#তবু_সুর_ফিরে_আসে
৩০ তম পর্ব
বুবুর যাওয়ার সময় হয়ে গেছে । কিভাবে কিভাবে এক মাস হয়ে গেল ! হেরা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। বুবুর সঙ্গে শপিং এ যাচ্ছে প্রতিদিন । বুবু রাজ্যের শপিং করছেন । হেরা কে একগাদা ড্রেস, শাড়ি কিনে দিলো। নিজের দুই ছেলের বউ ছেলে নাতিদের জন্য, পরিচিত সবার জন্য গিফট কিনেছেন । নাদিয়া আর মিলার জন্য গিফট কিনে দিয়েছে। হেরা বুঝতে পারে ওকে বুবু বাকি দুজনের চেয়ে বেশি আদর করে।
আপনি আমাকে এত কিছু কিনে দিয়েছেন বুবু !
হ্যাঁ নাদিয়া, মিলা কে বলো না মন খারাপ করবে । তোমার জন্য আমার অন্য রকম অনুভুতি । তুমি আমার বাবুর বউ । বাবুর জীবন টা মরুভূমি হয়ে ছিল তুমি বাবুকে আবার আনন্দে রেখেছো তাই তুমি আমার খুব প্রিয়।
হেরা বুবুকে জড়িয়ে ধরলো । একটা কথা বলব বুবু মায়ের আদর খুব একটা পাইনি আপনাকে দেখলে মনে হয় মা বুঝি এমনই হয় !
আমার কি মনে হয় জানো হেরা তুমি অনেক ভালো মা হবে ! আমার নিশালকে অনেক আদরে রাখবে ।
নিশালকে আদর না করে উপায় আছে ও কত ভালো আর একটা মাত্র ছেলে আমাদের।
খুব শান্তি পেলাম হেরা তুমি ওকে তোমাদের ছেলে বলেছো শুনে !
কি বলব বুবু ও যদি আমাকে মামনির জায়গা দিতে পারে আমি ওকে ছেলে ভাববো না কেন ?
খুব ভালো থাকো তোমরা , হেরার হাত ধরে জান্নাত আজমী বললেন।
তোমাকে একটা কথা বলতে চাইছি হেরা, বাবু তোমাকে বলবে না হয়তো কখনো ।
কি বুবু ?
বাবু সারাজীবন বাচ্চা খুব পছন্দ করতো । ওর অনেক গুলো ছেলে মেয়ে থাকবে বলতো। গীতির ইউটেরাসে ফেব্রয়েড মানে টিউমার ছিল তাই নিশালের পর কনসিভ হয়নি আরো নানান সমস্যা ছিল ওর। তুমি বাবুর সেই ইচ্ছেটা পূরন করো ভাই ! ও মুখ ফুটে বলবে না নিশাল বড় হয়ে গেছে দেখে । কিন্তু তুমি ওকে বলবে তুমি মা হতে চাও। তোমার অধিকার আছে মা হওয়ার ।
হেরা মাথা নিচু করে আছে বুবু আপনার ভাইয়ের ইচ্ছে ই আমার ইচ্ছে। উনি যা বলবেন তাই হবে আমার জীবনে।
তুমি ইচ্ছে প্রকাশ করবে তুমি কিছু চাইলে বাবু না করবে না । কথা দাও আমাকে বাবুকে বলবে ?
ঠিক আছে বলব কিন্তু যেদিন এ প্রসঙ্গ উঠবে সেদিন তার আগে না। হেরা হেসে দিল।
ঠিক আছে।
আমি খুব তাড়াতাড়ি শুনতে চাই তুমি মা হতে যাচ্ছো ! খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি চলে আসব এখানে তোমার যত্ন করার জন্য । একজন কেউ তো তোমার পাশে থাকতে হবে নাকি ? আমার ভাই তার অফিস, ফ্যাক্টরি নিয়ে পরে থাকবে বউ এর যত্ন রাখতে পারবে না !
তাড়াতাড়ি কিনা জানিনা বুবু ! আমি আবারও বলছি আপনার ভাইয়ের ইচ্ছে আমার ইচ্ছে।
ঠিক আছে ঠিক আছে আমি বাবুকেও বলে যাব !
জান্নাত আজমী এই প্রসঙ্গ আবার নওশাদের সামনে তুললেন। নিশাল চলে গেছে বাসাটা খালি হয়ে গেছে !
