এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ২৫.

0
214

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৫.

ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি পান করে গলার তেষ্টা কিছুটা মেটায় বাণী। অত:পর স্থির হয়ে বসে। দূর্জয় এক পল বাণীকে দেখে নিয়ে শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,

“ কার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছো? “

বাণী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দৃষ্টি নত রেখে জবাব দেয়,

“ হিরণ। “

“ হিরণ কে? “

“ আমার মেয়ের পাপা। “

দূর্জয় এবার আগ্রহ অনুভব করলেও তা প্রকাশ করে না। কেবল প্রশ্ন করে,

“ কেন? “

বাণী এই পর্যায়ে চোখ তুলে তাকায়।

“ কারণ অনেক বড়। কোথা থেকে শুরু করবো? “

“ শুরু থেকেই নাহয় শুরু করো। আমার হাতে সময় আছে। এক রাত যথেষ্ট হবে না তোমার দীর্ঘ কারণ বলার জন্য? “

বাণী দূর্জয়ের প্রশ্নের উত্তর দেয় না। সে এবার দূর্জয়ের চোখে চোখ রেখে বলতে শুরু করে,

“ সাত বছর আগের ঘটনা। ভাইয়া খুব করে চাচ্ছিলো আমি যেনো আমার হায়ার স্টাডিজ কমপ্লিট করার জন্য বাহিরের দেশে ট্রাই করি। আমি তখন ভাইয়ার কথা মতো আইইএলটিএস এর প্রিপারেশন নিচ্ছি। বাবা একদিন সন্ধ্যাবেলা করে আমাকে আর মামণিকে ডাকলেন গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা বলতে। বাবার চেহারা দেখেই আমরা আঁচ করতে পারি খুব সিরিয়াস কোনো বিষয়। মামণি কি হয়েছে জানতে চাইলে বাবা বলেন, তিনি আমার বিয়ে নিয়ে ভাবছেন। শুধু ভাবছেনই না বরং তিনি রীতিমতো একজনের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা পাকা করে ফেলেছেন। বাবার এরকম ষ্টুপিড সিদ্ধান্তের পিছনে কোনো কারণ শোনার মতো ধৈর্য্য আমার ছিলো না। আমি সোজা না জানিয়ে দেই। বাবা তবুও ইনিয়ে বিনিয়ে আমাকে রাজি করানোর চেষ্টা করে। আমি রাজি হই না। জেদি স্বভাবটা ঘাড়ে চেপে ধরে। রুমে গিয়ে রাগে দরজা আটকে ভাঙচুর শুরু করি। কোথাও না কোথাও আমার বিশ্বাস ছিলো সবসময়ের মতো বাবা এবারও আমার জেদের সামনে হার মানবে। কিন্তু আমার বাবা সেদিন প্রথমবারের মতো আমার বিশ্বাস ভাঙে। আমার ভাঙচুর বন্ধ হয় মামণির চিৎকারের শব্দে। দরজা খুলে দ্রুত মামণি বাবার রুমের সামনে যেতেই চিৎকারের শব্দ আরো স্পষ্ট শুনতে পাই। মামণি কখনোই বাবার মতের বিপক্ষে কোনো কথা বলতো না। কিন্তু সেদিন মামণি বাবার বিপক্ষে গিয়ে আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলে। এটাই মামণির ভুল ছিলো। আদরের একমাত্র মেয়েকে কিছু বলতে না পেরে বাবা দরজা লাগিয়ে মামণিকে ঝাড়ু পেটা করে। আমি দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে যখন প্রায় ভেঙে ফেলার উপক্রম হয় তখন মামণির চিৎকার থেমে যায়। বাবাও দরজা খুলে গটগট করে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। বাবা যখন আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো আমার মনে হচ্ছিলো আমি এই লোককে চিনি না। নিজের বাবাকেই নিজে চিনতে পারছিলাম না। বাবা বের হয়ে যেতেই আমি রুমে ঢুকে দেখি মামণি ফ্লোরের একপাশে অর্ধ চেতনাহীন অবস্থায় পড়ে আছে। “

এতটুকু বলতেই বাণীর গলা ফের শুকিয়ে আসে। তবে সে থামে না। দূর্জয়ের চোখে তাকিয়ে বলতে থাকে,

