এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ৩৬

0
142

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৬.

সরু গলিপথ ধরে হেঁটে চলেছে দুজন ব্যক্তি। এই ভীনদেশের মাটিতেও নিজের পুরুষালি কর্তব্যটুকু পালন করতেই রিদওয়ান জারিয়াহকে তার ঠিকানা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছে। প্রত্যয় ও রাফি ইতিমধ্যে নিজেদের ক্যাম্পিং এরিয়ায় ফিরে গিয়েছে। আজকে কেবল আড়াল হতে তারা ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা লোক দুটোর গতিবিধি মেপে চলে এসেছে। রিদওয়ানদের অনুমান মতে ওই জায়গায় আরো লোক আছে। আর লোকগুলো খুব একটা সাধারণ নয়। সিভিল ড্রেসের আড়ালে এবং কাপড় দিয়ে ঢাকা মুখের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে নিজেদের আসল কোনো পরিচয়।

ভাবনা চিড়ে নীরবতার ইতি ঘটিয়ে রিদওয়ানই প্রথম বলে,

“ তোমার পরিবারে শুধু তোমার বোন আছে? “

জারিয়াহ একপল রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নত করে ফেলে। হাঁটার গতি স্থিতিশীল রেখেই সে বলে উঠে,

“ মা – বাবাও ছিলো। অন্য শহরে থাকতাম আমরা। আমার বোন জুবেদা একদিন পাড়ার বাচ্চাদের সাথে খেলতে বেরিয়েছিলো। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসায় আমি ওকে আনতে যাই। খেলার মাঠ থেকে ওকে নিয়ে ফেরার পথে আচমকা মনে হলো পায়ের তলের মাটিটা সম্পূর্ণ কেঁপে উঠলো। কানের কাছে এক বিধ্বংসী ধ্বসে পড়ার শব্দ হয়। আমি আর আমার বোন দৌড়ে বাসার কাছাকাছি যেতেই দেখি আমাদের বাসাসহ আশেপাশের আরো কিছু বাসা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বুঝতে পারি এই ধ্বংসযজ্ঞ কারা চালিয়েছে। সঙ্গে এ-ও বুঝতে পারি ওই বর্বরা শুধু আমার মাথার উপরের ছাদ নয় বরং বাবা মা’র ছায়াও কেড়ে নিয়েছে। এতিম হয়ে গিয়েছি। “

এতদূর শুনতেই রিদওয়ান অস্থির অনুভব করে। প্রশ্ন করে,

“ তারপর কি করলে? “

“ ওই শহরে তখন একের পর এক হামলা চলছিলো। জীবনের নিশ্চয়তা ছিলো না। বাঁচার তাগিদে বোনকে নিয়ে ওই শহর ছেড়ে যত সম্ভব দূরে চলে আসি। এখানেও যে খুব জীবনের নিশ্চয়তা আছে তা নয়। কিন্তু এখানে হামলার পরিমাণ এখনো কম। “

বেশ সরল ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে জারিয়াহ। রিদওয়ান বলে,

“ এখানে তোমার পরিচিত কেউ আছে? “

“ উহু। “

“ তাহলে কার ভরসায় আছো এখানে? জীবিকা কিভাবে চলছে? “

জারিয়াহ মৃদু হেসে বলে,

“ আল্লাহর ভরসায়। উনি রিজিক রেখেছেন বলেই জীবিকা চলছে। রিজিক ফুরিয়ে গেলেই, দমটাও ফুরিয়ে যাবে। “

রিদওয়ানের পা আচানক থেমে গেলো। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সরল মুখশ্রীর মেয়েটার দিকে। অত:পর বলে উঠে,

“ তুমি বেশ সাহসী জারিয়াহ। “

জারিয়াহ হেসে প্রশ্ন করে,

“ একজন সৈন্যের মতো? “

“ যুদ্ধ যেহেতু লড়ছো সেহেতু সৈন্যের মতোই৷ “

রাস্তার পাশে একটা ছোট একরুমের ধ্বংস স্তুপের সামনে এসেই জারিয়াহর পা থেমে যায়। সে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলে,

