এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৩৩.

0
144

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৩.

তিন ঘন্টা ধরে চলমান তুফানি বৃষ্টির ফলে প্রকৃতির ভ্যাপসা গরমটা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। বাতাসে বয়ে বেড়াচ্ছে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। থমথমে, নীরব রুমটায় সবেমাত্র ফিরলো সাইফ। সারাদিনের ক্লান্তির লেশমাত্র তার চেহারায় লক্ষ্যনীয় নয়। ফ্রেশ না হয়েই সে বিছানায় গিয়ে হেলান দিয়ে বসলো। সাদাত এই মুহুর্তে রুমে উপস্থিত থাকলে এই নিয়ে একশোটা কথা শোনাতো তাকে। কিন্তু সাদাত মেসের বাহিরে থাকায় এই মুহুর্তে তাকে জ্ঞান বিলিয়ে বিরক্ত করার মতো কেউই নেই।

বালিশে পিঠ এলিয়ে দিয়ে সাইফ ফোনের ডাটা অন করে। সঙ্গে সঙ্গে তার নোটিফিকেশন বার টুংটুং শব্দ করে জানান দেয় ইয়াসমিন মুজতবা হতে পাঠানো খুদেবার্তার। সাইফ নিশার পাঠানো ম্যাসেজ ওপেন করে। সকাল ১১ টার দিকে একটা ছবি পাঠিয়েছে। মা মেয়ের হাস্যজ্বল ছবি। ছবির সঙ্গে একটা ছোট্ট ম্যাসেজও লিখতে ভুলে নি,

“ গেস হোয়াট! আম্মু এসেছে। আ’ম সো হ্যাপি রাইট নাও। “

ম্যাসেজের সঙ্গে দাঁত বের করে হাসার এক ইমোজি। সাইফ ম্যাসেজটা দেখে মৃদু হাসে। স্ক্রল করে নিচে যেতেই দেখে আরেকটা ছবি। কাসুন্দি দিয়ে কাঁচা আম মাখার। এটা দুপুর ১২ টার দিকে পাঠিয়েছে। সঙ্গে লিখেছে,

“ আপনি কাসুন্দি দিয়ে কাঁচা আম মাখা খেয়েছেন কখনো? দুর্দান্ত হয়। আমি বারান্দায় বসে মেঘলা আবহাওয়া দেখছি আর আম্মুর হাতে বানানো আম মাখা খাচ্ছি। আপনি খাবেন? “

সাইফ আরো একদফা হাসে। এবার আরেকটু স্ক্রল করতেই সে দেখে শেষ ম্যাসেজটা। যেটা বিকেল ৪ টা বেজে ৩৫ মিনিটে পাঠানো হয়েছে। যেখানে নিশা লিখেছে,

“ আম্মু চলে গিয়েছে। আবার একা হয়ে গিয়েছি। “

সাইফ এবার ম্যাসেজের রিপ্লাই দেয়,

“ আপনার মন খারাপ মিস ইয়াসমিন? “

নিশা অনলাইনেই ছিলো। সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ম্যাসেজটা সিন করে রিপ্লাই করলো,

“ আপনি ফ্রি আছেন? একটু ভিডিও কলে আসবেন? এক্ষুনি! “

সাইফ ম্যাসেজটা পড়ে সামান্য অবাক হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেলের ভীতু মেয়ে এমন জরুরি তলবে তাকে কেন ভিডিও কলে আসতে বলছে? সাইফ আচ্ছা লিখে রিপ্লাই দিয়ে সামান্য সোজা হয়ে বসে। পরপর নিজেই ভিডিও কল দেয়। নিশা তৎক্ষণাৎ কলটা রিসিভ করতেই সাইফ ফোনের স্ক্রিনে দেখতে পায় একটা হাস্যজ্বল রমণীর মুখশ্রী। মাথার অর্ধেক চুলগুলো পিছনের দিকে নিয়ে খুব সম্ভবত ক্লাচার দিয়ে আটকানো। উজ্জ্বল মুখখানি একগাল হেসে বলে উঠে,