“ বাবা পরের দিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসে। বাবা ফেরার আগ পর্যন্ত আমরা মা মেয়ে মূর্তির মতো সারাদিন যে যার রুমে পড়ে ছিলাম। না আমি লজ্জায় মামণির সামনে দাঁড়াতে পারছিলাম, না মামণি আমার সাথে কোনো কথা বলছিলো। সেদিন রাতের বাবার এই নতুন রূপের কথা মিশিগানে বসে থাকা ভাইয়াকেও জানাই নি আমরা। কি জানাতাম? মাথা কাজ করছিলো না তখন। জানানোর মতো পরিস্থিতি ছিলো না। বাবা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে অদ্ভুৎ এক কাজ করে। মামণির কাছে আমার সামনে পা ধরে মাফ চায়। আমাকেও বলে তিনি সেই বিয়ে ভেঙে দিয়ে এসেছেন। আমার সামনে আর বিয়ের কথা তুলবে না। জানিনা আমার মামণি কিসের তৈরী কিন্তু তিনি একমাস পেরোতেই বাবার সেই আঘাতের কথা ভুলে যায়। আবার আগের মতো স্বাভাবিক আচরণ শুরু করে। কিন্তু আমি বাবার সেই আচরণের কথা ভুলতে পারি নি। উপরে যতটাই স্বাভাবিক আচরণ করি না কেনো ভিতরে ভিতরে বাবার প্রতি আর সম্মান কিংবা ভালোবাসা অনুভব করতে পারতাম না। “

দূর্জয় শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,

“ তোমার বাবা পরে আর কখনো তোমার সামনে এরকম আচরণ করেছে? “

দূর্জয়ের প্রশ্ন শুনে বাণী মলিন হাসে। ঠোঁটের কোণে মলিন হাসি বজায় রেখেই ঠান্ডা গলায় বলতে থাকে,

“ সেই ঘটনার এক মাস পনেরো দিন পরে বাবা হঠাৎ জানায় তিনি কি যেনো এক কাজে চট্টগ্রাম যাবেন। আমাকেও সাথে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন। আমার সবসময়ই সমুদ্রে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু কখনো সুযোগ কিংবা সময় হয়ে উঠেনি যাওয়ার। ভাইয়া যখন বন্ধুদের সাথে মিলে কক্সবাজার ট্রিপে গিয়েছিলো, তখন আমার খুব হিংসে হতো। এতো ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সেদিন বাবার প্রস্তাবে আমার মন টানছিলো না। মানা করে দেই। সেদিন রাতে মামণি আমার রুমে আসে। মাথায় তেল দেওয়ার বাহানায় খুব কথা বলেন আমার সঙ্গে। কথায় কথায় এ-ও বলেন যে সেদিন প্রথম বাবা উনাকে আঘাত করেন নি। এর আগেও করেছেন বহুবার। এতটুকু শুনেই আমার বাবার প্রতি খুব ক্ষোভ জন্মায়। ইচ্ছে করছিলো থানায় গিয়ে নারী নির্যাতনের মামলা করি। কিন্তু মামণি আমাকে টেনে নিজের সামনে বসিয়ে খুব অদ্ভুৎ কথা বলে। এসব থানা পুলিশে নাকি মামণির সম্মান যাবে। উনার নাকি এই সংসারে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছে না। আর বাবাও নাকি শুধুমাত্র খুব রেগে গেলেই মাঝেমধ্যে এরকম গায়ে হাত তুলে। মামণি আমার এবিউজার বাবাকে ডিফেন্ড করে আমাকে অনুরোধ করে আমি যেনো বাবার সাথে চট্টগ্রাম গিয়ে ঘুরে আসি। তিনি চান না অযথা এসব নিয়ে আবার কোনো কথা কাটাকাটি হোক। আমি সেদিন মামণির অনুরোধ ফিরাই নি। চট্টগ্রাম যেতে রাজি হই। কিন্তু মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম একবার মিশিগান পৌঁছাতে পারলে ভাইয়াকে রাজি করিয়ে মামণিকেও আমাদের কাছে নিয়ে যাবো। আর দেশে বাবার কাছে কখনোই ফিরবো না। “

এতদূর বলে বাণী আচমকাই থেমে যায়। দৃষ্টি নত করে। আনমনে বলে উঠে,

“ কে জানতো সেটাই আমার নিজের বাড়িতে শেষ রাত হতে যাচ্ছে? কে জানতো সেটাই আমার মামণির সাথে শেষ সাক্ষাৎ ছিলো? “