হ্যাঁ বুবু ও থাকলে খুব যে দৌড় ঝাঁপ করে তা না কিন্তু বাসাটা ভরা ভরা লাগে!
বাসার আসল প্রাণ তো বাচ্চা রা ।
হ্যাঁ।
বাবু তুই তো সব সময় বলতি তোর তিন চার টা বাচ্চাকাচ্চা থাকবে । হেরার বয়স কম তোর মাসাআল্লাহ সম্পদের কমতি নেই নিয়ে নে ভাই আরো দুইটা বাচ্চা ।
বুবু যেভাবে বলছো মনে হচ্ছে দোকানে গিয়ে অর্ডার করলেই বাচ্চা চলে আসবে ! নওশাদ হাসছে !
আমি কি সেই কথা বলছি ? তুই আগে বল কি চিন্তা করেছিস ?
কিছু চিন্তা করিনি ! বুবু , বুবু প্লিজ আমাকে একটু সময় দাও চিন্তা করি আগে । নওশাদ মনে মনে ভাবছে , তোমাকে কিভাবে বলি বুবু আমার আর হেরার মাঝে সেই দূরত্বই এখনো অতিক্রম হয়নি। আমরা দুজন আগে নিজেদের বোঝাপড়া টা তৈরি করি তারপর দেখা যাবে ! আর হেরা কি সন্তানের জন্য তৈরি । ওর বয়স কত কম পড়াশোনা শেষ করবে । ওসব পরে দেখা যাবে ।
বুবু আর দুলাভাই চলে গেলেন ফ্লোরিডাতে । যাওয়ার দিন নওশাদের হাত ধরে খুব কাঁদলেন ! পরের বার এসে আব্বাকে দেখব কিনা জানিনা আমিই বা আর আসতে পারবো কিনা জানিনা বাবু । তুই ইউএসএ গেলে আমাকে দেখতে আসবি কিন্তু !
আসব বুবু তুমি এভাবে কাঁদলে আব্বা তো ভেঙে পড়বে আরও। তখন সামলাবো কিভাবে?
তুই হেরাকে সময় দিবি বাচ্চা বয়সী মেয়ে সারাদিন একা থাকে বাসায় তুই তো তোর কাজ নিয়েই ব্যস্ত !
ঠিক আছে সময় দিব ।
বুবু চোখের পানি ফেলতে ফেলতে এয়ার পোর্টে র জন্য গাড়িতে উঠে গেল। নওশাদের কাজ থাকায় এয়ার পোর্টে যেতে পারেনি ছোট ভাই ফারহান আর শোয়েব গিয়ে বিদায় দিয়ে এলো ।
ইদানিং নওশাদ যখন রাতে বাসায় ফিরে হেরা অপেক্ষা করতে করতে কোন কোন দিন ঘুমিয়ে যায় । হেরার অপেক্ষা করতে খারাপ লাগে না কারণ মানুষটা এসেই ওর সঙ্গে এত সুন্দর করে হেসে হেসে মজার মজার কথা বলবে ওর মন ভালো হয়ে যায়। এখন রাত প্রায় এগারোটা নওশাদ আসেনি । সন্ধ্যায় একবার ফোন দিয়ে বলেছে ফিরতে দেরি হবে। হেরা যেন ডিনার করে ফেলে। হেরা তবুও না খেয়ে বসে আছে। হেরার ভালো লাগে না মানুষটা একা একা বসে খায় এটা দেখতে।
নওশাদ যখন এসেছে অপেক্ষা করতে করতে হেরা ঘুমিয়ে গেছে। নওশাদ বাসায় ফিরেই আনারের মা কে প্রশ্ন করলো, খেয়েছে তোমার আম্মা ?
না স্যার আপনার জন্য বইসা আছে ।
কি বলো আমার তো দাওয়াত ছিল খেয়ে এসেছি !
আম্মা তো অসুখ ভালা হওয়ার পর খাইতেই পারে না । দুপুরেও কোন দিন খায় কোন দিন খায় না । ঐ সকালে ই আপনার সঙ্গে যা খায় সেইটাই।
এই কথাটা তুমি আগে বলবে না ? আচ্ছা ঠিক আছে তুমি খাবার নিয়ে উপরে এসো।
নওশাদ নিজের রুমে ঢুকে দেখে হেরা কমফোর্টারের নিচে শুয়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে । নওশাদ ফ্রেশ হয়ে হেরার কাছে বসে ওর গাল, নাক ধরে টানাটানি করতেই হেরা চোখ খুলে হাতটা ধরলো নওশাদের ।
কি হচ্ছে ?
