তবু_সুর_ফিরে_আসে ২৪তম পর্ব

0
158

#তবু_সুর_ফিরে_আসে

২৪তম পর্ব

চারদিন পরেও হেরা চুপচাপ হয়ে আছে ! একেবারে শান্ত ! দুপুরে নিশাল লাঞ্চের সময় ওকে ডাকতে রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালো ! দরজা খোলা হেরা সোফায় শুয়ে আছে কম্বল গায়ে!
আন্টি তুমি খাবে না ?
হেরা উঠে বসলো ! খেতে ইচ্ছে করছে না !
তুমি সোফায় শুয়ে আছো কেন ? বেডে আরাম করে ঘুমাও ঐ দিন ও দেখি সোফায় ঘুমিয়ে আছো ! সোফায় কেউ ঘুমায়, এত বড় বেড থাকার পর ?
হেরা বলল, আমার এখানে ভালো লাগছে ! তুমি খেয়ে নাও আমি পরে খাব !
পরে কেন আমার সঙ্গে এখন‌ই চলো !
ইচ্ছে করছে না !
তাহলে তোমার সঙ্গে তুমি যখন খাবে তখন খাব !
ও মা সে কি কথা তোমার খিদে পেয়েছে তুমি খেয়ে নাও না প্লিজ নিশাল !
সেরকম কিছু না ! তুমি সারাক্ষন মন খারাপ করে আছো দেখো সবাই কেমন চুপ করে আছে ! বাসাটা একদম চুপ হয়ে আছে ! পাপাও চুপ করে আছে মন খারাপ পাপার ও !
অনেক খারাপ লাগছে বুঝলে শুধু মনে পরে যাচ্ছে নানা ভাইয়ের সঙ্গে কাটানো সময় গুলো !
স্বাভাবিক ! একদিন দেখবে ওসব তুমি ভুলে যাবে ! আমি যেমন ভুলে গেছি মাম্মার সঙ্গে কাটানো কত ঘটনা ! এখন শুধু হালকা , ঝাপসা কিছু মনে আছে !
কিছুই মনে থাকবে না নিশাল ?
থাকবে অনেক কম !
তোমার পাপা বলছিল প্রিয়জনের চেহারা নাকি ঝাপসা হয়ে আসে !
হুম !
তুমি উঠো আন্টি খেয়ে ওষুধ খাও তোমার নাকি ওষুধ খেতে হচ্ছে !
কে বলল তোমাকে ?
আনারের মা বলল!
ওষুধ সকালে খেয়েছি তারপর রাতে খাব আবার !
না খাও চলো রুম থেকে বের হ‌ও , তোমাকে মন খারাপ দেখে বাসার সবাই মন খারাপ করে ঘুরছে ! আনারের মা , পারুল, বুয়া সবাই গিয়ে দেখো ! সবচেয়ে বেশি তো পাপার মন খারাপ। আজ তো ব্রেকফাস্ট না করেই অফিস চলে গিয়েছে আনারের মা বলল!
তাই নাকি ! এটা কেমন কথা ?
হুম! তুমি এক কাজ করো পাপা কে কল দাও হয়তো লাঞ্চ ও না করে থাকবে !
ফোন দিব?
হুম !
নিশাল মোবাইল এ পাপার নাম্বার ডায়াল করে মোবাইল এগিয়ে দিল , নাও রিং হচ্ছে কথা বলো ! আমি ডাইনিং এ যাচ্ছি তুমি এসো! নিশাল মোবাইল হেরার হাতে দিয়ে বের হয়ে গেল!
ওপাশে ফোন রিসিভ করে ন‌ওশাদ বলল, হ্যালো নিশাল !
আমি হেরা !
কি অবস্থা তোমার ?
আপনি ব্রেকফাস্ট না করেই অফিস চলে গিয়েছেন ?
ইচ্ছে করছিল না !
এখন লান্চ করেছেন ?
না এখনো করিনি দেখি করব ! তুমি তো কোন টাই করোনি !
ইচ্ছা করছে না আমারো !
ভালো, এভাবে না খেয়ে মুখ লুকিয়ে কান্নাকাটি করলে কি সব দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যাবে হেরা ?
হেরা চুপ করে আছে ।
তাহলে তো গত ছয় বছর আমার উচিত ছিল সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে না খেয়ে জীবন শেষ করে দেয়া ! আর নিশাল তো ছোট শিশু ছিল ওর কি উচিত ছিল মা মারা যাওয়ার পর ?