বাণীর আনমনে বলা কথা দূর্জয়ের কানে পৌঁছায়। সে এখনো যথেষ্ট ঠান্ডা আছে। উত্তেজিত হয় নি মোটেও। শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে,

“ তারপর? “

বাণী সম্বিত ফিরে পায়। ফের বলতে শুরু করে,

“ পরের দিন আমি বাবার সাথে চট্টগ্রাম আসি। প্রথমদিন বাবা সারাদিন কাজে ব্যস্ত ছিলো বিধায় আমি হোটেলে ঘুমিয়ে সময় পাড় করি। কিন্তু তার পরের দিন বাবা সারাদিন হাতে সময় রেখে আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। সারাদিন চট্টগ্রাম শহর ঘুরে বিকেলের দিকে খুব ক্লান্ত অনুভব করায় আমি চলন্ত গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু ঘুম যখন ভাঙে তখন আমি আর গাড়িতে ছিলাম না। ছিলাম অপরিচিত কারো বেডরুমে। ঘুম ভাঙতেই আমি অনুভব করি আমার মাথাও অজানা কোনো কারণে খুব ভারী অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু সেসব দিকে পাত্তা না দিয়ে আমি বাবাকে ডাকতে শুরু করি। রুম থেকে বের হতেই উপলব্ধি করি এটা কোনো সাধারণ বাড়ি নয়। আমাদের বাড়ির থেকেও কয়েকগুণ বড় এবং জৌলুশপূর্ণ বাড়ি। আমি ঘুরতে ঘুরতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে যেতেই দেখি বাবা সোফায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। উনার সঙ্গে আর কেউ নেই। আমি দ্রুত বাবার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করি আমরা কোথায় আছি। বাবা আমার প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে আয়েশ করে আগে চায়ে শেষ চুমুকটা বসায়। তারপর আমাকে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে বলতে শুরু করে, নিজের রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক দূরাবস্থার কথা। ব্যবসায় হঠাৎ বিশাল এক লস খেয়ে বাবার আর্থিক অবস্থার তখন করুণ দশা। অপরদিকে ইলেকশন এগিয়ে আসছে। ইলেকশন লড়ার মতো টাকাও বাবার কাছে নেই। এই পরিস্থিতির একটাই সমাধান। আমার বিয়ে। আমি যদি একবার বিয়েতে রাজি হয়ে যাই তাহলে পাত্র বাবাকে গুণে গুণে দশ কোটি টাকা দিবে। সেই সঙ্গে বাবার ইলেকশনে জেতার জন্য অনুসাঙ্গিক আর যা খরচ আছে সব সে বহন করবে। বাবার কথা শুনে আমি নির্বাক হয়েছিলাম। নিজেকে মানুষ কম পণ্য বেশি মনে হচ্ছিলো। আমার দাম কতো জানো? দশ কোটি টাকা। “

শেষ বাক্যটা উচ্চারণ করার সময় বাণীর গলা কাপলো। দূর্জয়ের স্থির চিত্ত মুখশ্রীতে এবার মৃদু অস্থিরতা লক্ষণীয় হলো। সে উঠে এগিয়ে আসতে চাইলো বাণীকে আরেক গ্লাস পানি দেওয়ার জন্য। কিন্তু বাণী তার আগেই বলে উঠে,

“ ঠিক আছি। “

বাণীর ইশারা পেতেই দূর্জয় আর নড়লো না। আপন জায়গায় বসে রইলো। বাণী নিজ থেকেই বলতে শুরু করে,

“ আমি রাজি হলাম না বিয়ের জন্য। চিৎকার, চেঁচামেচি করলাম খুব। আমার বাবা বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় নি। তিনি আমার সব চিৎকার গুলোকে নীরবে হজম করে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত রেখে হেসে বলে, তিনি যা করছেন সবার ভালোর জন্য করছেন। আমাদের পুরো পরিবার এতে ভালো থাকবে। ভালো থাকবো আমিও। বাবার প্রতি আমার এতো দিনের রাগ আমি আর চেপে রাখতে পারি নি। রাগে ক্রোধে উনার হাত মাথা থেকে সরিয়ে একটা ফুলদানি তুলে নেই উনার দিকে ছুঁড়ে মারার জন্য। ছুঁড়েও মারি। কিন্তু উনি নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়। এক তিল পরিমাণ রাগ দেখায় না আমার উপর। দেখাবে কেনো? আমি উনার কাছে তখন সোনার ডিম পাড়া হাস। উনি শুধু মুচকি হেসে বলে, আমি না বিয়ে করি কিংবা না করি এখন থেকে আমাকে সেই অচেনা লোকটার সাথেই থাকতে হবে। কারণ বাবা ইতিমধ্যে টাকার বিনিময়ে আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে। যেদিন আমি রাজি হবো একমাত্র সেদিনই বিয়ে হবে। এটুকু বলেই উনি আমাকে সেই সম্পূর্ণ অচেনা বাড়িতে অচেনা এক লোকের আওতায় রেখে চলে যায়। “