না খেয়ে কেন ঘুমাচ্ছো ?
শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেছি । চলেন খেয়ে আসি ।
সরি হেরা আমার দাওয়াত ছিল খেয়ে এসেছি । আসলে অনেক দিনের অভ্যাস বাসায় না জানানো ভুলে গেছি যে আমার জন্য এখন কেউ না খেয়ে অপেক্ষা করে। সরি ।
আচ্ছা কোন ব্যাপার না । আমার খেতে খুব একটা ইচ্ছেও করছে না ।
আমি শুনেছি হেরা তুমি ঠিক ভাবে খাচ্ছো না ইদানিং।
সেরকম কিছু না একটু খাওয়ার পর আর খেতে ইচ্ছে করে না।
কেন?
জানি না।
আনারের মা হেরার খাবার নিয়ে ঢুকলো !
এত খাবার কে খাবে তোমার স্যার খেয়ে এসেছে আনারের মা?
রেখে যাও তো আনারের মা ! আনারের মা ট্রে রেখে চলে গেল ।
আমি একটা অপরাধ করেছি খেয়ে আসব তোমাকে জানাইনি এখন সেই অপরাধের জরিমানা দিব ঠিক আছে।
কিভাবে?
তোমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেই হেরা ।
হেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে প্লিজ লাগবে না আমি খেয়ে নিচ্ছি !
উহু আমি দিব বলেই নওশাদ হেরার জন্য প্লেটে ভাত মেখে মুখের সামনে ধরলো ।
হেরা ভাত মুখে নেয়ার আগেই ওর চোখ ভিজে উঠলো ।
কি হলো ?
কিছু না এত সুখও পাওনা ছিল আমার ?
ছিল হেরা ! জানো একটা সময় আমি রাত করে বাসায় ফিরতাম ক্লান্তিতে খাওয়ার ইচ্ছে থাকতো না গীতি আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতো। কিন্তু আমার কখনো সুযোগ হলো না ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়ার । খুব ইচ্ছে করতো ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দেই কিন্তু ওর কারো হাতে খাওয়া পছন্দ ছিল না। ও আবার যেটা পছন্দ না সেটা করতে চাইতো না কখনো। কাউকে খুশি করার জন্যে ও না ।
আপনার খুব ইচ্ছে করতো তাই না উনাকে খাইয়ে দিতে ?
খুব !
আর কি কি করার ইচ্ছে ছিল করতে পারেননি আপনারা ?
অনেক ইচ্ছে ই ছিল । আমার খুব ইচ্ছে ছিল গীতিকে পাহাড়ের কাছ ঘেঁষা কোন একটা বাড়ি করে দিব তারপর হঠাৎ হঠাৎ ছুটি কাটাতে যাব ! সন্ধ্যায় দুজন বারান্দায় বসে নিরবতার শব্দ শুনব আকাশে থাকবে পূর্ণিমার চাঁদ।
আপনার তো অনেক টাকা আপনি কেন ইচ্ছে গুলো অপূর্ণ রাখলেন ?
নওশাদ হেরার দিকে তাকিয়ে হেসে দিল, বোকা মেয়ে টাকা দিয়ে কি সব সময় ইচ্ছে পূরণ করা যায় ?
সময়ের দরকার হয়। জীবন আমাকে সেই সময়টুকু দেয়নি হেরা। একটা সময় আমি টাকার পিছনে ছুটেছি তারপর টাকা এলো কিন্তু সময়টা আমার কাছে ধরা দিলো না ! দেশ বিদেশে কত জায়গায় ঘুরলাম কিন্তু আমার ছোট্ট সেই স্বপ্ন টা পূরন করতে পারলাম না।
হেরা খাওয়া শেষ করলো , আপনার খুব কষ্ট হয় তাই না এসব ভেবে ?