আমি চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না কেন জানি ?
তুমি কোন চেষ্টাই করছো না ! এভাবে কান্নাকাটি করলে মৃত ব্যক্তির আত্মার কষ্ট হয় হেরা ! এখন তুমি কি করবে সেটা তুমি জানো ! আমার তোমাকে এভাবে পরে আছো দেখতে ভালো লাগছে না ! কালকে খেয়াল করলাম সারা শরীর খালি করে কোন গয়না নেই একদম শূন্য হয়ে পরে আছো তুমি !
সরি !
সরি বলো না । তুমি স্বাভাবিক হয়ে গেছো সেটা হলেই খুশি আমি !
চেষ্টা করব !
ঠিক আছে! এখন যাও খাওয়া দাওয়া করো !
আপনি ও খেয়ে নিন ! আর বাসায় কখন আসবেন ?
আসব ! একটা সেমিনারে যেতে হবে সেটা এটেন্ড করে চলে আসব !
আচ্ছা রাখছি !
হুম!
হেরা ফোন কেটে চোখে মুখে পানি দিয়ে এলো ! চুল ঠিক করল ! খুলে রাখা চুড়ি, চেইন, কানের দুল সব পড়লো ! মনে মনে ভাবছে, আমার জন্য সবাই কে কষ্ট দেয়ার তো কোন মানে নেই ! যে মানুষ টা তাকে এত কিছু দিল জীবনে সেই মানুষটা র জন্য আর একটা মানুষ তাকে এবং তার নানাকে এত সন্মান দেয় সেই মানুষটা কে কষ্ট দেয়ার অধিকার নেই তার !

দুপুরে নিশালের সঙ্গে লাঞ্চ করে হেরা লনে গিয়ে বসলো ! বিকেলে একটু রোদ পড়েছে লনে, গায়ে একটা চাদর পরে সেই রোদে এসে বসলো সে ! মাথায় ঘোমটা টেনে দিলো কানে হালকা বাতাস ঢুকলেই আবার ঠান্ডা লেগে যায় ওর ! এখন ন‌ওশাদের সঙ্গে এক ঘরে থাকে ওর কাশির জন্য বারবার উনার ঘুম ভেঙ্গে যায় ! মানুষটা প্রতিবার ঘুম ভেঙ্গে গেলে রাতে উঠে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ! গতকাল রাতে একবার তার কপালে চুমু খেয়েছে হেরা জেগেই ছিলো কি যে ভালো লেগেছে তার কিন্তু সে একটুও নড়াচড়া করেনি ! তারপর সারা রাত হেরার বারবার ঘুম ভেঙ্গে গেছে ! মনে হয়েছে এই বুঝি ন‌ওশাদ আবার ওর কাছে এলো !
আনারের মা এসে পাশে দাঁড়ালো হাতে ট্রে তে করে চা নিয়ে!
কিছু বলবে ?
আম্মা চা খাবেন ,আদা চা দেই আপনারে ?
বানিয়ে যখন নিয়ে এসেছো তখন দাও খাই !
আপনার ঠান্ডা লাগছে তো আদা চা অনেক আরাম দিব , নেন!
হেরা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে চুমুক দিলো !
তোমার স্যার সকালে না খেয়ে গেছে শুনে খারাপ লাগছে আমার!
হ স্যার তো আপনি যেদিন থে কান্নাকাটি করতেছেন ঠিক মত খায় না ! একটু খাবার নেয় নাড়াচাড়া করে রাইখা দেয় ! স্যারের মন বেশি যখন খারাপ থাকলে খাইতে পারে না !
উনার‌ও মন খারাপ জানি !
আপনি মন খারাপ ক‌ইরা আছেন তাই স্যার কষ্ট পাইতাছে ! আম্মা একটা কথা ক‌ই , যা হ‌ওয়ার তো হ‌ইয়া গেছে আপনি এখন আপনের নানার জন্য দোয়া করেন । আর মনটা শক্ত করেন । আপনার নানা কি এমন মুখ দেখলে খুশি হ‌ইতো কন ?
না !
তাইলে , স্যারের জন্য , নিশাল ভাইয়ার জন্য মন শক্ত করেন! আম্মা ভাইয়া আপনার জন্য মন খারাপ ক‌ইরা ঘুরতেছে ! আমারে বলছে আন্টিকে দেখে কষ্ট হচ্ছে খুব ! আপনারে কত পছন্দ করে বুঝছেন আম্মা !