“ আপনাকে একটা জিনিস দেখাবো। “

কথাটুকু বলেই নিশা ব্যাক ক্যামেরা অন করে। লম্বাকৃতির আয়নায় দেখা যায় ফতুয়া এবং স্কার্ট পরিহিত এক নারী কায়া। যে ধীর গতিতে হেঁটে সামনের দিকে আগাচ্ছে। সাইফ দৃশ্যটুকু মনযোগ দিয়ে দেখে। পরপরই সে চাপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠে,

“ ইয়াসমিন। ফাইনালি! “

নিশাও খুশিতে চেঁচিয়ে বলে,

“ ইয়েস। আমার খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে। “

সাইফ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠে,

“ ডোন্ট! এতো দ্রুত লাফঝাপ করার পারমিশন কি ফিজিওথেরাপিস্ট আপনাকে দিয়েছে? “

“ উঁহু। কথার কথা বললাম আরকি। আম্মু যাওয়ার পর একা বাসায় বোর হচ্ছিলাম। কি মনে করে একা একা চেষ্টা করতে গিয়ে দেখি নিজে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছি। দেয়ালের সাপোর্ট নিয়ে হাঁটতেও পারছি ধীরে ধীরে। দ্যা ফিজিওথেরাপি ওয়ার্কড ফাইনালি। এই অত্যাধিক খুশির খবরটা কাউকে জানাতে না পেরে পেট ব্যথা করছিলো। আপনাকেই প্রথম জানালাম। উফ! এক্সাইটমেন্ট চেপে রাখা এতো কষ্টকর কাজ! “

নিশা একনাগাড়ে কথা গুলো বলে থামে। সাইফের আচমকা বুক কেঁপে উঠে। চব্বিশ বছরের এই জীবনে এই ধরনের অভিজ্ঞতা তার প্রথম। কারো খুশির খবরের প্রথম ভাগিদার সে। খুব ছোট্ট এবং সাধারণ একটা বিষয়। কিন্তু সাইফের মতো শিকড়হীন মানুষের কাছে বিষয়টার গভীরতা অসীম। মুখে কিছু না বললেও তার চোখের কোণে ফুটে উঠলো হাসির রেখা। নিশা ক্যামেরা নিজের দিকে ফিরিয়ে বিছানায় বসে আপনমনে বলে উঠে,

“ আব্বু বাসায় আসুক। আব্বুর সামনে হেঁটে আব্বুকে চমকে দিবো। খুব খুশি হবে। আর আম্মুকেও আগামীকাল যে কোনো মূল্যে এখানে আসার জন্য রাজি করাবো। আম্মুকেও সামনাসামনি হেঁটে দেখাবো। উফ! রুহীটা যে কবে ঠিক হবে। ও দেখলেও খুব হ্যাপি হতো। “

সাইফ নিশার হাস্যজ্বল মুখ দেখে নীরবে। ক্ষনিকের জন্য ভুলে বসে যে ফোনের অপর পাশের এই রমণী তার লেফটেন্যান্ট কর্নেলের একমাত্র মেয়ে। কিন্তু পরপরই তার মনে পড়ে যায় বাস্তবতা। মনে পড়ে যায় নিজেদের মধ্যের বিস্তর ফারাক। সাইফের আকাশ কুসুম ভাবনার মাঝেই নিশা ফোনের স্ক্রিনের পানে তাকায়। মুহুর্তেই নোটিফিকেশন বারে ভেসে উঠা একটা ম্যাসেজ দেখে তার দৃষ্টিতে অবিশ্বাস খেলে যায়। সেই দৃশ্য সাইফের দৃষ্টি এড়ায় না। সে কোনো প্রশ্ন করার পূর্বেই নিশা হাত থেকে ফোনটা ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে। দ্রুত ছুটে যায় রুমের বাহিরে। সাইফ ব্যস্ত হয়। গলায় একরাশ চিন্তা ঢেলে দিয়ে চেঁচিয়ে প্রশ্ন করে,