এখন আর কষ্ট ছাড়া অন্য সবকিছুই হয় । হাহাকার বোধ হয় । তারপর নিজেকে বুঝাই।
আসলে কি জানো ছোট ছোট অপূর্ণতার নামই জীবন। কিছু আফসোস না থাকলে জীবন একেবারে পানসে ! সব কিছু ঠিকই ছিল গীতিই ফাঁকি টা দিলো আমাকে অসময়ে চলে গিয়ে।
হেরার খুব বলতে ইচ্ছে করছে আমার সঙ্গে কি সেই ইচ্ছা গুলো পূরণ করা যায় না ? অনেক কথার মতই এই কথা টা বলতে পারেনি হেরা।
নওশাদ হাত ধুয়ে এসে চুপচাপ বসে রইল কিছুক্ষণ তারপর হেরার কাছে এসে বসলো।
তোমাকে বলতে খেয়াল ই ছিল না । তুমি আগামীকাল এলিন,নাহিনদের ভার্সিটিতে ভর্তি হতে যাচ্ছো সকাল সকাল উঠে রেডি হয়ে যেও।
আগামীকাল ? হেরা লাফিয়ে উঠলো!
কোন এডমিশন টেস্ট দিতে হবে না আমাকে ?
না । ভার্সিটির রেজিস্ট্রার আমার বন্ধু মানুষ বিশেষ বিবেচনায় তুমি কোন টেস্ট ছাড়াই ভর্তি হচ্ছো !
সাবজেক্ট ?
তোমার ইচ্ছা !
আপনি সাজেশন দিন প্লীজ !
তোমার মার্কশিট দেখে মনে হলো ইংলিশ, ইকোনমিক্স নিয়ে পড়লে তুমি ভালো করবে ! ল ‘ ও পড়তে পারো ইচ্ছে করলে !
আপনি যেটা বলবেন ?
তাহলে ইংলিশ ই পড়ো তোমার আগের সাবজেক্ট ।
ঠিক আছে। আমার খুব এক্সাইটেড লাগছে আবার ভয়ও লাগছে !
ভয় লাগছে কেন?
যদি আবার হারিয়ে যাই !
গাড়ি দিয়ে যাবে গাড়ি দিয়ে আসবে বাসায় । তোমার কাছে মোবাইল আছে হারাবে কিভাবে তাহলে ? বোকা মেয়ে। এসো আমার কাছে ! হেরা নওশাদের কাছ ঘেঁষে এলো।
একটা কথা বলব হেরা তুমি ভার্সিটিতে কাউকে বলো না তুমি বিবাহিতা ?
কেন ? বললে কি সমস্যা?
সমস্যা নেই দেখি ছেলেরা আমার সুন্দরী বউ এর প্রেমে পড়ে কিনা!
এসব কি বলেন আপনি উল্টো পাল্টা কথা ! আমি ছেলেদের সঙ্গে কেন কথা বলতে যাব !
বারে এক সঙ্গে পড়বে বন্ধু থাকবে না তোমার ।
না আমি ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করি না ! আর আপনি জানেন আমি ছেলেদের কতটা এড়িয়ে চলি ! কোন একটা ছেলের আশেপাশে থাকলেই আমার অস্বস্তি হতে থাকে।
আমার পাশে থাকলেও ?
আপনি আর অন্য ছেলে কি এক হলেন ?
আচ্ছা ঠিক আছে কালকে ভর্তি হয়ে মাইকিং করে এসো, তুমি বিবাহিতা হে পুরুষ জাতি আমার কাছ থেকে দূরে থাকুন। নওশাদ হাসছে !
আপনি তো আমাকে টেনশনে ফেলে দিলেন ! এত সব ছেলেদের সঙ্গে কিভাবে পড়াশোনা করবো ?
চুপ কি সব ফালতু বিষয় নিয়ে টেনশন করো তুমি হেরা। তুমি তোমার মত পড়াশোনা করবে। আর দশটা মেয়ের মত বন্ধু বানাবে । যত খুশি বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে হৈচৈ করো দিন শেষে আমার বুকে ফিরে আসলেই হবে । আমি এ ঘরে একা থাকতে পারবোনা কখনো।
একা থাকতে কে বলেছে আপনাকে। কালকে আপনি ভর্তি করাতে নিয়ে যাবেন ?
সরি আমি যেতে পারবো না শোয়েব তোমাকে নিয়ে যাবে আর এলিন নাহিন থাকবে তো তোমার সঙ্গে। তোমার দুই গাইড !