হ্যাঁ বুঝেছি ! আচ্ছা এলিন , নাহিন কবে আসবে ?
নিজের মা বাপের কাছে গেছে কয়দিন তো থাকব‌ই !
ওরা থাকলে বাসাটা ভরা ভরা লাগে ! বুবু ও গ্রামের বাড়ি গেছে আমার খারাপ লাগছে !
আপনে একবার দাদার ঘরে যাইয়েন ! আপনার কথা জিগায় দাদা !
ঠিক আছে !
আমি যাই আপনার রুমটা গুছায় দেই !
হুম।
আনারের মা যাওয়ার একটু পর শোয়েব অফিস থেকে বাসায় ফিরে এলো । অফিসের গাড়ি নামিয়ে দিয়ে গেল!
হেরা কে লনে বসে থাকতে দেখে ওর সামনে এসে দাড়ালো !
কেমন আছেন আপনি ?
জ্বি ভালো ! হেরার সঙ্গে খুব কম কথা হয় শোয়েবের ! কেন জানি শোয়েব কে দেখলে চুপচাপ হয়ে যায় হেরা !
মামা আপনার নানার জন্য আপনাদের চেয়ারম্যান কে দিয়ে আপনাদের স্কুলে দোয়া ও মিলাদ পড়িয়েছেন ! সমস্ত গ্রামের লোকজন এসেছিল ! চেয়ারম্যান এর কাছে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি আমি নিজে !
তাই ! আমাকে উনি কিছু বলেনি তো ! হেরা খুব অবাক হলো!
মামা এমন‌ই ! এখানের একটা এতিমখানা আছে মামার টাকায় চলে, সেখানে বাচ্চাদের স্প্যাশল খাবার দিতে বলেছেন আগামী শুক্রবার !
হেরা শোয়েবের কথা শুনে ন‌ওশাদের প্রতি শ্রদ্ধায় , কৃতজ্ঞতায় নুয়ে যাচ্ছে‌ !
উনি কোথায় এখন ?
মামা একটা সেমিনারে হোটেল রিডিসনে গেছে !
কখন আসবে জানেন ?
সেমিনার শেষ করে চলে আসবে ! আজ হয়তো গলফে যাবে না আমাকে কিছু বলেনি !
আপনার শরীর খারাপ ছিল এখন কেমন ?
জ্বি ভালো !
শোয়েব হেরার দিকে তাকিয়ে আছে ! সে খেয়াল করেছে মামি তার দিকে না তাকিয়েই কথা বলেন সব সময় ! ওর দিকে চোখ তুলে কথা বললে কি সমস্যা সে বুঝে না !
নিশাল শোয়েব কে দেখে ছুটে এলো ! ভাইয়া তুমি কখন এলে ?
এই তো মাত্র ! তোমার কি খবর ?
আমি রুমে ছিলাম উপর থেকে দেখলাম আন্টি একা বসে আছে এখানে তাই আন্টির কাছে আসছিলাম ।
হেরা ঘাড় ঘুরিয়ে নিশালের দিকে তাকালো তারপর হাত বাড়িয়ে নিশালের হাতটা ধরলো ! থ্যাঙ্কস বাবা ! তুমি আমাকে নিয়ে ভাবো আমার খুব ভালো লাগে দেখে !
নিশাল হাসলো !
তোমরা এখানে বসো আমি রুমে যাই একটু শুয়ে থাকব ঠান্ডা লাগছে খুব !
আজ বাহিরে রোদ থাকলে কি হবে বাতাস প্রচন্ড তুমি রেস্ট নাও আন্টি !
হেরা উঠে এলো দোতলায় ! নিশাল শোয়েবের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলার প্ল্যান করেছে ! বাসার পেছনে ব্যাডমিন্টন এর কোট করা আছে ! দুজন হেঁটে সেদিকে চলে গেল !

হেরার রুমে এসে মনটা অদ্ভুত এক ভালো লাগায় ভরে গেল! ন‌ওশাদ তার নানার জন্য যা করছে সে কল্পনাও করতে পারেনি মানুষ টা এমন কিছু করবে! এবং আশ্চর্যের বিষয় তাকে একবারও বলেনি ! হেরা শুয়ে শুয়ে ন‌ওশাদের কথাই ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেল ! ঠান্ডার ওষুধ গুলো খেলে ওর শুধু ঘুম আসে।
সন্ধ্যায় ওর ঘুম যখন ভেঙেছে দেখে রুমের কর্নারে একটা ল্যাম্প সেইড জ্বলছে! কে এসেছে রুমে ভাবছে ! কি সুন্দর একটা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছে ! ন‌ওশাদের পারফিউম এর ঘ্রাণ ! মাথা উঠিয়ে দেখে ন‌ওশাদ বিছানায় শুয়ে আছে! হেরা উঠে বসলো ! ন‌ওশাদ রাতে ইজি চেয়ারে ই ঘুমাচ্ছে এ ঘরে আসার পর এই প্রথম বিছানায় শুয়ে আছে! হেরা উঠে কাছে দাঁড়িয়ে দেখে ঘুমাচ্ছে ন‌ওশাদ !