“ ইয়াসমিন? ঠিক আছেন আপনি? ইয়াসমিন? শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো?… “

ফোনের অপর পাশ থেকে কোনো জবাব না আসায় সাইফের চিন্তার পরিমাণ গাঢ় হয়। সে হাত ঘড়িটা একবার দেখে নেয়। স্যার তো মেজরের সঙ্গে বেড়িয়েছেন তার জানামতে। বাসায় ফিরতে নিশ্চয়ই দেরি হবে! এমন অবস্থায় যদি ওই ভীতু মেয়েটার কোনো বিপদ হয়ে থাকে? সাইফ আর এক দন্ড অপেক্ষা করে না। ফোন কেটে পকেটে ভরে নিয়ে দ্রুত বের হয়। যাওয়ার পথে জুনায়েদের থেকে বাইকের চাবিটা নিতেও ভুলে না।

__________

ঘড়ির কাটা ছুটে চলেছে অলস ভঙ্গিতে। বিছানায় গুটিসুটি মেরে ঘুমে আচ্ছন্ন নারী হঠাৎ কেঁপে উঠে। স্বপ্নের রাজ্যে তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে তীব্র ভয়। অতীতে তাকে সাহায্যকারী সায়াহ্ন তালুকদারের পরিণতি চারিদিকে আতঙ্ক ভাব ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিষাক্ত, শ্বাসরুদ্ধকর স্বপ্নের ইতি ঘটতেই বাণী ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। ভাইয়ার লাশটা এখনো তার চোখে ভেসে আছে। আতঙ্কে বিভোর বাণীর ঘোর ভাঙে পিঠে কারো আলতো হাতের ছোঁয়ায়। সে চকিতে পাশ ফিরে তাকায়। হিরণের মুখদর্শন হতেই সে চটে উঠে। এক ঝটকায় নিজের পিঠ হতে হিরণের হাত সরিয়ে ফেলে। হিরণ তাতে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,

“ খারাপ স্বপ্ন দেখছিলে? “

“ না। বাস্তবতা দেখছিলাম। আপনার আমার ভাইকে খুন করার দৃশ্য স্বপ্ন হয়ে হানা করছিলো আমাকে। “

হিরণ নীরব রয়। কোনো প্রতুত্তর করে না। বাণী সময় নেয় স্থির হতে। অত:পর বলে উঠে,

“ ভাইয়ার মৃত্যুর জন্য কোনো না কোনো ভাবে আমি দায়ী। এই ভাবনাটা আমাকে প্রচন্ড মানসিক পীড়া দেয়। খুব না বড়ো বড়ো কথা বলেন? আমাকে ভালোবাসেন বলে দাবী করেন? তাহলে আমার মানসিক যন্ত্রণা বাড়াতে চাচ্ছেন কেনো? কেনো শুধু শুধু ওই সাহায্যকারীর পরিচয় জানতে চাইছেন? “

“ আমি ক্ষমা করি না বাণী। এসব অযথা সেন্টিমেন্টাল ডায়লগ ছেড়ে আমাকে দূর্বল করার বৃথা চেষ্টা করবে না। কোনো লাভ হবে না। “

বাণীর রাগে নিজেকে জুতোপেটা করতে মন চায়। দূর্জয়ের জীবন আশংকা তাকে এতটাই ভীত করে রেখেছে, যে সে কিনা কোনো দিশা না পেয়ে এই জানোয়ারের কাছে দয়া আশা করছিলো! আশাহত বাণী মনে মনে প্রার্থনা চায়,

“ এই জানোয়ার তো দয়া করবে না রব। তুমি নাহয় করো। আর কার কাছে চাইবো বলো? দূর্জয়কে হিরণের হাত থেকে রক্ষা করো। ওর পরিণতিও যেনো ভাইয়ার মতো না হয়। “