হেরা মনে মনে কালকের দিনটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো।
পরদিন সকালে হেরা শোয়েব, এলিন, নাহিনের সঙ্গে ভার্সিটিতে গেল ভর্তি হওয়ার জন্য। রেজিস্টার নওশাদের বন্ধু হওয়ায় কোন ঝামেলাই হলো না হেরার ভর্তি হতে ।
আমি ভেবেছিলাম ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে ?
শোয়েব বলল, আপনার জন্য ওসব লাগবে না কারণ আপনি নওশাদ আজমীর ওয়াইফ । এই ভার্সিটির ভিসি থেকে রেজিস্ট্রার মামার খুব ঘনিষ্ঠ । তাই আপনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ।
আপনি এলিন দের সঙ্গে ঘুরে দেখেন ভার্সিটি টা এদিকের কাজ আমি সামলাচ্ছি ।
না ঘুরতে গেলে হারিয়ে যাব আবার !
আপনি খুব ভয় পান তাই না ? শোয়েব হাসছে!
আপনি তো আমার সব কিছু জানেন না তাই হাসছেন ।
না জানালে জানব কিভাবে মামি ?
সব কিছু সবার জানতে হয় না । হেরা নওশাদকে ফোন দেয়ার জন্য উঠে গেল ।
শোয়েব তাকিয়ে আছে হেরার দিকে । মনে মনে বলল, অদ্ভুত একটা মেয়ে !
এলিন নাহিন হেরা কে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ভার্সিটি দেখালো। ওদের বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। ওরা দুজন কোন কারণ ছাড়াই ওকে বৌমনি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিল না। হেরা একটু অবাক হলো কিন্তু চুপ করে রইলো।
মাহাদি নামের নাহিনের ফ্রেন্ড হেরা কে দেখে নাহিন কে বলল, কে রে এই সুন্দরী ?
আমাদের আত্মীয় ।
এখানে পড়বে ?
হুম ।
রূপের আগুনে পাগল করে দিবে তো সবাই কে ।
সাবধানে বন্ধু আগুনে হাত পুড়ে গেলে আবার বলো না তোমাকে সতর্ক করিনি ।
হাত পুড়বে কেন মাহাদির হাত লোহার পুড়ে না কখনো ।
এমনও তো হতে পারে হাত পুড়ে ছাই হয়ে গেল তুই টেরই পেলি না !
দেখা যাক । তুই একটু হেল্প কর নাহিন ,তাহলে হয়তো পুড়লো না কিছুই ।
নাহিন মাহাদির কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, প্রেমে পড়া বারন , কারনে অকারণ …. মনে রাখিস এই গানটা । আর কিছু বললাম না।
আজ হেরার জীবনে একটা বিশেষ দিন । একদিন সে ভেবেছিল পড়াশোনা আর কোন দিন হবে না । আজ সে দারুন সুন্দর একটা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে এসেছে। অনেক টাকা লেগেছে। কিন্তু তার কাছে যা অনেক টাকা তার স্বামীর কাছে সেটা কিছুই না। ইস নানা ভাই যদি জানতো খুব খুশি হতো ।
হেরা সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করছে নওশাদের । মানুষ টার জন্য তার জীবনটা বদলে গেছে । এত সুন্দর একটা জীবন তার অপেক্ষায় ছিল সে জানতো না ।
গোল্ড ফিশ গুলোর কাছে বসে যখন ভাবছে নিজের জীবনটা নিয়ে তখন আনারের মা ছুটে এলো কাছে , আম্মা আপনার মোবাইল কই ?
উপরে চার্জে দেয়া কেন?
স্যার ফোন দিসিলো আপনারে কইছে রেডি হয়ে থাকতে বাইরে নিয়া যাইবো !
কি ? হেরা উঠে দাঁড়ালোকোথায় নিয়ে যাবে ?
আমি কেমনে বলবো যাইব কই ,মনে হয় কোন পার্টিতে তাড়াতাড়ি কাপড় পড়েন সুন্দর কইরা সাজেন দৌড় দেন।
হেরা চিন্তায় পরে গেল । সে ছুটে গেল এলিনদের কাছে । এসব বিষয়ে দুই বোন খুব ওস্তাদ ।
বৌমনি তুমি আজকেই প্রথম ভাইয়ার সঙ্গে বাহিরে যাবে তোমাকে দারুন করে সাজিয়ে দিব আমরা দেখো !