“ তুমি? তুমি ওখান থেকে পালানোর চেষ্টা করো নি? “

দূর্জয়ের কণ্ঠে আগ্রহ না-কি চিন্তা তা ঠিক ঠাওর করতে পারলো না বাণী। সে আপাতত অতীতের তীক্ষ্ণ ব্যথা গুলো ফের অনুভব করছে। ব্যথাতুর দৃষ্টি মেলে বলে,

“ করেছি। সঙ্গে সঙ্গে বেরোনোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু বের হওয়ার সুযোগ পাই নি। কিছু অপরিচিত মুখ এসে আমাকে ঘিরে ধরে। অনুরোধের সুরে বলতে থাকে ভয় না পেয়ে শান্ত হয়ে বসতে। আমি রাগে উগ্র আচরণ শুরু করি। সামনে যা পাচ্ছিলাম সব ওদের দিকে ছুঁড়ে মারতে শুরু করি। কিছুজন আঘাত প্রাপ্ত হয়। এসবের মধ্যেই কোথা থেকে এক আহত লোক এসে হঠাৎ আমার ঘাড়ে সুঁচালো কিছু একটা চেপে ধরে। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কিছু একটা প্রবেশ করছিলো। তা আমি অনুভব করছিলাম। কিন্তু সেই অনুভূতি বেশিক্ষণ টিকে নি। চেতনাহীন হয়ে পড়ি। “

দূর্জয়ের বুকের ভেতর নীরব স্পন্দন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে ক্রমশ। দম আটকে সে বাণীর পানে চেয়ে থাকে। বাণী চুপ রইলো ক্ষণকাল। অত:পর বলতে শুরু করে,

“ যখন জ্ঞান ফিরে তখন গভীর রাত্রি। অন্ধকারের মধ্যেও আবার আমি নিজেকে সেই একই বেডরুমে খুঁজে পাই। চেতনানাশক ওষুধের প্রভাবে কিনা জানা নেই তবে শরীরে তখন বিন্দুমাত্র বল খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি। না পাচ্ছিলাম কিছু বলার শক্তি। কোনো মতে বিছানায় উঠে বসি। তখনই রুমের দরজা খুলে অন্ধকারের মধ্যে কেউ একজন রুমে প্রবেশ করে। সে কে তা জানার প্রয়োজন বোধ করি না আমি। শুধু অন্ধকারে হাতড়ে হাতের কাছের বালিশটা তার দিকে ছুড়ে মারি। কোনো লাভ হয় না। কেউ একজনটা এগিয়ে এসে বিছানায় আমার মুখোমুখি বসে। মানুষটার উপস্থিতি আমাকে অস্বস্তি দিচ্ছিলো। তবুও আমি সাহস করে তার হাত খাঁমচে ধরি। নখের আঁচড়ে রক্ত বের করে আনি। গলায় মৃদু বল জুগিয়ে জানতে চাই সে কে। এক হিমশীতল পুরুষালি গলা জবাব দেয় ‘হিরণ’। নিজের নামটুকু বলেই উনি একটা লাইটার জ্বেলে ধরে আমার মুখের কাছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমে সেই মৃদু উষ্ণ আলোয় আমি নিজের জীবনের অভিশাপের মুখদর্শন করি প্রথমবারের মতো। লোকটা শান্ত গলায় আমাকে জানায় ভয় না পেতে। আর কেউ আমাকে ছুঁতে আসবে না। যেই লোকটা আমাকে সেই চেতনানাশক ওষুধ ইনজেক্ট করেছিলো তাকে মৃত্যু উপহার দিয়ে এসেছে। আর কেউ যদি এই ভুল করার স্পর্ধা দেখায় তার-ও একই পরিণতি হবে। লোকটার এসব ভয়ংকর কথা শুনে আমার মাথায় উনার জন্য উপযুক্ত একটা শব্দই বারবার ঘুরছিলো। ‘মানিয়াক’। লোকটা আমাকে বলে, আমি যতদিন নিজ থেকে রাজি না হবো ততদিন বিয়ে হবে না। তবে আমার ওই বাড়ি থেকে পালানোরও অনুমতি নেই। আমার জীবন ওই উঁচু চার দেয়ালের সীমানার মধ্যেই বদ্ধ থাকবে। বাহিরের পৃথিবীর সাথে আমার বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে। “