__________

যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটার আবহাওয়া তখন ২০° সেলসিয়াসে স্থির। সকাল সকাল ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ এপ্লাইড সায়েন্স গাজার সামনে সৈন্যরা ত্রাণ বিতরণের ক্যাম্পিং খুলে বসেছে। প্রত্যয়, রাফি, রিদওয়ানও বাকি সৈন্যদের সঙ্গে দায়িত্ব পালনে কর্মরত রয়েছে। লম্বা লাইনে ত্রাণ পাওয়ার আশায় চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করছে অসংখ্য মানুষ। ইতিমধ্যে যারা ত্রাণ পেয়েছে তাদের সবার মুখের অমূল্য হাসি এই বিষন্ন পরিবেশে সৈন্যদের মনে প্রশান্তি এনে দেয়। একজন বয়োবৃদ্ধ লোক তো ত্রাণ হাতে পেয়ে কেঁদেও ফেলেছিলেন। প্রত্যয়ের মতো কাঠখোট্টা মানুষও এমন পরিস্থিতিতে নিজের জড়তা কাটিয়ে লোকটাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলো। লোকটা অশ্রুসিক্ত গলায় নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রত্যয়কে কিছু একটা বলেন। সেই ভাষা প্রত্যয়ের বোধগম্য না হলেও লোকটার চামড়ায় ভাজ পড়া হাতটা যখন তার মাথায় ঠেকে বুলিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তখন তার মনটা ভালো লাগায় ভরে যায়। অনুধাবন করে নিজের মরহুম ভাইয়ের এই পেশার প্রতি এতো টান এবং শ্রদ্ধার কারণ। যা সে কখনোই নিজের মা বাবাকে বুঝাতে পারবেন না।

রিদওয়ান তখন ত্রাণ বিতরণে ব্যস্ত ছিলো। আচমকা একটা দূর্ঘটনায় লাইনচুত্য হয়ে মানুষের শোরগোল শুরু হতেই তার মনযোগ ভঙ্গ হয়। কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে সে সামনে তাকাতেই দেখে কেউ একজন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুজন। এতদূর দৃশ্য দেখতেই রিদওয়ান ব্যস্ত পায়ে এক বোতল পানি হাতে নিয়ে সেদিকে ছুটে যায়। মানুষের ভীড় ঠেলে কাছে যেতেই সে দেখে ছাই রঙা বোরখা জাতীয় পোশাক পরিহিত এক নারী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রয়েছে। মাথা এবং মুখ তার ওড়নার আড়ালে ঢাকা। রিদওয়ান এক হাঁটু ভেঙে বসে। মেয়েটার মুখের ওপর থেকে ওড়না সড়িয়ে সে দ্রুত সামান্য পানি ছিটকে দেয় তার মুখে। প্রথমবারে কোনো লাভ না হওয়ায় সে আরো কিছুটা পানি হাতে নিয়ে সেই মেয়ের মুখে ছিটিয়ে দেয়। এবার মেয়েটা পিটপিটিয়ে চোখ মেলে তাকায়। চোখ মেলে অপরিচিত কাউকে দেখতেই সে খানিকটা ভীত হয়ে পড়ে। কণ্ঠে ভীত ভাব মিশিয়ে নিজ মাতৃভাষায় প্রশ্ন করে,

“ মান আনতা? “

প্রশ্নটা রিদওয়ানের কানে পৌঁছায় না। তার দৃষ্টি স্থির রমণীর গভীর হালকা নীলাভ চোখ পানে। এরকম রঙের চোখের মানুষ এই প্রথম সরাসরি দেখছে রিদওয়ান। কেমন ভ্যাবলাকান্তের মতো তাকিয়ে দেখছে সে। আশেপাশের স্থানীয়রা ভাবলো ছেলেটা হয়তো তাদের ভাষা না বুঝে এমন বেকুবের মতো তাকিয়ে রয়েছে। তাই তারা নিজ দায়িত্বে মেয়েটাকে বলে যে সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। ভীনদেশী এই সৈন্য তার মুখে পানি ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে। মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে দূর্বল শরীর টেনে উঠে বসে কৃতজ্ঞতার সহিত বলে উঠে ,