বোঝাই যাচ্ছে খুব ক্লান্ত ! এই সময় তিনি কখনোই ঘুম আসেন না ! হেরা ফ্রেশ হয়ে এসে নিজের চুল ঠিক করল, চোখে একটু কাজল পড়লো, কপালে টিপ লাগালো ! মানুষটা তার মন খারাপ দেখে এত চুপ হয়ে আছে হেরা এখন থেকে নিজের মন খারাপ করে আর কাউকে কষ্ট দিবে না ঠিক করেছে !
ন‌ওশাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে ! গায়ের কমফোর্টার টা ঠিক করে দিল! কপালে হাত ছুয়ে দিলো ! হেরার‌ও খুব ইচ্ছে করছে কপালে চুমু খেতে! মনে মনে হাসলো সে ! আরেক বার হাতটা কপালে রাখতেই চোখ মেলে তাকালো ন‌ওশাদ !
হেরা কে দেখে সুন্দর করে হাসলো !
কখন এসেছেন আপনি ?
অনেকক্ষণ তুমি তখন গভীর ঘুমে !
আমাকে ডাক দিলেই হতো !
ইচ্ছে করে দেইনি ঘুমাচ্ছো আরাম করে ! বসো এখানে !
হেরা ন‌ওশাদের পাশে বসলো !
শরীর কেমন তোমার ?
আমার শরীর ভালো , কিন্তু আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে ?
না তো , শুয়ে ছিলাম চোখ লেগে গেছে !
আপনি নানার জন্য মিলাদ পড়িয়েছেন আমাকে বললেনি তো ?
ও আচ্ছা অফিসে ব্যস্ত ছিলাম ভেবেছিলাম বাসায় এসে বলব ! তোমাকে কে বলল ?
আপনার ভাগ্নে শোয়েব ! আমি আপনাকে যত দেখি অবাক হয়ে যাই ! আমার জন্য কত কি করছেন !
তোমার জন্য না , স্যার আমারো একজন শ্রদ্ধার মানুষ ছিলেন ! ন‌ওশাদ হেরার হাত ধরলো !
তোমাকে আজ আগের মত লাগছে । গয়না গুলো পড়েছো ! টিপ লাগিয়েছো ! এভাবে থাকলেই ভালো লাগে তোমাকে !
সরি মন খারাপ ছিল তাই সব খুলে ফেলেছিলাম !
ব্যাপার না এখন মন ভালো হয়েছে ?
হুম!
গুড গার্ল !
আপনি চা খেয়েছেন , আমি বানিয়ে আনছি ?
দরকার নেই সারাদিন এত চা খেয়েছি এখন খেতে ইচ্ছে করছে না ! তুমি বসে থাকো এখানে !
নিশাল কি করে ?
আজ আপনি ব্রেকফাস্ট করে জাননি আমাকে বলল, তুমি মন খারাপ করে আছো তাই পাপাও খায়নি !
আমার খেতে ইচ্ছে করছিল না আবার একটু তাড়াহুড়ো ও ছিল !
আপনার ছেলে আপনাকে নিয়ে চিন্তা করে দেখলেন তো !
তাই তো দেখছি! ন‌ওশাদ হাসলো !
কি করছে এখন ?
ব্যাডমিন্টন খেলার প্ল্যান করছিল ওর ভাইয়ার সঙ্গে !
তাই যখন আমি এলাম বাসায় দেখিনি !
এখন যান কথা বলেন ওর সঙ্গে !
হুম ভালো লাগবে ওর তাই না ?
হ্যাঁ আপনি যান !

ন‌ওশাদ নিশালের রুমের ঢুকে দেখে নিশাল গিটার হাতে বসে আছে !
পাপা এসো !
কি করছো ?
মেহরাবের গিটার টা টিউন করছি !
ন‌ওশাদ নিশালের গিটার টা হাতে তুলে নিল !