দূর্জয় না চাইতেও তার গলায় বিস্ময় ফুটে উঠে। পাথরের ন্যায় প্রশ্ন করে,

“ বিয়ে করতে রাজি হলে কেনো তাহলে? “

দূর্জয়ের প্রশ্নের পিঠে বাণী এবার মৃদু হাসে। রহস্যময় সেই হাসি। বাণীকে যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে দূর্জয়। এই ধরনের হাসি যে পরিস্থিতিকে কতটা রহস্যময় করে তুলছে সেই সম্পর্কে কি এই মেয়ের বিন্দুমাত্র ধারণা আছে? বাণী দূর্জয়ের সেই প্রশ্নকে উপেক্ষা করে বলে,

“ এক বছর। এক বছর ওই বাড়িতে আমি বন্দী দশায় ছিলাম। বাহিরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। নিজের পরিবারের সাথে যোগাযোগহীন ছিলাম। এই এক বছরে হিরণের অসংখ্য লোককে আঘাত করে আহত করেছি। সুযোগ পেলে হিরণকেও ছাড়তাম না। যতবার সুযোগ পেয়েছি আঘাত করেছি। ওর বুকে কাঁটা চামচও গেঁথে দিয়েছিলাম একবার। মুহুর্তটা তৃপ্তিকর ছিলো। এই এক বছরে আমার জীবনের কন্ট্রোল আমার হাতে না থাকলেও, একটা জিনিসের কন্ট্রোল আমার হাতে ছিলো। সেটা হলো হিরণকে বিয়ে করতে মত দেওয়া। আমার বাবা হয়তো ভেবেছিলো আমি মামণির মতো এসব কিছু মেনে নিবো। কিন্তু বাবা আমাকে কখনো চিনতে পারে নি। আমার জেদ সম্পর্কেও হয়তো উনার ধারণা নেই। নিজের সঙ্গেই আমি জেদ ধরি। প্রয়োজনে মরে যাবো কিন্তু এই মানিয়াক বর্বরকে কখনো বিয়ে করবো না। আমি আমার জেদে অটক থাকি। এই এক বছর পর উপরওয়ালা আমার দিকে মুখ তুলে তাকায়। হিরণের কঠোর নিরাপত্তা ভেদ করে আমার ভাইয়া আমার পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়। আমাকে হিরণের জাহান্নামতুল্য প্রাসাদে ফেলে বাবা সিলেট ফিরে যাওয়ার পর মামণি আর বাবার মধ্যে কি হয়েছে তা ভাইয়ার অজানা। কেবল তার পরের দিন তিনি খবর পায় মামণি সিড়ি থেকে পড়ে গিয়েছে। আমার মামণি আর নেই। ভাইয়া খবর পেয়ে দেশে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ততক্ষণে মামণিকে দাফন করা হয়ে গিয়েছে। আমরা দুই ভাই বোন নিজের মা’কে শেষ বারের মতো দেখার সুযোগও পাই নি। আমাকে না পেয়ে ভাইয়া যখন বাবার কাছে জানতে চায় আমি কোথায়, তখন বাবা জানায় আমি তাদের মুখে চুনকালি মেখে কারো সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছি। বাবার এই মিথ্যাটা ভাইয়া বিশ্বাস করে না। উল্টো তার কাছে সবকিছু সন্দেহজনক লাগছিলো। তবে সেই মুহুর্তে তিনি কোনো রিয়েক্টও করে না। ভাইয়া আমার বিপরীত স্বভাবের। ঠান্ডা, শান্ত স্বভাবের। ভাইয়া নিজের পড়াশোনা ছেড়ে দেশে রয়ে যায়। বাবার ব্যবসা সামলানোর নাম করে বাবার উপর নজর রাখে। দশ মাস পর আমার তথ্য পেতে সক্ষম হয়। আমি কোথায় আছি জানতে পেরে দুইমাস ওঁৎ পেতে ছিলো আমাকে উদ্ধার করার জন্য। সুযোগ পেতেই ভাইয়া সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমার কাছে পৌঁছায়। হিরণের গার্ডদের চোখে ধূলো ছুড়ে আমাকে নিয়ে পালায়। “