“ ধন্যবাদ। সাবধানে যাবেন। “

রিদওয়ান শীতল চোখ মেলে দেখে জারিয়াহর ছোট্ট বাসা নামক ধ্বংস স্তুপটাকে। বাড়ির একপাশের দেওয়ালের অর্ধেকটাই বলতে গেলে নেই। সেইটুকু একটা বড় চাদর দিয়ে কোনো মতে ঢাকা। রিদওয়ান কিছু একটা ভেবে আচমকা নিজের গায়ের উষ্ণ জ্যাকেটটা খুলে জারিয়াহর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,

“ তুমিও সাবধানে থেকো। আসি। “

জারিয়াহ অবাক হয়ে কিছুক্ষণ নিজের হাতের জ্যাকেটের দিকে তাকিয়ে রয়। রিদওয়ান ততক্ষণে বেশ ক্ষানিকটা দূরে চলে গিয়েছে। জারিয়াহ হঠাৎ পিছু ডাকতেই সে ফিরে তাকায়। জারিয়াহ সরল গলায় বলে উঠে,

“ আমার অপেক্ষা করবেন। আমাকে ছাড়া কাল রাতে ওদিকটায় যাবেন না দয়া করে। “

__________

বাণী তখন তীব্র মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ব্যথায় থেকে থেকেই মৃদু গোঙাচ্ছে সে। বহ্নি এতক্ষণ ভীত হয়ে দূর হতে মাম্মার এই তড়পানো দেখলেও এবার সে সাহস করে উঠে দাঁড়ায়। সবার আগে দৌড়ে গিয়ে সে টিস্যুবক্স হতে দু তিনটে টিস্যু হাতে নিয়ে বাণীর কাছে এগিয়ে যায়। অত:পর বাণীর সামনে বসে নিজের ছোট ছোট হাত দ্বারা অতি সাহসের সঙ্গে তার নাক হতে বের হওয়া রক্তটুকু মুছে দেয়। বাণী ঝাপসা চোখ মেলে তা দেখে। ফের চোখ বন্ধ করে মেয়ের এই যত্নটুকু অনুভব করে।

বহ্নি সন্তর্পণে কাজটুকু সেড়ে মাম্মার হাত আলতো টেনে ধরে বলে,

“ আমার কোলে শুয়ে পড়ো মাম্মা। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। ব্যথা চলে যাবে। “

বাণী মেয়ের কথা শুনে ফের চোখ মেলে তাকায়। তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেও সামান্য স্বস্তি খুঁজে পায়। উপরওয়ালা তার এইটুকু মেয়েকে এতো বুঝ কেনো দিয়েছে? যাতে মায়ের কষ্টটুকু বুঝতে পারে? বাণী আর কোনো টু শব্দ না করে নীরবে মেয়ের কোলে মাথা রেখে ফ্লোরে শুয়ে পড়ে। বহ্নি ভদ্র বাচ্চা। একটুও জ্বালাতন করে না মা’কে। বরং নিজের ছোট হাত জোড়া দ্বারা বাণীর চুলের মাঝে বিলি কাটতে থাকে। এই কাজটা সে তার মাম্মার কাছ থেকেই শিখেছে। বহ্নি যখন অসুস্থ হয় তখন তার মাম্মাও এভাবেই তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সঙ্গে অবশ্য ওষুধও দেয়। কিন্তু বহ্নি তো আর ওষুধ চিনেনা। সে কিভাবে মাম্মাকে ওষুধ দিবে? বড়ো হয়ে ডাক্তার হলে কেমন হয়? তখন সে ঠিকই ওষুধ চিনবে। মাম্মার ব্যথা কমানোর জন্য সে ওষুধ খুঁজে এনে দিতে পারবে।

বহ্নির ছোট্ট মস্তিষ্কের হাবিজাবি ভাবনার মাঝেই বাণী ধীরে ধীরে ঘুমে তলিয়ে যায়। বহ্নি তবুও নড়ে না। একইভাবে বসে রয়। নড়লে যদি মাম্মা উঠে যায়?