তাড়াতাড়ি করো উনি চলে আসবেন !
কালো একটা মসলিনের শাড়ি বের করলো নাহিন হেরার আলমারি থেকে এটা পরো বৌমনি ব্ল্যাক ইজ অলওয়েজ এলিগ্যান্ট ।
দুই বোন মিলে হেরা কে খুব সাধারণ ভাবেই সাজালো । চোখে একটু কাজল , আইলাইনার, একটু নুড লিপস্টিক এক সাইডে একটা খোঁপা এতেই নওশাদ হেরার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ !
গাড়িতে উঠে হেরা জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাব আমরা ?
তোমার আজ একটা বিশেষ দিন তুমি ভার্সিটিতে ভর্তি হলে আমাকে খাওয়াবে না হেরা ?
এই কথা আগে বলবেন না আমি তো ফ্রী ছিলাম বিকেল থেকে আপনার পছন্দের সব রান্না করে রাখতাম!
বোকা মেয়ে আমরা রেস্টুরেন্টে খাব ! আমাকে রেস্টুরেন্টে ট্রিট দিবে তুমি।
আমার কাছে টাকা নেই বিল আপনাকেই দিতে হবে , হেরা হেসে বলল।
উহু হুঁ তুমি দিবে !
হেরা নওশাদের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, সত্যি আমার কাছে টাকা নেই।
নওশাদ হাসছে দেখা যাক কি হয় হেরা।
ওরা নওশাদের পছন্দের একটা রুফ টপ রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলো। হেরা উপর থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে চারপাশ টা । ছাদে রেস্টুরেন্ট বৃষ্টি হলে কি হবে ?
ভিজে ভিজে খাব !
মোটেও সেরকম কিছু হবে না !
একটা জিনিস খেয়াল করেছো আমরা ঢুকতেই অনেকেই তাকাচ্ছিলো ! সবাই তোমাকে দেখছে !
কেন ?
দেখতে এত সুন্দর মেয়েটা এই বুড়োর সঙ্গে এসেছে কেন তাই ভাবছে !
ছিঃ এসব কি বলছেন আপনি !
নওশাদ হাসছে ।
নিজেকে বুড়ো ভাবতে আপনার খুব ভালো লাগে তাই না?
আমি তো বুড়োই !
এসব কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। রেস্টুরেন্টটা খুব সুন্দর।
এটা নিশালের খুব পছন্দের রেস্টুরেন্ট ।
তাহলে ও আসলে আসব আমরা।
ঠিক আছে।
আজ কেমন লাগলো তোমার ভার্সিটি ?
ভালো ।
ক্লাস কবে থেকে ?
আগামী মাস থেকে ।
গুড ।
বিল দেয়ার সময় নওশাদ একটা কার্ড হেরার হাতে দিয়ে বলল, এটা দাও । এবং যত্ন করে রাখো নিজের কাছে এটা তোমার ।
হেরা নওশাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
অবাক হওয়ার কিছু নেই তুমি বাসার বাহিরে যাবে টাকা লাগবে না সে জন্য ।
সেই রাতের পর ঠিক তিন দিন পর হেরা তার জীবনের সবচেয়ে বড় চমকটা পেলো নওশাদের কাছ থেকে ।
নওশাদের ফ্যাশন আউটলেটের উদ্বোধন এর দিন হেরা নওশাদের সঙ্গে পাঁচ তারকা হোটেলে এসে যখন ঢুকছে ওর খুব ভয় ভয় লাগছে। সুমনা কে দেখে যদিও সে একটু ভরসা পেলো।
তোমার জন্য দারুন একটা খবর আছে হেরা, সুমনা বলল।
কি খবর ভাবি ?
আমি তো বলবো না অপেক্ষা করো ! হেরা তুমি কি জানো এখানে উপস্থিত অনেক মেয়ে তোমাকে হিংসা করছে ! তাদের মধ্যে অনেক মিডিয়ার সেলিব্রিটি , বিজনেস উইমেন এমনকি বিজনেস ম্যানের স্ত্রী আছে !
কেন ভাবি আমি কি করলাম?