কি করলে সারাদিন ?
আজ অনেকক্ষণ পড়লাম ! বিকেলে শোয়েব ভাইয়ার সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলেছি ! তুমি তো বাহিরে যেতে নিষেধ করেছো তাই বের হচ্ছি না বেশি!
বের হতে নিষেধ করিনি বাচ্চা তোমার সঙ্গে কাউকে থাকতে বলেছি !
কেন পাপা ?
আমার তোমাকে নিয়ে খুব ভয় বাবা, তুমি ছাড়া আমার তো কেউ নেই । তোমার ক্ষতি কেউ করুক আমি চাই না ! ন‌ওশাদ গিটারে রিদম তোলার চেষ্টা করছে!
নিশাল অবাক হয়ে বলল,কে ক্ষতি করবে আমার ?
যে আমার ক্ষতি করতে চায় !
কে আবার তোমার ক্ষতি করতে চায় ? নিশাল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে!
আমি জানি না তো বাবা ! নিশাল তুমি কি প্ল্যান করলে কি করবে ফিউচারে ? ন‌ওশাদ প্রসঙ্গ টা চেঞ্জ করলো !
পাপা আমি আর্মি তে জয়েন করব !
ন‌ওশাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে , আর্মিতে কেন ?
পাপা আমি আগেও বলেছি আমার ঐ লাইফ টা পছন্দ !
বুঝলাম কিন্তু আমার ছেলে এত কষ্টের জীবন কেন বেছে নিবে ?
কামন পাপা কষ্ট তো সব লাইফেই আছে , তুমি ও তো সারাজীবন কষ্ট করছো !
কিন্তু আমি একা একা তোমাকে ছাড়া থাকব কিভাবে নিশাল ? আমি তো চাই তুমি আমার পাশে থাকো !
আমি তো দেশেই থাকব পাপা !
দেশে থাকলেই কি হয় আমি চাই তুমি আমার বিজনেস দেখো ! আমি তোমার একটা সিকিউর লাইফ দেখতে চাই বাবা!
ও মাই গড আমি বিজনেস কি বুঝি নাকি ?
বোঝার চেষ্টা করলে বুঝবে একদিন । যাই করো আমার কাছে থেকো নিশাল তোমার এই দূরত্ব আমাকে কষ্ট দেয় !
তুমি মন খারাপ করো না আমি এখনও ডিসিশন নেই নাই দেখা যাক কি হয় !
ঠিক আছে !
ন‌ওশাদের মনটা খারাপ হয়ে যায় নিশালের আর্মি তে যাওয়ার কথা শুনে!

ন‌ওশাদ আর নিশাল লিভিং রুমে গিয়ে গিটার নিয়ে বসলো ! দুজন বাজাচ্ছে । হেরা শ্বশুরের রুমে বসে ছিল ওকে কয়দিন না দেখে বারবার খোঁজ করেছে শ্বশুর!
হেরা গিটারের শব্দ শুনে বের হয়ে এলো শ্বশুরের ঘর থেকে ! তখন‌ই রেজোয়ান আর সুমনা ও দোতলায় এসে উঠলো ! হেরা অবাক এবং খুশি দুটোই হলো!
কেমন আছো এখন তুমি ?
ভালো আছি ভাবি !
খুব ভালো লাগছে আপনারা এসেছেন ! বাসার সবাই আমার মন খারাপ দেখে মন খারাপ করে আছে !
সেজন্যই তোমার বর আমাদের বলল, বাসায় আসার জন্য !
উনি বলেছেন !
হুম আমাকে ফোন দিয়ে বলল, হেরার মন কোন ভাবেই ভালো হচ্ছে না তোমরা দুজন চলে এসো তোমাদের দেখলে ও খুব আনন্দে থাকে !
থ্যাঙ্কস ভাবি সত্যি আপনারা আসলে খুব ভালো লাগে!
চলো ওদিকে গিয়ে বসি !
হেরা আর সুমনা লিভিং রুমের সোফায় গিয়ে বসলো !
বাহ্ ন‌ওশাদ আজ তাহলে তোমার গিটার বাজানো শুনব !
সুমনা আজ নিশালের গিটার শুনো। আমার ছেলে চমৎকার বাজায় !
আন্টি পাপা বেশি বেশি বলছে । আমি পাপার মত এত ভালো কখনোই পারবো না !
দেখি আমরা শুরু করো দুজন !
