্প করছে ! বুবু এসে আদর করে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর ! এক সন্ধ্যায় দুই দেবর ও বউদের নিয়ে এসে হাজির হয়েছে ! যতটা না হেরার জন্য তারচেয়ে ও বেশি তাদের বড় ভাই আর বোনের সামনে দায়িত্ব টা পালন করছে সেটা দেখিয়ে গেল !
সুমনা এসেছিল ! রেজোয়ান কক্সবাজারে গিয়েছে হোটেলের কাজ দেখতে তাই সুমনা একাই এসেছে !
রাতে নওশাদ জোর করেই হেরাকে রুম থেকে বের করলো ! লিভিং রুমে নিয়ে পাশে বসিয়ে বুবু আর নিশালের সঙ্গে গল্প করলো ! ডিনারের পর রুমে বসে হেরার দিকে তাকিয়ে বলল , হেরা এভাবে তুমি চুপচাপ থাকলে আমার ভালো লাগে না !
হেরা নওশাদের দিকে তাকিয়ে আছে ! ওর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে !
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে!
আমি জানি তো । জানো হেরা প্রিয় মানুষ চলে গেলে সবচেয়ে কষ্ট কখন হয় , দেখবে ইচ্ছে করলেও চেহারাটা মনে করা যায় না যখন ! আমি এই ঘরের সব জায়গায় গীতিকে আজও দেখি । মনে হয় এই তো বেডের ঐ পাশটায় শুয়ে থাকতো ও ! সোফার এখানটায় বসে পেপার পড়তো ! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করতো ! কিন্তু ওর মুখটা ঝাপসা দেখি ! মানুষ আর অন্য প্রাণীদের মধ্যে পার্থক্য কি জানো প্রাণীরা বুঝে যায় সে মরে যাবে কয়দিনের মধ্যে কিন্তু মৃত্যু পথযাত্রী মানুষ ও বুঝে না সঠিক সময়টা ! মানুষ বাঁচতে চায় খুব !
যেদিন গীতি চলে গেল আমি কি জানতাম আমার সকাল টা যেমন শুরু হলো রাতটা শেষ হবে কেমন ? জানতাম না !
বুঝলে প্রতিদিনের মত অফিসের জন্য রেডি হচ্ছি ! ও এসে আমার পাশে দাঁড়ালো ! আমার খুব মনে আছে , আমাকে বলল তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে নওশাদ !
আমি হেসে বললাম তুমি ভয় পেয়ো না আমি অন্য কোন মেয়ের দিকে তাকাব না !
ও হাসতে হাসতে বলল, সে আমি জানি তোমাকে ! ইদানিং তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে সারাক্ষণ নওশাদ !
আমি বললাম , তাহলে এক কাজ করি অফিস না যাই বসে থাকি তোমার সামনে !
তা কি হয় ! যাও কালকে লন্ডন যাবে কত কাজ অফিসে তোমার !
আমি বারবার বলেছি চলো গীতি তুমি গেলে না !
ও বলল নিশালের এক্সাম সামনে পরের বার যাব !
বের হয়ে যাব এখানে টেবিল টার কাছে আমি ল্যাপটপ টা নিচ্ছি আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো !
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম, কি ব্যাপার সূর্য উঠলো কোন দিক দিয়ে আজ ! যে কাজটা আমি করি সব সময় এবং বকা খাই বুড়ো হচ্ছি কিন্তু রোমান্স কমে না বলে আজ আপনার কি হলো ?
ও বলল খুব ইচ্ছে হলো তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি !
জানো হেরা ঐ শেষ বারের মত আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল ও ! গীতি সব সময় আমি বের হওয়ার সময় গাড়ি পর্যন্ত যেতো না ! ডাইনিং টেবিল থেকেই ,আমি আসছি বলে চলে যেতাম ! সেদিন ও গাড়ি পর্যন্ত এসেছিল আমি তাকিয়ে দেখি মুখটা শুকনো করে তাকিয়ে আছে ! প্রতিদিন লাঞ্চ করার সময় আমিই ফোন দিতাম খেয়েছে কিনা খোঁজ নিতাম সেদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম কোন ফোন দেইনি । আমি মনে করতে পারি না সেদিন আমি লাঞ্চ করেছিলাম কিনা !
তারপর সন্ধ্যায় ফারহান ফোন দিল হসপিটালে ছুটে গেলাম ! আমি জানতাম না , কল্পনাও করিনি গিয়ে দেখবো সাদা একটা চাদর দিয়ে মুখ ঢাকা সেই মানুষটা কে, যাকে সকালে এইখানে জড়িয়ে ধরে আদর দিয়েছি ! শান্ত হয়ে শুয়ে আছে হসপিটালের বেডে !
হেরা নওশাদের হাতটা ধরলো , ঘাড়ে মাথা টা রাখলো!
তারপর কত রাতের পর রাত আমি বসে থেকেছি ! গীতির নাম ধরে ডেকেছি ! একা একা কথা বলেছি গীতি কে কল্পনা করে ! নিশালের রুমে ছুটে গেছি ! ওর মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় গীতিকে দেখছি !
প্রিয়জন চলে গেলে তার সঙ্গে কাটানো সুন্দর সময় গুলো মনে পড়লে সেটাও কষ্ট দেয় ! তাই বলছি তোমার কষ্ট টা আমি জানি ,বুঝি !
হেরা নওশাদের চোখের পানি টা মুছিয়ে দিলো !
একটা কথা বলতে তোমাকে খুব ইচ্ছে করছে হেরা !
জ্বি বলুন !
ঐ দিন বলেছিলাম না তোমাকে আমি ,এখন আমার বেঁচে থাকার কারন একমাত্র নিশাল !
হুম !
শুধু একা নিশালের জন্য না আমি এখন তোমার জন্যেও বাঁচতে চাই ! তোমার সঙ্গে অনেক দিন সুখে দুঃখে বেঁচে থাকতে চাই ! তোমাকে কষ্ট পেতে দেখলে আমার খুব খারাপ লাগছে ! প্লিজ তুমি আর কষ্ট পেয়ো না ! তোমার নানা তোমাকে এভাবে দেখলে নিশ্চয়ই খুশি হতেন না !
হেরা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, খুব একা লাগছে , মনে হচ্ছে এ পৃথিবীতে আমাকে ভালোবাসতো , আদর , স্নেহ করতো একটা মানুষ সেই আর নেই !
হেরা আমি আছি তারপরও তোমার একা লাগছে ? আর আমার উপর কি তোমার বিশ্বাস নেই !
আছে !
নওশাদ মুখ ফুটে বলতে পারলো না এ পৃথিবীতে তোমাকে ভালোবাসে আরও কেউ তোমার পাশেই আছে !
হেরা নওশাদের কোলে মাথা রেখে শুয়ে চোখ মুচছে !
গান শুনবে হেরা ?
আপনি গাইবেন !
না গাইবো না ! আর কেউ গাইবে আমরা শুনবো নওশাদ মোবাইল এ গান চালু করলো ,
” বেঁচে থাকার জন্যে
দুহাত রাখার জন্যে
অভিমানের জন্যে
কেউ একজন লাগে …
ধরে রাখার কেউ নেই
মনে করার কেউ নেই
মাঝে মাঝে তাই ভিসন একা লাগে ……”
( চলবে)