দূর্জয় বাণীর কথায় এতটাই ডুবে গিয়েছে যে বাণী পালাতে সক্ষম হয়েছিলো শুনে আনমনেই সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বাণী বলে উঠে,

“ কিন্তু সেটাই আমাদের সবথেকে বড় ভুল ছিলো। চব্বিশ ঘণ্টাও পালিয়ে থাকতে সক্ষম হই নি আমরা। ভাইয়া আমাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে চেয়েছিলো। কিন্তু চট্টগ্রাম শহর ছাড়ার আগেই হিরণের লোকেরা আমাদের ধরে ফেলে। ফের নিয়ে যায় হিরণের ওই পাপের প্রাসাদে। ভাইয়ার এই দুঃসাহস হিরণের ক্ষোভের কারণ হয়। ক্ষোভে অন্ধ হয়ে ও ভাইয়াকে বাড়ির পেছনের ওই শিমুল গাছের সাথে বেঁধে রাখে। ভাইয়াকে মারতে মারতে ওরা রক্তাক্ত করে ফেলেছিলো। আঘাত করে যখন ক্ষান্ত হয় নি তখন হিরণ… “

এতদূর বলে বাণী আর কথা বলতে পারে না। চোখ বুজে জোরে একটা নিঃশ্বাস টেনে নেয়। গাল গড়িয়ে পড়ে তার উষ্ণ জল। কাঁপা গলায় বলে,

“ আমার চোখের সামনে আমার ভাইয়াকে খুন করে হিরণ। ওর হাতে আমার ভাইয়ার খুনের রক্ত লেগে আছে। “

দূর্জয়ের মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে আছে। তার আর কিছু শুনতে ইচ্ছা করছে না। গতকাল থেকে তার মস্তিষ্ক একের পর এক ধাক্কা সামলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত অনুভব করছে সে। আচ্ছা যেই অতীতের গল্প শুনতে গিয়েই সে অসুস্থ অনুভব করছে, সেই অতীতের ভার তার সামনে বসা এই মেয়েটা কিভাবে বয়ে বেড়াচ্ছে? দূর্জয় আর সোজা হয়ে বসে থাকার শক্তি খুঁজে পাচ্ছে না৷ শরীরটা অসাড়ল হয়ে আসে তার। সঙ্গে সঙ্গে দূর্জয় নিজের নীতি ভেঙে একটা কাজ করে। কঠিন চিত্তের খোলস ছেড়ে সোফায় পিঠটা এলিয়ে চোখ বুজে ফেলে সে। নিজের দূর্বল হয়ে পড়াটা সামনে বসে থাকা নারীর সামনে প্রকাশ করে নিজের অজান্তেই। বাণী অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি মেলে নীরবে দেখে সেই দৃশ্য। নিস্তব্ধ পরিবেশের নীরবতা ভেঙে মলিন গলায় বলে উঠে,

“ আমার শেষ আশ্রয়স্থল সায়াহ্ন তালুকদারের লাশের উপর পড়ে কাঁদছিলাম আমি। ভাইয়ার রক্ত আমার শরীর জুড়ে লেপ্টে ছিলো। কিন্তু আমি অভাগী। নিজের ভাইয়ের মৃত্যুর শোক পালনেরও সুযোগ পেলাম না আমি। ভাইয়ার লাশের উপর থেকে আমাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যায় হিরণ। নিজের ব্যক্তিগত বেডরুমে টেনে নিয়ে যায়। পালানোর শাস্তি শুধু আমার ভাই পায় নি সেই রাতে। আমিও পেয়েছি। হিরণের ভয়ংকর রূপের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে সেই রাতে। হি ডিস্ট্রোয়েড মি মেন্টালি এন্ড ফিজিক্যালি। বহ্নি যাকে নিজের পাপা বলে চিনে, সে আমার রেপিস্ট, আমার ভাইয়ের খুনী। ও বহ্নির পাপা হতে পেরেছে, কিন্তু আমার স্বামী হতে পারে নি। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

[ আগামী কিছুদিন গল্প দিতে দেরি হতে পারে। একে-তো বাসা শিফট করবো। তার উপর নেক্সট উইক থেকে আমার এক্সাম শুরু। সব মিলিয়ে জগাখিচুড়ি অবস্থা। তাই পরবর্তী পর্ব আসার আগ পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরুন। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here