নিশাল আর ন‌ওশাদ গিটার বাজাচ্ছে ! হেরা সুমনার পাশে বসে মুগ্ধ হয়ে শুধু ন‌ওশাদ কে দেখছে !
ন‌ওশাদ শুধু টুং টাং করলে আমরা মজা পাচ্ছি না একটা গান শোনা রেজোয়ান বলল !
রেজোয়ান তুই ধর গান !
তোর মত গানের গলা থাকলে বলতে হতো না বুঝলি, তুই বেটা ভাব ধরে আছিস !
ন‌ওশাদ একবার হেরার দিকে তাকিয়ে গিটার এ সুর তোলা শুরু করলো!
তারপর গেয়ে উঠলো,
‘ পালাতে পারিনি আমি যে দিশেহারা
দুটি চোখ যেন আমায় দিচ্ছে পাহারা
ধরা পড়ে গেছি আমি নিজের‌ই কাছে
জানি না তোমার মনে‌ও কি এত প্রেম আছে
সত্যি যদি হয় বলুক যা বলছে নিন্দুকে!
মন্দ করেছে আমাকে ঐ দুটি চোখে !
কি নামে ডেকে বলব তোমাকে
মন্দ করেছে আমাকে ঐ দুটি চোখে…’

গান শেষে নিশাল বলে উঠলো, পাপা এক্সিলেন্ট ! নিশাল খুশি হয়ে উঠলো ! তুমি এত সুন্দর গান গাও !
নিশাল তোমার পাপা আরো সুন্দর গান গাইতো আমরা যখন ভার্সিটিতে পড়তাম !
সত্যিই আন্টি আমি তো মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি !
ন‌ওশাদ বন্ধু কোন চোখ তোকে এত মন্দ করলো ?
ন‌ওশাদ নিশালের সামনে রেজোয়ানের কথায় একটু আন‌ইজি ফীল করছে।
বল ?
যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায় ভালো মন্দ মিলায় সকলি …শালা তোর মত না ।‌ সারাক্ষণ পিছনে লেগে থাকে !
ওফফ তোমাদের টম এন্ড জেরি খেলা শেষ হয় না তাই না সুমনা রেজোয়ান কে বলল!
হেরা তুমি একটা গান গাও না !
ভাবি আমার গলা বসে গেছে !
আন্টি তুমি গান গাইতে পারো ? নিশাল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে হেরার দিকে!
নিশাল তোমার আন্টি চমৎকার গান গায় ! আমরা কক্সবাজারে তোমার আন্টির গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম ! তোমার পাপা কে জিজ্ঞেস করে দেখো !
ন‌ওশাদ হাসছে ! থাক ওর ঠান্ডা গলা বসে আছে !
হেরার খুব ইচ্ছে করছে ন‌ওশাদের পাশে গিয়ে বসতে । মানুষ টা এত চমৎকার কেন ! ওর ভাগ্যে এরকম একটা মানুষ ছিল ! হেরার বুকের ভেতরে শুধু ন‌ওশাদের জন্য ভালোবাসা আর মুগ্ধতা ই বাড়ে !

বুবু , এলিন, নাহিন সব এসে গেছে বাসাটা এখন লোকজনে ভরা ! ন‌ওশাদের দুই ভাইয়ের ব‌উ বাচ্চাদের নিয়ে বিকালে এসেছে !
হেরা সবার সঙ্গে বসে গল্প করছে ! ন‌ওশাদ আগামীকাল ব্যাঙ্কক যাবে তাই অফিস থেকে অন্যদিনের চেয়ে আগেই এসেছে বাসায় ! সাধারণত দেশের বাহিরে যাওয়ার আগে ন‌ওশাদ অনেক ব্যস্ত দিন পার করে ! আজ ওর বাসায় ফেরার জন্য মনটা খুব চাইছিল ! ও আসবে যেদিন নিশাল কলেজে ফিরে যাবে সেদিন ।ছেলেটার সঙ্গে সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে। হেরার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করছে ! দুজনকে নিয়ে বাহিরে খেতে গেলে ভালো লাগতো ! বুবু বাসার বাহিরে কোথাও খায় না কিছু ! কিন্তু বাসায় এসে দেখে নাদিয়া আর মিলা এসেছে বাসায় ! সঙ্গে তাদের বাচ্চারা !
হেরা ন‌ওশাদ এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছে দেখে মনে মনে খুব খুশি হলো ।
কি খবর নাদিয়া তোমরা কখন এলে ? ন‌ওশাদ হেরার পাশে এসে বসলো !