“ শুকরান জাজিলান। “

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার খেয়াল হয় লোকটা ভীনদেশী। তাদের ভাষা তার বোধগম্য হবে না। তাই মেয়েটা ফের বলে উঠে,

“ থ্যাংক ইউ। “

প্রত্যয়, রাফি ততক্ষণে সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। রিদওয়ানকে এমন বোকার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রত্যয় তার কাধে হাত রেখে সামান্য ঝাকিয়ে ডাকে। সঙ্গে সঙ্গে রিদওয়ান স্তম্ভিত ফিরে পায়। নিজের বিস্ময় সামলে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মেয়েটার দিকে সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিয়ে ইংরেজিতে বলে,

“ উই হেভ আওয়ার মেডিক্যাল সার্ভিস করপস উইথ আস। কাম উইথ আস। “

মেয়েটাকে এই পর্যায়ে সামান্য দ্বিধায় মশগুল দেখা গেলো। কিছু একটা ভেবে সে নিজের ভাষায় বলে উঠে,

“ লা আহতাজ ইলা খিদমাত তিবিয়াতিন। আহতাজ লিবায়েদ আল তাইয়িয়াম ফাকাত। “

মেয়েটার কথা বোধগম্য না হওয়ায় তিন বাংলাদেশী সৈনিকই চোখ সরু করে তাকিয়ে রয়। ভীড়ের মধ্যে থেকে একটা ছেলে ইংরেজিতে ট্রান্সলেশন করে বলে উঠে,

“ ও বলেছে ওর মেডিক্যাল সার্ভিসের প্রয়োজন নেই। ওর শুধু একটু খাবারের প্রয়োজন। “

রিদওয়ান আগ্রহী গলায় প্রশ্ন করে,

“ ইউর নেম? “

এবার মেয়েটা এক শব্দে জবাব দেয়,

“ জারিয়াহ। “

__________

নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মায়ের কোলে মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে আছে নিশা। নাঈমা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ব্যস্ত। মেয়েকে কি বলে শান্তনা দিবেন সেই ভাষা তার জানা নেই। শান্তনার কোনো ভাষা না পেয়ে তিনি অসহায় দৃষ্টি মেলে জুলফিকারের পানে তাকায়। রুমের এককোণে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলো জুলফিকার। মেয়ের দুঃখের গভীরতা সম্পর্কে তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম। অতীতে তিনিও নিজের ভাই সমতুল্য বন্ধুকে হারিয়েছেন। ঠিক চোখের সামনে। বন্ধু জীবন তৃষ্ণায় ছটফট করছিলো। জুলফিকার নিরুপায় ছিলেন তখন। যুদ্ধের ময়দানে বন্ধুকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয় নি।

আজ এতো বছর পর তার মেয়েও একই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে দিচ্ছে। নিউজ চ্যানেলে রাজধানীর বহুতল ভবন থেকে এক রমণীর ঝাপিয়ে আত্মহত্যা করার খবর পাওয়ার পর থেকেই মেয়েটা এমন ফুপিয়ে কাঁদছে। বারবার আফসোসের সুরে বলছে,

“ সব দোষ আমার। আমি আমার বন্ধুর খারাপ সময়ে তার পাশে ছিলাম না। রুহী কতটা কষ্ট পাচ্ছিলো একা! “

নিশা বন্ধুকে শেষ বারের মতো একবার দেখার বায়নাও করছিলো খুব। নাঈমা এই ব্যাপারে বাঁধ সাধলেও জুলফিকার মেয়ের আবদার রাখেন। ইমারজেন্সি দুটো টিকেটের ব্যবস্থা করেন। চট্টগ্রাম টু ঢাকার ডিরেক্ট ফ্লাইট। নাঈমাও যাবেন নিশার সঙ্গে।

রেসিডেন্সিয়াল কটেজের সামনে গাড়ি এসে থামার শব্দ হতেই জুলফিকার উঠে দাঁড়ায়। প্রাক্তন স্ত্রী এবং একমাত্র মেয়েকে গাড়িতে তুলে দেয়। গাড়ি ছাড়ার পূর্বে মেয়েকে একপল দেখে নিয়ে নাঈমার উদ্দেশ্যে বলে,