__________

রিদওয়ান সবে মাত্র ক্যাম্পিং এরিয়ায় ফিরে এসেছে। নিজের তাবুতে প্রবেশের পূর্বেই রাফি তাকে টেনে নিজের তাবুতে নিয়ে যায়। প্রত্যয় সেখানে আগে থেকে উপস্থিত ছিলো। রিদওয়ান অবাক সুরে প্রশ্ন করে,

“ তোরা এখনো ঘুমাস নি? “

রাফি ভ্রু দ্বয়ের মাঝে ভাজ তুলে প্রশ্ন করে,

“ আগে বল তোর চক্কর কি? “

রিদওয়ান অবাক হয়।

“ আমার আবার কিসের চক্কর! “

প্রত্যয় জানতে চায়,

“ কি নিয়ে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে বুঝতে পারছিস না? “

“ না। “

রাফি রিদওয়ানের পিঠে চাপড় মেরে বলে,

“ শালা সারা রাস্তায় আমরা নোটিশ করেছি। তোর চোখ সরছিলোই না জারিয়াহর থেকে। কেস কি এখন সেটা বল। হৃদয় ঘটিত ব্যাপার? “

রিদওয়ান বিরক্তি মিশ্রিত গলায় বলে,

“ কিসের সাথে কি পান্তা ভাতের ঘি! “

প্রত্যয় বলে,

“ অস্বীকার করবি না রিদওয়ান। প্রথম দিনও তুই ওর দিকে কিভাবে তাকিয়েছিলি তা কিন্তু আমরা ভুলে যাই নি। “

রিদওয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করে,

“ আসলে এখানে আসার পর থেকে এখানে স্থানীয় সবার জন্যই মায়া লাগছে আমার। জারিয়াহও এর ব্যতিক্রম নয়। হয়তো ওকে একটু কাছ থেকে দেখেছি বলে মায়াটা একটু বেশি লাগছে। এই আরকি! “

রাফি জানতে চায়,

“ তাহলে ভ্যাবলার মতো ওর দিকে তাকিয়ে ছিলি কেন? “

“ আরে ভাই ওর চোখের রঙ একটু ব্যতিক্রমী। নিজে স্বচক্ষে কখনো নীল চোখের মানুষ দেখিনি। তাই আগ্রহবশত একটু দেখছিলাম। এই সামান্য ব্যাপারটাকে টেনে তোরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস! “

রিদওয়ানের কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলা কথাটুকু শুনে রাফি প্রসঙ্গ বদলে বলে,

“ আচ্ছা যা বাদদে। কিন্তু দোস্ত তোর জ্যাকেট কোথায়? “

রিদওয়ান অকপটে বলে ফেলে,

“ জারিয়াহকে দিয়ে এসেছি। “

কথাটা বলেই সে জিভ কাটে। অত:পর বন্ধুদের দিকে তাকাতেই দেখে তারা কেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রত্যয় খানিকটা মশকরা করে বলে,

“ মন দিস নি কিন্তু জ্যাকেট দিয়ে চলে এলি? “

রাফি এবার ঠোঁট টিপে হাসতে শুরু করে। প্রত্যয়ও সামান্য হাসছে। রিদওয়ান বিরক্ত হয়ে বলে,

“ ধ্যাৎ। “

__________

বিশাল আলিশান বাড়ির বাহিরে কঠোর নিরাপত্তার বেড়াজাল। এক দল লোক বর্ডার পাহারা দেওয়ার মতো করেই টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে বাড়ির চারিদিকে। বাড়ির সামনে পাকা রাস্তার অপরপাশটা কেমন গভীর জঙ্গুলে। সেই জঙ্গলের ভেতর হতেই আপন আপন স্থান হতে সেই টহলকারীদের উপর নজর রাখছে চার জোড়া চোখ। টহলকারীদের প্রতিটি গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত তারা।