জ্বি ভাইয়া এসেছি অনেকক্ষণ ! আপনি আজ আগে আগে চলে এসেছেন !
হুম , এলাম কালকে দুই দিনের জন্য ব্যাঙ্কক যাচ্ছি আসব যেদিন নিশাল চলে যাবে তাই ভাবলাম ছেলেটার সঙ্গে সময় কাটাই !
ভালো করেছেন ভাইয়া !
ন‌ওশাদ সবার সামনে এভাবে হেরার পাশ ঘেঁষে বসতেই হেরার খুব লজ্জা লাগা শুরু হয়েছে ! আগে কখনো সবার সামনে এতটা কাছে উনি বসেনি ! মিলা হেরার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে !
হেরা চুপ করে বসে আছে !
ভাইয়া ভাবিকে নিয়ে যাবেন না থাইল্যান্ড ?
না আমি যাচ্ছি কাজে তাও দুই দিনের জন্যে ! আর ওর পাসপোর্ট করাতে হবে !
হেরা ন‌ওশাদের দিকে তাকিয়ে বলল , আপনাকে চা দিব ?
এখন না ! নিশাল কোথায় ?
বাচ্চারা সব ব্যাডমিন্টন খেলছে !
তাই দেখি আমিও ওদের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলব আজ ! তোমার মুখ শুকনো কেন হেরা ?
কোথায় না তো !
আমার মনে হচ্ছে ! শরীর ঠিক আছে?
জ্বি!
তোমরা গল্প করো আমি ফ্রেশ হয়ে আসি ! বলেই ন‌ওশাদ উঠে গেল !
মিলা হেরার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাবি ভাইয়া তোমার খুব টেক কেয়ার করে তাই না ?
হেরা মুখে কিছু বলল না হাসলো শুধু।
মিলা ভাইয়া সব সময় এমন কেয়ারিং দেখো নাই আগে গীতি ভাবির কত খেয়াল রাখতো !
হুম , ঠিক বলেছো ভাইয়া সব সময়ই কেয়ারিং !
মিলা হেরার কাছ ঘেঁষে বসলো , এই ভাবি তুমি সত্যি করে বলো তো ভাইয়া খুব রোমান্টিক না ? গীতি ভাবি আর ভাইয়া তো সমবয়সী ছিল ! আমাদের যখন বিয়ে হয়েছে ততদিনে তো দেখেছি গীতি ভাবি পুরো ভাইয়ার গার্ডিয়ানে মত ভাইয়ার উপর কন্ট্রোল তার! তুমি তো ভাইয়ার অনেক অনেক ছোট ! তোমার সঙ্গে নিশ্চয়ই ভাইয়া খুব রোমান্টিক ? বলো না প্লিজ ?
কি বলবো ?
বলবে বিড়াল টা কে মারলো তুমি না ভাইয়া ? নাদিয়া আর মিলা হেরার কাছে এসে ঝুকে বসলো !
হেরা অবাক হয়ে বলল,কিসের বিড়াল ? এই বাসায় তো কোন বিড়াল দেখিনি এখনও !
আঁ নাদিয়া আর মিলা মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে ! তারপর হো হো করে হেসে উঠলো !
আমি বুঝতে পারছি না সত্যি ভাবি , নিশাল সেদিন একটা কুকুর নিয়ে এসেছে কিন্তু বিড়াল কখনো দেখিনি এই বাসায় !
আচ্ছা আর দেখতে হবে না বলে দুই জা হাসতে হাসতে সোফা থেকে পড়ে যাচ্ছে প্রায় !

রাতে ঘুমানোর সময় ন‌ওশাদ হঠাৎ প্রশ্ন করলো নাদিয়া আর মিলাকে দেখলাম তোমার সঙ্গে খুব মজা করে গল্প করছে !
হুম ভাবিরা অনেক মজার মজার গল্প করে ! যদিও আমি সব গল্পে অংশগ্রহণ করতে পারি না !
কোন গল্পে ? ন‌ওশাদ মনোযোগী হয়ে হেরার দিকে তাকালো !
বাচ্চাদের পড়াশোনার গল্প , তারপর কাজের মানুষের বিভিন্ন কিছু নিয়ে গল্প , শপিং নিয়ে গল্প থাকে ! ফেইসবুকে ছবি দেখে শপিং করে ভাবিরা ! আমার সামনে বসে একজনের কাছে দুটো ড্রেস অর্ডার করলো ! সেই সব গল্প !
আর কি নিয়ে গল্প করলো ?