“ সাবধানে যেও। নিশার খেয়াল রেখো। রিটার্ন টিকেট আগামীকালের করেছি। দ্রুত ফিরে এসো। “

নাঈমা কেবল মৃদু মাথা নেড়ে সম্মতি পোষণ করে।

__________

আকাশটা কালো মেঘে ছেয়ে আছে। চারিদিকে কেমন বিষন্ন আলো বিরাজ করছে। পুশআপ দিতে ব্যস্ত সাইফের মনটাও কেমন বিষন্ন। তার মনে প্রশ্ন জাগে। বিষন্নতা কি ছোঁয়াচে? নাহলে গতকাল ইয়াসমিনের নিজের বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে ওই কান্নার দৃশ্য দেখার পর থেকে সাইফের এতো বিষন্ন কেনো অনুভব হচ্ছে? যেই দৃশ্য দেখে সাইফ আর আগে পা বাড়ানোর সাহস পায় নি। যেমন আড়ালে ছুটে গিয়েছিলো, তেমন আড়ালেই ফিরে এসেছে।

তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুশআপ দিতে ব্যস্ত বন্ধু মহল বিভিন্ন আলোচনায় মত্ত। কিন্তু কোনো শব্দই সাইফের মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছায় না। তার চোখের সামনে ভাসছে ইয়াসমিন মুজতবার ওই করুণ কান্নার স্বর। দুনিয়া কত বিচিত্র! কিছু মানুষের কাছে কান্না করে মাথা গুজার জায়গা থাকা সত্ত্বেও তারা কাঁদে। আর কিছু মানুষের কাছে না আছে অশ্রু, আর না আছে মাথা গুজার জায়গা। হয়তো এই কারণেই উপরওয়ালা সাইফের মতন মানুষদের এতটা শক্ত বানায়। যাতে তারা সহজে না ভাঙে। কিন্তু দিন শেষে কেউ একজন আসে। ভূমিকম্পের ন্যায়। বিশাল ইমারতে কাঁপন ধরায়। শক্ত মানুষটার খোলস ভেঙে গুড়িয়ে দেয়।

___________

নিউজ চ্যানেলে রিপোর্ট কাভার করছেন এক পুরুষ। টিভির এককোণে তার নাম ভেসে উঠেছে। তূর্য রশীদ। স্পষ্ট গলায় আওড়াচ্ছেন গতকাল রাতে রাজধানীতে ঘটে যাওয়া এক সুইসাইড কেসের বর্ণনা। রুহী মেহরোজের মৃত্যুর খবরটা অতি নীরবেই শুনলো দূর্জয়। অত:পর টিভিটা রিমোট চেপে বন্ধ করে দিলো। মনে পড়ে গেলো মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে ভাইয়ের আবদারের কথা। রুহী মেহরোজ নামক মেয়েটার গায়ে যেনো আতঙ্কবাদীর প্রেমিকা হওয়ার কলঙ্ক না লাগে। দূর্জয় ভাইয়ের আবদার পূরণ করেছিলো। মেয়েটার গায়ে কলঙ্ক লাগতে দেয় নি। তার বাবা মা কে বুঝিয়ে এখান থেকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু শেষ রক্ষা কি হলো? দীপ্ত কি একটাবারও ভাবে নি মেয়েটা এতো বড় প্রতারণার ভার বয়ে আদৌ বাঁচতে পারবে কি-না?

গুরুত্বপূর্ণ ফোন কলটা বেজে উঠতেই দূর্জয় ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে। একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে কল রিসিভ করতেই ফোনের অপরপাশ হতে বলে উঠে,

“ স্যার, সিসিটিভি ফুটেজ হতে ওই গাড়ির লোকেশন ট্রেস করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। “

এতক্ষণের বিষন্নতা একপাশে ঠেলে দিয়ে শীতল পুরুষালি স্বরটা বলে উঠে,

“ আ’ম কামিং। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here