আচমকা সাইফ ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ বালামার। মশা কামড়ায়া মাইরা ফেলতাসে। “

সাদাত সাইফের দিকে সামান্য চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে চুপ থাকার ইশারা করে। সাইফ চুপ হয়ে গেলেও তার মুখ থেকে বিরক্তি ভাবটা সম্পূর্ণ কাটে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই জুনায়েদ ও ফারদিন চাপা স্বরে ফিসফিসিয়ে উঠে,

“ কেউ বের হচ্ছে সম্ভবত। “

সাদাত এবং সাইফ সঙ্গে সঙ্গে প্রধান ফটকের দিকে দৃষ্টি স্থির করে। বিশাল ফটকটা ধীরে ধীরে দু’দিকে খুলে যায়। একটা কালো রঙা গাড়ি বাড়ির ফ্রন্ট ইয়ার্ড হতে বেরিয়ে আসে। সাইফ দ্রুত নিজের হাতের ক্যামেরায় তা দৃশ্যবন্দী করে। জুম করেও বেশ কিছু ছবি তুলে। সম্পূর্ণ কাজটা সে করে অতি নীরবে। সাদাত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে গাড়ির ভেতরে বসা মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু গাড়ির জানালার কাঁচ ভেদ করে ভেতরে অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা মানুষটাকে স্পষ্ট দেখা যায় না।

সাদাত সেই গাড়িটাকে অনুসরণের উদ্দেশ্যে উঠতে নিলেই আচমকা তার কানে ক্যামেরায় ছবি ধারণের শব্দ ভেসে আসে। সাদাত অবাক সুরে সাইফকে প্রশ্ন করে,

“ সাউন্ডটা কি তোর ক্যামেরা থেকে এসেছে? “

সাইফ, জুনায়েদ এবং ফারদিনের কানেও সেই শব্দ ভেসে এসেছিলো। সাইফ বিষ্ময় নিয়ে বলে,

“ আমার ক্যামেরার সাউন্ড না এটা। “

সাদাত সহ সকলেই সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি মেলে পরখ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আচমকা সাদাত লক্ষ্য করে জঙ্গলের একপাশ দিয়ে একটা ছায়া ক্যামেরা হাতে দ্রুত দৌড়ে পালাচ্ছে। সাদাত আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না। বড়ো বড়ো পা ফেলে সেই ছায়াকে অনুসরণ করে দৌড়ে যায়। দৌড়ানোর সময় ধুপধাপ পায়ের শব্দে টহলকারীদের মধ্যে একজনের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। সাইফ তা লক্ষ্য করতেই দ্রুত জুনায়েদ আর ফারদিনকে তাড়া দেয়,

“ তোরা শর্টকাট ধরে তাড়াতাড়ি এখান থেকে ফুট হ। আমি সাদাতের পিছনে যাচ্ছি। “

বলেই সাইফ আর অপেক্ষা করে না। দ্রুত সাদাতের পিছু পিছু দৌড়ে যায়। টহলকারীরা এদিকে এগিয়ে আসার পূর্বে জুনায়েদ আর ফারদিনও ভাগ মিলকা ভাগের মতো শর্টকাট ধরে উল্টো পথে ছুট লাগায়। আচমকা মাঝপথে জুনায়েদ পায়ের গতি থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তাকে থেমে যেতে দেখে ফারদিনও থেমে যায়। বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিতে নিতে প্রশ্ন করে,

“ থামলি কেনো? “

জুনায়েদ বুক টান টান করে দাঁড়িয়ে বলে,

“ আমরা কেনো পালাচ্ছি? আমরা সৈন্য। এভাবে শত্রু দেখে পালিয়ে যাওয়া আমাদের মানায় না। “

এরকম একটা সিচুয়েশনে জুনায়েদের এই ডায়লগ শুনে ফারদিনের রাগ উঠে। সে জুনায়েদের ঘাড়ের কাছের কলার হাতের মুঠোয় পুড়ে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বলে,