কারণ তুমি নওশাদের স্ত্রী । এখানে অনেকের কাছেই নওশাদ অনেক আকাঙ্ক্ষিত পুরুষ। অনেকেই চাইতো নওশাদ একটা সন্ধ্যা তার সঙ্গে কাটাক। কেউ কেউ তো চাইতো নওশাদ একটা রাত তার সঙ্গে কাটাতো যদি ফিসফিস করে সুমনা বলল।
কি বলছেন ভাবী !
হুম তুমি কল্পনাও করতে পারবে না সুন্দর মুখের আড়ালে মানুষের চরিত্র টা কত কালো।
মানুষের চরিত্রের আন্দাজ হয়তো করতে পারবো না কিন্তু আপনার বন্ধু অন্য রকম মানুষ সেটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।
ঠিক বলেছো নওশাদ অন্য ভুবনের মানুষ।
অবশ্য পুরুষরা কেউ কেউ আরো বেশি হিংসা করছে নওশাদকে কারণ এত বছর একা থাকার পর তোমার মত কাউকে নওশাদ পেয়েছে।
কি যে বলেন ভাবি এখানে সব মেয়েরা কত স্মার্ট দেখতেও কত সুন্দর আমি ওদের মত এত যোগ্যতা সম্পন্ন নই।
সবাই ঘষে মেজে মেকআপ সুন্দরী তোমার মত ন্যাচারাল সুন্দরী না। দেখো তুমি হালকা মিষ্টি কালারের একটা জামদানী পড়েছে হালকা একটা গয়না পড়েছো এতেই তোমার দিক থেকে চোখ সরানো যাচ্ছে না ! আর যোগ্যতা র কথা যদি বলো এক এক মানুষের এক একদিকে যোগ্যতা তোমার গুনে তুমি অনন্য।
নওশাদ যখন হেরাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল সবার কাছে হেরার ভেতরে ভালোলাগা র অন্য এক অনুভূতি তৈরি হচ্ছিল এই ভালোলাগাকে কোন বিশেষনে ফেলতে পারবে না সে !
একটু পরেই মঞ্চে উঠে নওশাদ মিডিয়া , দেশের অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিদের সামনে ঘোষণা করলো তার আউটলেট ‘হেরা’ র নাম। দেশীয় তৈরি পোশাকের নতুন ব্র্যান্ড হিসেবে ‘ হেরা ‘ কে পরিচয় করিয়ে দিল সবার সামনে।
হল ভর্তি অতিথিরা যখন করতালি দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে
নাম শুনে হেরা তখন এত চমকে গেল সবসময় যা হয় চোখটা তাকে খুব যন্ত্রণা দেয় ওর চোখ ভিজে গেল সঙ্গে সঙ্গে । সে ঘুনাক্ষরেও কল্পনা করেনি এরকম কিছু একটা ঘটতে পারে তার জীবনে ! নওশাদের প্রতি ওর অনুভূতি টা সে প্রকাশ করতে পারে না কখনো কিন্তু তার এই মুহূর্তে খুব ইচ্ছে করছে মানুষ টাকে ছুঁয়ে দেখতে । এত উজাড় করে সন্মান সত্যি কেউ তাকে দিতে পারে ভাবনার সীমান্তে দূর দূর পর্যন্ত ছিল না কখনো তা। নওশাদ মঞ্চ থেকে দেখছে হেরা কে । হেরা চোখের পানি মোছায় ব্যস্ত তখন। কিছু পাওয়া অনেক প্রত্যাশা কে ছাড়িয়ে যায় । কিছু মানুষ এত ভালোবাসা নিয়ে আসে পৃথিবীতে ! হেরা মুগ্ধ হয়ে নওশাদকে দেখে তার মত নগন্য একটা মেয়ে কে কোথা থেকে নিয়ে এসে কোথায় জায়গা দিলেন উনি ! এত এত ভালোবাসা, সন্মানের যোগ্য সত্যি ই কি সে ছিল কখনো ! হেরা তাকিয়ে দেখছে শুধু নওশাদকে শত লোকের ভীড়ের মাঝে তার চোখ শুধু নওশাদের দিকেই যাচ্ছে । মনে মনে বলছে হেরা আপনি কি একটু আসবেন আমার কাছে, খুব ইচ্ছে করছে আপনাকে একটু ছুঁয়ে দেখি !
( চলবে )