দুজন ভাইয়াদের অনেক বদনাম করলো ! হেরা হাসছে কথাটা বলেই !
তুমি আমাকে নিয়ে কিছু গল্প করতে । আমার দোষত্রুটি গুলো আলোচনা করতে !
আপনার দোষ তো আমি খুঁজেই পেলাম না অন্যদের কাছে সে গুলো বলে বেড়াব কিভাবে ছিঃ !
হাজব্যান্ডের দোষ আলোচনা করা দোষের কিছু নেই এটা মেয়েদের বিনোদন ! আচ্ছা আমার ভাইদের কি বদনাম করলো ওরা ?
আরমান ভাইয়া অনেক আনরোমান্টিক আর ফারহান ভাইয়া খুব কন্জুস এই কথা বলেছে ভাবিরা !
ন‌ওশাদ হাসছে হেরার কথা শুনে মিলা যে বিলাসীতা করে সেটা বলেনি তাই না !
আপনি একজন পার্ফেক্ট মানুষ ওরাও বলে !
তাই বুঝি , আমাকে নিয়ে কি বলল আবার ?
আপনি একজন অলরাউন্ডার । কেয়ারিং হাজব্যান্ড, বড় ভাই, ভাসুর , ছেলে সব ! আপনার মত বাকি ভাইয়েরা রোমান্টিক ও না ব‌উ এর কেয়ার ও করে না !
আমার ছোট ভাইয়ের বউ রা এই কথা বলল, আমি রোমান্টিক ! মান ইজ্জত আর র‌ইলো না ! ন‌ওশাদ হাসছে !
আমি রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় দেখি নাদিয়া মিলা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে কি নিয়ে ? কিন্তু তুমি দেখলাম চুপ করে তাকিয়ে আছো !
হ্যাঁ উনারা একটা বিড়াল নিয়ে কথা বলল , তারপর নিজেরাই হেসে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছিল !
কি বিড়াল ?
আমাকে বলল, বিড়াল টা কে মারলো ভাবি তুমি না ভাইয়া ? আমি বলেছি এই বাসায় নিশাল একটা কুকুর এনেছে সেদিন কিন্তু কখনো কোন বিড়াল দেখিনি ! আর বিড়াল দেখলেই মারতে হবে কেন তাড়িয়ে দিলেই তো চলে যায় !
ন‌ওশাদ হেরার কথা শুনে হো হো করে হাসছে ! হাসতে হাসতে ওর চোখে পানি চলে এসেছে !
আপনিও দেখি ওদের মত হাসছেন ! ঘটনা বলুন তো আমি তখন থেকে চিন্তা করছিলাম এই সামান্য কথায় এত হাসির কি হলো উনাদের !
তুমি বুঝবে না !
বুঝিয়ে বলুন !
আচ্ছা ঠিক আছে কাছে এসো আমি বুঝিয়ে বলছি !
হেরা ন‌ওশাদের পাশে গিয়ে বসলো !
আরো কাছে , কানে কানে বলতে হবে !
কানে কানে কেন ? এই ঘরে তো আমাদের কথা শোনার কেউ নেই !
কিছু কথা কানে কানে বলতে হয় হেরা !
ঠিক আছে বলুন কানে কানে !
ন‌ওশাদ হেরার কানের কাছে মুখ নিয়ে এলো ! ন‌ওশাদের নিঃশ্বাস টা গায়ে স্পর্শ করতেই হেরার শরীর আবার সেই ঝিমঝিম করছে ! হেরার কানের পিছনে চুমু খেয়ে ন‌ওশাদ ফিসফিস করে বলল, আমি থাইল্যান্ড থেকে আসি তারপর বিড়াল টা নিয়ে আলোচনা করব ! কথাটা বলেই ন‌ওশাদ হাসছে ! অনেক দিন পর এতটা প্রাণ খুলে হাসলো সে !
হেরা তাকিয়ে দেখছে কোন পুরুষ মানুষ হাসলে এতটা সুন্দর লাগে কখনো সে আগে দেখেনি ! মনে হচ্ছে পুরো ঘরটা ঝলমল করছে !
এভাবে হাসবেন না প্লিজ !
কেন ?
আমার নজর লেগে যাবে , আপনাকে হাসলে অনেক সুন্দর লাগে !
ন‌ওশাদ তবুও হাসছে ! হাসতে হাসতে সে হেরা কে জড়িয়ে ধরলো ! তুমি সত্যিই অনেক অবুঝ হেরা !

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here