“ শালা নিজেও মরবি একদিন আমাকেও মারবি। “

__________

পিছনে কেউ দৌড়ে তাকে অনুসরণ করছে টের পেতেই ছায়াটা নিজের পায়ের গতি আরো বাড়ায়। গম্ভীর পুরুষালি একটা স্বর পিছন থেকে আদেশ দেওয়ার মতো করে বলে উঠে,

“ স্টপ! আদারওয়াইজ আই’ল শুট। “

ছায়াটা থামে না। উল্টো আরো জোরে দৌড়ায়। সাদাত দৌড়াতে দৌড়াতে নিজের প্যান্টের পিছন থেকে কায়দায় পিস্তলটা বের করে নেয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায় দূরন্ত ছায়ার পানে। শু, প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট ও তার সঙ্গে মাথায় ক্যাপ পরিহিত হ্যাংলা যুবকটার মধ্যে থামাথামির কোনো লক্ষণ নেই৷ সাদাত বাধ্য হয়ে এবার পায়ের গতি সামান্য স্থিতিশীল করে পিস্তল তাক করে ছায়াটার বাম হাতের বাহু বরাবর নিশানা স্থির করে। সাইলেন্সার বসানো পিস্তলের ট্রিগারটা চাপতেই একটি বুলেট নীরব ঘাতকের ন্যায় গিয়ে সেই ছায়াটাকে আঘাত করে। ছায়া মানব মুহুর্তেই নিজের কাধ চেপে ধরে মাটিতে নুয়ে পড়ে।

সাদাত সঙ্গে সঙ্গে থামে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠে। গুপ্তচোরকে ধরার জন্য ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। ঠিক পিছনে গিয়ে যখন সে দাঁড়ায় তখন আচমকাই ওই আহত ছায়াটা সোজা হয়ে নিজের ডান হাতের কনুইয়ের সাহায্যে সাদাতের বুক ও পিঠের মাঝামাঝি জায়গায় জোরে আঘাত করে। আচমকা আঘাতে সাদাত চাপা আর্তনাদ করে উঠে। হ্যাংলা দেখতে ছায়াটার কনুইয়ের হাড়কে কোনো রডের সাথে তুলনা করলে ভুল হবে না। আঘাত করেই ছায়াটা পালানোর জন্য ছুটতেই সাদাত পিছন থেকে হাত বাড়িয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করে। ফলস্বরূপ সেই ছায়া মানবের মাথার ক্যাপটা খুলে সাদাতের হাতে এসে পড়ে।

সঙ্গে সঙ্গে সে ভিমড়ি খায়। এতক্ষণ সে যাকে ছায়া মানব ভাবছিলো সে কোনো ছায়া মানব নয়, বরং ছায়া মানবী। মেয়েটার দৌড়ের গতির সঙ্গে পিঠময় জুড়ে দুলতে থাকা দীঘল রেড ওয়াইন কেশ তো তাই বলছে। সাদাত বিমূঢ় হয়ে মেয়েটার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। সাইফ ততক্ষণে দৌড়ে সাদাতের কাছে এসে এই অবস্থা দেখে প্রশ্ন করে,

“ কি রে? এইভাবে যেতে দিলি? “

সাদাত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

“ যেতে দিলাম। “

সাইফ অবাক হয়ে জানতে চায়,

“ কেনো? “

“ চোর পুলিশ খেলতে চাইছে। আমি নাহয় একটু খেলতে দিলাম। “

সাইফ সাদাতের কথার ভাবার্থ বুঝতে পারে না। উল্টো বেশ বিরক্ত হয়। মানব জাতির এই এক সমস্যা। সোজা সাপ্টা কথাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বললে এদের পেটের ভাত হজম হয় না।

__________

নির্জন এক সড়কের ধারে এসে কালো গাড়িটা থামে। গাড়ির ভেতর বসে থাকা মানুষটা শীতল চোখ মেলে একবার অন্ধকার রাস্তার পানে তাকায়। অত:পর গাড়ির জানালাটা নামিয়ে দেয়। রাতের এই বাতাসটা বড্ড স্নিগ্ধ ও শীতল। কেমন গা কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দু ধারে উঁচু গাছের সারিই এই বাতাসের মূল উৎস।

এই শান্ত পরিবেশে গাড়ির ভেতর ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা মানুষটা আচমকা একহাতে শক্ত করে স্টিয়ারিংটা চেপে ধরে অপর হাতে স্টিয়ারিংয়ে আঘাত করতে শুরু করে। তার চোখ ছাপিয়ে নামে জল। ভয়ংকর চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে সে। কানের কাছটায় ভাসতে থাকে নিজের মেয়ের উচ্চারণ করা তিনটি শব্দ,

“ আই হেইট ইউ। “

রাতের আঁধারে এবং জনমানবহীন নির্জন রাস্তায় হিরণের কান্না মিশ্রিত চিৎকার গুলো মিলিয়ে যেতে থাকে। সব ছক এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। তার মেয়েকে আর সবকিছু নিয়ে সে বুঝ দিতে পারলেও এবার বুঝ দেওয়ার আর কোনো উপায় নেই। বহ্নি স্বচক্ষে ঘটনাটার সাক্ষী হয়েছে। সে দেখেছে কিভাবে তার পাপা তার মাম্মাকে আঘাত করছিলো। এই ঘটনার কি ব্যখ্যা দিবে হিরণ? তার মেয়ে আদৌ কোনো ব্যাখ্যা কানে তুলবে?

মুহুর্তেই হিরণের চোখের সামনে ভেসে উঠে বাণীর আহত মুখ। নিজের প্রতি তীব্র ঘৃণা অনুভব করে সে। কিভাবে পারলো সে বাণীকে আঘাত করতে? ওই শমসেরের কথায় সে কিভাবে নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো? আর কেউ না জানুক হিরণ তো জানে বাণী দুশ্চরিত্রা নয়। তাহলে সেই মুহুর্তে কেনো নিজের বিধ্বংসী রাগের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলো না সে? কি করবে সে? বাণী আর বহ্নির পায়ের কাছে গিয়ে লুটিয়ে পড়বে? মাফ চাইবে? মাফ করবে আদৌ?

হিরণ এলোমেলো হাতে নিজের পকেট থেকে ফোনটা বের করে। অত:পর গুগলে গিয়ে দ্রুত সার্চ করে ‘Is it dangerous to get injured in head?‘ গুগল সঙ্গে সঙ্গে নিজের উত্তর পেশ করে ‘Head injuries are one of the most common causes of disability and death in adults. The injury can be as mild as a bump, bruise or cut on the head. Head injuries cause internal bleeding and damage to the brain.’

লেখাটুকু পড়তেই হিরণ আতঙ্কিত হলো। তার স্পষ্ট মনে আছে সে কি পরিমাণ জোরে বাণীর মাথায় আঘাত করেছে। একবার নয় বরং অনেকবার। হিরণের কানে ফের ভেসে আসে রুমের ভেতর হতে বাণীর যন্ত্রণায় করা আর্তনাদ। সে আবার নিজের মাথা চেপে ধরে। নিজের করা পাপের কথা ভেবেই তার নিঃশ্বাস আটকে আসে। মনে হয় যেনো সমুদ্রের অতল ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। চারিদিকে কোনো কিনারা নেই৷ হিরণ আচমকা উপলব্ধি করে তার বহু বছরের তিলে তিলে গড়া এই সাম্রাজ্যের ছাদ ছিলো বহ্নির ভালোবাসা। যা সবসময় তাকে রোদ, তাপ, ঝড়, বৃষ্টি হতে রক্ষা করতো। কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে যেনো সেই ছাদ ভেঙে পড়েছে। আর এতটা কঠিনভাবে ভেঙে পড়েছে যে আর কখনো তা হিরণকে এক রত্তি পরিমাণ ছায়া দিবে না।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here